1 of 2

৪৬. বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না

বন্ধ্যা, ওর বাচ্চা হয় না

একবার এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলাম—সমস্যা কী? ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, ওর বাচ্চা হয় না। স্ত্রীর সারা মুখে অপরাধের শ্যামল ছায়া। তাদের বিয়ে হয়েছে সাত বছর। ভদ্রলোক নিদ্বিধায় স্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে সকলকে এমনই বুঝিয়েছিলেন যে তার স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম। কিন্তু আমি স্বামী-স্ত্রী দুজনের পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম ভদ্রলোক নিজে অক্ষম, স্ত্রী তার সম্পূর্ণ সুস্থ। দুঃসংবাদটি পরিবেশন করবার পর দু’জনে বিস্মিত হলেন, অর্থাৎ তারা যতদূর জানেন এরকম হওয়ার কথা নয়। আমি সহজ করবার জন্য প্রশ্ন করলাম ভাত রাধতে হলে পাতিলে কি শুধু পানি হলেই চলে?

মেয়েটি মাথা নাড়ল—না।

চাল থাকলে হয়, তাই না?

মেয়েটি হ্যাঁ বলল। আমি এবার তাদের সন্দেহ মুক্ত করবার জন্য বললাম—আর যদি চাল না থাকে তবে তো কেবল পানি ফুটে আর যাই হোক ভাত হবে না।

ভদ্রলোকের Semen analysis-এ কোনও Sperm ছিল না। অথচ কত দীর্ঘ বছর নিরপরাধ স্ত্রীটি আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-পড়শির সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেনি। সকলে জানে সতী শব্দের যেমন কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই, তেমন ‘বন্ধ্যা’ শব্দেরও নেই। নারীকে একাই মাথা পেতে নিতে হয় ‘বন্ধ্যা’ শব্দের যাবতীয় কলঙ্ক।

‘বন্ধ্যা’ শব্দের একটি পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ কিন্তু আছে, ‘বন্ধ্য’। একথা কেউ জানে বলে আমার মনে হয় না। কারণ পুরুষ যে বন্ধ্য হতে পারে—এ বিশ্বাস আমাদের সমাজে প্রচলিত নয়। তাই খুব সহজে পুরুষেরা সন্তান না হবার ছুতোয় বউ-তালাক এবং নতুন বিবাহের পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে।

প্রখ্যাত স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ স্যার নরম্যান জেফকট বলেছেন, সন্তানের জন্য পুরুষের তুলনায় নারীর আগ্রহ বেশি। নারী নিজের সৌন্দর্য ও শারীরিক গঠনের চেয়ে, নারী নিজের প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিভার চেয়ে অধিক আগ্রহ বোধ করে সন্তানের প্রতি। কিন্তু পুরুষের ঐ আগ্রহ নারীর তুলনায় অত্যন্ত কম, যৎসামান্য। তাই একজন বিবাহিত নারীকে সন্তানহীনতার কষ্ট নাছোড়বান্দার মত আঁকড়ে ধরতে পারে কিন্তু পুরুষকে কখনও নয়। সন্তানহীনতার জন্য পুরুষের যে আম্ফালন দেখি, তা মেকি, বানানো। অসৎ উদ্দেশ্যেই পুরুষেরা সন্তানের তৃষ্ণায় বুক চাপড়ায়।

নারীর ওপর বন্ধাত্বের দোষ দেওয়া হয় সেই প্রাচীন সভ্যতার সময় থেকে। সেকালে বীর্য পান, মন্ত্রপূত কবচ, প্রার্থনা এবং বিসর্জন দ্বারা বন্ধ্যাত্ব রোগের চিকিৎসা হত। স্ত্রীকে, কেবল স্ত্রীকেই তখন বন্ধাত্ত্বের জন্য দায়ী করা হত। তখন বিজ্ঞান নারী ও পুরুষের শরীর খুঁড়ে বুঝতে শেখেনি অক্ষম কে, তখন নারীই বন্ধ্যা হিসেবে চিহ্নিত হত এবং এখনও কি নয়—যখন শরীর খুঁড়লে পুরুষের অক্ষমতার খবর পাওয়া যায়। এবং এখনও কি নারীকেই বন্ধাত্বের জন্য এককভাবে দায়ী করা হয় না—যদিও বিজ্ঞান অণুবিক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখে পুরুষের শুক্ৰকীট ভাঙা, পুরুষের শুক্ৰকীট স্থির, অচঞ্চল, অসুস্থ?

তবু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোনও পুরুষকে অক্ষম বলে না। অক্ষম পুরুষেরা দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বিবাহ দ্বারা বার বার নারীকে অপরাধী বানায়। এই সমাজে নিঃসন্তান নারীর কোনও অধিকার নেই একটির পর একটি পুরুষ পাল্টানো। পুরুষ বদল করে তার বন্ধ্যাত্ব ঘোচানো।

পুরুষের বন্ধ্যাত্বের সকল দায় নারীকেই বহন করতে হয়। নারীকেই বহন করতে হয় সকল অপূর্ণতার দায়। পুরাকাল থেকেই জগতে যা কিছু দোষাবহ তার জন্য নারীকে দায়ী করে নির্বিচারে শাস্তিদান করা হয়েছে এবং এখনও, এই পুরুষ প্রধান সমাজ তা থেকে নিরস্ত হয়নি।

এ কথা ক’জন জানে যে একশজন অনুর্বর দম্পতির মধ্যে পঁয়ত্ৰিশ জন পুরুষই নির্বীর্য? এককালে নারীকে আশীর্বাদ করবার ভাষাই ছিল শতপুত্রের জননী হও । নারীকে গাভীর মত ভাবা হত। কোনও মান নেই, মর্যাদা নেই, গর্ভধারণের যন্ত্র ছাড়া সে কিছু নয়। এখন কি ভাবা হয় না–একথা কত জোর দিয়ে বলতে পারি যে—না, দিন বদলে গেছে?

পারি না। কারণ মাতৃত্বকেই এখন নারী জন্মের সার্থকতা বলে বিবেচনা করা হয়; কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত সকল সমাজে। বুদ্ধিবিদ্যা, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব নাকি পুরুষকে মানায়, নারীকে নয়। নারীকে মাতৃত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা এবং স্নেহময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা এক ধরনের কুৎসিত ষড়যন্ত্র।

সন্তান-জন্মদানে এক অক্ষম পুরুষের স্ত্রীকে আমি একবার উপদেশ দিয়েছিলাম দ্বিতীয় বিবাহের। শুনে আঁতকে উঠেছিল সেই স্ত্রী, স্ত্রীর অক্ষম স্বামী এবং আত্মীয়স্বজন সকলে। তারা বিস্মিত হয়েছে আমার এই স্পর্ধায়। কিন্তু অক্ষম স্ত্রীর বেলায় স্বামীকে এই উপদেশ দিলে আমি জানি স্বামী এবং স্বামীর সকল স্বজন লাফিয়ে উঠত আনন্দে।

দিন বদলায়নি। দিন কেন বদলায় না? কেন বন্ধ্য পুরুষ বন্ধ্যা নারীর মত একই নিগ্রহ ভোগ করে না? কেন বন্ধ্য পুরুষদের গ্লানি ও কলঙ্কের বোঝা বইতে হয় না, কেন বন্ধ্য পুরুষেরা পার পেয়ে যায় সামাজিক লাঞ্ছনা থেকে, বন্ধ্যা নারীর তো মুক্তি নেই কিছুতে।

যদি নারীর মুক্তিই নেই তবে মাতৃত্বের মত পিতৃত্বই হোক এখন পুরুষের প্রধান সাফল্য। এবং পুরুষের বন্ধত্বের সকল দায় পুরুষই ভোগ করুক। অমঙ্গল যদি হয় তবে এক নারীর হবে কেন–পুরুষেরও হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *