পরিশিষ্ট

দুষ্টচক্র

দুষ্টচক্র

ডাক্তার সুরেশ রক্ষিত বলিলেন, ‘আপনাকে একবার যেতেই হবে, ব্যোমকেশবাবু। রোগীর যেরকম অবস্থা, আপনি গিয়ে আশ্বাস না দিলে বাঁচানো শক্ত হবে।’

ডাক্তার সুরেশ রক্ষিতের বয়স চল্লিশের আশেপাশে, একটু রোগা শুষ্ক গোছের চেহারা, দামী এবং নূতন বিলাতি পোশাক তাঁহার গায়ে যেন মানায় নাই। কিন্তু ভাবভঙ্গী বেশ চটপটে এবং বুদ্ধিমানের মত। আজ সকালে তিনি ব্যোমকেশের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন এবং এক বিচিত্র প্রস্তাব করিয়াছেন।

বলা বাহুল্য, ব্যোমকেশের রোগী দেখিতে যাইবার ইচ্ছা নাই। সে অর্ধ-নিমীলিত নেত্রে ডাক্তার রক্ষিতের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘রোগটা কি?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘প্যারালিসিস— মানে পক্ষাঘাত। প্রায় তিন মাস আগে অ্যাটাক হয়েছিল। প্রথম ধাক্কাটা সামলে গেছেন, কিন্তু রক্তচাপ খুব বেশি। মাথাটা অবশ্য পরিষ্কার আছে। আমাকে পাঠালেন, আপনি যদি দয়া করে একবার আসেন। মনে ভরসা পেলে হয়তো বেঁচে যেতে পারেন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি চিকিৎসা করছেন?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তাঁর বাড়ির একতলার ভাড়াটে। এবং গৃহ-চিকিৎসকও। লোকটি মহা ধনী, সুদের কারবার করেন। বিশু পালের নাম হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি নাম বললেন— শিশুপাল?’

ডাক্তার হাসিলেন, ‘বিশু পাল। তবে কেউ কেউ শিশুপালও বলে। কেন বলে জানি না, লোকটি সুদখোর মহাজন বটে কিন্তু অর্থ-পিশাচ নয়। বিশেষত গত তিন মাস শয্যাশায়ী থেকে একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু আমি কি করতে পারি? আমি তো আর ডাক্তার নই।’

ডাক্তার কহিলেন, ‘তবে আসল কথা বলি। বিশু পালের এক খাতক আছে, নাম অভয় ঘোষাল। লোকটা ভয়ঙ্কর পাজি। বিপদে পড়ে বিশু পালের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিল, এখন আর শোধ দিচ্ছে না। বিশু পাল জোর তাগাদা লাগিয়েছিলেন, তাইতে অভয় ঘোষাল নাকি ভয় দেখিয়েছে, টাকা চাইলে তাঁকে খুন করবে। তারপরই বিশু পালের স্ট্রোক হয়, সেই থেকে তিন মাস বিছানায় পড়ে আছেন। অবশ্য প্রাণের আশঙ্কা নেই, সাবধানে চিকিৎসা করলে হয়তো আবার চলে ফিরে বেড়াতে পারবেন। কিন্তু আসল কথা তা নয়, ওঁর প্রাণে ভয় ঢুকেছে অভয় ঘোষাল ওঁকে খুন করবেই, তিনি যদি টাকা ছেড়েও দেন তবু খুন করবে। —আপনাকে চিকিৎসা করতে হবে না, বিশু পালের ইচ্ছে আপনার কাছে তাঁর হৃদয়-ভার লাঘব করেন; আপনি যদি কিছু উপদেশ দেন তাও তাঁর কাজে লাগতে পারে।’

ব্যোমকেশ একটু বিমনা থাকিয়া বলিল, ‘কেউ যদি শিশুপাল বধের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে তাকে ঠেকিয়ে রাখা শিবের অসাধ্য। যাহোক, ভদ্রলোক যখন আমার সঙ্গলাভের জন্যে এত ব্যাকুল হয়েছেন তখন আমি যাব। ইহলোকেই হোক আর পরলোকেই হোক, মহাজনদের হাতে রাখা ভালো। কি বল, অজিত?’

আমি বলিলাম, ‘তা তো বটেই।’

ডাক্তার রক্ষিত উঠিয়া দাঁড়াইলেন, হাসিমুখে বলিলেন, ‘ধন্যবাদ। এই নিন আমাদের ঠিকানা। কখন আসবেন?’ তিনি একটি কার্ড বাহির করিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিলেন।

ব্যোমকেশ কার্ডটি দেখিয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিল। দেখিলাম বিশু পালের বাসস্থান বেশি দূর নয়, আমহার্স্ট স্ট্রীটের একটা গলির মধ্যে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ বিকেলবেলা পাঁচটা নাগাদ যাব। —আচ্ছা, আসুন।’

ডাক্তার প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগীকে সান্ত্বনা দেবার কাজ আমার এই প্রথম।’

গলিটি বিসর্পিল; নানা ভঙ্গীতে আঁকিয়া বাঁকিয়া পার্বত্য নদীর মত চলিয়াছে। দুই পাশে তিনতলা চারতলা বাড়ি। গলি যতই সরু হোক, দেখিয়াছি বাড়ি কখনও ছোট হয় না, আড়ে বাড়িবার জায়গা না পাইয়া দীঘে বাড়ে।

একটি তেতলা বাড়ির দ্বারপার্শ্বে ডাক্তার সুরেশ রক্ষিতের শিলালিপি দেখিয়া বুঝিলাম এই বিশু পালের বাড়ি। ডাক্তার রক্ষিত জানালা দিয়া আমাদের দেখিতে পাইয়া বাহির হইয়া আসিলেন, বলিলেন, ‘আসুন।’

বাড়িটি পুরানো ধরনের; এক পাশে সুড়ঙ্গের মত সঙ্কীর্ণ বারান্দা ভিতর দিকে চলিয়া গিয়াছে, তাহার এক পাশে দ্বার, অন্য পাশে দু’টি জানালা। দ্বার দিয়া ডাক্তারখানা দেখা যাইতেছে; তক্‌তকে ঝক্‌ঝকে একটি ঘর। কিন্তু রোগীর ভিড় নাই। একজন মধ্যবয়স্ক কম্পাউন্ডার দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া আছে। ডাক্তার রক্ষিত আমাদের ডাক্তারখানায় লইয়া গেলেন না, বলিলেন, ‘সিঁড়ি ভাঙতে হবে। বিশুবাবু তিনতলায় থাকেন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ তো। আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন? না কেবলই ডাক্তারখানা?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘তিনটে ঘর আছে। দুটোতে ডাক্তারখানা করেছি, একটাতে থাকি। একলা মানুষ, অসুবিধা হয় না।’

দোতলাতেও তিনটি ঘর। ঘর তিনটিতে অফিস বসিয়াছে। টেবিল চেয়ারের অফিস নয়, মাড়োয়ারীদের মত গদি পাতিয়া অফিস। অনেকগুলি কেরানি বসিয়া কলম পিষিতেছে।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এটা কি?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘বিশুবাবুর গদি। মস্ত কারবার, অনেক রাজা-রাজড়ার টিকি বাঁধা আছে ওঁর কাছে।’

ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। আমি মনে মনে ভাবিলাম, বিশু পাল শুধু শিশুপালই নয়, জরাসন্ধও বটে।

তেতলার সিঁড়ির মাথায় একটি গুর্খা রণসাজে সজ্জিত হইয়া গাদা-বন্দুক হস্তে টুলের উপর বসিয়া আছে; পদশব্দ শুনিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং আমাদের পানে তির্যক নেত্রপাত করিল। ডাক্তার বলিলেন, ‘ঠিক হ্যায়।’ তখন গুর্খা স্যালুট করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।

বারান্দা দিয়া কয়েক পা যাইবার পর একটি বন্ধ দ্বার। ডাক্তার দ্বারে টোকা দিলেন। ভিতর হইতে নারীকণ্ঠে প্রশ্ন আসিল, ‘কে?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘আমি ডাক্তার রক্ষিত। দোর খুলুন।’

দরজা একটু ফাঁক হইল। একটি প্রৌঢ়া সধবা মহিলার শীর্ণ মুখ ও আতঙ্কভরা চক্ষু দেখিতে পাইলাম। তিনি একে একে আমাদের তিনজনের মুখ দেখিয়া বোধহয় আশ্বস্ত হইলেন, দ্বার পুরাপুরি খুলিয়া গেল। আমরা একটি ছায়াচ্ছন্ন ঘরে প্রবেশ করিলাম।

পুরুষ কণ্ঠে শব্দ হইল, ‘আলোটা জ্বেলে দাও গিন্নি।’

মহিলাটি সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালিয়া দিলেন, তারপর মাথায় আঁচল টানিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন।

এইবার ঘরটি স্পষ্টভাবে দেখিলাম। মধ্যমাকৃতি ঘর, মাঝখানে একটি খাট। খাটের উপর প্রেতাকৃতি একটি মানুষ গায়ে বালাপোশ জড়াইয়া শুইয়া আছে। খাটের পাশে একটি ছোট টেবিলের উপর ওষুধের শিশি জলের গেলাস প্রভৃতি রাখা আছে। ঘরে অন্যান্য আসবাব যাহা আছে তাহা দেখিয়া নার্সিং হোমে রোগীর কক্ষ স্মরণ হইয়া যায়।

প্রেতাকৃতি লোকটি অবশ্য বিশু পাল। জীর্ণগলিত মুখে নিষ্প্রভ দু’টি চক্ষু মেলিয়া তিনি আমাদের পানে চাহিয়া আছেন। মাথার চুল পাঁশুটে সাদা, সম্মুখের দাঁতের অভাবে অধরোষ্ঠ অন্তঃপ্রবিষ্ট হইয়াছে। বয়স পঞ্চাশ কিম্বা ষাট কিম্বা সত্তর পর্যন্ত হইতে পারে। তিনি স্খলিত স্বরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু এসেছেন? আমার কী সৌভাগ্য। আসতে আজ্ঞা হোক।’

আমরা খাটের কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। বিশু পাল কম্পিত হস্ত জোড় করিয়া বলিলেন, ‘আপনাদের বড় কষ্ট দিয়েছি। আমারই যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দেখছেন তো আমার অবস্থা—’

ডাক্তার বলিলেন, ‘আপনি বেশি কথা বলবেন না।’

বিশু পাল কাতর কণ্ঠে বলিলেন, ‘বেশি কথা না বললে চলবে কি করে ডাক্তার? ব্যোমকেশবাবুকে সব কথা বলতে হবে না?’

‘তবে যা বলবেন চটপট বলে নিন। ডাক্তার টেবিল হইতে একটি শিশি লইয়া খানিকটা তরল ঔষধ গেলাসে ঢালিলেন, তাহাতে একটু জল মিশাইয়া বিশু পালের দিকে বাড়াইয়া দিলেন, বলিলেন, ‘এই নিন, এটা আগে খেয়ে ফেলুন।’

বিশু পাল রুগ্ন বিরক্তিভরা মুখে ঔষধ গলাধঃকরণ করিলেন।

অতঃপর অপেক্ষাকৃত সহজ স্বরে তিনি বলিলেন, ‘ডাক্তার, এঁদের বসবার চেয়ার দাও।’

ডাক্তার দু’টি চেয়ার খাটের পাশে টানিয়া আনিলেন, আমরা বসিলাম। বিশু পাল ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘বেশি কথা বলব না, ডাক্তার রাগ করবে। সাঁটে বলছি। আমার তেজারতি কারবার আছে, নিশ্চয় শুনেছেন। প্রায় পঁচিশ বছরের কারবার, বিশ লক্ষ টাকা খাটছে। অনেক বড় বড় খাতক আছে।

‘আমি কখনো জামিন জামানত না রেখে টাকা ধার দিই না। কিন্তু বছর দুই আগে আমার দুর্বুদ্ধি হয়েছিল, তার ফল এখন ভুগছি। বিনা জামিনে ত্রিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম।

‘অভয় ঘোষালকে আপনি চেনেন না। আমি তার বাপকে চিনতাম, মহাশয় ব্যক্তি ছিলেন অধর ঘোষাল। অনেক বিষয়-সম্পত্তি করেছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কাজ-কারবারও হয়েছিল। তাই তাঁকে চিনতাম; সত্যিকার সজ্জন।

‘বছর দশেক আগে অধর ঘোষাল মারা গেলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে অভয় ঘোষাল বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে বসল।

‘অভয়কে আমি তখনো দেখিনি। বাপ মারা যাবার পর তার সম্বন্ধে দু’-একটা গল্পগুজব কানে আসত। ভাবতাম পৈতৃক সম্পত্তি হাতে পেলে সব ছেলেই গোড়ায় একটু উচ্ছৃঙ্খলতা করে, কালে শুধরে যাবে। এমন তো কতই দেখা যায়।

‘আজ থেকে বছর দুই আগের ব্যাপার। অভয় ঘোষালের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছি, হঠাৎ একদিন সে এসে উপস্থিত। তাকে দেখে, তার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কার্তিকের মত চেহারা, মুখে মধু ঝরে পড়ছে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, তার বাবা আমার বন্ধু ছিলেন, তাই সে বিপদে পড়ে আগে আমার কাছেই এসেছে। বড় বিপদ তার, শত্রুরা তাকে মিথ্যে খুনের মামলায় ফাঁসিয়েছে। কোনো মতে জামিন পেয়ে সে আমার কাছে ছুটে এসেছে, মামলা চালাবার জন্যে তার ত্রিশ হাজার টাকা চাই!

‘বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি বিশু পাল বিনা জামানতে শুধু হ্যান্ডনোট লিখিয়ে নিয়ে তাকে ত্রিশ হাজার টাকা দিলাম। ছোঁড়া আমাকে গুণ করেছিল, মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল।

‘যথাসময়ে আদালতে খুনের মামলা আরম্ভ হল। খবরের কাগজে বয়ান বেরুতে লাগল; সে এক মহাভারত। এমন দুষ্কর্ম নেই যা অভয় ঘোষাল করেনি, পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি প্রায় সবই উড়িয়ে দিয়েছে। কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার হিসেব নেই। একটি বিবাহিতা যুবতীকে ফুসলে নিয়ে এসেছিল, তারপর বছরখানেক পরে তাকে বিষ খাইয়ে খুন করেছে। তাইতে মোকদ্দমা। আমি একদিন এজলাসে দেখতে গিয়েছিলাম; কাঠগড়ায় অভয় ঘোষাল বসে আছে, যেন কোণ-ঠাসা বন-বেরাল! দেখলেই ভয় করে। ও বাবা, এ কাকে টাকা ধার দিয়েছি!

‘কিন্তু মোকদ্দমা টিকলো না, আইনের ফাঁকিতে অভয় ঘোষাল রেহাই পেয়ে গেল। একেবারে বেকসুর খালাস। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রমাণ হল না।

‘তারপর আরো বছরখানেক কেটে গেল। আমি অভয় ঘোষালের ওপর নজর রেখেছিলাম, খবর পেলাম সে তার বসত-বাড়ি বিক্রি করবার চেষ্টা করছে। এইটে তার শেষ স্থাবর সম্পত্তি, এটা যদি সে বিক্রি করে দেয়, তাহলে তাকে ধরবার আর কিছু থাকবে না, আমার টাকা মারা যাবে।

‘টাকার তাগাদা আরম্ভ করলাম। প্রথমে অফিস থেকে চিঠি দিলাম, কোন জবাব নেই। বার তিনেক চিঠি দিয়েও যখন সাড়া পেলাম না, তখন আমি নিজেই একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমরা মহাজনেরা দরকার হলে বেশ আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলতে পারি, ভাবলাম মামলা রুজু করবার আগে তাকে কথা শুনিয়ে আসি, তাতে যদি কাজ হয়। সে আজ তিন মাস আগেকার কথা।

‘একটা গুর্খাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম তার বাড়িতে। সামনের ঘরে একটা চেয়ারে অভয় ঘোষাল একলা বসে ছিল। আমাকে দেখে সে চেয়ার থেকে উঠল না, কথা কইল না, কেবল আমার মুখের পানে চেয়ে রইল।

‘কাজের সময় কাজী কাজ ফুরোলে পাজি। গালাগালি দিতে এসেছিলাম, তার ওপর রাগ হয়ে গেল। আমি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে তার চৌদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করলাম। তারপর হঠাৎ নজর পড়ল তার চোখের ওপর। ওরে বাবা, সে কী ভয়ঙ্কর চোখ। লোকটা কথা কইছে না, কিন্তু তার চোখ দেখে বোঝা যায় যে সে আমাকে খুন করবে। যে-লোক একবার খুন করে বেঁচে গেছে, তার তো আশকারা বেড়ে গেছে। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল।

‘আর সেখানে দাঁড়ালাম না, ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরে সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরল, কিছুতেই কাঁপুনি থামে না। তখন ডাক্তারকে ডেকে পাঠালাম। ডাক্তার এসে কোনো মতে ওষুধ দিয়ে কাঁপুনি থামালো। তখনকার মত সামলে গেলাম বটে, কিন্তু শেষ রাত্রির দিকে আবার কাঁপুনি শুরু হল। তখন বড় ডাক্তার ডাকানো হল; তিনি এসে দেখলেন স্ট্রোক হয়েছে, দুটো পা অসাড় হয়ে গেছে।

‘তারপর থেকে বিছানায় পড়ে আছি। কিন্তু প্রাণে শান্তি নেই। ডাক্তারেরা ভরসা দিয়েছেন রোগে মরব না, তবু মৃত্যুভয় যাচ্ছে না। অভয় ঘোষাল আমাকে ছাড়বে না। আমি বাড়ি থেকে বেরুই না, দোরের সামনে গুর্খা বসিয়েছি, তবু ভরসা পাচ্ছি না। —এখন বলুন ব্যোমকেশবাবু, আমার কি উপায় হবে।’

বিবরণ শেষ করিয়া বিশু পাল অর্ধমৃত অবস্থায় বিছানায় পড়িয়া রহিলেন। ডাক্তার একবার তাঁহার কব্জি টিপিয়া নাড়ি দেখিলেন, কিন্তু ঔষধ দিবার প্রয়োজন বোধ করিলেন না। ব্যোমকেশ গভীর ভ্রূকুটি করিয়া নতমুখে বসিয়া রহিল।

এই সময় বিশু পালের স্ত্রী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মাথায় আধ-ঘোমটা, দুই হাতে দু’-পেয়ালা চা। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম, তিনি আমাদের হাতে চায়ের পেয়ালা দিয়া স্বামীর প্রতি ব্যগ্র উৎকণ্ঠার দৃষ্টি হানিয়া প্রস্থান করিলেন। নীরব প্রকৃতির মহিলা, কথাবার্তা বলেন না।

আমরা আবার বসিলাম। দেখিলাম বিশু পাল সপ্রশ্ন নেত্রে ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া আছেন।

ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় ক্ষুদ্র একটি চুমুক দিয়া বলিল, ‘আপনি যথাসাধ্য সাবধান হয়েছেন, আর কি করবার আছে। খাবারের ব্যবস্থা কি রকম?’

বিশু পাল বলিলেন, ‘একটা বামুন ছিল তাকে বিদেয় করে দিয়েছি। গিন্নি রাঁধেন। বাজার থেকে কোনো খাবার আসে না।’

‘চাকর-বাকর?’

‘একটা ঝি আর একটা চাকর ছিল, তাদের তাড়িয়েছি। সিঁড়ির মুখে গুর্খা বসিয়েছি। আর কি করব বলুন।’

‘ব্যবসার কাজকর্ম চলছে কি করে?’

‘সেরেস্তাদার কাজ চালায়। নেহাৎ দরকার হলে ওপরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে যায়। কিন্তু তাকেও ঘরে ঢুকতে দিই না, দোরের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলে যায়। বাইরের লোক ঘরে আসে কেবল ডাক্তার।’

চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, হাসিয়া বলিল, ‘যা-যা করা দরকার সবই আপনি করেছেন, আর কী করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু সত্যিই কি অভয় ঘোষাল আপনাকে খুন করতে চায়?’

বিশু পাল উত্তেজিতভাবে উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিয়া আবার শুইয়া পড়িলেন, ব্যাকুল স্বরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু, আমার অন্তরাত্মা বুঝেছে ও আমাকে খুন করতে চায়। নইলে এত ভয় পাব কেন বলুন! কলকাতা শহর তো মগের মুল্লুক নয়।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা বটে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’

বিশু পাল বলিলেন, ‘সেই তো ভাবনা, এভাবে কতদিন চলবে। তাই তো আপনার শরণ নিয়েছি, ব্যোমকেশবাবু। আপনি একটা ব্যবস্থা করুন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভেবে দেখব। যদি কিছু মনে আসে, আপনাকে জানাব। —আচ্ছা, চলি।’

বিশু পাল বলিলেন, ‘ডাক্তার!’

ডাক্তার রক্ষিত অমনি পকেট হইতে একটি একশো টাকার নোট বাহির করিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে ধরিলেন। ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া বলিল, ‘এটা কি?’

বিশু পাল বিছানা হইতে বলিলেন, ‘আপনার মর্যাদা। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, অনেক সময় নষ্ট করেছি।’

‘কিন্তু এ রকম তো কোনো কথা ছিল না।’

‘তা হোক। আপনাকে নিতে হবে।’

অনিচ্ছাভরে ব্যোমকেশ টাকা লইল। তারপর ডাক্তার আমাদের নীচে লইয়া চলিলেন।

সিঁড়ির মুখে গুর্খা স্যালুট করিল। সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই লোকটা সারাক্ষণ পাহারা দেয়?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘না, ওরা দু’জন আছে। পুরোনো লোক, আগে দোতলায় পাহারা দিত। একজন বেলা দশটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত থাকে, দ্বিতীয় ব্যক্তি রাত্রি দশটা থেকে বেলা আটটা পর্যন্ত পাহারা দেয়।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘সকালে দু’-ঘণ্টা এবং রাত্রে দু’-ঘণ্টা পাহারা থাকে না?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘না, সে-সময় আমি থাকি।’

দ্বিতলে নামিয়া দেখিলাম দপ্তর বন্ধ হইয়া গিয়াছে, কেরানিরা দ্বারে তালা লাগাইয়া বাড়ি গিয়াছে।

নীচের তলায় নামিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাকে দু’-একটা প্রশ্ন করতে চাই, ডাক্তারবাবু।’

‘বেশ তো, আসুন আমার ডিসপেন্সারিতে।’

আমরা সামনের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি রোগীদের ওয়েটিং রুম, নূতন টেবিল চেয়ার বেঞ্চি ইত্যাদিতে সাজানো গোছানো। কম্পাউন্ডার পাশের দিকের একটি বেঞ্চিতে এক হাঁটু তুলিয়া বসিয়া ঢুলিতেছিল, আমাদের দেখিয়া পাশের ঘরে উঠিয়া গেল। ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল, ‘খাসা ডাক্তারখানা সাজিয়েছেন।’

ডাক্তার শুষ্ক স্বরে বলিলেন, ‘সাজিয়ে রাখতে হয়: জানেন তো, ভেক না হলে ভিখ্‌ মেলে না।’

‘কতদিনের প্র্যাকটিস আপনার?’

‘এখানে বছর তিনেক আছি, তার আগে মফঃস্বলে ছিলাম।’

‘ভালই চলছে মনে হয়— কেমন?’

‘মন্দ নয়— চলছে টুকটাক করে। দু’-চারটে বাঁধা ঘর আছে। সম্প্রতি পসার কিছু বেড়েছে। বিশুবাবুকে যদি সারিয়ে তুলতে পারি—’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল, ‘হ্যাঁ। —আচ্ছা ডাক্তারবাবু, বিশু পালের এই যে মৃত্যুভয়, এটা কি ওঁর মনের রোগ? না সত্যিই ভয়ের কারণ আছে?’

ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘ভয়ের কারণ আছে। অবশ্য যাদের অনেক টাকা তাদের মৃত্যুভয় বেশি হয়। কিন্তু বিশু পালের ভয় অমূলক নয়। অভয় ঘোষাল লোকটা সত্যিকার খুনী। আমি শুনেছি ও গোটা তিনেক খুন করেছে। এমন কি ও নিজের বাপকে বিষ খাইয়েছিল কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই নাকি! ভারি গুণধর ছেলে তো। এখন মনে পড়ছে বছর দুই আগে ওর মামলার বয়ান খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। ওর ঠিকানা আপনি জানেন নাকি?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘জানি। এই তো কাছেই, বড়জোর মাইলখানেক। যদি দেখা করতে চান ঠিকানা দিচ্ছি।’

এক টুকরা কাগজে ঠিকানা লিখিয়া ডাক্তার ব্যোমকেশকে দিলেন, সে সেটি মুড়িয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে বলিল, ‘আর একটা কথা। বিশুবাবুর স্ত্রীর কি কোনো রোগ আছে?’

ডাক্তার বলিলেন, ‘স্নায়ুর রোগ। স্নায়বিক প্রকৃতির মহিলা, তার ওপর ছেলেপুলে হয়নি—’

‘বুঝেছি। — আচ্ছা, চললাম। বিশুবাবু একশো টাকা দিয়ে আমাকে দায়ে ফেলেছেন। তাঁর সমস্যাটা ভেবে দেখব।’

বাহিরে তখন, রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘সাড়ে ছ’টা। চল, খুনি আসামী দর্শন করে যাওয়া যাক। বিশু পাল যখন টাকা দিয়েছেন, তখন কিছু তো করা দরকার।’

মোড়ের মাথায় একটা রিক্‌শা পাওয়া গেল, তাহাতে চড়িয়া আমরা উত্তর দিকে চলিলাম। লক্ষ্য করিয়াছি, আমহার্স্ট স্ট্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আশেপাশে সামনে পিছনে যখন জোয়ারের সমুদ্রের মত জনস্রোত ছুটিয়াছে, তখনও আমহার্স্ট স্ট্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আমহার্স্ট স্ট্রীট সমুদ্রের সমান্তরাল সঙ্কীর্ণ খালের মত নিস্তরঙ্গ পড়িয়া আছে।

রাস্তায় উত্তর প্রান্তে আসিয়া একটি নম্বরের সামনে রিক্‌শা থামিল, আমরা নামিলাম। ব্যোমকেশ নম্বর মিলাইয়া বলিল, ‘এই বাড়ি।’

বাড়িটি ঠিক ফুটপাথের ধারে নয়, মাঝখানে একটু খোলা জমি আছে, তাহাতে কাঁঠালি চাঁপার ঝাড় বাড়িটিকে রাস্তা হইতে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। দ্বিতল বাড়ির উপরতলা অন্ধকার, নীচের একটা জানালা দিয়া পত্রান্তরাল ভেদ করিয়া ঝিকিমিকি আলো আসিতেছে।

আমরা ছোট ফটক দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

সামনের ঘর টেবিল চেয়ার দিয়া সাজানো, যেন অফিস ঘর। একটি লোক চেয়ারে বসিয়া অলসভাবে পেন্সিল দিয়া কাগজের উপর হিজিবিজি কাটিতেছে। আমরা দ্বারের কাছে আসিলে সে চোখ তুলিয়া চাহিল।

সুপুরুষ বটে। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, টক্‌টকে রঙ, কোঁকড়া চুলের মাঝখানে সিঁথি, নাক চোখ যেন তুলি দিয়া আঁকা। আমিও বিশু পালের মত মুগ্ধ হইয়া গেলাম।

ব্যোমকেশ দ্বারের নিকট হইতে বলিল, ‘আসতে পারি? আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী, ইনি অজিত বন্দ্যো।’

অভয় ঘোষালের চোখের দৃষ্টি সতর্ক। তারপর সে অধর প্রান্তে একটি মুকুলিত হাসি ফুটাইয়া বলিল, ‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী! কী সৌভাগ্য। আসুন।’

আমরা গিয়া অভয় ঘোষালের মুখোমুখি বসিলাম। সে পেন্সিল নামাইয়া রাখিয়া বলিল, ‘কি ব্যাপার বলুন দেখি। সম্প্রতি কোনো কু-কার্য করেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’

ব্যোমকেশ হাসিল, ‘আপনাকে দেখতে এলাম।’

অভয় ঘোষাল বলিল, ‘ধন্যবাদ! আমি তাহলে একটি দর্শনীয় জীব। আপনি নিজের ইচ্ছেয় এসেছেন, না কেউ পাঠিয়েছে?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘পাঠায়নি কেউ। কিন্তু মহাজন বিশু পাল তাঁর দুঃখের কথা আমাকে শোনালেন, তাই ভাবলাম আপনাকে দর্শন করে যাই।’

‘ও— শিশুপাল।’ অভয় ঘোষাল ক্ষণেক থামিয়া বলিল, ‘আপনাকে কেউ পাঠিয়েছে বুঝেছিলাম, কিন্তু শিশুপালের কথা মনে আসেনি।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘জানেন বোধ হয়, বিশু পালের পক্ষাঘাত হয়েছে।’

অভয় বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, ‘তাই নাকি; আমি জানতাম না। মাস তিনেক আগে শিশুপাল আমার বাড়িতে এসেছিল, আমাকে চৌদ্দ-পুরুষান্ত করে গেল। ভগবান আছেন।’ তাহার মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনো উষ্মা প্রকাশ পাইল না। পেন্সিলটা তুলিয়া লইয়া সে আবার কাগজে হিজিবিজি কাটিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখান থেকে ফিরে গিয়েই তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল। সেই থেকে তিনি নিজের বাড়ির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছেন। অবশ্য পক্ষাঘাতই তাঁর বাড়িতে আবদ্ধ থাকার একমাত্র কারণ নয়। আপনার ভয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হন না।’

‘আমার ভয়ে— বলেন কি! আমি খাতক, সে মহাজন, আমারই তার ভয়ে লুকিয়ে থাকার কথা।’ অভয় ঘোষাল ভ্রূ তুলিয়া পরম বিস্ময়ভরে কথাগুলি বলিল, কিন্তু তাহার অধর-প্রান্তে হাসি লাগিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাঁর ভয় হয়েছে আপনি তাঁকে খুন করবেন।’

‘এই দেখুন। যত দোষ নন্দ ঘোষ! আমি একটিবার খুনের মামলায় ফেঁসে গিয়েছিলাম, অমনি সবাই ভেবে নিলে আমি খুনী আসামী। আমি যে বেকসুর খালাস পেয়েছি সেটা কেউ ভাবল না।’ অভয় ঘোষাল একটু থামিয়া অপেক্ষাকৃত মন্থর কণ্ঠে বলিল, ‘তবে একটা কথা সত্যি। আমার কোষ্ঠীর ফল— যারা আমার শত্রুতা করে তারা বেশি দিন বাঁচে না। — উঠছেন নাকি?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘হ্যাঁ। আপনাকে দেখতে এসেছিলাম, দেখা হয়েছে। এবার যাওয়া যাক। —একটা কথা বলে যাই। বিশু পালের যদি অপঘাতে মৃত্যু হয় আমি খুব দুঃখিত হব। এবং আপনিও শেষ পর্যন্ত দুঃখিত হবেন।’

অভয় ঘোষালের মুখে হঠাৎ পরিবর্তন হইল। মুখের হাসি মুছিয়া গিয়া চোখে একটা নৃশংস হিংস্রতা ফুটিয়া উঠিল। সে নির্নিমেষ সর্প-চক্ষু মেলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল।

আমার বুকের একটা স্পন্দন থামিয়া গিয়া আবার সবেগে চলিতে আরম্ভ করিল। এই দৃষ্টি বিশু পালকে ভয়ে দিশাহারা করিয়াছিল। চোখের দৃষ্টিতে মৃত্যুর শপথ এত স্পষ্টভাবে আর কাহারো চোখে দেখি নাই।

ব্যোমকেশ তাহার প্রতি একটি অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, ‘চল অজিত।’

ফুটপাথে পৌঁছিয়া দেখিলাম, রাস্তায় পরপারে একটা ট্যাক্সি দাঁড়াইয়া আছে। ড্রাইভারকে ডাকিবার জন্য হাত তুলিয়াছি, ট্যাক্সিটা চলিতে আরম্ভ করিল, দ্রুত বেগ সংগ্রহ করিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

আমি ব্যোমকেশের পানে চাহিলাম। সে বিলীয়মান ট্যাক্সির দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘ভেতরে কেউ ছিল?’

বলিলাম, ‘দেখিনি। ড্রাইভারটা কিন্তু আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাই ভেবেছিলাম খালি ট্যাক্সি। হয়তো পিছনের সিটে কেউ ছিল।’

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ চলিতে আরম্ভ করিল, ‘কেউ বোধ হয় আমাদের পিছু নিয়েছিল।’

‘কে পিছু নিতে পারে?’

‘ডাক্তার রক্ষিত ছাড়া আর তো কেউ জানে না যে আমরা এখানে এসেছি।’

‘কিন্তু কেন? কী উদ্দেশ্য?’

‘তা জানি না। অবশ্য সমাপতনও হতে পারে। ট্যাক্সিতে আমাদের অজানা আরোহী ছিল, কোনো কারণে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল, তারপর চলে গেল।’

রাত্রি সাড়ে সাতটা। আমরা পদব্রজে বাসার দিকে চলিলাম। মনে কিন্তু একটা ধোঁকা লাগিয়া রহিল।

পরদিন সকালে খবরের কাগজ খুলিয়াই বলিয়া উঠিলাম, ‘ওহে—!’

ব্যোমকেশ চকিতে আমার দিকে ঘাড় ফিরাইল, ‘কী! বিশু পাল খুন হয়েছে?’

বলিলাম, ‘বিশু পাল নয়—অভয় ঘোষাল।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বোকার মত আমার মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর কাগজখানা আমার হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।

সংবাদপত্রের বিবরণ অতি সংক্ষিপ্ত। গত রাত্রে আমহার্স্ট স্ট্রীট নিবাসী অভয় ঘোষাল নামক এক ধনী ব্যক্তি ঘুমন্ত অবস্থায় শয্যায় খুন হইয়াছেন। পুলিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াছে; কে খুন করিয়াছে তাহা এখনো জানা যায় নাই। দুই বৎসর পূর্বে অভয় ঘোষাল খুনের অভিযোগে আসামী হইয়া বেকসুর খালাস হইয়াছিলেন। —

মনটা অন্য প্রকার সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত ছিল, তাই অনেকক্ষণ বিমূঢ় রহিলাম। কাল রাত্রি সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আমরা তাহাকে দেখিয়াছি, সে হাসিমুখে পরম স্বচ্ছন্দভাবে ব্যোমকেশের সহিত প্রচ্ছন্ন বাক্‌যুদ্ধ করিয়াছে। তারপর কী হইল? সে ব্যঙ্গভরে বলিয়াছিল, তাহার অনেক ‘বন্ধু’ আছে। ট্যাক্সিতে তবে কি তাহার ‘বন্ধু’ ওৎ পাতিয়া বসিয়া ছিল, আমরা চলিয়া যাইবার পর ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে খুন করিয়াছে? কিম্বা ট্যাক্সির লোকটি ডাক্তার রক্ষিত? কিন্তু ডাক্তার রক্ষিত তাহাকে খুন করিতে যাইবে কেন?

বেশি জল্পনা-কল্পনা করিবার আগেই দারোগা রমাপতিবাবু উপস্থিত হইলেন।

রমাপতিবাবুর সহিত কর্ম সম্পর্কে আমাদের ঘনিষ্ঠতা না থাকিলেও অল্প পরিচয় ছিল। কাজের লোক বলিয়া পুলিস বিভাগে তাঁহার সুনাম আছে। আমাদেরই সমবয়স্ক ব্যক্তি; মজবুত চেহারা, অমায়িক বাচনভঙ্গী, চোখের দৃষ্টি মর্মভেদী।

ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া তাঁহাকে বসাইল, বলিল, ‘কাগজে দেখলাম আপনার এলাকায় অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে।’

রমাপতিবাবু চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ‘আপনি অভয় ঘোষালকে চিনতেন?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘চিনতাম না, কাল সন্ধ্যেবেলা পরিচয় হয়েছিল। আমরা তার বাড়িতে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে?’

‘তাই নাকি! দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন?’

ব্যোমকেশ সহাস্যে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘আগে আপনি খবর বলুন, তারপর আমি বলব।’

রমাপতিবাবু ক্ষণেক ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, আমিই আগে বলছি। অভয় ঘোষালের ওপর অনেক দিন থেকে পুলিসের নজর ছিল। লোকটা ভদ্রতার মুখোশ পরে বেড়াতো, কিন্তু এত বড় শয়তান খুব কম দেখা যায়। কত ভদ্রঘরের মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। নিজের একটা স্ত্রী ছিল, হঠাৎ তার অপঘাত মৃত্যু হয়। তারপর এক ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে উধাও হয়েছিল; ভদ্রলোক স্ত্রীকে ডিভোর্স করেন। তখন স্ত্রীলোকটি বোধ হয় অভয়কে বিয়ে করার জন্যে বায়না ধরেছিল, অভয় তাকে বিষ খাইয়ে মারে।

‘অভয় ঘোষালকে পুলিস অ্যারেস্ট করল, মামলা কোর্টে উঠল। কিন্তু মামলা টিকল না, অভয়ের অপরাধ পাকাপাকি প্রমাণ হল না। ৩০২ ধারার মামলা, হয় এস্‌পার নয় ওস্‌পার, অভয় ঘোষাল ছাড়া পেয়ে গেল।

‘এই হল অভয় ঘোষালের ইতিহাস। কলকাতা শহরেই অন্তত দশজন লোক আছে যারা তাকে খুন করতে পারলে খুশি হয়।

‘কাল রাত্রে আন্দাজ বারোটার সময় অভয়ের বাড়ির চাকরানী থানায় এসে খবর দেয় যে অভয় খুন হয়েছে। আমি তখন থানায় ছিলাম না, খবর পেয়ে তদন্ত করতে গেলাম। অভয় ঘোষালের আর্থিক অবস্থা এখন পড়ে গেছে: বাড়িতে একলা থাকে, কেবল একটা কম-বয়সী চাকরানী দেখাশোনা করে। এই চাকরানীটাই থানায় খবর দিতে এসেছিল।

‘গিয়ে দেখলাম অভয় দোতলার ঘরে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে, তার পিঠের বাঁ দিকে গুনছুঁচের মত একটা শলা বিঁধে আছে। চাকরানীকে সওয়াল করে জানা গেল যে অভয় রাত্রি ন’টার সময় খাওয়া-দাওয়া করে শুতে গিয়েছিল; চাকরানী বাড়ির কাজকর্ম সেরে, নিজে খেয়ে, দোর জানলা বন্ধ করে অভয়ের ঘরে গিয়ে দেখল ইতিমধ্যে কেউ এসে অভয়কে খুন করে রেখে গেছে।

‘আমরা চাকরানীটাকে আটক করে রেখেছি, কিন্তু সে বোধ হয় খুন করেনি। কে খুন করেছে তাও জানা যাচ্ছে না। অভয়ের সঙ্গে যাদের শত্রুতা ছিল— মামলায় যারা অভয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল— তাদের সকলের অ্যালিবাই যাচাই করে দেখেছি, তারা কেউ নয় বলেই মনে হয়।

‘এই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি! এখন আপনি কি জানেন বলুন?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি যে কিছু জানি তা আপনি জানলেন কি করে?’

রামপতিবাবু পকেট হইতে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া ব্যোমকেশের দিকে বাড়াইয়া দিলেন, ‘এই কাগজের টুকরোটা নীচের তলায় অভয়ের বসবার ঘরে টেবিলের ওপর রাখা ছিল।’

গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, কাগজের উপর পেন্সিল দিয়া হিজিবিজি কাটা, তারপর লেখা আছে— ব্যোমকেশ বক্সী—শিশুপাল—। মনে পড়িয়া গেল কাল রাত্রে অভয় ঘোষাল আমাদের সামনে বসিয়া হিজিবিজি কাটিতেছিল।

রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘আপনার নাম দেখে মনে হল আপনি হয়তো কিছু জানেন। তাই এলাম।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিক। এবার আমি যা জানি শুনুন।’

ব্যোমকেশ কাল সকালে ডাক্তার রক্ষিতের আগমন হইতে সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করিল। রমাপতিবাবু গাঢ় মনোযোগ দিয়া শুনিলেন; ব্যোমকেশ কাহিনী শেষ করিলে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বলিলেন, ‘সন্দেহজনক বটে। কিন্তু বিশু পালের কোনো মোটিভ পাচ্ছি না। তার ওপর লোকটা পঙ্গু। — আপনার কি মনে হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। ক’টার সময় মৃত্যু হয়েছে জানেন কি?’

‘পুলিস সার্জন বলছেন, রাত্রি ন’টার পর এবং বারোটার আগে।’

‘হুঁ’—ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘আমার মনে হয়, বিশু পাল সত্যি পঙ্গু কিনা ভাল করে যাচাই করে দেখা উচিত।’

রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘তা বটে। আর কাউকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন বিশু পালকেই নেড়েচেড়ে দেখা যাক। আপনার ফোন আছে, আমাকে একবার ব্যবহার করতে দেবেন?’

‘নিশ্চয়। আসুন।’ ব্যোমকেশ তাঁহাকে পাশের ঘরে লইয়া গেল।

কিছুক্ষণ পরে রমাপতিবাবু ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘পুলিস সার্জনকে বিশু পালের বাড়িতে যেতে বললাম। আমিও যাচ্ছি। আপনারা আসবেন?’

‘বেশ তো, চলুন না।’

আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হইয়া রমাপতিবাবুর সঙ্গে বাহির হইলাম।

বিশু পালের বাড়ির সামনে ঈষৎ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। পুলিস সার্জন বাড়ির দ্বারের কাছে পুলিসের ছাপ-মারা গাড়িতে বসিয়া আছেন, রাস্তায় ভিড় জমিয়াছে। ডাক্তার রক্ষিত দ্বারের কাছে উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। আমরা উপস্থিত হইলে সার্জন সুশীলবাবু গাড়ি হইতে নামিলেন। ডাক্তার রক্ষিত আমাদের দিকে আগাইয়া আসিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু! কী হয়েছে?’

ব্যোমকেশ দুই পক্ষের পরিচয় করাইয়া দিল। রমাপতিবাবু ডাক্তার রক্ষিতকে বলিলেন, ‘পুলিসের ডাক্তার বিশু পালকে পরীক্ষা করে দেখতে চান। আপনার আপত্তি আছে?’

ডাক্তার রক্ষিত ক্ষণেক অবাক হইয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ‘আপত্তি! বিন্দুমাত্র না। কিন্তু কেন? কি হয়েছে?’

রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল নামে এক ব্যক্তিকে কাল রাত্রে কেউ খুন করেছে!’

ডাক্তার রক্ষিত প্রতিধ্বনি করিলেন, ‘অভয় ঘোষালকে খুন করেছে! ও— বুঝেছি, আপনাদের সন্দেহ বিশুবাবু অভয় ঘোষালকে খুন করেছেন।’ তাঁর মুখে একটু শুষ্ক হাসি দেখা দিল—‘অর্থাৎ বিশুবাবুর পক্ষাঘাত সত্যিকার পক্ষাঘাত নয়, ভান মাত্র। বেশ তো আসুন, পরীক্ষা করে দেখুন!’

আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে চলিলাম।

দ্বিতলে সেরেস্তা বসিয়াছে। ত্রিতলে সিঁড়ির মুখে গুর্খা সমাসীন। তাহাকে আশ্বস্ত করিয়া ডাক্তার রক্ষিত বন্ধ দরজায় টোকা দিলেন। দরজা অল্প খুলিয়া বিশু পালের স্ত্রী ভয়ার্ত চোখে চাহিলেন। সমস্ত প্রক্রিয়াই কাল সন্ধ্যার মত।

বিশু পালের স্ত্রী পাশের ঘরে চলিয়া গেলেই, আমরা পাঁচজন ঘরে প্রবেশ করিলাম। ডাক্তার রক্ষিত আলো জ্বালিয়া দিলেন।

বিছানায় বিশু পাল বালাপোশ জড়াইয়া শুইয়া আছেন, কলহশীর্ণ কণ্ঠে বলিয়া উঠলেন, ‘কী চাই! ডাক্তার, এত লোক কেন?’

ডাক্তার রক্ষিত তাঁহার শয্যাপার্শ্বে নত হইয়া বলিলেন, ‘পুলিসের পক্ষ থেকে ডাক্তার এসেছেন, আপনাকে পরীক্ষা করতে চান।’

বিশু পালের কণ্ঠস্বর আরও তীক্ষ হইয়া উঠিল, ‘কেন? পুলিসের ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করতে চায় কেন?’

ডাক্তার রক্ষিত ধীর স্বরে কহিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে, তাই—’

বিশু পালের ঊর্ধ্বাঙ্গ ধড়ফড় করিয়া উঠিল, ‘কে খুন হয়েছে! কী বললে তুমি ডাক্তার?’

ডাক্তার আবার বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে।’

বিশু পালের মুখে পরিত্রাণের আলো ক্ষণেক ফুটিয়া উঠিয়াই মুখ আবার অন্ধকার হইয়া গেল; তিনি স্খলিত স্বরে বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে! কিন্তু— আমি যে তাকে ত্রিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছি, সুদে-আসলে তেত্রিশ হাজার দাঁড়িয়েছে। আমার টাকার কি হবে?’

ডাক্তার নীরস কণ্ঠে বলিলেন, ‘টাকার কথা পরে ভাববেন। এখন এঁরা এসেছেন যাচাই করতে সত্যিসত্যি আপনার পক্ষাঘাত হয়েছে কিনা।’

‘তার মানে?’ বিশু পাল তীব্র চক্ষু ফিরাইয়া আমাদের পানে চাহিলেন।

রমাপতিবাবু খাটের ধারে আগাইয়া গেলেন, শান্তভাবে বলিলেন, ‘দেখুন, আমাদের কোনো মতলব নেই। আমাদের ডাক্তার কেবল আপনাকে পরীক্ষা করে দেখতে চান। আপনার আপত্তি আছে কি?’

‘আপত্তি! কিসের আপত্তি! পুলিসের ডাক্তার আমার রোগ সারিয়ে দিতে পারবে?’

সুশীলবাবু বলিলেন, ‘তা—চেষ্টা করে দেখতে পারি।’

আরো কিছুক্ষণ সওয়াল জবাবের পর বিশু পাল রাজী হইলেন। সুশীলবাবু তাঁহার অঙ্গ হইতে বালাপোশ সরাইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিলেন। বিশু পালের পা দু’টি পক্ষাঘাতে অবশ, ঊর্ধ্বাঙ্গ সচল আছে। সুশীলবাবু পায়ে ছুঁচ ফুটাইয়া দেখিলেন, কোনো সাড়া পাইলেন না। তারপর আরো অনেকভাবে পরীক্ষা করিলেন; নাড়ি দেখিলেন, রক্ত-চাপ পরীক্ষা করিলেন, ডাক্তার রক্ষিতকে নানাপ্রকার প্রশ্ন করিলেন। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বিশু পালের গায়ে বালাপোশ মুড়িয়া দিলেন।

তাঁহার পরীক্ষাকালে এক সময় আমার দৃষ্টি অন্দরের দিকে সঞ্চালিত হইয়াছিল। দেখিলাম বিশুবাবুর স্ত্রী দরজা একটু ফাঁক করিয়া নিষ্পলক চোখে স্বামীর দিকে চাহিয়া আছেন। তাঁহার উদ্বেগ যেন স্বাভাবিক উদ্বেগ নয়, একটা বিকৃত ভয়ার্ত উত্তেজনা—

সুশীলবাবু বলিলেন, ‘দেখা হয়েছে। চলুন, যাওয়া যাক।’

আমরা দ্বারের দিকে ফিরিলাম। পিছন হইতে বিশু পালের গলা আসিল, ‘কেমন দেখলেন? সারবে রোগ?’

সুশীলবাবু একটু অপ্রস্তুতভাবে বলিলেন, ‘সারতে পারে। আপনার ডাক্তারবাবু ভালই চিকিৎসা করছেন। — আচ্ছা, নমস্কার।’

পুলিসের গাড়িতে বাসায় ফিরিবার পথে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তাহলে রোগটা যথার্থ, অভিনয় নয়!’

সুশীলবাবু বলিলেন, ‘না, অভিনয় নয়।’

সেদিন সারা দুপুর ব্যোমকেশ উদ্‌ভ্রান্ত চক্ষে কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া তক্তপোশে পড়িয়া রহিল এবং অসংখ্য সিগারেট ধ্বংস করিল। অপরাহ্ণে যখন চা আসিল, তখনো সে উঠিল না দেখিয়া আমি বলিলাম, ‘পুলিস তো তোমাকে অভয় ঘোষালের খুনের তদন্ত করতে ডাকেনি, তবে তোমার এত ভাবনা কিসের?’

সে বলিল, ‘ভাবনা নয়, অজিত, বিবেকের দংশন।’

তারপর সে হঠাৎ উঠিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল। শুনিলাম কাহাকে ফোন করিতেছে। মিনিট কয়েক পরে যখন ফিরিয়া আসিল, দেখিলাম তাহার মুখ একটু প্রফুল্ল হইয়াছে।

‘কাকে ফোন করলে?’

‘ডাক্তার অসীম সেনকে।’

ডাক্তার অসীম সেনের সঙ্গে ‘খুঁজি খুঁজি নারি’ ব্যাপারে আমাদের পরিচয় হইয়াছিল।

ব্যোমকেশ এক চুমুকে কবোষ্ণ চা গলাধঃধরণ করিয়া বলিল, ‘চল, বেরুনো যাক।’

‘কোথায়?’

‘বিশু পালের বাড়ি।’

বিশু পালের বাড়িতে কেরানিরা দিনের কাজ শেষ করিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিতেছে। ডাক্তার রক্ষিত রোগী দেখার ঘরে টেবিলের উপর পা তুলিয়া দিয়া সিগারেট টানিতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া ত্বরিতে পা নামাইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার রোগী কেউ নেই দেখছি। একবার ওপরে চলুন, আপনার সামনে বিশুবাবুকে দুটো কথা বলব।’

ডাক্তার প্রসন্ন নেত্রে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া আমাদের উপরে লইয়া চলিলেন।

গুর্খা অন্তর্হিত হইয়াছে, বিশুবাবুর ঘরের দ্বার খোলা। আমরা প্রবেশ করিলাম। আজ আর আলো জ্বালিবার প্রয়োজন হইল না, খোলা জানালা দিয়া পর্যাপ্ত আলো আসিতেছে। বিশু পালের অপঘাত-মৃত্যুভয় কাটিয়াছে।

তিনি পিঠের নীচে কয়েকটা বালিশ দিয়া শয্যায় অর্ধশয়ান ছিলেন, আমাদের পদশব্দে চকিতে ঘাড় ফিরাইলেন।

ব্যোমকেশ শয্যার পাশে গিয়া কিছুক্ষণ বিশু পালের মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল, ‘খুব খেলা দেখালেন আপনি!’

বিশু পালের চক্ষু দু’টি প্যাঁচার চোখের মত ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল। ব্যোমকেশ দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, ‘ডাক্তারকে দলে টেনেছিলেন, তার কারণ ডাক্তার না হলে আপনার কার্যসিদ্ধি হত না। কিন্তু আমাকে দলে টানলেন কেন? আমি আপনার পক্ষে সাক্ষী দেব এই জন্যে?’

ডাক্তার এতক্ষণ আমাদের পিছনে ছিলেন, এখন লাফাইয়া সামনে আসিলেন, উগ্র কণ্ঠে বলিলেন, ‘এসব কী বলছেন আপনি! আমার নামে কী বদনাম দিচ্ছেন!’

খোঁচা খাওয়া বাঘের মত ব্যোমকেশ তাঁহার দিকে ফিরিল, ‘ডাক্তার, প্রোকেন নামে কোনো ওষুধের নাম শুনেছ?’

ডাক্তার ফুটা বেলুনের মত চুপসিয়া গেলেন। ব্যোমকেশ আরো কিছুক্ষণ তাঁহার পানে আরক্ত নেত্রে চাহিয়া থাকিয়া বিশু পালের দিকে ফিরিল, পকেট হইতে একশো টাকার নোট বাহির করিয়া বিছানার উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল, ‘এই নিন আপনার টাকা। আমি আপনাদের দু’জনকে ফাঁসিকাঠে তুলতে পারি, এই কথাটা ভুলে যাবেন না। আপনাকে দু’-দিন হাজতে রাখলেই পক্ষাঘাতের প্রকৃত স্বরূপ বেরিয়ে পড়বে।’

বিশু পাল প্রায় কাঁদিয়া উঠিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, দয়া করুন। আমি যা করেছি প্রাণের দায়ে করেছি, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে করেছি।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এক শর্তে দয়া করতে পারি। আপনাকে এক লক্ষ টাকা প্রতিরক্ষা তহবিলে দান করতে হবে। রাজী আছেন?’

বিশু পাল শীর্ণ কণ্ঠে বলিলেন, ‘এক লক্ষ টাকা!’

‘হ্যাঁ, এক লক্ষ টাকা, এক পয়সা কম নয়। কাল সকালে আপনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে এক লক্ষ টাকা জমা দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। যদি টাকা না দেন—’

‘আচ্ছা, আচ্ছা, দেবো এক লক্ষ টাকা।’

‘মনে থাকে যেন। কাল বেলা বারোটা পর্যন্ত আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রসিদ দেখার জন্য অপেক্ষা করব। —চল অজিত।’

বাড়িতে ফিরিয়া আর এক দফা চা পান করিতে করিতে ভাবিতেছিলাম, প্রতিরক্ষা তহবিলে এক লক্ষ টাকা চাঁদা খুবই আনন্দের কথা, কিন্তু ব্যোমকেশ দু’টা খুনীকে হাতে পাইয়া ছাড়িয়া দিল কেন? ব্যোমকেশ বোধ হয় আমার মুখ দেখিয়া মনের কথা বুঝিতে পারিয়াছিল; বলিল, ‘বিশু পালকে ছেড়ে না দিয়ে উপায় ছিল না। মোকদ্দমা কোর্টে উঠলেও সে ছাড়া পেয়ে যেতো। হত্যার মোটিভ কেউ বিশ্বাস করত না।’

বলিলাম, ‘কিন্তু মোটিভটা তো খাঁটি?’

‘বিশু পালের দিক থেকে খাঁটি, সে সত্যিই নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে অভয় ঘোষালকে খুন করেছিল। কিন্তু জুরী বিশ্বাস করত না, হেসে উড়িয়ে দিত।’

‘আচ্ছা, একটা কথা বলো। আত্মরক্ষার জন্যে নরহত্যা করলে দোষ নেই আইনে একথা বলে, কেমন? তাহলে বিশু পাল অভয় ঘোষালকে খুন করে কী দোষ করেছে?’

‘আত্মরক্ষার জন্যে নরহত্যার অধিকার মানুষের আছে, কিন্তু তিন মাস ধরে ষড়যন্ত্র করে নরহত্যা করলে আইন তা স্বীকার করবে না। বিশু পাল তা জানত বলেই এত সাবধানে আট-ঘাট বেঁধে কাজে নেমেছিল।’

‘ব্যাপার বুঝলাম। তবু তুমি সব কথা পরিষ্কার করে বলো।’

ব্যোমকেশ তখন বলিতে আরম্ভ করিল—

‘অভয় ঘোষালকে কাল আমরা দেখেছিলাম। মুখে হাসি লেগে আছে, কিন্তু চোখে জল্লাদের নিষ্ঠুরতা। লোকটা সত্যিকার খুনী। ওর সম্বন্ধে আমরা যা শুনেছি তা একবর্ণ মিথ্যে নয়।

‘বিশু পাল মিষ্টি কথায় ভুলে অভয় ঘোষালকে ত্রিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিল। তারপর যখন ধার শোধ করার পালা এল, তখন আর অভয় ঘোষালের দেখা নেই। কে কার টাকা ধারে!

‘বিশু পাল তখনো অভয় ঘোষালকে পুরোপুরি চিনত না, সে একদিন তার বাড়িতে গিয়ে তার চৌদ্দ-পুরুষান্ত করল। অভয় ঘোষাল একটি কথা বলল না, কেবল তার পানে চেয়ে রইল। সেই চাউনি দেখে বিশু পাল ভয় পেয়ে গেল। সে বুঝতে পারল অভয় ঘোষাল কী ধাতুর লোক; সে আগেও খুন করেছে, এবার তাকে খুন করবে।

‘বিশু পালও কম নয়। সে যখন পাকাপাকি বুঝলো যে অভয় ঘোষাল তাকে খুন না করে ছাড়বে না, তখন সে ঠিক করল অভয় ঘোষালকে সে আগে খুন করবে। তার টাকা মারা যাবার ভয় নেই, কারণ অভয় ঘোষালের একটা বাড়ি আছে, সেটা ক্রোক করে টাকা আদায় করা যাবে।

‘খুন করার ব্যাপারে বিশু পালের একটা সুবিধা ছিল। সে জানত যে অভয় ঘোষাল তাকে খুন করতে চায়, কিন্তু বিশু পাল যে অভয় ঘোষালকে খুন করতে চায়, একথা অভয় ঘোষাল জানত না। তাই সে সাবধান হয়নি।

‘বিশু পালের বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হল। সিঁড়ির মুখে গুর্খা মোতায়েন হল। তারপর বিশু পাল প্ল্যান ঠিক করতে বসল।

‘নীচের তলার ভাড়াটে ডাক্তার সুরেশ রক্ষিত। বেশ বোঝা যায় তার প্র্যকটিস নেই। সে বাড়িভাড়া দিতে পারে না, তাই বিশু পালের খাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশু পাল তাকে ডেকে নিজের প্ল্যান বলল। ডাক্তারের গলায় ফাঁস, সে রাজী হল।

‘বিশু পাল নতুন আসবাব কিনে ডাক্তারের ডিসপেন্সারি সাজিয়ে দিল, যাতে মনে হয় ডাক্তার হেঁজিপেঁজি ডাক্তার নয়, তার বেশ পসার আছে। তারপর বিশু পালের পক্ষাঘাত হল।

‘আজকাল ডাক্তারি শাস্ত্রের অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে অপারেশনের জন্যে রুগীকে অজ্ঞান করতে হলে ক্লোরোফর্ম দিতে হতো, এখন আর তা দরকার হয় না। প্রোকেন জাতীয় এক রকম ওষুধ বেরিয়েছে, মেরুদণ্ডের স্থান-বিশেষে ইনজেকশন দিলে শরীরের স্থান-বিশেষ অসাড় হয়ে যায়; তখন শরীরের সেই অংশে স্বচ্ছন্দে অপারেশন করা যায়, রোগী ব্যথা অনুভব করে না।

‘ডাক্তার রক্ষিত তাই করল, বিশু পালের পা দুটো অসাড় হয়ে গেল। তখন একজন নামকরা বড় ডাক্তারকে ডাকা হল; তিনি দেখলেন পক্ষাঘাত, সেই রকম ব্যবস্থা করে গেলেন।

‘প্রোকেন জাতীয় ওষুধের ফল পাঁচ-ছয় ঘণ্টা থাকে। তারপর আর থাকে না। কিন্তু সে খবর বাইরের লোক জানে না, কেবল বিশু পালের স্ত্রী আর ডাক্তার জানে। কেরানিরা দোতলায় আসে, তারা জানতে পারে মালিকের পক্ষাঘাত হয়েছে। সেরেস্তাদার ঘরে ঢুকতে পায় না, দোরের কাছ থেকে দেখে যায় মালিক বিছানায় পড়ে আছে। কারুর অবিশ্বাস হয় না, অবিশ্বাসের কোন কারণ নেই।

‘কিন্তু বিশু পাল ঝানু লোক, সে কাঁচা কাজ করবে না। নিরপেক্ষ নির্লিপ্ত সাক্ষী চাই; এমন সাক্ষী চাই যাদের কথা কেউ অবিশ্বাস করবে না। কাল সকালে সে ডাক্তারকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালো। আমি যেতে রাজী হলাম। ডাক্তার ফিরে গিয়ে বেলা একটা আন্দাজ বিশু পালের শিরদাঁড়ায় প্রোকেন ইনজেকশন দিল।

‘আমরা পাঁচটার সময় গিয়ে দেখলাম বিশু পাল শয্যাশায়ী, উত্থানশক্তি রহিত। সে তার দুঃখের কথা আমাকে শোনালো, তারপর একশো টাকা দক্ষিণা দিয়ে বিদায় করল। তার মতলব ঠিক করা ছিল, কাল রাত্রেই অভয়কে খুন করবে।

‘আমি অভয়ের ঠিকানা নিয়েছি সে খবর ডাক্তার বিশু পালকে জানালো। বিশু পালের ভাবনা হল, আমরা যদি বেশি রাত পর্যন্ত অভয় ঘোষালের বাড়িতে থাকি, তাহলে তার প্ল্যান ভেস্তে যাবে। সে ডাক্তারকে পাঠালো আমাদের ওপর নজর রাখতে; ডাক্তার ট্যাক্সিতে অভয় ঘোষালের বাড়ির সামনে এসে অপেক্ষা করতে লাগল, তারপর আমরা যখন অভয়ের বাড়ি থেকে বেরুলাম তখন সে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল। লাইন ক্লিয়ার!

‘সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ বিশু পালের শরীরের জড়ত্ব কেটে গেল, সে চাঙ্গা হয়ে উঠল।

‘রাত্রি আটটার সময় একটা গুর্খা চলে যায়, দ্বিতীয় গুর্খা আসে দশটার সময়। বিশু পাল আন্দাজ ন’টার সময় বাড়ি থেকে বেরুলো, বোধ হয় র‍্যাপার মুড়ি দিয়ে বেরিয়েছিল, হাতে ছিল গুনছুঁচের মত একটা অস্ত্র। গত তিন মাসে সে অভয় ঘোষালের চাল-চলন সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে রেখেছিল। বাড়িতে একটা ঝি ছাড়া আর কেউ থাকে না; অভয় ঘোষাল ন’টার সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে যায়; সদর দরজা ভেজানো থাকে, চাকরানী বোধ হয় দশটার পর রান্নাঘরের কাজকর্ম সেরে সদর দরজা বন্ধ করে।

‘সুতরাং বিশু পালের কোনই অসুবিধা হল না। অভয় ঘোষালকে খুন করে সে দশটার আগেই নিজের বাড়িতে ফিরে এল; কেউ জানতে পারল না। যদি কেউ তাকে দেখে ফেলত তাহলেও বিশু পালের অ্যালিবাই ভাঙা শক্ত হতো। যে লোক তিন মাস পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী সে খুন করতে যাবে কি করে? খুন করার মোটিভ কোথায়?

‘আজ ভোরবেলা বিশু পাল আর একটা ইনজেকশন নিল। সাবধানের মার নেই। তারপর পুলিস-ডাক্তারকে নিয়ে আমরা গেলাম। পুলিস-ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন পক্ষাঘাতই বটে।

‘আমার মনটা গোড়া থেকেই খুঁৎখুঁৎ করছিল। একটা সুদখোর মহাজন কেবল আমাকে তার দুঃখের কাহিনী শোনাবার জন্য একশো টাকা খরচ করবে? ওইখানেই বিশু পাল একটু ভুল করে ফেলেছিল। তারপর আজ সকালে যখন কাগজে অভয় ঘোষালের মৃত্যু-সংবাদ পড়লাম, তখন আর সন্দেহ রইল না যে বিশু পালই অভয় ঘোষালের মৃত্যু ঘটিয়েছে। কিন্তু কী করে?

‘তিনজন লোক আছে: বিশু পাল নিজে, তার স্ত্রী এবং ডাক্তার রক্ষিত। ডাক্তার রক্ষিত খুবই প্যাঁচে পড়েছে, সে বিশু পালকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু নিজের হাতে খুন করবে কি? বিশ্বাস হয় না। বিশু পালের স্ত্রী মেয়েমানুষ, স্বামীকে বাঁচাবার জন্যে সে অভয় ঘোষালকে হাতের কাছে পেলে বিষ খাওয়াতে পারে কিন্তু অত দূরে গিয়ে ছুরি চালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। ছুরি মেয়েমানুষের অস্ত্র নয়। বাকি রইল বিশু পাল। কিন্তু সে তো পক্ষাঘাতে পঙ্গু—

‘গুর্খা দুটোকে গোড়াতেই বাদ দিয়েছি। প্রাণীহত্যায় তাদের অরুচি নেই, তারা কুক্‌রি চালাতেও জানে। কিন্তু বিশু পাল নিজের গুর্খা দারোয়ানকে দিয়ে খুন করাবে এত কাঁচা ছেলে সে নয়। গুর্খাদের মাথায় প্যাঁচালো বুদ্ধি নেই, তারা সরল এবং গোঁয়ার। ধরা পড়লেই সত্যি কথা বলে ফেলবে।

‘তবে?

‘হঠাৎ আসল কারসাজিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ডাক্তারি শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে অনেক আগেই বুঝতে পারতাম। বিশু পালের পক্ষাঘাত সত্যিকারের পক্ষাঘাত নয়, পক্ষাঘাতের অস্থায়ী বিকল্প, ডাক্তারি প্রক্রিয়ার দ্বারা তৈরি করা হয়েছে।

‘ডাক্তার অসীম সেনকে ফোন করলাম। তিনি প্রবীণ ডাক্তার, এক কথায় বুঝিয়ে দিলেন।

‘আমার দুঃখ এই যে বিশু পালের সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার রক্ষিতও ছাড়া পেয়ে গেল। ডাক্তার হয়ে সে যে-কাজ করেছে, তার ক্ষমা নেই। — যাহোক, প্রতিরক্ষা তহবিলে এক লক্ষ টাকাই বা মন্দ কি?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *