৫
সুদীর্ঘ কাহিনী। যেন কোনো অতীত যুগের কাহিনী শুনলাম। সব কথার সঠিক অর্থ অনুমান করতে পারিনি। কী করে পারব! আমার নেই কোন অধ্যাত্মবাদের অনুভূতি। নিতান্ত বিজ্ঞানমাশ্রিত মানুষ। জীবনে আছে অনেক বিড়ম্বনা। তার মাঝে ফাঁকতালে এসেছি ছুটে জনসমুদ্রের মহাসঙ্গমে।
তার মাঝে এই কাহিনী, যেন কোনো অতীত অধ্যায়ের পাতা মেলে দিল আমার সামনে। যে রক্তমাংসের উচ্চ-নীচ মানুষ নিয়ে আমাদের কারবার, এ কাহিনীর নায়ক-নায়িকারা সে আওতার বাইরে। বেদাশ্রিত সন্ন্যাসীর প্রেম—সে-ই তো বিচিত্র। অথচ চোখে দেখে এসেছি রামজীদাসীকে! অধ্যাত্মবাদ না বুঝি, রঘুনন্দনের সঙ্গে রুক্মিণীর প্রেম অনুমান করতে পারি। যে প্রেম তাকে ঘরছাড়া করেছিল। ঘর-ই তো। আখড়া, আচার, নিয়ম, পূজা আর খাওয়া, এই মিলে যে অভ্যাসের ঘর তৈরি হয়েছিল, সেই ঘর ভেঙে গিয়েছিল তার।
রঘু-রুক্মিণীর প্রেম আমাদের প্রেম নয়, তবু পলক-শিহরণে কত বিচিত্ৰ দৰ্শন তো আমাদেরও ঘটে থাকে। প্রেমে কত নতুন অনুভূতির বীজ অঙ্কুরিত হয় মনে। কত সময় বেলাশেষের রক্তিম আকাশ দেখে চোখ ভুলে যায়। হাওয়া-দোলা শস্যের হরিৎ সাগরে নিজের প্রাণে লাগে ঢেউ। দূর গ্রামের কোন্ এক অনামী স্টেশনে, ডাগর চোখে কিষাণী কলাবউটিকে দেখে মনে হয় আমাদের ছোঁয়া লাগে অপরূপের। স্টিয়ারিং হুইল চেপে-ধরা যন্ত্রী, আর উদয়াস্ত কলমপেষা মানুষের দল আমরা আচমকা এক সময়ে গুনগুনিয়ে উঠি –
‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।
মন উড়েছে উড়ুক না রে,
মেলে দিয়ে গানের পাখনা।’
জানি, দিন যাবে না অমনি করে। জানি, মনের রঙিন পাখা মেলে থাকবে না দিবানিশি। তবু, জীবনযুদ্ধের মাঝে, অমনি করেই আমরা হৃদয়ের একটি দিক আঁকড়ে ধরে রয়েছি। হাজার দুঃখ যন্ত্রণা বেদনার মধ্যেও ওই বস্তুটি ছাড়তে রাজি নই।
রুক্মিণীর প্রতি রঘুর প্রেম, আমাদের চোখে কিছু রহস্যময় রহস্যে ঘেরা। মনো ব্রহ্মতি ব্যজনাৎ। কথাটি আমাদের মনে সৃষ্টি করে রহস্যবাদের।
কিন্তু সৌন্দর্য পিপাসুর চোখে এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছিল। যে-দিক তার চোখে বুলিয়ে দিয়েছিল শিল্পীর অঞ্জন। যে-চোখ গাছ-গাছালি দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। যে-প্রাণ ভুলেছিল বিহঙ্গকুলের গানে। এ তো রক্তমাংসেরই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি। রঘুর সেই সহজ সুন্দরের উপাসনা, সে তো আছে সকলের মনে মনে। আছে অন্যরকমে। আছে সকলের বুকে বুকে। রঙের হেরফের করে আছে।
নইলে ভুলি কেন বাউলের গানে! বাউল তো আমাদের কাছে সাধক নয়। সে শিল্পী। মনের মানুষের খোঁজে সে ফিরছে। ফেরার আনন্দই তার কাছে বড়। সেই আনন্দে গান গেয়ে উঠছে, তার মনেরই মানুষ, ‘আমি কী গান গা’ব যে, ভেবে না পাই।’ সে কণ্ঠে কণ্ঠ দিয়ে আমরাও ‘উঠি যে ফুকারি ফুকারি।’
বুঝলাম, বেদাশ্রিত সন্ন্যাসী রঘু বাউল হয়েছিল। রুক্মিণী, রামজীদাসীর অপূর্ব রূপের মাঝে রয়েছে কোন্ রহস্যময়ী, তা কে জানে! বিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে এ যেন কোনো অতীত যুগের নয়িকা এসেছে এ যুগে মানুষের সামনে। কে জানে তার হৃদয়তলে কোন রহস্যের আধার! তার রক্তিম ঠোঁটের কোণে বঙ্কিম রেখার কোন্ গূঢ় তত্ত্বের উঁকি ঝুঁকি! কিন্তু সরোদ হাতে সেই মানুষটি হঠাৎ বড় হয়ে উঠলো চোখের সামনে। সেই সরকারী কেরানী। যে সব ছেড়ে, সরোদের বুকে সুর সাজিয়ে ফিরছে রামজীদাসীর সঙ্গে সঙ্গে। যার সরোদের ঝঙ্কার বিনা রামজীদাসীর সুঠাম পদযুগলে আসে না নাচের জোয়ার।
বহুরূপী ভারতের এও এক রূপ। এই কাহিনী। যা শুনলাম তাতে সারা বালুচর যেন এক বিচিত্র ঝাপসা চেহারায় ভেসে উঠলো চোখের সামনে। যাই, ফিরে গিয়ে দেখি আর একবার সেই সরোদবাদককে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে হয়তো আসর।