পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ১৮

আঠারো

ঘুম ভাঙিল মাথার মধ্যে ঝন্ ঝন্ শব্দে। তখনও ভাল করিয়া ভোর হয় নাই, মনে হইল কানের কাছে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। কয়েকদিন আগে ঘুমের মধ্যে এমনি আর্ত আহ্বান আসিয়াছিল।

আজ আর বিছানায় থাকিতে পারিলাম না। তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ ইতিমধ্যে আসিয়া টেলিফোন ধরিয়াছে। আমি তক্তপোশের পাশে বসিয়া একতরফা সংলাপ শুনিলাম—‘হ্যালো…বিজয়বাবু…কী? মারা গেছে। কখন?..কি হয়েছিল…আমি যেতে পারি, কিন্তু এখন গিয়ে লাভ কি?…আপনি বরং ইন্সপেক্টর বরাটকে ফোন করুন, তিনি ব্যবস্থা করবেন…হ্যাঁ, পোস্ট-মর্টেম হওয়া চাই, আর ওষুধের শিশিটা পরীক্ষা হওয়া চাই…আচ্ছা—’

টেলিফোন রাখিয়া ব্যোমকেশ একটা আরাম-চেয়ারে বসিল। আমার ঠোঁটের কাছে যে প্রশ্নটা ধড়ফড় করিতেছিল তাহা বাহির হইয়া আসিল,—‘কে? কে গেল?’

ব্যোমকেশের চোখে-মুখে যেন দুঃস্বপ্নের জড়তা লাগিয়া ছিল, সে মুখের উপর হাত চালাইয়া তাহা সরাইয়া দিবার চেষ্টা করিল। বলিল,—‘পানুগোপাল। কিছুক্ষণ আগে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। বোধহয় কানে ওষুধ দিয়েছিল; ওষুধের শিশিটা ছিপিখোলা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ওষুধে বিষ মেশানো ছিল, বিষের জ্বালায় সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে, বারান্দা থেকে নীচে পড়ে যায়। সেইখানেই মৃত্যু হয়েছে।—আমার দোষ। আমার ভাবা উচিত ছিল, পানু যদি সত্যিই কোনও গুরুতর কথা জানতে পেরে থাকে, তাহলে তার প্রাণের আশঙ্কা আছে। কেন সাবধান হইনি! কেন তাকে সঙ্গে নিয়ে আসিনি। কিন্তু কাল বিজয় বললে, ওটা একটা ইডিয়ট, হয়তো কিছুই বলবার নেই। আমার মনও সেই কথায় ভিজে গেল—’

ব্যোমকেশ হঠাৎ চুপ করিল। তাহার তীব্র আত্মগ্লানির মধ্যে আবার কোন নূতন সংশয় মাথা তুলিয়াছে, সে মুখের উপর একটা হাত ঢাকা দিয়া নীরব হইয়া রহিল।

তারপর সকাল হইল; পুঁটিরাম চা দিয়া গেল। ব্যোমকেশ কিন্তু চা স্পর্শ করিল না, একটা সিগারেট পর্যন্ত ধরাইল না, মোহগ্রস্তের মত মুখের উপর হাত চাপা দিয়া আরাম-চেয়ারে পড়িয়া রহিল।

আমার মনটা বিকল হইয়া গিয়াছিল। পানুগোপাল ছেলেটা প্রকৃতির কৃপণতায় অসুস্থ দেহ লইয়া জন্মিয়াছিল, কিন্তু সে নির্বোধ ছিল না। তাহার হৃদয় ছিল, হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা ছিল। নিশানাথবাবু তাহাকে ভালবাসিতেন, আমারও তাহাকে ভাল লাগিয়া গিয়াছিল। তাহার এই যন্ত্রণাময় মৃত্যুর সংবাদ কাঁটার মত মনের মধ্যে বিঁধিয়া রহিল।

বেলা বারোটার সময় ব্যোমকেশ নিঃশব্দে উঠিয়া স্নানাহার করিল, তারপর পাখা চালাইয়া শয্যায় শয়ন করিল। সে যে দিবানিদ্রা দিবার জন্য শয়ন করিল না তাহা বুঝিলাম। পানুগোপালের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে দোষী মনে করিতেছে, একান্ত নিভৃতে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করিতে চায়। এবং যে অদৃশ্য নরঘাতক পর-পর দুইটি মানুষকে নিঃশব্দে পৃথিবী হইতে সরাইয়া দিল তাহার ছদ্মবেশ অপসারিত করিয়া তাহাকে ফাঁসিকাঠে লট্‌কাইবার পন্থা আবিষ্কার করিতে চায়।

অপরাহ্ণে দুইজনে নীরবে বসিয়া চা-পান করিলাম। ব্যোমকেশের মুখখানা শাণ দেওয়া ক্ষুরের মত হিংস্র এবং কঠিন হইয়া রহিল।

সন্ধ্যার সময় পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট লইয়া প্রমোদ বরাট আসিল। ব্যোমকেশের হাতে রিপোর্ট দিয়া বলিল,—‘নিকোটিন বিষে মৃত্যু হয়েছে। ওষুধের শিশিতেও নিকোটিন পাওয়া গেছে।’

ব্যোমকেশ বরাটের সম্মুখে সিগারেটের টিন রাখিয়া পুঁটিরামকে আর এক দফা চায়ের হুকুম দিল; রিপোর্ট পড়িয়া কোনও মন্তব্য না করিয়া আমার হাতে দিল।

রাত্রি দশটা হইতে এগারোটার মধ্যে মৃত্যু হইয়াছে। পানুর কানের মধ্যে ক্ষত ছিল, রাত্রে শয়নের পূর্বে শিশির ঔষধে তুলা ভিজাইয়া কানে দিয়াছিল। ইহা তাহার প্রাত্যহিক কর্ম। কিন্তু কাল কেহ অলক্ষিতে তাহার ঔষধে বিষ মিশাইয়া দিয়া গিয়াছিল। বিষ রক্তের সহিত মিশিবার অল্পকাল মধ্যে মৃত্যু হইয়াছে। তাহার দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নাই। —পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট ও বরাটের মুখের কথা হইতে এই তথ্যগুলি প্রকাশ পাইল।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘মৃতদেহ কে প্রথম আবিষ্কার করে?’

বরাট বলিল,—‘নেপালবাবুর মেয়ে মুকুল।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বরাটের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল,—‘এবারেও মুকুল। আশ্চর্য।’

বরাট বলিল,—‘যা শুনলাম, ভোর রাত্রে উঠে বাগানে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটার অভ্যেস।’

‘হুঁ।—আপনি খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন?’

‘সকলকেই সওয়াল করেছিলাম কিন্তু কাজের কথা কিছু পেলাম না।’

‘পানু যে-ওষুধ কানে দিত সেটা কি ভুজঙ্গধরবাবুর দেওয়া ওষুধ?’

‘হ্যাঁ। ওষুধে ছিল স্রেফ গ্লিসারিন আর বোরিক পাউডার। ভুজঙ্গধরবাবু বললেন, তিনি মাসে এক শিশি পানুকে তৈরি করে দিতেন, পানু তাই কানে দিত। কাল রাত্রি দশটার আগে কোনও সময় হত্যাকারী এসে তার শিশিতে নিকোটিন মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত পানু তখন খেতে গিয়েছিল।’

‘কে কখন খেতে গিয়েছিল খবর নিয়েছেন?’

‘সকলে একসঙ্গে খেতে যায়নি, কেউ আগে কেউ পরে। পানু খেতে গিয়েছিল আন্দাজ পৌনে দশটার সময়, অর্থাৎ আমরা চলে আসবার পরই।’

‘কাল রান্না করেছিল কে?’

‘দময়ন্তী আর মুকুল। দু’জনেই সারাক্ষণ রান্নাঘরে ছিল।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। পুঁটিরাম চা ও জলখাবার দিয়া গেল।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘নিকোটিন। অজিত, লক্ষ্য করেছ, দ্বিতীয়বার নিকোটিনের আবির্ভাব হল।’

বলিলাম,—‘হ্যাঁ। তার মানে—সুনয়না।’

বরাট বলিল,—‘কিন্তু সুনয়না বা অন্য কোনও স্ত্রীলোক নিশানাথবাবুকে কড়িকাঠ থেকে ঝুলিয়ে দিতে পারে এ প্রস্তাব আমরা আগেই খারিজ করেছি। ধরে নিতে হবে সুনয়নার একজন সহকর্মী আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘সহকর্মী কিম্বা সহকর্মিণী। একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে যে কাজ অসম্ভব, দু’জন স্ত্রীলোক মিলে সে কাজ সহজেই করতে পারে। কিন্তু আসল কথা নিকোটিন। এ বিষ এল কোত্থেকে? ইন্সপেক্টর বরাট, আপনি নিকোটিন সম্বন্ধে কিছু জানেন?’

বরাট বলিল,—‘ওটা ভয়ঙ্কর বিষ এই জানি। আপনার মুখে সুনয়নার কথা শোনবার পর খোঁজখবর নিয়েছিলাম, দেখলাম ওষুধের দোকানে ও-মাল পাওয়া যায় না; কোথাও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। এক যদি কোনও বড় ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয় তো বলতে পারি না।’

‘এক হতে পারে যে-ব্যক্তি বিষ ব্যবহার করেছে সে নিজে একজন কেমিস্ট কিংবা কোনও কেমিস্টকে দিয়ে বিষ তৈরি করিয়েছে।’

‘তা হতে পারে। কেমিস্ট তো একজন হাতের কাছেই রয়েছে—নেপাল গুপ্ত।’

‘যদি নেপাল গুপ্ত হয়, সুনয়নার সঙ্গে তার সম্বন্ধ কি?’

‘বাপ-বেটি হতে বাধা কি?’

আমি বলিলাম,—‘নেপালবাবুর সঙ্গে দময়ন্তী দেবীরও যোগাযোগ আছে—তাঁরা দুজনে হতে পারেন।’

ব্যোমকেশ ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল,—‘দময়ন্তী দেবী আর বিজয় হতে পারে, বিজয় আর বনলক্ষ্মী হতে পারে, বনলক্ষ্মী আর দময়ন্তী হতে পারে, দময়ন্তী আর ভুজঙ্গধর হতে পারে, বনলক্ষ্মী আর ব্রজদাস হতে পারে, এমন কি মুস্কিল মিঞা আর নজর বিবি হতে পারে। সম্ভাবনা অনেকগুলো রয়েছে, কিন্তু কেবল সম্ভাবনার কথা গবেষণা করে কোনও লাভ হবে না। পাকাপাকি জানতে হবে।’

বরাট জলযোগ শেষ করিয়া মুখ মুছিতে মুছিতে বলিল,—‘বেশ তো, পাকাপাকি জানার একটা উপায় বলুন না। পুলিসের দিক থেকে আর কোনও বাধা নেই, পানুকে যে খুন করা হয়েছে—আমার কর্তারা তা স্বীকার করবেন; সুতরাং পুলিসের যা-কিছু কর্তব্য সবই আমি করতে পারি। এখন কি করতে হবে বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘এক, কলোনীর সকলের কুঠি খানাতল্লাস করে দেখতে পারেন, কিন্তু নিকোটিন পাবেন না। আমার মনে হয়, রুটিন-মাফিক কাজে কোনও ফল হবে না। বরং আপাতত কিছুদিন বসে থাকা ভাল।’

‘চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকব?’

‘একেবারে হাত গুটোবার দরকার নেই। ব্রজদাস আর রসিকের তল্লাস যেমন চলছে চলুক। রসিকের দোকানের খাতাপত্র পরীক্ষা করুন। আর কলোনীতে গুপ্তচর বসান। কে কখন বাইরে যাচ্ছে সেটা জানা বিশেষ দরকার।’

বরাট গাত্রোত্থান করিয়া বলিল,—‘আজ থেকেই লোক লাগাবো ঠিক করেছিলাম কিন্তু পানুর ব্যাপারে সব গোলমাল হয়ে গেছে। কাল থেকে হবে।—কলোনীতে আর কারুর হঠাৎ মৃত্যুর যোগ নেই তো?’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া রহিল, তারপর বলিল,—‘বোধহয় না। থাকলেও আমরা ঠেকাতে পারব না।’