১২
উঠে দেখি ঘোড়-সওয়ার ছুটছে! নেহরু আসছেন। মানুষের দুরন্ত গতি অচমকা, দু’দিকে ফিরছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী, অন্যদিকে সঙ্গম।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা স্পর্শে ফিরে তাকালাম। সর্বনাশ! তাকিয়েই লাফিয়ে সরে গেলাম দু’পা। একটি প্রকাণ্ড ময়াল সাপের ল্যাজ এসে ঠেকেছে গায়ে। ল্যাজটি টেনে গলায় জড়িয়ে নিয়ে, একরাশ হলদে দাঁত বের করে হাসলো সাপের মালিক। ভাঙা মোটা গলায় বললো, ‘কুছ ডর নহি বেটা। এ মন্ত্রপূত শিব হার।’
একে তো ভয় পেয়েছিলাম। তার উপরে হেসে হেসে এ ভয়ংকর শিব-হারের কথা শুনে বড় রাগ হয়ে গেল। বললাম, ‘খুব হয়েছে। সাপের ল্যাজ ঠেকিয়ে ছাড়া কি ডাকা যায় না?’
কিন্তু রেয়াত করলো না সে আমার রাগকে। পরনে তার ময়লা গেরুয়া আলখাল্লা বিশেষ। হিসাব করলে মিলবে শতখানেক তালি। চেহারায় খানিকটা ভূতানন্দ ভৈরবের ছাপ। চুল দাড়িও সেই রকমেরই। কিন্তু গলায় এতবড় একটা ময়াল, এই দারুণ ভিড়ের জনতাকেও দূরে সরিয়ে রেখেছিল অনেকখানি। যে দেখে, সেই ভীত চকিত চোখে তাকিয়ে কয়েক হাত তফাত দিয়ে যায়। কাঁধে তার বড়সড় ঝুলি একটি। হাতে বিচিত্র লাঠি। লাঠি নয়, যেন এক আঁকাবাঁকা সাপ।
আমার ক্রুদ্ধ মুখের দিকে সে শিবনেত্রে চেয়ে হাসলো। হেসে বললো, ‘দেখ বেটা বাবুজী, এ যাকে স্পর্শ করে, তার কপাল ভালো। তোরও কপাল আমি খুব ভালো দেখছি বাবুজী।’
বলে, সে সত্যি সত্যি কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করলো আমার কপাল। বুঝলাম, গতিক ভালো নয়। বাপ মা আত্মীয় বন্ধুস্বজন যে-কপাল কোনোদিন ভালো দেখে নি, সে-কপাল আজ অকস্মাৎ এই আলখাল্লাধারীর কাছে ভালো হয়ে ওঠা ভালো নয়। পেছন ফেরার উদ্যোগ করে বললাম, ‘হবেও বা।’
সে তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে বললো, ‘শুন্ বেটা, কোথায় যাচ্ছিস! তোর ভাগ্য ভালো। কপালে তোর শিব লীলা করছে। আজ তোকে আমি মহাদেবের প্রসাদ দান করব।’
বলে, সে চট করে হাত ঢুকিয়ে দিল তার ঝুলিতে। বন্ধ মুঠি বের করে বললো, ‘হাত পাত।’
বুঝলাম, বিপদ বড় দরো। কী দেবে সে হাতে? একবার এক সাপুড়ে এমনি হাত পাততে বলে বেমালুম হাতের উপর ছেড়ে দিয়েছিল একটা জীবন্ত কাঁকড়া বিছে। অবশ্য সে বিছের হুল ছিল না। কিন্তু শিউরুনি তো কাটে না তাতে। এও যদি তেমনি হয়?
বললাম, ‘কী আছে, দেখাও।’ সে বললো, ‘নারাজ ন হো বেটা। হাত পাত, আমি দিচ্ছি।’
কী মুশকিল! এদিকে ভিড় হচ্ছে আমারই চারপাশে। যত আমি চলতে চাই, সে তত আমার পিছনে ধাওয়া করে। হাত পাততে হলো। সে আমার হাতের উপর কী একটা দিল। চেয়ে হঠাৎ মনে হলো, কোন ছোট জাতের পোকা, কিন্তু মৃত। বস্তুটি শক্ত, সরু ও লোমশ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী এটা?’
সে বললো চাপা গলায়, ‘শেয়ালের শিং।’
শেয়ালের শিং! অনেক চতুষ্পদীয়ের শিং দেখেছি চোখে ও ছবিতে। কিন্তু, এমন অভুতপূর্ব বস্তু তো কখনো দেখিনি, শুনিনি শেয়ালের আবার শিং গজায়! বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা না হয় রইলো কিন্তু শেয়ালের শিং দিয়ে কী রূপ খুলবে আমার কপালের? জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু কী করবো এ দিয়ে?’
সে বললো হেসে হেসে, ‘তোর কিছু করতে হবে না বেটা। তুই খালি রেখে দিবি। যা করবার, স্বয়ং শিব করবেন। সব শেয়ালের শিং হয় না। যে মহাদেবের সাক্ষাৎ পায়, তারই হয়। কখন? না, যখন মহাদেব কালিকাদেবীর সঙ্গে মিলতে আসেন, তখন যে ‘শিয়াল’ তাঁর সাক্ষাৎ পায়, তারই শিং গজায়! তোর কপাল ভালো, পেয়ে গেলি।’
তা হবে হয়তো। কিন্তু যে সাধনা আমি করিনি, তার ফলে কেন ভাগ বসাই! জানিনে, মহাদেবের দর্শনপ্রাপ্ত কোন সে ভাগ্যবান শেয়াল, আর তার শিং কেটে ভাগ্যবান আজ এই সাধক। কিন্তু আমার ভাগ্যের বড় দুরূহ পথে যাত্রা। এ দিয়ে আমার কী হবে?
আমার দ্বিধান্বিত ভাব দেখে আলখাল্লাধারী তাড়াতাড়ি আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিফিস্ করে বললো, ‘ইস মে বশীকরণ হোতা হ্যায় বেটা। দুনিয়া তোর বশ হয়ে যাবে। মনের মানুষ তোর কাছে আসবে। তোর দিল ভরে দেবে।’
হেসে উঠলাম। যেমন নিয়ে বেরিয়েছিলাম পথে, সেই মনের হাসিটা যেন এই কদিন পরে গঙ্গা-যমুনার তীরে বেরিয়ে এলো স্বরূপে। বশীকরণ, তাও মনের মানুষকে? মনের মানুষ খুঁজতে গিয়ে কেউ বিবাগী। কেউ পেয়ে, না পেয়েও বিবাগী। মনের মানুষ! সে কেমন জানি নে। কোথায় তার বাস, কেমন তার রূপ তাও জানি নে। নিশিদিন তো খালি এই নাম গুনগুন করছি—
ঘুরেছি পথে বিপথে।
গহন বনে বনে।
মন পাখি গেয়েছে শুধু
রয়েছি, তোমারি মনে মনে।।
অকারণে কেন মনের মানুষকে শেয়ালের শিং দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করা! সে যে আড়াল থেকে এই লক্ষ মুখের হাসি দিয়ে আমাকে বিদ্রূপ করবে। বললাম, ‘সাধুজী, এ আমার দরকার নেই।’
কিন্তু সে নিরাশ হবার পাত্র নয়। গম্ভীর মুখে, চোখ ঘুরিয়ে বললো, ‘বেটা, সব দরকার তো তোর বোঝার মধ্যে নয়। এটা তোকে নিতেই হবে। হাওয়া লাগাস নি, পবিত্রজ্ঞানে পাকিটে ফেলে রাখ। আর আমায় খুশি করে দে!’
তাকে খুশি করাটাই বোধ হয় আসল। বুঝলাম, শেয়ালের শিং না গছিয়ে সে ছাড়বে না, জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ভাবে, বল?’
সে চোখ বুজল, আবার খুলল। বললো, ‘বেশি নয়, আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দে।’ অচিরাৎ তার বশীকরণ যন্ত্র বাড়িয়ে ধরলাম। আমার শহুরে মূর্তি ধরে বলতে হল ‘এই নাও বাবা, তোমার জিনিস। পাঁচ টাকা দিয়ে এ জিনিস কিনতে পারব না।’
কিন্তু সে আমার চেয়েও অগ্রসর। বললো, ‘কেনাকাটা নয় বাবা, দান। তোমারো দান, আমারো দান। আচ্ছা দু’টো টাকা দে।’
আমি হাতটা আরো এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমাকে রেহাই দাও সাধুজী, দু’টাকা আমার কাছে নেই।’
‘কত আছে বেটা? ‘
মিথ্যের আশ্রয় না নিয়ে আর পারলাম না। বললাম, ‘চার আনা আছে।’
চোখে তার অবিশ্বাস দেখা দিল। অবিশ্বাসী চোখে একবার দেখলো আপাদমস্তক হতাশভাবে ঘাড় নেড়ে বললো, ‘তাহলে ফিরিয়েই নিতে হয়।’
বাঁচলাম। ফিরিয়েই দিতে গেলাম। সে চিন্তিতভাবে বললো, ‘কিন্তু দান তো ফিরিয়ে নিতে পারি না। আচ্ছা দে, চার আনা-ই দে। তোর কপালে ছিল।’
এতখানি যখন হলো, আর একটু হোক। বললাম, ‘তোমাকে চার আনা দিলে আমি কী খরচ করব? দু আনা নাও।’
এবার আর তার মুখে কথা নেই। তীর্থক্ষেত্রে আমার মতো এমন বেয়াদব পুণ্যার্থী থাকতে পারে, এটা বোধ হয় সে ভাবতে পারেনি। সে বড় বিমর্ষ হয়ে পড়লো। কোথায় তার সেই সাধনদীপ্ত চোখ? দেখি, দুর্ভাগার করুণ দু’টি চোখে তার নিরাশার গ্লানি। দু-আনা দিলাম। সে তবু হাত পেতে রইলো।
চলে যাই দেখে ডেকে বললো, ‘বাবুজী, গরীবটাকে একটু চা খাওয়াও। আর কী বলব?’
তার মাঝে এবার আসল মানুষটি দেখা দিয়েছে। জীবনের রসদ খোঁজার এই তার পন্থা। মানুষের আসল মূর্তি দেখা দিলে কে আর তাকে অবহেলা করতে পারে! বললাম, ‘চল। খাওয়াচ্ছি।’
সঙ্গমের এই তাঁবু-সমুদ্রে চায়ের দোকানের অভাব নেই। দোকানে গিয়ে বললাম, ‘তোমার বস্তু তুমি নাও, পয়সা তোমাকে ফেরত দিতে হবে না।’
সে গরম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে জিভ কাটল। বললো, ‘আরে বাপরে, ও আমি আর ফিরিয়ে নিতে পারবো না।’
ভাঙি তো মচকাই না। চায়ের গেলাসে ঘন ঘন চুমুক দিয়ে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হলো তার। শেয়ালের শিং দিয়ে বশীকরণ করতে পারল না। ওই চোখ দিয়ে বশীভূত করলো আমাকে চায়ের পরে আরো দু-আনা দিয়ে বললাম, ‘চলি সাধুজী।’
বিস্মিত হাসিটি তার চোখে দেখা দেওয়ার আগেই ভিড়ে মিশলাম।
ভিড়ের মধ্যে হিদের মা। হাত ধরে বললো, ‘বাবা যে!’
ঘুরে ঘুরে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। আশ্রমমুখী হয়েছিলাম। দেখলাম, হিদের মা’র সামনে একজন সাধু।
বললাম, ‘কী করছেন?’
হিদের মা সাধুকে দেখিয়ে বললো, ‘এই বাবাজীর কাছে বসে একটু কথা শুনছিলুম। বড় সুন্দর কথা বলে। বলে, মা, যে জন্ম-দেনদার, সে যদি মুখ ঘুরিয়ে চলে, পাওনাদার হাসে। তুই খুব হাস, হেসে হেসে বেড়া। মায়ের দেনা শোধ হয় না। তুই মরলে, তোর ছেলে মুখে আগুন দিয়ে কাঁদবে। ভাববে তখন, কেন দেনা শোধ করিনি মায়ের?’
বলে হাসলো হিদের মা। মোটা আর ফাটা লেন্সের আড়ালে সেই মুগ্ধ চোখজোড়া। কিন্তু হাসিটি যেন অসম্পূর্ণ। বললো, ‘তা হলে যাই বাবাজী, আবার কাল আসব, আপনি আমাকে একজন সাক্ষ্মণ সাধু মিলিয়ে দেবেন। আমি তাঁরে ভোজন করাব।’
সাধু ক্ষীণদেহ। জটা প্রকাণ্ড। তবে, এই শীতেও নগ্নদেহ। শুধু কনি আঁটা। বললো, ‘বটে! বেশ তো মা, আমিও ব্রাত্মণ। আমাকে ভোজন করিয়ে দাও।’
হিদের মা এক মুহূর্ত দেখলো সাধুটির দিকে, তারপর বললো, ‘বেশ তো বাবা, বল, তুমিই আমাকে আশীর্বাদ করবে।’
আমি বললাম, ‘তাহলে চলি আমি।’
কিন্তু হাত ছাড়লো না হিদের মা। বললো, ‘যাবে কেন? চল, বাবাজীকে খাওয়াই। দেখে য্যাও।’
বলে, আমার আপত্তি না মেনে হাত ধরে নিয়ে চললো সে আমাকে। এতে আমার কিছুই করবার ছিল না। কৌতূহলও অনুভব করলাম না। বরং খানিক ভয়ই ছিল। হিদের মা খাওয়াবে, কিন্তু কী দিয়ে খাওয়াবে সে!
সামনেই একটি ছোট খাবারের দোকান দেখে দাঁড়ালো হিদের মা। আহ্বান করলো বিদেশী দোকানদার। মেলার তেমন ভিড় নেই দোকানটিতে। পিতলের বড় বড় বাটায় সাজানো রয়েছে প্যাঁড়া, পাকানো খোয়া আর সন্দেশ। পুরিও ভাজা হচ্ছে।
হিদের মা দোকান থেকে জল চেয়ে নিল। নিজের হাতে জল ছিটিয়ে, আঁচল দিয়ে মাটি লেপে সাধুকে বললো, ‘বোসো বাবা।
সাধু বসে বললো, ‘কত খাওয়াতে পারবি মা?’ হিদের মা বললো, ‘যত তুমি খেতে পারো বাবা।’ বলে দোকানদারকে বললো, ‘বাবাজীবনকে খেতে দাও বাবা। পুরী সন্দেশ প্যাড়া, সবরকম দাও।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মখু চুন হয়ে উঠলো। ওকি খাওয়া! এ যে থামতে চায় না। কিন্তু হিদের মা মুগ্ধ চোখে, যেন প্রাণভরে সেই খাওয়া দেখছে। আমার মুখ চুন হলো, কারণ আমার যে এক ভয়। সে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে হিদের মা নিজে। এত পয়সা সে কোথা থেকে দেবে? তবে কি, ভাবতে যতই সংকোচ হোক, তবে কি সেইজন্যেই হিদের মা হাত ধরে স্নেহভরে ডেকে নিয়ে এলো আমাকে?
এবার দোকানীরও চোখে সংশয় দেখা দিল। তার ছোট দোকান, খুবই ছোট। মাল খুবই কম। তবু একজনের পক্ষে সে যে অমানুষিক। কিন্তু তার পেতলের বাটার ভাণ্ডার ফুরিয়ে এলো। যত ফুরিয়ে আসতে লাগল, তত সে সংশয়ান্বিত। একবার দেখছে হিদের মার দিকে, আর একবার আমার দিকে। আমার জামাকাপড়ের দিকে। সে চাউনি দেখে আমার বুকে ধুকপুকু। এ কী বিপদে এনে ফেললো আমাকে হিদের মা!
কিন্তু আশ্চর্য সহজ ও নির্বিকার খাওয়া সাধুর! তার কি একটু কষ্টও হচ্ছে না? দেখতে মানুষটি সে ওইটুকু, কিন্তু পাতা তার কেবলি খালি হয়ে চলেছে। এ কি সে-ই খাচ্ছে, না আর কেউ?
দোকানী না জিজ্ঞেস করে পারল না, ‘আর দেব মায়ীজী?’
হিদের মা বললো, ‘দেবে না বাবা? উনি যত খাবেন, তত দাও। খাওয়াও। খাইয়ে তোমার আমার, সকলের সুখ। কী বল বাবা, অ্যাঁ?’
বলে সে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু এত অসহায় বোধ আর কখনো করি নি। যা-ই বলি, যা-ই বল, সংশয় পেরিয়ে সন্দেহ আমার বন্ধমূল হতে চললো। পকেটের মধ্যে আমার পয়সার পুঁটলিটা যেন বন্দী ইঁদুরের মতো লাফালাফি করছে বেরিয়ে পড়বার জন্য। ওটাকে যদি কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারতাম! কিন্তু কে জানতো, এমন বিপদে পড়বো! আমার তো কোনো সন্দেহ নেই, ‘দেওয়ার চেয়ে সুখ কী?’ এই কথা শুনতে হবে আমাকে। কিন্তু এতবড় দুঃখ থেকে কে আমাকে উদ্ধার করবে, হিদের মা’র হাত থেকে রেহাই পাব কী করে?’
যে খাচ্ছে আর খাওয়াচ্ছে, শুধু তারাই নির্বিকার। তৃপ্ত, মুগ্ধ। কেবল স্বস্তি নেই দোকানদারের। দুরন্ত শঙ্কা আমার। আমার শঙ্কিত মুখ দেখেই, সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে দোকানদারের। কে জানে, চোখের ইশারায় পাহারা বসিয়েছে কিনা সে।
দোকানদারকে ঘোষণা করতে হলো, ‘আমার এ-বেলার তৈরি খাবার সব শেষ হয়েছে। টাকা মিটিয়ে তোমরা দুসরা দোকান দেখ।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, ‘সত্যি তার সবই শেষ।’
হিদের মা বললো, ‘বাবা, আর খাবে?’
মন খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। এখনো তার রেশ যায় নি। কিন্তু মানুষের অতি-মানবিকতায় কিংবা পশুত্বে আমার বিশ্বাস নেই, শ্রদ্ধাও নেই। গল্পের মতো শুনেছি, কোনো এক কালে অমুকে অত খেতে পারত। পারত কিনা জানি নে। কিন্তু আজ চোখের সামনে বিরক্তি ও ভয়ে সে দৃশ্য দেখতে হচ্ছে।
জল খেয়ে মুখ মুছল সাধু। একটি উদ্ধার তুলে, ক্ষুধাতৃপ্ত বললো, ‘না, আর খাব না। আমার পেট ভরেছে।’
তবু ভালো। কিন্তু যা খেয়েছে, তাই যে অনেক। সে অনেকের কী উপায় হবে! মানসচক্ষে দেখতে পেলাম, হিদের মা ওই চোখ দু’টি তুলে আমাকে যেন কিছু বলছে, কী যে বলছে তা মাথায় আসছে না।
হিদের মা বললো সাধুকে, ‘বাবা, আমাকে নিয়ে, আমার কাছে খেয়ে কেউ সুখী নয়। তুমি খুশি হয়ে থাকলে আমাকে আশীর্বাদ কর!’ বলে সে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করলো লুটিয়ে।
সাধু বললো, ‘তোমার প্রাণে আনন্দ হোক।’
বলে সে চলে গেল। হিদের মা উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলো দোকানদারকে, ‘কত হয়েছে দাদা তোমার?’
দোকানদার বললো, ‘খুচরা হিসাব ধরি নি ময়ীজী। সের হিসাবে তোমার উনিশ টাকা তিন আনা হয়েছে।
হিদের মা একবার তাকালো আমার মুখের দিকে। তারপর কোমর থেকে বার করলো একটা ময়লা পুঁটলি। খুলতে দেখা গেল, দোমড়ানো নোট আর খুচরো পয়সা। সবগুলি একটি একটি করে হিসেব করলো। আবার আঁচল খুলল। তাতেও কিছু পয়সা ছিল। সেই পয়সাগুলি যোগ করে, কয়েক আনা পয়সা ফের বাঁধল আঁচলে। বাদবাকি সব তুলে দিল দোকানীর হাতে। বললো, ‘গুনে দেখে নাও দাদা।’
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হিদের মা’র গোনার সঙ্গেই দোকানীর গোনা হয়েছিল। সে টাকাগুলি হাতে নিয়ে, মুগ্ধ চোখে যেন দেবীদর্শন করছিল। তাড়াতাড়ি গদির উপর টাকা রেখে সন্ত্রস্ত গলায় বললো, ‘হিসাব আমার হয়েছে মায়ীজী, ও আমার ভগবানের দান।
হিদের মা ফিরে তাকালো আমার দিকে। চোখে তার জল, মুখে হাসি। তারপর আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো বাইরের জনরণ্যের দিকে। ফিফিস্ করে বললো, ‘পাষাণভার নামল আমার বুক থেকে। আনন্দ হোক, আনন্দ হোক প্রাণে। আমার প্রাণের সব নিরানন্দ ধুয়ে মুছে যাক।’
বলতে বলতে কী এক আবেগের তোড়ে ভেসে গেল হিদের মা। আমাকে ডাকলে না, ফিরলে না। কোনো এক মহা আনন্দের সব-ভোলানো হাওয়া এসে টেনে নিয়ে গেল তাকে। ডেকে নিয়ে গেল। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সব শঙ্কা ভয়, আমার সব অহংকার চূর্ণ করে দিয়ে চলে গেল সে। হিদের মা’র জীবনে যা ভক্তি, যা বিশ্বাস, আমার তা নয়। হয়তো একেই বলে আত্মসম্মোহন। কিন্তু তার এই ভক্তি, বিশ্বাস দিয়েই সে আমার মনের সঙ্কীর্ণতার স্পর্ধাকে ভেঙে দিয়ে গেল। এর অবাস্তবতা, অলৌকিকতা, সব জেনেও তার সব দেওয়ার এ আনন্দের মর্যাদাকে তো অবহেলা করতে পরি নে। যে এমনি করে দিয়ে যায়, তাকে এক টাকা দিয়ে আমি করুণার আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলাম। বিদ্রূপ নয়, কথা নয়, নিজের আনন্দ ও বেদনা দিয়ে সে আমার আত্মপ্রসাদকে ধিক্কার দিয়ে গেল। সে আমাকে সাধু খাওয়ানো শেখাল না। আমার নিজের বিশ্বাসের প্রতি হৃদয়ের সব দ্বার অসঙ্কোচে উন্মোচনের শিক্ষা দিয়ে গেল। তাই সে অমনি করে দেওয়ার কথা বলেছিল। তাই কিপটে বুড়ি মিষ্টি গলায় বলেছিল, ‘আমাকে দু-চার আনা পয়সা দেবে বাবা?’
ব্যাকুল হলাম, ফিরে তাকালাম। নেই, হারিয়ে গিয়েছে হিদের মা। চোখের সামনে শুধু জনারণ্য। হাসিমুখর, কোলাহলপূর্ণ।