পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ১৭

সতের

বরাট, ব্যোমকেশ ও আমি বনলক্ষ্মীর কুঠিতে উপস্থিত হইলাম। ভিতরে প্রবেশ করিবার সময় পাশের খোলা জানালা দিয়া একটি নিভৃত দৃশ্য চোখে পড়িল। ঘরটি বোধহয় বনলক্ষ্মীর শয়নঘর; আলো জ্বলিতেছিল, বনলক্ষ্মী শয্যায় শুইয়া আছে, আর বিজয় শয্যার পাশে বসিয়া মৃদুস্বরে তাহার সহিত বাক্যালাপ করিতেছে।

আমাদের পদশব্দে বিজয় বাহির হইয়া আসিল। বলিল,—‘বনলক্ষ্মী এখনও বড় দুর্বল। মাথার চোট গুরুতর নয়, কিন্তু স্নায়ুতে শক্ লেগেছে। তাকে এখন জেরা করা ঠিক হবে কি?’

ব্যোমকেশ স্নিগ্ধস্বরে বলিল,—‘জেরা করব না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা শুধু তাকে দেখতে এসেছি, দেখেই চলে যাব।’

‘তা—আসুন।’

ব্যোমকেশ ঘনিষ্ঠভাবে বিজয়ের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল,—‘আপনাকে কিন্তু আর একটি কাজ করতে হবে বিজয়বাবু। একাজ আপনি ছাড়া আর কারুর দ্বারা হবে না।’

‘কি করতে হবে বলুন।’

‘পানুগোপাল কিছু জানে, আপনার কাকার মৃত্যুর রাত্রে বোধহয় কিছু দেখেছিল! কিন্তু সে উত্তেজিত হয়েছে, কিছু বলতে পারছে না। আপনি তাকে ঠাণ্ডা করে কথাটা বার করে নিতে পারেন? আমরা পারব না, আমাদের দেখলেই সে আবার উত্তেজিত হয়ে উঠবে।’

বিজয় উৎসুক হইয়া বলিল,—‘আচ্ছা, দেখি চেষ্টা করে।’ বলিয়া সে চলিয়া গেল।

আমরা বনলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিলাম।

লোহার সরু খাটের উপর বিছানা। বনলক্ষ্মী খাটের ধারে উঠিয়া বসিয়াছে, তাহার কপালে পটি বাঁধা। আমাদের দেখিয়া উঠিবার উপক্রম করিল।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘উঠবেন না, উঠবেন না, আপনি শুয়ে থাকুন।’

বনলক্ষ্মী লজ্জিতমুখে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল,—‘কোথায় যে বসতে দেব আপনাদের!’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘সে ভাবনা ভাবতে হবে না আপনাকে। আপনি শুয়ে পড়ন তো আগে।’

বনলক্ষ্মী গুটিসুটি হইয়া শুইল। ব্যোমকেশ তখন খাটের পাশে বসিল, আমরা দু’জনে খাটের পায়ের কাছে দাঁড়াইলাম। ক্ষুদ্র নিরাভরণ ঘর; লোহার খাটটি ছাড়া বলিতে গেলে আর কিছুই নাই।

ব্যোমকেশ হাল্কা গল্প করার ভঙ্গীতে বলিল,—‘কী হয়েছিল বলুন দেখি? বাইরে থেকে কেউ ঢিল ছুঁড়েছিল?’

বনলক্ষ্মী দুর্বল কণ্ঠে বলিল,—‘কিছু জানি না। জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলুম, তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হল ডাক্তারবাবুর টিঞ্চার আয়োডিনের জ্বলুনিতে।’

‘কপালে ছাড়া আর কোথাও লেগেছে নাকি?’

বনলক্ষ্মী ডান হাত তুলিয়া দেখাইল,—‘হাতে কাচের চুড়ি ছিল, ভেঙে গেছে। হাতে একটু আঁচড় লেগেছে। বোধহয় হাতটা মাথার কাছে ছিল, একসঙ্গে লেগেছে—’

‘তা হতে পারে।’ ব্যোমকেশ হাত পরীক্ষা করিয়া বলিল,—‘প্রথমে বোধহয় ইট আপনার হাতে লেগেছিল, তাই মাথায় বেশি চোট লাগেনি। আচ্ছা, কে ইট ছুঁড়তে পারে? কলোনীতে এমন কেউ আছে কি, যে আপনার প্রতি প্রসন্ন নয়?’

বনলক্ষ্মী ব্যথিত স্বরে বলিল,—‘মুকুল আর নেপালবাবু আমাকে—পছন্দ করেন না। তা ছাড়া—তা ছাড়া—’

‘তা ছাড়া ভুজঙ্গধরবাবুও আপনার ওপর সন্তুষ্ট নন।’

বনলক্ষ্মী চুপ করিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘ভুজঙ্গধরবাবু হয়তো আপনাকে দেখতে পারেন না, কিন্তু সেজন্য ওঁর কর্তব্যে ত্রুটি হয় না।’

বনলক্ষ্মীর অধরে একটু তিক্ত হাসি ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল,—‘না, তা হয় না। আমার কপালে খুব টিঞ্চার আয়োডিন ঢেলেছেন।’

ব্যোমকেশ হাসিল,—‘যাক। —ব্রজদাস বাবাজী আর রসিকবাবুর সঙ্গে আপনার কোনও রকম অসদ্ভাব—?’

বনলক্ষ্মী বলিল,—‘ব্রজদাস ঠাকুর খুব ভাল লোক ছিলেন, আমাকে স্নেহ করতেন। কেন যে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন—’

‘আর রসিকবাবু?’

‘রসিকবাবুকে আমি দেখেছি, এই পর্যন্ত। কখনও কথা হয়নি। —তিনি মিশুকে লোক ছিলেন না, নিজের কাজ নিয়ে থাকতেন।’

‘ওকথা যাক। আপনি এখন বেশ সুস্থ বোধ করছেন তো?’

বনলক্ষ্মী একটু হাসিল,—‘হ্যাঁ।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘তাহলে বাঁধা বুলিটা আউড়ে নিই। সে-রাত্রে দশটা এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’

বনলক্ষ্মীর চোখে অন্ধকার জমিয়া উঠিল। অতি অস্ফুট স্বরে সে বলিল,—‘কাকাবাবুর মৃত্যু তাহলে—?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘তাই মনে হচ্ছে।’ বনলক্ষ্মী ক্ষণকাল চোখ বুজিয়া রহিল, তারপর বলিল,—‘সে-রাত্রে রান্নাঘর থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে আসার পর আমি অনেকক্ষণ কলে সেলাই করেছিলুম।’

বাহিরের ঘরে একটি পায়ে-চালানো সেলাইয়ের মেশিন দেখিয়াছি; পূর্বে নিশানাথবাবু বনলক্ষ্মীকে দর্জিখানার পরিচারিকা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন মনে পড়িল।

ব্যোমকেশ নরম সুরে বলিল,—‘আপনি তো কলোনীর সকলের জামা-কাপড় সেলাই করেন। অনেক কাজ জমা হয়ে গিয়েছিল বুঝি?’

‘না, কাজ বেশি জমা হয়নি। কাকাবাবুর জন্যে সিল্কের একটা ড্রেসিং গাউন তৈরি করছিলুম।’ বনলক্ষ্মীর চক্ষু সহসা জলে ভরিয়া উঠিল।

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,—‘আচ্ছা বলুন দেখি, আপনি সে-রাত্রে যখন সেলাইয়ের কল চালাচ্ছিলেন, তখন ভুজঙ্গধরবাবুকে সেতার বাজাতে শুনেছিলেন? ওঁর কুঠি তো আপনার পাশেই?’

বনলক্ষ্মী চোখ মুছিয়া মাথা নাড়িল,—‘না, আমি কিছু শুনিনি। কানের কাছে কল চলছিল, শুনব কি করে!’ তাহার যেন একটু রাগ-রাগ ভাব।

ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিল,—‘শুধু যে ভুজঙ্গধরবাবু আপনাকে দেখতে পারেন না তা নয়, আপনিও তাঁকে দেখতে পারেন না। ভুজঙ্গধরবাবু সে-রাত্রে নিজের ঘরে বসে সেতার বাজাচ্ছিলেন, অন্তত তাই বললেন। আপনি যদি না শুনে থাকেন, তাহলে বলতে হবে উনি মিথ্যে কথা বলেছেন।’

এবার বনলক্ষ্মীর মুখের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইল। লজ্জা ও অনুতাপভরা মুখে সে ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া আবেগভরা কণ্ঠে বলিয়া উঠিল,—‘না! উনি সেতার বাজাচ্ছিলেন। আমি কল চালাবার ফাঁকে ফাঁকে শুনেছিলাম!’

ব্যোমকেশ তাহার হাতটি দুই হাতের মধ্যে লইয়া বলিল,—‘তবে যে আগে বললেন শোনেননি!’

বনলক্ষ্মীর অধর স্ফুরিত হইল, অনুতাপের সহিত অভিমান মিশ্রিত হইল। সে বলিল,—‘উনি আমার সঙ্গে যেরকম ব্যাভার করেন—’

‘কিন্তু কেন ও রকম ব্যবহার করেন? কোনও কারণ আছে কি?’

বনলক্ষ্মী হাত ছাড়াইয়া লইয়া একবার কপালের উপর আঙ্গুল বুলাইয়া অর্ধস্ফুট স্বরে বলিল,—সে আপনার শুনে কাজ নেই।’

‘কিন্তু আমার যে জানা দরকার।’

বনলক্ষ্মী চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ আবার অনুরোধ করিল। তখন বনলক্ষ্মী লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিল—

‘আমার কথা বোধহয় শুনেছেন, নিজের দোষে ইহকাল পরকাল নষ্ট করেছি। কাকাবাবু আশ্রয় দিয়েছিলেন তাই—নইলে—

‘আমি এখানে আশ্রয় পাবার পর ডাক্তারবাবু আমার সঙ্গে খুব সদয় ব্যাভার করেছিলেন। উনি খুব মিশুকে, ওঁকে আমার খুব ভাল লাগত। উনি চমৎকার সেতার বাজাতে পারেন। আমার ছেলেবেলা থেকে গান-বাজনার দিকে ঝোঁক, কিন্তু কিছু শিখতে পারিনি। একদিন ওঁর কাছে গিয়ে বললুম, আমি সেতার শিখব, আমাকে শেখাবেন?—’

‘তারপর?’

বনলক্ষ্মীর চোখ ঝাপ্‌সা হইয়া গেল,—‘উনি যে প্রস্তাব করলেন তাতে ছুটে পালিয়ে এলুম…আমি জীবনে একবার ভুল করেছি তাই উনি মনে করেন আমি—’ তাহার স্বর বুজিয়া গেল।

ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,—‘ভুজঙ্গবাবু তো খাসা মানুষ। একথা কেউ জানে?’

বনলক্ষ্মী জিভ কাটিল,—‘আমি কাউকে কিছু বলিনি। একথা কি বলবার? বললে কেউ বিশ্বাস করত না…যে-মেয়ের একবার বদনাম হয়েছে—’

বাহিরে পায়ের শব্দ হইল। বনলক্ষ্মী চমকিয়া ত্রস্তস্বরে ফিস্ ফিস্ করিয়া বলিল,—‘উনি—বিজয়বাবু আসছেন! ওঁকে যেন কিছু বলবেন না। উনি রাগী মানুষ—’

‘ভয় নেই’ বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

দ্বারের কাছে বিজয়ের সঙ্গে দেখা হইল। ব্যোমকেশ বলিল,—‘কি হল? পানুগোপালের কাছ থেকে কিছু বার করতে পারলেন?’

বিজয় বিষণ্ণ বিরক্তির সহিত বলিল,—‘কিছু না। পানুটা ইডিয়ট; হয়তো ওর কিছুই বলবার নেই, যখন বলতে পারবে তখন দেখা যাবে অতি তুচ্ছ কথা। আপনাদের কোনই কাজে লাগবে না।’

‘তা হতে পারে। তবু চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি নেই। কাজের কথাও বেরিয়ে পড়তে পারে।’

‘কাল সকালে আর একবার চেষ্টা করে দেখব।’

‘আচ্ছা। আজ চলি তাহলে।’

‘আসুন। দরকার হলে কাল টেলিফোন করব।’

বিজয় রহিয়া গেল, আমরা বাহিরে আসিলাম। কুঠি হইতে নামিবার স্থানটি অন্ধকার। বরাট টর্চ জ্বালিল।

পাশের যে জানালা দিয়া বনলক্ষ্মীর শয়নঘর দেখা যায়, তাহার নীচে একটা কালো কাপড়-ঢাকা মূর্তি লুকাইয়া ছিল, টর্চের প্রভা সেদিকে পড়িতেই প্রেত-মূর্তির মত একটা ছায়া সট্‌ করিয়া সরিয়া গেল, তারপর গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হইল। ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেগে বরাটের হাত হইতে টর্চ কাড়িয়া লইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। আমরা বোকার মত ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিলাম, তারপর অন্ধকারে হোঁচট খাইতে খাইতে তাহার অনুসরণ করিলাম।

কিছুদূর যাইবার পর দেখা গেল ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিতেছে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বলিল,—‘ধরতে পারলাম না। নেপালবাবুর কুঠির পিছন পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ মিলিয়ে গেল।’

বরাট বলিল,—‘লোকটা কে আন্দাজ করতে পারলেন?’

‘উঁহু। তবে মেয়েমানুষ। দৌড়বার সময় মনে হল বাতাসে গোলাপী আতরের গন্ধ পেলাম। একবার চুড়ি কিম্বা চাবির আওয়াজও যেন কানে এল।’

‘মেয়েমানুষ—কে হতে পারে?’

‘মুকুল হতে পারে, মুস্কিলের বিবি হতে পারে, আবার দময়ন্তী দেবীও হতে পারেন। —চলুন, সাড়ে ন’টা বেজে গেছে।

বরাট স্টেশন পর্যন্ত আমাদের পৌঁছাইয়া দিতে আসিল—ট্রেন তখনও আসে নাই। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনাকে আর একটা কাজ করতে হবে। ইন্সপেক্টর বরাট, আপনি মনে করবেন না আমি আপনার ওপর সর্দারি করছি। এ কাজে আমরা সহযোগী। আপনার পেছনে পুলিসের অফুরন্ত এক্তিয়ার রয়েছে, আপনি যে-কাজটা পাঁচ মিনিটে করতে পারবেন আমি করতে গেলে সেটা পাঁচ দিন লাগবে। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি—’

বরাট হাসিয়া বলিল,—‘কি কাজ করতে হবে বলুন না।’

ব্যোমকেশ বলিল, —‘গুপ্তচর লাগাতে হবে। কলোনী থেকে কে কখন কলকাতায় যাচ্ছে তার খবর আমার দরকার। যেই খবর পাবেন সঙ্গে সঙ্গে আমাকে টেলিফোন করবেন।’

‘তাই হবে। কলোনীতে আর স্টেশনে লোক রাখব।—বনলক্ষ্মীর ভাঙা চুড়িটা আমায় দিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে কী করা যাবে?’

‘ওটা ফেলে দিতে পারেন। ভেবেছিলাম পরীক্ষা করাতে হবে, কিন্তু তার দরকার নেই।’

‘আর কিছু?’

‘আপাতত আর কিছু নয়।—আজ যা দেখলেন শুনলেন তা থেকে কি মনে হল? কাউকে সন্দেহ হচ্ছে?’

‘দময়ন্তীকে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হচ্ছে।’

‘কিন্তু এ স্ত্রীলোকের কাজ নয়।’

‘স্ত্রীলোকের সহকারী থাকতে পারে তো।’

ব্যোমকেশ চকিতে বরাটের পানে চোখ তুলিল।

‘সহকারী কে হতে পারে?’

‘সেটা বলা শক্ত। যে-কেউ হতে পারে। বিজয় হতে বাধা কি? ও যেভাবে কাকীমাকে আগলে বেড়াচ্ছে দেখলাম—’

‘হ্যাঁ—ভাববার কথা বটে। ওদিকে নেপালবাবুর সঙ্গেও দময়ন্তী দেবীর একটা প্রচ্ছন্ন সংযোগ রয়েছে।

‘আচ্ছা, দময়ন্তীর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে কিছু জানা গেছে?’

‘দুর্নাম কিছু শুনিনি, বরং ভালই শুনেছি।’

‘আপনার গাড়ি এসে পড়েছে। হ্যাঁ, রসিক দে’র সবজি-দোকানের হিসেব-পত্র দেখবার ব্যবস্থা করেছি। যদি সত্যিই চুরি করে থাকে, ওর নামে ওয়ারেন্ট বের করব।’

ট্রেনের শূন্য কামরায় ব্যোমকেশ একটা বেঞ্চিতে চিৎ হইয়া আলোর দিকে চাহিয়া অনেকক্ষণ স্বপ্নচ্ছন্ন হইয়া রহিল। তারপর হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল,—‘চিড়িয়াখানাই বটে।’

উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘হঠাৎ একথা কেন?’

ব্যোমকেশ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল,—‘চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কি? নাম-কাটা ডাক্তার সংস্কৃত শ্লোক আওড়ায়, মুখপোড়া প্রফেসর রাত দুপুরে মেয়ের সঙ্গে দাবা খেলে, কর্তাকে দোর-বন্ধ বাড়িতে ঢুকে কেউ খুন করে যায় কিন্তু পাশের ঘরে গৃহিণী কিছু জানতে পারেন না, কর্তার ভাইপো খুড়োর তহবিল ভেঙ্গে সগর্বে সেকথা প্রচার করে, বোষ্টম ফেরারী হয়, গাড়োয়ানের বৌ আড়ি পাতে—। চিড়িয়াখানা আর কাকে বলে?’

জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘আজকের অনুসন্ধানে কিছু পেলে?’

‘এইটুকু পেলাম যে সবাই মিথ্যে কথা বলছে। নির্জলা মিথ্যে বলছে না। সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে এমনভাবে বলছে যে কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে ধরা যায় না।’

‘বনলক্ষ্মীও মিথ্যে বলছে?’

‘অন্তত বলবার তালে ছিল। নেহাৎ বিবেকের দংশনে সত্যি কথা বলে ফেলল।’

‘আচ্ছা, অ্যালিবাই সম্বন্ধে কি মনে হল?’

‘কারুর অ্যালিবাই পাকা নয়। বিজয় বলছে, ঠিক যে-সময় খুন হয় সে-সময় সে কলকাতায় ছিল, অথচ তার কোনো সাক্ষী-প্রমাণ নেই, বেনামী চিঠিখানা পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। নেপালবাবু মেয়ের সঙ্গে দাবা খেলছিলেন, কেউ তাঁদের খেলতে দেখেনি। ডাক্তার অন্ধকারে সেতার বাজাচ্ছিলেন, একজন কানে শুনেছে কিন্তু চোখে দেখেনি। বনলক্ষ্মী কলে সেলাই করছিল, সাক্ষী নেই। দময়ন্তীর কথা ছেড়েই দাও। এর নাম কি অ্যালিবাই?’

ব্যোমকেশ খানিকক্ষণ বাহিরের অপসৃয়মান আলো-আঁধারের পানে চাহিয়া রহিল, তাহার ললাটে চিন্তার ভ্রুকুটি। সে বলিল,—‘বনলক্ষ্মী একবার আমার হাত ধরেছিল, লক্ষ্য করেছিলে?’

বলিলাম,—‘লক্ষ্য আবার করিনি। তুমিও দু’হাতে তার হাত ধরে কত আদর করলে দেখলাম।’

ব্যোমকেশ ফিকা হাসিল,—‘আদর করিনি, সহানুভূতি জানাচ্ছিলাম।—কিন্তু আশ্চর্য, বনলক্ষ্মীর বাঁ হাতের তর্জনীর ডগায় কড়া পড়েছে।’

বলিলাম,—‘এ আর আশ্চর্য কি? যারা সেলাই করে তাদের আঙুলে কড়া পড়েই থাকে।’

ব্যোমকেশ চিন্তাক্রান্ত মুখে সিগারেটে একটা সুখ-টান দিয়া সেটা বাহিরে ফেলিয়া দিল। তারপর আবার লম্বা হইয়া শুইল।

সে-রাত্রে বাসায় ফিরিতে সাড়ে এগারোটা বাজিল। আর কোনও কথা হইল না, তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া শুইয়া পড়িলাম।