অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ১৮

১৮

মেলা পাগল হয়ে উঠলো। যে মানুষের বন্যা দেখে এতদিন অবাক হয়েছি, এবার তার অনেক গুণ বেশি। মনে হলো, মানুষ আর ধরবে না সারা মেলায়।

অমাবস্যা নিকটবর্তী। সকালবেলা এসে হাজির বলরাম। এসে বললো, ‘চলেন ঠাকুর।’ বললাম, ‘কোথায় হে?’

বললো, ‘যেখানে যাওয়ার।’

আশ্রমের সবাই অবাক বলরামকে দেখে। শুনলাম, সকলেই বলাবলি করছে, ছোঁড়াটা কোনো গুণ-তুকের ওষুধের সন্ধানে আছে। নইলে, ওসব মানুষের সঙ্গে কেন? ব্রজবালাও আমাকে পর পর ভাবতে আরম্ভ করেছে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায়? তোমাদের তাঁবুতে?’

সে বললো, ‘না, বেড়াইতে।’

বের হলাম। বলরাম সোজা দক্ষিণে নিয়ে চললো। নিয়ে চললো, যেখানে গৃহবধূদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বুঝতে দেরি হলো না, কেন বলরাম টেনে নিয়ে এসেছে।

দূর থেকেই দেখলাম, জনবিরল গঙ্গার ধারে শ্যামা দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের কাছে তার জলভরা কলসী। কলসীর মুখে ভেজা জামাকাপড়। বুঝলাম, চান করে দাঁড়িয়ে আছে। পরেছে লাল টকটকে শাড়ি। জানি, সে দেখেছে। তবু মুখ ফিরিয়ে আছে অন্যদিকে।

পা আপনি থেমে এলো। বললাম, ‘বলরাম, তুমি তো আনন্দ ছাড়া কিছু জানো না। তবে পথের মাঝে শুধু অনাসৃষ্টি করে এ নিরানন্দকে ডেকে আনছ কেন?’

বলরাম বললো, ‘ঠাকুর, ‘আপনি বইলছেন অনাচ্ছিষ্টি? তবে চোখের জল কি শুধু অনাচ্ছিষ্টি? তবে আনন্দে চোখের জল ফেলেন কেন? ‘

‘এখানে সে আনন্দ কই?’

‘ওই যে। হেসে, কথা কয়ে একজন আনন্দ ছিষ্টি করতে চাইছে, তারে আমি থামাই কেমনে? যে কেন্দে কেন্দে আনন্দ কইরতে চায়, তারে ফিরাই কেমনে? এই যমুনাপারে আপনারা দেখা করেন, কেন্দে ফিরে যান। আমি তাই দেখি। দেইখে ফিরে যাইব। সেই আমার আনন্দ। পথ চলার ওই তো মজা। ওই আনন্দটুকুই তার লাভ।’

‘এই বুঝি তোমার গুরুর শিক্ষা?’

‘হ্যাঁ। কিন্তুন্ সে বলে ওইটুকু নাকি তার দুঃখু। সে-দুঃখু মাইনসের সঙ্গ ছাড়ে না। আমরা আনন্দ-দুঃখু একসঙ্গে থাকি।’

বলে সে হাসলো। এগিয়ে গেলাম। শ্যামা ফিরে তাকাল। কিন্তু এ কী! এতদিন সে অন্য শাড়ি পড়ে রাঙা হাসি হেসেছে। আজ রাঙা শাড়ি পরে এসেছে, কিন্তু সারা মুখে ব্যথা-নীল যমুনার স্থির ও গম্ভীর ছায়া। ভেজা চুল এলানো। বাঁকা চোখে তার অভিমানক্ষুব্ধ তিরস্কার। তাকিয়ে প্রথমে শুধু বললো, ‘মিথ্যুক!’

ওইটকু বলতেই তার গলায় যেন অনেক জোর দিতে হলো। বলরাম বললো, ‘ঠিক। কপট বাক্যিতে ঠাকুর বড়সড়ো দেখতেছি।’

না হেসে পারলাম না। মেনে নিতে হলো শ্যামার অভিযোগ। বললাম, ‘শুনলাম, তোমরা একদিন আশ্রমে এসেছিলে।’

চকিতে ঠোঁট বেঁকিয়ে শ্যামা বললো, ‘মগর, তুমি পালিয়েছিলে। ভীরু! কেন পালিয়েছিলে?’

বললাম, ‘পালাই নি। জানতাম না তোমরা আসবে।’

সে বললো, ‘জানতে। ভয়ে পালিয়েছিলে।’

‘কার ভয়ে?’

‘আমার ভয়ে।’

‘তোমার ভয়ে? কেন?’

শ্যামা চকিতে মুখ ফিরিয়ে নিল। মুখ না দেখিয়ে বললো, ‘আমি খারাপ আওরত, তাই। তোমাকে তখলিফ দেব, সেই ভয়ে তুমি কথা দিয়েও যাওনি। তুমি এসেছ, চলে যাবে। আমিও চলে যাব। মানুষের সঙ্গে কি মানুষের মিতালি হয় না?’

বলে সে ফিরল। হাস্যময়ী শ্যামার চোখে বহতা যমুনা। বললো, ‘যেয়ে দেখতে, তোমাকে তখলিফ দিতাম না। যত খারাপ ভাব, আমি তত খারাপ নই।’

পরাজয় ধিক্কার দিল আমাকে। শ্যামার লাল শাড়ি নীল হয়ে উঠলো। ও যে ব্যথার রঙ। যমুনার কারসাজি। যমুনাতীরের বাঁশি কবে লোকলজ্জা মেনেছে! সে যে চিরদিন কলঙ্কের ফোঁটা কপালে দিয়ে হাসিয়েছে কাঁদিয়েছে। শুধু মিতালী! শ্যামা আমার মিত্রাণী। মনে মনে কোনো অস্বীকৃতি ছিল না। প্রকাশ্যে লজ্জা ছিল, সে-বাঁধও ভাঙল। তাকিয়ে দেখি, সেই দুরন্ত মেয়ে, কী অসহায়! ডাকলাম, ‘শ্যামা!’

এই প্রথম তার নাম ধরে ডাকা। শ্যামা ফিরে তাকাল। বললাম, ‘ভীরু নই। তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি।’

শ্যামা বললো, ‘তুমি আমার তখলিফ ভাবছিলে? মিথ্যুক। তবে আসো নি কেন?’ বলতে বলতে তার ভেজা চোখে ও বাঁকা ঠোঁটে হাসি দেখা দিল। বললো, ‘এখানে রোজ চান করতে আসব, যে কদিন আছি। আসবে তো? আসতে হবে।’

মনের কথা বলতে পারলাম না। নীরবে স্বীকৃতি দিতে হলো। বলরাম বললো, ‘একখান হিন্দি গান শিখছি এইখ্যানে এইসে-

‘শুন শুন রাধে, মৎ যাইয়ো যমুনাকে তীর
বেন্দাবনকে কুঞ্জ গলিমে কর পকড়ত মরি চীর।’

এবার গানের সঠিক অর্থ বোঝায় কোনো গণ্ডগোল হয়নি শ্যামার। একবার বলরাম, আর একবার আমার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো অপাঙ্গে। হাসলো নিঃশব্দে ঠোঁট বাঁকিয়ে। তারপর বললো, ‘চল।’

‘কোথায়?’

‘আমাদের ওখানে।’

গেলাম। দেখলাম, মিথ্যের আশ্রয় নিতেই হলো। বলতে হলো, আমার সঙ্গে পথে দেখা হয়েছে তাই ধরে নিয়ে এসেছে। প্রৌঢ়া প্রেমবতীয়া আমাকে দেখে হেসে উঠলো। প্রৌঢ়া বললো, ‘লুলাসাধুজীর সঙ্গে তোমার আশ্রমে গিয়েছিলাম। কদ্দিন আছ আর?’

কোনো বিকার না দেখে অবাক হলাম। বললাম, ‘অমাবস্যাটা দেখে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।’

তারপরেই বুড়োর সঙ্গে দেখা। সর্বনাশ! বৃদ্ধ ব্যাঘ্র এক নজরে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য! বুড়ো হঠাৎ ফোকলা দাঁতে হেসে বললো, ‘খবর ভালো?’

বললাম, ‘হ্যাঁ।’

বুড়ো বললো, ‘আমার ছোট বউ তোমার কথা খুব বলে।’ তারপর হঠাৎ গুরুগম্ভীর গলায় বললো, ‘ভগবান তোমার ভালো করুন।’

বলে, বৃদ্ধ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দূর আকাশের দিকে।

চোখ তুলে দেখি শ্যামা তাকিয়ে আছে এদিকে।

তারপর দেখা হয়েছে প্রায় প্রতিদিন। শুধু ঘাটে নয়, নাগাবাসুকির মন্দিরে, দারাগঞ্জের বেণীমাধবের স্থানে, ওপারে অড়হরের ক্ষেতের ধারে। বলরাম ছিল সব সময়। প্রৌঢ়া প্রেমবতীয়াও সঙ্গে ছিল দু-একবার। কেবল পাগলের মতো ঘুরেছে লক্ষ্মীদাসী বলরামের পেছনে পেছনে।

অমাবস্যার আগের দিন যমুনার ঘাটে বললাম, ‘পরশু চলে যাব।’

শ্যামা বললো, ‘আমরাও।’ বলে, সে ফিরে তাকালো দূর যমুনার দিকে। রুদ্ধ গলায় বললো, ‘মনে থাকবে?’

‘কী?’

‘এই মেলা?’

‘থাকবে।’

শ্যামা দুর্জয় কটাক্ষ হেনে বললো, ‘মিথ্যুক।’

না, মিথ্যুক নই। জানিনে কিসে ভরে রহলো বুক ও মন। এই ভরা মন নিয়ে আমার চলা। ভুলবো কেমন করে! বলরাম বললো, ‘আমার কী পাওনা হইল?’

বললাম, ‘কিসের পাওনা?’

‘আপনাদের বিদায়ের?’

শ্যামা বললো, ‘আমি দেব তোমাকে, কাল ভোরে, এখানে। তোমার বাবুজী এলে।’

ভোরে যেতে পারলাম না। অনেক বেলা হলো। আশ্রম ফাঁকা। ভিড় দেখে আতঙ্ক হলো। কিন্তু এ তো শুধু ভিড় নয়, পাগলের মতো সবাই দিগ্বিদিক্ ছুটছে। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে, চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে, কাপড়-জামা ছিঁড়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মানুষ চারিদিকে ছুটছে। খুন! মৃত্যু! মরে গেছে, হাজার হাজার মরে গেছে!

কী হল? যাকে জিজ্ঞেস করি, সে-ই ঠেলে ফেলে ছুটে যায়। দু’বার মুখ থুবড়ে পড়লাম। মানুষ কি পাগল হয়েছে?

শুনলাম, মানুষে সাধুতে দলে বিষে প্যারেড গ্রাউন্ডে হনুমানজীর মন্দিরের কাছে মৃতদেহের স্তূপ জমেছে। সাঁকো পারো হতে পারলাম না। ভিড় আর পুলিশের কর্ডন চারিদিকে।

বেলা দশটায় এসে একটার সময় পারো হলাম। সারা মেলা জুড়ে শুধু মৃত্যু-চিৎকার। সে কাহিনী আর বাড়াব না।

কিন্তু বলরামদের তাঁবু কোথায়? বলরাম কোথায়? সব ছিন্ন-ভিন্ন ভাঙা তছনছ চারিদিকে। কাউকে পেলাম না। লক্ষ্মীদাসী, বলরাম, শ্যামা-কাউকে না।

চারিদিকে শুধু মৃতদেহের স্তূপ। তাকে ঘিরে রয়েছে পুলিশবাহিনী। অপরিচিত নারী ও পুরুষ কণ্ঠলগ্ন হয়ে পিযে মরেছে। শিশু চেপটে লেপটে রয়েছে মায়ের বুকে। যে দেহ ও রূপ নিয়ে অনেক লজ্জা, তা আজ ঠাণ্ডা, স্পন্দনহীন স্তূপীকৃত। রঙিড় ওড়না আর সিল্ক শাড়ি, নাগরা জুতো আর কলিদার পাঞ্জাবি, মাথার টিকুলি আর গলার চন্দ্রহার, তারই সঙ্গে ছন্নছাড়ার ছিন্ন বেশ, সব একাকার। কিন্তু সে স্তূপে সাধু একটিও নেই। পুলিশের কর্ডন ভেঙে মানুষ ছুটে আসতে চাইছে। খুঁজছে। বউ-মা, বাপ-ছেলে, আত্মীয়-বন্ধু, সবাইকে খুঁজছে, ডাকছে, পায়ে পড়ছে পুলিশের।

কে একজন চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘সব মাতাল সাধুরা এদের খুন করেছে, খুন।

রাজপুরুষ থেকে শুরু করে সকলের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও ক্রোধ ফেটে পড়েছে।

চলে এলাম। দেখলাম, আশ্রমের অনেকে এসেছে হাত-পা ভেঙে। হাত-পা-ভাঙা অবস্থাতেই গোছাতে ব্যস্ত। পালাও পালাও। একদিন যেমন কারুর মুখে পা দিয়ে, কারুর গলা টিপে সবাই এসেছিল, তেমনি করে আজ সব পালাচ্ছে। একদিন পাগলের মতো হন্যে হয়ে সবাই এসেছিল, আজ পাগলের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে সবাই পালাচ্ছে।

সন্ধ্যা হলো। শত শত চিতার আগুন লকলকিয়ে উঠলো প্রয়াগের আকাশে। আগুন লেগেছে ভেবে, ভুল করে বার বার ফায়ারব্রিগেড অ্যালার্ম বাজাল। কিন্তু সে আগুন নেভাবার জন্য কোনো জলাধারা ছুটে এলো না। কার প্রতিশোধ এমন রূপ নিল, কার প্রতিদানের এমন ভয়ংকর মূর্তি দেখা দিল!

ব্রজবালা ডাকল। চমকে উঠলাম। দেখলাম, তারা লটবহর নিয়ে রওনা হয়েছে। কেউ বললো না, শুধু সে বললো, ‘যাবে না? ‘

ঝোলা কাঁধে নিয়ে বললাম, ‘চল।’কিন্তু প্যারেড গ্রাউণ্ডে এসে স্থির থাকতে পারলাম না। ব্রজবালারা চলে গেল। আবার ছুটে গেলাম সেখানে। না, কেউ নেই। শুধু অপরিচিত জনতা ও পুলিশের ভিড়। ফিরে বাঁধে উঠতে গিয়ে, একটি গাছতলায় দেখলাম লক্ষ্মীদাসী, সঙ্গে কয়েকজন ছন্নছাড়া ভীত সন্ত্রস্ত বৈষ্ণব। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম বলরামের কথা

লক্ষ্মীদাসী আমাকে দেখে শান্ত গলায় বললো, ‘কতবার, কতবার বারণ কইরেছি ঠাকুর। কিন্তু সে যে যাওনের জন্যি আইসছিল, তারে আমি ফিরাইয়া নিয়া যাইব কেমনে?

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে বলরামের?’

একজন বৈষ্ণব ফুঁপিয়ে বললো, ‘বলরাম ওইখানেই আছে।’ বলে, চিতার দিকে দেখিয়ে দিল।

বলরাম নেই? নেই। বলরাম তার কথার ফুলবাগান নিয়ে এখানে এসেছিল। তার মালিনী ছিল লক্ষ্মীদাসী। এখন বাগান দগ্ধ হচ্ছে। বাগানের মালিনী এইখানে বসে আছে। শক্ত হয়ে রইলাম, নিজেকে দু’হাতে চেপে ধরে রইলাম। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। পরে বললাম, ‘চলো, যাওয়া যাক।’

লক্ষ্মীদাসী বললো, ‘চিতা নিভুক ঠাকুর, পরে যাইব।’

তারপরে ফিসফিস করে বলে চললো, ‘তুমি যেথায় আছো সেথায় আছি, আমার মিছা ভাবনা নাই মনে। তুমি ডাকলে আপনি কপাট খোলে, তোমার বাতাসে বাতাসে তাল দিয়া নাচি।’

বলরামের-ই গান। মূল গায়েনের গান। যার গান না শুনলে লক্ষ্মীদাসীর মন্দিরের ঠাকুর হাসে না, মুখ তোলে না। সে আবার বললো, ‘নিভুক ঠাকুর, তা পরে যাইব।’

সেই ভালো। গভীর রাত্রে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওদের, মানে শ্যামাদের কোনো খবর জানো?’

লক্ষ্মীদাসী বললো, ‘আপনার ওনার?’

আমার ওনার! সে বললো, ‘ওনারে দেখি নাই। ওনার সতীনেরে দেখেছি ঠাকুর, বুক থাপড়াইয়ে কানতেছিল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস কইরতে পারি নাই।’

বুক চাপড়ে কান্না? হাঁটু মুড়ে বসে রইলাম। নতুন করে আর কোনো ভয়ংকরতাই নাড়া দিতে পারল না মনকে। কেবল ভেতরটা অস্থির হয়ে রইলো।

সকালেও চিতা নিভল না। তবু যাত্রা করতে হলো। পলায়মানদের স্রোতে ভেসে গেলাম। আসার জন্য মৃত্যু, এবার যাওয়ার তাড়ায় মানুষ মানুষকে পিষে মারছে।

ভিড়ের মধ্যে ট্রেনের কামরা খুঁজছিলাম। পিঠের ঝোলায় টান পড়ল। ফিরে দেখি প্রৌঢ়া। বলল, ‘উঠে এসো!’ উঠলাম লক্ষ্মীদাসীকে নিয়ে। লক্ষ্মীদাসী বসলো এক কোণে। দেখলাম, তার পাশে প্রেমবতীয়া, তারপরে পাতিয়া, তারপরে শ্যামা। প্রৌঢ়া আর শ্যামা দু’টি সাদা ওড়নার ঘোমটা দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকেছে।

প্রৌঢ়া ফুঁপিয়ে উঠে বললো, ‘আমার বুড়াটা মারা গেল ভাই।’

ফুঁপিয়ে উঠলো প্রেমবতীয়া ও পাতিয়া। কেবল শ্যামার মুখ দেখতে পেলাম না। সারা কামরাই ব্যথা ও শোকের কান্নায় ভরা।

জায়গা ছিল না। মাঝখানে মালের উপর বসতে হলো। শ্যামা ফিরে তাকাল। ওড়না খসে গিয়েছে। সিঁথিতে মেটে সিঁদুর নেই, কপালে নেই টিপ। রাত্রিজাগরণ ও ক্লান্তির ছাপ সারা চোখে-মুখে। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল। ও-ই শ্যামার বিধবার বেশ। চোখে মুখে তার ক্লান্তি ও বেদনা ছিল। আর ছিল চাপা সুখের একটি নিগূঢ় ছাপ। কিন্তু বৈধব্যের যন্ত্রণার ছাপ কোথায় যেন আড়াল পড়েছে।

অনেকক্ষণ পর চোখ বুজে আসছিল। ঘাড়ে স্পর্শ পেয়ে ফিরে দেখি শ্যামার হাত। ঠোঁট দু’টি একবার কাঁপল। বললো, ‘আমরা পাটনায় নেমে অন্য গাড়ি ধরব।’

অকারণেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘কেন?’

ব্যথিত হেসে শ্যামা বললো, ‘ঘরে যেতে হবে না?’

কোনো সঙ্কোচ না করে তার দিকে ফিরে বসলাম। বললাম, ‘বলরাম—’

সে বললো, ‘জানি। তুমি ঘাটে এলে না। তোমার হয়ে তাকে আমি একটা জিনিস দিয়েছিলাম।’

‘কী?

‘আমার একটা আংটি।’

নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে বিষন্ন হেসে বললো, ‘একটা কথা বলব? আমাকে কী মনে হল?’

‘এখনো বুঝতে পারি নি।’

‘আমার কিন্তু মনে হয়েছে।’

‘কী?’

‘তুমি নিষ্ঠুর।’

বলতে বলতে তার চোখের কোণ দু’টি চকচক করে উঠলো।

কে জবাব দেবে? বলরাম নেই আজ। কথা নয়, সে যে গান গেয়ে জবাব দিতে পারত! সে আবার বললো, ‘যমুনাপারের ওই ঘাটে অনেকবার একলা গিয়ে অনেক ভেবেছি। তুমি যেখানে আসতে। ভেবেছি, আচ্ছা কী হল?’

বললাম, ‘কিছুই না।’

সে বললো, ‘অনেক কিছু। যমুনার ঘাটে আর আমার মনে রয়েছে তা। এই প্রথম আর…’ চুপ করে আবার বললো, ‘এই শ্যামাকে, নতুন বিধবাকে তোমার মনে থাকবে?’

‘থাকবে!’

সে আবার আমাকে বললো, ‘মিথ্যুক! তুমি বড় মিথ্যুক!’

বলতে বলতে তার গলা রুদ্ধ হলো।

আমার মনের মধ্যে শুধু হু-হু করে উঠলো একটি কথা, আজ বলরাম নেই! নেই! সে ছাড়া যে আমাকে সত্যবাদী বলার আর-কেউ ছিল না।

পাটনা এলো। প্রৌঢ়া বললো, ‘যাই।’

প্রেমবতীয়া, পাতিয়া প্রথম কথা বললো, ‘যাচ্ছি।’ শ্যামা তাকাল, ঠোঁট দু’টি নড়ল।

কী বললো অস্ফুটে, বুঝলাম না। তারপর সাদা ওড়নার ঘোমটা ঢেকে নেমে গেল। অনেক কথা ছটফট করে উঠলো মনের মধ্যে। কিছুই বলতে পারলাম না। কেবল তাকিয়ে রইলাম! যতক্ষণ গাড়ি দাঁড়িয়ে রইলো, প্ল্যাটফরমের ওপর থেকে নতুন বিধবা শুধু অন্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *