1 of 2

০২. নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে ‘মানুষ’ লেখা নেই

কলকাতা সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত অভিধানগুলো বিগত ৩০ বছর ধরে বাংলাভাষী সহৃদয় পাঠকের অনিকূল্য লাভ করে আসছে। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত ‘সমার্থ শব্দকোষ ‘একটি ভিন্ন ধরনের বাংলা অভিধান। এই সমার্থক শব্দকোষ বাংলাভাষার থিসরাস। কোনও শব্দ, তার প্রতিশব্দ, সেই শব্দের আনুশাংগীক,সমশ্রেণীভুক্ত এবং সমবর্গীয় শব্দ কে এই অভিধানে একত্রিত করা হয়েছে। সমার্থ শব্দকোষ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একটি অতুলনীয় সংযোজন। এই মূল্যবান অভিধানে ‘পুরুষ’ শব্দের সমার্থ শব্দ -পুরুষ মানুষ, বেটাছেলে, ছেলে, মরদ, মদ্দ, মদ্দা, মর্দ, পুমান, মিনসে, নর, মানব,মানুষ, মনুষ্য,আদমী, এবং নারীর সমার্থ শব্দ-স্ত্রী, মেয়ে, মানবী, মানবিকা, কামিনী, অবলা, আওরত, জেনানা, যোষিৎ, যোষিতা, যোষা, জনি, বালা, প্রমদাজন, বনিতা, ভামিনী, শর্বরী, প্রতিপদর্শিনী লেখা হয়েছে। নারীর সমার্থ শব্দ সংখ্যা এখানে অধিক কিন্তু লক্ষ্যনীয় এই, ‘মানুষ’ শব্দটি পুরুষের সমার্থক শব্দ হিসেবে উল্ল্যেখিত অথচ নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে কোথাও মানুষ অথবা মনুষ্য লেখা নেই। সুধীজন সমাদৃত গ্রন্থটিকে পুরুষ ও নারীর অদ্ভুত অর্থ আমাকে স্তম্ভিত করেছে।

আমি এইরকম স্তম্ভিত হই,যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রী নিবাসগুলো সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়,হাঁস-মুরগীর খোঁয়ার যেমন বন্ধ হয়।অচিরেই এইসব গৃহপালিত জন্তুর নাম নারীর সমার্থ শব্দ তলিকায় স্থান পাবে,এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। একটি ছাত্র তার প্রয়োজন মত হলে বা হোষ্টেলে যাওয়া আসা করে,সেক্ষেত্রে ছাত্রীর প্রয়োজন অপ্রয়োজন জরুরি কোন বিষয় নয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার একইরকম অনুশীলন ও প্রতিযোগিতায় দুজনেই অংশগ্রহণ করেছে; ছাত্রীর জন্য কিছু দুর্বল, কিছু সহজ,কিছু নিচু স্থরের শিক্ষাব্যাবস্থা সেখানে নেই। নির্দিষ্ট একটি সময়ে হলে ফিরবার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ যে বাণী দিবেন,তা শুনে যে কোন দুর্বল স্নায়ু ও অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সহজে কাবু হয়ে যাবে,কিন্তু নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন মেয়েরা এই অবৈধ ও অশ্লীল নিয়মটি মেনে নিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করেছে -তারা অশহায়, দুর্বল, তারা পুরুষের ভোগের সামগ্রী, প্রাচীর এবং প্রহরী ছাড়া তারা নিরাপদ নয়। (ছাত্রীদের হল সন্ধ্যায় বন্ধ হয় বলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তাঁদের প্রবচনে-কথনে ছাত্রীদের পতিতা বলেন না? বলেন। বলবেন।)

আসলে রাত কিছু নয়, অন্ধকার কিছু নয়, দুর্ঘটনা কিছু নয়, সকল কিছুর উদ্দ্যেশ্য নারীকে দমন করা। যাবতীয় বিপর্যয়, বিঘ্ন, দুর্যোগ, সঙ্কট ; যাবতীয় দু:সময়, দু:শাসন, সন্ত্রাস, অতিক্রম করে সে আবার না স্বাবলম্বী হয়ে উঠে, স্বছন্দ হয়ে উঠে, সবল ও দুর্লভ হয়ে উঠে।

আর তা যদি হয়ে উঠে তাহলে তো ভীষন অসুবিধে। কারণ বিদ্যাধরী মেয়ে ‘আধুনিক ক্রীতদাসী’ হওয়ার জন্য চমৎকার।স্বামীকে মুগ্ধ ও তুষ্ট করবার জন্য এদের নিরলস রুপচর্চা,এদের সভা সমিতি, শিল্প সংস্কৃতি, নারী আন্দোলন -সবই হচ্ছে ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি বাংগালী মেয়েদের বালিশের ওয়াড়ে রংগীন সুতোয়, ‘সতীর দেবতা পতি’ চর্চার আধুনিকরণ।

জার্মেইন গ্রীয়ারের লেখা ‘ফিমেল ইউনাক’ গ্রন্থে মেয়েদের হাইহিল জুতো আবিষ্কারের একটি চমৎকার কারণ তুলে ধরা হয়েছে। পুরুষ যখন একটি মেয়েকে আক্রমন করে,মেয়েটি নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রথমে দৌড় দেয়, সে যেন ভাল দৌড়াতে না পারে, হাইহিলের ব্যবস্থা সেজন্যই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *