১
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, মন যেন এক সর্বনেশে যন্ত্রবিশেষ। বর্ষে বর্ষে ঋতু বদলায়, তার সঙ্গে রূপ বদলায় এই পৃথিবীর। কত তার রূপ, কখনো দেখি জলশূন্য রিক্ত মাঠ, সহস্র ফাটল ফেটে চৌচির হয়ে আছে। সেই ফুটি-ফাটা মাঠের উপর দিয়ে পাগল হাওয়া হা হা করে ছুটে যায়। মনে করি, রিক্তা ধরিত্রী নিঃশব্দ কান্নায় গুমরে উঠছে। অগ্নিশ্রাবী আকাশ। গাছে পাতা নেই, কলকাকলী নেই বিহঙ্গকুলের। বিশ্বসংসার জ্বলছে নিরন্তর।
আবার দেখি, কোনো অদৃশ্যলোক থেকে সহস্র ধারে আসছে বন্যা। আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি। ভেসে গিয়েছে মাঠ, সবুজ শস্যে ভরে উঠেছে তার বুক। হঠাৎ হাওয়ার শিউরিনিতে সোহাগী গর্ভবতী কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসিতে।
মনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে শূন্য। লোকে বলে, মনের মানুষ মেলে না। তাই কি! মনের সঙ্গে কোনোদিন বোঝাপড়া করলাম না। শূন্য মন নিয়ে আমরা দিবানিশি ছুটে চলেছি বৈচিত্র্যের সন্ধানে। কী চাই জানি নে, পাওয়ার জন্য পাগল হয়েছি। তাই কেউ বলেছে, ‘ব্রেথা তারে খুঁইজে মরা মাটির এই বৃন্দাবনে।’ কেউ বলেছেন, ‘একবার—আপনারে চিনলে পরে, যায় অচেনারে চেনা। মনের এই বিড়ম্বনার কথা আর একজন বলেছেন
‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।
যাহা পাই তাহা চাই নে।’
বৈচিত্র্যের সন্ধান, আমাদের মনেরই সন্ধান। মানুষ খোঁজার ছলে আমরা মন খুঁজি। তাই বন্ধু যখন বিদ্রূপ করে বললে, ‘কেন যাচ্ছ কুম্ভমেলায়? ধর্ম করতে নাকি?’ ধর্মের নামে যে হিসাবে ধার্মিক বোঝায় তা নই, আবার বিধর্মীও নই। আমরা সেই মানিকবাবুর ‘লেবেল ক্রসিং’-এর নায়কের মতো।
বললাম, ‘দেখতে।’
‘কী দেখতে? লক্ষ লক্ষ ধর্মান্ধ মানুষকে?
ধর্মান্ধ! লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি ধর্মান্ধ হয়, তবে খুঁজেই দেখি না কেন, লক্ষ মনের কোন চোখে পরানো আছে সেই ঠুলি! মনে পড়ছে এক প্রৌঢ়া বিধবার কথা। বাঙালি বিধবা কুম্ভমেলায় গঙ্গার উপরে এক ভাসমান সেতুর কোণে বসেছিলেন আহ্নিক শেষ করে। সন্ধ্যা নামছে। আমিও যাচ্ছিলাম জলের দিকে। মহিলাটির গায়ে পা লেগে গেল। বাঙালির ছেলে আমি। সসংকোচে ক্ষমা চেয়ে হাত বাড়ালাম ওঁর দিকে। উনি তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে চিবুকে হাত দিয়ে সশব্দে আঙুলটি চুম্বন করলেন। স্বভাবতই অনেক কথা হলো। ওঁর একটি কথা এখানে বলবো।
কথার পিঠে কথা দিয়ে একবার কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলেন। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন মেলার ভিড়ের দিকে। তারপরে বললেন, ‘বাবা, মানুষ মিলে মেলা, মানুষের মেলা। যখন ভাবি, এই লক্ষ লক্ষ মানুষের মেলায় আমিও একজন, তখন সুখে আনন্দে আমি, আর চোখের জল রাখতে পারি নে।’
এখন মনে পড়ছে সে-কথা। কিন্তু তখন বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘ধর্মান্ধ কিনা জানি নে, তবে মানুষ দেখতে যাচ্ছি। আমাদের সব কিছুতে সাধ মিটতে পারে। সাধ মেটে না মানুষ দেখে মানুষ চেখে। মানুষের চেয়ে বিচিত্র এ সংসারে আর কী আছে?’
বুঝলাম, বন্ধু খুশি হয় নি। বিদ্রুপে বেঁকে ছিল তার ঠোঁট। অনেক তর্ক সে তখন করেছিল। এখন সে তর্কের কথা তুলে লাভ নেই। তর্ক করেও লাভ নেই। আমরা যা দেখি নি, যা পাই নি, তাই দেখবার ও পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। অজানা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
সত্যি, অষ্টপ্রহর মানুষের সঙ্গেই বাস করি। মানুষের কত রূপ দেখি। কিন্তু যেখানে চলেছি, সেখানে আরও কত মানুষ, কত তার রূপ! যে প্রতিবেশীকে বছরের পর বছর দেখেও কোনোদিন চোখে পড়ে নি, পরিবেশের গুণে তার বিচিত্র রূপ দেখে আমাদের মন ভুলে যায়। কী কথা! হাজার দিন দেখেও যে মন ভোলে না, সে একদিন সব ভোলে। মন চিনি না। তাই তো বারে বারে রূপ দেখি।
‘জনম অবধি হম রূপ নেহারনু
নয়ন না তিরপতি ভেল।’
এত রূপের ফেরে ফিরি কেন আমরা! মন খুঁজি। লক্ষ রূপের আরশিতে আমরা নিজের বৈচিত্র্যকে দেখি। এই বৈচিত্র্য হলো নিরিখ, যাকে বলে কষ্টিপাথর। দাগ কাটো। সোনা কি লোহা, নিমেষে তা ফুটে উঠবে।
না, আর দেরি নয়। মন চলেছে আগে আগে, এবার পা চালিয়ে দিই। ডুব দেব লক্ষ হুদি কুম্ভ-সায়রে।
পিঠে নিয়েছি ঝোলা, হাতে নিয়েছি ঝুলি। কিন্তু হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফরম দেখে চক্ষুস্থির। তবুও উঠতে পেরেছি, এক সময়ে গাড়িও ছেড়েছে।
এক ফালি ছোট কামরা। জনা আটেকের বসবার জায়গা। কলকাতাবাসী উত্তরপ্রদেশের এক পরিবারের ছ’জন পরিবার বসেছেন প্রায় দু’টো সিট দখল করে। আমিও পেয়েছি খানিকটা। আরও জনা চারেক উপরে নিচে। এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!
ছ’জনের পরিবারের চালক যে যুবকটি, সে গোটা তিনেক স্টিট্রাঙ্ক সেঁটে দিল প্ল্যাটফরমমুখো দরজায়। দিয়ে আমার দিকে বীরত্বব্যঞ্জক অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলো। অর্থ পরিষ্কার। হেসে জবাব দেওয়া ছাড়া উপায় কী!
আমার আজানুলম্বিত কালো ওভারকোট আর টুপি দেখিয়ে সে ইংরেজি মিশ্রিত হিন্দিতে বললো, আপনাকে দেখাচ্ছে যেন মিলিটারি সেপাই। দরজার দিকে সিরিফ কটমট করে তাকিয়ে থাকবেন। তাহলেই আর কেউ সাহস করে—’
শেষটুকু তার চোখের আধবোজা হাসিতেই পরিস্ফুট। অতএব তার নির্দেশে আমি হলাম এ কুঠরির আর-এক দিকের দ্বাররক্ষী। সন্দেহ ছিল নিজেরই, এ চোখের কটমটানিতে কেউ ঘাবড়াবে কিনা।
এই তো আমরা। কেউ বলতে এলে মন ভারী করি। অথচ সামান্য সুখের জন্য আমরা নিয়ত এমনি অভিনয় করে চলি। নিজের সঙ্গেও করি কিনা কে জানে!
কথায় জানলাম, ছ’জনের পরিবারের দেশ আজমগড় জেলায়। ব্যবসাক্ষেত্র কলকাতা গন্তব্য এলাহাবাদ, কুম্ভমেলা। আমি? আমিও একই পথের যাত্রী। হ্যাঁ? শুনে ভারি খুশি। যুবকটি লাফ দিয়ে উঠে পড়লো ট্রাঙ্কের উপর। নাক ডাকাতে আরম্ভ করলো কম্বল মুড়ি দিয়ে।
পরিবারের মা, মেয়ে আর বউ সামলে দিব্যি এলিয়ে পড়লেন আমার উপরে। ভগবান জানেন, কী খেয়ে ওঁর গতরখানি অমন ভয়াবহ হয়েছে। আমি বেঁকে রইলাম একটা চ্যাপটানো ব্যাগের মতো। ওভারকোটের মহিমায় এত যে ফৌজী কায়দায় কটমট করে তাকালাম, সেদিকে কারুরই হুঁশ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকার ঐকতান শোনা গেল। কিন্তু নথ-নোলকপরা নাকগুলিও যে এমন মেঘগর্জন করতে পারে, তা কে জানতো!
কয়েক হ্যাঁচকাতেই এক্সপ্রেসখানি গজলের দ্রুত লয়ের মতো বাঙলাদেশ পেরিয়ে গেল। মুখ বাড়িয়ে দিলাম বাইরে। অন্ধকারের বুকে অজস্র আলোর সারি, যেন কচি শিশুর হাসকুটে চোখের মতো। অন্ধকার মিহিজামের আলো। যন্ত্রনগরী চিত্তরঞ্জন। সীমান্ত বাঙলার কাঁথামাদুর পচা ছেলে আমরা। বাইরে বড় যাতায়াত নেই। এইটুকুতেই মনে হলো, দেশ ছেড়ে এলাম। এবার মহাদেশের পথে। মহামেলার পথে, লক্ষজনের অকল্পিত বিচিত্র রূপ বিচিত্র নাদে আমার প্রতিটি ধমনীকে ডাক দিয়ে চলেছে। পথে কী আছে কে জানে! মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি কালো কঙ্কালের দু’টি হাত। চমকে উঠলাম। সকলে নিদ্রামগ্ন। আমি প্রহরী।
কঙ্কালসার কম্পিত হাতদু’টো অতিকষ্টে একটি কমলালেবু ছাড়াচ্ছে। এতক্ষণ মুখোমুখি দেখেছিলাম, সামনের সিটে একটি কম্বলের পুঁটুলি। এবার সেই পুঁটুলির মধ্যে দেখছি একটি মুখ। লিকলিকে ঘাড়ের উপর বসানো একটি মাথা। গোঁফ-দাড়ি গজানো শীর্ণ মুখ। কোটরগত চোখ। অস্বাভাবিক উজ্জ্বল সেই চোখের চাউনি। গেঁড়িগুগুলির মতো একরাশ মাদুলি ঝুলছে। কণ্ঠার কাছে।
নিঃসন্দেহে মানুষ। চোখাচোখি হতেই নিঃশব্দে হেসে উঠলো সে। বালকের মতো তার কোটরগত চোখেও হাসির নির্ঝর। ঘাড় বাঁকিয়ে বললো হিন্দিতে, ‘আমি যাব, হ্যাঁ।’
আমাকেই বলছে। অবাক হয়ে বললাম, ‘কোথায়?’
‘কুম্ভমেলায়? কেন, আমি যেতে পারিনে?’
এই সামান্য জিজ্ঞাসায় তার চোখের ব্যগ্রতা দেখে আরও অবাক হলাম। কেন যেতে পারবে না! কিন্তু তার কথা শুনে আমার সন্দেহ হলো, জিজ্ঞেসা করলাম, ‘তোমার কি অসুখ করেছে?’
সে-কথার কোনো জবাব দিল না সে। খানিকক্ষণ ধরে চিবুল কমলালেবু। তারপর আপনা থেকেই বলতে আরম্ভ করলো। তার একটানা কণ্ঠস্বর একান্ত হয়ে গেল ট্রেনের
শব্দের সঙ্গে। বললো, বাড়ি তার বালিয়া জেলায়। কাজ করতো কলকাতার শহরতলীর এক কারখানায়। সেখানে আছে তার বউ, তার ছেলেমেয়ে। বউও কাজ করে। না, তার চেহারা দেখে যেন বয়স ঠিক না করে ফেলি। বয়স তার মাত্র আঠাশ। বউ তার বাইশ বছরের জোয়ানী অওরত। বেচারা তাকে খাওয়া-দাওয়া সবই দিচ্ছিল। সে যে বড় ভালো লড়কী। কিন্তু–
তার রুগ্ন চোখে ফুটে উঠলো অসহ্য যন্ত্রণা। ‘আর সহ্য হয় না এই ব্যামোর কষ্ট, তাই চলেছি কুম্ভমেলায়।’
বললাম, ‘কেন?’
এবার তার অবাক হওয়ার পালা। তাই সেই কোটরগত বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কেন, তুমি জানো না? তবে তুমি কেন চলেছ? জানো না, অসুরের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেবতারা তাঁদের অমৃতকুম্ভ প্রয়াগ-সঙ্গমে লুকিয়ে রেখেছিলেন?’
বললাম, ‘শুনেছি।’
তেমনি মিষ্টি হেসে সে বললো, শুধু শোননি, কেন দুনিয়ার মানুষ যায় সেখানে? কেন মহাপুরুষ সাধুরা আসেন সেখানে স্নান করতে? তাদের চেহারা দেখ নি, কী সুন্দর! কী তার বাঁধুনি! কুম্ভযোগে সঙ্গমে স্নান করলে মানুষ শত বছর পরমায়ু পায়, রোগমুক্ত হয়। তাই তো .. আমি যাচ্ছি।’
বলতে বলতে আলোকিত হয়ে উঠলো তার কালো কঙ্কাল মুখ। বোধ হয় খানিকটা উত্তেজনাও এসেছে তার। কীসের একটা বেগ আসছে তার হৃৎপিণ্ড থেকে। সে তাড়াতাড়ি আবার কম্বল মুড়ি দিল। কম্বলের ভেতর থেকে শুনতে পেলাম একটা ঘড়ঘড় শব্দ, তার সঙ্গে দেহাতী ভাষায় ছন্দিত ঈশ্বরের নাম।
ঘুমন্ত কামরা। বাইরে অন্ধকার। আকাশে অস্পষ্ট নক্ষত্র। গাড়িটা হুড়মুড় করে ছিটকে গেল আরেকটা লাইনে। কত রাত কে জানে!
মিথ্যে বলেনি যুবকটি। ব্যর্থ হয়নি আমার প্রহরা। ফৌজের মতনই বাধা দিয়েছি জন-বন্যার পাগলা গতি।
কিন্তু এই মানুষটি, ওই কম্বলের পুঁটুলিটি কী অপূর্ব! ভাবতে গেলাম, কিন্তু ভাবা হলো না। লোকটির গা থেকে খসে পড়েছে কম্বল। বুকে হাত দিয়ে কাশছে ঘং ঘং করে। কাশির ফাঁকে ফাঁকে বলছে রুদ্ধগলায় : ‘উঃ, বড় তখলিফ, বড় তখলিফ। এখন নয়, হে ভগবান! সে যে অনেক দূর, অনেক দূর।’
কী অনেক দূর! ভীত বিস্মিত হয়ে তার অসহ্য যন্ত্রণা দেখতে লাগলাম। বললাম, ‘কী বলছো?’
সে বললে, ‘খুলে দাও দরজা, জিঞ্জির খুলে দাও। প্রাণ গেল হে ভগবান! এখনো অনেক দূর।’
দরজা খুলে দেব! চাবুকের আঘাতের মতো ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা বাইরে। দরজা খুলে দেব কি!
সে কাশতে কাশতে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘খুলে দাও বাবু, খুলে দাও।’
কথা শেষ হলো না। তার কম্বলের উপর কী যেন চকচক করে উঠলো। তরল পদার্থ। রক্ত। রক্ত তার ঠোঁটের কশে। রাজরোগ যক্ষা।
সে যে অমৃতকুম্ভ সন্ধানের যাত্রী। সে যে শত বছরের পরমায়ুসন্ধানী। এ গাড়ি কি পথ ভুল করেছে!
আর আমি! কত কথা বলেছি নিজের মনে। অমৃতকুম্ভকে হুদিকুম্ভ নাম দিয়ে চলেছি ছুটে। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হলো, কোথায় পালাই। চোখের সামনে কিলবিল করছে জীবন্ত মৃত্যু জীবাণু। পালাও পালাও। বিচিত্রের সন্ধানী, অমৃতের সন্ধানী ভুল করে পা দিয়েছি যমের দোরে।
আশ্চর্য! কেউ উঠলো না ঘুম থেকে। কাশির শব্দে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে শুলো কেউ কেউ। আমি খুলে দিলাম দরজা। বুঝতে পারিনি যে, গাড়ি একটা স্টেশনে এসেছে। ছুটে গেলাম গার্ডের কাছে। গার্ড বললেন, ‘কুড়ি মিনিট দেরিতে দৌড়াচ্ছি আর এখনো রাত রয়েছে, কাকে বলতে যাব বলুন! আপনি তার চেয়ে কামরাটা বদলী করে ফেলুন।’
সেই ভালো, ওই কামরাটি ছাড়া আর সব কামরাতেই আছে অমৃত কুম্ভ! মৃতসঞ্জীবনী। এসে দেখি, ভয়ানক ব্যাপার। ফৌজ নেই দরজায়, বিনা বাধায় ঢুকছে সব বেনো জলের মতো। প্রায় কুড়িখানেক মাথার উপর মাথা। অন্ধকূপ হত্যার জীবন্ত ছবি।
চেঁচিয়ে মারামারি করে কোনোরকমে নেমে এলাম নিজের ঝোলাঝুলি নিয়ে। কিন্তু কেউ দরজা খোলে না। আমি এক দ্বাররক্ষী, পড়েছি অনেক রক্ষীর হাতে। কেউ কথাই বলে না। কিন্তু পড়েও থাকতে পারি না। মন তো আবার বলছে, চলো চলো।
গাড়ি ছেড়ে দেয়। ছুটে গিয়ে উঠলাম একটা আপার ক্লাস কামরায়। তীরের মতো ছুটে এলো কয়েক জোড়া আধ-ঘুমন্ত চোখের বিরক্ত সন্দেহান্বিত দৃষ্টি। গুটিকয়েক অবাঙালি মহিলা ও পরুষ। অস্ত্র ছিল একটি। পরিষ্কার ইংরেজিতে বললাম, ‘একটু বিপদে পড়ে উঠে পড়েছি। যাব এলাহাবাদ। সুযোগ পেলেই নেমে যাব, আপনাদের কষ্ট দেব না।’
চেহারা দেখিয়ে সব বোঝানো যায় না। কথা শুনিয়ে অনুমান করাতে হয়। একটু একটু করে বিরক্ত চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এলো। তারপর একটু বা কৌতূহল। তারও পরে আপার ক্লাস গদির সামান্য একটুখানি জায়গার প্রতি অঙ্গুলিসঙ্কেতের করুণা।
দাম আছে এই প্রত্যাশিত করুণার। করুণা কেন, সভ্যতাই বলা যাক না। বুঝলাম, দু’টি পরিবার রয়েছে কামরাটিতে। একটি পরিবার অন্ধ্রের, আর একটি মধ্যপ্রদেশের। জায়গা দিলেন অন্ধ্রের এক ভদ্রলোক। এঁরা তীর্থযাত্রী। কলকাতার কালীঘাট দর্শন করে চলেছেন প্রয়াগসঙ্গমের কুম্ভমেলায়। ঘুরেছেন আরও অন্যান্য জায়গায়। প্রয়াগ হয়ে চলে যাবেন দেশে। অনেক কথা হলো। বললেন, ‘আপশোস রয়ে গেল, কল্যাণী কংগ্রেস দেখা হলো না।’
সে আপশোস ছিল আমারও। কিন্তু একটা দেখতে গেলে আর একটা ছাড়তে হবে, উপায় কী? তারপর ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন, ‘আপনি কেন চলেছেন প্রয়াগে?’
ভদ্রলোকেরা তিন ভাই। তিনজনেই অদ্ভুত কালো। যাকে বলে নিকষ কালো। মাথার চুলও তিনজনেরই ঘন কুঞ্চিত। সঙ্গে বড় ভাইয়ের বউ। আজানুলম্বিত বেণী ঝুলে পড়েছে সিটের নিচে। দু’টি কানে গুটি আটেক সোনার মাকড়ি, নাকের দু’দিকে দু’টি নাকছাবি। ঘোমটা নেই। কিন্তু ইংরেজি জানে বলে মনে হয়। তাঁরা তিন ভাই ও এক ভাজ, চারজনেই আমার জবাব শোনার জন্য মুখের দিকে তাকালেন।
লজ্জা পেলাম। বললাম, ‘কেন, যেতে নেই?’
‘নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ইয়ংম্যানেরা তো এ সব বড় একটা—’
বললাম, ‘পছন্দ করে না বলছেন তো? ঠিকই। আমিও মাথা মুড়োতে যাচ্ছি না। দেখুন, আমাদের জীবন বড় সীমাবদ্ধ। গণ্ডীবদ্ধ জীবনদর্শনের কচকচি নিয়ে আমরা দিনগত পাপক্ষয় করি। কিন্তু নিজের দেশের কতটুকু জানি! দেখেছি কতটুকু! আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষ যা নিয়ে মরে বাঁচে (তা ভালো কি মন্দ জানি নে), সে তার জাতীয় বিশেষত্ব নিয়ে যেখানে মিলিত হয়, যেখানে আমাদের সমস্ত জাতি হাসে কাঁদে গান গায়, তাকে ইয়ংম্যান হয়ে আমি অবহেলা করবো কী করে! যদি আমার হাসি পায়, তবে আমি কাঁদবো। যদি নুয়ে আসে মাথা তাকে আমি মিথ্যে অহংকার দিয়ে জোর করে তুলে ধরবো না। আমি যদি থাকতে পারি নিরাসক্ত তা-ই থাকবো। এত বড় দেশ, এত মানুষ, কত তার বৈচিত্র্য! আপনাদের দেখবো বলেই তো এসেছি। না এসে পারলাম না।’
আবার বিচিত্রের কথা। ধক করে উঠলো বুকের মধ্যে। এই একই গাড়ির কয়েকটা বগীর পেছনে রয়েছে সেই মানুষটা। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তার সেই যন্ত্রণাকাতর মুখ। এতক্ষণ কী করছে সে? কেমন আছে?
এঁরা আমার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন কিনা জানি না, বিস্মিত হয়েছেন বুঝলাম। কিন্তু আমার আর কথা বলতে ইচ্ছা করলো না। এঁদের কৌতূহল ছিল অনেক, মেটাতে পারলাম না আর।
কাচের সার্শির বাইরে দেখছি আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। রক্তিমাভা দেখা দিয়েছে পূর্ব দিগন্তে। গাড়ি এসে দাঁড়ালো মোকামাঘাটে। নেমে গেলাম প্ল্যাটফরমে। নিচু প্ল্যাটফরম। উত্তুরে হাওয়া দুরন্ত ঝাপটা মারছে। গায়ের মোটা ওভারকোটটা পর্যন্ত পাতলা কাপড়ের মতো উড়তে লাগলো।
বিহারের চেহারা এখন শ্যামল। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছোলা আর মটর অড়হরের কিশোরী ডগা দোলাচ্ছে মাথা। মাথা তার হলুদ ফুলে গিয়েছে ছেয়ে।
গাড়ির পেছন দিকে ভিড় দেখে এগিয়ে গেলাম। আর একবার চমকে উঠলো বুকের মধ্যে। লাল কাঁকরের উপর শোয়ানো রয়েছে সেই মানুষটি। অমৃতসন্ধানী। মুখটি খোলা। শরীর ঢাকা কম্বলে। সে যেন চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে!
মনে পড়ছে সেই বালকের মতো আবদারের সুর, ‘আমিও যাব।’ কেন? না, বাঁচবার জন্য।
আমার যাত্রাপথের প্রথমেই বিচিত্র এই মৃত্যু দৃশ্য। কে জানতো, অমৃতসন্ধানীর পেছনে পেছনে মৃত্যু এসে এই কামরায় ওত পেতে ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। তাই সে বার বার বলেছিল, ‘হে ভগবান, সে যে এখনো অনেক দূরে।’
গাড়ির দরজায় দরজায় কুম্ভযাত্রীর মারামারি, চিৎকার হল্লা। সবাই যাওয়ার জন্য পাগলের মতো ছটফট করছে। তুমি পড়ে রইলে। সে যে এতদূর, তা আমিও জানতাম না। তোমার হয়ে আমি হাজারটা ডুবও যদি সঙ্গমে দিই তাহলেও তোমার আশা আর কোনোদিন মিটবে না। তুমি পড়ে থাকো, আমাদের পরমায়ু নিয়ে আমরা ছুটে চলি। এটাই নিয়ম।
সত্যি এ নিয়ম বড় বিচিত্ৰ।
কত সুখ দুখ আসে নিশিদিন।
কত ভুলি কত হয়ে আসে ক্ষীণ।
নইলে বাঁচতাম কী করে! মনে পড়ে, একটা আধপাগলের মুখ থেকে একবার শুনেছিলাম, ‘শুনি পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। জল আমাদের দুঃখ, স্থলটুকু আমাদের সুখ।’
সেই অপার দুঃখকে ভুলে থাকা ছাড়া উপায় কী? সামান্য সুখের মুখ দেখলেই দুঃখ ভুলে যাব।
তাড়াতাড়ি সেই আপার ক্লাসে এসে তুলে নিলাম নিজের ঝোলাঝুলি। অন্ধ্রের বড়ভাই বললেন, ‘কোথায় চললেন?’
বললাম, ‘আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি, এবার নেমে যাই।’
‘কেন, বসুন না। শুধু শুধু আর কামরা বদলি করে কী হবে। একেবারেই এলাহাবাদে গিয়ে নামবেন।’
ভাবলাম, উনি হয়তো জানেন না যে আমার তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট। বললাম, ‘উপায় নেই থার্ড ক্লাসের টিকিট।’
কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই নামতে দিলেন না। মনে হলো তাঁদের সমস্ত পরিবারটিই নামতে দিতে চান না। চোখমুখ কুঁচকে ভদ্রলোক এমন একটি ভাব করলেন যে, সামান্য টিকিটের জন্য আবার এত ভাবনা কীসের। কিন্তু আমি তো জানি, কালো-কোটধারী একজন আর কর্মচারী সময় বিশেষে কী দারুণ বিভীষিকা। অপমানের ভয়টাই বড়। তাছাড়া আর কী!
তবু বসতে হলো ভদ্রলোকের আগ্রহে। বুঝলাম, ওদিকে মধ্যপ্রদেশের পরিবারটি রুষ্ট হয়েছেন। রুষ্টতার সঙ্গে কিছুটা বিদ্রূপ।
সমুদ্রোপকূলবর্তী প্রদেশের মানুষগুলো বোধ হয় একটু বেশি সেন্টিমেন্টাল। নাকি ইংরেজিতে বলে ‘টাচি’, বোধ হয় তাই। অর্থাৎ আবেগপ্রবণ। সেই আবেগপ্রবণতা মধ্যপ্রদেশের লোকের কাছে ন্যাকামো মনে হতে পারে। আমার উঠে যাওয়াতেই বা কী এমন ভদ্রতা প্রকাশ পেতো।
কিন্তু এক-একটা সময় আসে, যখন মনকে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে পারি নে। অন্ধ্রের লোক আলোচনা পেড়ে বসলেন ধর্মতত্ত্বের। অথচ মন পড়ে রইলো মোকামাঘাটে। মোকামাঘাটের বিছানো লাল কাঁকরের বুকে, যেখানে শুয়ে রয়েছে আমাদের অনেকের সহযাত্রী। তাছাড়া ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় আমার অধিকারই বা ছিল কতটুকু!
পায়ের কাছেই দেখছি ছেঁড়া কম্বল ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে একটি মানুষ। বেরিয়ে আছে শুধু মুখটি। ঘুমন্ত মুখ। বয়স ঠাওর করা মুস্কিল। মুখের উপর ছড়িয়ে আছে একরাশ রুক্ষ চুল। ভাবলাম, এদেরই কারুর চাকর-বাকর হবে।
গাড়িটা হঠাৎ লোকালের মতো থামতে থামতে চলেছে। শত হলেও পশ্চিমদেশ। ভোরের আলোয় যাকে দেখেছিলাম শ্যামাঙ্গিনী, রৌদ্রালোকে দেখলাম শ্যামাঙ্গিনী কিঞ্চিৎ রুক্ষ। যত দূরে চোখ যায়, শুধু জনহীন মাঠ আর মাঠ। অড়হর, কলাই, মুগ আর মুসুরির মাঠ ঠেকেছে গিয়ে আকাশের গায়ে। মাঝে মাঝে হঠাৎ ক্লান্ত চোখের সামনে ভেসে উঠছে গ্রাম। এ গ্রাম কালকাসুন্দের বনঝোপ আর আম-জাম-সুপুরি-নারিকেলের ছায়া-শীতল গ্রাম নয়। আমবাগান আছে বটে, থোকো থোকো কাঞ্চনবরণী বোলে ভরে উঠেছে তার সর্বাঙ্গ। আর আছে তালবন। তারই ফাঁকে ফাঁকে মাটির দেয়াল আর খোলার ছাউনি দেওয়া বস্তি।
অন্ধ্রের ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন, ‘আপনি বোধ হয় আমার কথা ঠিক ধরতে পারছেন না। না না, আমি আপনাকে খুব বড় কথা কিছু বলছিলাম না। আমি শুধু আপনাকে—’ বলতে বলতে থেমে গেলেন। নিতান্ত হুঁ-হাঁ দিয়ে কাজ সারছিলাম। লজ্জা পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখি, তিনি আপন মনে মাথা নাড়ছেন। মাথা নামিয়ে বসে আছেন দুই ভাই। আর তাঁর স্ত্রী তাকিয়ে রয়েছেন বাইরের দিকে। কিন্তু কিছু দেখছেন না। মন-চোখ তাঁর এদিকেই। চোখ দু’টি ছলছল করছে। লজ্জিত করুণ মুখে সামান্য হাসির আভাস জোর করে ফুটিয়ে রেখেছেন তিনি।
তারা চারজনেই যেন বড় বিমর্ষ হয়ে উঠেছেন। মনে মনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন উপনিষদে যে সমস্ত প্রাকৃত—’
‘না না, অতবড় কথা আমি বলতে পারবো না। আমি বলেছিলাম,’এক মুহূৰ্ত ইতস্তত করে বললেন তিনি, ‘জানেন, আমাদের এই চারজনের পরিবারটি একেবারে অভিশপ্ত। আমি নিজে এক জন সরকারী কর্মচারী, আমার ভাই দু’জনও তাই। আমাদের অর্থের অভাব নেই। শুধু একটি অভাবে আমরা সর্বহারা হয়েছি, আমরা পাগলের মতো ঘুরে মরছি সারা দেশ। এই আমাদের কুলগুরুর নির্দেশ।’
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন তিনি। উত্তেজনার পাল্লা দিয়ে হু-হ রক্ত ছুটে আসছে তাঁর স্ত্রীর মুখে। স্বামীর দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে তিনি বোধ হয় নিরস্ত করতে চাইছিলেন স্বামীকে। কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতে পারছিলেন না।
আমার দিকে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আশ্চর্য! মনে হলো, তাঁর ঠোঁট দু’টো কেঁপে উঠলো। তাঁর দক্ষিণী সমুদ্রের অতল ডাগর চোখে ঝিকমিকিয়ে উঠলো অশ্রুর মুক্তাবিন্দু। সপ্তরশ্মি খেলে গেল তাঁর গ্রাম্য নারীর মতো কানে পরা অনেকগুলি পাথরখচিত কর্ণভূষণে। ক্লান্ত কালনাগিনীর মতো পিঠের উপর এলিয়ে পড়ে রইলো রুক্ষ বেণী।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ভুলে গেলাম কুম্ভসহযাত্রীর কথা। কৌতূহলপূর্ণ মন নিয়ে, জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলাম, তিন ভাই ও এক বউয়ের দিকে।
বড় ভাই তাঁর স্ত্রীকে লক্ষ করেই চুপ করে গিয়েছিলেন। আবার বললেন নিচু গলায় ‘জানেন, প্রয়াগের আর-এক নাম তীর্থরাজ। এইবারই আমাদের শেষ, আমাদের আশা-নিরাশার পরীক্ষার শেষদিন এগিয়ে আসছে। এইবারই আমাদের সমস্ত সঞ্চিত পাপ নষ্ট হয়ে যাবে। সংসার পাতবে আমার ভাইয়েরা, আর আমার—’
তাঁকে বাধা দিয়ে এক ভাই নিতান্ত দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলে উঠলেন। মনে হলো, তাঁর স্ত্রীর বিষয়ে কিছু বললেন। তিনিও স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তেমনি দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বললেন। কিন্তু মহিলাটি কোনো জবাব দিলেন না।
আমি যেন এক রহস্যনাটকের বিস্মিত নীরব দর্শক। ভদ্রলোক এবার হাসবার চেষ্টা করে বললেন, ‘আপনি বলছিলেন, অনেক কিছু দেখতে চলেছেন আপনি। আপনার দুর্ভাগ্য যে, আমার মতো একজন লোকের সঙ্গেও আপনার আলাপ হয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না, আমি আমাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত একটা কথা আপনাকে বলছিলাম।’
সমস্ত সংকোচ কাটিয়ে আমি বললাম, ‘কিন্তু আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারি নি।’
তিনি বললেন, ‘ক্ষমা করবেন। আমার স্ত্রীর বড় কষ্ট হচ্ছে। আপনি আসবেন আমাদের ক্যাম্পে। পাণ্ডার কাছে আমাদের খবর পাবেন। আপনি এলে আমরা খুব খুশি হব।’ বলে, তিনি আমাকে সিগারেট দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। তাঁর স্ত্রী তাকালেন শান্ত চোখে কৃতজ্ঞতা নিয়ে, তাঁর আত্মভোলা স্বামীর এবং আর আমার দিকে। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা, বোধ হয় আর কৌতূহল না প্রকাশ করবার জন্য।
বুঝলাম, ভদ্রলোকের ধন মান ও বিলাসের তলে বুকে একটি পাথর চেপে আছে। নিজের অজ্ঞাতসারে কয়েক মুহূর্তের জন্য সরে গিয়েছিল সেই পাথর। মন পেতে বসেছিলেন এক অপরিচিত নগণ্যের কাছে।
মন পাতা হলো, মনের কথা হলো না। এখানে পরস্পরকে গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় কী! ভবিষ্যতের আশা রইলো কিনা কে জানে! আশা এইটুকু, পথের দেখা পথেই শেষ হবে না। আমরা সকলেই চলেছি এক মহাসঙ্গমে। সেখানে হবে মিলন, তারপরে বিদায়। মিলন মুহূর্তে এক হয়ে যায় হাসি-কান্না। সেই হাসি-কান্নার কলরোলে যদি শুনে নিতে পারি তাঁর কথাটি, সেটুকু লাভ।
এখন শুধু মনে রইলো, তাঁদের পরিবারের মধ্যে একটা ট্র্যাজেডি লুকিয়ে আছে তারই প্রায়শ্চিত্ত করে ফিরছেন তাঁরা। প্রায়শ্চিত্তের শেষ দিন আগত। গরলে হবে অমৃতের উদ্ভব ভরে উঠবে তাঁদের তিন ভাইয়ের সংসার।
এমনি ভরিয়ে তোলার জন্যে ছুটে চলেছে লক্ষ মানুষ। লক্ষ জনের লক্ষ রকম কামনা। আমিও চলেছি তেমনি এক কামনা নিয়ে।
কিন্তু আর কতদূর? পুব আকাশের কোল ঘেঁষে দেখা দিয়েছে বিন্ধ্যাচলের উঁচু-নিচু মাথা। বেলাও হয়েছে মন্দ নয়।
পায়ে মৃদু চাপ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি, পায়ের কাছে শোয়া সেই মানুষটি। মুখের চুল সরিয়ে ধূলিরুক্ষ মুখ ভরে হাসছে। তাকাতেই ওই অবস্থাতেই কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করলো।
অবাক হলাম! এদের কারুর লোক নয় নাকি! বললাম, ‘কিছু বলছ আমাকে?’
‘একটা বিড়ি দেন
প্রথমেই বিড়ি, তাও আবার প্রাণের ভাষায়। অর্থাৎ বাঙলা কথায় বুঝলাম, এদের কেউ নয়। বললাম, ‘এখানে উঠলে কী করে?’
হেসে বললো, ‘উঠি নি, উঠিয়ে দিলে নোকেরা। কাল রাতেই আপনার মুখখানি দেখে মনে হয়েছিল, এ আমার চেনা মুখ। এখন দেখছি, ঠিক তাই!’
‘চেনা মুখ? কী করে চিনলে?’
‘কেন! এই তো এতগুলোন মুখ রয়েছে। আমার দেশের মানুষের মতো মুখখানি আর ক্যার আছে, আপনি বলেন।’
ভাবলাম, ধন্য তোষামোদ! কী ভাগ্যি বলে নি বাড়ির কাছের মানুষ! বিড়ি তো নেই। প্রাণধরে দিলাম একটা সিগারেট।
তার কালা মুখের হাসিটি আরও মধুর করে বললো, ‘ছিগরেট দিলেন? তবে এট্টুস নিধমের হাতটা ধরুন, উঠে বসি।’
নিধম মানে অধম করে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু হাত ধরে ওঠাতে হবে কেন বুঝলাম না। বললাম, ‘কেন?’
তেমনি হেসে পায়ের উপর থেকে তুলে নিল ছেঁড়া কম্বলটা। দেখলাম, পা-দুটো হাঁটুর কাছ থেকে বেঁকে ঠেকে রয়েছে পাছার কাছে। উঠে বসতে হয়তো পারে, তবে অবলম্বন চাই।
হাত বাড়িয়ে দিলাম। উঠে বসলো সে। একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, ‘রাস্তায় বসে বসে খাচ্ছিলে, আবার পথে পথে কেন?
‘রাস্তায়?’ হাসতে হাসতে বললো, ‘ভিক্ষের কথা বলছেন? তাই-ই, তবে রাস্তায় তো বসিনি কখনো। পড়ে থাকতাম এক কোণে। রাস্তা আর পথ, যা-ই বলেন এই পেখম থাকতে পাইরলাম না কিছুতেই। দ্যান, দিয়াশলাইটা দ্যান।’
দেশলাই দিয়ে বললাম, ‘যাওয়া হবে কোথায়?’
‘যেখানে সব্বাই চইলছে, সেইখেনে। পেরাগের মেলায়।’
‘আসছ কোত্থেকে?’
‘নদে জিলা। আমঘাটার নাম শুইনছেন, নবদ্বীপের কাছখেনেই? সেইখেনে নক্কীদাসীর আখড়ায় নাম-গান করি। আমি মূল গায়েন।’
বললাম, ‘বৈষ্ণবেরাও কুম্ভের মেলায় যায়?’
সে তাড়াতাড়ি কপালে হাত ঠেকিয়ে বললো, ‘আরে বাপরে, বোষ্টম যাবে না তো যাবে কে? তীখখানি তো বোষ্টমের। ভাগাভাগির কথা যদি বলেন, অন্য মতের সাধকেরা তো জোর করে ভাগ বইসেছে। শিবভক্তরা আইসবে বটে, তবে বিষ্টুভক্তি না চাইলে পেরাগের মাটি আপনার পেন্নাম নেবে না।’
নাকমুখ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো, ‘এটা হলো ঝগড়ার কথা। এ কথা বাদ দেন। ওনার কাছে, ভাগাভাগি নাই, জাত নাই। যানার কাছে এলেম, তারে না ডেকে দলের মারামারি করে লাভ?’
বললাম, ‘এলে তো, ওই পা নিয়ে যাবে কী করে?
সে হাসলো। হাসি তার মুখের ভূষণ। অনর্গল ধোঁয়ার জালের আড়ালে আড়ালে দেখলাম ভিজে ওঠা চোখ দু’টো মুছে নিল। বললো, ‘বাবু, আমার নাম মা-খেগো বলা। অর্থাৎ কিনা বলরাম। আমারে জম্মো দিয়ে মা আর সামলাতে পারে নাই, মরে গেছিল। এই পা দু’টোর জন্যিই। জম্মো-লুলা বইসে ছিলেম, কবে সেদিন আইসবে, যেদিন বেরিয়ে পড়বে। তা এই পা দু’টোর জন্যি পড়ে থাকতি বলেন? বুকে হেঁটে যাব।’ বলে, সে গলা ছেড়ে গান ধরে দিল-
‘অগো আইসবে বলে
পথের মাঝে জীবন কেটে গেল,
তুমি এমনি খেলা খেল।
সবুর-মেওয়া রইলো মাথায়,
চইলব এবার যথায় তথায়,
রোদবিষ্টি আশীর্বাদী।
আমার মাথায় ঢেলো।।’
সকলেই কিছুটা চমকে উঠেছিলেন, আমিও। কিন্তু মা-খেগো বলার গলাটি এমনি উদার ও মিষ্টি যে, ভেসে গিয়েছিলাম। লক্ষ্মীদাসীর মূল গায়েন বলে আর অস্বীকার করার উপায় ছিল না বলরামকে।
বোধ হয়, গানটা আরও বাকি ছিল। মধ্যপ্রদেশের সগুম্ফ বিরাটকায় ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ক্যায়া, অভি গানা ভি শুরু কিয়া?’
বলরাম হাতজোড় করে বললো, ‘আজ্ঞে কী বললেন কর্তা?’
‘উসব কতা ফতা নাহি জানতা, গানা বন্দ কর।
অজেয় হাসি বলরামের। বললো, ‘আচ্ছা বাবু, আর করেগা নেই।
আমি তাকালাম অন্ধ্রের পরিবারটির দিকে। তাঁরা তাকালেন আমার দিকে একটা চাপা ও অর্থপূর্ণ হাসি বিনিময় হলো আমাদের মধ্যে
বড়ভাই বললেন, ‘আপনি এই ভিক্ষুকটিকে চেনেন?’
বললাম, ‘না। চেনা হয়ে গেল।’
বলরাম আমাকে আবার ডাকলো, ‘বাবু।’
বললাম, ‘বলো।’
‘বাবু, মুনিঋষিরা কথা না কইয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। আর আমরা? কাল রাত থেকে মুখ বন্ধ। আর চুপ কইরে থাকতে পারি না। আমার কষ্ট হইবে, সেই ভেবে নক্কীদাসী আমারে এই বাবু-কামরায় উঠিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তুন, নক্কী যদি নরকে থেকেও সঙ্গে নিয়ে যেইতো তবে বাঁচতাম।’
বললাম, ‘লক্ষ্মীদাসীকে ছাড়া বুঝি থাকতে পারো না?’
বলরাম হাসলো মাতালের মতো। বললো, ‘বাবু, পা দুইখান নাই, কিন্তুন মানুষ তো। তাই মানুষ ছাড়া থাইকতে পারি না। থাইকলে নিজে নিজে গান গেইয়ে নিজের পরান তোষ করি। যাচ্ছি পেরাগে জাগ্রত বেণীমাধবের ঠাঁইয়ে। ওঁয়ার কাছে নক্বীদাসী, আপনি, সবাই যাচ্ছেন, সবারে পাব সেখানে। ওই যে বলে না, বলে সে চাপা গলায় গুনগুনিয়ে উঠলো-
‘মাত্তর দু’দিন বইলে কাছে।
মনে কষ্ট হয় পাছে,
তাই, যাবার সময় বইলে গেলে
আরশিখানি লয়ে কোলে।
দেখিস, সে তোর বুকে আছে।’
বলে, সে তার নিজের বুকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো।
বললাম, ‘বলছ বোষ্টম। গানে ত দেখছি পাক্কা বাউল।’
বলরাম খপাত করে পায়ে হাত দিয়ে বলে ডঠলো, ‘খাঁটি কয়েছেন। আপনি জানেন, জানেন সব। যাবার কথা শোনা ইস্তক মন বাউরা হইছে। আজ পথে আসছি, আর চাইপতে পারি না মনটারে। বাবু, বৈরাগ্য এইলে বেরাগী হয়। আসলে আমরা সব্বাই বাউল। সব গানেতেই আপনি ওইটি পাবেন। আবাগী রাই-কিশোরী যে প্রেমে পাগল হইয়ে পথে পা দিছিল, সেও তো একই ব্যাপার।’
পা ছাড়িয়ে নিতে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘পা ছাড়ো হে।’
‘কিন্তু বাবু, আপনি নিশ্চয় গুণী মানুষ। আমারে দুই-একখান পদ শোনান।’
বলরামেরা এমনিতেই পাগল। তাদের খ্যাপালে আর রক্ষে নেই। বললাম, ‘পাগলামি কোর না বলরাম। আমি গুণী নই, গানও গাইতে জানি নে।’
কিন্তু অস্বীকার করতে পারি না, বলরাম আমার এই নীরস শহুরে বস্তুতান্ত্রিক মনকে ভাসিয়ে নিয়েছে তার নিজের স্রোতে। আমার পথের ক্লান্তি, আমার এতক্ষণের ছোটখাটো সুখদুঃখ, সব ডুবিয়ে দিয়েছে সে। আমার জমকালো ওভারকোটটাকে রেয়াত করলো না একটুও। বাবুর মতো মানলো না বাবু বলে। বিকলাঙ্গ বলরাম সমস্ত আড়ম্বর ও আবরণের ভেতর থেকে টেনে বের করে দিল আমার শুষ্ক দেহের ভেতরের মনটাকে। নিজের সঙ্গে তার তুলনা করতে গেলে কোথায় ঠাঁই পাব জানি না। কিন্তু, অন্ধ সংস্কারের বশেই কি বিকলাঙ্গ বলরাম এমনি নিরত হেসে-গেয়ে মূর্তিমান আনন্দের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে? বিশ্বাস করতে মন চায় না। কুসংস্কারের এক চিমটি বেলুনে-ঠাসা জীবন তো এ নয়! না-থাকা ও না-পাওয়ার বেদনা বলরামের প্রাণে তাড়া দিয়েছে। তাড়া দিয়েছে প্রেমসন্ধানের, ভালবাসার। বলরাম ভালোবাসে জগৎ সংসারকে।
বলরাম কিন্তু আমাকে ছাড়লো না। সে তেমনি গুনগুন করে চলেছে, ‘পথের ধুলো সোনা হইল, এবার চোখের জল দিয়ে রসকলি কাটবো/তোমারে ছেইড়ে তো দিব না।’
গান ছেড়ে আবার কথা আরম্ভ করলো, ‘আর ভাববো না, সে কতদূর। গাড়ি তো একসময় থামবে। সময় হইলে আপনি নামিয়ে দেবে। কী বলেন বাবু অ্যাঁ?’ বলে আবার
গান-
‘সবাই বলে যৈবন জ্বালা,
তবে এ যৈবন যাক চলে যাক।
কী হবে এ কালো কেশে, নীল বেশে
এ পোড়া অঙ্গ তোমার চরণ পাক।’
কী ভাগ্যি, গলা নামিয়ে গাইছিল। মধ্যপ্রদেশের ভদ্রলোকের তন্দ্রা ভাঙছিল না তাতে। অন্ধ্রের পরিবারটি অবাক হয়ে পাগলামি ও পাগলামির দর্শককে দেখছিলেন। বললাম, ‘বলরাম, তোমার প্রথম গানটি বেশ। কার গান ওটি?’
‘বাবু, ও পদ আতাউলের। আতাউল বাউল তার নাম।’
বললাম, ‘তোমাকে একটা গানের লাইন বলি শোনো। তমার ঐ গানের মতোই যেন এটিও—
‘কবে তুমি আসবে বলে রইব না বসে,
আমি চলব বাহিরে।
শুকনো ফুলের পাতাগুলি পড়তেছে খসে,
আর সময় নাহিরে।।’
বলরাম আবার আমার পায়ে হাত দিতে এলো, ‘তবে নাকি জানেন না? আর কবে সে আইসবে, সেই আশায় আমি মরা পা নিয়ে বইসে থাকবো! বাবু, পেরাগের সঙ্গমে কি আর হাঁড়ি ভরা মধু আছে? তা নেই। আছে অমর্ত। অমর্ত-কুম্ভ যে! সে-অমর্ত প্রেম-অমর্ত, ডুবলে পরান শীতল হবে। বা-বা! বা-বা! কী সোন্দর পদ! পদখানি ক্যার বাবু?’
কার পদ! আশ্চর্য! কুম্ভমেলা যাবার পথে কবিগুরুর গান নিয়ে যে এমনি এক মা-খেগো বলার সঙ্গে আলাপ করতে হবে, তা কে জানতো! আর কেমন করেই বা তাকে সে-কথা বলবো!
বললাম, ‘পদকর্তার নাম রবিঠাকুর।’
আলোয় আলো হয়ে উঠলো বলরামের চোখ, ‘রবিঠাকুর! ঠাকুর তো বটেই, রবিও বটে। নইলে এমন পদ বেরোয়! তা উনি কোথাকার বাউল বাবু?’
কোথাকার বাউল! হায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ! বলরাম তোমাকে কোথায় টেনে নিয়ে এলো! তার বুকে ঠাঁই দিয়ে তোমাকে সে খাটো করলো কিনা বুঝলাম না। বললাম, ‘কলকাতা।’
বলরাম বললো, ‘তা হোক। কেঁদুলির জয়দেবের মেলায় নিচ্চয় দেখেছি ওঁয়ারে, এখন মনে নাই। পোষপুণ্যিমেতে সব বাউল বাবাজীকে এখানে আসতেই হবে কিনা একবার!’
জানি, এক কথায় রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিতে পারবো না আমি। দু’কথায় রবিঠাকুরের কল্পিত বাউল-মূর্তি অদৃশ্য হবে না বলরামের মন থেকে। আবার এও ভাবি, বলরামের ভুলই বা কোথায়, যে ভুল ভাঙব! মন যার বাউল হয়নি, তিনি বাউল গান গাইলেন কেমন করে।
আচমকা ঝড় এলো। ঝড়-ই বলি। হঠাৎ একটা তুমুল গণ্ডগোল আর তার সঙ্গে শিলাবৃষ্টির মতো কামরাটার মধ্যে এসে পড়তে লাগলো বাক্স, প্যাটরা, বোঁচকা, পুঁটুলি। প্রতিবাদের অবসর ছিল না। অবসর ছিল না তাকাবার। যে যার মাথা বাঁচাতেই ব্যস্ত। তার সঙ্গে একটা বাজখাঁই মহিলা কন্ঠের চিৎকার, ‘শ্যামা! প্রেমবতী। ইধার, ইধার মে। বুঢ়া কো উঠাও। পাতিয়া, এ পাতিয়া। ছোকরি বহেরা হো গয়ী। শুনতি কি নহি? শ্যামা, হাঁ হাঁ তু কোণে চলে যা।’
মনে হলো, আমার ঘাড়ের উপর একটা দু-মণি বোঝা পড়ল।
তারপর ব্যাপারটা যখন একটু শান্ত হলো, তাকিয়ে দেখি, পিঠের কাছে মস্ত বস্তা। বস্তার উপর হয় প্রেমবতী, নয় শ্যামা কিংবা পাতিয়া। তার পায়ের কাছে জুজুবুড়ির মতো এক ঘাড় নোয়ানো বুড়ো। দরজার কাছে দু’টি যুবতী আর এক প্রৌঢ়া। বুঝলাম, ওই প্রৌঢ়ারই কন্ঠস্বর আমি শুনেছি এতক্ষণ। তারা সকলেই মাল সাজাতে ব্যস্ত। বোধ হয় উঠতে পারার আনন্দেই মহিষাসুরমর্দিনীর মতো আমার ঘাড়ের উপরে মহিলাটি খিলখিল করে হেসে উঠে বললো, ‘আরে বাপরে, গাড়ি মে উঠনা এক আজীব কাম হ্যায়।’
ওদিকে মধ্যপ্রদেশের পরিবারটি যুদ্ধংদেহী অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়তে উন্মুখ। অন্ধ্রের পরিবারটিও সামলাতে ব্যস্ত।
গাড়ি ছেড়ে দিল। তারপরেই আসল যুদ্ধ শুরু। মধ্যপ্রদেশের সেই ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠতেই নতুন দলের প্রৌঢ়া গলা সপ্তমে উঠিয়ে আরম্ভ করলো। যা বললো, তার বাঙলা করলে এই হয়, ‘থার্ড ক্লাসের টিকিটই হোক, আর যা-ই হোক, আমি চড়বই। নিয়ে এসো তোমার পুলিশ আর মিলিটারী। আমাকে মারুক আর কাটুক, আমি কিছুতেই পড়ে থাকতে পারবো না। টাকা নেই বলে কি আমি তীর্থটুকুও করতে পারবো না? খালি তোমরাই যাবে? উঠেছি তো বটেই, এবার তোমার যা খুশি তাই করো।’
তার কথার ফাঁকে ওদিকে দুই যুবতী কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। আমার ঘাড়মর্দিনীও যুবতী। কিন্তু আমার শক্তির তো একটা সীমা আছে! অবাক হয়ে অবশ্য এও ভাবছিলাম যে, যাবে তীর্থ করতে। কিন্তু সঙ্গে এতগুলি অল্পবয়সী মেয়ে নিয়ে কেন? বাঙলাদেশে তো এর ব্যতিক্রমই দেখি।
বললাম, ‘এই, দেখিয়ে, আপ উত্তর যাইয়ে হামারা ঘাড়সে।’
ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো মেয়েটি। ভাবখানা, এ আবার কে গা! তারপর হেসে পরিষ্কার গলায় বললো, ‘আরে ভাই সবকোইকা তলিফ, কিসিকো তো একেলি নহি। এ দেখো, আদমিলোগ ঝগড়া কর রহে!’
বলে, সে তার বলিষ্ঠ দেহটি সামান্য সরিয়ে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে হাসলো। অর্থাৎ, হলো তো? কতখানি হলো, সে আমিই জানি। আর খানিকক্ষণ বাদে আমার উঠে পড়া ছাড়া গতি নেই। কিন্তু–
কিন্তু বলরাম কোথায়? বলরাম! মা-খেগো বলা? পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখি, একরাশ মাল আমার বুকসমান উঁচু হয়ে আছে। তবে কি চাপা পড়ে গিয়েছে বলরাম? এক সহযাত্রীকে রেখে এসেছি মোকামাঘাটে। বলরামকেও রেখে যেতে হবে নাকি?
কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি উঠে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলাম মালপত্ৰ।
যা ভেবেছি, তাই। দেখি বলরাম হাসছে। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। ফুলে উঠেছে কপালটা, রক্ত ফুটে বেরুচ্ছে, তবুও হাসছে। তার হাসি আমার সমস্ত হৃদয় জ্বালিয়ে দিল। মরতে মরতেও সে হাসবে নাকি?
হাসুক। তার মতো হাসি তো সকলের নেই। মুখ গোমড়া করে তুলে বসালাম তাকে। মালপত্র ছুঁড়ে ফেলতে দেখে, নতুন দলের সকলে হা-হা করে তেড়ে এলো আমার দিকে।—’আরে আরে, আদমি আন্ধা না কি? দিলে সব মাল চৌপাট করে।’
বললাম, ‘আন্ধা তো মনে হচ্ছে তোমরাই। তোমরা যে একটা জান চৌপাট করে দিচ্ছিলে।’
জান! জানো কোথায়! এতক্ষণে উঁকি মেরে দেখলে তারা বলরামকে। কিন্তু বলরাম ছিল তার সেই কপাল-ফোলা মুখ নিয়ে। সে-হাসি দেখে আমার গায়ের মধ্যে আরও জ্বলে উঠলো।
এক মুহূর্তের নীরবতা। প্রথমে হেসে উঠলো প্রৌঢ়া। তারপর শ্যামা প্রেমবতীয়ার দল।
হাসির কারণ বুঝলাম না। তাকিয়ে রইলাম বিস্মিত বোকার মতো।
হাসেনি ওদের একজন, সেই বুড়োটি। সে হাতের লাঠির ডগায় নড়বড়ে থুতনিটি রেখে তাকিয়ে দেখছিল আমাকে। মোটা সাদা ভুর তলায় তার সেই চোখে বিরক্তিপূর্ণ অনুসন্ধিৎসা, এতখানি বেলাতেও তার আপাদমস্তক শাল দিয়ে ঢাকা। তার নাকের দু’পাশের গভীর রেখা দেখে মনে হলো, সে বীতশ্রদ্ধ এ জগৎসংসারের উপর। জীবনে হাসির পালা তার শেষ হয়েছে। আর কোনোদিন সে হাসবে না।
হাসি থামিয়ে প্রৌঢ়াই প্রথমে বললো, ‘আহা, বেচারা!’
আর একজন, ‘সাধু নাকি?’
পার্শ্ববর্তিনী, ‘বোধ হয়।
প্রৌঢ়া করুণ মুখে বলে উঠলো, ‘শ্যামা, দিয়ে দে বেচারাকে দু-চার পয়সা।
শ্যামা নামধারিণী অচিরাৎ আঁচলের বদলে ট্যাঁক থেকে এক আনা পয়সা বার করে ছুঁড়ে দিল বলরামের কোলে। তারপর প্রৌঢ়া আমার দিকে ফিরে বললো, ‘আরে ভাই, দেখা নহি উনকো। গোসা না করো।’
বলেই, আবার তারা তাদের মালপত্র গোছাবার জন্য লাফালাফি, ঘাড়ে ওঠাউঠি শুরু করে দিল। যত না মালপত্র সাজায়, তত সামলায় বুড়োকে। বুড়ো যেন তাদের সাত রাজার ধন এক মানিক। কেন, কে জানে! সেই সঙ্গেই স্ব-ভাষায় কী একটা কথা নিয়ে হেসে খুন হচ্ছে সকলে। আর আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে আমাকে। কেন, তারাই জানে!
তারা শুধু খ্যাপা হাওয়ার মতো আসে নি। খ্যাপা তারা নিজেরাও। তাদের হাসি কথা কাজ দেখে তাই মনে হয়। যেন খাঁচার পাখি খাঁচাছাড়া হয়েছে। মাতিয়ে তুলেছে বনপালা।
তাদের চারজনের মধ্যে প্রৌঢ়াসহ তিনজনের দেহে সাবেকী ধরনের সোনার অলংকার। জামাকাপড়েও গ্রাম্য অবস্থাপন্ন পরিবার বলেই মনে হয়। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে এই বাঁধনছাড়া কলকাকলীর মধ্যে তাদের স্বাস্থ্যের ঔজ্জ্বল্য।
মধ্যপ্রদেশের শার্দুল তখনো হাত-পা গুটিয়ে বসে গজরাচ্ছেন। অন্ধ্রের পরিবারটির শান্তিভঙ্গ হয়েছে বিলক্ষণ। তবু মনে হলো, তাঁরা উপভোগ করছেন সমস্ত ব্যাপারটা।
বলরাম বিকলাঙ্গ। পরিচয়ও তার সঙ্গে সামান্য। তবু মনটা আমার বিমুখ হয়ে উঠলো তার প্রতি। কী বলে সে আনিটা নিয়ে হাসছে আমার দিকে চেয়ে! যারা অমনি আঘাত করে তার মাশুল দেয় এক আনা, দিয়ে আবার নির্লজ্জের মতো হাসে, তাদের প্রতি বলরামের এত অনুরক্তি কীসের! বলরামেরা চিরকালই এমনি! ছিঃ, ওর সঙ্গে আর কথা বলবো না।
দু’মিনিট গেল না। বলরাম আবার ডাকলো, ‘বাবু।’
যেন শুনতে পাই নি, এমনিভাবে তাকিয়ে রইলাম অন্যদিকে। কিন্তু বলরাম চাপা ও খুশি গলায় বললো, ‘এতক্ষণে শুকনা খালে জোয়ার এইল। বাবা! এতক্ষণ এই কামরাটাতে বইসে মনে হচ্ছিল না যে পেরাগে যাচ্ছি। এইবার দেখেন তো, কেমন কলর-বলর গমগম কইরছে।’
আমি জবাব দিলাম না। কিন্তু সে আপন মনে বলেই চললো, ‘বুইঝলেন বাবু, বলে মানুষ নিয়ে কথা। বেঁইচে আছি যদ্দিন, তদ্দিন মানুষ ছাড়া গতি নাই। একলা সুখ, একলা দুখ, এ কি হয়! তবে মরণ ঘনাইলে অত কান্না কীসের, অ্যাঁ? ছেইড়ে যাবার ভয়েই তো! আসুক আরো আসুক। কী বলেন বাবু, যে কয় একলা চলি, সে তো চলে দোকলার জন্যি। নইলে চইলতে যাবে কেন, অ্যাঁ?’
কাঁচা কুয়োয় উপরের জল চুইয়ে পড়বেই। তা রোধ করবে কে? বলরামের কথাগুলি ঠিক কানে এসে ঠেকছিল। শুধু ঠেকছিল না, অবাক করছিল আমাকে। শাসন, রাজনীতি, নিরাপত্তাহীন জীবন, সব মিলিয়ে আমাদের মনে অনেক সন্দেহ, অনেক সংশয়, অনেক সঙ্কীর্ণতা। দিবানিশি পা টিপে টিপে চলেছি চোরাবালি এড়িয়ে। এই জীবনেই ফাঁক পেয়ে আবার দৌড় দিয়েছি অমৃত-কুম্ভের সন্ধানে, ভারতের সেই বিচিত্র রূপের রসে ডুব দেব বলে। সে রূপ লক্ষ লক্ষ হৃদয়েরই, কিন্তু বলরামের এ কীসের রস! এ কি তার নিরক্ষর অন্তরেরই বিশ্বাস, নাকি শুধু কথার জাদু! মানুষের প্রতি তার এত টান! নাকি টানটা চার পয়সার!
ফিরে তাকাতেই চোখে পড়লো বলরামের ফোলা কপাল। লাল জায়গাটিতে বিন্দু বিন্দু রক্তও দেখা দিয়েছে। তবু সে হাসছে। অম্লান হাসি দেখে সহজে মনে পড়ে শুধু বৌদ্ধ শ্রমণদের কথা। কিন্তু এ যুগে তা অচল এবং অবিশ্বাস্য। গলায় আমার আপনিই ঝাঁজ এসে পড়লো। বললাম, ‘তোমার কি একটুও চোট লাগে নি?’
বলরাম বললো, ‘চোট আমার লাগে নি বাবু? কিন্তু কাঁদবো কার কাছে বলেন! কাঁদলে লাভ? ওনারা কইবেন, দেখি নাই বাপু। মিটে গেল। তাই বলে পইড়ে থাকবো না, চইলব। চইলতে চোট লাগে না বাবু? আপনার লাগে না?’
আবার সেই কথার ফুল ফোটানো। সে-ফুলে এমন গন্ধও ছিল যে, চট করে জবাবও দিতে পারি না এই সামান্য বলরামের কথার।
সে আবার বললো, ‘বাবু, নোকে সংসার চালায়। সংসারে কত ব্যথা, কত চোট। সেখানে পেটে চোট, মনে চোট। পেটে দানা নাই, বুক-জোড়া মানুষটি নাই, হাজার চোট খেয়েও থেমে আছে কেউ বলেন?’
তর্কের অবকাশ ছিল কিনা জানি নে। কিন্তু হেরে গেলাম। জানি নে, কোন্ পথে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। আমাকে আবার ভাসিয়ে নিয়ে গেল তার স্রোতে। একটা সামান্য নুলা বলরামের কাছে হার মেনে গেল আমার বিদ্যাবুদ্ধি। অন্তত এই মুহূর্তের জন্য সে আমার মনের দুকূল ভাসিয়ে ভরিয়ে দিল।
এর পরে আর ওই চারটে পয়সার কথা বলে তাকে আঘাত দেওয়ার কথা আমার মনে আনতে সংকোচ হলো। আমার মন তো বলরামের মন নয়।
তৃতীয়বার বলরামের হাত এসে ঠেকলো আমার পায়ে। ছি ছি, অমন পায়ে হাত কেন বার বার! বললাম, ‘কী বলছো?’
দেখলাম, বলরামেরও সঙ্কোচ হয়। বললো, ‘অ্যালবাদ ইষ্টিসনে এট্টুস হাত দুইখান ধরবেন, কোনোরকমে একবার টেনে-হিঁচড়ে ফেলতে পারলেই হইবে। আপনি একলা মানুষ, তাই কইলাম।
বলে, সে আমার মুখের দিকে ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে রইলো। সেই চোখে দেখতে পেলাম বোধ হয় বলরামের আসল রূপ। সে রূপ এক বিকলাঙ্গর করুণ অসহায় রূপ এ সংসারের আয়নায় বোধ হয় এটাই তার প্রকৃত মূর্তি। আর এ রূপই বুঝি তাকে দিয়েছে প্রাণ-ভোলানো সুর, গলা, কথা ও মন।
বললাম, ‘পায়ে হাত দিও না। দেব, নিশ্চয় নামিয়ে দেব।’
ব্যস। আবার গুনগুন।