অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ১৪

১৪

যেতে হলো। বুঝলাম, না গেলে বলরামের পরাজয়! জানি নে আবার সে কী বাধিয়ে রেখেছে কোথায়। সে কেল্লার পথের প্রাচীরের কোলের দিকে এগিয়ে চললো। সারি সারি তাঁবু, জ্যোৎস্নায় দেখলাম নানান রকম নিশান উড়ছে তাঁবুগুলির মাথায়। এদিকটা দোকানপাট কম, সেইজন্য ভিড়ও কম।

একটি গাছতলার তাঁবুর কাছে এসে থামল বলরাম। তাঁবুর সামনে, খানিকটা জায়গা জুড়ে মাথায় সামিয়ানার মতো ঢাকনা দেওয়া। একটি হ্যারিকেন জ্বলছে। সেই আলোয় দেখলাম একটি জ্বলন্ত উনুনে রয়েছে তাওয়া। একজন রুটি করছে, বেলে দিচ্ছে আর-একজন।

আমাকে আর বলরামকে দেখে তারা দু’জনেই ফিরে তাকাল। তাকাতেই চমকে উঠলাম। চমকে ওঠবার মুহূর্তেই একটি চাপা খিলখিল হাসি হঠাৎ বেজে উঠে কুহক বিস্তার করলো। তাওয়াটা ঠক করে নেমে এলো উনুন থেকে। আগুনের আঁচে দেখলাম, হাসিতপ্ত লাল মুখ শ্যামার। ছি-ছি-ছি, এ কোথায় নিয়ে এলো বলরাম! বলতে যাচ্ছিলাম তাকে সেই কথা। তার আগেই বলরাম হাত কপালে ঠেকিয়ে শ্যামাকে দেখিয়ে বললো, ‘রোজ রোজ বলেন, লুলাসাধু তোমার সেই বাবু কোথায়? একদিন ডেইকে নিয়া আস। আজ ধইরে নিয়া আইসলাম।’

মনে করলাম, তাড়াতাড়ি পেছন ফিরি। জীবনে এত বড় লজ্জার সামনে আর কোনোদিন পড়ি নি। কে জানতো, বলরাম আমাকে এইখানে ধরে নিয়ে আসবে! লজ্জার সঙ্গে রাগ হলো। বলরামদের হৃদয়াবেগ লোকলজ্জার ধার ধারে না। সংশয়, সন্দেহ ও রুষ্ট চোখের বাধা মানে না। কিন্তু আমাকেও কি সে তাই ভাবল?

নোকরানী পাতিয়া বেলে দিচ্ছে রুটি, বানাচ্ছে শ্যামা ছোট্ট একটি চারপায়ার উপর বসে, তার চটুল চোখে বিস্ময় ও হঠাৎ-হাসির ঝলকানি। সে উঠে দাঁড়িয়ে আবার হেসে উঠলো। সে হাসি শুনেছিলাম পথে পথে, এক বন্দী বিহঙ্গের পাখা ঝাপটা-খাওয়া শব্দ শুনেছিলাম তখন লৌহপিঞ্জরে। আর এখন, দুর্গকোলে, এই যমুনাতীরের জ্যোৎস্নাভরা হাল্কা কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্রি। এ-রাত্রি যেন বদ্ধজলার নিস্তরঙ্গ জল। তাতে রুদ্ধশ্বাস। ব্যথা ও যন্ত্রণা এক নতুন হাসির কুহকজাল ঘিরে আনন্দময়ের রূপে ফুটে উঠতে চাইছে।

আরো শুনলাম। শুনলাম, বুঝি এক তীব্র বিদ্রুপের ধ্বনি অনুরণিত হচ্ছে ওই হাসিতে। যেন আমাকে বিঁধিয়ে বলছে, এসেছ তো? এসেছ!

মনে পড়লো, নিজের অভিশপ্ত জীবন ও হৃদয়ের তিক্ততায় সেদিন শ্যামা হঠাৎ বিচিত্র রূপ ধরে আমার মাথা হেঁটে করে দিতে চেয়েছিল, আমি তখন হেসেছিলাম! আজ এই হাসির সামনে যদি না হাসতে পারি, তবে এই ভীরু দুর্বল চিত্ত নিয়ে লজ্জায় মরে যাব।

ফিরে তাকালাম শ্যামার দিকে। সাজা-গোজার অন্ত নেই। সিল্ক শাড়ি পরে বসেছে রুটি সেঁকতে। উলেন স্কার্ফ এলিয়ে পড়েছে কাঁধের থেকে মাটিতে। তাকিয়ে দেখলাম, বাঁকা চোখে তীব্র অনুসন্ধিৎসা। ঠোঁটের কোণের হাসিটুকু কেন যেন নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারেনি, বরং হঠাৎ লজ্জায় তার খরহাসির তীব্রতাকে একটু করুণ করে তুলেছে। কাঁচা সোনার অলংকার ঝিক্‌মিক্ করছে তার হাতে গলায়। তার অপলক চোখের দৃষ্টিটা এমন করে বিঁধে রইলো আমার সারা মুখ জুড়ে যে, মুখ ফেরাতেও পারি নে।

শ্যামা তাড়াতাড়ি নিজের ছোট্ট চারপায়াটি এগিয়ে দিল বললো, ‘বস।’

পাতিয়া যেভাবে রামনাম নিল, তাকে বাঙলা করলে বোধ হয় হবে ‘মরণ’! বলরাম ও হাসল, ‘বসেন ঠাকুর।’

বলরামের গলায় ব্যাকুলতা। ফিরে তাকিয়ে দেখি, তার মুখে পাগলা হাসির বান ডেকেছে। কিন্তু বসব? সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারছি নে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর সব কোথায়?’

শ্যামার হৃদয় বাঁকা! কথার আগেই ঘাড় বেঁকে যায়। যেন তাগ কষছে! বললো, ‘আর কারা?’

বললাম, ‘তোমার সতীন, স্বামী, তারা সব কোথায়?’

ভ্রূ তুলে বললো শ্যামা, ‘না থাকলে বুঝি বসা যায় না?’

এবার কথার সুরও বাঁকা হয়ে উঠলো শ্যামার। চট করে কোনো জবাব যোগাল না মুখে। তার মুখের দিকে চেয়ে চমকে আড়ষ্ট হয়ে উঠলো মন। হাসিটি কেন যাই-যাই করে তার মুখ থেকে? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরটি পর্যন্ত দেখে নিতে চাইছে।

বললাম, ‘না, বসা যাবে না কেন? এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।’

শ্যামা বললো, ‘তবে নারাজ কেন?’

নারাজ নই। নারাজ আমার মনের সামাজিকতা, ভব্যতা, লোকলজ্জা। কিন্তু বুঝলাম, ওই বোধগুলি আপাতত বিবেকের আড়াল করে বসতে হবে। মনে করেছিলাম, পথে বেরিয়েছি, লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়। ওসব বালাই রাখব না মনে। কিন্তু যে আছে আমার রক্তধারায়, তাকে ছাড়ব বললে ছাড়ানো যায় না। তবু ভাবলাম, শ্যামার কথায় বসতে গিয়ে যদি কোনো বেদনাদায়ক অপমান নিয়ে ফিরতে হয়, আমার চলার পথের ধূলায় তো ফেলে রেখে যাব। যদি না পারি, তবু জানি, জীবন-মনের পলিতে একদিন তা ঢাকা পড়ে যাবে।

বসলাম। তবু বিস্ময়ের সঙ্গে একটা অজানা বিচিত্র অনভূতি ঘিরে রইলো মনে। অজানা, কেননা, শ্যামার হৃদয়ের গতি অজানা। সে খিলখিল করে হাসলে, ঠাট্টা করলে, তাকে বুঝতে পারি। কিন্তু ডেকে বসতে বলে যদি এমনি করে মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে, যদি তার মনের গোপন লীলা খেলা করতে থাকে মুখের ছায়ায়, তবে থাকি কেমন করে!

পাতিয়া দেহাতি ভাষায়, চাপা স্বরে বিদ্রুপ করে বলে উঠলো, ‘তাহলে রাতে আর রুটি বানানো হবে না তো? আজ এই পর্যন্তই?’

শ্যামা অমনি তার চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে দিল। টানাটা একটু বেশিই হয়েছে। টাল সামলে পাতিয়া বললো, ‘উঃ বাবাগো! নিজের চুল ধরে টানো। আমার কেন?’

বলে, চকিতে একবার আমাকে দেখে, বলরামের দিকে চেয়ে হাসলো। বুঝলাম, শুধু নোকরানী নয়, পাতিয়া নোকরানীর অন্তরালে খুনসুটি করার সইও বটে। কিন্তু পাতিয়ার খোঁচানিতে কাজ হলো। আবার উনুনের ধারে বসলো শ্যামা।

আর বাধা মানল না বলরামের গলা। সে আপন মনে চাপা স্বরে গুনগুন করে উঠল—

‘কত কথা ছিল মনে।
আজ মনে বাহির হইল না,
সখী, একি দায়, সময় যায়,
বুক ফাটিয়ে মুখ খুইল্ল না।।’

ওরা না বুঝুক বলরামের গানের কথা। নিজে তো বুঝি। বুঝে লজ্জায় ও ত্রাসে চমকে উঠলাম। অবস্থাটা কাটাবার কারণে তাড়াতাড়ি কথা বলবার জন্য মুখ তুললাম। শ্যামাও মুখ তুলল। বোধ হয় কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, থেমে রইলো।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শ্যামা বললো, ‘কী বলছিলে?’

বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কী কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তা নিজেই জানি না। বললাম, ‘কিছু নয়। তুমি কী বলছিলে?’

শ্যামা বললো, ‘বলছিলাম, কোথায় আছ? কোন্ আশ্রমে?’

জবাব দিলাম।

পাতিয়া বিদ্রুপভরে বললো শ্যামাকে, ‘মেহেরবানি করে একটু সরে বস, এবার আমি বানাচ্ছি রুটি।

শ্যামা সে-বিদ্রুপ গায়ে মাখল না। সরে বসলা সত্যি সত্যি। তারপর কেমন আছি, কোথায় ঘুরলাম, কোথায় খাই, সব জিজ্ঞেস করলো। জিজ্ঞেস করলো, জবাব নিল, আর টেরে টেরে চেয়ে হাসলো নিঃশব্দে। বললো, ‘তোমার লুলাসাধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার সঙ্গে দেখা হয় কিনা। এমন আজীব আদমি তুমি?’

এটা বোধ হয় তার ডাকাডাকির কৈফিয়ত। কিন্তু আজীব কেন? বললাম, ‘কেন?’

সে বললো, ‘কী জানি! রেলগাড়িতে সেদিন তোমাকে খুব তখলিফ দিয়েছিলাম, না?’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেইজন্যই ডেকেছ বুঝি?’

সে বললো, ‘হট।’

এমন করে তাকিয়ে ছিল পাতিয়া আর বলরাম, এমন নীরবে শুনছিল, যে আর বসে থাকতে পারলাম না। একেবারে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘উঠি।’

শ্যামা বললো, ‘কাল আসবে তো?’

কেন, জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। পারলাম না। কিন্তু আসা-আসির কথা আদায়ের বাঁধাবাঁধি কেন!

বললাম, ‘যদি পারি।’

বলে, মাথার ছাউনির বাইরে এলাম। বলরাম এলো। গলায় তার গুনগুনানি থামেনি। হ্যারিকেনের আলো কোথায় হারিয়ে গেল। মাঘ মাসে পৌষ-পূর্ণিমার জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়লো গায়ে।

শ্যামার চাপা আহ্বান শোনা গেল, ‘শোনো।’

ফিরে তাকালাম। চাপা বর্ণের খয়েরি সিল্ক শাড়িতে নীল জ্যোৎস্নার ঝরনা গড়িয়ে পড়ল। আর ঝিকমিকিয়ে উঠলো রুপোলি উলেন স্কার্ফ। কাছে এসে বললো, ‘সেদিন রাগ করেছিলে?’

সেদিন মানে একদিনই। বিদায়ের মুহূর্তে চকিতে বদলে যাওয়া মুখে তার সেই তিক্তকথা। না জেনে সেদিন তার বড় তিক্ত বেদনার বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে দিয়েছিলাম। রাগ করবো কেন! দোষ তো আমারই।

বললাম, ‘না, রাগ করি নি তো!’

‘সত্যি? সচ বলছ?’ সংশয়াকুল হাসি তার মুখে।

সংশয় কেন? কেন রাগ করিনি, অত সব কথা বলতে পারবো না বুঝিয়ে। রাগ যে করিনি, করতে পারিনি, সে কথা তো জানি নিজের মনে।

বললাম, ‘মিছে বলবো কেন? সত্যি বলছি।’

এবার হাসির সঙ্গে চোখে তার কৃতজ্ঞতা দেখা দিল। বললো, ‘কাল এসো কিন্তু। এই সময়?’

চোখাচোখি হলো আবার। হাসির সঙ্গে এই বিষন্ন জ্যোৎস্নার মতে। একটা আবেশের লক্ষণ ফুটে উঠেছে তার চোখে। কপালের টিপটি কাঁপছে তার তৃতীয় নয়নের মতো। অনুরোধে মিনতির সুর!

জবাব না দিয়ে চলে এলাম। ভুলি নি, সঙ্গে রয়েছে বলরাম। তবু কথা এলো না। মন চমকাল বারে বারে। মানুষের মন। সে যেন পথের ধারে দোলানো আয়না। লক্ষ চমক তার বুকে।

শ্যামা স্বৈরিণী নয়। এক কুলীন ভূঁইহার ঘরের অশীতিপর বৃদ্ধের যুবতী বউ! হৃদয়ে তার বহু বজ্রের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ রয়েছে চাপা। উৎসবের রাত্রে তা খোলা আকাশের বুকে বহু রঙের সব আলোর ঝাড়ে হাউইয়ের মতো জ্বলে উঠতে চায়। চোখ ও মন ভরে দিতে চায়। উৎসবের বাসর রচনা করতে চায় সর্বত্র, জীবনের বিড়ম্বনার অন্ধকারে। তাই এ সমাজের সব পরিবেশেই সে ভিন্ন ও বিচিত্র।

কিন্তু আমার পথে নেমে আসে যদি অন্ধকার! ভেজা পথে যদি বারে বারে আটকায় পা?

বলরাম বললো, ‘ঠাকুর, আমার উপর রাগ কইরেছেন?’

বললাম, ‘না।’

‘তবে বলি এট্টা কথা?’

‘বল।’

‘বইলব, তার আগে এট্টুস গরম চা পেইলে হইত।’

নাঃ, বলরামই দেখছি ঠিক আছে। মুখ ফেরাতেই দেখলাম চাঁদের আলোয়, এক গাল হাসি তার মুখে। ভিড় এখনো খুব। গাড়ি ঘোড়া ও মানুষের অবিরাম যাওয়া-আসা। জ্যোৎস্না পেয়ে সবাই যেন নতুন করে মেতে উঠেছে।

দোকানের কোনো অভাব নেই। চা নিয়ে বলরাম বললো, ‘ঠাকুর, গুরু ধইরেছেন?’

এ আবার কী কথা! বললাম, ‘গুরু? কেন হে?’

বলরাম বললো, ‘গুরু না হইলে কি চলে? জন্ম থেকে মরণ পর্যন্ত, গুরু আসে যায়, সকলে তো চিনা দেয় না।’ বলে গুনগুন করে উঠল—

‘গুরু বইলে ক্যারে পরনাম করিব মন।
তোর ভিতরে গুরু, বাইরে গুরু,
গুরু অগণন।’

গেয়ে বললো- ‘তার মধ্যে এক গুরু,
সখী গো! এবার গুরু বলে রাখি মাথা
তোমার চরণে,
পেমরীতি বুঝাইলে তুমি অবোধ
জীবনে।’

বললো, ‘বুইঝেছেন? এই গুরু ঠিক না থাকলে, সব বেঠিক।’ বলে হেসে উঠলো।

একটু বুঝি অন্যমনস্ক রইলাম। পরে বললাম, ‘তুমি গুরু করেছ তো, বলরাম?’

বললো, ‘কইরেছি। কিন্তু ঠাকুর, গুরুর সেবা কইরে আমার মনটা ভরে না।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তোমার সেই গুরু?’

বলরাম বললো, ‘যে নিজে কেন্দে আমাকে কান্দায়।’ বলে সে হঠাৎ চোখ মুছলো। চোখে তার জল! বললো, ‘ঠাকুর, কাইলকে আইসবেন কিন্তুন্। নক্কীদাসী আপনার জন্যে বইসে থাকবে।’

চলে এলাম। শেষ, বলরামের চোখের জলে আজ আমার ডুব দেওয়া সাঙ্গ হলো। জলের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। অনেক, অনেক মুখ মনে পড়ছে। এক লক্ষ মানুষের মুখের মিছিল, আজ তারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। কত গুরু। পথে প্রান্তরে, কুটিরে বস্তিতে, ইমারতে ঘরে—অগণিত গুরুকে আমার নমস্কার জানাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *