১৬
শুনলাম, আগুন লেগেছে প্যারেড গ্রাউণ্ডে। যে আগুন এখন মানুষের প্রাণ, সেই আগুন রুদ্রমূর্তিতে দিয়েছে দেখা। ভয় হলো। প্যারেড গ্রাউণ্ডে বলরাম থাকে। এর পরে একদিনও যাই নি। আগুন লাগার কথা শুনে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, না, বলরামের তাঁবু অক্ষত আছে।
বলরাম বললো, ‘জাইনতাম, ঠাকুর আমার না এইসে পাইরবেন না। ঠাকুর কি আর এমনি কইছি! ওইখানে থেকে উনি পিতিদিন এইসে এইসে জিজ্ঞাসা কইরেছেন, কই লুলাসাধুজী, তোমার বাবুজী তো আইসলেন না? মনে মনে কইছি, রয়েন গো ঠাকরুণ, সময় হইলে আপনি আইসবেন।’
বুঝলাম, শ্যামার কথা বলছে। অভদ্রতার চেয়েও বড় কথা, শ্যামার নিস্পাপ হৃদয়লীলা দু’দিনের জন্য সুর তুলতে চেয়েছিল। তার সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারিনি, আমার সমাজবোধের জন্য।
বলরাম বললো, ‘আপনি রোজই শহরে চইলে যান শুইনলাম, কাইল গেছিলাম আমরা আপনার আশ্রমে। গিয়া শুনলাম, আপনি নাই। কেউ কিছু কয় নাই আপনারে?’
অবাক হলাম। তাই তো, কাল ব্রজবালা কী যেন বলছিল। প্রহ্লাদ এ ভয়ংকর ঠাণ্ডায় শয্যা নিয়েছে। ব্রজবালার মন খারাপ। তবু একবার যেন বলেছিল, ‘তোমাকে ডাকতে এসেছিল কারা।’ ভেবেছিলাম, শহরের কেউ হবে। যেভাবে শহরে পরিচয়ের বাড়াবাড়ি ঘটে, কারুর আসা বিচিত্র নয়।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি গেছলে?’
বলরাম বললো, ‘একলা নয়, ওনারা চাইরজন আছিলেন। ওনার সতীন, সতীনের বুইন আর ঝি। আমারে কইলেন, লুলাসাধুজী, আমার সতীন না গেলে তোমার বাবুজী আইসবেন না। চলো ঘুইরে আসি। আপনারে পালাম না। ওনারা অনেক জিনিসপত্র কিনলেন, তারপর আইসে পড়লেন।’
স্তব্ধ হয়ে রইলাম। বলরাম বললো, ‘যাইবেন একবার?’ বলরামেরও হাসিমুখে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা।
বললাম, ‘বলরাম, যাওয়া যায় না।’
ফিরে আসবার পথে লক্ষ্মীদাসী ছুটে এলো। বললো, ‘ঠাকুর, আপনে এট্টু বারণ কইরে যান তারে, যেন এমনি করে বাইরে না বইসে থাকে। আবার মেলায় মানুষ বাড়তেছে। কাইলকে কার পায়ের তলায় পইড়ে মাথায় চোট খাইছে। আপনে এট্টু কন, আপনার কথা শুইনবে। কিছু কইলে খালি এক. কথা, নক্বীদাসী! মন যে মানে না গো! তবে আখড়া, ভোগ পূজা রেইখে তুমি আমার সঙ্গে চল। যদি কই, কোথায়? কয়, যেইখানে মন টানে, মন যায়।’
কেঁদে ভাসাল লক্ষ্মীদাসী। বলরাম বললো, ‘নক্কীদাসী, তোমার কাছেই তো পাঠ নিছি—
‘আর বইসে থাকার সময় নাই গো,
বেন্দাবনে বাজছে বাঁশি আমার নাম ধইরে।
তবু বললাম, ‘কিন্তু সাবধান থেকো বলরাম। এভাবে জীবন সংশয় কোর না।’