চুড়ি আর সস্তার জিনিস
১. পুরুষ যদি কোনও শক্ত কাজে অপারগ হয়, তবে সেই পুরুষকে অপদস্থ করবার একটি পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়—হাতে চুড়ি পরতে বলা। এতে অপারগ পুরুষটি পুরোমাত্রায় অপদস্থ হয় এবং অপদস্থকারীরা প্রভূত আনন্দ লাভ করে।
পুরুষের মান-মর্যাদা ধুলোয় লুটোবার জন্য এই হাতে চুড়ির প্রসঙ্গটি সবচেয়ে কার্যকর। হাতে চুড়ি পরবার অর্থ সে পুরুষ নয়, যেহেতু পুরুষ নয়—সে শক্তিমান নয়, শৌর্যশালী নয়; যেহেতু সে পুরুষ নয়—সে নারী, সে নারী কারণ সে ব্যর্থ, কারণ সে দুর্বল। নারীমাত্রই অক্ষম, অসমর্থ, অপদার্থ ও অকৰ্মণ্য। তাই নারী-বেশ পুরুষকে ধিকৃত করে, কলঙ্কিত করে।
অকথ্য গালিগালাজের চেয়ে, শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে হাতে চুড়ি পরবার কথা উচ্চারণ করাই বেশি অপমানকর। পুরুষেরা হাতে চুড়ি পরাকে অসম্মানজনক মনে করে। পুরুষেরা তিলার্ধ নারী হওয়াকেও ঘৃণা করে। তাই বীর্যবন্ত শরীরে নারীর সজ্জা পুরুষের খ্যাতি নাশ করে, পুরুষকে নিন্দিত করে। নারী হবার মত চরম লজ্জা আর কিছুতে নেই।
একবার এক ছেলেকে ভীষণ এক অপরাধের কারণে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। শাণিত বুদ্ধির কিছু ছেলে শাস্তি হিসেবে অপরাধীকে মেরে লাশ বানাবার বদলে তার গায়ে শাড়ি পরিয়ে, ঠোটে-কপালে লিপস্টিক মেখে দেওয়াকে সর্বোচ্চ শক্তি বিবেচনা করে। এতে অপমানের মাত্রা এত বেড়ে যায় যে ছেলেটি আত্মহত্যা করে। নারী-সাজ ছাড়া অন্য কোনও শাস্তিই, আমি নিশ্চিত, ওই ছেলেকে অন্তত আত্মহত্যা করাত না। নারী-রূপে এত অসম্ভ্রম, এত গ্লানি—তা সেই রূপ অঙ্গে না নিলে বোঝা দুরূহ।
কই, পুরুষের পোশাক পরলে তো নারীর সন্মান যায় না, নারী অপমানিত হয় না, আত্মহত্যা করে না। নাকি নারী অধম বলে, অকিঞ্চিৎকর বলে নারীর পোশাককে পুরুষেরা হীন ও নীচ চরিত্রের পোশাক মনে করে তাই ওই পোশাকের আবরণে তারা লজ্জিত হয়, তাই তারা মুখ লুকোয়। তাই তারা ক্লাউন হয়, লোক হাসাবার লোক হয়। নারী হওয়ার মত লজ্জা আর কোথায় আছে। নারী জন্মের মত ঘৃণ্য জন্ম শুয়োর-শকুনদেরও নয়।
প্রাচীনকালে পাপী-পুরুষদের অভিশাপ দেওয়া হত, যেন পরজন্মে তারা নারী হয়ে জন্মায়। ছাগল-ভেড়া হয়ে জন্মাবার চেয়ে নারী হয়ে জন্মানোটিই অভিশাপ হিসেবে অধিক মারাত্মক ছিল।
২. ‘মূলধারা’ নামে এদেশে একটি শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক সাপ্তাহিকী ছিল। চলেনি। ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকবার বদলে মূলধারা এখন নারীদেহে ফিরে গেছে। চলচ্চিত্র নায়িকাদের ক খ গ অর্থাৎ তাদের চুল, চোখ, নাক, ঠোঁট নিয়ে গবেষণা, রাঁধা-বাড়া, গৃহকোণ, টেলিভিশন-তারকাদের চেহারা ছবি, সাজগোজ, নারীর বক্ষ উন্নত ও কটিদেশ সরু করবার উপদেশ বর্ষণই এখন মূলধারার মূল কাজ। এখন মূলধারার বাজার হবে রমরমা। দেশে নারী দেহের ব্যবসা যেমন ভাল, নারী দেহ সম্পর্কিত খবরা-খবরের বাণিজ্যও সমান তালে ভাল।
আমাদের পাঠক মুখরোচক খাদ্য ও দেহরোচক নারী পেলে ব্যস, আর কিছুই চায় না। তাই পাঠকের সুবিধার্থে মূলধারা তার অধঃযাত্রাকেই কবুল করেছে।
৩. লোকে বলে, নারী মুখে সাদা রঙের ক্ষো পাউডার বুলোয় আর চোখে কালো কাজল পরে। আমি বলি নারী নিজের মুখে নিজে চুনকালি মাখে। নারী নিজের হাতে নিজের গালে চুন মাখে, নিজের হাতে নিজের চোখে কালি মাখে।
মুখে চুনকালি পড়লে মানুষ লজ্জিত হয়। নারীর লজ্জা নেই। নারীর নিজের প্রতি ঘৃণা নেই। দিব্যি হেঁটে বেড়ায় আপাদমস্তক সামাজিক সঙ।
চোখে কালি পড়তে পড়তে নারীর চোখ এখন অন্ধ। ত্বকে চুন পড়তে পড়তে নারীর ত্বক এখন বোধহীন, নিস্তেজ। তাই গায়ে আঘাত লাগলে নারী চিৎকার করে না, সম্মানে ঘা পড়লে নারী টের পায় না। তাই চোখের সামনে নারীর সর্বস্ব লুঠ হলেও নারী চোখে দেখে না।
৪. মাঝে মাঝে কবিতার জলে আমি আকণ্ঠ ভুবি। সেদিন একটি কবিতা আমাকে ডুবিয়ে ভাসিয়ে এমন একাকার করল যে আমি দাঁড়াবার কোনও কিনার পেলাম না। কবিতাটির নাম ‘সস্তার জিনিস’।
বাজারে এত সস্তায় আর কিছু মেলে না, যত সস্তায় মেয়ে মানুষ মেলে
ওরা একটা আলতার শিশি পেলে আনন্দে তিনদিন না ঘুমিয়ে কাটায়।
গায়ে ঘষার দুটো সাবান আর চুলের সুগন্ধী তেল পেলে
ওরা এমন বশ হয় যে ওদের গায়ের মাংস খুলে
সপ্তাহে দু’বার হাটে-বাজারে বিক্রি করা যায়।
একটা নাকছবি পেলে ওরা সত্তর দিন পা চাটে
ডুরে একখানা শাড়ি হলে পুরো সাড়ে তিন মাস।
বাড়ির একটা নেড়িকুত্তাও সময়ে ঘেউ ঘেউ করে
আর সস্তার মেয়ে মানুষের মুখে একটা কুলুপ থাকে
সোনার কুলুপ।