অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ১৩

১৩

সকাল থেকে যেন ঝড়ের গতিতে কেটে গেল এতক্ষণ। সবাই প্রাণভরে ডুব দিল সঙ্গমে। টেরও পাই নি, জানিও নে, কী অমৃতের সঞ্চার হয়েছিল আজ সেখানে! সবাই কি নিয়ে এলো বুক ভরে, কীসের নেশায় মাতাল হলো মানুষ! প্রথম দিন থেকে, পরিচিত সকলের মুখগুলি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সকলের সব কথা।

সত্য, আমি ভগবান পেতে ছুটে আসি নি! ডুব দিতে এসেছিলাম লক্ষ হৃদি-সায়রে। এখন, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমার সারা বুক ভারী। সে যে কীসের ভারে এমন পাষাণ হয়েছে জানি নে। এত লক্ষ লক্ষ লোক। আমি ডুব দিলাম, কি ডুব দেওয়ার সময় হয়েছে জানি নে। কিন্তু প্রাণভরে একটা নিশ্বাসও নিতে পারছি নে। কিসে ভরে উঠলো মন এমনি করে! আমি কী পেলাম!

দিন শেষ হয়ে আসছে। সারাটি দিন ঘুরছি পাগলের মতো। দেখা হলো অনেকের সঙ্গে। এবার সময় আসছে নিজের সঙ্গে দেখা হওয়ার। আজও এই উত্তর প্রদেশের মাঘের আকাশে মেঘ ছিল। খুব সামান্য। তাতে শেষ রোদের ঝলক লেগেছে। শেষ হওয়ার আগে রঙ ছড়ায় বেশি।

উচিত মনে হলো, আশ্রমে ফিরে যাওয়া। কিন্তু পেটের জ্বালাটি কেমন থিতিয়ে গিয়েছে। ওদিকে বড় টান বোধ করছি না। ব্রজবালার অভিমান-ক্ষুব্ধ চোখ দু’টি দেখতে পাচ্ছি, উঁকি দিয়ে আছে তাঁবুর আড়াল থেকে। তবুও বিরল নৌকা ও স্নানার্থীহীন যমুনার দিকে পা চললো আপনি আপনি।

চলতে চলতে কিসে আটকে গেল পা। অবাক হলাম। কে চেপে ধরেছে পা! ভিক্ষুক। রাগতভাবে তাকাতে গিয়ে দেখি, একমুখ হাসি। বিকলাঙ্গ বলরাম।

বলতে যাচ্ছিলাম, ‘বলরাম যে!’ তার আগেই সে পাগলের মতো গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠল—

‘তুমি কে-এ, পাগলপারা হে!
বহুদিনের চেনা বলে মনে হতেছে,
পাগলপারা হে!’

খোলা গলার এ উদাত্ত স্বর আকাশ ছুঁল গিয়ে। চকিতে মনে হলো, বুকে ছিল আমার স্তব্ধ জলরাশি। সে অশ্রু কিনা জানি নে। তাতে হাওয়া লাগল, ঢেউ বইল, আর পাগলা মাঝির মতো বলরাম সেই জলে চালিয়ে দিল তার পাসি। পাগল তো আমি নই। পাগল যে সে! কৌতূহলী কিছু নরনারীও এ বিচিত্র দৃশ্য দেখছিল। কিন্তু থামাই কী করে! বললাম, ‘বলরাম শোনো। ‘

বলরাম তবু গেয়ে উঠল—

‘বইসেছিলাম বুক পেতে,
আজ ধরা দিলে হে!
পাগলপারা হে!
য্যাতই মাখো ধূলাবালি,
নেপ য্যাতই কালো কালি,
চইলবে না আর ফাঁকিবাজি
ছাইড়ব না আর হে,
পাগলপারা হে।’

বলরামের আনন্দ দেখে, রুষ্ট হতে পারি নে। তবু, কৌতূহলী নরনারীর লজ্জা যে পারি নে কাটাতে। তার হৃদয়াবেগের ধারে লজ্জার অন্ধকার হয় তো কেটে যায়। আমার যে সে উত্তরণ হয়নি। ডাকলাম, ‘বলরাম! ‘

বলরাম হেসে গেয়ে মাতাল। বোধ হয় গানের সুর এখনো নতুন করে ছুটে আসছে তার গলায়। বললো, ‘বলেন।’

বললাম, ‘লোক জমছে।’

‘বেশ, তবে চলেন, কোথায় চইলছিলেন। কিন্তু ঠাকুর! ছেইড়ে দেব না।’

ছি ছি ছি, বলরাম আমাকে বার বার ঠাকুর বলে আমার মানুষিক অস্তিত্বটাকে যেন বেশি করে জানিয়ে দিতে লাগল। বললাম, ‘যমুনার ধারে–-’

কথা শেষের আগেই সে বলে উঠলো, ‘সেই ভালো, সেই ভালো।’

বলে সে আমার আগে, হেঁচড়ে হেঁচড়ে, দু’হাতে ভর দিয়ে চললো। আমাকে সে-ই পথ দেখিয়ে চললো নিয়ে। তার স্বাভাবিক চলার কষ্ট দেখে নিজেরই কষ্ট হয়। কিন্তু তাকে থামানো যাবে না। কেল্লার কোলের যমুনার তীরে এসে সে বসলো। হেসে ঘাড় কাত করে বললো, ‘বইসতে হবে কিন্তুন।’

শুল্ক বালুসৈকত। মাথার গামছাখানি খুলে তাড়াতাড়ি পেতে দিল বলরাম। জানি, আমার অনেক আত্মাভিমান আছে, ধুলোবালির বাছবিচার আছে। তা বলে এখানেও গামছা পাতা কেন? বলরাম এত খুশি, আমি একটু বসতে পারি নে? বললাম, ‘গামছা থাক।’

বলরাম জিভ কেটে মাটি দেখিয়ে গুনগুন করে উঠলো—

‘ভুঁয়ে নি সে বইসবেরে ধন?
বইসবে হিয়ের মাঝখানে।।’

বলে, আঙুল দিয়ে দেখাল খোলা বুক! বললো, ‘ওই গামছা আমার মনে হিদয় কইরে দিলাম, বইসতে হইবে।’

বসলাম। বলরামের কথার বাগানে আমি দীন।

বলরাম বললো, ‘এমন কইরে আর একদিনও যমুনার পাড়ে আসি নাই। যদি আইসলাম। তবে একটু গান গাই, অনুমতি দেন।’

বললাম, ‘গাও।’

অমনি মিষ্টি গলায় যমুনার দিকে ফিরে গান ধরলো সে-

‘যমুনে, এই কি তুমি সেই যমুনা
পোরবাহিনী।
ও যার বিশাল তটে রূপের হাটে
বিকাত নীলকান্তমণি।।
কোথা চারু চন্দ্রাবলী, কোথা সেই জলকেলি
কোথা শ্যাম রাসবিহারী বংশীধারী
বামেতে রাই বিনোদিনী।।’

যমুনার রূপ ফিরিয়ে দিল বলরাম। রঙ বদলে দিল। সন্ধ্যাকাশের রক্তরাগে কালিন্দীর এক অংশ আচমকায় লাল হয়ে উঠেছে। আর সারা ঘননীলে ব্যাকুল কালো চোখের ছলছল ঢেউ। শীত, তবু বাতাস বহে ঝিরিঝিরি। বলরাম বললো, ‘কত চোখের জলে নীল হইছ তুমি, সে আমি জানি।’ তাকিয়ে দেখলাম, বলরাম হাসছে আমার মুখের দিকে চেয়ে। বললো, ‘এই তো সেই জল। ভাবি, এখনো কি বাঁশি বাজে ঠাকুরের! ছুটে ছুটে আসে রাইঠাকরুণ? সুরে তাল নাই। বাঁশি বাজবে, পায়ের মলের তাল বাজবে না?’

বলে তার কী হাসি! হেসে বললো, ‘তা হইলে, এই যমুনার পাড়ে বইসেই কই, একবার কি মনে করতেও নাই? লক্ষ লক্ষ গলা পাইছেন, তাই বুঝি আমারে ভুলছেন।’

বললাম, ‘না, তোমার আশ্রমটি তো চিনি না।’

বললো, ‘ওইতো, কেল্লার কাছেই। নন্দগোপাল মাধবাচার্য বাবাজীর আশ্রম। আজ কিন্তুন্ যাইতে হইবে। আমি কি একলা? আর নোক রইছে বইসে আপনার জন্য। রোজ আমারে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর সে কোথায়?’

বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে বলরাম? লক্ষীদাসী?’

সে বললো হেসে, ‘শুধু নক্কীদাসী কেন? সে আছে, আরো আছে। নিজের চোখে গিয়া দেখতে হবে। যাবেন তো?’

বলরামের মুখের দিকে তাকিয়ে আর ‘না’ বলতে পারলাম না।

প্রাক্-চন্দ্রোদয়-মুহূর্তে প্রদোষকালের মতো হাল্কা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে যমুনা কালিন্দী হলো। দুর্গের গাঢ় ছায়া দুলতে লাগলো ঢেউয়ে ঢেউয়ে। সঙ্গমের কোণ-ভূমিতে অস্থায়ী টাওয়ারটি যেন শহরের ওয়াটার ট্যাঙ্কের মতো দেখাচ্ছে। রাজকীয় অতিথিদের জন্য ওটি তৈরি হয়েছে। সাধারণের আরোহণে চার আনা দর্শনী।

টাওয়ারের পাশ দিয়ে, লোকের ভিড় ঠেলে চললাম বলরামের সঙ্গে সঙ্গে। বলরাম আমার পাশে পাশে। আমার হাঁটুতে ঠেকছে তার মাথা। কী আমার ভাগ্য! জন্মবিকলাঙ্গ এক সঙ্গী আমার। না পাই তার মুখ দেখতে। পাশ ফিরিয়ে না দেখি তাকে। সে চলেছে আমার সঙ্গে, মাটি হেঁচড়ে।

আলো জ্বলে উঠেছে এখানে সেখানে। আজ বড় ভিড়। দোকান সম্ভারে পরিপূর্ণ স্তূপাকার বেলোয়ারি চুড়ি নিয়ে দিকে দিকে বসেছে চুড়িওয়ালী ও ওয়ালার দল। আলো পড়ে রঙের বাহার লেগেছে রামধনুর। ঘিরে বসেছে ঝি-বহুড়িরা। তাদের কলহাসি রঙ ছড়াচ্ছে আরো। এদেশের রেওয়াজ। পালা-পার্বণে, উৎসব-আনন্দে লক্ষপতির বউ থেকে দরিদ্র গৃহিণী সকলেই পরেছে রাশি রাশি কাচের চুড়ি। শখ যাদের আরো বেশি তারা কণ্ঠে পরেছে পুঁতির হার। রঙবেরঙের পুঁতির পাহাড় বসেছে। আজমগড়ের কুমোরেরা ছড়িয়ে বসেছে বিবিধ কারুকার্যপূর্ণ মাটির জিনিস নিয়ে। সিগারেট-ফোঁকা বাবুদের মন-ভোলানো ছাইদানি থেকে, আহা মরি মরি,. ভাবের গাঁজার কলকেটি পর্যন্ত। ফুলদানি, টি-পটেরও অভাব নেই।

পা আর মন ওই দিকে ছুটে যায়। বলরামকে ছেড়ে যেতে পারি নে। এই রাতের ভিড়। বলরামকে কেউ মাড়িয়ে দিলেও তার কিছু করার নেই। সঙ্গে যখন রয়েছি, তাকে তো ছেড়ে যেতে পারি নে। কিন্তু আশ্চর্য! হাতে ভর দিয়ে চলেছে, কিন্তু গুনগুনানির কামাই নেই।

বলরাম ডাকলো, ‘ঠাকুর!’

বললাম, ‘বলরাম, ওই নামটি কি বাদ দেওয়া যায় না?’

বলরাম বললো, ‘মন ডাকে। আমি কি ডাকি? ওইটে আপনার নাম নয়, পরাণ ওই বলে ডাইকল আপনেরে। তাতে তো এই সোসারে কেউ দুঃখু পাইবে না। তবে?’

তবে ওই নামেই ডাকুক বলরাম। দুঃখ পাই নে, ভয় পাই। বললাম, ‘কী বলছিলে?’

বলরাম বললো, ‘বলতেছিলাম, আমার ঠাকুরের মুখখানি অমন শুকু শুকু ক্যান? এই কয়দিনে মুক্তিখানিও বড় রোগা হইয়েছে। কষ্টে আছেন?

যার এত কষ্টের জীবনযাত্রা, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কষ্টে আছি কিনা! কিন্তু বলরামের মন ও প্রাণ সম্পর্কে আর সংশয়ের অবকাশ ছিল না। এ সংসারে কতকগুলি চোখ আছে, যাদের কাছে কিছুই ফাঁকি দেওয়া যায় না। তাদের চোখের এক অদৃশ্য মাইক্রোস্কোপ প্রতিটি বিন্দু দ্যাখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বলরাম দেখেছে ঠিক। আখড়াবাসী মূল গায়েন, সংসারের আসন কথাগুলি দেখছি জানে ঠিক।

বললাম, ‘মেলার ব্যাপার। ঘুরে ঘুরে দিন কেটে যায়, তাই হয়তো—’

বলরাম হঠাৎ থেমে বললো, ‘একা-একা কিনা, তাই! সঙ্গে কেউ থাইকলে চখে চখে রাইখতে পারতো। ব্যামো হইলে যে বড় বিপদ হইবে ঠাকুর। সাবধানে বইয়েন।’

বলে সে বাঁক ফিরে, দু-পাশের তাঁবুর মাঝে সরু পথে পড়ল। দুর্গপ্রাকার সামনেই। কানে এলো খোল-করতালের শব্দ। বাঙলা নাচ-গান চলেছে ভারি উল্লসিত কণ্ঠে।

বলরাম থামল। আমিও থামলাম। একটি তাঁবুর কাছে কে দাঁড়িয়েছিল।

অদূরস্থ একটি হ্যাজাক লাইটের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। তাঁবুর পর্দার বাইরে সে মূর্তি মেয়েমানুষের

বলরাম তাকে কী বলতে গেল। কিন্তু চকিত কটাক্ষের ঝিলিকে সে একবার বলরামকে দেখে ভেতরে ঢুকে গেল।

বলরাম গলা বাড়িয়ে বললো, ‘যাইও না, কারে ধইরে নিয়ে আসছি, একবার দ্যাখ গলা নামিয়ে বললো আমাকে, ‘গোঁসা কইরেছে আমার উপুর। চিনতে পারে নাই। আপনারে।’ বলেই বলরামের হাসি। হাসতে হাসতেই গাইল—

‘মানের বশে যাইও না গো, রখো মিনতি,
ভাবো আমার কি হইবে গতি।’

বুঝলাম, মূল গায়েনের লক্ষ্মীদাসী। আমঘাটার আখড়ার অধ্যক্ষা। রাগ করেছে খুবই। কিন্তু, মধ্যবয়সী লক্ষ্মীদাসীর চোখেও অমন অগ্নিবর্ষণ হয়? বুঝি প্রাণে আগুন আছে আরো অনেক। মধ্যমা ঋতু আশ্বিনের ঢলঢল মদালসা গাঙের বিস্তারে চকিত বাতাসের শিহরণ।

জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, এত রাগ কেন! তার আগেই আবার দেখা দিল লক্ষ্মীদাসী। চল্লিশ বছরের বালিকা। লজ্জায় বিস্ময়ে ভরে উঠলো তার বালিকার মতো চোখ দু’টি। কিন্তু হাসতে গিয়ে শীতে ফাটাফাটা ঠোঁট বিস্ফারিত হতে পারে না। তাড়াতাড়ি কাছে এসে বললো, ‘ঠাকুর! আসেন, আসেন! মনে পড়েছে?

বলরাম অমনি বলে উঠলো, ‘মনে কি পড়ে গো! মনে পড়াইতে হয়। ধ্যান কইরে নিয়ে আইসলাম।’

কিন্তু লক্ষ্মীদাসী চেয়ে দেখলো না বলরামের দিকে। হাত জোড় করে বললো, ‘ভিতরে আসেন, এট্টুস বইসতে হইবে, এখনি ছাইড়ব না।’

বলরাম বললো, ‘আসেন ঠাকুর।’

দু’টি তাঁবুর মাঝখান দিয়ে এসে উঠলাম একটি উঠোনে। উঠোনের উপরে সতরঞি পাতা। পুবদিকে একটি ছোট পিতলের শিবিকা। মধ্যে রয়েছে ফুটখানেক দীর্ঘ রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। সামনে নামাবলীধারী কিছু লোক বসে খোল-করতাল সহযোগে ঢুলে ঢুলে দুলে দুলে নাচ-গানে মত্ত। একজন দাঁড়িয়ে ভাবাবেশে হাত তুলে দুলছে। বৈদ্যুতিক আলো নেই। একটি মাত্র হ্যাজাক জ্বলছে। তাঁবু ও হোগলার ঘরগুলিতে কোনো কোনোটাতে জ্বলছে কেরোসিনের বাতি।

বুঝলাম, চারপাশের তাঁবু আর হোগলার ঘরের ঘেরাওয়ের মধ্যে এই উঠোনটি হলো শ্রীআনন্দগোপাল মাধবাচার্যের আশ্রম। সম্ভবত, এই তাঁবু ও ঘরগুলি এ আশ্রমের শিষ্যদের।

আমাকে দেখে একটু বে-তাল হলো আসর। বেশভূষার মিল নেই। বোধ হয় আমার চেহারাতেও বিলক্ষণ গরমিল ছিল আশ্রমের সঙ্গে। নিতান্ত নিরীহ মুখগুলি তুলে বাবাজীরা বড় বড় চোখে কৌতূহলী হয়ে দেখলো। এলাহাবাদ স্টেশনে কাউকে কাউকে দেখেছি এদের লক্ষীদাসীর সঙ্গে। তাদের গায়ে মুখে সর্বদাই গ্রাম্য দরিদ্র বোষ্টমের ছাপ। বুঝলাম, আমার মতো মানুষ এমন আড়ম্বরহীন আশ্রমে আসে না, আসে নি এ ক’দিনে। চোখেই পড়ে না সম্ভবত। আমারও পড়বার কথা নয়। টেনে নিয়ে এলো বলরাম।

আসরের কাছ থেকে খানিকটা দূরে একটি হোগলার ঘরের মধ্যে ঢুকতে হলো। লক্ষ্মী আসন পেতে দিয়ে বললো, ‘বসেন।’

বললাম, ‘দেরী হয়ে যাবে যে।’

বলরাম হাসি মুখখানি তুলে বললো, ‘দেরিতে যে আসছেন। সাধ মিটবে না ঠাকুর, কিন্তু যতটুকুন মিটে ততটুকুন না মিটাইয়ে ছাড়ি কেমনে?’

বলে, লক্ষ্মীর দিকে ফিরে বললো, ‘নক্কীঠাকরুণ, ঠাকুরের মুখখানি বড় শুকু শুক মনে হইতেছে। রাধামাধবের পেসাদ একটুস—’

তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ‘থাক না—’

বলরাম বললো, ‘থাইকতে নাই। কোনো কিছু থেইমে থাকে না। বুকে হাত দিয়া দেখেন, সেও থেইমে নাই। থাক কইয়ে তারে থামাইয়ে রাইখতে পারেন? যেদিন থাইমবে সেদিন সবই থাইমবে। যতক্ষণ চলে, চইলতে দ্যান ঠাকুর।’

জানতাম, বলরামের সঙ্গে কথায় পারবো না। তার তো শুধু কথা নয়! কথার সঙ্গে ছিল তার কালো মুখের নিরন্তর হাসি। ওই হাসি যেন প্রসন্ন বাতাস, উদার আকাশ। সেদিকে তাকালে মূক-মুগ্ধতায় স্তব্ধ হতে হয়। বলরাম ততক্ষণে চোখ বুজে গুনগুন করে গান ধরেছে-

‘চল চল চল রে মন,
কোথায় খোঁজো মনেরি জন।
তুমি যত চল, সেও চলে,
চলে, দিবানিশি সব্বোক্ষণ।’

ফিরে দেখি লক্ষ্মীদাসী। হাতে দু’টি পিতলের ঘটি। কিন্তু সে নিথর বিহ্বল। তার সেই কালো চোখ দু’টি মেলে, সব ভুলে তাকিয়ে আছে বলরামের দিকে। যেন, গুনগুনানির সুরের মধ্যে ডুবে গিয়েছে, একাত্ম হয়েছে গানে। গানে শুধু নয়, রূপে অন্ধ হয়েছে। আমি একটা মানুষ, তাকে নজরে পড়লো না লক্ষ্মীদাসীর। কী দেখছে অমন করে তার মূল গায়েনের দিকে? গুনগুনানি থামিয়ে চোখ তাকালো বলরাম। তার দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল লক্ষ্মীদাসী। একটি উদ্ধৃত নিশ্বাস চেপে ঘটি দু’টি বসিয়ে দিল আমাদের দু’জনের সামনে। দিয়ে পিছনে এসে ধরে দিল দু’টি শালপাতা। দেখলাম, রয়েছে খানিকটা খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, বাঁধাকপির তরকারি, খানিকটা খোয়া। বলরামকেও তাই।

বলরাম বললো, ‘আমাকেও দিলে? ঠাকুরের সঙ্গেই?’

বড় লাগে নিজেরই কানে। জানি নে কী দিয়ে বলরামের মন পেয়েছি! একটি সিগারেট ছাড়া তো কিছুই দিইনি। কিন্তু ‘ঠাকুর ঠাকুর’ করে সে এবার আমাকে ঠাকুর বলিয়ে ছাড়বে।

লক্ষ্মীদাসী বললো, ‘আপনেরা খান ঠাকুর।’

বলে, আমাকে লুকিয়ে লক্ষ্মী আড়চোখে দেখল বলরামকে। খেতে খেতে ভাবলাম, না, বলরামকে আমি হিংসে করবো, সেকথা এ বিশ্বে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু সত্যি বলি, ভাবতে পারি নি, বলরামের জীবনের চারপাশে নিরাপত্তার একটি সুরক্ষিত পাঁচিল আছে। তার খাওয়ায় পরায় আহারে বিহারে কোনো সযত্ন হাতের স্পর্শ থাকতে পারে, একথা মনে আসেনি, তাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম পথেরই ভিখারি, তারপরে আখড়ার মূল গায়েন। আজ আমারই এক পংক্তিতে সে আহারে বসেছে। আমার ঢাকা চোখের সামনে বিস্মিত মুক্ত প্রাঙ্গণ কে খুলে দিলে বুঝতে পারলাম না। লক্ষ্মীদাসী, না বলরাম? হৃদয়াবেগ, ভক্তি ও জ্ঞানের পরিচয় মিলেছিল বলরামের গানে ও কথায়। সে একদিক। আর-এক দিক দেখিয়ে দিল তার লক্ষ্মীদাসী।

হঠাৎ লক্ষ্মীদাসী ডাকলো, ‘ঠাকুর।’

তাকিয়ে দেখি, চোখে তার জল। অবাক হয়ে বললাম, ‘কী বলছ?’

লক্ষ্মী বললো, ‘নালিশ আছে, বিচার কইরতে হইবে আপনারে।

বিচার? এত বড় ভয়ানক দায়িত্ব তো আমাকে কেউ কখনো দেয়নি। তাকিয়ে দেখি, বলরামের হাসি এ-কথায় বাগ মানছে না। সে তাড়াতাড়ি বললো, ‘আমারো মন কইরতেছিল গো নক্কীদাসী, আসো, দুইজনে বিচার চাই এনার কাছে। বেশ, তবে বাদী আগে বলুক, আমি হইলেম পিতিবাদী অর্থাৎ কিনা আসামী।’

বলে, বলরাম হেসে উঠলো। সারাদিনের পর পেটে আহার পড়ে ঝিমনো মনটাও গা-নাড়া দিয়ে উঠলো খানিকটা।

লক্ষ্মীদাসী বললো, ‘ওই তো দেখেন মানুষটা। আর এই মেলা। মেলা নয়, যেন শহরের সড়ক। মানুষ হাতি ঘোড়া গাড়ির কামাই নাই। কথা নাই বাত্তা নাই, য্যাখন ত্যাখন বাহির হইয়ে যায়। কোথায় গিয়ে বইসে থাকে। এট্টা বিপদ আপদ হইলে আমি কোথায় যাইব, বলেন তো?’

বলে, চোখের জল নিয়ে তাকালো লক্ষ্মীদাসী। এতক্ষণে বুঝলাম, কেন লক্ষ্মীদাসী অভিমান করেছে। সত্যি, বিকলাঙ্গ বলরাম। বাইরের ভিড়ে তো সর্বক্ষণই তার প্রাণ-সংশয়।

বলরাম অমনি হাসি মুখখানি তুলে বললো, ‘অনুমতি করেন, এইবার এই নিধম জবাব দেউক।’ বলে, লক্ষ্মীর দিকে একবার দেখে সে বললো, ‘ঠাকুর, জন্মোলুলা আমি। এখেনে নক্কীদাসী আমারে আনতে চায় নাই। জোর কইরে আসছি। কিন্তু এখেনে আইসে যে আমি আর থির থাইকতে পারি না! আমার শরীলখানি ভাঙা, মন যে রয় না। সে যে মানে না। কে আমারে ডাইকলো, জানি না। যদি আইসলাম, তবে এই আখড়ায় পইড়ে থাকি কেমনে! ঠাকুর, আমি যে লুলা, এমন কইরে আর কোনোদিন বুঝি নাই। আইজ বার বার দৌড়বার নেগে য্যাখন ছটফট কইরতেছি, পাখা য্যাখন মেইলতে চাইতেছি, ত্যাখন দেখি, এ পাখা উইড়তে পারে না। যদি আইসলাম, তবে যেটুকু ঠেইকতে ঠেইকতে পারি।’

লক্ষ্মীদাসী আমার দিকে ফিরেই বললো, ‘যদি এট্টা বিপদ আপদ হয়?’

বলরাম বললো, ‘অমঙ্গলের চিন্তা নাই। সোসারে সবই আছে, সেই ভেইবে কি বইসে থাকে কেউ?

লক্ষ্মীদাসী বললো, ‘কিন্তু যদি কিছু হয়, তবে আমার আখড়া যে অন্ধকার হইবে। রাধামাধব তো আর কারুর গানে তুষ্ট নয়!

রাধামাধবের অনুভূতি সম্পর্কে আমার নিতান্ত মানুষসুলভ মন চৈতন্যহীন। মনে হলো, যদি বলরামের বিপদ হয়, তবে এক জায়গায় অন্ধকার নেমে আসবেই। তার গান না শুনলে কোনো এক হৃদয়ের রাধামাধব চিরদিনের জন্য দরজা বন্ধ করবে।

বলরাম বললো, ‘নক্কীদাসী, বাইরে কত নোক! সামনে যমুনে কেমন কলকল কইরে বইতেছে। সেখানে তিনি কান খাড়া কইরে রইয়েছেন। আমি যে আসলজনারে গান শুনাইতে চাই।’

বলে, সে হঠাৎ গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠলো-

‘তুমি যেথায় আছ, সেথায় আছি।
আমার মিছা ভাবনা নাই মনে।
তুমি ডাকলে আপনি কপাট খোলে
তোমার বাতাসে তাল দিয়া নাচি।’

আর কথা নেই লক্ষ্মীদাসীর মুখে। দু-চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো সে বলরামের দিকে। কোথায় গেল নালিশ, বিচার! এইটুকুনির জন্যই বোধ হয় নালিশ, এইটুকুনি পেলে আর কিছু চাওয়ার নেই।

কিন্তু অবাক মানল মন। এই বিকলাঙ্গ মূল গায়েন যে এমনি করে একটি নারীর হৃদয় জুড়ে রয়েছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করতে মন চায় না। বুঝলাম, এ সংসারে হৃদয়ের রীতি বড় বিপরীত পথে ধায়।

লক্ষ্মীদাসীর ধ্যান ভাঙাল বলরাম। বললো, ‘কই, তুমি যে ঠাকুরকে কী বলবা বলতেছিলে আমারে। ধইরে নিয়া আসলাম, বল। একবার পরখ কইরে ল্যাও, কারে ঠাকুর কইছি।’

বলে আমাকে বললো, ‘এই গানখানি সেই আতাউল বাউলের, ঠাকুর।’

লক্ষ্মীদাসী বললো, ‘ঠাকুর, আপনারে সেই কইলকেতার রবি বাউলের গান একখানি শুনাইতে হইবে।’

মনটা চমকে উঠলো। আবার সেই কথা। বলরামের গান শুনে এক নিঃশব্দ সুরতরঙ্গ আপনি দোল খাচ্ছিল আমার গলায়, আমার বুকে, আমার রক্তধারায়। জানি নে কে আতাউল, কিন্তু সে কথা ও সুরের রাজা, সন্দেহ নেই। তা বলে রবীন্দ্রনাথকে সেই দলে নিয়ে আসতে আমার সঙ্কীর্ণ মন বার বার বাধা পেল, তবু শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু অঙ্কিত সেই রবি বাউলের একতারা বাজানো মূর্তিখানা বার বার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বললাম, ‘তাঁর অনেক গান। কোন্ গান যে বাউল তা তো ঠিক জানি নে। তাছাড়া আমি তো গান গাইতে পারি নে।’

বলরাম বললো, ‘তা বইললে শুনব না ঠাকুর। ছলছল চোখে, ছলো হাসি হাসো, তোমায় চিনি গো, চিনি। ওনার একখান গান শুনান, যিনি কন—কবে তুমি আইসবে বইলে রইব না বইসে, তানার গান না শুনলে আমার আমঘাটায় ফিরা যাওয়া বেরথা ঠাকুর।’

ধন্য কথা বলরামের, ধন্য তার স্মৃতিশক্তি। একবার বলেছিলাম, ঠিক মনে রেখেছে। তবু, এই বলরাম যেন সুরের নদী। আজ আমি তার সেই সুর-দরিয়ায় ডুব দিয়েছি। মুখে যা-ই বলি, আমার সমস্ত লজ্জা ও অক্ষমতার সঙ্কোচ ধুয়ে দিয়েছে। সুর ও কথা আপনি ভেসে এলো মনে। বাউল গান জানি নে। তবু ধরে দিলাম। আমার জীবন, সমাজ ও পরিবেশ ভুলে এক নতুন সংসারে মেতে উঠলাম

‘আমার মন বলে চাই, চাই, চাই গো—যারে নাহি পাই গো।
সকল পাওয়ার মাঝে আমার মনে বেদন বাজে—
নাই, নাই, নাই গো।।
হারিয়ে যেতে হবে,
আমায় ফিরিয়ে পাব তবে।
সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে ভোরের আলোয় জাগবে ব’লে—
বলে সে–যাই, যাই, যাই গো।।’

বলরাম ঝাঁপ দিল প্রায় পায়ের কাছে, ‘তবে, তবে ঠাকুর! ফাঁকি দিয়ে পলাইতে চাইছিলেন?’

লক্ষ্মীদাসীর চোখে জল। বললো, ‘আহা, সন্ধ্যাতারা যায় যে চইলে, ভোরের আলোয় জাইগবে বইলে। কী কথা।’

আমার বিস্ময়ের অবধি ছিল না। উচ্চারণে গ্রাম্য দোষ। তবু রবীন্দ্রনাথের গান যে এই গ্রাম্য অশিক্ষিত মানুষগুলির মনকে এমনি করে ভাসিয়ে দেবে, তা কোনোদিন ভাবিনি। মনে করেছিলাম, সে শুধু আমাদের, আমাদেরই। আমাদের এই বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চের চাপা-গলা দুর্বল স্বরের প্যানপ্যানানি-ওয়ালাদের। ফিরে দেখি, হোগলা ঘরের দরজার কাছে জোড় হাতে, দাঁড়িয়ে আরও কয়েকজন। একজন বললে, ‘আর-একখান কিরপা করেন।’

ছি-ছি-ছি। ছিঃ, শেষটায় আমাকে গানের আসরে অনুরোধ!

কিন্তু আর তো বসতে পারি নে। বললাম, ‘আর না বলরাম, এবার উঠব। অন্যদিন হবে।’

বলরাম বললো, ‘আচ্ছা ঠাকুর, এখেনে আর ধইরে রাখব না।’ বলে লক্ষ্মীর দিকে ফিরে বললো, ভাব, মূল গায়েন করবা কিনা?’ বলে হাসতে হাসতে আমার সঙ্গে এলো।

বললাম, ‘তুমি আর এসো না, আমি নিজেই যাচ্ছি।’

বলরাম বললো, ‘নিজে তো যাইতে পারবেন না। আমারে নিয়া যাইতে হইবে।’

বললাম, ‘কোথায় হে?’

সে কথার জবাব না দিয়ে লক্ষ্মীদাসীর দিকে চেয়ে হাসলো। লক্ষ্মীদাসীও। তারপর বললো, ‘চলেন, নিয়া যাই। আমারে রোজ জিজ্ঞেস করে, সে কথার জবাব দিতে পারি না। আজ জবাব দিয়া আস।’

লক্ষ্মী পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়াল। বললো, ‘ঠাকুর, রোজ একবার দেখা দিতে হইবে যদ্দিন আছেন।

বললাম, ‘চেষ্টা করব।’

তাঁবুর বাইরে এসে দেখি, জ্যোৎস্নালোকে ভরে গিয়েছে সারাটি মেলা। আকাশ জুড়ে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ।

বললাম, ‘বলরাম, এখন আর কোনো আখড়ায় যাব না।’

বলরাম বললো, ‘আখড়ায় নয় ঠাকুর। কিন্তু একবার না গেলে যে চইলবে না।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেখানে কে আছে?’

‘যাইয়া দেখবেন।’

পেছন থেকে ছুটে এলো লক্ষ্মীদাসী। তাড়াতাড়ি একখানি কম্বল মুড়ে দিল বলরামের সর্বাঙ্গে। দিয়ে আবার একবার আমাকে মিনতি করে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *