1 of 2

১৫. পর্দা প্রথায় ধর্ষণ রোধ হয়না

কাপড় ব্যবহার করেন। অনেকটা ওড়নার মত, কিন্তু ওড়না নয়। আমি অনেককে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি, এই বস্ত্রখণ্ডটি বোরখার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শহরে এই বস্ত্রখণ্ডটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে বলে এটিকে ‘শহুরে বোরখা’ বলা যায়; এখনও গ্রামাঞ্চলে, আপাদমস্তক আবৃত করা বোরখার প্রচলনই বেশি।

এই কাপড়টি দিয়ে শরীরের যে যে অংশ আবৃত করা যায়, তা শাড়ির আঁচল দিয়েই করা সম্ভব, সুতরাং এটি বাড়তি একটি প্রলেপ ছাড়া কিছু নয়। আর যে কোনও বাড়তি বস্তুই বিলাসিতার নামান্তর। যে দেশের অধিকাংশ নারীই বস্ত্রহীনতায় ভোগে, সে দেশে কাপড়ের ওপর কাপড় পরিধান দৃষ্টিকটু তো ঠেকেই, বৈষম্যের ব্যবস্থাগুলোও আরও বেশি প্রকট হয়।

ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্র—কোনও দিক থেকেই নারী তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। মানুষ হিসেবে পুরুষ ও নারীতে অসাম্য ও বিভেদ সবচেয়ে বেশি সৃষ্টি করেছে ধর্ম। সুরা আহজাবে লেখা—‘হে নারীগণ, তোমরা তোমাদের গৃহসমূহে অবস্থান কর এবং সজ্জিত হয়ে গৃহের বাইরে যেয়ে নিজেদের সৌন্দর্য ও বেশভূষা পর-পুরুষকে প্রদর্শন করবে না—যেমন অন্ধকার যুগের নারীগণ প্রদর্শন করত।‘

ঘরের বাইরে বের হওয়ার অর্থ পর-পুরুষকে সৌন্দর্য ও বেশভূষা প্রদর্শন করা নয়। যে বস্তু ঢেকে রাখা হয়, সেই বস্তুর প্রতি আকর্ষণ তীব্র হয়—এই সত্যটি মানুষের জীবনে বিভিন্নভাবে পরীক্ষিত।

যে জিনিস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, সেই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি, অদৃশ্য ও আবৃত বস্তুর প্রতি, গুপ্ত ও গোপন সত্যের প্রতি মানুষের দুনিবার আকর্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে এ যাবৎ কোন ধর্ম পারেনি। মানুষ উন্মোচন করে, উন্মুক্ত করে মৃত্তিকা, জল, আকাশ ও মানুষ। মানুষের প্রকৃতিই এই মানুষ ক্রমশ গভীরে ও গহনে প্রবেশ করে। মানুষের প্রকৃতিই এই মানুষ যে কোনও বন্ধন এবং আচ্ছাদন থেকে ক্রমশ মুক্ত হয়।

সৌন্দর্য শুধু নারী-শরীরে নয়, পুরুষ-শরীরেও থাকে; বেশভূষা নারীর চেয়ে পুরুষের কম নয়। তবে আবৃত করবার দায় কেবল নারীর একার কেন ? পুরুষের সৌন্দর্য ও বেশভূষার প্রতিও নারীর দৃষ্টি যায় (বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ পুরুষ এবং নারীর শারীর-বিজ্ঞান মতে সমান)। নিজেকে আড়াল করা তবে পুরুষের জন্যও বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। মানুষের হিংস্রতার কারণে মানুষ যখন মানুষ থেকে নিজেকে আড়াল করে, তখনই সেই যুগকে নিদ্বিধায় বলা যায় অন্ধকার যুগ। অন্ধকার কেটে গেলে মানুষ মানুষের বন্ধু হয়। পুরুষ ও নারীর সহাবস্থানে জীবন হয়ে ওঠে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিপূর্ণ। তখন পুরুষের যেমন সর্বাঙ্গ আচ্ছাদনের প্রয়োজন হয় না, নারীরও নয়।

আরব দেশের বর্বরতার যুগ এখন নেই। অন্ধকার কেটে গেছে। বিজ্ঞানের আলোকিত যুগে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার শীর্ষে মানুষকে এখন অযথা আচ্ছাদিত হওয়া উচিত নয়। আচ্ছাদনের অর্থই শরীর নিয়ে ব্যস্ত হওয়া, সচেতন হওয়া, সতর্ক করা, শরীরকে লোভনীয় করা। শরীরের চেয়ে এখন কাজকর্ম বড়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চেয়ে ব্যক্তিত্বই প্রধান।

পর-পুরুষের যদি কু-প্রবৃত্তি থাকে, তবে পর্দাপ্রথা দিয়ে সেই কু-প্রবৃত্তি সংবরণ করা যায় না। প্রবৃত্তি উত্তরণের জন্য অন্য কোনও প্রথার প্রয়োজন। পর্দা প্রথায় পৃথিবীর কোথাও নারী-হরণ, নারী-ধর্ষণ, নারী-হত্যা রোধ হয়নি। পুরুষের যৌন-উন্মাদনার সকল দায়-দায়িত্ব নারীকে বহন করতে হবে, নারীর শরীরে ধারণ করতে হবে ধর্মীয় বস্ত্রাদি, তা মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্ট কোনও আধুনিক ব্যবস্থা নয়।

তিরমিজি হদিস শরীফে লেখা—স্ত্রীলোক গোপনীয় বস্তু, যখন সে পর্দার বাহির হয়, শয়তান তাহাকে পুরুষের চক্ষে মনোমুগ্ধকর করিয়া দেখায়।‘

স্ত্রীলোক মানুষ। পুরুষ যেমন মানুষ, স্ত্রীলোকও মানুষ। স্ত্রীলোক যদি মনোমুগ্ধকর হয়, তাকে মনোমুগ্ধকর দেখানোর জন্য শয়তানের প্রয়োজন হয় না। পুরুষের চরিত্রে যদি দোষ থাকে, স্ত্রীলোকের পর্দা থাকুক বা না থাকুক—সে স্ত্রীলোককে আক্রমণ করে। দোষ এখানে পুরুষের, শয়তানের নয়। অভিযুক্ত পুরুষের কোনও অধিকার নেই নারীর পর্দাহীনতার দোহাই দেবার।

মানুষ শিক্ষিত না হলে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির সংস্কার না হলে কুচক্ৰী মৌলবাদরা ধর্মের নামে মানুষকে কেবল পেছনে ঠেলবে, সামনে নয়। মানুষ সভ্য হয়েছে, বস্ত্র ব্যবহার করছে। এই বস্ত্রের ভাল এবং মন্দ দুরকম ব্যবহার হয়। অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় কোনও ব্যবহারই মঙ্গলজনক নয়। একদিকে বাড়লে আরেকদিকে কমে। একদিকে যদি বস্ত্রাধিক্য, অন্যদিকে বস্ত্রহীনতা। একদিকে যদি অঢেল খাদ্য, অন্যদিকে ক্ষুধা। একদিকে সুরম্য অট্টালিকা, অন্যদিকে বস্তি, উদ্বাস্তুর প্লাটফরম, ফুটপাত।

বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য বাড়ছে কারণ ধর্মে বৈষম্য আছে, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এই বৈষম্যের বিপরীত কোনও কথা বলে না। অন্যায়ের গোড়ায় জল ঢাললে অন্যায়ের কোনও শক্তি নেই মরে যাবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *