অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ২

কথায় বলে, বানের জল একবার ঢুকলে আর রক্ষে নেই। শ্যামার দল ঢুকে আপার ক্লাসের আভিজাত্য ও গাম্ভীর্যে চিড় ধরিয়ে দিয়েছিল। এর প্রতিটি স্টপেজ থেকে কলকল নাদে ধেয়ে এলো বন্যা। এবার সাধারণ পুণ্যার্থীর সঙ্গে সাধু। গণমনের গঠন-প্রকৃতিও এমনি বিচিত্র যে একবার যেদিকে ঢল নামে, সবাই ছুটে চলে সেদিকে। জানি নে, অন্যান্য কামরাগুলির কী অবস্থা। কিন্তু এখানে আমাদের মুখে মুখে ঠেকে গেল। যেমন ঠাসাঠাসি, তেমনি কলরব। শুধু খুশির অন্ত নেই বলরামের।

মানুষ বিরক্তিতে ও হতাশায় হাসে। অন্ধ্রের বড় ভাই তেমনি হেসে বললেন, ‘কিছু করবার নেই, কী বলেন? কী ভাগ্যি, আমাদের গন্তব্য আর বেশি দূরে নয়।’

বললাম, ‘আমাদের সকলের বোধ হয় একটাই গন্তব্য।’

বড় ভাইয়ের মধ্যেও বোধ হয় বলরামের মতো একটা পাগলামি ছিল। বললেন, ‘কী করে বলি বলুন! আমাদের সকলের গন্তব্য এক হতে পারে না। আমি সম্পূর্ণ অন্য পথের যাত্রী।’

বলে, তিনি চুপ করে গেলেন। ঘুরে-ফিরে তাঁর সেই পারিবারিক ট্র্যাজেডির কথাই আসছে। পথ যত সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে, তার পাথরের মতো নিকষ কালো মুখে তত পরিস্ফুট হয়ে উঠছে গভীর ফাটলের চিহ্ন। সম্পূর্ণ অন্য পথের যাত্রী, অথচ চলেছেন সেই প্ৰয়াগেই।

ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে মধ্যপ্রদেশের ক্ষিপ্ত অথচ অসহায় শার্দুলের। তারা মহিলাপুরুষ মিলে কিছুক্ষণ রীতিমতো ঝগড়া করেছেন। এমন কি ভয়ও দেখিয়েছেন, কর্তৃপক্ষকে বলে এদের নামিয়ে দেবেন।

কাকস্য পরিবেদনা। কাকেই বা বলা! যাদের বলছেন, তাদের ভয়ের লেশমাত্র নেই। ভয় নেই, আছে শুধু এক বিষম সংশয়। এত কাছে এসেও তাদের শুধু সংশয়, তারা যেতে পারবে কিনা। ভয় তারা পেছনে ফেলে এসেছে। নিষ্ঠুরের মতো এর চুলের মুঠি ধরে, ওর মুখে পা দিয়ে, যেভাবে সবাই হন্যে হয়ে উঠেছে যাবার জন্যে, দেখে মনে হচ্ছে, প্রাণকেও তুচ্ছ করেছে তারা। যে যার নিজের ভাবনায় নিজে উন্মাদ। পাশের মানুষটির কথা ভাববার অবকাশও নেই কারুর। সে যদি অপরের পেষণে পীড়নে আর্তনাদ করে ওঠে, তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই কারুর।

পাগলা হাতি ছুটতে দেখেছিলাম কুম্ভমেলায়। লিখতে বসে সেই উপমা মনে পড়ছে। এক নির্মম প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে সকলে। কে পড়ে থাকবে, কে মরবে, সেটা বড় কথা নয়। আমি যাব। সামনে পড়ে আছে তার জীবন-যৌবন, আজন্মলালিত কাম্যবস্তু, তার ধ্যানধারণা।

বৃথা দোষ ধরেছিলাম শ্যামাদের দলের। এখন আর ছোট কামরাটিতে খুঁজে পাওয়া দায় শ্যামাদের। তারা চারটি মেয়েমানুষ নিজেদের সমস্ত পেষণ যন্ত্রণার মধ্যেও আগলে রেখেছে সেই বুড়োকে। আমি আগলে রেখেছি বলরামকে।

আস্তে আস্তে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে কামরার অবস্থা।

আর কতদূর! দূর নেই আর। ক্রমে এলাহাবাদ শহরের সীমানায় ঢুকলো গাড়ি।

ভেবেছিলাম, সকালেই পৌঁছাবো। চারটের সময় গাড়ি দাঁড়ালো এলাহাবাদে। তা দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই, দেখতে পেলাম দুমদাম করে মালপত্র পড়ছে প্ল্যাটফরমের উপর। পড়ছে আমাদেরই গাড়ির দরজা-জানালা দিয়ে।

এসে পড়েছে। একটিমাত্র কথার অপেক্ষা। সত্যিই এলো কিনা, সন্ধানের প্রয়োজন নেই। শোনামাত্র সংক্ষিপ্ত স্থানে পাক-খাওয়া ঘূর্ণিজলের আবর্ত মুহূর্তে পথ পাওয়ার জন্য ফুলে ফুলে উঠলো। অকস্মাৎ এই স্ফীতিতে একটা তীব্র আর্তনাদ উঠলো সারা কামরাটার মধ্যে। ‘মরে গেলুম বাবারে। মেরে ফেললে, মেরে ফেললে।’

কারুর হাত ভাঙল, পা ভাঙল, গুঁতো খেয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়লো মুখ দিয়ে। এরই মধ্যে বাঁদরের মতো কুলিদের লম্ফ-ঝম্ফ। স্টেশনে মাইকের চিৎকার, হাজার হাজার নরনারীর কলরব। গাড়িটা ফিরোজপুর এক্সপ্রেস। যাত্রীরা নামবার আগেই অন্য যাত্রীর দল ওঠার জন্য ঠেলাঠেলি করছে দরজার কাছে।

প্ল্যাটফরমের উলটো দিকে নামবার সুবিধা নেই। আমার হাঁটু চেপে ধরে চুপ করে বসেছিল বলরাম। বুঝলাম, উপায় নেই। এর মধ্যেই নামতে হবে। আমার এই ক্ষীণ দেহে কখনো শক্তির পরীক্ষা দেব, সেটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু ত্রাণ পেতে হবে।

এক কাঁধে ঝোলা নিলাম। দু’হাতে বলরামকে তুলে বললাম, ‘শক্ত করে গলা ধরে ঝুলে পড়ো।’

শঙ্কিত বলরাম বললো, ‘পারবেন তো ঠাকুর! আমার ঠাকুরের কোনো কষ্ট হবে না তো!’

বাবু থেকে ঠাকুর হয়েছি বলরামের কাছে। এর পরে দেবতা হব। নরাধম পাপিষ্ঠও হতে পারি।

সামনে তাকিয়ে মগজের সমস্ত বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এতক্ষণ অপরকে বলেছি, এবার নিজে একটা অন্ধ ক্ষিপ্ত মোষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম সামনের দিকে।

অন্ধ্রের বড় ভাইয়ের উৎকণ্ঠিত গলা একবার শুনতে পেলাম, ‘এ কী, মিঃ শুনুন।’ না, শুনব না। নামতে হবে। কতটা এগিয়েছি জানি না, একটা নারীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ শুনে তাকিয়ে দেখলাম, শ্যামা। আমার কনুই তার গলায় ঠেকেছে। প্রাণভয়ে চিৎকার করছে : সেই মুক্ত পাখির দল। কোথায় প্রৌঢ়া, প্রেমবতীয়া, পাতিয়া! কোথায় বা বুড়ো! দেখতে পেলাম না, শুধু চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

শ্যামা আমার কনুই চেপে ধরল দু’হাতে। অসহ্য ভার। প্রাণ বেরিয়ে যায়। যেতে দাও যেতে দাও।

হুশ করে এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলো ঘাম ঝরা মুখে। বাইরে এসে পড়েছি। দেখলাম, একসঙ্গে অনেকে এসে পড়েছি। খসে পড়েছে বলরাম ঘাড়ের উপর থেকে। না, তার লাগেনি। সে ভগবানকে ডাকছে।

ওভারকোটটা কে ধরে রেখেছে পেছন থেকে। ফিরে দেখি শ্যামা। উৎকণ্ঠিত চোখে জলের ধারা। অসহায় ভাবে বলে উঠলো, ‘ওদের একটু নামিয়ে দাও বাঙালিবাবু।’

আবার! কিন্তু এবার দু’জন সেপাই এসে পড়েছে। সেপাই ডেকেছেন মধ্যপ্রদেশের সেই ভদ্রলোক। অবস্থা কিছুটা আয়ত্তে এলো যেন।

পরোপকারের নেশা বলে কোনো বস্তু আছে কিনা জানি না। মানুষের মনে মাঝে মাঝে একটা ঝোঁক চাপে। আমারও ঝোঁক চাপল তেমনি। শ্যামার হাতে ঝোলা ফেলে উঠে গেলাম আবার।

প্রৌঢ়া চেঁচিয়ে উঠলো, ‘এই বুড়োকে, দোহাই বাবু, এই বুড়োকে একটু নামিয়ে দাও।’

বলতে না বলতে বুড়ো দু’হাতে চেপে ধরল আমাকে। যেমন করে জলে ডুবন্ত মানুষ কোনো আশ্রয় খোঁজে। ভেবেও দেখে না, আশ্রয়সুদ্ধ সে তলিয়ে যাবে কিনা।

নেমে এলাম। নেমে এসেছে সবাই। কোথায় গেল হা-হুতাশ, যন্ত্রণা, চিৎকার ও কান্না শ্যামা হাসছে। হাউমাউ করে কী সব বলছে প্রৌঢ়াকে আর আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাকে। বুঝতে পারলাম, এমন ভালামোনুষ ওরা কখনো দেখে নি, সে কথাই বলছে আর বোঝাতে চাইছে আমাকে।

বলরাম ডাকলো, ‘ঠাকুর!’

বললাম, ‘ঠাকুর নই, জাত শুদ্দুর আমি।’

কিন্তু বলরামের আছে কথার ফুলবাগান। বললো, ‘কই! আপনার গায়ে মুখে যে নেকা রয়েছে ঠাকুর বলে। তা আমি কেন ঠাকুর, অ্যাই, অ্যাই যে নক্কীদাসী—’

দেখলাম, বলরামের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পেটেন্ট বাঙালি নামাবলীধারী বৈষ্ণব, আর একজন কালো স্থূল চেহারার মেয়েমানুষ।

বুঝলাম, আমঘাটার লক্ষ্মীদাসী এই মেয়েমানুষটি। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। থানের উপর নামাবলী। পান-দোক্তা-খাওয়া ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়েছে। স্থূল ঠোঁট বিস্ফারিত করে বেচারি হাসতেও পারছে না। বোধ করি তার মূল গায়েনকে রক্ষা করেছি বলেই মুগ্ধ কৃতজ্ঞতায় বাকরহিতা হয়েছে সে।

বললাম, ‘বেশ, এবার চলি বলরাম।’

জবাব দিল লক্ষ্মীদাসী। সেও বললো, ‘ঠাকুর-’

ফিরে তাকালাম তার দিকে। চল্লিশ বছরের লক্ষ্মীর কালো কালো ডাগর চোখ দু’টি এখনও বালিকার মতো কৌতূহলিত ও নম্র। বললো, ‘একবার আমাদের আশ্রমে পায়ের ধুলো দিবেন।’

‘কোথায় তোমাদের আশ্রম?’

‘কোথায় জানি না। দেখি নাই তো কোনোদিন। আশ্রমের নাম ছিরি নন্দগোপাল মাধবাচার্য বাবাজীর মন্দির। আমাদেরও খুঁজে নিতে হবে।

বললাম, ‘পারলে যাব। না যেতে পারলে কিছু মনে কোর না। তবে তোমার মূল গায়েনের গলাটি বড় মিষ্টি। ওর গান শোনবার ইচ্ছা রইলো মনে।’

অন্ধ্রের পরিবারটি নেমে এসেছেন। দেখলাম, ড্রাইভারের উর্দি-পরা একটা লোক তাদের পথ করে দিয়ে নিয়ে চলেছে। সকলেই আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। বড় ভাই বললেন, ‘আমাদের ক্যাম্পটার নাম মনে আছে তো? আসা চাই।’

সাধারণ যাত্রীদের বেরুবার পথে এগিয়ে গেলাম। জানি, আমার দিকে তাকিয়ে আছে বলরাম। জলে ভেসে যাচ্ছে তার দু’চোখ। মা-খেগো বলা মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু!

এই মহামেলার জনারণ্যে আর কোনোদিন ওকে খুঁজে পাব কিনা জানি না।

মানুষের মন-নদীর কূলে সৈকতভূমি, সেখানে দিবানিশি পলি পড়ছে। পলের পলি, মিনিটের পলি, ঘণ্টার পলি, মহাকাল ও যুগের পলি। একটা বেলার মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে মৃত-সহ তীব্র স্মৃতি। এর পর হারিয়ে যাবে বলরাম ও

আবার কোনো ঘটনার ঢেউ আছড়ে পড়ে যেদিন জাগিয়ে দেবে এই কুম্ভযাত্রার স্মৃতি, সেইদিন হয়তো এই বিচিত্র মুখগুলি ভেসে উঠবে চোখের সামনে। কত কথা মনে পড়বে।

স্মৃতি যেন কণ্ঠমালা প্রেয়সী। প্রেয়সীর আদরে অবিমিশ্র সুখ থাকে না। সুখ ও দুঃখ, এ দুই ধারার মিলনে সেখানে নোনা জলের ধারাও গড়িয়ে আসে। স্মৃতিও তেমনি। এমন কি কন্ঠলগ্ন হয়েও তীব্র দহন সময়ে সময়ে অনুভব করি আমরা। তবুও স্মৃতি বিনা প্রাণ বাঁচে না।

মাইকে অনবরত বলে চলেছে, ‘কলেরার ইনজেকশন নিতে ভুলবেন না। ভুলবেন না সর্টিফিকেট নিতে। বিনা সার্টিফিকেটে আপনার মেলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ।’

তার ব্যবস্থাও হয়েছে কম নয়। সমস্ত স্টেশনটি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে একটি অস্থায়ী কারাগার সৃষ্টি হয়েছে। দরজায় দরজায় ডজন ডজন পুলিশ।

স্টেশনের খোলা আঙিনাতেই ছাউনি পড়েছে মহামারী প্রতিষেধকওয়ালাদের। কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ বাগিয়ে ধরে আছেন চকচকে সিরিঞ্জ আর তুলো।

শ্যামার দল এখানেও হট্টগোল পাকিয়েছে। ইনজেকশন তারা কিছুতেই নেবে না। শুধু শ্যামারা কেন, অনেক শ্যামার দলই মূর্ছিতের মতো পড়ে আছে ছাউনির পাশে। ভগবানের কাছে হত্যে দেওয়ার মতো অসহায়ভাবে পড়ে আছে।

পুন্যার্থী নারীবাহিনীর কোনো কোনো দল তো কান্নার রোল তুলেছে——হে ভগবান, হে মহাদেও, তোমার রাজত্বে এ কী কাণ্ডকারখানা চলছে!’

অবাক হয়ে দেখি পাশে একজন মস্ত মরদ জোয়ান পাগড়ী নিয়ে চোখের জল মুছছে। বললাম, ‘কাঁদছ কেন?’

সে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। বললো, ‘বিনা সুঁইসে ইনলোগ হম কে যানে নাহি দেগা।’

সত্যি, ভগবানের রাজত্বেরই কাণ্ডকারখানা বটে! মরদটিকে দেখে মনে হচ্ছে, সে রাজস্থানের কৃষক। শরীর তার আমার চার ডবল। তার চওড়া থাবাটাই আমাকে বোধ হয় টিপে মেরে ফেলতে পারে। সে যে সামান্য একটি ছুঁচ হাতে বেঁধবার ভয়ে রীতিমতো কান্না জুড়েছে, এ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছি, শুধু সে কেন, এমনি কয়েক জনেরই চোখ ছলছল করছে। অথচ এই মানুষই হয়তো সামান্য আলপথের জমি নিয়ে দাঙ্গা করে নিজের ও পরের মাথা ফাটায় অনায়াসে। তখন সে রক্ত দেখেও ভীত নয়। হয়তো ধর্মের নাম করে তার নাক কান ফুটো করে দিলেও সে সহ্য করবে। কিন্তু ইন্জেকশন! সে যে বড় সাংঘাতিক।

কিন্তু তেল দাও, সিঁদুর দাও, ভবী ভোলবার নয়। ইন্জেকশন-রূপী দেবতাটি বড় নির্দয়। ছুঁচ হয়ে না ঢুকে সে ছাড়বে না। আর তার পরোয়ানা না পেলে স্বর্গের দরজাও বন্ধ। যারা ভীত অথচ বুদ্ধিমান, তারা কেউ অস্বীকার করছে না। নিচ্ছে আর পালাচ্ছে। ভাবখানা যা হয় পরে দেখা যাবে। এখন তো যাক।

শ্যামার দল শেষটায় টাকা বের করছে। কিন্তু টাকা নিয়ে যারা নিষ্কৃতি দেবে, এ দিনের আলোয়, সহস্র চোখের সামনে তাদের ইচ্ছা থাকলেও লজ্জা বলে একটা বস্তু তো আছে।

বৃথা দেরি করা। যেতে হবে। এদিকে বেলা যায়। ইনজেকশন নিয়ে, এক টুকরো কাগজের শাটিফিকেট পকেটে পুরে বেরুতে গেলাম।

সামনেই দেখি শ্যামা ও প্রৌঢ়া, পেছনে প্রেমবতীয়া, পাতিয়া ও বৃদ্ধ।

শ্যামা উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘চোট লাগে নি?’

ভাবলাম, বলরামের মতো জবাব দিই যে, চোট ছাড়া চলা যায় নাকি? হেসে বললাম, ‘সামান্য। ও কিছু নয়।’

শ্যামা বললো, ‘সচ বলছ?’

‘ঝুটা বলে লাভ কি আমার। নিয়ে দেখো। ‘

এত ভয় যে, শ্যামা আমার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো। বললো, ‘আমাদের এই বুড়ো মানুষটি নিতে পারবে তো?’

বললাম, ‘নিশ্চয়ই। একশোটা নিতে পারবে।’

বলে, হাসতে হাসতে বাইরে এসে দাঁড়াতেই এক কাণ্ড। একটি বাঙালি বৃদ্ধা শণ-নুড়ি চুল উড়িয়ে ভাঙা গলায় খনখন করে উঠলো, ‘দাঁত বের করে নিয়ে তো এলে বাছা। এমনি করে তোমরা প্যাঁক প্যাঁক করে নিলে মড়ারা কি আর আমাদের ছাড়বে? একটু বলে কয়ে ব্যবস্থা তো করতে হয়।

অবাক হয়ে বললাম, ‘আমাকে বলছেন?’

তবে আর কাকে বলবো!’

‘কিন্তু বলে কয়ে কাকে বোঝাব, বলুন তো?’

‘কেন, হিন্দিমিন্দিওয়ালাদের বলে দাও, আমাদের এই বুড়িসুড়িদের সাতকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে। মরি মরব। আমরাও সব ইঞ্জিশন-ফিঞ্জিশন নিতে পারবো না।’

তাই ভালো। ভেবেছিলাম, না জানি কী করেছি। দেখলাম, বুড়ির পাশে বছর ত্রিশ-বত্রিশ বয়সের এক যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যেই সে আপাদমস্তক মোটা শালে ঢাকা দিয়েছে। শীত আছে সত্যি কিন্তু যুবকটিকে শীতের জুজুবুড়িতে ধরেছে বলে মনে হলো। ঠেলাঠেলির ঠেলায় আমাকে তো সব গরম জামা খুলে ফেলতে হয়েছে।

যুবকটির পাশে দেখলাম একটি অবগুণ্ঠিতা বালিকা। বালিকা উৎকণ্ঠিতা। আমার চোখে চোখ পড়তেই যুবকটি বলে উঠলো, ‘কী করা যায় বলুন তো?’

আমি বললাম, ‘কেন আপনিও নেন নি নাকি?’

যুবকটি লজ্জিত হলো না একটুও। মুখটা আরও করুণ করে বললো, মানে হল গিয়ে, কথা কখনো নিই নি কিনা, তাই বড় ঘাবড়ে যাচ্ছি। দেখুন না, আমার পরিবারটি তো একেবারে মরিয়া হয়ে গেছে দাদা। আর দিদিমার কথা তো শুনলেনই।’

পরিবার অর্থাৎ বালিকাটি। বুড়ি হলো দিদিমা। লোকটির অবস্থা সবদিক দিয়েই কাহিল হয়ে পড়েছে, বুঝতে পারলাম। কিন্তু অবাক ওর কাণ্ড দেখে। ইন্‌জেকশন যে এমন করালরূপে এখনো দেশে বিরজিত, তা জানতাম না।

বললাম, ‘জানতেন তো আসবার আগেই। ব্যবস্থা একটা করলেন না কেন?’

যেমনি বলা, অমনি যুবকটি শাল খুলে একেবারে রুদ্রমূর্তিতে জ্বলে উঠলো। চেঁচিয়ে বললো, ‘মশাই, এই বুড়ি যত নষ্টের মূল। পইপই করে বলেছিলুম, ছটা টাকা দে দিমা, (অর্থাৎ দিদিমা) মিউনিসিপালের হেলথ্ অফিসারকে মাথা পিছু দু’টাকা করে দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে নিই। তখন বলে কত কথা। ছটা টাকা! এখন কোন্ শালা এ বোত্রনি পারো করবে অ্যাঁ?’

যুবক স্বমূর্তিতে বিরাজিত। দিদিমাও কম যায় না আদুরে নাতির চেয়ে। সেও গলা চড়িয়ে বললো, ‘হ্যাঁ রে একালঘেঁড়ে, দু’পয়সা কামাবার মুরোদ নেই, ছটা টাকা আসে কোত্থেকে। আর তখন কি জানতুম যে, ‘মিনসেরা এমনি করে ধরবে!’

যুবক আরও উগ্র হয়ে উঠলো। শাল কোমরে বেঁধে জামার আস্তিন গুটিয়ে বললো, ‘আমি শালা এখুনি ইন্‌জেকশন নেব, যা খুশি তুই কর।’

সর্বনাশ! বুড়ি একেবারে ক্ষেপে উঠলো। বললো, ‘মাথা কুটে মরব পেল্লাদ, তোর দিমার তালে আজ এখেনেই মিত্যু আছে। খবরদার।’

কিন্তু পেল্লাদ আস্ফালন করতে ছাড়ে না——হোক মরণ তবু নেব।’

বলে, কিন্তু এগোয় না। আর আমিই কি জানতাম যে এলাহাবাদে স্টেশন প্রাঙ্গণে এমনি ও নেহাত বাঙলা নাটক দেখব।

দর্শক অনেক ছিল। বোধকরি ভারতের প্রতিটি প্রদেশের নরনারী দেখলো এই নাটক। প্ল্যাটফরম থেকে জনতা ক্রমে আঙিনাতে ভিড় করতে আরম্ভ করেছে। মহামারী ক্যাম্পের লোকেরা তাড়া দিলেন ভিড় কমাবার জন্য।

ইতিমধ্যে অনেকেই বেরিয়ে গিয়েছে। বুঝলাম, দাঁড়িয়ে থাকা বৃথা। জানি না দিদিমা-নাতির এ নাটকের যবনিকা কিভাবে কখন পড়বে। সরে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

এলাহাবাদ শহর। প্রাচীন হিন্দু-রাজত্বের প্রয়াগ প্রদেশ। শুধু হিন্দুর তীর্থভূমি বলে নয়, যে কোনো ইতিহাস-কৌতূহলিত ব্যক্তি রোমাঞ্চিত হবেন আজকের উত্তরপ্রদেশের এই শহরের ইতিহাস শুনলে।

দলবদ্ধ তরুণীদের কলহাসির মতো অনেকগুলি বেল বাজছে সাইকেল রিকসার। এখানে কর্নবিদারী ভেঁপু নেই। ঘাড় নুইয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে উত্তরপ্রদেশের রিকসাওয়ালারা। সময় নেই আজ তাদেরই পৌষ মাস। এক টাকার জায়গায় চার টাকা চাইলেও না বলার মতো কেউ নেই। রথ যাদের চাই, তাদের আজ রথীদের মনোমতো ব্যবস্থায় রাজি হতেই হবে।

কিন্তু সে-কথা বলছিলাম না। বলছিলাম এ দেশের কথা। বাঙলা থেকে খুব দূরে বলবো না এ দেশকে। বিশেষ এই বিজ্ঞানের যুগে। তা ছাড়া বাঙালি বাসিন্দার সংখ্যাও এখানে কম নয়।

আজ এই দেশের রাজপথের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখছি পিচঢালা রাস্তা, দুপাশে ইমারতের সারি। ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে মোটর লরি আর প্রাইভেট কার। সাইকেল রিকসা আর রকমারি টাঙ্গা। টাঙ্গাগুলিই বোধ হয় প্রাচীন ভারতের ঘোড়ায়-টানা রথের স্মৃতি বহন করছে। মানুষ চলেছে অসংখ্য।

শহরের চেহারা বাঙলার মফস্বল শহরের মতো। বিশেষ, বর্তমান বাঙলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের ছাপ এলাহাবাদে পরিস্ফুট।

কাল থেকে কালান্তর, যুগ থেকে যুগান্তর। কাল যায়, যুগ যায়। যাওয়ার সময় সে তার ছাপ রেখে যায়। সবই মানুষের কীর্তি। মানুষই ভাঙে, আবার মানুষই গড়ে। তবু পেছন দিকে তাকালে আমাদের দু’চোখ জলে ভরে আসে। এ চোখের জল অবস্তুবাদীর নয়, নয় ইতিহাসবিমুখের। বরের গৃহে মেয়ে পাঠাবার জন্য পিতা কত সুন্দর অনুষ্ঠান করেন। মেয়ের প্রতিষ্ঠা, তার নারীত্বের মহিমা প্রকাশের জন্য এক নতুন জীবনে তুলে দিয়ে আসেন তাকে। তবুও যাকে লালন করেছেন, জন্মের পর থেকে যার বিকাশের জন্য প্রতিদিন কষ্ট করেছেন, তারই নব জীবনের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে তিনি কেঁদে ভাসান।

প্রয়াগ নাম আমাদের তেমনি মুগ্ধ করে। হাজার হাজার বছর আগে থেকে ভারতের নামের সঙ্গে প্রয়াগের নাম জড়িত। ভাবি, যে-পথের উপর দিয়ে আজ রিকসায় চেপে চলেছি, একদিন এখানকারই ভয়াবহ বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে অযোধ্যার দশরথ-পুত্র রাম, ভাই লক্ষ্মণ ও স্ত্রী সীতাকে নিয়ে বনবাসের পথে গিয়েছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন দূর আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠেছিল ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম থেকে।

কাব্য নয়, বাস্তবে কি একবার চোখ বুজে ভাবতে পারি না, সৎমায়ের তাড়নায় দুইভাই আর এক বউ বহুকাল পূর্বে একদিন ঘর ছেড়ে এ পথে এসেছিলেন! তাঁদেরই নিয়ে আমাদের রাজকথা, কাব্য, গৌরবগাথা, রূপকথা, আমাদের ইতিহাস।

চমকে উঠলাম। হঠাৎ কানে এলো, ‘এই যে বাঙালি ভাই!’

কথার সঙ্গেই জলতরঙ্গের চড়া সুরের মতো এক ঝলক হাসি। হাসি, ঘোড়ার পদশব্দ, ঘোড়ার গলায় বাঁধা বলসের ঘুঙুরে ঝুমঝুম বাজনা

চোখ চেয়েছিলাম কিন্তু মন-চোখ হারিয়ে গিয়েছিল রামায়ণ কাব্যলোকের স্বপ্নরাজ্যে। সুপ্তোত্থিতের মতো চমকে তাকিয়ে দেখি, মাত্র দু’হাত দূরে শ্যামা। টাঙ্গার প্রান্তে বসেছে পা ঝুলিয়ে একটা টাঙ্গারই স্বল্পপরিসর জায়গায় তারা সকলে বসেছে বুড়োকে নিয়ে। বুড়ো রয়েছে মাঝখানে। তাদের টাঙ্গা চলেছে আমারই রিকসার গায়ে গায়ে। এত গায়ে গায়ে যে ঠেকে না যায় আবার।

সামনে পিছনে টাঙ্গা ও রিকসার ভিড়। পথের দু’পাশে ভিড় মানুষের। মেয়ে পুরুষ শিশু ও বুড়ো। সারবন্দী চলেছে সকলে। চলেছে সাধুর দল।

ক্রিং ক্রিং নয়, রিনি-রিনি করে বাজছে রিকসার বেল। তাড়া দিচ্ছে আমার রিকসা শ্যামাদের টাঙ্গাকে।

শ্যামা হাসছে, হাসছে ওদের সমস্ত দলটা। বুড়োটিও কি হাসছে? হাসছে না, কিন্তু নাকের পাশে গভীর রেখা দু’টিতে তার প্রসন্নতার আভাস!

প্রৌঢ়া কী বললো শ্যামাকে। যাত্রী ও যানবাহনের কলকোলাহল ছাপিয়ে গলা চড়িয়ে শ্যামা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাঁহা জানা হ্যায়?’ বাঙলা করলে বোধ হয় অর্থ দাঁড়ায়, কোথায় যাওয়া হবে?’

বললাম, ‘মেলায়। কুম্ভমেলায়।’

‘সচ্?’ সত্যি! চমকিত বিস্ময় ও মুহূর্তের নীরবতা। আবার হাসি। সে-হাসিতে পথচারী নরনারী চমকায়, জানোয়ার চমকায়। বোধ হয় চকিতের জন্য থমকে যায় অবিরাম বয়ে চলা এই জনসমুদ্রের পায়ের তলার মাটি, উত্তরপ্রদেশের হাল্কা মেঘ-ছাওয়া বেলাশেষের রক্তিম আকাশ, উত্তরের সর্বনাশী বাতাস। কেন না, এ হাসিতে মুক্তির স্বাদ নেই।

কেন এত হাসি, জানি নে। বলরামের যেমন দেখলাম, হাসি প্রাণ, হাসি গান, হাসি অঙ্গের বসন-ভূষণ। বুঝি এদেরও তাই। কিন্তু বলরামের নীরব হাসিতে খুলে যায় প্রাণের বন্ধ দরজা। নীরব অথচ এক প্রাণখোলা মানুষের মুক্তির উদার ডাক। আর এই চড়া হাসির লহরে লহরে অনুভূত হয় এক চাপাপড়া বন্দীর নিঃশব্দ যন্ত্রণার ছটফটানি।

রিকসায় সামনের চাকা গিয়ে ঠেকেছে শ্যামার পায়ের কাছে। ঠেকে ঠেকে তবু ঠেকে না।শ্যামার একটি খেলা আরম্ভ হয়েছে দেখছি। কার সঙ্গে? আমার সঙ্গে, না রিকসাওয়ালার সঙ্গে, তা জানি নে।

বাঙালি ছেলে বলে ভাবি, দেশের মেয়েরা ছাড়া বুঝি কেউ আলতা দিয়ে পা রাঙায় না। কিন্তু শ্যামারও দেখি আলতা রাঙানো পা, প্রজাপতির নকশাকাটা স্যাণ্ডেল, আবার বাঁকা মল। মলের উপরেই পেখম-উন্মুক্ত ময়ূর-ছাপা শাড়ি। তার বলিষ্ঠ অঙ্গ জুড়ে ছড়াছড়ি নৃত্যরত ময়ূরের। খুলে গিয়েছে ধূলিরুক্ষ চুল, সিঁথিতে মেটে সিন্দুর। কাঁচা সোনার স্থূল কাজ-করা কঙ্কণ-শোভিত দু’হাতে কোলের উপর জড়িয়ে ধরেছে একটা পেতলের কলসীর গলা। বসেছে বেঁকে, ঘাড় হেলিয়ে। মুখে তার খেলার হাসি।

সে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন্ আশ্রমে থাকবে?’

বললাম, ‘জানি নে।’

‘জানো না?’ বোধ হয় নিজেদের মধ্যে সেই কথাটি বলাবলি করে আবার তারা সকলে হেসে উঠলো। কী করে জানবো! যেখানে কোনোদিন যাই নি, দেখি নি কেমন জায়গা, কী রকম আশ্রয়, সেখানে কোথায় থাকবো সেই ভেবে তো বেরুই নি। কী ভেবে বেরিয়েছিলাম, আজ পথ চলতে সব যেন ঘুলিয়ে গিয়েছে। বক্তৃতা আর যুক্তি গিয়েছি ভুলে। ভেঙে পড়ি নি ক্লান্তিতে, তবু মনেও হচ্ছে না কখন কেন বেরিয়েছিলাম।

মনকে জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। বেরুবার জন্য মন অস্থির হয়েছিল। অস্থিরতা ঘুচেছে, এখন মন পাগল হয়েছে। নিজের সেই পাগল রূপটি দেখতে কেমন জানি নে! এখন চলা নামের মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে। মনের বুকে কান পাতলে শুনি শুধু, চলো চলো চলো। এত মানুষ চলেছে, অবিরাম চলেছে। বন্যার জলে আমি জল হয়ে মিশে গিয়েছি।

কোথায় গিয়ে ঠেকব জানি নে। ঠেকব কি ভেসে যাব তাও জানি নে। আশ্রয়ের কথা কে ভেবেছে!

পথের দু’ধারে চলেছে পাঞ্জাব সিন্ধু বোম্বাই গুজরাট দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ। কী বিচিত্র তার রূপ। কোথাও রঙিন পায়জামা পাঞ্জাবি ও ওড়নার সঙ্গে ঘাড়ের উপর এলানো খোঁপা, দোলানো বেণী। বাঁকা খোঁপায় ফুল গুঁজে রঙিন রেশমী শাড়িতে টেনে দিয়েছে কাছা। গলায় ঝোলানো বেল্টের সঙ্গে খাপে ঢাকা ছুরি, কোমরে তলোয়ার নিয়ে চলেছে পাঞ্জাবী শিখ। হাজার কুঁচি-ঘেরা ঘাগরায় ঢেউ তুলে চলেছে দিল্লিওয়ালী। বিচিত্র বর্ণবহুল চৌদ্দ হাত শাড়িতেও সর্বাঙ্গ উদাস করে চলেছে রাজপুতানী। মাথায় সোনার টিকুলি, হাতে পায়ে সোনা। কারুর বা রুপোর হাঁসুলি, কান-ছিঁড়ে-পড়া ছ-ইঞি ভারী কর্ণাভরণ নাকের দু’পাশে নাকছাবি, কপালে দেশি গোলাপী রঙের সিঁদুরটিপ, সামনে কুঁচি দিয়ে বাঁ-দিকে আঁচল এলিয়ে চলেছে দক্ষিণদেশিনী। বাবরিকাটা, লুঙ্গিপরা, মুখে চুরুট পুরুষবাহিনী। কোথাও চোস্ত পাজামা আর চুড়িদার পাঞ্জাবি, কোথাও নকশা-ফোটানো নাগরা জুতো, ধুতি আর ঝোলা পাঞ্জাবি পরা গোঁফ-পাকানো হিন্দুস্থানের পুরুষ। এরই মধ্যে চোখে পড়ে কাস্তাপেড়ে বাঙলা শাড়ি আর বাঙলা সিঁদুরের আগুনের মত লাল উজ্জ্বল টিপ ও শাঁখা। সর্বহারা শুভ্রবেশিনী বিধবা। ক্বচিৎ বাঙালি কুমারীর মস্ত বড় আঁট খোঁপা, স্নিন্ধ মুখে উত্তরপ্রদেশের ধূলি-রুক্ষতা আর কোঁচা-ঝোলানো কিংবা পায়ের গোড়ালি অবধি মালকোঁচা দেওয়া পুরুষ, আমারই মতো সব টাইপ চেহারার বাঙালি!

দেখে শেষ হয় না, আশ মেটে না পথের এই বিচিত্র রূপ দেখে। ভাবি, যার বেশ এত বিচিত্র, তার হৃদয় ও চরিত্রের গতিবিধি না জানি আরও কত বিচিত্র! সে বিচিত্রকে জানব কেমন করে। মন ভারী হয়ে উঠলো। এত মানুষ, কত রূপ! এ রূপের শেষ রূপ কোথায়! সে রূপকে খুঁজবো, সেই অপরূপকে দেখবো। ভুলি নি তো! ডুব দেব সেই হৃদিকুম্ভে। রূপে তাকে চিনব না, প্রাণে প্রাণে বুঝবো বলে ডুব দিতে চাই। প্রাণের দরজা যদি থাকে বন্ধ, করাঘাত করব। চাবি হয়ে ঘুরবো কুলুপ ছিদ্রের মধ্যে।

কেন এলাম ছুটে উদভ্রান্তের মতো! দেখবো বলেই তো! ভারতের এই বিচিত্র আরশিতে নিজের মুখটি ভালো করে যাচাই করবো বলেই তো এসেছি। সে মুখ আমার মন। আমার ধর্ম।

চলো চলো, আর কত দূর! নিজের মনের কথা নিজে বলতে পারি নে, মা-খেগো বলা হলে হয়তো গান গেয়ে শুনিয়ে দিত আমার মনের কথা।

এরই মাঝে আর এক রূপ যেন মসলিনের ওড়নার সর্বাঙ্গে ধূলিমলিন ন্যাকড়ার তালিতে ভরা। ভারতের দরিদ্র নরনারী এই সমারোহপূর্ণ মিছিলের সবচেয়ে বড় অংশ। জীর্ণ কম্বল, ছিন্ন কাঁথা, ময়লা জামাকাপড়, উস্কোখুস্কো চুল, ধুলো-মাখা মুখ। তাদের ঘাড়ে মাথায় বোঝা। শত মাইল, শত গ্রাম-গ্রামান্তরের ধুলো তাদের সর্বাঙ্গে ছাওয়া। তবু নিজের প্রদেশ-পরিচয় লেখা রয়েছে তাদের মলিন পোশাকে।

এই রূপের স্রোত চলেছে টাঙ্গায়, রিকসায়, পায়ে হেঁটে। দূর-গ্রামের মানুষ এসেছে মোষের গাড়ি, বলদের গাড়ি নিয়ে। ভারতের বর্ণাঢ্য ঐশ্বর্য, ভারতের মলিন ছাইচাপা সোনা। আমি দু’হাতে কুড়িয়ে নেব এই সম্পদ।

চারিদিকে কলকোলাহল। গাড়ির ঘর্ঘর, ঘোড়ার খুরাঘাত, ঘুঙুরের বাজনা, রিকসার জলতরঙ্গ। পথচলতি মেয়েরা গান ধরেছে। মেয়েদের দেখে মনে হয় তারা মারোয়াড়ের ঝি-বহুড়ি। হাত দিয়ে নথ নোলক সাপটে ধরে গান করছে তারা। গান চলেছে একটি টাঙ্গায়, মোষ-বলদের গাড়িতে। এই তো বিরাট মেলা। চলন্ত মেলা। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে হাতে হাত ধরেছে, আঁচলে আঁচল বেঁধেছে সকলে।

তৃয়ার্ত হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, কোথাও হাসি, কোথাও গান, কোথাও কান্না, কোথাও বিবাদ। ভাষা বুঝি নে, ভাব বুঝি নে সকলের।

সব যখন এমনি ভাঙা রেকর্ডের বিকৃত শব্দের মতো তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে, তখন শুধু স্তব্ধ বনের মাঝে যেন একটি ব্যাকুল কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘ও নিধিরাম, বাবা নিধিরাম, কোথায় গেলি? আমি যে হাতছাড়া হয়ে গেছি বাপ! আমার হাত ধর, তোর কাছে টেনে নে।’

একটি ক্লান্ত মোটা গলার জবাব শোনা গেল আরও দূর থেকে, ‘এই যে পিসি, আমি এখানে। ভয় নেই, চলো। আমি তোমাকে ঠিক দেখতে পাচ্ছি, তুমি হারাবে না। ভয় নেই!

ভয় নেই। নির্ভয়ে চলো। কারা কথা বলছে। মানুষ দেখার জো নেই। কথা বলছে ভিড়। এক গানের ভাষা বুঝতে পারি নি, আর-এক গানের ভাষা বুঝতে পারছি। শুনতে পাচ্ছি খোল করতালের ঝিমানো বাজনা, তার সঙ্গে ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ, হরে কৃষ্ণ হরে রাম রাধে গোবিন্দ। ‘

শুনেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বলরামের মুখ। কারা গাইছে লক্ষ্মীদাসীর দল নাকি! রাস্তার বাঁ-দিকে একটা প্লেটে লেখা রয়েছে, কমলা নেহেরু রোড। রাস্তার দু’পাশের কাঁচা অংশে ঝাঁট দিচ্ছে ঝাড়ুদারনীরা। বাঁশের ডগায় ঝাড়ু বেঁধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝাঁট দিচ্ছে, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে যাত্রীদের। এক ফোঁটা জল নেই, ঝাঁট দিয়ে শুধু কেন ধুলো ওড়ানো হচ্ছে বুঝি নে। ধোঁয়ার মতো ধুলো ছেয়ে ফেললো সারাটা রাস্তা। ঝাপসা হয়ে গেল হাজার হাজার মুখ।

এই রাস্তায় আজ আমরা চলেছি, কুম্ভের যাত্রীরা! যদি খুলে দিই এই রাস্তার পুরনো ইতিহাসের পাতা, তবে খুঁজে পাব বুঝি গৌতম বুদ্ধের পদরেণু। কান পাতলে শুনতে পাব বিজয়ী মৌর্য বাহিনীর পদশব্দ। দেখতে পাব মুগ্ধচিত্ত গ্রীক-রাজদূত মেগাস্থিনিসকে, চীন পর্যটক ফা-হিয়েনকে। শুনতে পাব সমুদ্রগুপ্ত ও হর্ষবর্ধনের রথচক্রের ঘর্ঘরানি। পদচিহ্ন খুঁজে পাব হিউ-এন-সাঙ আর শঙ্করাচার্যের!

তবে সে ইতিহাস প্রয়াগের। এলাহাবাদের নয়। গবেষকদের মতে, একসময়ে এই প্রায়াগের নাম ছিল বৎসদেশ। ত্রিশ মাইল দূরে, যমুনাকূলে ছিল তার রাজধানী কৌশাম্বী নগরী। প্রয়াগেরই নাম বৎসদেশ। তারপর মুঘলযুগের দুর্ধর্ষবাহিনী ছুটে এসেছে এই পথের উপর দিয়ে। মুঘলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবর প্রয়াগে এসে তার নাম রাখলেন ইলাহাবাস। ভিত্তি স্থাপন করলেন ইলাহাবাস দুর্গের। ক্রমে বাদশাহের রম্যভূমি হয়ে উঠেছে এই ইলাহাবাস। জাহাঙ্গীর তৈরি করলেন তাঁর শখের খসরুবাগ। শাজাহান ইলাহাবাসের নাম দিলেন ইলাহাবাদ।

তার পরেও ইলাহাবাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিদ্রোহী বুন্দেলা আর মারাঠাদের নিৰ্ভীক অশ্ববাহিনী। আক্রমণ আর প্রতি-আক্রমণে রক্তে ভেসে গিয়েছে এলাহাবাদের মাটি। কখনো মুঘলদের গোলা আর কখনো মারাঠীদের তলোয়ার অধিকার করেছে এই দেশ।

তারপর অন্ধকার। অযোধ্যার নবাব দেনার দায়ে বিকিয়ে দিল এ দেশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাছে।

আর আজ চলেছি আমরা। আমরা ঐতিহাসিক যাত্রী নই, কিন্তু ইতিহাস রচিত হচ্ছে। আমাদের মনে। আমাদের ইতিহাস আমরা।

হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে উলটে পড়বার মুখে সামনে হাত বাড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করলাম। সামনে হাত বাড়িয়ে যে-বস্তুটি ধরলাম, সেটি শ্যামার কলসী। রিকসার সামনের চাকা খানিক বেঁকে দাঁড়িয়েছে। সামনে পেছনে সর্বত্র আচমকা দাঁড়িয়ে পড়েছে চলন্ত মিছিল। পুলিশ হাত তুলেছে মোড়ে।

তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিলাম। তাকিয়ে দেখি শ্যামা হাসছে খিলখিল করে।

বললাম, ‘একেবারে দেখতে পাই নি।’

শ্যামা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। বললো, ‘ঘরের কথা ভেবেছিলে বুঝি?’

বলে আবার হাসি। আশ্চর্য! হাসি মেয়েটার রোগ নয় তো?

প্রৌঢ়া জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’

শ্যামা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে এবার নিঃশব্দে হাসলো। মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘কিছু না, বাঙালি ভাই আমার কলসী বাঁচিয়ে দিয়েছে।’

কলসী বাঁচিয়ে দিলাম কেমন করে? কলসী ধরে তো নিজেকে বাঁচালাম। অবাক হয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শ্যামার দিকে তাকিয়ে আমার পথচলা মন চমকে উঠলো।

অমন করে কী দেখছে শ্যামা? ঠোঁটের কোণে তার সেই সর্বক্ষণের হাসি চমকাচ্ছে। তার শাণিত চোখের খর তারা দু’টি নেচে নেচে যেন কী খুঁজে বেড়াচ্ছে আমার মুখে। সে-চোখের দৃষ্টি যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনি মনের এক গোপন খেলার দুষ্টুমিতে ভরা।

তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। নিজে অপ্রতিভ হলাম। পথে লজ্জা পেতে হবে, সেকথা ভেবে বেরুইনি। পথে আবার লজ্জা কীসের! পথের দেখা পথেই শেষ হয়ে যাবে। জানি নে শ্যামা কতখানি নির্লজ্জ। জানি নে, শ্যামার এই উদ্ধত চটুলতার মধ্যে তার হৃদয়ের কোন্ গোপন লীলা নিহিত রয়েছে। তার নিজের লীলা নিয়ে সে চলে যাবে এক পথে, আমি যাব অন্য পথে। আমি কেন লজ্জা পাব!

লজ্জা নয়, লোকলজ্জা। সামনে মানুষ, পেছনে মানুষ, মানুষ দিগন্তজোড়া। তার মধ্যে শ্যামা ভিন্ন হয়ে উঠেছে, লোকলজ্জার কারণ সেইটুকুই।

উচ্চকণ্ঠের হাসি একরকম। নীরবে হেসে তাকিয়ে থাকা আর একরকম। অস্বস্তিও তো হয়। বললাম, ‘কী দেখছ?’

বাতাসে ঝরা চুলের গুচ্ছ মুখ থেকে সরিয়ে দিল শ্যামা। তেমনি হেসে গলার স্বর নামিয়ে বললো, ‘আমি কোথায় দেখছি! দেখছ তুমি।’

তা বটে! আজ সকাল থেকে অনেকবার দেখেছি তাকে। ভেবে দেখি নি দেখবো বলে। যে দেখা দেয়, তাকে না দেখে উপায় কী! পথ চলতে আকাশ না-দেখে কে! বাগানে ফুল চোখে পড়ে না কার! শূন্যে ডিগবাজি খাওয়া গান-পাগলা বিহঙ্গ কে না দেখতে পায়!

শুনেছি, তাও অনেকে দেখতে পায় না। আমি যে দেখবো বলেই এসেছি। আর শ্যামাকে দেখতে পাব না, তা কেমন করে হয়!

কিন্তু জিজ্ঞেস করেছিলাম এক কথা একরকম ভাবে। জবাব পেলাম আর-এক কথা, আর এক রকম ভাবে। উপরন্তু পালটা অভিযোগ। এ অভিযোগ, অভিযোগ না হয়ে যদি খেলা হয়, তবে শ্যামার কাছে হার মানা ছাড়া উপায় নেই। এই ব্যাপারে শ্যামাদের কাছে আমরা চিরকাল হার মানি।

আমাকে জবাব না দিতে দেখে শ্যামার চাপা হাসি ফেটে পড়তে চাইল। খানিকটা ঝুঁকে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কী দেখছিলে?’

শুধু শ্যামাকে দেখছি, সে তো মিছে কথা। তবু বললাম, ‘তোমাকেই। তোমার আলতা রাঙানো পা, তোমার ময়ূর ছাপা শাড়ি…’

তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিল শ্যামা। এই সামান্য কথায় অন্যমনস্কতার ভান করতে হচ্ছে উদ্দাম রহস্যময়ী শ্যামাকে? জনতার মাঝে কী দেখবার জন্য মুখ ফেরাতে হলো তাকে! আমাকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে এই অনুশোচনা, নাকি লজ্জা পেয়েছে?

কিন্তু অপ্রতিভ হতে চায় না শ্যামা। যেন আমার আগের কথা শুনতে পায় নি, এমনি ভাবে ফিরে বললো, ‘গলাটা আমার এখনো ব্যথা করছে। গাড়ির ভিড়ে তুমি আর একটু চাপ দিলে আমাকে মরতে হতো।’

প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইছে শ্যামা নিজেই। কিন্তু রহস্যের আভাস যায় না তার মুখ থেকে তবু। আবার বললো, ‘ওই বাঙালি নুলা সাধুকে তুমি অমন করে ঘাড়ে নিয়েছিলে কেন? তোমার জানো-পহচান নাকি?’

‘না।’

‘তবে?’

বললাম, ‘তুমি আমার মতো এই ক্ষীণ মানুষটার কনুই ধরে ঝুলে পড়েছিলে। কিন্তু তুমি তো আমার জানো-পহচানও নও।’

হাসির সঙ্গে বিস্ময়ের বিদ্যুৎ-রেখা খেলে গেল শ্যামার মুখে। তারপর হেসে উঠে বললো ‘আজীব আদমী!’

হাত উঠেছে পুলিশের। যানবাহনের মিছিল চলতে আরম্ভ করেছে আবার। এক হ্যাঁচকায় শ্যামাদের টাঙ্গা এবার এগিয়ে গেল অনেকখানি। কানে শুনতে পেলাম না, দেখলাম, শ্যামা তার তিন সঙ্গিনীর সঙ্গে কী কথায় হাসিতে মেতে উঠলো।

সামনে তাকিয়ে দেখি, উত্তর-দক্ষিণের লম্বালম্বি রাস্তার পোস্টে লেখা রয়েছে গ্রাণ্ড-ট্রাঙ্ক রোড। আমরা চলেছি পশ্চিম থেকে পুবে। কিছুটা অবশ্য কোনাকুনি। জনসমুদ্রের কলরোলের সঙ্গে মাইক যন্ত্রের সেই চির-পরিচিত কান পচা গান ভেসে আসছে।

মাথা তুলে দেখি, বিস্তৃত মাঠের উপর তাঁবুর সারি। ভাবলাম, এই কি মেলা! বীচিবিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের মতো তাঁবু আর চালাঘরের দিগন্তহীন সমুদ্র একদিকে। কিন্তু কী বিপদ! ঝাড়ুদারনীরা এখানে ধুলো নিয়ে যেন হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। বাঁ-দিকে বিশাল প্রান্তর। একগাছা ঘাস নেই, একচ্ছত্র ধুলোর রাজা। জানি নে, কী সুখে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঝাড়ুদারনীরা, আর কী ভেবে তাদের হুকুম দিয়েছেন শহরের স্বাস্থ্যরক্ষী কর্তা। এদেশে একফোঁটা জল নেই!

বেলা যায়। কিন্তু অন্ধকার হয় নি। অথচ সামনে ধুলোয় অন্ধকার হয়ে এসেছে। ভারী কুয়াশার মতো ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সম্মুখ দিগন্ত। মানুষ তো দূরের কথা, ঘোড়াগুলিও ঘড়ঘড় করে নাক ঝাড়তে আরম্ভ করেছে। অনেকে চলেছে গাধার পিঠে করে। সে বেচারিরাও ভেঁপু ফুঁকতে আরম্ভ করেছে।

আর কী নিদারুণ ব্যাপার! গাড়ি-ঘোড়াগুলি সব ঢালু পথ বেয়ে হু-হু করে নেমে চললো সেই ধুলোমাঠের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম রিকসাওয়ালাকে, ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’

বললো, ‘বাবু, এখানে সব গাড়ি দাঁড় করাতে হবে। গাড়ির টিকিট নিতে হবে। ছ-আনা পয়সা দিন।’

এ আট আনার পথটুকু দুটাকায় রফা করেও আবার ছ-আনা কীসের?

রিকসাওয়ালা তার ঘর্মাক্ত ধুলোমাখা মুখে একগাল হেসে বললো, ‘কানুন বাবুসাহেব। বাঁধ পর্যন্ত যেতে হলে টিকিট কাটাতে হবে। নইলে রিকসা নিয়ে যেতে দেবে না।’

বলে, সে এদিক-ওদিক একবার দেখে, সোজা একটা টাঙ্গার কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল আমার রিকসা। আবার সেই হাসি। ধুলোয় অন্ধকার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি টাঙ্গাটা শ্যামাদের। রিকসাওয়ালার নজরটা পরিষ্কার। কিন্তু এর জন্য বকশিশ দেওয়ার মতো মনে কোনো প্লাবন আসে নি।

ছ-আনা পয়সা দিয়ে বললাম, ‘জলদি আসবে।’

তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে মুখে চাপা দিলাম। বীজাণুর ভয়ে নয়। কেন না, এখানে খারাপ বীজাণু থাকলে, দেবতারও সাধ্য নেই দেহে প্রবেশ করা তিনি রোধ করবেন। কিন্তু দম যে বদ্ধ হয়ে আসছে।

কানের কাছেই একটি শব্দ শুনতে পেলাম, ‘আহা বেচারি!’

মুখ ফিরিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখি শ্যামার মুখ, কিন্তু তার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি, সঙ্গিনীদের মধ্যে আর একজন তাকিয়ে আছে। ধুলো তাদের চোখ বন্ধ করতে পারেনি। সেই সঙ্গিনীর পিছনের দিকে চোখ পড়তেই চমকে গেলাম। সর্বনাশ! বুড়ো আমার দিকে একটা ক্ষিপ্ত বাঘের মতো এক নজরে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম, লোকটির দোষ নেই। অভিভাবক হয়ে আর কতক্ষণ এ আলাপন সে সহ্য করবে!

শ্যামাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই মানুষটি কি তোমার বাবা?’

‘বাবা! হট্! বাবা কেন হবে?’

কথা কটি অত্যন্ত দ্রুত ছিটকে বেরিয়ে এলো শ্যামার গলা থেকে। ঠাওর পেলাম না, মনে হলো, হেসেই মুখটা সরিয়ে সে অন্যদিকে তাকালো।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে?’

জবাব না পেয়ে মুখ তুলে দেখি, শ্যামা দূরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন গাম্ভীর্য ও অন্যমনস্কতা তার। আশ্চর্য! একি ধুলোর ধাঁধা দেখছি, না সত্যি একটা ছায়া ঘনিয়ে এসেছে মুখে! আর কিছু না জিজ্ঞেস করাই উচিত ছিল। কি-ই বা পরিচয়! তবু কৌতূহল চাপতে পারলাম না। বললাম, ‘বলো না।’

অন্ধকারে বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো তীক্ষ্ণ হাসি চমকে উঠলো শ্যামার মুখে। বললো, ‘আমার স্বামী।’

স্বামী! ওই অশীতিপর বৃদ্ধ! এও শ্যামার রহস্য নয় তো! কিন্তু ফিরে আর সে বিষয়ে প্রশ্ন করবার সাধ্য ছিল না আমার।

প্রৌঢ়াকে দেখিয়ে বললাম, ‘উনি?’

তেমনি হেসে শ্যামা বললো, ‘আমার সতীন।’

‘আর এরা দু’জন?

‘একজন আমার সতীনের বোন, আর একজন নোকরানি।’

আমার ঠোঁটের ডগায় হু-হু করে একরাশ প্রশ্ন ছুটে এলো। কিন্তু একরাশ এলেই তো হয় না। রাশ টানতে হয়! জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কী জাত?’

শ্যামা বললো, ‘ভূঁইয়ার।’

ভূঁইয়ার। জানা ছিল আমার। ভূঁইয়ারেরা ব্রাহ্মণ-কায়স্থের মতোই বর্ণ হিন্দু। শুনেছি, তাদের কৌলীন্যপ্রথা বড় প্রবল। মনের মতো পাত্র না জুটলে মেয়েকে অনেক সময় আজীবন কুমারী থেকে বাপের ঘরে কাটাতে হয়। বাঙালির ছেলের কাছে এ জিনিস নতুন নয়। কৌলীন্যপ্রথার কাছে অনেক বাঙালি কুমারী নিজেকে আহুতি দিয়েছেন। ভূঁইয়াদের কথা যখন শুনেছিলাম, তখন বাঙলার কৌলীন্যপ্রথার সঙ্গে তুলনা করতে পারি নি। আজ চোখের সামনেই দেখছি সেই বাস্তব চিত্র।

কিন্তু শ্যামার এমন কী বয়স হয়েছে যে কুমারীত্ব ঘোচাবার জন্য এই লোলচর্ম বৃদ্ধের অঙ্কশায়িনী হয়েছে সে! ভুল ভাবলাম। অঙ্কশায়িনী হয় নি, করা হয়েছে। শুনেছি, এদের অর্থের অভাব নেই। অধিকাংশ ভূঁইয়ার পরিবারই ধনী। সান্ত্বনা বোধ করি সেইটুকুই।

কিন্তু তাকাতে ভরসা পেলাম না আর শ্যামার দিকে। একবেলার পরিচয়। পুণ্যার্থী নয়, বোধ হয় সামান্য একজন মুসাফির ছাড়া তার কাছে আমার আর কোন পরিচয় নেই। আমরা কেউ কারুর জীবন ধারণের রীতি জানি নে। পথ চলার সামান্য হৃদ্যতা। এটা চলতে থাকলে বন্ধুত্ব জন্মায়। বোধ করি, তারই ক্ষীণ সূত্রপাতও হয়েছে। তা ছাড়া শ্যামার মতো মেয়ের অপরিচয়ের বাধা ভেঙে ফেলতে বেশি সময় লাগে না।

তবু তাকাতে পারলাম না। বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো যে হাসি তার মুখে দেখেছি, সে হাসি যে সমস্ত জাতির হৃদয় পুড়িয়ে দিতে পারে। আকাশের বিদ্যুৎ যখন বজ্র হয়ে নেমে আসে তখন রূপবতী সৌদামিনী আগুন হয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।

চাপা ও তীব্র কণ্ঠে শ্যামা বলে উঠলো, ‘কই, আর কিছু জিজ্ঞেস করলে না?’ বলে হেসে উঠলো খিলখিল করে।

কিন্তু আর ও-হাসিতে ভোলার কিছু নেই। যে বলিষ্ঠ ঘোড়ার দুরন্ত দৌড়ের কান-ফাটানো টকাটক শব্দ শুনে ভেবেছিলাম প্রসন্নময়ের মুক্ত দূত ছুটে আসছে, এখন দেখি সে সার্কাসের ঘোড়া। সে আছে তারের বেড়ার ঘেরাওয়ের মধ্যে। গতি নির্ধারিত তার চাবুকের নির্দেশে।

তার হাসি শুনে প্রৌঢ়া আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে রে শ্যামা?’

মুহূর্তে মুখভঙ্গি বদলে শ্যামার ঠোঁট বেঁকে উঠলো। আমার প্রতি বিদ্বেষের বাঁকা কটাক্ষ করে বলে উঠলো, ‘দেখ না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে কত কথা জিজ্ঞেস করছে। ‘ও কে, সে কে, কী জাত? কেন রে বাবা?’

‘তাই নাকি?’

তারা সকলে হেসে উঠলো। যেন আমাকে অপমান করবার জন্যই শ্যামা একটি নিতান্ত গ্রাম্য মেয়ের মতো হঠাৎ ন্যাকা হয়ে উঠলো। যেন প্রতিশোধ নিতে চাইল আমার কোন কৃত অপরাধের।

আমার অপ্রতিভ হবার কথা। কিন্তু শ্যামার এই চকিত রঙ বদলানোর বহুরূপিণী রূপ আমাকে একটুও বাজে নি। তাদের সশব্দ হাসির সঙ্গে আমিও হেসে উঠলাম নীরবে। শ্যামার বিদ্বেষ তো আমার প্রতি নয়। বিতৃয়া তার ওই সংসারের প্রতি। অসতর্ক মুহূর্তে নিজেকে সামান্যতম প্রকাশ করে ফেলতেও মর্যাদাহানি ঘটেছে তার। সেই অপমানের জ্বলুনিটুকু সে রেখে গেল।

আরও কিছু বলবার সাধ ছিল হয়তো শ্যামার। কিন্তু তাদের টাঙ্গা দুলে উঠলো। টিকেট কেটে এনেছে টাঙ্গাওয়ালা।

মনে মনে প্রার্থনা করলাম, বলুক, বলে যাক শ্যামা যা তার প্রাণ চায়। এই জনারণ্য হয়ে উঠুক তার কাছে দুর্গম বন জঙ্গল, আমি রইলাম সেই বনের বিষডোবা হয়ে। সেখানে তার সঞ্চিত বিষ ফেলে দিয়ে সে চলে যাক অমৃতকুম্ভে ডুব দিতে। পুণ্যসঞ্চয়ে ভাসুক প্রাণ-সঞ্চারের সঙ্গম।

কিন্তু তা হয় না। তাদের টাঙ্গার চাকা দু’টো একটা তীব্র আর্তনাদ করে এগিয়ে চলে গেল। ধুলোরাশির উপর ধুলো ছড়িয়ে দিয়ে গেল আরও খানিকটা

কিছুক্ষণের জন্য জনারণ্যের কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল আমার কানে। উৎকর্ণ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম শ্যামার দিকে, একবার সেই মিলিত হাসির ঝঙ্কার শুনব বলে।

শ্যামা এদিকে তাকিয়েছিল। গাড়ি চলতে চলতেই ঠোঁটের কোণের বিদ্বেষটুকু অদৃশ্য হয়েছে। বিদ্বেষ নেই, আনন্দ নেই, হাসিও নেই। মুখ তার হঠাৎ ভাবলেশহীন হয়ে উঠেছে, দৃষ্টি চলে গিয়েছে শূন্যে। চোখে তার তীব্রতা নেই, জ্যোতি নেই। সে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার পেছনেই চকিতের জন্য জ্বলতে দেখলাম, বৃদ্ধ ব্যাঘ্রের ভূ-ঢাকা একজোড়া চোখ। তারপর ধুলো আস্তরণের ভাঁজে ভাঁজে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই টাঙ্গা।

আর হাসি শোনা গেল না। ধূলি-ধূসরিত এই যানবাহন ও জনতাপূর্ণ প্রান্তর যেন পাতালের বদ্ধ জলের আবর্তের মতো নিঃশব্দে পাক খেয়ে ছটফট করে উঠলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *