1 of 2

০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা

নির্বাচিত কলাম – আদিলা বকুলের ভালবাসা

১. কবি অসীম সাহা মাঝে মধ্যেই আদিলা বকুলের প্রশংসা করে বলেন—আদিলার লেখার অভ্যোস ছিল। কিন্তু স্বামী রফিক আজাদকে আদিলা এত বেশি ভালবাসেন যে নিজের লেখালেখি পর্যন্ত ছেড়ে দেন। অসীম সাহা আদিলার এই সাহিত্য-ত্যাগের কথা বেশ গুছিয়ে বর্ণনা করেন। আদিলা বকুল রফিক আজাদকে ভালবাসেন, কিন্তু এতে তার লেখা ছেড়ে দেবার এবং লেখা ছেড়ে দিলে ভালবাসার ওজন বৃদ্ধি পাবার কোনও কারণ আমি দেখি না।

আসলে মেয়েদের কিছু ত্যাগ দেখলে ছেলেরা বড় খুশি হয়। একটি ছেলের জন্য মেয়ে তার আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করলে ছেলের আনন্দ আর ধরে না। স্বামী গান গাওয়া পছন্দ করে না বলে মেয়ে গানের সকল সম্ভাবনার ইতি ঘটালে ছেলে বড় আহ্লাদিত হয়।

যে মেয়ে নাচে কিংবা ছবি আঁকে তার নাচ-ছবি আঁকা বন্ধ করে স্বামী বড় গর্ব করে বলেন যে তার স্ত্রীকে বিয়ের পর তিনি আর নাচতে কিংবা ছবি আঁকতে দেন না। স্বামী লেখেন বলে আদিলার না লেখার মধ্যে কবি অসীম সাহা ভালবাসার তীব্রতা খুঁজে পেয়েছেন।

ছেলে সংক্রান্ত কোনও কারণে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করলেও ছেলেটি মুখে যত শোক প্রকাশ করুক, মনে মনে খুব একটা অখুশি হয় না। ছেলে উপার্জনে, ব্যক্তিত্বে এবং নানান প্রতিভায় পরিপূর্ণ হােক এবং মেয়ে তার গতি ও প্রতিভার সকল পথ রুদ্ধ করে ক্রমশ নিঃস্ব হােক, নিঃসঙ্গ হােক, নির্ভরশীল হােক তা সমাজের সকলেই কামনা করে। এই একপক্ষীয় ত্যাগকে সমাজ বড় গুরুত্ব দিয়ে দেখে, কারণ তার হাতে প্রচুর ধর্মীয় কালাকানুন আছে যা সময় সুযোগ মত মেয়েদের অপদস্থ করবার জন্য ব্যবহৃত হয়। তার হাতে আছে প্রাচীনকাল থেকে বয়ে আনা সামাজিক নীতি ও নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিছু অন্যায় এবং অত্যাচার, কিছু বৈষম্য ও বিভেদ। তার হাতে রাষ্ট্রীয় অবাধ সুযোগ।

অপর্ণ সেনের ছবি ‘পরমা’য় স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় পরমা নামের মেয়েটি ভুলে যায় সে একদিন সেতার বাজাত, কবিতা আবৃত্তি করত। পরমা তার মধ্যবয়সে সেতার বাজাবার যে মিজোরাবটি খুঁজে পায় তাতে জং ধরে গেছে। শাশুড়িকে ওষুধ খাওয়ানো আর বাচ্চাদের হােমওয়র্ক করানোর বাইরে যদি কোথাও সে বেরোয়, বড় জোর নিউমার্কেট, মিনুর বাসা, নয়ত শীলার ফ্ল্যাট। পরমার স্বামীও জানেন তার স্ত্রীর দৌড় ওই পর্যন্তই।

আসলে মেয়েদের দৌড় ওই পর্যন্তই বেঁধে দেওয়া হয়, যদিও স্বামীরা নিজেদের দৌড়ের জন্য সামনে কোনও লাল ফিতে রাখতে রাজি নন। পরমার স্বামী হােটেলের ঘরে পি এ-কে ডিকটেশন দেবার পর অভ্যোস অনুযায়ী আমন্ত্রণ করেন রাতের খাদ্য গ্রহণের, যে আমন্ত্রণ কেবল খাদ্য গ্রহণের নয়, যুবতীর শরীর নামক খাদ্যবস্তু ত্যাগেরও।

অথচ ওদিকে পরমা প্রেমে পড়লেই যত অসুবিধে, কোনও অপর পুরুষ তার শরীর স্পর্শ করলেই সে আপাদমস্তক অশুচি হয়। সংসারের গণ্ডির বাইরে কাউকে ভালবাসবার স্বাধীনতা কোনও মেয়ের নেই। কারণ মেয়ে মাত্ৰই স্বামীর ইচ্ছের অধীন। এই অধীনতা অপর্ণ সেন স্বীকার করেননি। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন একটি মেয়ে তার জীবনের যে কোনও সময়ে প্রেমে পড়তে পারে, এতে অপরাধবোধের কিছু নেই। জীবনটা যার যার, তার তার। অপর্ণ সেন জীবনের সবচেয়ে সত্য কথাটি উচ্চারণ করেছেন—’কোনও মানুষই কোনও মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, সামাজিক সম্পর্ক থাকলেও।’ ক’জন মানে সে কথা !

চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত একটি মেয়ে, তার গান শুনেই একটি ছেলে তার প্রেমে পড়ে। এবং প্রেমে পড়বার কারণে ছেলেটি যখন মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তখন প্রথম শর্ত থাকে বিয়ের পর গান গাওয়া চলবে না। মেয়েটি এখন গানের প্রসঙ্গ উঠলে সলজ্জ কণ্ঠে বলে—বাইরে গাই না, ঘরে গাই। এরপর সে স্বামীর কানে কানে গাইবে, অবশেষে মনে মনে। মেয়েদের দৌড় কমতে কমতে এত সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে যে একসময় তার স্থির হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না ।

উপায় থাকবেই বা কেন, অনাকাঙ্খা দিয়েই যার জন্মের শুরু। প্রসবকক্ষের বাইরে অপেক্ষমাণ শতকরা এক ভাগ পুরুষও চায় না তার সন্তান কন্যা হােক। একজন উচ্চশিক্ষিত পুরুষও একটি সুস্থ সন্তানের চেয়েও আশা করে একটি পুত্র সস্তান | আমাদের দেশে, হাসপাতালের প্রসবকক্ষে স্বামীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা উচিত। দীর্ঘ নয় মাস স্ত্রী তার শরীরের ভেতর ধারণ করে আরেক শরীর, এই বহনের এবং প্রসবের চূড়ান্ত শারীরিক যন্ত্রণা চােখের সামনে দেখে স্বামীর অন্তত এইটুকু যেন উপলব্ধি হয় উভয়ের সন্তান যে জন্ম দেয়, জন্মদানের সবটুকু কুঁকি যে একই বহন করে, তাকে অত হেলাফেলায় তালাক বলা যায় না। তালাক বলবার সময় কণ্ঠনালীতে স্ত্রীর যন্ত্রণার সহস্র অংশের এক অংশও যদি অনুভূত হয়, তাহলে কোনও পুরুষই সহজে তালাক শব্দটি উচ্চারণ করবে না।

২. অনেকে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এবং লেনিনের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে বলেন—সমাজতন্ত্র ছাড়া নারীমুক্তি অসম্ভব। দেশে সমাজতন্ত্র না এলে নারীমুক্তির জন্য অযথা চিৎকার করে লাভ নেই। তাই নারী আন্দোলনের হােতারা নাকে সর্ষের তেল ঢেলে ঘুমোচ্ছেন, সমাজতন্ত্র এসে দরজায় কড়া নাড়লে তারা উঠে বসবেন।

সমাজতন্ত্র অতি সহজলভ্য নয়। তা আনবার এবং ধরে রাখবার ক্ষমতা আগে অর্জন করা চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *