অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ১১

১১

শেষ রাত্রের দিকে বুজে আসছিল চোখ। পাঁচুগোপালের চেঁচামেচিতে তা-ও হলো না। তার ‘ওঠো গো ওঠ গো’ ডাকে চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। তাঁবুতে তাঁবুতে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির হিড়িক। তার মধ্যে শীতের কামড়ের হি-হি-হু-হু। আর দিকে দিকে ব্যস্ত উৎকণ্ঠিত গলা।

‘ও নন্দ, নন্দ। আমাকে ফেলে যাসনি যেন।..’

‘ও মাসি, তোমার গমছা কোথা গেল?..’

‘ও মা, কাল যে অত করে বেলপাতা কটা পুঁটলিতে রেখেছিলুম, সেগুলো তো দেখছিনে।…’

‘ননীবালা, আতপচালগুলান নিতে ভুলিস নে লো।..

‘বড় বউমা, ও বড় বউমা, তুমি যে আর শীতে বাঁচচো না বাছা। সধবা মানুষ, প‍ই পই করে রাত থাকতে বলে রেখেছি, সিঁদুরটুকু আঁচলে বেঁধে নিয়ে শোও, সঙ্গমে নাইবার সময় দিতে হবে। তা আর…’

এমনি সব নানা কণ্ঠে সাড়া পড়ে গিয়েছে। এটা নাও, ওটা নাও। বুড়িরা কাঁদছে শঙ্কায় ও উৎকণ্ঠায়। আমাকে নাও, হাত ধর! বুড়োরা গোঙাচ্ছে, হে ভগবান, শক্তি দাও, শক্তি দাও!

অসহ্য শীত। দুরন্ত উত্তুরে হাওয়া। শীত নয়, যেন লক্ষ লক্ষ বিষধর অদৃশ্যে ছোবলাচ্ছে চেরা জিভ বার করে।

কিন্তু সময় নেই, চল চল! সঙ্গমে সঞ্চারিত হচ্ছে অমৃত। জীবন-যৌবন, ধ্যান-ধারণা, কামনা-বাসনার অমৃত-ঢেউ লেগেছে, ডুব দিতে হবে, চল চল।

‘বেরজো, ওঠ। চল্ চল্। পেল্লাদ, দাদুভাই আমার, আমার সোনামানিক, চল্ চল্।’

‘খনপিসি, চল চল।’

‘ওগো তোমরা আমায় ধর, আমার পা টলছে। আমায় নিয়ে চল।’

শীত! সরে যাও। মৃত্যু! দূরে যাও। দুর্বল! শক্তি ধর। অন্ধকার! আলো হও। চল্‌ চল্। কী পড়লো? ঘটি? থাক। কী রইলো? জামাকাপড়? থাক। সময় নেই! ক্ষণ বয়ে যায়, চল্ চল্!

বাইরে পাঁচুগোপালের তীব্র মোটা গলার ডাক ভেসে আসছে, ‘বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়।

শুনছি শুধু ডাক, শুধু চল চল আহ্বান। তবু পড়ে রইলাম। বিস্ময়ে হতবাক, দেহ আড়ষ্ট। মন ছটফট করছে, তবু পড়ে রইলাম।

কে ডাকছে! কে ডাক দিল সবাইকে এমনি করে! কার বাঁশি বাজল! কোন্ মন্ত্র শুনলো সবাই কানে কানে! কেন এত ব্যাকুল হলো! কেন এমন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চললো সবাই! আশ্চর্য! এই ভয়ংকর শীতে সঙ্গমে ডুব দিতে পাগল হলো সকলে?

দিদিমা বলছে, ‘পেল্লাদ, ছেলেটাকে ডাক।’

প্রহ্লাদ ডাকলো, ‘কই দাদা, উঠুন, সব কিন্তু ফাঁক গেল নইলে। উঃ! ও হো হো হো, দি’মা কী শীত রে!’

বেরিয়ে পড়েছে সবাই। খুলে দিল তাঁবুর ঢাকনা। তারপর কে হ্যাঁচকা দিয়ে খুলে দিল আমার কম্বল।

চেয়ে দেখি ব্রজবালা। উল্লাসে, উৎকণ্ঠায় শীতে কাঁপুনিতে অদ্ভুত তার মুখের ভাব। বললো, চাপা গলায় ফিস ফিস করে, ‘চল, চল তাড়াতাড়ি।’

ব্যাকুল ও করুণ আকুতি। তারপর বেরিয়ে গেল দিদিমা আর স্বামী—দুয়ের মাঝে দেহলগ্ন হয়ে। ডাক পড়েছে। ত্রিপূর্ণিতে ডুব দেবে আজ ব্রজবালা। তার জীবনে ডুব দেবে, তার যৌবনে ডুব দেবে, তার শাঁখা-সিঁদুরে, মাছ-ভাতে, স্বামীর পরমায়ুতে আর ভবিষ্যতের জাদুমানিকের অমৃতমন্বিত ওষ্ঠগহ্বরে। কে গান ধরে দিয়েছে—

চল গো তারা ত্বরা করে।
সে যে আর রইবে না রে।
সোনার বরণ কালি হলে।
দেখবি অন্ধকার।
তখন কাঁদবি বসে ধূলায় পড়ে,
দেবতা কাঁদবে দেখে তোরে,
দেখবি, চারদিকে তোর ভরাডুবি,
পাবিনেকো পারাপার।।
তোরা চল গো চল।।

পাঁচুগোপালের গলা শোনা গেল, ‘সবাই এসেছে? চল, এবার পা চালাও।’ পাঁচুগোপাল চালক। পুণ্যসঞ্জয়ের হাত-ধরা খুঁটি। জানি নে, এতে পাঁচুগোপালের কতখানি আনন্দ ও লাভ। কিন্তু তার কণ্ঠে একটা চাপা উল্লাসের ধ্বনি বাজছে।

খনপিসি বলছে, ‘পাঁচুদা, নাপতে ব্যাটা কোথায় গেল?’

জবাব শোনা গেল, ‘আছে, আছে, চল চল। সঙ্গমের ধারে বসে মাথা মুড়োবে, ভাবনা কী?’

মনে হলো ফাঁকা হয়ে গেল আশ্রমটা। সবাই চলে গেল, পড়ে থাকি কেমন করে? ডুব না দিই, একলা থাকবো কেমন করে? আমি যাই তাদের সঙ্গে সঙ্গে। ডুব না দিই, ডুবেই তো আছি।

বেরিয়ে এলাম ওভারকোট চাপিয়ে। সামনে দেখা কোতোয়ালজীর সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হলো, যান নি?’

কোতোয়াল বললো, ‘আমাদের আজ নয়। অমাবস্যার দিন। ওই দিন পর্ণকুম্ভ যোগ আছে। আজকেও কম নয়। গ্রহণ যোগ আছে। কিন্তু সাধু সম্প্রদায় আজকে এ যোগে যোগ দেবেন না।

তাড়াতাড়ি মুখ ধোয়ার জন্য গেলাম পেছনের কল-পাড়ে। গিয়ে অপ্রস্তুত হলাম। ভেবেছিলাম কেউ নেই আশ্রমে। কিন্তু রয়েছে।

দেখলাম, তাঁবুর একপাশে নিরুদ্দেশ-স্বামী-সন্ধানী বৌদি। খসা ঘোমটা। আঁচল এলিয়ে পড়েছে ধুলোয়। সিঁথি ও কপালে সিঁদুর। চোখে জলের ধারা। তাকিয়ে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে দেবর। গম্ভীর, ম্লান ও ব্যথিত।

কোনো কথা নেই। দু’জনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ। আশ্রম পেছনের এই নিরালা প্রাঙ্গণটিও যেন একান্ত হয়েছিল তাঁদের সঙ্গে। গতকাল, দূর থেকে পোশাকের ঔজ্জ্বল্যে তাঁদের এই রূপটি আমার চাখে পড়েনি, মনেও আসেনি। শুধু ব্রজবালার কাছে শুনেছিলাম, বউটি কথা বলে না কারুর সঙ্গে। সে নির্বাক।

ইতিমধ্যে রোদ উঠতে আরম্ভ করেছে। আজ এই সোনার মতো সকালে সবাই মৃত্যুর বিনিময়ে যখন ছুটে চলেছে প্রাণের সঙ্গমে, তখন এই নিরালায় দাঁড়িয়ে তাঁরা দুজন।

তাঁদের পরিচয় জানি নে। জানি নে মন। মনে হলো, এই নিঃশব্দ আসরে বেদনার ও চোখের জলের একটি আবেগময় সুর বাজছিল। এই নিরালা অবসরেই মানুষ তার ব্যথা মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, ব্যথার গৌরবে পারে হাসতে কাঁদতে।

আমি অজান্তে এসে কেটে দিলাম সুর। ভেঙে দিলাম আসর। বৌদি চকিতে একবার আমাকে দেখে ঢুকে গেলেন তাঁবুতে। দেবর রইলেন দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত নতমস্তকে। তারপর ঢুকে গেলেন তিনিও।

আমার মুখ ধোয়া হলো না। কলে গিয়ে জলে হাত দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি।

বাইরে বেরিয়ে আসতে ভিন্ন রূপ। কোনো কিছু ভাববার অবসর ছিল না। চোখ ও মন টেনে নিয়ে গেল আদিগন্ত বালুচরে। দিশাহারা করে দিল আমাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমুদ্র।

কোথায় যাব, কোন্ দিকে যাব তোরা চল গো চল। যে দিকে তাকাই, মানুষ। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ, অন্ধ খঞ্জ। এক বিরাট পাগলা বন্যার ঢল নেমেছে দক্ষিণে। দিগন্তবিস্তৃত মৌমাছিরা চাক ভেঙে যেন কোনো এক সংক্ষিপ্ত সরু পথে উড়ে চলেছে। সেই সরু পথ দক্ষিণে। গঙ্গার এপার ওপারের ছুটে-চলা মানুষ যেন কোন এক নিয়মের বশবর্তী হয়ে চারদিক থেকে এসে এক জায়গায় অগ্রসর হচ্ছে।

দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া সম্ভব বোধ হলো না। পুল পেরিয়ে চলে এলাম প্যারেড গ্রাউণ্ডে, বাঁধের নিচে।

সবাই ছুটে চলেছে সঙ্গমের দিকে। দল বেঁধে যাওয়া-আসার পথের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। দাঁড়িয়ে থেকে পরিচালনা করছে উদ্ব্যস্ত ভলান্টিয়ার বাহিনী। দিকে দিকে কর্ণবিদারী তাদের হুইসেলের তীক্ষ্ণ ধ্বনি। ঘন ঘন বিপদ সঙ্কেতে বাজছে বাঁশি।

ধাক্কা খেয়ে সরে গেলাম অনেকখানি। দাঁড়াবার উপায় নেই। সঙ্গমের ঢালুতে বন্যা উদ্দাম হয়ে উঠেছে। মাইক বাজছে বিউগল সঙ্কেত করছে, বয়-স্কাউটবাহিনী করছে কুচকাওয়াজ। প্রধানমন্ত্রী শ্রী জহরলাল নেহরু আসবেন। বাঙলাদেশের কল্যাণী কংগ্রেসের পথে দেখে যাবেন একবার।

বাঁধের উপর উঠছে সারবন্দী হাতির দল। গায়ে তাদের রাজকীয় জরি-মখমলের ঢাকনা। সওয়ার ছাই-মাখা সাধু। সেদিকে ছুটে চলেছে একদল মেয়ে। অবাক হয়ে ভাবলাম, কেন? এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, মেয়েরা দৌড়চ্ছে, আর চেঁচাচ্ছে, ‘হে ভগবান, হে বাবা, থোরা ঠায়রো, ঠায়রো!’

কিন্তু ঘণ্টা দুলিয়ে বাজিয়ে হস্তিবাহিনী উঠে চলেছে। তার মধ্যে একটি মেয়ে ছুটে গিয়ে হাতির গায়ে হাত দিল। হাসিতে আনন্দে অধৈর্য হয়ে কপালে হাত ছোঁয়াবার আগেই, হাতির পেছনের পায়ের লাথিতে সে ছিটকে পড়লো অনেক দূরে।

তবুও, তবুও আবার ছুটল। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে, ওরা হাতির পেছনে কেন?’

শুনলাম, হাতি স্পর্শ করে প্রণাম করবে। সে-ই হবে তার পুণ্য। ধন্যি পুণ্য তোরা চল গো চল। প্রাণে ভয়ও কি নেই?

অকস্মাৎ, ‘হট যাও, হট যাও’ শব্দে চমকিত হয়ে সরে দাঁড়াতেই দেখলাম, একদল মানুষ ছুটে আসছে। দলের সামনে ছিন্নভিন্ন ধুলোমাখা আলখাল্লা জড়ানো একদল মানুষ। কিন্তু মানুষ বলে আর তাদের চেনা যায় না। ধূলিমাখা চুল-দাড়িতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে তাদের সারা মুখ। পা-গুলি ফুলে ফেটে রক্ত ঝরছে। কাঁধে বড় বড় ঝুলি। তারা দ্রুত পায়ে চলেছে।

তাদের পেছনে পেছনে ছুটছে মেয়ে-পুরুষের দল। আছড়ে পড়ছে তাদের পায়ের তলায়। চিৎকার করে উঠছে, ‘দেয়া কর বাবা, দেয়া কর!’ লুটিয়ে পড়ছে সুবেশ পুরুষ, মহামূল্য অলংকার ও শাড়ি-শোভিতা নারী।

কিন্তু আলখাল্লাবাহিনী নির্দয়। তারা থামতে জানে না।

মানুষ ছুটে ছুটে খাবার ও পয়সা পুরে দিচ্ছে তাদের ঝুলিতে।

একটি অল্পবয়স্কা নবীনা ঘোমটাউলী দু-হাত আড়াল করে দাঁড়ালো একজন আলখাল্লাধারীর সামনে। থামতে হলো আলখাল্লাধারীকে। কিন্তু সৈনিকের লেফ্‌ট-রাইটের মতো ওঠাপড়া করতে লাগলো তার পা। চুলে ঢাকা চোখে তার ক্রোধ নেই। ব্যস্ততা ও ব্যাকুলতা, মিনতি ও প্রার্থনা।

ঘোমটাউলী সুদৃশ্য রুমাল খুলে কয়েকটা টাকার নোট পুরে দিল তার ঝুলিতে। দিয়ে হাত পাতল।

আলখাল্লাধারী তার আলখাল্লায় খামচা দিয়ে এক চিলতে ন্যাকড়া ছিঁড়ে নিয়ে গুঁজে দিল তার হাতে। দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে আবার বেরিয়ে গেল।

‘মিল গয়া, মিল গয়া!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো অনেকে। কিছুই বুঝলাম না। কারা এরা, কী ব্যাপার! জিজ্ঞেস করলাম একজনকে।

সে বললো, ‘ওরা মহাপুরুষ। ওরা এ জীবনে কোনোদিন থামবে না। ওরা ওদের সাধনার প্রথম দিন থেকে ছুটে চলেছে। জীবনভর ছুটবে। এই ওদের সাধনা!’ আশ্চর্য! মানুষের জীবনধারণেই বা তা কী করে সম্ভব, কিন্তু বিতর্ক অনাবশ্যক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নাম ওদের?’

সে বললো, ‘জানি নে।’

সালঙ্কারা ঘোমটাউলী আনন্দে খুশিতে হাসতে হাসতে চলেছে তার পরিজনদের সঙ্গে। ওই এক চিলতে ন্যাকড়ার আনন্দ!

আবার ধাক্কা। সরে যাও, ঢল নেমেছে। হা হা করে ছুটে আসছে নরনারী। গতি সঙ্গমের দিকে। সে কি শুধু গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম! নাকি, বিচিত্র মানুষ সেখানে সঙ্গম তৈরি করেছে সহস্র স্রোতের মিলিত মোহানায়।

স্রোতের টানে ভেসে গেলাম। একদল মেয়ে হাসছে, গান করছে, ঠেলে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। দেখলাম, সকলেই গৈরিকবসনা। যুবতীর সংখ্যা বেশি, প্রৌঢ়া কয়েকজন। যেন দু’টি দল। একদল মেয়ে, ফর্সা লাল টুকটুকে, বোঁচা নাক, টেপা ঠোঁট, খুদে চোখ। খাটো গড়ন। বাকিরা সকেলই আর দশজনের মতো। কটা কটা চুল এলিয়ে, হাসি-খুশি খেলায় তারা বনবালার মতো উদ্দাম হয়ে চলেছে। কারুর কারুর মস্তক মুণ্ডিত। চোখাচোখি হলেই চোখে-মুখে ঝলকে ওঠে হাসি। মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করে ফেললাম একজনকে, ‘আপনারা কোত্থেকে আসছেন?’

শর্বনাশ! এ যে সেই শ্যামাদের দলের মতো কথার পৃষ্ঠে কেবলি হাসি। হেসে একজন বললো, ‘আমরা হরিদ্বার থেকে আসছি। তুমি? ‘

বললাম, ‘বাঙলাদেশ।’

‘কোলকাতা?’

আবার হাসি। জনতাও কৌতূহলিত হয়ে তাকালো এদিকে। এক গৈরিকবসনা বললেন, ‘আমরা অবধূতানী। আমাদের আশ্রম আছে হরিদ্বারে।’

অবধূতানী! মনে পড়লো সেই গৃহাবধূতের কথা। মনে পড়লো তার অবধূতানীর হাসিখুশি মূর্তিখানি। কিন্তু এরা কার অবধুতানী?

এগিয়ে চল, এগিয়ে চল। পথের দু’পাশে ভিক্ষুকের ভিড়। সুস্থ, অসুস্থ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গ, অন্ধ। তাদের সামনে বিছানো ময়লা কাপড়ে ডাল চাল ফুল পয়সার ছড়াছড়ি। এরই মধ্যে সাপুড়ে বসে গিয়েছে সাপ নিয়ে। ময়াল ছেড়ে দিয়ে বসেছে ওষধি লতাপাতা ছড়িয়ে। তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়।

হটযোগীরা আরম্ভ করেছে যোগ দেখাতে। মাটির তলায় মাথা দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে দিয়েছে পা। কেউ চিৎ হয়ে, খালি গায়ে শুয়ে আছে কণ্টকশয্যায়।

এক জায়গায় দাঁড়াতে হলো। বছর দশেকের একটি ছেলে, ছাই মেখে শুয়ে আছে কাঁটার বিছানায়। মুখ হাঁ করে রয়েছে। জিভে ফোঁড়ানো লম্বা একটি তীক্ষ্ণ সরু ত্রিশূল। তার লাল চোখ বেয়ে জল পড়ছে। কাঁপছে থর থর করে।

বিস্ময়ে ব্যথায় চমকে উঠলাম! এইটুকু ছেলেকে দিয়ে কেন এ ভয়াবহ ধৰ্মলীলা! এ মহামেলায় এমন করুণ দৃশ্যের অবতারণা কেন?

পরমুহূর্তেই মনে হলো, শুধু কি ধর্ম? প্রাণের এ যন্ত্রণার মধ্যে কি ওর কোন সাধনা নেই? বাঙলা দেশে কত ছেলে পথে পথে, বাজারে ট্রেনে এমনি ভয়ংকর সাধনায় ব্যস্ত। সেই সাধনা তাদের পেটের। তাদের বাঁচবার সাধনা।

আমার ব্যথার দৃষ্টিদানে ওর থলি ভরবে না। এই নিদারুণ যন্ত্রণাতেও দেখছি, ওর ব্যাকুল নজর রয়েছে সামনে বিছানো কাপড়ের দিকে। ওর সাধনার ডালি ভরে উঠেছে কিনা, তাই। মেয়েরা ঘিরে রয়েছে ওর চারদিক থেকে। করুণার বিচিত্র শব্দ শোনা যাচ্ছে তাদের মুখে।

থাক করুণা। যা দিয়ে ও মানুষের দৃষ্টিকে খোঁচা দিয়েছে, ওর সেই প্রাপ্য মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম।

জলের ধারে এসে সে এক ভয়ংকর ব্যাপার! ধারের কাছে পাঁক হয়ে উঠেছে জল। আর পাঁকের মধ্যে ক্ষিপ্ত মোষের মতো ঠেলাঠেলি করছে মানুষ। মেয়ে আর পুরুষ। বৃদ্ধ ও শিশু। ওদিকে সঙ্গমের বুক জুড়ে নৌকার ভিড়। দড়ির সীমারেখা দিয়েছে বেঁধে যমুনার কোলে। প্রতি মুহূর্তে সেখানে বাজছে ভলান্টিয়ারের হুইসল্, উড়ছে পতাকা। ওইটি হলো ডেঞ্জার জোন। নীল জলের প্রাণ-ভোলানো হাসির ঢেউয়ের তলায় চিরমৃত্যু রয়েছে তার পাকে পাকে, চোরা বালুতে। ওই যমুনার জলে যে মরেছে, সে আর কবে উঠেছে!

ঠেলাঠেলি করছে, তবু উল্লাসের অন্ত নেই! এ ওকে চান করাচ্ছে, ও একে বুকে, করে নিয়ে চলেছে জলে।

‘মহারাজ, মহারাজ’, বলে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল এক বুড়ো। বললাম, ‘কী করব?’

সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল জলের কিনারে। তারপর আমার হাতখানি ধরেই জলে কাদায় মাখামাখি করে উঠে এলো। কী হাসি! ফোকলা দাঁতে এক গাল হেসে কাদা হাতখানি ঠেকিয়ে দিল মাথায়, ‘জীতা রহো বাবা। পানিমে বহুত ডর, সাঁতার নহি জানতো।’

তাই ভালো। আমাকে ধরে সে চান করে নিল। দুঃখের মধ্যে কাদা লাগলো জামা-কাপড়ে।

এখানে লজ্জার অবকাশ নেই। কারুর কাপড় খুলে গিয়েছে, কেউ নিজেই রেখেছে খুলে। কেউ অন্তর্বাসটুকুও পরিত্যাগ করেছে। জামাটি অদৃশ্য হয়েছে গায়ের থেকে। সবই ঠিক। তার পাঞ্জাবী মহিলারা এদিকে যেন বড় উদাসীন। একে তো অধিকাংশই সাঁতার জানেন না। কিন্তু নির্বিকারভাবে তারা কেমন করে শালোয়ার-পাঞ্জাবি খুলছেন। কেমন করে এত লোকের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে হাসতে হাসতে জলে নেমে আসছেন, জানি নে। হয়তো ওঁদের দ্বারাই সম্ভব এমনি মরালীর মতো জলখেলা।

দেখলাম, একজন মাঝি হাঁকছে, দো দো আনা আসুন। বেশ বড় নৌকা। অনেকে উঠছে। সঙ্গমের মাঝখানের দিকে তাকিয়ে আর থাকতে পারলাম না। উঠে পড়লাম মাঝির হাত ধরে। পাশে রয়েছে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। ঐ নৌকার গলুই সেই বাঙলা দেশের মতো। অল্পতেই ডিঙা টলমল নাচে। অথচ ছোট ছোট ডিঙাতে পাতা রয়েছে গদীমোড়া বেঞি। মাথায় ঢাকনা। কিন্তু এ বড় নৌকাতে ছই বেঞ্চি কিছুই নেই।

আমাদের নৌকা ভরে উঠলো। তবু মাঝি ছাড়ে না। সবাই তাড়া দিল। মাঝির দায় কাঁদছে। সে তখনো হাঁকছে, সঙ্গমে নাইবে এসো, দু-আনা, দু-আনা।

তারপর যখন নৌকা ডুবু-ডুবু হলো, তখন ছাড়ল। মাঝি খেলা জুড়ল ভালো। একি ভয়াবহ নৌকাবিলাস, আমাদের মতো নিতান্ত বেরসিক নরনারী নিয়ে! শুধু হাসির অন্ত নেই কয়েকটি আধুনিক গরম স্যুট-পরা পাঞ্জাবী যুবক ও যুবতীর। অথচ ভয় তাদেরও বেশি। সাঁতার জানে না। আসলে হাসিটাই ভয়ের। নৌকা যত টলমল করে, ততই তারা ভয়ের হাসি দিয়ে জাপটাজাপটি করছে নিজেদের মধ্যে। পুণ্যস্নানের সাত সকালে, চোখে-মুখে মেয়েদের প্রসাধনের পলেস্তারা পড়েছে। জামাকাপড়গুলিও জলে নামার মতো নয়। বাদবাকি সবাই জড়োসড়ো, উদ্ব্যস্ত। একটি বাঙালি পরিবারও উঠেছে দেখছি। তিনটি প্রৌঢ়া আর দুই যুবক। অলেস্টারের কলারে আর মাথায় জড়ানো তোয়ালে। এদিকে আবার ঘাড়ে ক্যামেরা।

কুল্যে প্রায় জনা ত্রিশের উপর নরনারী ভিড় করেছে উন্মুক্ত পাটাতনের উপর। ঘাড়ে মাথায়, বুকে মুখে, কাঁধে কোলে পিঠে। তার মধ্যে মনে হলো দু’টি কিশোরী, একটি কয়েকমাসের শিশুকে নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পোশাকে চাকচিক্য নেই, কিন্তু অলঙ্কারের বাহুল্য দেখছি খুব। হাতে গলায় কানে সোনা প্রায় অপর্যাপ্ত। তা ছাড়াও একজনের হাতে দেখছি রাশিখানেক বেলোয়ারি চুড়ি। কিন্তু শিশুটিকে এনেছে কেন, বুঝতে পারলাম না।

ডাঙায় জনারণ্য, জলে নৌকারণ্য। দাঁড়ে দাঁড়ে, বৈঠায় বৈঠায়, হালে ঠোকাঠুকি। গলুয়ে গলুয়ে ধাক্কাধাক্কি। মাঝিতে মাঝিতে বিবাদ। হটাও, পাশ দাও। শুধু নৌকার ভিড় নয়, জলের মধ্যে ভিড় মানুষের। কোমরজলে, বুকজলে ডুব আর দারুণ শীতের হিহিক্কার। তার ওপরে নৌকার ধাক্কা। ডুবন্ত অবস্থায় একবার চাপলে আর রক্ষে নেই।

মাঝি বললো, ‘এখানেই নেমে পড় সব।’

প্রতিবাদের প্রচণ্ড কলরব উঠলো। নৌকাই যখন ভাড়া হলো, এত শীঘ্র কেন? মাঝি বললে কী হবে! কেউই নামে না। আরো চল, আরো চল।

চারপাশের নৌকাগুলিতে ঝড় লেগেছে। স্নানের ঝড়। কেউ নৌকা ধরে, কেউ হাত ধরে স্নান করছে। হাসিতে, কান্নায়, কলহে চিৎকারে মুখরিত সঙ্গম।

জলের উপর ভাসছে ফুল বেলপাতা। ঘোলা নীলজলে কোথাও সিঁদুরের গুঁড়ো। কিন্তু আশ্চর্য! এই ঘোলাজলের বুকেও দেখছি, দু’টি রঙের ধারা চলেছে পাশাপাশি। বর্ষা নয়, গঙ্গা তার স্বভাব-গৈরিক বেশ ধারণ করে নি। তার নিরন্তর দক্ষিণাভিমুখী জলের ধারা এখন টলটলে। যত এগিয়ে চলেছে, ততই ঘোলা জল ছাড়িয়ে পরিচ্ছন্ন জলের ধারা দেখা দিচ্ছে।

পাশাপাশি চলেছে যমুনা-গঙ্গা। সাদা নীল দুই ধারা। একজন উত্তর থেকে দক্ষিণে, দৃকপাতহীনা। আর-একজন পশ্চিম থেকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণে। সে শুধু বাঁক নয়। বাঁকা তার স্বভাব। একজন রাগে অনুরাগে, যুগান্তের বিরহের বেদনার রঙে নীল। আর একজন সব পাওয়ার আনন্দে বৈরাগ্য-উদাসীন গৈরিক-বসনা। একজন হাসে খিলখিল করে, আর-একজন খলখল হাসিতে উন্মাদিনী। তবুও দু’জনে পাশাপাশি, একই প্রেমের টানে তারা দিগন্তে চলেছে ছুটে। সরস্বতী কোথায়? শুনেছি তিনি গুপ্ত আছেন।

আর নয়। নৌকা থামল। হাওয়া আরো বেশি, ঢেউয়ে দুলছে নৌকা। কিন্তু জল সেই বুক সমান। তার বাইরে চারিদিকে দড়ির বেড়ার পাহারা।

নৌকার পাশে নৌকা। তারই মাঝে প্রাণ হাতে করে স্নান। দুই নৌকার মাঝখানে পেশাই হয়ে মরে গেলেও কেউ রক্ষা করার নেই।

জামাকাপড় ছাড়ার পালা শুরু হলো। ছি ছি, মনে মনে বলি, হে মন! চোখ বন্ধ কর। পাঞ্জাবী মহিলাদের জামা খোলার কাহিনী আর বলবো না ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে। কিন্তু তারা নামবেন কী করে? মাঝি বেচারির অবস্থা কাহিল। সবাই তাকে ধরে ডুবে ডুবে পুণ্যিটুকু সঞ্চয় করতে চায়। যৌবন-উচ্ছল হাসি-ছলছল, অর্ধনগ্ন পাঞ্জাবী মহিলাদের পাল্লায় পড়ে, ফোকলা দেঁতো মাঝি হাসিতে বিরক্তিতে ‘হায় রাম হায় রাম’ করে অস্থির। কিন্তু জলে যদি নামা হলো, উঠবার নাম নেই। ধন্য! শীতও কি নেই?

সকলেই জামাকাপড় ছাড়ে, আর চায় আমার দিকে। ভাবটা, কে গো মিনসে? জামাকাপড় খোলে না কেন?

হঠাৎ চমকে উঠলাম চাপা কান্নার ফোঁপানিতে। কে কাঁদে এখানে? সেই দুইজন! যাদের মনে করেছিলাম কিশোরী। সেই তাদের একজন, কোলে যার কয়েকমাসের শিশু।

আর একজন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, হাতে যার বেলোয়ারি চুড়ি, ‘রহো, মতো রো। বলছে, কিন্তু চোখে তার ব্যথার ছায়া। মেঘভারাক্রান্ত সেই চোখে জল নামবে যেন এখুনি, কিছুটা বা লজ্জা! লজ্জাটুক লোকের জন্য। কিন্তু লোকের নজর তার দিকে ছিল না। সকলে ডুবে ডুবে পুণ্য-সয়ে মত্ত।

তারা কিশোরী নয়, তরুণী। কিশোরীর ছাপ রয়েছে তাদের মুখে। কিন্তু যখন সবাই হাসিতে, কাঁপুনিতে, স্নানে, কোলাহলে মাতিয়ে তুলেছে সঙ্গম, তখন তারা দু’টিতে কেন পাশাপাশি বসে চোখের জল ফেলছে।

তারা দু’জনে পুঁটুলি খুলল। পুঁটিলির মধ্যে জামাকাপড়। উপরের জামাকাপড়টি দেখে মনে হলো, সাদা মুগার। সকালের রোদের ঝিকিমিকি লেগেছে তাতে। আরও দু’টি বস্তু রয়েছে সেই কাপড়ের উপরেই। দু’টি সোনার বালা।

গরম-জামা-পরানো শিশুটিকে ভেজা পাটাতনের উপরে শুইয়ে দিল। শুইয়ে দিতেই শিশুটি শুরু করলো পরিত্রাহী চিৎকার। কেন জানি নে, মন ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কুঁকড়ে রয়েছি। শিশুর এই অসহ্য পীড়ন যেন লাগলো শরীরের প্রতিটি রোমকূপে।

কিন্তু সে-কান্নায় কান দিল না তারা। যে কাঁদছিল, তাকে ধরে দাঁড় করাল আর-একজন। সে দাঁড়াল, কিন্তু সঙ্গিনীর বুকে মুখ রেখে ভেঙে পড়লো উচ্ছ্বসিত কান্নায়। বাতাসে খসে গিয়েছে তার ঘোমটা, উড়ছে রুক্ষ চুলের গোছা। এবার তার সঙ্গিনীও ফুঁপিয়ে উঠে বললো, ‘কাঁদিস নে শিবপিয়ানী, বোন আমার কাঁদিস নে।’

কিন্তু আশ্চর্য! তাদের সঙ্গে নেই কোনো পুরুষ সঙ্গী। এ নৌকায় কোনো মানুষের নজর নেই সেদিকে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বুঝলাম, সবাই ভাসছে নিজ নিজ হৃদয়াবেগে। সেই তিন বাঙালি প্রৌঢ়ার একজন কাঁদছে জলে দাঁড়িয়ে। ডুব দিয়ে উঠেছে, কাঁপছে শীতে ঠকঠক করে, তবু জলের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে আর ফিসফিস করে বলছে অনেক কথা।

এদিকে শিশুটি, কান্নার আবেগে, নিজের দু’টি পা ধরেছে মুঠি করে, ঢুকিয়ে দিচ্ছে প্রায় নিজেরই মুখে। তারপরেই হঠাৎ কাত হয়ে, উপুড় হয়ে পড়ার মুহূর্তে হাত দিয়ে ধরে ফেললাম। ধরে তুলে নিলাম কোলের উপর

মেয়ে দু’টি অবাক হয়ে তাকালো চোখের জল নিয়ে। তারপর কৃতজ্ঞতা দেখা দিল। এমনকি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু যেন হাসলো।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমন করে ফেলে রেখেছ কেন ওকে?’

শিবপিয়ানীর সঙ্গিনী বললো, ‘আমরা স্নান করব।’

‘কী স্নান! ভেজা পাটাতনের উপর শিশুকে রেখে পুণ্য করতে নামছে দু’টিতে। নৌকার ভিড়ের চাপেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘বাচ্চাটাকে কেন?’

সঙ্গিনী বললো, ‘ও চান করবে।’

চান? পৃথিবীতে আসতে না আসতে পুণ্যস্নান? জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওকে কেন? তোমরা করলে হত না?’

দুঃখ থাক, বেদনা থাকো, এমন করে কথা শুরুতে তারা দু’জনেই কিছুটা বিব্ৰত, সঙ্কুচিত। একটু চুপ করে থেকে সঙ্গিনী বললো, ‘ওর বাবা নেই, ওকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে, না চান করলে চলবে কেন?’

বলতে বলতেই দেখলাম, সঙ্গিনীর শিবপিয়ানী আবার ব্যাকুল হলো কেঁদে। তারপর দু’টিতে নৌকার ধারে গেল। সঙ্গিনী বললো, ‘ওর মাকে একটু চান করিয়ে দিই। তুমি—’

বাদবাকি চাউনিতেই প্রকাশিত। ‘তুমি বাচ্চাটাকে দেখো।’

ওরা নেমে গেল জলে। ডুব দিল। আর উত্তর প্রদেশের এই দুরন্ত পিতৃহীন শিশু এক অপরিচিত বাঙালির কোলটি কচি কচি পায়ে আছড়ে ঠেলে, শূন্যে হাত তুলে লালা উদ্গীরণ করে মাতিয়ে তুলল। বুঝলাম, যুবতী শিবপিয়ানী বিধবা। এই শিশুর মা।

শিশু মানুষ চেনে না বুঝি এখনো। মানুষের উম্বু কোলটি বুঝেছে। কোলটি পেয়েছে, অমনি চারদিকে আলো ও শব্দের মাঝে তার বিচিত্র জগতে গিয়েছে হারিয়ে।

সকলের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলাম, পুণ্যস্নান দেখবো বলে। কোথা থেকে এসে বুক জুড়ে বসলো এক শিশু। তার পরিচয় জানি নে। কেমন ছিল তার বাপ, কে জানে! ওর ওই মায়ের দেহে অকঙ্কার দেখে অনুমান করতে পারি নি, সে বিধবা। জানি নে, অলঙ্কারের পেছনে কতখানি নিরাপত্তার খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে এই শিশুর জন্য। পিতৃহীনতা বোঝে না, পুণ্য বোঝে না। এই সঙ্গমের বুকে এক বিচিত্র মানুষ, ও এসেছে ওর পরমায়ুর সন্ধানে, এই অমৃতকুম্ভের সঙ্গমে। ওর এই পরমায়ুর সন্ধান পীড়ন মাত্র। পীড়নের পেছনে আছে কুসংস্কার। কিন্তু ওর মায়ের সারা বুক জুড়ে রয়েছে ও। প্রাণের আকাঙ্খার মর্যাদাই এখানে বড়। কুসংস্কার তো, সমাজের অভিশাপ।

ওর বাবা নেই, সেজন্য যতটুকু ব্যথা, ওর বুকজোড়া দাপাদাপি সেই পরিমাণেই উল্লাসের ধ্বনি হয়ে বাজল বুকে। এক সঙ্গীকে হারিয়েছিলাম পথে আসতে। সে আসছিল তার ব্যাধিমুক্তি ও আয়ু সন্ধানের জন্য। আমরা একজন মরি, আর একজন জন্মাই। দিবানিশি এই যাওয়া-আসার মধ্যে আমরা নতুন থেকে নতুনতর। একজনের আকাঙ্ক্ষা পুরাই আর-একজন। একজন পথের শেষে, শুরু করি আর একজন। সেইজন্য আমরা মানুষ, আমরা বন্ধু!

একজন বিড়ম্বিত জীবনের প্রচণ্ড করালরোগ নিয়ে চলে গিয়েছে, আর-একজনকে আলিঙ্গন করছি। ওকে পথে পেলাম, পথেই ছেড়ে দিয়ে যাব। ও বেঁচে থাকুক, পথের এই কামনা নিয়ে ঘরে ফিরে যাব।

শিবপিয়ানী উঠেছে, কাপড় ছেড়েছে। কথায় বুঝলাম, তারা দুই জা। বাড়ি এলাহাবাদ শহরেই।

নতুন কাপড় পরে শিবপিয়ানী পুঁটলি থেকে ফুল বেলপাতা গোছাতে গোছাতে বার বার গুপ্ত কটাক্ষে দেখলো শিশুকে। তার ঘোমটা তুলে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘দাও।’

তুলে দিলাম। দু’জনে মিলে শিশুর জামা খুলে, আবার শুইয়ে দিল পাটাতনে। দিয়ে, অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে ছিটিয়ে নাইয়ে দিল তাকে। আর-এক দফা চিলকণ্ঠের চেঁচানি ছাপিয়ে উঠলো। লক্ষ লক্ষ গলার চিৎকার। জামা পরিয়ে তার হাতে পরিয়ে দিল সোনার বালা। তারপর ওকে আবার শোয়াতে গিয়ে অসঙ্কোচে তুলে দিল আমার কোলে।

দিয়ে নিজেরা ফুল বেলপাতা সিঁদুর দিল জলে। হঠাৎ কী হলো জানি নে। শিবপিয়ানীর হাত চেপে ধরল তার জা। কিন্তু শিবপিয়ানী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের হাত থেকে দু’টি সোনার চুড়ি খুলে ফেলে দিল জলে।

শুধু তার জা ম্লান হেসে বললো, ‘পাগলী।’

কিন্তু বাধা দিলেও আক্ষেপ নেই তার আর। এবার আমার দিকে ফিরে একটু হাসলো শিবপিয়ানী। হেসে, দেখলো নিজের ছেলেকে। এবার আর নিজে না বলে, সঙ্গিনী জাকে বললো, ‘ওকে আমার কোলে দাও।

বুঝে, আমি নিজেই শিশুটিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে দিলাম। মাঝি হাঁক দিল, ‘ওঠো ওঠো! আমাকে আবার খেপ দিতে হবে।’ এখনো অনেকেই জলে। শিখ গৃহিণীদের দেখছি এখনো ওঠবার কোনো আগ্রহ নেই। স্বয়ং শিখ পুরুষেরাও নেমেছে

হঠাৎ ওভারকোটে টান পড়তে পেছনে ফিরলাম। দেখি, আলুলায়িত সিক্ত কেশ ও শশু উৎফুল্ল শিখ একজন। চোখে তার রীতিমতো দুষ্টামির হাসি। বলে, ‘আরে ভাই, তুমি, জলে নামছ না কেন?’

সর্বনাশ! জলে নামব কি এইসব জামাকাপড় পরে! বললাম, ‘বিমার হ্যায়।’

যতক্ষণ তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, ততক্ষণে জলের ছিটায় ভিজে উঠেছে আমার ওভারকোট। একলা নয়, সঙ্গিনীসহ হাসিতে চিৎকারের ভয়াবহ জলকেলিতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। হেসে বললো, ‘আরে ভাই, থোড়া তো লাগাও।’

লাগাব কি! ঠাণ্ডা জলের কয়েকটি ধারা তখন শরীরটাকে কেটে কেটে নিচে নামছে। সকলেই হেসে উঠলো।

মাঝিটাও হাসতে গিয়ে যেন কেঁদে উঠলো। বললো, ‘নৌকা ছেড়ে দেব কিন্তু।’

আবার নৌকার ভিড় ও মানুষের মাথা ঠেলে ফিরে আসা।

পাড়ে এসে, ভিড়ের মধ্যে দেখলাম খনপিসি। প্রায় বিপুলকায় পুরুষের মূর্তি ধরেছে। মাথাটি একেবারে নিরঙ্কুশ মুণ্ডিত। কী কাণ্ড! প্রহ্লাদ, দি’মাও দেখছি ন্যাড়া মাথা।

তখনো নৌকা থেকে নামা হয় নি। প্রহ্লাদ দেখে ফেললো। বললো, ‘এই যে দাদা, বেশ হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছেন। মাথা মুড়োবেন না?’

হেসে বললাম, ‘না।’

প্রহ্লাদ বললো, ‘কেন? পাপ করেন নি কোনদিন?’

জবাব দিতে গিয়ে হেসে ফেললাম। প্রহ্লাদ বললো, ‘করেছেন নিশ্চয়ই। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে। জানেন না।’

‘প্রয়াগে মুড়ায়ে মাথা,
মরগে’ পাপী যথা তথা।

‘মুড়িয়ে নিন, তারপর আবার পাপ করবেন, কিছু হবে না, আগের পাপটা তো কাটান।’

খনপিসি খ্যাঁক করে উঠলো, ‘ছি ছি ছি, কী অনাচ্ছিষ্টির কথা। সঙ্গমে দাঁড়িয়েও মুখের রাখ-ঢাক নেই?’

প্রহ্লাদ অন্যদিকে ফিরে বললো, ‘আর রাখ-ঢাক! শালা এখনো সকাল থেকে দু-হাত এক হলো না, সঙ্গম দেখাচ্ছে!

দু’হাত এক হওয়া মানে, দু’হাতে কলকে ধরা। ভাগ্যি কথাটা খনপিসির কানে যায়নি! ব্রজবালা জলে নেমে কাঁপছে ঠকঠক করে। চকিতে একবার আমাকে দেখলো, তারপর আবার ঘোমটার আড়াল।

আমাদের নৌকা পাড়ে ঠেকলো প্রায় খনপিসি-বাহিনীকে ভেদ করে।

নৌকা থেকে সবাইকে হাত ধরে ধরে নামাল মাঝি। শিবপিয়ানী আর তার জা নেমে দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়িয়ে ছিল বলতে পারি নে। ভয়াবহ ভিড়ের ঝড়ে খাড়া হয়ে ছিল কোনোরকমে।

আমি নেমে আসতে শিপিয়ানীর জা বললো, ‘যাচ্ছি।’

বললাম, ‘আচ্ছা।’

শিবপিয়ানী তার কোলের ছেলেকে ঝাঁকানি দিয়ে বললো, ‘বল্ যাচ্ছি!’ আচমকা ঝাঁকানি খেয়ে শিশু একটু অবাক হয়ে থমকে রইলো। পরমুহূর্তে হাত-পা আস্ফালন করে কয়েকটি দুর্বোধ্য শব্দ করে উঠলো তার মাড়ি দেখিয়ে। শিবপিয়ানী ঘোমটার আড়াল দিয়ে একটি হাসিচকিত কটাক্ষে যেন বলে দিল, ‘দেখলে তো, কেমন বলতে পারে?’ তারপর শিশুকে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল তারা।

একটি নিশ্বাস ফেলে আবার ফিরে দেখতে গেলাম খনপিসি-বাহিনীর দিকে। কিন্তু ও কে? খনপিসির পাশে? সর্বনাশ! সর্বনাশী স্বয়ং! আমারই বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো। না জানি কী দুর্ঘটনা ঘটে যাবে চক্ষের পলকে! কিন্তু কী আশ্চর্য। এত কাছে, প্রায় গায়ে গায়ে, তবু পিসির চোখে একবারও পড়ছে না সর্বনাশী।

আর এ কী বিচিত্র রূপ সর্বনাশীর! এ বিচিত্র বেশ তার কাপড়ে নয়, জামায় নয়, সিঁদুরে। তার সিঁথি-ভরানো সিঁদুরে, তার কপাল-লেপা সিঁদুরে। কপাল ও সিঁথির মেটে সিঁদুরে মাখামাখি হয়েছে সারা মুখ। জলে ভেজা জামাকাপড়। তার বক্ষলগ্ন এক পুরুষ। কালো রোগা ক্ষীণজীবী পুরুষটির গলায় একরাশ মাদুলি। বহুদিনের না কাটানো একমাথা ধূলিরুক্ষ জটের মতো চুল। শীতে কাঁপছে থরথর করে। দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আছে সর্বনাশীর বুক ও পিঠ। অসহায় জীবের মতো তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে।

সর্বনাশীর চঞ্চল চোখে কোথায় সেই দুরন্ত কটাক্ষ, কণ্ঠে সেই সেয়ানা পাখির ডাক? গম্ভীর মুখে তার বিষন্ন স্নেহজড়িত হাসি। স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে বক্ষলগ্ন পুরুষটিকে। কী যেন বলছে তাকে আর অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে ঢেলে দিচ্ছে তার মাথায়। পুরুষটি মাথা পেতে জল নিচ্ছে আর শিশুর মতো হেসে উঠছে।

হঠাৎ একটু ধাক্কা লাগলো খনপিসির গায়ে। মুণ্ডিতমস্তক খনপিসি তখন কোমরজলে দাঁড়িয়ে আহ্নিক সেরে নিচ্ছে। বিরক্ত চোখে ফিরে তাকাল। বুঝলাম, এখুনি লাগবে, পিট্রান দিই তার আগেই। কিন্তু অবাক কাণ্ড! খনপিসির বিরক্ত মুখে দেখি হাসির আলো। মুণ্ডিতমস্তক, প্রকাণ্ড মুখে সে-হাসি যে কতখানি বিচিত্র, না-দেখলে বুঝি বোঝা যায় না। কিন্তু কেন? খনপিসি কি সর্বনাশী মেয়েটিকে চিনতে পারল না? পরিবেশে ও কাজের গুণে মানুষের চেহারাও কি বদলে যায়?

তাই। তাই যায়। জানি নে, কেমন করে চিনতে পারলাম সর্বনাশীকে। কিন্তু খনপিসি স্থূল ঠোঁট দু’টি বিস্ফারিত করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে বাছা এটি? তোমার স্বামী?’

সর্বনাশী জবাব দিল ঘাড় নেড়ে, ‘হ্যাঁ।’

বেদনার ছায়া ঘনিয়ে এলো পিসির চোখে। বললো, ‘আহা, ব্যামোয় ভুগছে বুঝি অনেকদিন থেকে?

সর্বনাশীর চোখেও ঘনিয়ে এলো তেমনি ছায়া। বললো, ‘হ্যাঁ, অনেকদিন।’

খনপিসি ব্যথা কাতর চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখলো পুরুষটিকে। ছলছলিয়ে উঠলো চোখ। একটি উদ্ধৃত নিশ্বাসের মধ্যে পরম আশ্বাসের সুরে বলে উঠলো, ‘ভালো হয়ে যাবে মা, আমি বলছি। এত কষ্ট করে সঙ্গমে নিয়ে এসেছ, কে নেবে ওর পেরমায়ু! তোমার শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় হোক, চির-আয়ুষ্মতি হও।’

বলে, আকাশের দিকে মুখ তুলে নমস্কার করলো খনপিসি। জানি নে, এই বাঙলা কথার আশীর্বাদের কী বুঝল ওই বিদেশিনী! সে তার বরকে বার বার সঙ্গমের জল দিয়ে সিঞ্চিত করতে লাগল। কিন্তু আমার মনে শুধু বিস্ময় ছিল না। আরো কিছু ছিল।

যা ছিল, তা আমার আনন্দমুখরিত বিস্ময়, শ্রদ্ধা ও বেদনার নমস্কার। নমস্কার মানুষের জীবনের ও হৃদয়ের কোটি কোটি বৈচিত্র্যকে, অপরূপ বিচিত্রকে।

মনে করেছিলাম, ওই মেয়ে শুধু সর্বনাশের হাতধরা সঙ্গিনী। মনে করেছিলাম, সেই সর্বনাশে শুধু পাপলীলা। ধ্বংসের উন্মাদনায় মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধায় ও প্রেমহীনতায়, সে শুধু তার যৌবনের অগ্নিকণা ছিটিয়ে যায় মানুষের চোখে। অস্বীকার করবো না, তার ভ্রষ্ট জীবনে পঙ্কিল হাত থেকে নিজের পয়সার ব্যাগটি বাঁচিয়ে ধিক্কার এসেছিল মনে। ভেবেছিলান, পঙ্কে ডুবে যাওয়ার জন্য যাতে হাত পড়েছিল, তাকে বুকে মুঠি করে ধরে এ কোন্ পয়সাসর্বস্ব অসহায় মানুষ আমি!

আজ সেই পঙ্ক-সঙ্গমের অঙ্কে পঙ্ক? একেই মনের সেন্টিমেন্ট বলে কিনা জানি না। কিন্তু ওই পুরুষটি যদি ওর বর না হতো, হত অন্য কোন পথেরই মানুষ, তাহলেও কি নত হৃদয়ের এ নমস্কারকে ফিরিয়ে নিতে পারতাম? কে পারত? হৃদয়ের কোনও এক অংশ জুড়ে ছিল যার এই লীলাক্ষেত্র, প্রেমে ও স্নেহে যে সর্বনাশী এমন মূর্তি ধরতে পারে, যে এমনি করে অমৃতে হয় একাকার, তাকে পঙ্ক বলে ফিরে যাব, সে দুঃসাহসও আমার নেই।

যেন কারুর কোনোদিন না থাকে।

শুধু খনপিসি নয়, দলের কেউ-ই তাকে চিনল না। সেও চিনল কিনা কে জানে! এখন যদি একবার চোখাচোখি দেখা হয়, তবে হয়তো আমাকেও চিনতে পারবে না, কেন না, আমি যে তার এ জীবনের কেউ নই। এখন সে ডুবে আছে। সেখানে তার নিজের মেলা। সেখান থেকে যখনি উঠবে ভেসে, তখন এই বাইরের মেলা, তখন আমরা, তখন আমি। ভিড় ঠেলে এলাম উপরে। আজ আর না-ই হোক দেখাদেখি। সে যে বিচিত্রের দ্বার খুলে দিয়েছে আমার চোখের সামনে, সেই দোরগোড়ায় জমা হয়ে থাক আমার বিস্ময় ও নমস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *