স্ত্রৈণ শব্দটির অর্থ স্ত্রীর অতিশয় বাধ্য। অর্থাৎ যে ছেলে স্ত্রীর অতিশয় বাধ্য, সে ছেলেকে স্ত্রৈণ বলা হয়। একই ভাবে পতিপরায়ণা শব্দটির অর্থ পতির প্রতি একান্ত অনুরক্তা, আরও এক পা এগিয়ে গেলে পতিব্ৰতা, যার অর্থ পতিসেবাকে পুণ্যব্রত রূপে গ্রহণ করেছে এমন মেয়ে।
পত্নীসেবাকে পুণ্যব্রত রূপে গ্রহণ করবার বিধান মনুষ্য সমাজে নেই বলে পত্নীব্রত বলে কোনও শব্দও অভিধানে নেই।
যে মেয়েটিকে সমাজ ‘পতিপরায়ণা’ অথবা ‘পতিব্ৰতা’ আখ্যা দেয়, তাকে সকলেই খুব ভাল বলে, কিন্তু যে ছেলে ‘স্ত্রৈণ’ তাকে কেউ ভাল চোখে দেখে না বরং তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসে।
পতিপরায়ণা হিসেবে একটি মেয়ে যতটুকু মর্যাদা পায় স্ত্রৈণ হিসেবে একটি ছেলে এই সমাজে ততটুকু অমর্যাদা পায়।
২. সূরা নিসার পঞ্চম পারায় লেখা ‘পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাহদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং পুরুষ তাহদের ধনসম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধবী স্ত্রীরা অনুগত এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হিফাজতে উহারা উহাদের সতীত্ব ও স্বামীর আর সব অধিকারের হিফাজত করে। স্ত্রীদের মধ্যে যাহাঁদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাহাদিগকে সদুপদেশ দাও তারপর তাহদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর।’
যেহেতু পুরুষ তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাই বলা হয়েছে স্ত্রীরা যেন অনুগত থাকে। এক্ষেত্রে স্ত্রীও যদি উপার্জন করে এবং ধনসম্পদ ব্যয় করে তবে নিশ্চয়ই স্বামীরও উচিত স্ত্রীর অনুগত থাকা। কিন্তু এ ধরনের কোনও বাণী ধর্মগ্রন্থে নেই বলে স্ত্রীরা ধনসম্পদ ব্যয় করলেও স্বামীর অনুগত থাকতে হয় স্ত্রীদেরই। কারণ বিধান –বিধান একবার সৃষ্টি হয়ে গেলে আর নাকি খণ্ডানো যায় না। –
৩. ঘরে পুত্রবধুর সন্তান হয়েছে, বাইরে অপেক্ষমাণ বৃদ্ধ কন্যা-জন্ম শুনে উল্টোপথে চলে গেলেন আবার সেই বাড়ির গাভীটি যখন বকনা বাছুর জন্ম দিল, ‘ঠাকুর এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন’ বলে সে কী আনন্দ বৃদ্ধার!
অপর্ণা সেনের ‘সতী’ ছবিতে এই দৃশ্যটি দেখে আমি আপাদমস্তক স্তম্ভিত হই। মেয়ে মানুষ জন্ম নেওয়ায় সংসারের লোকেরা দুঃখ পায় কিন্তু মেয়েজন্তু জন্ম নিলে আনন্দে হাততালি দেয়। সংসারে জন্তুর চেয়েও মেয়ের মূল্য কম।
৪. আমার এক স্কুলের বন্ধু পড়াশোনার পাট শেষ করে চাকরি করছে। ঢাকায় তার আত্মীয়, যার বাড়িতে থেকে চাকরি করা যায়—কেউ নেই। অগত্যা তাকে কর্মজীবী হোস্টেলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমার এই বন্ধুটি ছুটি-ছাঁটায় আমার সঙ্গে দেখা করত। একদিন আমার অভিভাবক অবসর বুঝে আমাকে জানালেন মেয়েটির এত ঘন-ঘন আমার বাড়ি আসা উচিত নয়।
জিজ্ঞেস করলাম–কেন ?
ওঁরা বললেন—মেয়ে ভাল নয়।
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম—কেন ?
উত্তর এল—ওইসব হোস্টেলে ভাল মেয়েরা থাকে না।
একটি মেয়ে ভাল না খারাপ তা মানুষ খুব সহজেই বিচার করে ফেলে। বাজারের একটি শসাকে যেমন ভাল না খারাপ দাঁড়িয়েই রায় দিয়ে দেওয়া যায়। মেয়েরা যখন পরাশ্রয়ী লতার মত অভিভাবক-বৃক্ষকে আঁকড়ে থাকে এবং এই ব্যবস্থাকেই সমাজ সুষ্ঠু ও সুস্থ ব্যবস্থা বলে মত দেয় তখন আমার ছেলেবেলার এই বন্ধু পিতার মৃত্যুর পর মায়ের এবং নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে।
ক’জন মেয়ের স্নায়ু এমন সবল হয় ? আমি জানি খুব কম মেয়েই পারে দূর-আত্মীয়ের গলগ্ৰহ হয়ে বেঁচে থাকবার বদলে বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে।
যেহেতু মেয়েটি কোনও অভিভাবক নামক তথাকথিত ছাতার তলে বসে থাকেনি, তাই দীর্ঘ পাচ বছর যে ছেলেটি তাকে ভালবাসার কথা শুনিয়েছে, বিয়ের প্রসঙ্গে সেও একদিন এটা সেটা বলে বিয়ের কথা এড়িয়ে যায়। মেয়েটি কারও অনুগ্রহের জন্য হাত পেতে রাখেনি বলে আমার বড় গর্ব হয়।
আমার এই বন্ধুটিকে গলাধাক্কা দিয়ে পুলিশ হোস্টেল থেকে বের করে দিয়েছে, অনশনরত মেয়েটিকে লোকসমক্ষে পিটিয়েছে। রাষ্ট্রই যদি এই মেয়েদের গলাধাক্কা দেয়, সমাজ কেন দেবে না ?
৫. সেদিন, খুব বেশি দিন আগে নয়, ধানমণ্ডির এক ক্লিনিক থেকে নয়াপল্টন ফিরছি একা, ক্লিনিকের কাজ শেষে রাত বেজেছে সাড়ে আট। এই পথটুকু পার হতে আমার রিকশার সামনে গতি শ্লথ করেছে ছটি রিকশা, তিনটি গাড়ি, দুটি স্কুটার ও চারটি মোটর সাইকেল। আমি মোট পনেরোটি লোভের দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছি।
আমি জানি আমার পথ মসৃণ নয়। আমাকে পাথর সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটতে হয়। শুধু আমাকে কেন, প্রতিটি মেয়েকেই।