১. ‘বিয়ের বয়স’ বলে একটি কথা আছে, যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভিন্ন হুলের আকারে কৈশোর অথবা কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েদের গায়ে ফোটানো হয়।আসলে মেয়েদের মনের উপর এটি একটি সামাজিক চাপ,যে চাপের ফলে মেয়েটি খামোকা প্রমে পড়তে, পালিয়ে যেতে এবং আত্মহত্যা করতে উদ্যোগী হয়। এতে মধ্য ও নিম্নবিত্তের অভিভাবক রা এরকম রেহাই পান। উচ্চবিত্তের অধিকাংশ ‘মেয়ে বিয়ে’ অনেকটা কেনা বেচার ব্যবসার মত। মেয়ের চেয়ে আকর্ষনীয় মেয়ের সম্পদ।সম্পদ যার যত বেশি সে ততো বিকোয় ভাল।
একসময় পাঁচ বছর বয়সে মেয়েরা ঘোমটা মাথায় শশুরবাড়ি আসতো; কি অভিজাত কি অনভিজাত সকলেই। এখনো গ্রামের মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করলে,যারা নিজের বয়স বলবার জ্ঞান রাখে না, জিজ্ঞাসা করতে হয় বিয়ের বয়সে তার মাসিক রজ:স্রাব হয়েছিল কি হয়নি, আর যদি হয়েই থাকে ক’বার রজ:স্রাবের পর তার বিয়ে হয়েছে অথবা বিয়ের ক:মাস কী ক’বছর পর তার রজ:স্রাব হয়েছে। (মেয়েদের রজ:স্রাবের হিসেব দিতে পারলেই বিয়ের বয়স বের করা যায়, কারণ রজ; দর্শনের একটি নির্দিষ্ট বয়স আছে। বিয়ের বয়স জানা গেলে পরবর্তি দাসত্বের বছর হিসেব করলেই পাওয়া যায় মেয়ের বয়স)।
এখনো গ্রামে, শুধু গ্রামেই বা বলি কেন, শহরের আশেপাশে, এবং শহরে যারা শিক্ষা চিকিৎসা, পুষ্টি ও সুস্থ বসবাস থেকে সর্বতোভাবে বঞ্চিত, মেয়েরা তিন হাত লম্বা হলেই তারা বিয়ের খেলা শুরু করে। বাংলাদেশে পনের থেকে উনিশ বছরের মেয়েদের শতকরা ৭৫ ভাগই বিবাহিত অথচ প্রাশ্চাত্য ইউরোপে ওই বয়সি মেয়েদের শতকরা এক ভাগও বিবাহিত নয়।মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স বলে-স্ত্রীর বয়স যদি ষোল বছরের নিচে হয় এবং স্বামীর যৌনাঙ্গ যোনিমুখ স্পর্শমাত্র করলে যে ঘটনাটি ঘটে তাকে ধর্ষন বলা হয় এবং ধর্ষন আইনত একটি অপরাধ।
এমন এক সময় ছিল রজোদর্শনের আগেই মেয়েরা বিধবা হয়েছে, পুতুল খেলার বয়সেই নিরামিষ আর এলাদশী ব্রত নিয়ে নারী জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। এখনো, ক্রমাগত সন্তান ধারনে এবং পালনে কৌশোর পার করে যৌবন যখন মেলে দেবে তার পাপড়ি, সে মেয়ে তখন বহন করে সামাজিক বার্ধক্য।
যে মেয়ে লেখাপড়া করে সে মেয়ে বিধবা হয়;এ ধরনের একটি বিশ্বাস বাংগালীরা বহু বছর লালন করেছে।অনেকে বলে যুগ বদলেছে,যুগ কতোটুকু বদলেছে? ক’টি মেয়ে খাতা কলম নিয়ে স্কুলে যায়,ক’জন মেয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে আসে,আর যারা আসে তারাই বা সামাজিক সংস্কার কতটুকু অতিক্রম করে শিক্ষিত হয়?
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী প্রাপ্ত অনেক মেয়েকে আমি বলতে শুনেছি -‘আমার সাহেব এখনো ঘরে ফিরেননি,’ ‘আমার কর্তা গতকাল দেশের বাইরে গেছেন।’ সাহেব শব্দটির মূল অর্থ শাসনকর্তা, সম্রাট। নবাব সাহেব,জর্জ সাহেব, মেজিস্ট্রেট সাহেব ইত্যাদি সাহেব শব্দের সম্মানসুভক ব্যাবহার। মান্য ইউরোপীয় বা বিদেশি পুরুষের বেলায় এই শব্দ ব্যবহার হয়, যেমন লাট সাহেব, চীনা সাহেব, জাপানী সাহেব।
স্বামী কে সাহেব বা কর্তা ডাকবার রীতি কবে থেকে,তা আমার সঠিক জানা নেই। একসময় স্বামীর নাম উচ্চারণ করা স্ত্রীর জন্য নিষিদ্ধ ছিল, বাংলাদেশের গ্রামে -গঞ্জে এখনো এই অদ্ভুত নিয়ম প্রচলিত। শহরে বা নগরের বেলায় এই নিয়িমটি সামান্য আধুনিকীকরণ হয়েছে,অল্প শিক্ষিত বা বেশি শিক্ষিত দু ধরনের স্ত্রীই স্বামীর নাম উচ্চারণ না করবার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সাহেব বা কর্তা ব্যবহার করেন।
এদের জীবনে এদের সাহেবের আদেশ ছাড়া কোন কিছুই কার্যকর হয় না।আমি অনেক চিকিৎসক মেয়ের কথা জানি,এরা স্বামীর বিদেশে চাকরির নিসচয়তা এবং নিজের চাকরির অনিসচয়তা নিয়ে কেবল স্বামীর সংগী হিসেবে বিদেশে পাড়ি দেন। এরপর যে ঘটনাটি ওখানে ঘটে তা হলো,স্বামী সাহেবটি দিব্যি চাকরি করেন এবং স্ত্রী বেচারা রান্না ঘরে পেঁয়াজ কাটেন অথবা ফিরনি রান্না করেন। চিকিৎসার বদলে রন্ধন শিল্পের পিছনে পাঁচ ছ’ বছর খাটা-খাটনি করলে এদের বর্তমান জীবন অধিকতর আনন্দময় হতো সন্দেহ নেই।
কোনও কোনও মেয়ে বড় আহ্লাদ করে বলেন আমার স্বামী চাকরি করা পছন্দ করেন না।তাঁর স্বামী মাছ খেতে পছন্দ করে না সুতরাং তার মাছ রান্না করা বারণ,তার স্বামী বেড়াতে পছন্দ করেননা তাই তার বেড়াতে যাওয়া বারণ,তাঁর স্বামী চাকরি করা পছন্দ করেন না তাই স্ত্রীর চাকরি করা বারণ। এক্ষেত্রে স্ত্রীর পছন্দ অপছন্দের তোয়াক্কা কিন্তু কেউ করে না।
৩.দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি এবং তাঁর স্ত্রী বিলেতে বার বছর থাকার পর দেশে এসেছেন এমন এক দূর আত্মিয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা শেষে আত্মীয়টি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন এবং বিলেতি অভ্যেস মত করমর্দন করলেন ভিসির সঙ্গে এবং হাত বাড়ালেন ভিসির স্ত্রীর দিকে।আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, আমি স্পষ্ট দেখলাম ভিসির স্ত্রী , যার নাম আমি জানি না , ভিসির স্ত্রী বলেই তিনি পরিচিত,সম্ভবত নিজের নামের চেয়ে এই পরিচয় টিই তাকে অধিক আনন্দ দেয়, তাঁর ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কুঁকড়ে এমন এক অবস্থা করেছেন যেন এই পাপ কাজে হাত বাড়াতে তাঁর মোটেও ইচ্ছা নেই,দু’বার তিনি আড়চোখে দেখলেন তাঁর সাহেব বা কর্তাটি তাঁর উপর অসন্তুষ্ঠ হচ্ছেন কিনা। তারপর ভিসির বাড়িতে কি ঘটেছে আমি জানি না। আমি কেবল আন্দাজ করতে পারি, আন্দাজ করতে পারি অপর পুরুষের করস্পর্শ স্ত্রীর জন্য কি পরিমান গর্হিত একটি কাজ।
৪. ডিসেম্বর মাস চলছে। আঠারো বছর আগে ন’মাস যুদ্ধের পর যে মাসে বাঁশের কঞ্চিতে গাঢ় সবুজের উপর লাল, লালের মধ্যে হলুদ মানচিত্র আঁকা একটুকরো কাপড় বেঁধে একঝাক শিশু সারা উঠোন জয় বাংলা বলে মিছিল করছি , সে মাস ডিসেম্বর মাস।
ময়মনসিংহ শহরে একাত্তরের মার্চ থেকে নভেম্বর অব্দি বড় মসজিদের ইমাম সাহেব নিজের হাতে মানুষ জবাই করে কুয়োয় ফেলেছে, এই মাসে কুয়ো থেকে অগণিত লাশ তুলে শহরবাসী খুঁজছে চেনা মুখ , আমার আত্মীয়রা খুঁজতে গিয়েছে যুদ্ধে যাওয়া , হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া স্বজন ।পাকিস্থানি সৈন্য আমাদের টাকাকড়ি লোট করেছে। যাবার আগে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়ী ,আমার বাবাকে ধরে নিয়ে বুট ও বেয়নেট এ পিষছে, দুই কাকাকে গুলি করে ফেলে রেখেছে রাস্তার মোড়ে , আমার ভাইয়ের ডান চোখ উপড়ে নিয়ে গেছে। এই মাসে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া তিন মামার দুজন ফিরে এসেছে, ষোল দিন পর ক্যাম্প থেকে ফিরে এসেছে আমার একুশ বছর বয়সের খালা। পড়শি যারা যুদ্ধ করেছে , কারও হাত নেই , কারও পা। তবুও আত্মীয়রা ওদের ফেরার আনন্দে যে মাসে আত্মহারা হয়েছে সে মাস ডিসেম্বর মাস।
কেবল আমার খালার ফিরে আসা কেউ চায়নি। যেন ফিরে না এলেই সকলে স্বস্তি পেত। এতকাল গর্ব করে বলেছি আমার বাবা, ভাই, কাকা, মামার কথা, গর্ব করেছি আমাদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে। কিন্তু আমার খালার কথা এতটুকু উচ্চারণ করিনি। আজ সকল নিষেধের আওতা থেকে বেরিয়ে আমি গর্ব করে বলছি ক্যাম্পের অন্ধকার ঘরে আমার খালাকে দশজন পশুস্বভাবী কামুক একটানা ষোল দিন ধর্ষণ করেছে।
আমাদের সমাজ আমার খালাকে নিয়ে গর্ব করেনি। বড় বড় লোকজন কাগজপত্রে, সভাসমিতিতে ধর্ষিতা নারী নিয়ে বড় বড় কথা বলেছে। বীরঙ্গনা খেতাব দিয়ে উদারতার নামে এক ধরনের ফাজলামো করেছে।
যুদ্ধের সকল ভাঙ্গন, বুট ও বেয়নেটের নৃশংস অত্যাচার এবং মৃত্যুর মত বীভৎসতা সকলে গ্রহন করলেও ধর্ষণ নামক দুর্ঘটনাটি গ্রহন করেনি।
বাইরে যখন ধর্ষিতা মা বোনের সম্মান নিয়ে চিৎকার করছে রাজনীতির নেতারা, তখন অসম্মান থেকে নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হিসেবে ঘরের কড়িকাঠে আমার খালা যে মাসে ফাঁসি নিয়েছে, সে মাস ডিসেম্বর মাস।