1 of 2

০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি

দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি, আমার পিতার বয়সী, আমার কবিতার খুব প্রশংসা করেন কেবল আমার কাছে। জনসমক্ষে করেন না, কাগজেও লেখেন না, কারণ কবিতা যতই ভাল লিখি না কেন, আমি তো মেয়ে, একটি মেয়ের প্রশংসা কি ফলাও করে করা যায়, চরিত্র যাবে যে!

এ দেশের চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবিরা গোপনে মেয়ে নিয়ে ঘোরাফেরা পছন্দ করেন, শহরের বড় বড় রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে কোনার টেবিলে বসে চৈনিক খেতে খেতে গল্প করতে ভালবাসেন, কারণ তাঁদের মধ্যে তো কুৎসিত সংস্কার নেই, তাঁদের জীবন নিস্তরঙ্গ পুকুর নয়, উত্তাল সমুদ্র; জীবনের বিচিত্র সব আনন্দ আহরণে তাঁরা ব্যস্ত। মেয়েদের কানে তাঁরা ঘন ঘন বলেন-‘ভালবাসি’। কিন্তু প্রকাশ্যে বলেন না, চেপে যান। কারণ জাতে উঠে গেলে মেয়ে নিয়ে কথাবার্তা ভাল শোনায় না।

আমার এক ঔপন্যাসিক বন্ধু সেদিন বললেন, ‘তোমার কলাম বেশ ভাল হচ্ছে।’ আমি ধন্যবাদ জানাবার পর তিনি গম্ভীর কণ্ঠে যে বাক্যটি উচ্চারন করলেন, আমি তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, বললেন-‘সেলিনা হোসেনের চেয়ে তোমার গদ্য ভাল।’

–হঠাৎ সেলিনা হোসেনের প্রসঙ্গ কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি বললেন-মেয়েদের মধ্যে সেলিনা হোসেনের লেখাই ভাল কিনা। ‘মেয়েদের মধ্যে’ কথাটি আমাকে উপহার দিয়ে আমার ঔপন্যাসিক বন্ধু চলে গেলেন এবং আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন আমার লেখা যতই চমৎকার হোক না কেন, বিচার হবে ওই ‘মেয়েদের মধ্যেই,’ কারণ মেয়েরা তো আলাদা। জাতীয় দৈনিকগুলোয় ‘ছোটদের পাতা’র মত ‘মেয়েদের পাতা’ নামেও একটি আলাদা বিভাগ থাকে। ডাকসাইটে কাব্য-সমালোচকগণ আমি ভাল কবিতা লিখি, নাকি নাসিমা ভাল লেখে, নাকি সুহিতা ভাল, নাকি বিলোরা ভাল এই নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু কখনও জাহিদ ভাল লেখে নাকি আমি ভাল লিখি নাকি শাহ্‌রিয়ার ভাল লেখে এই নিয়ে কথা উঠে না। কারণ আমি তো মেয়ে, আমার বিচার হবে ‘মেয়েদের মধ্যে’।

এই দেশের একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার প্রায়ই বলে বেড়ান, মেয়েরা তাঁর কাছে প্রচুর চিঠি লেখে, কারণ মেয়েরা তাঁর প্রেমে বদ্ধ উন্মাদ, কিন্তু তিনি তাদের বিশেষ পাত্তাটাত্তা দেন না। একবার তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এলেন, এক মেয়ে তাঁকে বুকের রক্ত ঢেলে চিঠি লিখেছে। পরে অবশ্য জানা যায়, রক্তটক্ত কিছু নয়, রঙে ডোবানো একটি নববর্ষের কার্ড নিয়ে তিনি ওই গল্প ফেঁদেছেন। মেয়েদের নিয়ে এ ধরনের মুখরোচক গল্প বলে এঁরা একধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করেন।

আমার এক বন্ধু, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক, সেদিন অত্যন্ত উদ্বেগ এবং কিছুটা অসন্তোষসহ বললেন, শাহ্‌বাগের মোড়ে দুটো ছেলে তোমার নামে এই বলেছে সেই বলেছে। শুনে আমি তুমুল হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি-এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ওরা কি আবুল কালাম সম্পর্কে বলবে?

আবুল কালাম বলতে আমার সম্পাদক কি বুঝেছেন আমি জানি না, তবে আমি বলতে চেয়েছি, ‘এই বলা সেই বলা’ বলতে যা বুঝায় তা আবুল কালাম অথবা আবদুর রহমান অথবা শামসুল ইসলামদের মানাবে না। এক্ষেত্রে মেয়ে হলে জমে ভাল।

মেয়েরা, যারা লেখে, সাধারণের মধ্যে তাদের তাদের সম্পর্কে এমন একটি ধারনা আছে যে, তারা লেখে, নিশ্চয়ই তাদের জীবনে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। জীবনে কোনও না কোনও বিপর্যয় ঘটলে মেয়েরা কেউ আত্মহত্যা করে, কেউ বেশ্যাপাড়ায় আশ্রয় নেয়, অথবা কেও সাহিত্যে আশ্রয় নেয়। একটি মেয়ে লিখতে শুরু করলে লেখার চেয়ে তার নাড়ি নক্ষত্রের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ জন্মায়। প্রেমে পড়া অথবা প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, সংসারে অশান্তি অথবা সংসার-বৈরাগ্য ইত্যাদি ঘটনাগুলো না ঘটলে একটি মেয়ে অযথা সাহিত্য রচনা কেন করবে তা অনেকের বোধগম্য নয়। সাহিত্য তো বহু দূরের বিষয়, লেখাপড়া জিনিসটিই তো মেয়েদের জন্য নয়। মেয়েদের কোরান শিক্ষা দেওয়া হত স্বামীর মঙ্গলের জন্য যেন সে দোওয়া দরুদ পড়তে পারে। এরপর সামান্য অক্ষর জ্ঞান দেওয়া হল যেন ঘরে বসে ‘ভুলো না আমায়’ জাতীয় সূচকর্ম করতে পারে এবং প্রবাসী স্বামীকে ভুল বানানে পত্র লিখতে পারে। বর্তমানে মেয়েদের বিদ্যা শিক্ষা তো অধিকাংশই সন্তান পালনের জন্য। তাছাড়াও আজকালকার স্মার্ট স্বামীরা ‘ঘরে শিক্ষিত বউ’ নিয়ে এক ধরনের গর্ববোধ করার সুযোগ পায়। যেন কৃতিত্বটা তাদেরই, আর শিক্ষিত মেয়েদের সেবা পাওয়ার আলাদা একটি মজাও তো আছে। তো, এই মেয়েরা সাহিত্য করবে কেন? বড় জোর যৌতুক ও বিয়ে শাদির কিছু সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার ‘মহিলা অঙ্গনে’ লেখালেখি করে পাতা ভরাবে। এর বেশি কিছু করতে চাইলে; একেবারে ছেলেদের সঙ্গে গদ্যে, পদ্যে, ভাষা-সাহিত্যে, পাণ্ডিত্যে মেয়েদের তুলনা যদি চলে, ছেলেদের লজ্জা লাগে না বুঝি? ছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *