পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ১১

এগারো

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিল টেলিফোনের শব্দে।

টেলিফোনের সহিত যাঁহারা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত তাঁহারা জানেন, টেলিফোনের কিড়িং কিড়িং শব্দ কখনও কখনও ভয়ঙ্কর ভবিতব্যতার আভাস বহন করিয়া আনে। যেন তারের অপর প্রান্তে যে-ব্যক্তি টেলিফোন ধরিয়াছে, তাহার অব্যক্ত হৃদয়াবেগ বিদ্যুতের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়।

বিছানায় উঠিয়া বসিয়া উৎকর্ণ হইয়া শুনিলাম, কিন্তু কিছু বুঝিতে পারিলাম না। দুই-তিন মিনিট পরে ব্যোমকেশ টেলিফোন রাখিয়া আমার ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার মুখে-চোখে একটা অনভ্যস্ত ধাঁধা-লাগার আভাস; সে বলিল,—‘ঝড় এসে গেছে।’

‘ঝড়!’

‘নিশানাথবাবু মারা গেছেন। চল, এখনি বেরুতে হবে।’

আমার মাথায় যেন অতর্কিতে লাঠির ঘা পড়িল! কিছুক্ষণ হতভম্ব থাকিয়া শেষে ক্ষীণকণ্ঠে বলিলাম,—‘নিশানাথবাবু মারা গেছেন! কি হয়েছিল?’

‘সেটা এখনও বোঝা যায়নি। স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।’

‘কিন্তু এ যে বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ মারা গেলেন?’

‘কাল রাত্রে। ঘুমন্ত অবস্থায় হয়তো রক্তের চাপ বেড়েছিল, হার্টফেল করে মারা গেছেন। রাত্তিরে কেউ জানতে পারেনি, আজ সকালে দেখা গেল বিছানায় মরে পড়ে আছেন।’

‘কে ফোন করেছিল?’

‘বিজয়। ওর সন্দেহ হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। ভয় পেয়েছে মনে হল। —নাও, চটপট উঠে পড়। ট্রেনে গেলে দেরি হবে, ট্যাক্সিতে যাব।’

ট্যাক্সিতে যখন গোলাপ কলোনীর ফটকের সম্মুখে পৌঁছিলাম, তখনও আটটা বাজে নাই, কিন্তু প্রখর সূর্যের তাপ কড়া হইতে আরম্ভ করিয়াছে। ট্যাক্সির ভাড়া চুকাইয়া দিয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

বাগান নিঝুম; মালীরা কাজ করিতেছে না। কুঠিগুলিও যেন শূন্য। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম কোথাও জনমানব নাই।

আমরা নিশানাথবাবুর বাড়ির সম্মুখীন হইলে বিজয় বাহির হইয়া আসিল। তাহার চুল এলোমেলো, গায়ে একটা চাদর, পা খালি, চোখ জবাফুলের মত লাল। ভাঙা গলায় বলিল,—‘আসুন।’

বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল,—‘চলুন, আগে একবার দেখি, তারপর সব কথা শুনব।’

বিজয় আমাদের পাশের ঘরে লইয়া গেল; যে-ঘরে সেদিন দুপুরবেলা আমরা শয়ন করিয়াছিলাম সেই ঘর। জানালা খোলা রহিয়াছে। ঘরের একপাশে খাট, খাটের উপর সাদা চাদর-ঢাকা মৃতদেহ।

আমরা খাটের পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। ব্যোমকেশ সন্তর্পণে চাদর তুলিয়া লইল।

নিশানাথবাবু যেন ঘুমাইয়া আছেন। তাঁহার পরিধানে কেবল সিল্কের ঢিলা পায়জামা, গায়ে জামা নাই। তাঁহার মুখের ভাব একটু ফুলো ফুলো, যেন মুখে অধিক রক্ত সঞ্চার হইয়াছে। এ ছাড়া মৃত্যুর কোনও চিহ্ন শরীরে বিদ্যমান নাই।

নীরবে কিছুক্ষণ মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করিয়া ব্যোমকেশ হঠাৎ অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিল,—‘এ কি? পায়ে মোজা!’

এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই—নিশানাথের পায়ের চেটো পায়জামার কাপড়ে প্রায় ঢাকা ছিল—এখন দেখিলাম সত্যই তাঁহার পায়ে মোজা। ব্যোমকেশ ঝুঁকিয়া দেখিয়া বলিল,—‘গরম মোজা! উনি কি মোজা পায়ে দিয়ে শুতেন?’

বিজয় আচ্ছন্নের মত দাঁড়াইয়া ছিল, মাথা নাড়িয়া বলিল,—‘না।’

অতঃপর ব্যোমকেশ মৃতদেহের উপর আবার চাদর ঢাকা দিয়া বলিল,—‘চলুন, দেখা হয়েছে। ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছেন কি? ডাক্তারের সার্টিফিকেট তো দরকার হবে।’

বিজয় বলিল,—‘মুস্কিল গাড়ি নিয়ে শহরে গেছে, ডাক্তার নগেন পাল এখানকার বড় ডাক্তার—। কি বুঝলেন, ব্যোমকেশবাবু?’

‘ও কথা পরে হবে। —আপনার কাকিমা কোথায়?’

‘কাকিমা অজ্ঞান হয়ে আছেন।’ বিজয় আমাদের পাশের ঘরের দ্বারের কাছে লইয়া গেল। পর্দা সরাইয়া দেখিলাম, ও ঘরটিও শয়নকক্ষ। খাটের উপর দময়ন্তী দেবী বিস্রস্তভাবে পড়িয়া আছেন, ডাক্তার ভুজঙ্গধর পাশে বসিয়া তাঁহার শুশ্রূষা করিতেছেন; মাথায় মুখে জল দিতেছেন, নাকের কাছে অ্যামোনিয়ার শিশি ধরিতেছেন।

আমাদের দেখিতে পাইয়া ভুজঙ্গধরবাবু লঘুপদে আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার মুখ বিষণ্ণগম্ভীর; স্বভাবসিদ্ধ বেপরোয়া চটুলতা সাময়িকভাবে অস্তমিত হইয়াছে। তিনি খাটো গলায় বলিলেন,—‘এখনও জ্ঞান হয়নি, তবে বোধহয় শীগ্‌গিরই হবে।’

ফিস্ ফিস্ করিয়া কথা হইতে লাগিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে আছেন?’

ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—‘প্রায় তিন ঘন্টা। উনিই প্রথমে জানতে পারেন। ঘুম ভাঙার পর বোধহয় স্বামীর ঘরে গিয়েছিলেন, দেখে চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এখনও জ্ঞান হয়নি।’

‘আপনি মৃতদেহ দেখেছেন?’

‘দেখেছি।’

‘আপনার কি মনে হয়? স্বাভাবিক মৃত্যু?’

ডাক্তার একবার চোখ বড় করিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন,—‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলবার অধিকার নেই। পাকা ডাক্তার আসুন, তিনি যা হয় বলবেন।’ বলিয়া ভুজঙ্গধরবাবু আবার দময়ন্তী দেবীর খাটের পাশে গিয়া বসিলেন।

আমরা বাহিরের ঘরে ফিরিয়া গেলাম। ইতিমধ্যে বৈষ্ণব ব্রজদাস বাহিরের ঘরে আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়াছিলেন, আমাদের দেখিয়া নত হইয়া নমস্কার করিলেন। তাঁহার মুখে শোকাহত ব্যাকুলতার সহিত তীক্ষ্ণ উৎকণ্ঠার চিহ্ন মুদ্রিত রহিয়াছে। তিনি ভগ্নস্বরে বলিলেন,—‘এ কি হল আমাদের! এতদিন পর্বতের আড়ালে ছিলাম, এখন কোথায় যাব?’

আমরা উপবেশন করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,—‘কোথাও যাবার দরকার হবে না বোধহয়। কলোনী যেমন চলছে তেমনি চলবে। —বসুন।’

ব্রজদাস বসিলেন না, দ্বিধাগ্রস্ত মুখে জানালায় পিঠ দিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল,—‘কাল নিশানাথবাবুকে আপনি শেষ কখন দেখেছিলেন?’

‘বিকেলবেলা। তখন তো বেশ ভালই ছিলেন।’

ব্লাড্-প্রেসারের কথা কিছু বলেছিলেন?’

‘কিচ্ছু না।’

বাহিরে মুস্কিলের গাড়ি আসিয়া থামিল। বিজয় বাহিরে গিয়া ডাক্তার নগেন্দ্র পালকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। ডাক্তার পালের হাতে ব্যাগ, পকেটে স্টেথস্কোপ, লোকটি প্রবীণ কিন্তু বেশ চট্‌পটে। মৃদু কণ্ঠে আক্ষেপের বাঁধা বুলি আবৃত্তি করিতে করিতে বিজয়ের সঙ্গে পাশের ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার কথার ভগ্নাংশ কানে আসিল,—‘সব রোগের ওষুধ আছে, মৃত্যু রোগের ওষুধ নেই…’

তিনি পাশের ঘরে অন্তর্হিত হইলে ব্যোমকেশ ব্রজদাসকে জিজ্ঞাসা করিল,—‘ডাক্তার পাল প্রায়ই আসেন বুঝি?’

ব্রজদাস বলিলেন,—‘মাসে দু’ মাসে একবার আসেন। কলোনীর বাঁধা ডাক্তার। অবশ্য ভুজঙ্গধরবাবুই এখানকার কাজ চালান। নেহাৎ দরকার হলে এঁকে ডাকা হয়।’

পনেরো মিনিট পরে ডাক্তার পাল বাহিরে আসিলেন। মুখে একটু লৌকিক বিষণ্ণতা। তাঁহার পিছনে বিজয় ও ভুজঙ্গধরবাবুও আসিলেন। ডাক্তার পাল ব্যোমকেশের প্রতি একটি চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, মনে হইল তিনি বিজয়ের কাছে ব্যোমকেশের পরিচয় শুনিয়াছেন। তারপর চেয়ারে বসিয়া ব্যাগ হইতে শিরোনামা ছাপা কাগজের প্যাড্ বাহির করিয়া লিখিবার উপক্রম করিলেন।

ব্যোমকেশ তাঁহার দিকে ঝুঁকিয়া বলিল,—‘মাফ করবেন, আপনি কি ডেথ্ সার্টিফিকেট লিখছেন?’

ডাক্তার পাল ভ্রূ তুলিয়া চাহিলেন, বলিলেন,—‘হ্যাঁ।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনি তাহলে মনে করেন স্বাভাবিক মৃত্যু?’

ডাক্তার পাল ঠোঁটের কোণ তুলিয়া একটু হাসিলেন, বলিলেন,—‘স্বাভাবিক মৃত্যু বলে কিছু নেই, সব মুত্যই অস্বাভাবিক। শরীরের অবস্থা যখন অস্বাভাবিক হয়, তখনই মৃত্যু হতে পারে।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘তা ঠিক। কিন্তু শরীরের অস্বাভাবিক অবস্থা আপনা থেকে ঘটতে পারে, আবার বাইরে থেকে ঘটানো যেতে পারে।’

ডাক্তার পালের ভ্রূ আর একটু উপরে উঠিল। তিনি বলিলেন,—‘আপনি ব্যোমকেশবাবু, না? আপনি কী বলতে চান আমি বুঝেছি। কিন্তু আমি নিশানাথবাবুর দেহ ভাল করে পরীক্ষা করেছি, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। মৃত্যুর সময় কাল রাত্রি দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। আমার বিচারে কাল রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় ওঁর মাথার শিরা ছিঁড়ে যায়, তারপর ঘুমন্ত অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছে। যারা ব্লাড্-প্রেসারের রুগী তাদের মৃত্যু সাধারণত এইভাবেই হয়ে থাকে।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘কিন্তু ওঁর পায়ে মোজা ছিল লক্ষ্য করেছেন বোধহয়। এই দারুণ গ্রীষ্মে তিনি মোজা পরে শুয়েছিলেন একথা কি বিশ্বাসযোগ্য?’

ডাক্তার পালের মুখে একটু দ্বিধার ভাব দেখা গেল। তিনি বলিলেন,—‘ওটা যদিও ডাক্তারি নিদানের এলাকায় পড়ে না, তবু ভাববার কথা। নিশানাথবাবু এই গরমে মোজা পায়ে দিয়ে শুয়েছিলেন বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আর কেউ তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় মোজা পরিয়ে দিয়েছে তাই বা কি করে বিশ্বাস করা যায়? কেউ সে-চেষ্টা করলে তিনি জেগে উঠতেন না? আপনার কি মনে হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আগে একটা কথা বলুন। ব্লাড্-প্রেসারের রুগী পায়ে মোজা পরলে ব্লাড্-প্রেসার বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কি?’

ডাক্তার পাল বলিলেন,—‘তা আছে। কিন্তু মাথার শিরা ছিঁড়ে মারা যাবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বিশেষ ক্ষেত্রে মারা যেতে পারে।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘ডাক্তারবাবু, আপনি স্বাভাবিক মৃত্যর সার্টিফিকেট দেবেন না। নিশানাথবাবুর শরীরের মধ্যে কী ঘটেছে বাইরে থেকে হয়তো সব বোঝা যাচ্ছে না। পোস্ট-মর্টেম হওয়া উচিত।’

ডাক্তার তীক্ষ্ণ চক্ষে কিছুক্ষণ ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর কলমের মাথা বন্ধ করিতে করিতে বলিলেন,—‘আপনি ধোঁকা লাগিয়ে দিলেন। বেশ, তাই ভালো, ক্ষতি তো আর কিছু হবে না।’ ব্যাগ হাতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন,—‘আমি চললাম। থানায় খবর পাঠাব, আর অটপ্সির ব্যবস্থা করব।’

ডাক্তারকে বিদায় দিয়া বিজয় ফিরিয়া আসিল, ক্লান্তভাবে একটা চেয়ারে বসিয়া দু’হাতে মুখ ঢাকিল।

ভুজঙ্গধরবাবু তখনও ভিতর দিকের দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া ছিলেন, সদয় কণ্ঠে বলিলেন,—‘বিজয়বাবু, আপনি নিজের কুঠিতে গিয়ে শুয়ে থাকুন। আমি না হয় একটা সেডেটিভ্ দিচ্ছি। এ সময় ভেঙে পড়লে তো চলবে না।’

বিজয় হাতের ভিতর হইতে মুখ তুলিল না, রুদ্ধস্বরে বলিল,—‘আমি ঠিক আছি।’

ভুজঙ্গধরবাবুর মুখে একটু ক্ষুব্ধ অসন্তোষ ফুটিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন,—‘নিশানাথবাবুও ঐ কথা বলতেন। শরীরে রোগ পুষে রেখেছিলেন, ওষুধ খেতেন না। আমি রক্ত বার করবার জন্য পীড়াপীড়ি করলে বলতেন, দরকার নেই, আমি ঠিক আছি। তার ফল দেখছেন তো?’

ব্যোমকেশ চট্ করিয়া তাঁহার দিকে ঘাড় ফিরাইল,—‘তাহলে আপনিও বিশ্বাস করেন এটা স্বাভাবিক মৃত্যু?’

ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—‘আমার বিশ্বাসের কোনও মূল্য নেই। আপনাদের সন্দেহ হয়েছে পরীক্ষা করিয়ে দেখুন। কিন্তু কিছু পাওয়া যাবে না।’

‘পাওয়া যাবে না কি করে জানলেন?’

ভুজঙ্গধরবাবু একটু মলিন হাসিলেন। ‘আমিও ডাক্তার ছিলাম একদিন।’ বলিয়া ধীরে ধীরে ভিতর দিকে প্রস্থান করিলেন।

ব্যোমকেশ বিজয়ের দিকে ফিরিয়া বলিল,—‘ভুজঙ্গধরবাবু ঠিক বলেছেন, আপনার বিশ্রাম দরকার—’

বিজয় কাতর মুখ তুলিয়া বলিল,—‘আমি এখন শুয়ে থাকতে পারব না, ব্যোমকেশবাবু। কাকা—’ তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল।

‘তা বটে। আচ্ছা, তাহলে বলুন কাল থেকে কি কি ঘটেছে। কাল সকালে আপনি আমাকে চিঠি দিয়ে দোকানে গেলেন। ভাল কথা, আপনার কাকা আমাকে কি লিখেছিলেন আপনি জানেন?’

‘না। কি লিখেছিলেন?’

‘লিখেছিলেন আমার সাহায্য আর তাঁর দরকার নেই। কিন্তু ওকথা যাক। আপনি কলকাতা থেকে ফিরলেন কখন?’

‘পাঁচটার গাড়িতে।’

‘কাকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?’

‘কাকা বাগানে বেড়াচ্ছেন দেখেছিলাম। কথা হয়নি।’

‘শেষ তাঁকে কখন দেখেছিলেন?’

‘সেই শেষ, আর দেখিনি। সন্ধ্যের পর আমি এখানে আসছিলাম কাকার সঙ্গে কথা বলবার জন্যে কিন্তু বাইরে থেকে শুনতে পেলাম রসিকবাবুর সঙ্গে কাকার বচসা হচ্ছে—’

‘রসিকবাবু? যিনি শাকসব্‌জির দোকান দেখেন? তাঁর সঙ্গে কী নিয়ে বচসা হচ্ছিল?’

‘সব কথা শুনতে পাইনি। কেবল কাকা বলছিলেন শুনতে পেলাম—তোমাকে পুলিসে দেব। আমি আর ভেতরে এলাম না, ফিরে গেলাম।’

‘হুঁ। রাত্রে খাবার সময় কাকার সঙ্গে দেখা হয়নি?’

‘না। আমি—সকাল সকাল খেয়ে আবার আটটার ট্রেনে কলকাতায় গিয়েছিলাম।’

‘আবার কলকাতায় গিয়েছিলেন?’ ব্যোমকেশ স্থির নেত্রে বিজয়ের পানে চাহিয়া রহিল।

বিজয়ের শুষ্ক’ মুখ যেন আরও ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল। সে একটু বিদ্রোহের সুরে বলিল,—‘হ্যাঁ। আমার দরকার ছিল।’

কী দরকার ছিল এ প্রশ্ন ব্যোমকেশ করিল না। শান্তস্বরে বলিল,—‘কখন ফিরলেন?’

‘বারোটার পর। নিজের কুঠিতে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। আজ সকালে মুকুল এসে—’

‘মুকুল?’

‘মুকুল ভোরবেলা এদিক দিয়ে যাচ্ছিল, কাকিমার চীৎকার শুনতে পেয়ে ছুটে এসে দেখল কাকিমা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন আর কাকা মারা গেছেন। তখন মুকুল দৌড়ে গিয়ে আমাকে তুলল।’

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে সিগারেট মুখে দিতে গিয়া থামিয়া গেল, সিগারেট আবার কৌটায় রাখিতে রাখিতে বলিল,—‘রসিকবাবু কোথায়?’

বিজয় বলিল,—‘রসিকবাবুকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর কুঠি খালি পড়ে আছে।’

‘তাই নাকি?’

এই সময় ব্রজদাস কথা বলিলেন। তিনি এতক্ষণ জানালায় ঠেস দিয়া নীরবে সমস্ত শুনিতেছিলেন, এখন গলা খাঁকারি দিয়া বলিলেন,—‘রসিকবাবু বোধহয় কাল রাত্রেই চলে গেছেন। ওঁর কুঠি আমার পাশেই, রাত্রে ওঁর ঘরে আলো জ্বলতে দেখিনি।’

বিজয় বলিল,—‘তা হবে। হয়তো কাকার সঙ্গে বকাবকির পর—’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘হয়তো ফিরে আসবেন। কলোনীর আর সবাই যথাস্থানে আছে তো? নেপালবাবু—’

‘আর সকলেই আছে।’

আবার কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। তারপর ব্যোমকেশ বলিল,—‘বিজয়বাবু, এবার বলুন দেখি, নিশানাথবাবুর মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয় এ সন্দেহ আপনার হল কেন?’

বিজয় বলিল,—‘প্রথমে ওঁর পায়ে মোজা দেখে। কাকা শীতকালেও মোজা পরতেন না, মোজা তাঁর ছিলই না। দ্বিতীয়ত, আমি ঘরে ঢুকে দেখলাম জানালা বন্ধ রয়েছে।’’

‘বন্ধ রয়েছে!’

‘হ্যাঁ, ছিটকিনি লাগানো। কাকা কখনই রাত্রে জানালা বন্ধ করে শোননি। তবে কে জানালা বন্ধ করলে?’

‘তা বটে। —বিজয়বাবু, আপনাকে একটা ঘরের কথা জিগ্যেস করছি, কিছু মনে করবেন না। আপনার কাকার জীবনে কি কোনও গোপন কথা ছিল?’

বিজয়ের চোখের মধ্যে যেন ভয়ের ছায়া পড়িল, সে অস্পষ্ট স্বরে বলিল,—‘গোপন কথা! না, আমি কিছু জানি না।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘না জানা আশ্চর্য নয়। হয়তো তাঁর যৌবনকালে কিছু ঘটেছিল। কিন্তু কোনও দিন সন্দেহও কি হয়নি?’

‘না।’ বলিয়া বিজয় ক্লান্তভাবে দু’হাতে মুখ ঢাকিল।

এই সময় দেখিলাম বৈষ্ণব ব্রজদাস কখন নিঃসাড়ে ঘর হইতে অন্তর্হিত হইয়াছেন। আমাদের মনোযোগ বিজয়ের দিকে আকৃষ্ট ছিল বলিয়াই বোধহয় তাঁহার নিষ্ক্রমণ লক্ষ্য করি নাই।

ভিতর দিকের দ্বার দিয়া ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়া আমাদের মধ্যে দাঁড়াইলেন, খাটো গলায় বলিলেন,—‘মিসেস সেনের জ্ঞান হয়েছে।’

বিজয় ধড়মড় করিয়া উঠিয়া গমনোদ্যত হইল। ভুজঙ্গধরবাবু তাহাকে ক্ষণেকের জন্য আট্‌কাইলেন, বলিলেন,—‘পোস্ট-মর্টেমের কথা এখন মিসেস সেনকে না বলাই ভাল।’

বিজয় চলিয়া গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই দময়ন্তী দেবীর ঘর হইতে মর্মান্তিক কান্নার আওয়াজ আসিল।

‘কাকিমা—।’

‘বাবা বিজয়—।’

ভুজঙ্গধরবাবু একটা অর্ধোচ্ছ্বসিত নিশ্বাস চাপিয়া যে-পথে আসিয়াছিলেন সেই পথে ফিরিয়া গেলেন। আমরা নেপথ্য হইতে দুইটি শোকার্ত মানুষের বিলাপ শুনিতে লাগিলাম।