১. একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেলে বাংলা একাডেমির গেটে প্রতি বছর খুব নীরবে ঘটে যাচ্ছে অশ্লীল সব ঘটনা। একাডেমির পরিচালক এই অশ্লীলতার খবর জানেন না এমন নয়, জানেন, কিন্তু প্রতিরোধের কোনও উদ্যোগ তাঁর নেই।
গেটের ভিড়ের মধ্যে মূলত যারা ভিড় তৈরি করে, মনে হয় তারা ঢুকছে কিংবা বেরোচ্ছে, আসলে তারা একাডেমিতে ঢোকেও না, একাডেমি থেকে বেরও হয় না। কেবল গেটের কাছে ভিড় পাকায়। হঠাৎ ধাক্কায় গায়ে গায়ে গড়িয়ে পড়ে সকলে, আবার উঠে দাঁড়ায়, ভিড়ের চাপে ও তাপে এক একজন মথিত হতে হতে যদি ছিটকে বেরোতে পারে তো সে যাত্রা সে বাঁচল। কিন্তু বাঁচে না ওই মেয়ে মানুষেরা। কিছু ছেলের, ওরা দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে, এই ভিড় সৃষ্টির পেছনে একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। ভিড়ের মধ্যে কোনও মেয়ে পড়লে, আমার বলতে বাধে না যে সেই মেয়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসে অসংখ্য হাত এবং মেয়ের স্তন, তলপেট, উরু ও নিতম্বে যে থাবা পড়ে তা তাকে শারীরিকভাবে তো অসুস্থ করেই, মানসিকভাবেও আর সুস্থ রাখে না।
শরীরে শাড়ি নেই, ব্লাউজ ছেড়া, এই অবস্থায় সেদিন ভিড় থেকে বেরিয়েছে একটি একুশ-বাইশ বছরের মেয়ে; এইমাত্র ধর্ষিতা হয়ে অবিন্যস্ত পায়ে হেঁটে আসা নারীর মত তাকে মনে হয়—দেখে আমি আমূল শিহরিত হই, এই যদি হয় একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেল, এই যদি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, তবে যারা এই ভিড়ের বিকৃত যৌন-আনন্দ শেষে ভাল মানুষের মত মিশে যায় বই মেলায়, বই দেখে, কেনে, গান গায় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো—ধিক সেই বাঙালি, ধিক সেই মুখে একুশে ফেব্রুয়ারির গান।
এমন মেয়ে নেই, যে মেয়ে ভিড় পার হয়ে মেলায় ঢুকেছে অথচ তাঁর নারী অঙ্গে কারও অসৎ থাবা পড়েনি। আমি অনেক মেয়েকে ভিড়ের ভয়ে ফিরে যেতে দেখেছি, তারা ফিরে যায় কারণ জানে নিগ্রহের প্রকৃতি ওখানে কি রকম। যারা ভিড় পেরিয়ে যায়, তারা কেউ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, কেউ লজ্জায় নত হয়, যেন সমস্ত গ্লানি তারই যেন নারী অঙ্গ ধারণের পাপ তার, যেন নারী-জন্মের প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই হয়, একুশের চেতনায় উদ্দীপিত পুরুষ এভাবেই সহযাত্রী নারীকে স্বাগত জানায়।
বেশ কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হচ্ছে, ব্যাপারটিকে কেউ তেমন আমল দেয়নি। একটি মেয়েকে যদি প্রতিরোধ এবং প্রতিঘাতের দায়িত্ব দেওয়া হয় তবু কোনও মীমাংসা হয় না কারণ প্রথমত ভিড়ের মধ্যে চিহ্নিত করা যায় না প্রতিপক্ষ কে এবং এক মেয়ের উপর আক্রমণ হয় কম করে হলেও বিশ থেকে তিরিশ ছেলের। একা কোনও মানুষের পক্ষে এই সংখ্যাধিক্যের আক্রমণ প্রতিহত করবার প্রশ্ন ওঠে না।
যদি একাডেমি কর্তৃপক্ষ এই বিশেষ দিনটির দায়িত্ব না নিতে পারেন তবে সকল নারী একযোগে ঘোষণা করুক তারা ফেব্রুয়ারির বই মেলায় যাবে না। নিগৃহীত হয়নি বলে যে নারী পিছিয়ে যায়, তাঁর মত দুর্ভাগা আর কে আছে কারণ তাকে নিগ্রহ করবার জন্য সময় এগিয়ে আসছে। যে সমাজে নারীকে সম্মান করবার রীতি নেই, সেই সমাজের সকল দুনীতি আগলে বসে আর যাই হোক, নীতির আশা করা চলে না।
২. বাংলাদেশ টেলিভিশনে রজতজয়ন্তী উৎসবের এক অনুষ্ঠানে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অভিনেতা আফজাল হোসেনকে জিজ্ঞেস করেছেন—আফজাল হোসেন সেই খবর জানেন কি না যে তাঁর জন্য বাংলাদেশের তাবৎ ললনা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই অরুচিকর প্রশ্ন শুনে আফজাল হোসেন হেসেছেন, হাসতে হাসতে বলেছেন—ললনাদের দীর্ঘশ্বাস নীরব না হয়ে সরব হলে তাঁর অর্থাৎ আফজালের আশেপাশে একটি ভূমিকম্প ঘটে যেত। নারী নিয়ে এ ধরনের স্থল রসিকতা করা একজন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিক, শিল্পের নানা শাখায় যাঁর অবাধ বসবাস, তাকে মানায় না। একজন শিল্পী যদি নারীকে রঙ্গরস করবার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন, নারীকে যদি সেই শিল্পী মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে, সম্মান করতে না জানেন তবে তাঁর শিল্পের প্রতি, তাঁর শিল্পীতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতি আমি আশংকা প্রকাশ করি।