পাঁচ
বৈকাল চারটে বাজিবার পূর্বেই পাণ্ডেজি গাড়ি লইয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, ‘চলুন, একবার থানা হয়ে যাব। হয়তো পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এসেছে।’
তিনজনে থানায় উপস্থিত হইলাম। শহরের মাঝখানে থানা। রতিকান্ত উপস্থিত ছিল, আমাদের সসম্ভ্রমে লইয়া গিয়া নিজের অফিস ঘরে বসাইল। বলিল, ‘এইমাত্র পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট পেলাম, কিউরারি পাওয়া গেছে। মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই।’
পাণ্ডেজি রিপোর্টের উপর একবার চোখ বুলাইয়া বলিলেন, ‘আর ওষুধ পরীক্ষার রিপোর্ট?’
‘সেটা এখনও আসেনি। আমি জরুরী তাগাদা দিয়ে এসেছি। বোধহয় আজ রাত্রেই পাওয়া যাবে। ওষুধের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত ভালভাবে তদন্ত আরম্ভ করা যাচ্ছে না। তবে লোক লাগিয়েছি, কিউরারি নিয়ে কেউ চোরাকারবার করে কিনা খবর নিতে।’
পাণ্ডেজি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘ঠিক করেছ। যে চোরটার কাছে কিউরারির শিশি পাওয়া গিয়েছিল সে তো এখন জেলেই আছে। তাকে দম দিলে হয়তো খবর পাওয়া যেতে পারে কারা কিউরারির চোরাকারবার করে।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খবর নিয়েছি সে কয়েদীটা এখন পাটনা জেলে নেই, বক্সার জেলে আছে। তার সঙ্গে মুলাকাতের ব্যবস্থা করছি। ইতিধ্যে ডাক্তার পালিতের কম্পাউণ্ডারকে জেরা করেছি।’
‘কিছু পেলে?’
‘কিছু না। —ওদিকে দীপনারায়ণজির বাড়ির সকলকে বাড়িতেই থাকতে বলেছি। বাইরের লোকের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি, কেবল ম্যানেজার গঙ্গাধর আর তার ছেলে লীলাধর ছাড়া।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আমরা এখন সেখানেই যাচ্ছি। তুমি আসবে নাকি?’
রতিকান্ত একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘আপনারা এগোন, আমি একটা জরুরী কাজ সেরে যাচ্ছি।’ তারপর হাসিয়া ব্যোমকেশকে বলিল,—‘আপনি কিছু ঠাহর করতে পারলেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘উঁহু। কিন্তু মনে হচ্ছে বাড়ির কাউকেই সন্দেহ থেকে বাদ দেওয়া যায় না।’
রতিকান্ত বলিল, ‘শুধু বাড়ির লোক নয় স্টেটের কর্মচারীদেরও বাদ দেওয়া যায় না। সকলকেই অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় ফেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।’
ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে বলিল, ‘ডাক্তার পালিতকে আপনার কেমন মনে হয়?’
রতিকান্ত চকিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিল, ‘ডাক্তার পালিত! কিন্তু তিনি—যদি তাঁর কোনও মোটিভ থাকত, তিনি নিজের হাতে একাজ করতেন কি?’
ব্যোমকেশ মুচকি হাসিল, ‘তিনি নিজের হাতে একাজ করেছেন বলেই তাঁর ওপর সন্দেহ কম হবে।—’
মোটরে ফিরিয়া গিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ডাক্তার পালিতের ডিস্পেনসারি কি কাছেই?’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘এই তো খানিক দূর, রাস্তাতেই পড়বে। যাবেন নাকি সেখানে?’
‘চলুন, আসল অকুস্থলটা দেখে যাওয়া যাক।’
দু’তিন মিনিটের মধ্যে ডাক্তার পালিতের ডাক্তারখানায় পৌঁছিলাম। এটিও বড় রাস্তার উপর, চারিদিকে দোকানপাট, বসতবাড়ি নেই। শীতের রাত্রে আটটার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ হইয়া যায়, তখন চোরের তালা ভাঙিয়া ভিতরে প্রবেশ করিবার কোনই অসুবিধা নাই।
ডাক্তারখানাটি নিতান্তই মামুলী। সামনে পিছনে দুটি ঘর, সামনের ঘরে রুগী আসিয়া বসে, ভিতরের ঘরে ডাক্তার বসেন। কম্পাউণ্ডার ভিতরের ঘরেই ঔষধ তৈয়ার করে।
কম্পাউণ্ডার ও ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন, বাহিরের ঘরে কয়েকটি রুগীও বসিয়াছিল। আমরা গিয়া দেখিলাম, ভিতরের ঘরে ডাক্তার একটি রুগীকে লম্বা সরু টেবিলের উপর শোয়াইয়া তাহার পেট টিপিতেছেন। ঘাড় ফিরাইয়া আমাদের দেখিয়া একটু হাসিলেন, ‘কী, অ্যারেস্ট করতে এসেছেন নাকি?’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘না না, দেখতে এলাম।’
‘বসুন।’
আমরা ডাক্তারের টেবিল ঘিরিয়া বসিলাম। ডাক্তার রুগীর পরীক্ষা শেষ করিয়া টেবিলে আসিয়া বসিলেন, ব্যবস্থাপত্র লিখিয়া কম্পাউণ্ডারকে দিলেন। ইতিমধ্যে আমরা কম্পাউণ্ডারটিকে দেখিলাম। রোগা গাল-বসা বিহারী ছোকরা, নাম যদিও খুবলাল, কিন্তু গায়ের রঙ খুব কালো। ইউনিফর্ম পরা পাণ্ডেজিকে দেখিয়া তাহার মুখের কৃষ্ণতা আরও গাঢ় হইয়াছে।
ডাক্তার বলিলেন, ‘কি দেখবেন বলুন।’
পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের দিকে চাহিলেন, ব্যোমকেশ বলিল, ‘যে তালা ভেঙে চোর ঢুকেছিল সেটা কোথায়?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘খুবলাল, তালা নিয়ে এস।’
খুবলাল ঘরের একপ্রান্তে শিশি-বোতল-ভরা শেলফের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ঔষধ তৈয়ার করিতেছিল, আমরা তাহার পশ্চাদভাগ দেখিতে পাইতেছিলাম। কিন্তু মুখ দেখিতে না পাইলেও সে যে উৎকর্ণ হইয়া আমাদের কথা শুনিতেছে তাহা তাহার দেহের ভঙ্গী হইতে ধরা যাইতেছিল। ডাক্তারের আদেশে সে আসিয়া কম্পিত-হস্তে তালাটা টেবিলের উপর রাখিয়া আবার ফিরিয়া গিয়া ঔষধ তৈয়ার করিতে লাগিল।
তালাটা সস্তা এবং মামুলী, তাহাতে একটা লোহার শিক ঢুকাইয়া মোচড় দিলে তৎক্ষণাৎ ভাঙিয়া যাইবে, বেশি গায়ের জোরের দরকার নাই। হইয়াছেও তাই, তালার কব্জাটা ছিঁড়িয়া বাহির হইয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ তালা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিল, তারপর রাখিয়া দিল।
‘আপনার দেরাজের চাবিও তো ভেঙেছে।’
‘দেরাজ ভাঙবার দরকার হয়নি, ওটা খোলাই থাকে। চাবি অনেকদিন হারিয়ে গেছে।’
পালিত দেরাজ খুলিয়া দেখাইলেন, তাহাতে দুই চারিটা কাগজপত্র ছাড়া কিছুই নাই। পালিত বলিলেন, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। সাবধান হয়েছি, আজ থেকে একজন লোক রাত্তিরে এখানে শোবে। পুরনো ওষুধগুলো সব ফেলে দিয়ে নতুন ওষুধ আনিয়েছি। বলা তো যায় না।’
পাণ্ডেজি অনুমোদনসূচক ঘাড় নাড়িলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার খুবলালকে দু’ একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘করুন না। ওর অবশ্য একবার হয়ে গেছে, ইন্সপেক্টর চৌধুরী এক দফা জেরা করেছেন। খুবলাল!’
খুবলাল নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। অধর লেহন করিয়া ভাঙা গলায় বলিল, ‘হুজুর, আমার কোনও কসুর নেই।’
ব্যোমকেশ আশ্বাসের সুরে বলিল, ‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? যদি দোষ না করে থাকো ভয় কিসের? কেউ তোমার অনিষ্ট করবে না।’
খুবলাল বলিল, ‘জি, আমি গরীব মানুষ—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুমি কত টাকা মাইনে পাও?’
খুবলাল ডাক্তারের দিকে চোরা চাহনি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, ‘জি, ষাট টাকা। আর দশ টাকা ভাতা।’
‘উপরি কিছু নেই?’
খুবলাল সভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিল, ‘জি—না।’
‘তোমার বাড়িতে কে কে আছে?’
‘স্ত্রী আর একটা বাচ্ছা।’
‘কত টাকা বাড়িভাড়া দাও?’
‘সাড়ে বারো টাকা।’
‘সত্তর টাকায় তোমার চলে?
খুবলাল আবার ডাক্তারের পানে গুপ্তদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল—‘পেট চলে যায় হুজুর। ডাক্তারবাবু বলেছেন জানুয়ারি মাস থেকে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেবেন।’
ব্যোমকেশ ডাক্তারের পানে চাহিল, ডাক্তার ঘাড় নাড়িলেন। ব্যোমকেশ তখন বলিল, ‘আচ্ছা, ও-কথা থাক। কাল রাত্রে ক’টার সময় তুমি ডাক্তারখানা বন্ধ করেছিলে?’
‘জি, ঘড়ি দেখিনি। ডাক্তারবাবু রুগী দেখে ফিরে এলেন, ব্যাগ রেখে তখনি বেরিয়ে গেলেন। তখন বোধহয় সাতটা। তার পাঁচ-দশ মিনিট পরে আমিও ডাক্তারখানা বন্ধ করে বাড়ি গেলাম।’
‘তখন এখানে কোনও রুগী ছিল?’
‘না হুজুর!’
‘আচ্ছা, কাল রাত্রে দেরাজে কত টাকা পয়সা ছিল তুমি জানো?’
খুবলালের মুখে আবার আশঙ্কার ছায়া পড়িল। সে বলিল, ‘গুনিনি হুজুর, বোধহয় তিন টাকা কয়েক আনা ছিল। ডাক্তারবাবুর অনুপস্থিতিতে কয়েকটা পুরনো প্রেসক্রিপশন নিয়ে রুগী এসেছিল, তাদের ওষুধ দিয়েছিলাম আর পয়সা নিয়ে দেরাজে রেখেছিলাম।’
‘দোর বেশ ভাল করে বন্ধ করেছিলে?’
‘জি, হাঁ।’
‘রাত্রে চাবি তোমার কাছে থাকে?’
‘জি, হাঁ। সকালে আমি আগে এসে ডাক্তারখানা খুলি।’
‘তুমি ডাক্তার জগন্নাথ প্রসাদকে চেনো?’
খুবলাল থতমত খাইয়া গেল, শেষে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল, ‘জি।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রূ তুলিয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিল, ‘জগন্নাথের সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা আছে?’
খুবলাল ব্যাকুল হইয়া বলিল, ‘জি, না। আমি গরীব মানুষ, তিনি ডাক্তার। তবে—তবে—’
‘তবে কি?’
‘তিনি কিছুদিন আগে আমাকে তাঁর বাসায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন—’
‘তারপর?’
‘তিনি—তিনি আমাকে এখানকার চাকরি ছেড়ে দিতে বললেন।’
ডাক্তার বিস্মিতভাবে বলিলেন, ‘এটা তো নতুন শুনছি। —তুমি আমাকে বলনি কেন?’
খুবলাল অপরাধীর মত চুপ করিয়া রহিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা তুমি চাকরি ছাড়লে না কেন? জগন্নাথ ডাক্তার তোমাকে অন্য চাকরি দিত।’
খুবলাল বলিল, ‘তিনি আমাকে অন্য চাকরি দেবেন বলেননি, খালি এ চাকরি ছেড়ে দেবার কথা বলেছিলেন। আমি রাজী হলাম না, তখন আমাকে ধমক-চমক করলেন, বললেন—চাকরি না ছাড়লে বিপদে পড়বে।’
‘তবু তুমি চাকরি ছাড়লে না?’
খুবলাল ছলছল চক্ষে অবরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘হুজুর, ডাক্তার পালিত আমার মা-বাপ, উনি যতদিন আমায় রাখবেন ততদিন আমি ওঁকে ছাড়ব না। ওঁর মত দয়ালু লোক—’ খুবলাল চোখ মুছিতে লাগিল। ব্যোমকেশ সদয় কণ্ঠে বলিল, ‘আচ্ছা, এবার তুমি যাও, কাজ কর গিয়ে।’
আমরা উঠিলাম। ডাক্তার পালিত আমাদের সঙ্গে মোটর পর্যন্ত আসিলেন, বলিতে বলিতে আসিলেন, ‘খুবলাল ছেলেটা ভাল। তবে—মাঝে মাঝে দু’চার পয়সা চুরি করে, দুটো ভিটামিনের বড়ি কি দু’পুরিয়া কুইনিন পকেটে পুরে বাড়ি নিয়ে যায়; ওটা ধর্তব্য নয়, সব কম্পাউণ্ডারই করে। এসব গুরুতর ব্যাপারে ও আছে বলে মনে হয় না।’
ব্যোমকেশ গাড়িতে বসিয়া হঠাৎ গলা বাড়াইয়া বলিল, ‘ডাক্তারবাবু, শকুন্তলা দেবী ক’মাস অন্তঃসত্ত্বা?’
ডাক্তার পালিত পূর্ণদৃষ্টিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া বলিলেন, ‘তিন মাস।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি খুবই আশ্চর্য হয়েছেন।’
‘আশ্চর্য হবারই কথা।’ —বলিয়া তিনি ফিরিয়া চলিলেন।