একটি গন্তব্যের দিকে
একাত্তরের ডিসেম্বরে জনতার জয় দেখেছিলাম, কেবল দেখেইছিলাম, বুঝিনি। এবার ডিসেম্বরে মানুষের সমুদ্রে যে আনন্দের জোয়ার উঠেছে, তা যেমন দেখবার জিনিস, তেমনি অনুভব করবার। আমি এই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করিনি।
ডাঃ মিলনের মৃত্যুর কথা সকলে বলছে—সকল মৃত্যু ছাপিয়ে একটি মৃত্যুই এখন প্রধান হয়ে উঠেছে সকলের কাছে। ময়মনসিংহের স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত ফিরোজ ও জাহাঙ্গীর, ডাঃ মিলনের চেয়ে মানুষ হিসেবে কোনও অংশে কম নয়। কম নয় মনোয়ার, জেহাদ, জাকির, নিমাই–এরকম আরও অনেকে—সকলের নাম আমি জানি না। সরকারি হত্যাকাণ্ডের শিকার সব নাম ঠিকানার প্রচার প্রয়োজন। না হলে সময়ের ট্রাক এসে চাপা দিয়ে যাবে আদ্যোপান্ত ইতিহাস। হুজুগে বাঙালি স্মরণ করতে যেমন পারদর্শি, ভুলতেও তার সময় লাগে না। মৃত্যুগুলো লিখিত হওয়া দরকার, দুঘর্টনার স্থানগুলোয় শহীদ মিনার হওয়া জরুরি।
একইভাবে জরুরি—দালাল চিহ্নিত হওয়া। দালালদের নাম প্রচার হচ্ছে বিভিন্ন কায়দায়। এই নামগুলোর মধ্যে কিছু অতিরঞ্জন, আবেগের আতিশয্য কিছু আছে, যা নিতান্তই অশোভন। বেশ কিছু মেয়ের নাম প্রচার হচ্ছে এবং সেই নামগুলোর পাশে দেহপসারিণী, রক্ষিতা ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে অবলীলায়। দেহপসারিণী এই দেশে অবৈধ নয়, রক্ষিতাও নয়। তাই যে মেয়ে দেহপসারিণী এবং রক্ষিতা, তাকে দোষ দেওয়া কিংবা কাগজে তার নাম ছেপে বেড়ানো বোকামো ছাড়া কিছু নয় |
ধিকৃত রাষ্ট্রনায়ক সারাদেশে দেহপসারিণী ছড়িয়েছে সহযোগী কামুকদের ভোগের জন্য, নিজেও যথেচ্ছ ভোগ করেছে। তার অনুগত মন্ত্রিদের, ক্ষমতাসীন আমলাদের নানাবিধ যৌন সমস্যা ছিল, স্পীকারের যৌনবিকৃতির গল্প জানেন না এমন লোক কমই আছেন।
এই ধিক্কার আমরা নারীকে দেব কেন, দেব তাদের–যারা নারীকে তুচ্ছ সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে ব্যবহার করে। চিহ্নিত করব তাদের, নারীকে আমূল গ্রাস করে যারা তুড়ি বাজিয়ে রাজ্যের সৎ লোক সাজে। যারা দুনীতির পাহাড় গড়ে সেই পাহাড়ের চুড়োয় বসে দেশকে ডুবিয়ে দেয় অতল জলে।
শোষককে চিহ্নিত করতে গেলে মনে রাখতে হবে সেই দলে যেন কখনও শোষিতকে না ফেলি। পরে এই লজ্জা ঢাকবার জায়গা আমরা পাব না। লক্ষ্য যদি স্থির না থাকে, লক্ষ্যবস্তুর চেয়ে যখন প্রাধান্য পেয়ে যায় পরিপাশ্বের নগণ্য বিষয়-আশয়, তখন প্রধান ছাপিয়ে অপ্রধানই এত এগিয়ে আসে সামনে যে, মানুষ ভুলে যায় কোনদিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া উচিত; মানুষের তখন সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা দিগভ্রান্ত হওয়ার।
যে দেশে বহুবিবাহ দোষের নয়, যে দেশে লাম্পট্য দোষের নয়, সে দেশে বহুবিবাহের ছবি ছেপে লাম্পট্যের অনুপুঙ্খ বর্ণনা করলে মানুষ আহত হয় না বরং বিকৃত আনন্দ লাভ করে। তার চেয়ে এই দরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করাই কি ভয়ঙ্কর অপরাধ নয়? সংবিধান লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারই কি অপরাধের চূড়ান্ত নয়?
একজন স্বাধীন মানুষের কখনও অন্যায় নয় বিলিওনারদের ক্লাবে ভিনদেশি বান্ধবীর গালে চুমু খাওয়া, কখনও অন্যায় নয় পরকীয়া প্রেমে নিমজ্জিত হওয়া–কিন্তু সেই ব্যক্তির জন্য অবশ্যই এটি নিষিদ্ধ কাজ যে ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ ধর্ম নির্বাচন করে এবং সেই ধর্মের নাম হয় ইসলাম ।
একটি মানুষ কোনও একটি গোত্রের, কোনও একটি ধর্মের অর্থাৎ কোনও একটি বিশ্বাসের অন্তর্গত। এ সম্পূর্ণই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যে রাষ্ট্রে বাস করে সেই রাষ্ট্রকে টুপিদাড়ি পরানো হীন স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া কিছু নয়। মানুষকে ধর্মের সাগরে ভাসিয়ে নিজেই করেছে ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ। অর্থ আত্মসাৎ ও যৌন-বিকৃতির জন্য নিজের পাতা ধর্মের ফদে সে নিজেই পড়েছে। তার ইসলামই তাকে ধিক্কার দিক। –
মানুষ এগিয়েছে, মানুষ এগোবে। এই অভু্যত্থান মানুষকে যে বিজয় দিয়েছে, এই বিজয়কে আরও ব্যাপক এবং মহৎ উদ্দেশ্যে অগ্রসর না করলে মানুষ সামনে এগোবার শক্তি ও উদ্দীপনা দুই-ই হারাবে। মেরী, জিনাত, নাশিদ, মুনমুন, সিলভিয়া, ডালি, রোজী, পপি প্রসঙ্গ আজ থেকে বন্ধ হোক। মূল প্রসঙ্গ হোক এরশাদ। মূল প্রসঙ্গ হোক তার অমার্জনীয় অপরাধ এবং সে কারণে অচিরে তার প্রাপ্য শাস্তির ব্যবস্থা করা। বাঙালির মন বড় নরম, নরম হওয়া নিশ্চয় ভাল লক্ষণ কিন্তু অপাত্রে নরম হলে সর্বনাশ হয়। একাত্তরের রাজাকারে এখনও দেশ ছেয়ে আছে, সেই সব রাজাকারের বাচ্চ রাজাকারে দেশ এখন কিলবিল করে। কুখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক ও তার সহযোগিরা যদি এ যাত্রা ক্ষমা পেয়ে যায়, তবে কিলবিল করা রাজাকারের অনুজ ও বন্ধুতে দেশে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়াবে যে আত্মহত্যা করা ছাড়া মানুষের আর বাচবার পথ থাকবে না। যারা এই গণআন্দোলনের স্রোতে মিশে যেতে চাইছে, মিশে যেতে চাইছে ঘাতকের প্রচুর সহযোগী—এ সময় তাদের পৃথক করা বড় জরুরী।
যৌন সামগ্ৰী হিসেবে যে নারীরা রাষ্ট্রের উচ্চপদে-আসীন দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে তাদের আবার দ্বিতীয়বার নিগ্রহ করবার কোনও কারণ নেই। এই আন্দোলন সকল সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে, কোনও নিগৃহীতের বিরুদ্ধে নয়। কোনও ব্যবহৃত-বস্তুর বিরুদ্ধে নয়।
আসুন, আমরা আমাদের লক্ষ্য আরেকবার স্থির করি। আমরা আমাদের দৃঢ়তা আরেকবার পরীক্ষা করি। এবং আমরা অনড় হই একটি বৃহৎ উদ্দেশ্যে। আমরা একত্ৰ হই একটি সম্ভাবনার জন্য এবং আমরা যাত্রা করি একটি গন্তব্যের দিকে এবং একটি গন্তব্যের দিকেই।