সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র
১. মেয়েদের চোখের নিচ টেনে ধরে কী দেখ বুবু?
এনিমিয়া দেখি ।
এনিমিয়া কী বুবু?
রক্তশূন্যতা।
পেটের চামড়া টেনে কী দেখ তুমি?
ডিহাইড্রেশান দেখি।
ডিহাইড্রেশান কী জিনিস বুবু?
জলশূন্যতা।
মেয়েদের হাত পা টিপে টিপে কী দেখ এত?
ঘোড়ার ডিম দেখি বলে ছোটবোনকে প্রায়ই সরিয়ে দিতাম। আমার সেই ছোটবোন এখন বড় হয়েছে। তাকে এখন বলতে ইচ্ছে করে আমি মেয়েদের ম্যালনিউট্রিশন দেখিরে বোন। অপুষ্টি দেখি। তোরা খেয়ে-পরে আর ক’জন খুব ভাল বেঁচে আছিস, কত লক্ষ নারী অপুষ্টিতে ভোগে তার খবর কে রাখে। কেন ভোগে, তাদের ঘরের পুরুষেরা তো এত অপুষ্টিতে ভোগে না, যত ভোগে ঘরের মেয়েরা!
স্বামীর পদতলে তারা তাদের বেহেস্ত বলে জানে, স্বামীর এঁটোকাঁটা খেয়ে তারা তাদের পুণ্য হয় বলে জানে—আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী সেই পুণ্য সংগ্রহের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করছে।
সমাজের রীতি রক্ষার তাগিদে বাড়ির পুরুষ-ছেলেরা খেয়ে ঢেকুর তোলার আগে মেয়েরা খাবার স্পর্শ করে না, দুপুরের খাবার খেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হোক, তবু পুরুষ-ছেলেরা আমিষ-নিরামিষ খাবার পর যা থাকে, তা উঠোনের হাস-মুরগি পায় কিছু কিছু পায় ঘরের মেয়েরা, আর বাকি যদি কিছু থাকে, তা বাসি করে রাখা হয় পরদিনের জন্য (অবশ্য তা মেয়েদের জন্যই)–এই হচ্ছে সাধারণ গৃহস্থ ঘরের দৈনন্দিন চিত্র।
২. ছোটবেলা থেকেই আমার এক আত্মীয়ার মাথা ভর্তি উকুন ছিল। একবার ওষুধ দিয়ে তার মাথার উকুন সব মারা হল। উকুন মরে ভালর চেয়ে বরং খারাপ হয়েছিল সেই আত্মীয়ার। রাতে ঘুম হয় না, চোখে অন্ধকার দেখে, খাবারে রুচি নেই। শেষ অব্দি আত্মীয়াটি আবিষ্কার করল মাথায় উকুন নেই বলেই তার এই অবস্থা। দু’মাস চরম অস্থিরতায় ভোগার পর মাথায় নতুন করে উকুন ছাড়তে সে বাধ্য করল। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ।
আসলে উপদ্রব পোহাতে পোহাতে মেয়েদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে উপদ্রব ছাড়া মেয়েরা বাঁচতে পারে না।
প্রতি রাতে বউ না পিটিয়ে ঘুমোয় না এমন পুরুষ খুঁজে বের করলে সংখ্যায় খুব কম হবে না বলে আমার মনে হয় না। তো সেদিন এ ধরনের নির্যাতনে অভ্যস্ত এক বউকে বলেছিলাম–উল্টে আপনি ওকে মারুন, নয় ওই পাষণ্ডকে ত্যাগ করুন।
শুনে আঁতকে উঠল ঘোমটা ঢাকা বউ। তাঁর শরীরের কালশিরাগুলোও লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। সম্ভবত মেয়েদের রক্তে-মাংসে গভীর এক বিশ্বাসের অঙ্কুরোদগম হয়েই গেছে যে মেয়েমানুষ জন্মই নিয়েছে লাঞ্ছিত হতে, যাবতীয় যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ পোহাতে। তাই যথেচ্ছ নির্যাতিত হতে তাদের মোটেই অপমান লাগে না।
৩. শাস্ত্ৰে বলে—‘অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী নববর্ষা তু রোহিনী/ দশবর্ষা ভবেৎ কন্যা উর্ধ্বং রজঃস্বলা’ ইত্যাদি। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায়–আট বছরের কন্যাকে গৌরী বল, নয় বছরের কন্যাকে রোহিনী, আর দশ বছরের কন্যাকে–কন্যা। দশের ওপর যাদের বয়স তাদের বলে রজঃস্বলা।
বারো বছর হয়ে গেলেও যে পিতা কন্যাদান করেন না তাঁর পিতৃলোকের আয়ীয়রা মাসে মাসে সেই কন্যার ঋতুকালীন শোণিত পান করেন। কন্যাকে রজঃস্বলা দেখলে মা, বাবা এবং বড় ভাই নরকে যান। যে ব্রাহ্মণ অজ্ঞানতাবশত অন্ধ হয়ে সেই কন্যাকে বিয়ে করেন, তিনি সম্ভাষণের অযোগ্য, তাঁর সঙ্গে এক পাতে বসে ভোজন করতে নেই।
সেকালে মেয়েরা মায়ের কোল থেকে নামতে না নামতে শুরু হয়ে যেত দৌড়াদৌড়ি–কার আগে কে মেয়েকে বলিদান করতে পারেন।
একালে বলিদান কমেছে এই কথা গত এক মাসে দেশের পঁচিশটা গ্রাম ঘুরে না এলে আমিও হয়ত বিশ্বাস করতাম। একেবারে পাঁচ ছয় বছর না হােক বারো থেকে পনেরো বছরের অধিকাংশ মেয়েকেই আমি বিবাহিত দেখেছি। সতীদাহর চেয়ে এই বাল্যদাহ কম মারাত্মক নয়।
সেকালে এবং একালে সময়ের শুধু দীর্ঘ ব্যবধানই দেখি, সংস্কারের এক তিল ব্যবধান দেখি না।
৪. নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজ তাকে নারীত্বের নানা কলাকৌশল শিখিয়েছে। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ যে সমাজে এই পুঁথিকাব্য রচিত হয়— পতিভক্তি কর সদা থাকিতে জীবন।
পতিভক্তি সতী সাধণী করে প্রাণপণ।।
সতী সাধ্বী অবলার এইত ধরম।
পতিকে সেবিয়া করে সার্থক জীবন।।
পতি সেবা রমণীর আদরের ধন।
লভিয়ে সে ধন করে সার্থক জীবন।।
সতীর লক্ষণ ইহা জানিতে একীনে।
জানে না সে আর কিছু পতি সেবা বিনে।।
শয়নে স্বপনে ধ্যানে আর জাগরণে।
জীবন সার্থক করে পতির চরণে।।
কেমনে উজ্জ্বল হবে পতির সংসার।
দিবানিশি এ ভাবনা অন্তরে তাহার।।
পতির আনন্দ ছাড়া শান্তি নাহি চায়।
সতীর মরম ব্যথা পতির ব্যথায়।।
পতির সুখেতে সুখী দুঃখেতে দুঃখিনী।
পতির সোহাগে কাটে দিবস রজনী।।
সাধ্যের অতীত চাপ পতিকে না দেয়।
যাহা কিছু দেয় পতি খুশি মনে নেয়।।
পতি-হিতে পতি স্বার্থে নশ্বর জীবন।
বিলাইয়া দেয় সদা করি সম্ভাষণ।।
এবং এ জাতীয় গাথাই ঘরে ঘরে তুমুল জনপ্রিয় হয়। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজের নীতি ও নিয়মের কাঁধ খামচে ধরে তলপেটে কষে দুটো লাথি দিতে গেলে হই রই করে তেড়ে আসে সাত কোটি বুনো ষাঁড়। নারী তো এই সমাজেরই মানুষ, যে সমাজে অতঃপর হাত-পা-মাথা গুটিয়ে তাকে শামুকের মত সামাজিক খোলসে আবৃত হতে হয়।