১. সত্যজিৎ রায়ের যত ছবি আমি দেখেছি, পথের পাঁচালীর মত ভাল আর কোনওটিই লাগেনি। যদিও সত্যজিৎ রায় বলেন পথের পাঁচালীতে প্রচুর টেকনিক্যাল ক্রটি রয়ে গেছে, পরবর্তী ছবিগুলোয় সে ক্রটি কাটিয়ে উঠেছেন, আমার তবু ভাল লাগে পথের পাঁচালীই। পথের পাঁচালী আমি বারবার দেখি। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় ছাড়াও আমার কিছু প্রিয় চলচ্চিত্র-নির্মাতা, যাদের কাজ আমাকে মুগ্ধ করে, উদ্বেলিত করে, আলোড়িত করে—তারা শ্যাম বেনেগাল, রবীন্দ্র ধর্মরাজ, মোজাফফর, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ, গোবিন্দ নিহালিনি, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, ঋত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গিরিশ কাসরভল্লী, আদুর গোপাল কৃষ্ণন ও গিরিশ কারনাড।
শূদ্রক রচিত সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিক অবলম্বনে গিরিশ কারনাড ‘উৎসব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নারীকে প্রেমের বাতাবরণে ছাড়া অন্য ভাবে দেখা হয়নি। সে-ও যে একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি, পারিবারিক ভূমিকার বাইরে সে-ও যে একজন নাগরিক, তারও যে নিজস্ব সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন ও ব্যর্থতা বোধ থাকতে পারে সংস্কৃত-সাহিত্যে এই চেতনাই নেই। কিন্তু শূদ্ৰক (যদিও মৃচ্ছকটিকের রচয়িত শূদ্রক কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে) বসন্তসেনার চরিত্রে অন্য এক মাত্রা এনেছেন, সে শুধু প্রেমিকা নয়, সে প্রভু, নাগরিক, গৃহকত্রী ও সখী। অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যে প্রেমিক ছাড়া অন্য পরিচয়েও নারী দেখা দেয়, যেমন গ্রিক নাটকে। অবশ্য একথাও সত্য যে অন্য যে ভূমিকাতেই নারী অবতীর্ণ হোক না কেন সেটিও পুরুষ পরিকল্পিত পূর্বনিরূপিত একটি ছক, তার সীমার মধ্যেই নারীর সঞ্চরণ। সংস্কৃত সাহিত্যে প্রেমই একমাত্র বাতাবরণ বলে গুপ্তপ্রণয়, দূতী, সংকেতস্থল ও অন্তঃপুরের কুঞ্জ কাননের মধ্যেই তার বিচরণ। কিন্তু ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে নারী সত্তার অন্য কিছু দিক স্বীকৃত, শুধু দেহমাত্রসার নায়িকার যান্ত্রিক ভূমিকাতে ভোগ্যবস্তুরূপে সে দেখা দেয়নি।’
গিরিশ কারনাড ‘উৎসব’-এর শেষ দৃশ্যে দেখিয়েছেন নায়িকা বসন্তসেনা আবার তার গণিকা বৃত্তিতে ফিরে যায়, দুশ্চরিত্র সংস্থানক বসন্তসেনার ঘরের দরজায় আছড়ে পড়লে বসন্তসেনা তাকে নিজ ঘরে তুলে নেয়। অথচ ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে রাজা চারুদত্তের সঙ্গে বসন্তসেনার বিয়ের কথা হয়। গিরিশ কারনাড কেন মূল নাটকের এই বিষয়টি পরিবর্তন করলেন জানি না। সম্ভবত এই কারণে যে, কোনও গণিকাকে কোনও রাজার বিয়ে করবার সুসংবাদটির চেয়ে পুরনো গণিকাবৃত্তিতেই তার ফিরে যাওয়া অধিক যৌক্তিক। সাধারণত যা ঘটে, গিরিশ কারনাড তাই করলেন, গণিকা বসন্তসেনাকে সমাজে তুললেন না। কিন্তু যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে মৃচ্ছকটিক রচিত, সে সময়ে নগরীর রূপ-গুণ ও ধনবতী বসন্তসেনাকে রাজা চারুদত্তের বিয়ে করা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। প্রখ্যাত নাট্যকার ও চলচ্চিত্র-পরিচালক গিরিশ কারনাড বসন্তসেনার সামাজিক অবস্থার কোনও উন্নতি না ঘটিয়ে সুধীজনের বাহবা পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু আমি মনে করি মূল নাটকের প্রতি গিরিশ কারনাডের বিশ্বস্ত থাকা উচিত ছিল।
২. ঘর করা বলতে বোঝায় গৃহস্থতা করা, সংসারধর্ম করা। এই কমটি পুরুষেরা কখনও করে না। ঘর করে নারী। একটি নারী একটি পুরুষের ঘর করে। কিন্তু একটি পুরুষ কখনও একটি নারীর ঘর করে না।
অথচ পুরুষ নারীর মতই ঘরে খায়-দায়, ঘুমোয়। কিন্তু ঘর করা ব্যাপারটি নারীর জন্য বাঁধা। আমাদের অভিধানে, শব্দ ব্যবহারে নারীকে নিচু করবার প্রবণতা প্রচলিত। বিয়ে বিষয়টি পুরুষ ও নারী দুজনের জীবনেই ঘটে। দুজনই একটি নতুন জীবনে প্রবেশ করে। কিন্তু ঘটনাটিতে দু’জনের জন্য ক্রিয়াপদের ব্যবহার ভিন্ন। মেয়ে বিয়ে বসে, ছেলে বিয়ে করে। অর্থাৎ যে বসে সে নিক্রিয়। যে করে সে কর্তা। তাই গৃহকর্তা শব্দটি পুরুষের। এবং ঘর করা বলতে রান্না করা, ঘর গোছগাছ করা, ঝুল পরিষ্কার করা, সন্তান লালন করা ইত্যাদিকেই বোঝায়। এই কাজগুলো কোনও রকম যুক্তি ছাড়াই নারীর জন্য নির্ধারণ করা, নারী অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর হোক—তবু, নারী জ্ঞানে-বিদ্যায়-ব্যক্তিত্বে পুরুষের চেয়ে অগ্রসর হোক—তবু। এই পৃথিবীতে পুরুষ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিছু কথা তৈরি করেছে। ওই কথার মধ্যে কিছুর নাম দিয়েছে ‘ধর্ম’, কিছুর নাম ‘আইন।‘
৩. গত ২৮ মার্চ দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় বাংলাদেশ সরকারের একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি এই–‘মহিলাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত সকল শাড়ির (প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলাদের জন্য) বহর ও দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১.২২ মিটার (৪৮ ইঞ্চি) ও ৫.৫৪ মিটার (৬ গজ) হতে হবে। সকল উৎপাদনকারীকে শাড়ির এই মাপ আগামী ৭ দিনের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। এই আদেশ অমান্যকারিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
অর্থাৎ ধরে নিতে হয় এতকাল মহিলাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ ছিল না। তাই শাড়ির বহর ও দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে সেই মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখতে হবে। একটি মহিলা কি মাপের, কি ছাপের শাড়ি পরবে তা তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন, রুচি ও আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে। এখানে সরকারের গজ ফিতে নিয়ে ধর্মের নামে বহর মেপে দেওয়া অশোভন তো বটেই, অবৈধও। উৎপাদনকারী বিভিন্ন মাপের শাড়ি তৈরি করেন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। আমি নিজে বারো হাত শাড়ি ছাড়া পরতে পারি না, তাই বলে আমি কোনও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বারো হাত শাড়ি পরি না, এ আমার নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার। একইভাবে গ্রামের এবং শহরের অসচ্ছল পরিবারের যে মেয়েরা ঘরে বাইরে পরিশ্রম করছে এক প্যাঁচে শাড়ি পরে—তাদের জন্য বারো হাত শাড়ি মোটেও স্বস্তিদায়ক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। তারা দশ হাত শাড়িতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
এই দরিদ্র দেশের অধিকাংশ নারী একটি শাড়িকে তিন টুকরো করে ব্যবহার করে। কেউ ভিজে শাড়ি গায়ে শুকোয়, কেউ বাড়ি বাড়ি ন্যাকড়া ভিক্ষে করে লজ্জা ঢাকবার জন্য, তাদের কাছে শাড়ির ৪৫ ইঞ্চি ও ৪৮ ইঞ্চি বহরের মধ্যে, ৫ মিটার ও ৫.৫৪ মিটারের মধ্যে পার্থক্য কী ?
সরকার শেষ পর্যন্ত ধর্মকে মেয়েদের শাড়ির দৈর্ঘ্য ও বহরের মধ্যে এনে নামিয়েছে। এবং সরকারই ধর্মকে এভাবে সবচেয়ে বেশি অপদস্থ করছে।