অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ৬

এখনো চারিদিকে অনেক মানুষ। প্রচণ্ড শীত। হাল্কা কুয়শায় ছায়ার মতো চলেছে সব আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে। বোঝা যায়, তাঁবু-কোটরের দিকেই সকলের গতি। আর দেরি সইছে না কারুর। সারা দিনের পুণ্য সঞ্জয় এবার শীতের কামড়ে কাত করে দিয়েছে। আকাশে চাঁদ এসেছে প্রায় মাঝামাঝি। মেঘ ভেসে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। আকাশের কোন্ সীমানায় গর্জন করছে অদৃশ্য উড়োজাহাজ।

সপাং করে চাবুকের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। বালুচরে ঢুকেছে টাঙ্গা, চাকা বসে যাচ্ছে। ঘোড়া দৌড়ুতে পারছে না। যাত্রী ও যাত্রিণীরা সকলেই ঘুমে ঢুলুঢুলু। তাকিয়ে দেখি, চাবুক কোমরে গুঁজে টাঙ্গাওয়ালা ঝাঁপিয়ে পড়েছে চাকার উপর। বুঝলাম, একটু বেশি বালির গভীরে ডুবে গিয়েছে চাকা। চাকাটির প্রতি কটূক্তি করে নিজে হাতে চাকা টেনে টাঙ্গা এগিয়ে নিয়ে চললো সে। শুনলাম জড়ানো যাত্রী কন্ঠ, ‘ক্যায়া, বিমারীবালা ঘোড়া লে আয়া? ভাড়া ঠিক নাহি মিলেগী।’

টাঙ্গাওয়ালা যা বললো, তার মানে, ‘হ্যাঁ, কুম্ভমেলায় ভগবান খালি তোমাদেরই ঘাড়ে চেপে রয়েছে! আমি শালা খালি হাতে ফিরে যাব।’

কোনো জবাব শুনতে পেলাম না। টাঙ্গাওয়ালার কথা শুনে হাসতে যাচ্ছিলাম। হাসতে পারলাম না। সত্যি, পুণ্যসয় তো নয়, যেন সওদাগর এসেছে স্বর্ণরেণুর সন্ধানে।

ফিরতে যাব। কে একজন সামনে এসে দাঁড়াল। আমার কাছেই এসেছে বুঝলাম কেননা লোকটি তার বড় বড় দাঁত বের করে গোল গোল চোখে তাকালো আমার দিকে। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই খানিকটা চাপা উল্লসিত গলায় হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু পাওয়া গেল।’

অবাক হলাম। লোকটির আপাদমস্তক দামী শাল দিয়ে ঢাকা। বয়স অনুমান করা মুশকিল। কুহকী চাঁদের আলোয় যেন এক ষড়যন্ত্রীর মুখ ভেসে উঠেছে সামনে! নিশ্চয়ই লোক ভুল করেছে।

বললাম, ‘আমাকে বলছেন?’

লোকটি বিগলিত গলায় ঘাড় নেড়ে বললো, ‘আরে মহারাজ, তবে আর কাকে বলব?’

আরও বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘কী বলছেন?’

লোকটি অদ্ভুত ভঙ্গিতে তেমনি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু মিলল?’

কী মিলবে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। বরং খানিকটা ঘাবড়েই গেলাম। বললাম, ‘কিসের কী মিলবে, বুঝতে পারছি না তো!’

লোকটি এক মহা-বুদ্ধিমানের মতো ঘাড় দুলিয়ে বললো, ‘কেন গোপন করেছেন মহারাজ। আমি যে সেই অনেকক্ষণ থেকে দেখছি। হুঁ হুঁ, ফাঁকি দেবেন কী করে? আমাকে তো আর দেবেন না। ওকি আর কেউ কাউকে দেয়? কিন্তু কিছু পেলেন কিনা সেইটিই জিজ্ঞেস করছি।’

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কী যা-তা বলছেন! কার কাছ থেকে কী পাব?’

লোকটি বললো, ‘কেন, এই যে দু-ঘণ্টা ধরে সাধুজীর সঙ্গে কথা বলছিলেন! ফিসফিস করে কী বলছিলেন সাধুজী! হুঁ হুঁ, বাবুজী, সব দেখেছি। আপনার কপাল ভালো। তাই ওরকম পেয়েছিলেন। কিন্তু মহারাজ, একটু বলে যান, কী পেলেন থোড়া বহুত।’

আশ্চর্য! হাসব কি কাঁদব, বুঝতে পারলাম না। কী বিচিত্র এই লক্ষ মানুষের মেলা।

মনের মাঝে ভিন্ন তরঙ্গ। সেই তরঙ্গে চলেছিলাম ভেসে। ঠেকে গেলাম। মন পাগল হয়েছিল সরোদবাদককে দেখবো বলে। যে সরোদ বাজিয়ে ফিরছে রামজীদাসীর পিছে পিছে। বাজিয়ে দেখবো, তেমন দুঃসাহস ছিল না। আপনি বেজে উঠেছে আপন মনের তারে। তারের টান বড় চড়া। তার মাঝে এ লোকটি যেন ভিন্ন সুরে ঘ্যাং ঘ্যাং করে উঠলো। কে জানতো মহাবীরের সঙ্গে কথার ফাঁকে হয়ে পড়েছি তার নজরবন্দী।

আবার বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কী পাব বলুন তো?’

লোকটি ঘাড় কাত করে হেসে বললো, ‘আরে বাপরে, সে যদি আমিই জানবো, তবে আর ভাবনা ছিল কী?’

কিন্তু কী যে পাব, তা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। তাকে যতই বলি, কিছুই পাইনি, তত সে চেপে ধরে।

সে বললো, ‘ওই দেখে দেখে আমার চুল পেকে গেল ভাইয়া। আমাকে তো ফাঁকি দেওয়া যাবে না।’

অতএব আমার কালো চুলের কথায় সে মানবে কেন? মনে মনে বললাম শুধু, ‘কী বিপদ!

সে বলে চললো ঘাড় নেড়ে, ‘মেলায় ঢোকবার মুখে, বাঁধের ওপারে দেখেছেন মস্তবড় পাথরের দোকান?’

বললাম, ‘না তো!’

ভ্রূ নাচিয়ে দুর্বোধ্য হাসি হাসলো সে। বললো, ‘তবে আর কী দেখেছেন? ওই একটি লোক মশাই! লাখপতি। কে চিনত ওকে? ও তো লক্ষ্ণৌয়ের রাস্তায় ভিখ মেগে বেড়াত।‘ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘তারপরে একদিন দেখি, ব্যাটা এক সাধুর পেছনে ঘুরছে। কী ব্যাপার? না, দু’দিন বাদে দেখি, শহরে এক ছোট্ট খুপরি ঘর নিয়ে দোকান করেছে। পাথরের ছোট ছোট কটা শিবলিঙ্গ, মহাদেব বিষ্ণু, এইসব। আরে বাপরে, ক’বছরের মধ্যে দেখি, একেবারে একচেটিয়া কারবার করে ফেলেছে! বুঝেছেন? সেই সাধুসঙ্গ। হুঁ হুঁ, আপনি ভেবেছেন, আমি ব্যাটা বুঝিনে?’

হাঁ করে রইলাম। গূঢ় বস্তু-সন্ধানীই বটে। একেবারে পরমার্থ। সিঁড়ি খুঁজছে মোক্ষলাভের। কী ভাগ্যি, রঘুনন্দনের উপাখ্যান পেড়ে বসিনি তার কাছে। সে পরমার্থ যে এখানে অনর্থ ঘটাত।

জানি নে, কী অলৌকিক বস্তু। মনের অগোচরে দেখি হয়তো লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন! কিন্তু কুম্ভমেলায়? এই বালুচরে? সাধুর পেছনে পেছনে? কই, সেরকম কোনো পন্থার কথা তো মনে আসেনি। পাথর কেন? নিজের রক্ত বিক্রি করেও লাখপতি হওয়ার কল্পনা করতে পারি নে।

বললাম, ‘কই, তেমন কিছু পাই নি তো!’

আকুল স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘তবে কী পেলেন?’

মনে মনে বললাম, ‘যা পেয়েছি তা যে বলার নয়। সে তো একটি সুর। ধরাছোঁয়ার বাইরে। ট্যাকে গোঁজা যায় না। পোরা যায় না পকেটে। শুধু কানে শোনা যায়। হেসে ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘কিছুই পাইনি।’

বুঝলাম, বিশ্বাস করতে পারল না আমাকে। চোখে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মুখের হাসিরেখা হয়েছে উধাও। ক্লান্ত জীবের মতো বেরিয়ে পড়েছে জিভ। শাল ঢাকা সত্ত্বেও গায়ে তার মৃদু কাঁপুনি। এ কি রাগ, না হতাশা ঠিক বুঝতে পরলাম না।

এমন সময় ঝনঝন শব্দে ফিরে তাকালাম দু’জনেই। অদূরেই এক বিশাল মূর্তি চলেছে পুবদিকে। একেবারেই উলঙ্গ মূর্তি। মাথার জটা ঠেলে উঠেছে আকাশে। গলায় একরাশ মালা। হাতে একটি সুদীর্ঘ ত্রিশূল। তার গলায় কিংবা ত্রিশুলেই বাঁধা আছে হয়তো কিছু। তারই চাপা ঝনঝন শব্দ বাজছে।

আশেপাশের চলমান নরনারী সকলেই একবার থমকে দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ কেউ হাত ঠেকাচ্ছে কপালে। চলে-যাওয়া পদ-চিহ্ণের ভেজা বালু নিয়ে দিচ্ছে মাথায়।

আমার সামনের লোকটির গলা দিয়ে একটি বিচিত্র শব্দ উঠলো। তা ভায়ের কি পুলকের, বুঝতে পারলাম না। তাকিয়ে দেখি, সারা মুখে তার হাসির দীপ্তি। হতাশা উধাও। চোখে রোশনাই হাজার আলোর। চকিতে শাল খুলে বাঁধল কোমরে। চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো, ‘পেয়েছি পেয়েছি।’

তারপর আমার দিকে তার দীপ্ত চোখের একটি খোঁচা দিয়ে সরে গেল। পা টিপে টিপে অনুসরণ করলো ওই দিগম্বর মূর্তিকে। ছায়ার মতো চললো তার পিছে পিছে। যেন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে, শিকারী চলেছে শিকারের কাছে।

হাসতে গেলাম। হাসতে পারলাম না। বালুচরে তাকিয়ে দেখি লক্ষ লক্ষ পদচিহ্ন। বর্ষার ভেজা মাঠে গোরুর পালের মতো লক্ষ মানুষের পায়ের ছাপ সারা চরে। লক্ষ মনে লক্ষ কামনা বাসনা ও প্রবৃত্তি। সকলেই পাগলের মতো ছুটে চলেছে ঈপ্সিত বস্তুর পেছনে।

আর ওই লোকটি। এই সংসারের বেড়াজাল তাকে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। ও-ই তার সাধনা ধ্যান-ধারণা। তার ভগবান, তার পুণ্য। মিথ্যা সন্দেহে আমার কাছে হতাশ হয়েছে সে। কিন্তু আসা তার মরে নি। মুখে-চোখে তার যে হাসি ও দীপ্তি দেখলাম, সে তো শয়তনের মতো নয়। তাকে শয়তানে পেয়েছে কিনা জানি নে। কিন্তু চোখে-মুখে তার শিশুর সারল্য। লোভ? তা আছে। সংসার তাকে ওই পথ দেখিয়েছে। বয়স হয়েছে তার। এতখানি জীবন সে কাটিয়ে এসেছে ওই স্বপ্ন দেখে। হয়তো অবশিষ্ট আয়ুটুকু নিঃশেষ হবে ওই লাখ টাকার পেছনে। সংসারের এমনি নিয়ম। সারা সংসার দাঁড়িয়ে মজা দেখেছে এতদিন। কেউ ফিরিয়ে আনেনি। আজ সময় হয়ে গিয়েছে। স্বপ্ন আজ আর স্বপ্ন নয়, স্বপ্নসাধনা। সাধন পাগল।

জানি নে তার ঘর ও ঘরের মানুষের কথা। জীবনভোর হয়তো সে এমনি ‘পেয়েছি পেয়েছি’ বলে উল্লাসে বুক বেঁধে ছুটে চলেছে। ছুটবেও ওই ভয়ংকরী সুন্দরী মরীচিকার পেছনে। তারপর একদিন আসবে। হয়তো শেষ দিন। তার পলকহীন চোখে ফুটে থাকবে অভাবিত বিস্ময়, তীক্ষ্ণ ভ্রুকুটি। দু’ফোঁটা জল।

সেদিন সে-সময় তার চোখে ভাসবে কি এ রাতের দৃশ্য? মনে পড়বে কি আমাকে—যে তার কুম্ভমেলায় সব পেয়েও একদিন মিথ্যাচার করেছিল!

হাসতে পারলাম না। বিদ্রূপে বেঁকে উঠলো না ঠোঁট। সেটা হলেই ভালো হতো। নিষ্কৃতি পেতাম মনের কাছে। হেসে চলে যেতে পারতাম পাগল দেখে!

কিন্তু এই মানুষ! ফিরে দেখি, উধাও হয়ে গিয়েছে। মিশে গিয়েছে পায়ের দাগে দাগে। ঝাপসা জ্যোৎস্নালোকিত বালুচরে পাগলা সংসারের প্রেত হয়ে ফিরছে সে। হা হা করে ছুটছে, পেয়েছি পেয়েছি। ভাবি, কোনও এক পাওনা কি একদিন জুটবে না তার কপালে? ঘুচবে না ফাঁকির পাওনা? যেদিন বুক ভরে উঠবে দুঃসহ আনন্দ ও বেদনায়। নিঃশব্দে তার মন গেয়ে উঠবে, পেয়েছি পেয়েছি।

শীত লাগছে। হিম ঝাপটা লাগছে পুরু জামা ভেদ করে। কোলাহল ঝিমিয়ে আসছে। দ্রুত পায়ে ফিরে গেলাম আশ্রমের দিকে।

ভাঙা আসর, তবু আসর আছে। রমজীদাসী নেই, সরোদবাদক চলে গিয়েছে। চলে গিয়েছে মণ্ডলেশ্বরের দল। মাইকের সামনে বসে দু’টি লোক আধা সুর করে ছড়া কাটছে হিন্দিতে। আসরে কিছু নরনারী, কেউ শুনছে, কেউ ঢুলছে ঘুমঘোরে।

সে ভিড় নেই। গেটের কাছে নেই হাড্‌ড্সন অস্টিন। বাদককে ভালো করে দেখবো বলে এসেছিলাম। দেখা হলো না।

সেও ঘুরছে একজনের পেছনে। খুঁজছে কিনা কিছু কে জানে! অমনি কোন্‌ লাখ টাকার মরীচিকার মতো?

ঘুম থেকে উঠে দেখি, কেউ নেই তাঁবুতে। গুলতানি শুনতে পাচ্ছি পেছনে। জামাকাপড় ছেড়ে মুখ ধুতে গেলাম। পেছনটাই দেখছি আসল স্থান। সাংসারিক ব্যস্ততা। হাঁড়ি-কুড়ি উনুন। জলের কলে লাইন। যে রকম ভিড় দেখছি কলে, মুখ ধুতে পাব কিনা কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *