অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ১০

১০

পাঁচিল-ঘেরা বাড়িটির উঠোনের কাছে এসে দেখি, লোকের ভিড়। বেশি নয়। অনেক নারী পুরুষ বসে বসে গল্প জুড়েছে। বোধ হয় বিশ্রাম নিচ্ছে। সামনে দেখি, মন্দিরে যার পট রয়েছে, দেখে মনে হলো গুরু নানক। পাশের সেবাইতও শুভ্র বেশধারী শিখ সম্ভবত। দেখলাম, চরণামৃত বিতরণ হচ্ছে।

উঠানের মাঝখানে, ছাদ থেকে নামার মতো একটি সিঁড়ি-মুখের দরজার ভেতর দিয়ে পিলপিল করে অদৃশ্য হচ্ছে মেয়েপুরুষের দল। সামনে গিয়ে উঁকি দিলাম। কিছু দেখবার উপায় নেই। মানুষের ঠেলায় যেন ওই অন্ধ সুড়ঙ্গ গলে গলে পড়ছে। সিঁড়ি-মুখের কাছটিতে ভিড়ও হয়েছে বেশ।

একটা ব্যাপারে অবাক হলাম। একটি অবাঙালি, রীতিমতো দশাসই চেহারার ভদ্রলোক সিঁড়ি-মুখের কাছে একবার এগুচ্ছেন আর পেছুচ্ছেন। তাঁর হাত ধরে, একেবারে বিপরীত রূপ কাঠিসার একটি মহিলাও আগেপাছে করছেন। এই সিঁড়ির মুখে ভিড়ের মধ্যে তাই নিয়ে সাড়া পড়ে গিয়েছে হাসির

জিজ্ঞেস করলাম একজনকে, ‘কী হয়েছে ভাই?’

শুনলাম, ওই বাবুজী এই সুড়ঙ্গে অবতরণে ভয় পাচ্ছেন। যদি দম আটকে মরে যান, কিম্বা মাটি ধসে চাপা-ই পড়েন।

ভালো। কী দরকার নামবার! কিন্তু ওই তো মুশকিল। শুনলাম ভদ্রলোক বলছেন, ‘ভগবান আমার উপর বিরূপ, আমার কী উপায় হবে?’ আর অতবড় মানুষটাকে ‘ডরপুক’ অর্থাৎ ভীতু বলে একচিলতে মহিলাটি মুখঝামটা দিচ্ছেন।

সাধ আছে, সাহস নেই। কিন্তু ভগবানের যা চরিত্র, তিনি যে নিচের অবতরণিকাকে আরোহণী করে নেবেন, তেমন সম্ভাবনা কম। সুড়ঙ্গের মুখটি যেরকম সরু ও অন্ধকার, সে যে হঠাৎ আলোয় মুখব্যাদান করে বিকৃত হয়ে উঠবে তাও বোধ হয় না। অতএব, ওই চলতে থাকুক।

নেমে গেলাম ভিড়ের মধ্যে মিশে। সিঁড়ির মধ্যপথে গিয়ে মনে হলো, ভালো করি নি নেমে। মাঘ মাসের এই দারুণ শীতে ঘাম ছুটল শরীরে। নিজে চলছি নে। আমি একজনের পিঠে লেপটে আছি। আমার পিঠে আর একজন। যেন দলা পাকানো মানুষের একটা পিণ্ড। নারী পুরুষের বাছ-বিচার নেই। পেছনের চাপ আর-একটু বাড়লেই শেষ। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যদি মরিও, তবুও মাটিতে পড়বো না। এমনি দাঁড়িয়ে মরে থাকবো।

চাপে পড়ে দ্রুত নিশ্বাসে কার গলার ঘড়ঘড় শব্দ উঠেছে। কে যেন ফোঁপাচ্ছে আঁতকে ওঠা চাপা গলায়। মনে হলো, ভালো করিনি। এ যে সত্যি-ই কূপ। পাতালপুরী। ফিরব, সে আশা দুরাশা। লৌহ-দরজা ভাঙা যায়, এই মানুষ-পিণ্ডের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। দেখছি উপরের লোকটির আতঙ্ক অলীক নয়।

হঠাৎ একটু ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলো গায়ে। কোত্থেকে এল? বাঁদিক থেকে একটি আলোর রেখা এসে পড়েছে ভিতরে। যেন দুর্ভেদ্য অন্ধকারে এসে পড়েছে সার্চ লাইটের আলো। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনে স্থির হয়ে। ডান দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কোনো এক অন্ধ পাতালপুরী থেকে মানুষ-জলের হোসপাইপ খুলে দিয়েছে কেউ। কিছু দেখতে পাচ্ছি নে। শুধু একটু বুঝছি, দূরে একটা আবর্তিত বন্যা ওদিক থেকে ছুটে এসে এগিয়ে চলেছে ওই সার্চ লাইটের দিকে। এই এক বন্যা। আমার পেছন থেকেও আসছে সিঁড়ি দিয়ে নামা জলপ্রপাতের ধারা-বন্যা। কোন্ দিকে যাই বন্যার মধ্যে! ছিন্ন বস্ত্র, ধূলি-মলিন কম্বল, ত্রিশূল, চিমটা, মতিবাঈ থেকে জর্জেট শাড়ির খসখস, স্বর্ণালঙ্কারের ঝিকিমিকি ঠিনিঠিনি, রঙিন উত্তরীয়, ধুতি ও কোট-প্যান্টের পরিপাটি, সবই ছিল। ছিল না শুধু স্বাভাবিক রূপ। তিক্ত ওষুধ গেলার মতো এক দুরূহ কাজে নেমে এসেছে সবাই। পেটে গেলেই নিরাময়। এখানকার কাজ শেষ করে একবার বেরুতে পারলেই স্বর্গের চাবিকাঠি আপনি এসে জুটবে পকেটে।

দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। যেদিকে হোক চলা ভালো। দাঁড়িয়ে থাকলেই পেষাই। এখানে কী আছে, তাই তো জানি নে। শুধু শুনছি হনুমানজী আছেন। ডান দিকের মোড় নিয়ে, জিজ্ঞেস করলাম একজনকে, ‘এখানে হনুমানজী আছেন?’

সে বললো, ‘জী বাবু!’কিন্তু কী আশ্চর্য, লোকটি ওর মধ্যেই আরম্ভ করলো, ‘হনুমানজীকে একবার এখানে লুকিয়ে থাকতে বলার আর দরকার ছিল না। কেন-না, রামায়ণের অনেক পরে নিশ্চয়ই সমুদ্রগুপ্তের কূপ তৈরি হয়েছিল। হনুমানের লুকিয়ে থাকার কোনো ইতিহাস তাতে থাকতে পারে না।’

কিন্তু ভয়াবহ ভিড়ের মধ্যেও লোকটার খৈনিটেপা মুখে রামায়ণের বিচিত্র বুলি ঝাড়বার বাসনা দেখে অবাক হতে হয়।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এগুচ্ছ না কেন?’

সে হেসে বললো, ‘মরতে?’ তারপর পকেট থেকে পয়সা বার করে ডান দিকে একটি জায়গা লক্ষ করে ছুঁড়ে দিল। দেখে বুঝলাম, ওইখানেই আছেন তিনি। ওইখানেই ঘূর্ণিজলের আবর্তের মতো নরনারীর রঙ-বেরঙ-এর মাথা পাক খেয়ে উঠছে।

এগিয়ে গেলাম। অস্বীকার করবো না, পুণ্যার্থী নরনারী আমার তুলনায় ধৈর্যশীল, কষ্টসহিষু। এগিয়ে গিয়ে অন্ধকার দেখলাম। মনে হলো, আমার ওভারকোটের বোতামগুলি পড়পড় করে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। অসহ্য চাপে, মনে হলো কোটটা খুলে পড়েছে, টেনে নিচ্ছে কেউ গা থেকে। ঠোঁটের কোণে চোখের জলের মতো নোনতা ঘামের নির্ঝর এসে পড়ছে।

তারপর টিমটিমে প্রদীপ, তৈলসিক্ত চত্বর, সিঁদুর, ক্ষয়িষ্ণু পাথরের মূর্তি, পাণ্ডা ও পয়সা, সমস্তটা মিলিয়ে মনে হলো, একটা বিচিত্র ছায়ার খেলা।

বেরিয়ে এলাম তন্মুহুর্তেই। কার একটা হাত এসে পড়লো গলায়। পড়ুক। লক্ষ এখন সার্চ লাইট। যেন, মুমূর্ষর জীবনে এখনো আছে জীবনের সাড়, ওই আলোকরেখা।

কার একটা হাত এসে পড়েছে কোমরের কাছে। ওভারকোটের বোতাম তবে খুলেই গিয়েছে। কিন্তু, কিন্তু একি? হাতটা যেন কাশফুলের মোলায়েম সুড়সুড়ির মতো পেটে বুকে হাতড়ে ফিরছে। তারপরেই আটকে পড়া বিছের মতো স্পর্শটি পিছলে নেমে এলো কোমরের নিচে। পরমুহূর্তে আবার বুকে। অন্ধ নাকি? ভিড়ের চাপাচাপি ও ঠাসাঠাসি। একরাশ রুক্ষ চুলের গোছা ঢেকে দিল আমার চোখের দৃষ্টি।

কিন্তু, বুকে হাত? আমার যে সব ওই বুকে। আমার ছুটে আসা, আমার হৃদি-কুম্ভ-সায়রে ডুব দেওয়া, আমার অমৃতকুম্ভ যে ছোট্ট একটি চামড়ার ব্যাগে ভরা। এখানে মনের চেয়ে কাজ দ্রুত।

কোনো বস্তু নয়, বুকের স্পর্শটি চেপে ধরলাম হাত দিয়ে। একটি হাত। নরম নয়, শক্ত কিন্তু ছোট। হ্যাঁচকা দিচ্ছে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। চকিতে চুলের গোছা সরে গেল চোখের কাছ থেকে। অস্ফুট আর্তস্বর। কালো ওভারকোটের তলায় একটি মুখ। একজোড়া চোখে চকিত আলোর মায়াদীপ্তি। সেই চোখে একই মুহূর্তে শঙ্কা ও ক্রোধ, হাসি ও ভিক্ষা মনে হলো, ছিন্ন ময়লা কাপড় জড়ানো ধুলো-মাখা একদল মেয়ে-বাহিনীর ব্যুহ আমাকে ঘিরে ঠেলে নিয়ে চলেছে। হাত ছাড়িনি। চেঁচাব কিনা ভাবছি।

দাবি ও অনুরোধের যুগপৎ চাপা আর্তস্বরে শুনলাম, ‘ছোড় দো, ছোড় না!’

স্বর আমার কানের কাছে। সেই ভয়ংকর টানাটানা চোখ আমার মুখের কাছে। চোখ নামিয়ে তাকালাম। পালতোলা নৌকা-আঁচল শাড়ি। লাল জামা। আর এই অসহ্য ভিড়ের মধ্যে ঠিক সেই মুহূর্তেই অনুভব করলাম, এক অব্যক্ত ভাষাহীন নরম ও বিচিত্র স্পর্শ আমার বুকে।

সর্বনাশী! খনপিসির সর্বনাশী, ঝুসির ভয়ংকরী, ব্রজবালার আতঙ্ক ছেলেচোর। নিরালা মাঠের সেয়ানা পাখি।

ছেলেচোর কোথায়! ও যে আসল প্রাণচোর। সর্বস্ব-চোর। আমার হৃৎপিণ্ডের খোঁজ করছিল মৃত্যুর মতো সর্বনাশী স্পর্শে।

চকিতে কটাক্ষ বিলোল হলো। ঘন হলো স্পর্শ। এই ভয়ংকর পরিবেশে এক বিচিত্ৰ জড়ানো ও সানুনাসিক কণ্ঠ আমার সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে দিল, ‘ছোড় দো মেরী বাবু, ছোড় জী।’

যে মুহূর্তে টের পেয়েছি, সে মেয়ে, সেই মুহূর্তেই শিথিল হয়েছে হাতের মুঠো। আমি ভদ্রলোক, আমার আত্মাভিমান আছে। ভদ্রলোক এবং পুরুষ, মনের কানায় কানায় আমার আছে সভ্যতার সংস্কার। আমার অর্থের প্রতি যার লোভ, তার প্রতি আছে ঘৃণা ও ক্রোধ। তবু মাঝারি ঘরের বাঙলার ছেলে, স্পর্শকাতরতা আমাদের পায়ের তলা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত। বয়সের তারুণ্য ও উদারতা বাস্তব মানে না নিয়ত। সেখানে বিচিত্র রঙে রঙমহল। তা ছাড়া নারী। নারী নামে ধিক্কার দিচ্ছি নে। নিজের মনকে ফাঁকি দেব কোথায়! হাত আপনি শিথিল হলো। আমার ঘর্মাক্ত মুঠো। সর্বনাশী ছিটকে গেল মুহূর্তে। আমি আশ্রমের দিকে এগিয়ে গেলাম।

আশ্রমে আলোর ছড়াছড়ি খুব। মঞ্জুটিও রীতিমতো সুসজ্জিত। আঙিনায় চোট ছোট গাছের সারি দিয়ে আঁকা হয়েছে ভারতবর্ষ।

ঢুকতে গিয়ে বাধা। জুতো রেখে যেতে হবে। কার কাছে? সে ভাবনা নেই। তার জন্য লোক আছে। জুতো দিন, নম্বরমারা কার্ড নিয়ে যান। কার্ডটি ফিরিয়ে দিলেই জুতো। সেই ভালো।

মঞ্চে গান হচ্ছে। সুরটি ভজনের অনুরূপ। যারা গান করছেন তারাও রীতিমতো সুবেশ তরুণ। কিন্তু ভাষা দুর্বোধ্য। শ্রোতার চেয়ে বেশি শ্রোত্রী। যদি পাপ না হয় তবে বলি, এখানে রূপের বড় ছড়াছড়ি। রূপে ও পোশাকে দশ দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আশ্রম-প্রাঙ্গণের। তার উপরে তীব্র আলোয় রূপের বাড়াবাড়িও হয়েছে। আশ্রমের সুদীর্ঘ ঘেরাওয়ের মধ্যে বহু ঘর। কল্পবাসীদের নিঃসন্দেহে। কিন্তু কল্পবাসিনীরা যেন বড় বেশি চুমকি বাহার ও হীরে-জহরতের আলোয় পথ দেখে চলেছেন।

মুখে ছিল সিগারেট। একটা বিরক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠ ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো কানের কাছে, ‘বাঙালিবাবু?’

কণ্ঠস্বরে কিছু টান ও বিসর্গযুক্ত ইতি। পাঞ্জাবীদের মতো খানিকটা। ফিরে দেখি, মস্ত বড় পুরুষ, গৌরমূর্তি, গৈরিক বেশ। মাথায় চুলের রাশি, নাকে কাপড়। সারা মুখে অত্যন্ত বিরক্তি।

ফিরতে বললো, ‘ফেক দিজিয়ে সিগারেট। মহারাজলোগ্ হরবখত যানা আনা করছেন, তাঁদের নাকে বাস লাগলে আপনার নরকবাস হবে।’

চমকে প্রথমে সিগারেট নেভালাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন, শিখদের আশ্রম?’

সিগারেট নেভাতে দেখে সে একটু বোধ হয় খুশি হল। বললো, ‘না। তবু এ আশ্রমের মহারাজ ওটা পছন্দ করেন না। তাছাড়া শিখভক্ত এখানে সব সময় আসে। আপনারা হরটাইম সিগারেট পিনেসে কৈসে চলেগা! আপলোগ কিসীকো ধরম নেহি মান্তা।’

আপলোগ মানে কৌন লোগ? বাঙালি কি? তেমনই যেন খোঁচাটি। কার ধর্মে সে বাধা দিয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম, ‘উও ক্যায়সে, মহারাজ?’

প্রশ্ন শুনে একটু বিব্রত হলো সে। হঠাৎ সে বললো, ‘ওইসা শুনতা হ্যায় বাবুজী। কোলকত্তা কভি নহি দেখা। মগর, উনলোগ বড়ি জাদা সিগ্রেট পিতেঁ হ্যায়।’

প্রতিবাদ নিরর্থক। পালটা অভিযোগ অনেক তোলা যায়। তুলব কার কাছে? যাক। দেখে যাই। সাধু নিজে ধূমবিরোধী। তাই বিরক্ত। কথার দরকার ছিল না, বললেই নিভিয়ে তার মনস্তুষ্টি করতে পারতাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কোন্ আশ্রম, মহারাজ?’

বললো, ‘সাধুবেলা আশ্রম।’ বলে, নিজেই চমৎকৃত হয়ে ফিরে আবার বললো, ‘হিন্দুকো সবসে বড়িয়া আশ্রম বাবুজী। পাকিস্তানের এলাকায় পড়ে এখন বেনারসে আশ্রয় নিয়েছে। লাখ লাখ টাকা আশ্রমের সম্পত্তি। শ’ শ’ আদমি আগে খেত সাধুবেলা আশ্রমে।

লাখ টাকার ঔজ্জ্বল্য আছে সন্দেহ নেই। নেই মিষ্টি ও উদার হাসির স্নিগ্ধতা। জুতো নিয়ে বেরুতে গিয়ে গেটের কাছে চোখ পড়লো, রিডিংরুম। মনটা প্রফুল্ল হলো। টেবিলের উপর অনেক পত্র-পত্রিকা। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক। রাজনীতি, সিনেমা ও সাহিত্য সবই আছে। ইংরেজি, হিন্দি উর্দু, তামিল, মারাঠী, ওড়িয়া সবই আছে। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও পেলাম না বাংলা কাগজের একটি টুকরো। কেন, বুঝলাম না। যাকে নইলে চলবে না, শুধু সে-ই নেই?

বেরুবার মুখে একজন বাড়িয়ে দিল খাতা ও কলম। দর্শকের স্বাক্ষর। আপত্তি কী? অনেক প্রদেশের বিচিত্র অক্ষরমালার মধ্যে বাঙলায় লিখে দিলাম নিজের নামটি। নিচে লিখলাম, বাঙলাদেশ।

এ আমার প্রতিবাদ নয়। নয় মনের বিরূপতা। অনেকের মাঝে এ শোভার আধার বাঙলা ভাষা, এ লেখনে শুধু সেই তুষ্টি। রূপের মাঝে অপরূপকে দিলাম বসিয়ে।

বেরিয়ে এসে সোজা পাড়ি পশ্চিমোত্তর কোণে, যেখানে আলোর সারি ও লোকের ভিড়। কিছুটা আসতেই এক বিরাট বাহিনী। নেতৃত্ব করছে পাঁচুগোপাল। পাঁচ-বদ্যি। চোখ বটে তার! দেখেই হুঙ্কার দিল, ‘আই য্যা! চাঁদ, কোথায় ছিলে সারাদিন, অ্যাঁ?’

শোনো এবার বাঙলা কথা। হকচকিয়ে বললাম, ‘কোথায় চললেন?’ সে কথার জবাব না দিয়ে সে বললো, ‘খুড়ি, এই যে তোমার ছিরিমান। হাঁকপাক করছিলে, কোথায় গেল। এবার জিজ্ঞেস করো।’

তাই তো। তাকিয়ে দেখি, আশ্রমের সমস্ত বাঙালি সবলা ও অবলা যে আজ বেরিয়ে পড়েছে আশ্রম খালি করে! কম করে জনা পনেরো তো বটেই। তার মধ্যে কী অপরূপ! পাঁচ-বদ্যির গা ঘেঁষেই খনপিসি। শুনেছিলাম, দুই শক্তি একত্রিত হলে বিস্ফোরণ অনিবার্য। কি চাপা জ্যোৎস্নালোকে দেখলাম, শাল-জড়ানো শীতে কাঁপা খনপিসির মুখখানি বেশ প্রশান্ত। খালি বললো, ‘সেই ছেলেটা না?’

আর একজন বললো, ‘হ্যাঁ।’

দিদিমা বললো, ‘খেয়েছ কিছু সারাদিনে?’

মিথ্যে বলতে হলো। বললাম, ‘হ্যাঁ, খেয়েছি।’

পাঁচুগোপাল বললো, ‘তবে খাওয়া মুখখানি অমন শুকু-শুকু দেখাচ্ছে কেন?’

বললাম, ‘অনেক ঘুরেছি কিনা।’

প্রায় ভেংচে উঠলো পাঁচুগোপাল, ‘থাক, আর পাক দিতে হবে না। পড়েছ বোধ হয় কোনো মায়াবীর পাল্লায়? খবোদ্দার, মরবে। চাঁদপানা মুখ দেখবে আর জানটি নেবে, এর নাম কুম্ভমেলা, বোয়েচ? হ্যাঁ।’

না বুঝে উপায়? তার কথার প্রতিবাদ করছি নে আর।

খনপিসি বললো, ‘নেও, চল বাপু। গায়ের মধ্যে কাঁপুনি দিচ্ছে। কাল আবার পুন্নিমে! আজই এত শীত, কাল না জানি কী হবে!

পাঁচুগোপাল বললো, ‘চল চল।’

হুকুমটা আমাকেই করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় ঘুরলেন?

চাপা গলায় বললো, ‘নরকে। ঘোরার কি শালা মাথামুণ্ডু আছে?’ গলা ছেড়ে বললো, ‘রামকৃষ্ণ আশ্রম গেলুম, আনন্দময়ী দর্শন করলুম।’

চলতে চলতেই কানে এলো, দিদিমা বলছে, ‘খায়নি তার আমি কী করব, ঘরে-বাইরে কি আমি এই করতেই আছি যে একজনকে না একজনকে চিরকাল ডেকে ডেকে খাওয়াতে হবে? তুই ধরে বেঁধে খাওয়ালেই পারতিস?’

পাশ ফিরতেই চোখে পড়লো ব্রজবালার মুখ। জ্যোৎস্নালোকে দেখলাম। তার অভিমানক্ষুব্ধ দৃষ্টি। চোখে চোখ পড়তেই ঘোমটা টেনে আড়াল করলো মুখ।

কিশোরী হলেও হৃদয় যে তার রাঙা। মনে মনে বলি, সই বৌঠান আমার বোন! দিন যাচ্ছে, শেষ হয়ে আসছে দেখাদেখির পালা। ঘর থেকে এসেছে দূরে। তবু ঘরের হৃদয়, মন আর চোখ ফিরছে সঙ্গে সঙ্গে, পথে পথে। কে এক পথের মানুষ আত্মীয়তা পাতায়। তাকে ঘিরে রাগ হাসি। তার না-খাওয়ার জন্য অভিমান। নিষ্ঠুর ও তিক্ত জীবনে বুঝি এই লোকগুলিই জীইয়ে রেখেছে আমাদের মানবিকতা!

সারা রাত ঘুম হলো না। শীত তো ছিলই। তার উপরে সারা রাত ধরে লোকের চলাফেরা কথাবার্তার বিরাম নেই। কাল পূর্ণিমার স্নান আছে সঙ্গমে। স্নানার্থীদের আগমন হচ্ছে। কিন্তু সে কি সারা রাত ধরে? শুধু তাই নয়। জানি নে কিসের এত গান। তাঁবু-কোটরের শীতেই আমরা আধখানা। আর বাইরে স্নানার্থীদের শীত-কাঁপা মিলিত গলায় গানের শেষ নেই। বুঝতে পারছি, সব দলে দলে আসছে। শুনেছি, সঙ্গমে ভিড় হবে সাংঘাতিক। তাই রাত থাকতেই সবাই ভিড় করেছে এসে আশেপাশে। স্নানের সময় বাঁধা আছে পাঁজি পুঁথিতে। ঠিক সময়টিতে ডুব দিতে না পারলেই ফসকা গেরো। বুঝতে পারছি, দিদিমারও ঘুম নেই চোখে। মাঝে মাঝে তন্দ্রা আবার ভেঙে যাচ্ছে। ঠাকুরের নাম নিয়ে জেগে থাকার প্রয়াস শোনা যাচ্ছে ভাঙা গলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *