1 of 2

৪১. নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি

নারীর শরীরই তার সবচেয়ে বড় বেড়ি

আমি যখন আমার দিকে তাকাই—আমার শরীরের দিকে, আমি অনুভব করি আমার শরীরের কিছু অংশ নিয়ে আমি মাত্রাতিরিক্ত সচেতন। এই সচেতনতা আজ এই বয়সে হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। এই বোধ তখন থেকে—যখন আমার তেরো বছরের ভাই গরম লাগছে বলে এক উঠোন মানুষের সামনে গায়ের জামা খুলে ফেলেছিল। তার চেয়ে অধিক গরমে কাতর হয়েও, আমি তার সমবয়সী বোন, আমি পারিনি অবলীলায় আমার গায়ের জামা খুলে ফেলতে।

একবার দূরপাল্লার যাত্রায় খুব প্রস্রাবের প্রয়োজন হয় অধিকাংশ যাত্রীর। পুরুষ যাত্রীরা রাস্তার পাশে নর্দমা বা গাছের আড়ালে প্রাকৃতিক কাজটি সেরে ফেলে। বাসের মেয়ে-যাত্রীরা প্রচণ্ড বেগ থাকা সত্ত্বেও সেদিন জল বিয়োগ করবার জন্য নামতে পারেনি। যদি কেউ একজনও এই কাজে অগ্রসর হত আমি জানি দৃশ্যটি চমৎকার উপভোগ্য হত বাসের আর সকল যাত্রীর চোখে। এই লজ্জা এবং সঙ্কোচের চাকু নারী-শরীরকে একশ’ ভাগে কেটেছে বলে ওরা কেউ বিষম প্রয়োজনেও বাসের আসন ছেড়ে দাঁড়ায়নি। আমার জামার বোতাম খুব শক্ত করে এঁটেছি সেই তেরো বছর বয়স থেকে। গরমে সেদ্ধ হলেও আমার জামা খুলতে আড়াল লাগে। আমি খোলা হাওয়ায় গা খুলে স্নান করতে পারি না।

যে মানুষ এত বন্ধন, এত প্রতিবন্ধকতা বহন করে জীবন শুরু করে, সে খুব কম বিপত্তি, কম গলি ঘুপচি, কম অন্ধকার, কম পর্বত, কম অরণ্য পেরিয়ে বয়স্ক হয় না। যে কোনও নারীই গায়ে একটি বেড়ি অনুভব করে, নারীত্বের বেড়ি। (যেহেতু সে নারী এবং তার সারা অঙ্গে নারীত্বের বেড়ি—তার পথ মাপা এবং গন্তব্য নির্ধারিত।) সে তার সীমিত অঙ্গনে পদচারণা করে পদক্ষেপকে সংযত এবং সংক্ষিপ্ত করে। যত সে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয় তত তার অভিজ্ঞতা ও অনুভবের ভেতর আবিষ্কার করে নতুন চৈতন্য। নারীকে তাই মানুষের অধিক মানুষ বলতেই আমি পছন্দ করি।

নারীর ধারণ করবার ক্ষমতা এত বেশি যে আমি নিজে নারী হয়ে বিস্ময় বোধ করি। নিজের শরীরের ভেতর অন্য এক শরীর ধারণ করবার অভিজ্ঞতা যে একবার অর্জন করেছে তার কাছে পৃথিবীর সকল নির্মাণই তুচ্ছ হতে বাধ্য। সে নিজ অস্তিত্বের অনুরূপ এক অস্তিত্বকে নিজের ভেতর লালন করতে পারে, একইভাবে অসংখ্য অস্তিত্বকে। আমি এই ধারণের তুলনা অন্য কিছুর সঙ্গে দেবার সাহস করি না।

সেদিন আমার চোখের সামনে এক তরুণী অপর তিনজন সহ, সম্ভবত তার আত্মীয়, এক মেলায় হাঁটছিল। হেঁটে হেঁটে এক সময় আমার একেবারে কাছে খানিক থেমেছে, আমি লক্ষ্য করি পাশে একটি হোন্ডায় ভর রেখে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ছেলে, বয়স কুড়ি একুশ, আমড়া খেয়ে আমড়ার আঁটি মেয়েটির দিকে ছুড়ে দেয়। সেই আঁটি গিয়ে মেয়ের চুলে আটকায়। মেয়েটি চারপাশে তাকায়, চারপাশের চেয়ে সে বেশি তাকায় তার আত্মীয় তিনজনের দিকে। তার চোখ লজ্জায় ও শঙ্কায় অবনত। চুল থেকে দ্রুত আঁটি খুলে এমন তাকায় যেন সে এইমাত্র একটি মারাত্মক অপরাধ করে ফেলেছে এবং যেন ছেলে-ছোকরাদের অসভ্যতা গায়ে এসে পড়বার কারণ সে, সে নিজে, যেহেতু সে নারী, তাই নারী-জন্মের প্রায়শ্চিত্ত সে এভাবেই করে যে সে লজ্জিত হয়, আড়ষ্ট হয়, সে অপরাধী হয় এবং ওই স্থান থেকে নিজেকে সে দ্রুত বিতাড়িত করে। যারা এই দুষ্কর্ম করেছে, ঘৃণা বা ধিক্কার সেই দিকে যায় না, দৃষ্টি যায় মেয়ের দিকে। কেন, চারদিকে এত মাথা, আমড়ার আঁটি এসে অন্য মাথা রেখে এই মাথায় পড়ে কেন? মাথাটিরই নিশ্চয় দোষ। সকল দোষ, সকল অপবাদ, পুরুষের অপকর্মের সকল ফলাফল সে একই ধারণ করে। ধারণ করে পুরুষের যাবতীয় অস্থিরতা, অসুস্থতা, স্বৈরাচার। ধারণ করে সে পরিবেশ সুস্থ রাখে, সংসার সমাজ সুস্থ রাখে। যে নারীর স্বামীরা প্রকাশ্যে ভিন্ন রমণীতে উপগত হয়—সে নারী কি ধারণ করে না দাম্পত্যের সকল স্থলন? তেরো বছর বয়সে জামার বোতাম যারা এঁটেছিল শক্ত করে—জীবনের সকল কষ্ট তারা তেমন শক্ত করে বুকের মধ্যে এঁটে রাখে।

পুরুষেরা নারীর এক শরীরে আরও বহু কিছুর ধারণ দেখতে চায়। স্ত্রীকে মাতারূপে ভগ্নীরূপে, প্রিয়ারূপে দেখলে পুরুষের বড় সুখ হয়। একের ভেতরে তিনের বড় কাঙাল তারা। তাদের খুব সাধ—তারা যখন ঘরে ফিরবে—স্ত্রীরা যেন সুস্বাদু খাবার রান্না করে নিজেরা না খেয়ে মায়ের মত অপেক্ষা করে। বড় বোনের মত যেন তারা জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে, কাপড়চোপড় কেচে রাখে। প্রেমিকার মত যেন তারা বিছানায় মেলে ধরে অনিন্দ সুন্দর দেহ।

পুরুষেরা ঘরের বিভিন্ন কাজে নিজেদর সুবিধা অনুযায়ী স্ত্রীকে বিভিন্ন রূপে পেতে আগ্রহী। স্ত্রীকে বিভিন্ন অভিনয় করিয়ে তারা বাহবা দিচ্ছে, তালি দিচ্ছে। যত বেশি বহুমাত্রিক অভিনয়ে স্ত্রীরা পারদর্শি হয়, পুরুষের লাভ তত, আনন্দ তত শরীর এবং মনের।

বন্ধন কি সেই থেকে শুরু, গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়ে তেরো বছর বয়সের মেয়েরা যখন জামা খুলে ফেলতে পারে না? প্রাকৃতিক বিভেদ ছাড়া নারী ও পুরুষে আসলে কোনও বিভেদ নেই। আর প্রাকৃতিক বিভেদই—এই সমাজের সবচেয়ে বড় পুঁজি। এই পুঁজি খাটিয়ে তারা ব্যবসা করছে, মুনাফা লুটছে।

যে মাটিকে মানুষ পায়ে পিষে মারে, খোদাই করে, খুবলে তোলে—সেই মাটির নাম দিয়েছে জননী। মাটিকে নারীর মত ভাবা হয়, যেহেতু সে ধারণ করে, যেহেতু সে নিষ্পেষিত হতে—যেহেতু সে কর্তিত, বিদীর্ণ ও চূর্ণ হতে দ্বিধা করে না।

নারীকে এমন এক খেলনা বানানো হয় যে, চাবি দিলেই পুরুষের বেষ্টনির মধ্যে একবার সে ঢোল বাজাবে, একবার বাশি। মূলত পুরুষকে সে স্বস্তি দেবে, একই সঙ্গে রকমারি আনন্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *