1 of 2

৪৯. নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক

নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক

১. বিভিন্ন ধর্মে মানুষের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন রকম। এক বিবাহের অনুষ্ঠানে কুশণ্ডিকার হোমকুণ্ডের উত্তর-পশ্চিম ভাগে একটি পেষণীযুক্ত শিলার দিকে আমার নজর পড়েছিল। সেই শিলার সামনে বর বধূকে পেছন দিক থেকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বধুর অঞ্জলির নিচে আপন অঞ্জলি স্থাপন করলেন এবং বধূ তার পায়ের অর্ধেক তুলে দিলেন শিলের উপর। বর বললেন–এই শিলের উপর ওঠ—ওঁ ইমম অশ্মানম্‌ আরোহ। তুমি ঠিক এই শিলপাটার মত স্থির হয়ে থাকবে—অশ্বেব ত্বং স্থিরা ভব। আর শিলায় পা রাখা বউ বললেন—এই আমি মেয়ে, আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি—আমার স্বামী যেন দীর্ঘায়ু হন—শতং বর্ষানি জীবতু।

যে শিলপাটার ওপর বধুটি পা রাখলেন, সেটি পেষণীযুক্ত শিলা। শিলায় ওঠবার মন্ত্র আছে–অশ্লেব ত্বং স্থিরা ভব। এক্ষেত্রে পেষণীটির কাজ কি? পেষণীটি যদি পুরুষ চিহ্নের প্রতীক হয় তবে স্বামী দেবতা বরারোহ বধূশিলায় নিজের উচ্চাবচ ইচ্ছেগুলো বাটবেন। তাতে পুং নাম নরক থেকে বাঁচবার অছিলায় পুত্র যেমন জন্মাবে, তেমনি হবে ইচ্ছেপূরণ। শুধু স্বামী নন, বধূশিলায় বাটনা বাটবার পেষণী আছেন আরও, শ্বশুরকুলের সবাই, কারণ তাদেরও ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে বধূকে সংসার-শিলায় পেষণ করা হবে, আর তাই বর মন্ত্র পড়েন—তুমি এই সংসার যাত্রায় পাথরের মত স্থির হয়ে থেক—অশ্লেব ত্বং স্থিরা ভব। কারণ বাটনা বাটায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, বাটবার শিল নড়বড় করলে বা এদিক ওদিক ঘটাং ঘটাং করলে বাটনা বাটা যায় না। অতএব বধু! তুমি অশ্বেব ত্বং স্থিরা ভব, এদিক ওদিক ন’ড়ো না চ’ড়ো না।

ভিন্ন ধর্মের আরেক বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। অলঙ্কারাবৃত বন্ধুকে নতমুখে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তার নির্বাক নতমুখ এবং সাজসজ্জা অনুষ্ঠানের প্রধান একটি বিষয়। আমার ধারণা  হয়েছে বধূকে পরবর্তী জীবনে নির্বাক ও নতমস্তক হবার এটি একটি মহড়া বটে।

কাজী এলে ‘অমুকের পুত্র অমুকের সঙ্গে এত টাকা দেনমোহরের বিবাহে সম্মতি আছে কি না’ জিজ্ঞেস করতেই বধূ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাজী বললেন–আলহামদুলিল্লাহ। এরপর বধূর পিতা বরের হাতে কন্যা সমৰ্পণ করলেন এবং বর তা গ্রহণ করলেন। এই অনুষ্ঠানে আমার এও ধারণা হয়েছে যে, সাজানো পুতুল-বধূর কাছে গিয়ে সম্মতির কথা জিজ্ঞেস করা এবং না করা সমান কথা। এই বিবাহে দেনমোহরের টাকা নিয়ে দর কষাকষি চলে। কন্যাপক্ষ চান টাকা বাড়াতে—বরপক্ষ চান কমাতে। এই টাকা আদপে দৃশ্যমান নয়, কেবল উচ্চারিত। বরপক্ষ টাকার পরিমাণ কমান কারণ কন্যাকে তালাক দিলে দেনমোহরের টাকা ফেরত দিতে হয়। কন্যাপক্ষ বাড়ান কারণ অন্তত টাকা দেবার অসামর্থ্যের জন্য হলেও যেন বরপক্ষ কন্যাকে ত্যাগ না করেন। । বরপক্ষ হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর দৃষ্টান্ত দেন, হযরত বলেছেন–নিশ্চয়ই এই ধরনের বিবাহে বরকত বেশি হয়, যে বিবাহের মোহর কম হইয়া থাকে। মুহম্মদ এও বলেছেন—ঐ স্ত্রীলোক অতি উত্তম, যে দেখিতে সুন্দরী এবং যাহার মোহর অতি নগণ্য (দেখতে অসুন্দরী স্ত্রীলোককে মহানবীও অপছন্দ করতেন)।

এই দর কষাকষির বিবাহ আমার কাছে লেগেছে মাংসের হাটের মত। মেয়েমানুষের এক-শরীর মাংস ভোগ করতে নিয়ে যায় এক কামুক পুরুষ। মাংস সে এটো করলে কিছু ক্ষতিপূরণ দাবি করেন মাংসওয়ালা কন্যাপক্ষ। ক্ষতি হচ্ছে এটোর ক্ষতি। কিছু ডিসপোসেবল জিনিস আছে, একবার ব্যবহারের পর দ্বিতীয় ব্যবহার অস্বাস্থ্যকর ও অমর্যাদাকর। স্যানিটারি ন্যাপকিনও একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়। আমাদের সমাজে মেয়েমানুষ হচ্ছে ডিসপোসেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনের মত। এক-পুরুষ দ্বারা ব্যবহৃত হলেই সে অস্পৃশ্য হয়ে ওঠে, আপাদমস্তক অযোগ্য হয়ে ওঠে।

২. একবার নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এক অগ্রসর পুরুষ তাঁর হবু স্ত্রীকে বললেন–‘বিয়ের পর তোমাকে আমি পূর্ণ স্বাধীনতা দেব।‘

এই বাক্যটি শুনে হবু স্ত্রী এবং উপস্থিত শুভার্থীরা সকলে চমকিত এবং হরষিত হলেন। কেবল আমার বুকের মধ্যে বিধে রইল ‘দেব’ শব্দের কাটা। কারণ পুরুষটি তার উদারতার আড়ালে একটি ঘটনা বেশ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে স্বাধীনতা দেবার মালিক পুরুষেরা, স্ত্রীকে স্বাধীনতা দান করবেন স্বামী।

যেন স্বাধীনতা নামক জিনিসগুলো পুরুষের হাতের মুঠোয় থাকে। তারা ইচ্ছে করলে নারীকে তা দেন, ইচ্ছে না করলে দেন না। আমাদের এই উদার পুরুষটি বড় ইচ্ছে করেছেন স্ত্রীকে তিনি স্বাধীনতা দেবেন। স্ত্রীও তাই খুশিতে আটখানা। এ কথা অনস্বীকার্য যে পুরুষেরা স্বাধীনতা দিলে নারী বাধিত হয়, পুরুষেরা দয়া করলে নারী পুলকিত হয়, পুরুষেরা দক্ষিণ দিলে নারী কৃতাৰ্থ হয়।

আমি ওই ‘দেব’ শব্দটি বর্জন করতে বলি সকল শ্রেণীর পুরুষকে। নারীকে বোকা বানাবার যাবতীয় কূটকৌশল আমি নিষিদ্ধ করতে বলি।

নারী সম্পূর্ণ একটি মানুষ। পৃথিবীতে তার বাঁচবার অধিকার, চলবার, বলবার ভালবাসবার, ঘৃণা করবার অধিকার জন্মগত। নিজের অধিকারের দায়িত্ব কেউ কারও হাতে অপর্ণ করে না। যে সম্পর্ক মানুষের অধিকার হরণ করে, সে সম্পর্ক কখনও কল্যাণকর নয়। যে সম্পর্ক মানুষের স্বাধীনতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে সে সম্পর্ক কখনও মঙ্গলজনক নয়।

আর অকল্যাণ নয়, আর উৎপীড়ন নয়, নারী সচেতন হোক। নারীকে যেন নিজের স্বাধীনতা ভিক্ষে করতে না হয়। নারী যেন পুরুষের হাট-বাজারে নিজের ব্যক্তিত্ব না বিকোয়।

মানুষ ক্ষুধার্ত হলে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হয় কেড়ে খাবার। নারী ক্ষুধার্ত হোক, নারী তার থাবা বসাক আগ্রাসীদের উদরে। নারী মানুষ হোক। নারী সম্পূর্ণ মানুষ হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *