1 of 2

২৪. মেয়েদের পরিচয়

নির্বাচিত কলাম – মেয়েদের পরিচয়

১. এই শহরে আমি একটি ঘর খুঁজছি। রাতে ঘুমোবার একটি ঘর। এই শহরের একটি হাসপাতালে নটা পাঁচটা কাজ করে আমার ক্লান্ত পা যখন যেতে চায় একটি গন্তব্যে, আমার অবসন্ন শরীর যখন একটি আশ্রয় চায়—তখন হন্যে হয়ে একটি ঘর খুঁজতে হয় আমাকে। যে ঘরে অতীত ভবিষ্যৎ না ভেবে এমন কিছু করতে পারি যা আমার ইচ্ছে করে—যেন আমি গা খুলে স্নান করতে পারি, গলা ছেড়ে গান গাইতে পারি, অথবা নিজের বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে চমৎকার একটি কবিতা লিখতে পারি। অথচ এখন আমার সারা শহরে সামান্য একটু জায়গা খুঁজে বেড়াতে হয় বসবার, কারও সঙ্গে কথা বলবার। এ অদি আমার চেনাজানা এমন কেউ বাদ নেই যাকে বলিনি আমার জন্য একটি ঘর খুঁজতে। এত অল্প বেতনের চাকরি করি, আমার পক্ষে দুতিনটে ঘর ভাড়া নিয়ে একটিতে শোব, একটিতে খাব, একটিতে বসব—এমন সম্ভব নয়। যদিও ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্নের ভেতরে একটি বাড়ি সাজাই—খুব সুন্দর একটি বাড়ি।

আমি মোট পঁচিশজনকে বলেছিলাম একটি ঘর খুঁজতে। পঁচিশজনের মধ্যে বিশজনই আমার সঙ্গে আর দেখা করেনি। পাঁচজন জানিয়েছে বাড়ি ভাড়া আজকাল খুব বেড়ে গেছে, মহল্লায় টাউট-বাটপারের সংখ্যা খুব বেশি।

আমি নিজে সেদিন অন্তত ছ’টি বাড়িতে গিয়েছি। সকলেই জিজ্ঞেস করেছে পরিবারের সদস্য ক’জন। আমি বলেছি আমি এবং আমার সঙ্গে এগারো বছরের একটি মেয়ে, লিলি–ও আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। ছিমছাম মানুষ, কোনও বুট-ঝামেলা নেই, বাড়িঅলাদের খুশি হওয়ার কথা, অথচ তারা খুশি হয় না। তারা আরও কিছু যেন চায়। তাদের আরও একজন কাউকে দরকার হয়। নিঝঞ্ছাট একটি ভাড়াটে তারা মোটেও পছন্দ করেন না। আসলে তাদের দরকার একজন পুরুষলোকের। আমার সঙ্গে যেন-তেন একটি পুরুষলোক হলেই বাড়িঅলা খুশি। পুরুষলোকের যদি আমার কোনও প্রয়োজন না থাকে, যদি পুরুষলোক দ্বারা আমার স্নায়ুর অত্যাচার হয়, তবে ? আমার না হোক, পুরুষলোক বাড়িঅলার প্রয়োজন, সমাজের বাঘা বাঘা লোকের জন্য প্রয়োজন।

এই ঢাকা শহরে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে আমার দিন কাটাতে হয়। আমার কোনও নিজস্ব ঘর নেই। যে ঘরে আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারব, যে ঘরে আমার বাবা এসে আমাকে পাশে নিয়ে পুরনো দিনের গল্প করবে, যে ঘরে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বোন গেয়ে উঠবে—‘এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয় হরণ’, যে ঘরে আমার দাদা হঠাৎ এসে বলবে—‘আজ সারাদিন তোর ঘরে ঘুমোব, আজ আমার মন ভাল নেই।’

ভার্জিনিয়া উল্‌ফের ‘A Room of One’s Own’ বইটি পড়তে পড়তে আমার রাত কাটে। ওতে লেখা—‘নারী সমাজের পশ্চাৎপদতা এবং অক্ষমতার জন্য দায়ী হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, মহিলা লেখককে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তাকে অবশ্যই পুরুষশাসিত সমাজের শক্তিশালী পুরুষের শোষণ, কুসংস্কার ও অর্থনৈতিক স্বার্থপরতার মত দুর্বার প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। ন্যূনতম পক্ষে একান্ত নিজস্ব একটা ঘর শুধুমাত্র এই অবস্থা থেকে নারীকে মুক্ত করতে পারবে—এই ঘরের চাবিটা তার হাতেই থাকবে এবং ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে তার স্বাধীনতা থাকবে তার সহোদর ভাইদের যেমন তাদের ঘরে বিচরণের স্বাধীনতা আছে, তারই সমতুল্য।’

২. সেদিন এক অনুষ্ঠানে আমার পাশে এসে বসলেন এক মহিলা, আমার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, পরিচয়ের জন্য স্বাভাবিকভাবেই কিছু কথাবার্তার প্রয়োজন হয়। তিনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, যেমন—১। আপনার স্বামী কী করেন ? ২। আপনার স্বামীর নাম কী ? ৩। স্বামীর পদবী কী ? ৪। স্বামীর বাড়ি কোথায় ? ৫। স্বামীর ভাই-বোন ক’জন ? ৬। ভাইরা কী করে ? ৭। বোনদের বিয়ে হয়েছে কি না ? ৮। তাদের সন্তান ক’জন এবং কেউ কোথাও পড়াশোনা করে কি না আর পড়াশোনা করলে কে কোথায় পড়ছে? ৯। ভগ্নিপতিরা কে কী করে ? ১০ স্বামীর বাবা কোথায় কী করছেন? ১১। স্বামীর পদোন্নতির সম্ভাবনা আছে কি না ? ১২। স্বামীর কাকারা কে কোথায় কী করছে ? ১৩। স্বামীর মামারা কে কোথায় কী অবস্থানে আছে ? ১৪। স্বামীর খালা ও ফুপারা বিয়ের পর কে কোথায় কেমন আছে ? ১৫। স্বামীর মাসোহরা কত ? ১৬। স্বামী এই অনুষ্ঠানে আসেনি কেন ? ১৭। তার কোথাও কী কোনও কাজ আছে কী নেই? ১৮। স্বামীর স্বাস্থ্য ভাল না খারাপ ? ১৯। স্বামী সাধারণত কী খেতে পছন্দ করে? ২০। স্বামী কি দুপুরে ঘুমোয় ? ২১। স্বামী রাত কটা পর্যন্ত জেগে থাকে ২২। স্বামীর মেজাজ-মর্জির অবস্থা কেমন? ২৩। স্বামী কী ধরনের গান পছন্দ করে ? ২৪। স্বামী টিভির কোন অনুষ্ঠান দেখতে ভালবাসে ? ২৫। স্বামী সাধারণত কী ধরনের পোশাক পরে ?

প্রায় দেড় ঘণ্টা তার নানা প্রশ্নের উত্তর দেবার পর তিনি সন্তুষ্ট হলেন যে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল। কিন্তু পাঠক, আমাকে বিশ্বাস করুন আমি এক বর্ণ বানিয়ে বলছি না—সেই মহিলা আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি আমি কে, আমার বাড়ি কোথায়, আমার বাবা-মা কে, আমি কী কাজ করি, আমার নামই বা কী। যে মহিলা আমার সঙ্গে পুরো দেড় ঘণ্টা কথা বললেন তিনি আমার নাম পর্যন্ত জানেন না অথচ তিনি বড় পরিতৃপ্ত যে আমার সঙ্গে তিনি পরিচয় পর্ব সারলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *