পরিশিষ্ট

ব্যোমকেশ ও বরদা – ৬

দুপুরবেলাটা ব্যোমকেশ অলসভাবে কাটাইয়া দিল। একবার ছেঁড়া কাগজখানা ও আঙুলের টিপ বাহির করিয়া অবহেলাভরে দেখিল; আবার সরাইয়া রাখিয়া দিল। তাহার মনের ক্রিয়া ঠিক বুঝিলাম না; কিন্তু বোধ হইল, এই হত্যার ব্যাপারে এতাবৎকাল সে যেটুকু আকর্ষণ অনুভব করিতেছিল তাহাও যেন নিবিয়া গিয়াছে।

অপরাহ্ণে বরদাবাবু আসিলেন। বলিলেন, ‘এখানে আমাদের বাঙালীদের একটা ক্লাব আছে, চলুন আজ আপনাদের সেখানে নিয়ে যাই।’

‘চলুন।’

দুইদিন এখানে আসিয়াছি কিন্তু এখনো স্থানীয় দ্রষ্টব্য বস্তু কিছুই দেখি নাই; তাই বরদাবাবু আমাদের কষ্টহারিণীর ঘাট, পীর-শানফার কবর ইত্যাদি কয়েকটা স্থান ঘুরাইয়া দেখাইলেন। তারপর সূর্যাস্ত হইলে তাঁহাদের ক্লাবে লইয়া চলিলেন।

কেল্লার বাহিরে ক্লাব। পথে যাইতে দেখিলাম—একটা মাঠের মাঝখানে প্রকাণ্ড তাঁবু পড়িয়াছে; তাহার চারিদিকে মানুষের ভিড়—তাঁবুর ভিতর হইতে উজ্জ্বল আলো এবং ইংরাজি বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ আসিতেছে।

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ওটা কি?’

‘একটা সার্কাস পার্টি এসেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখানে সার্কাস পার্টিও আসে নাকি?’

বরদাবাবু বলিলেন, ‘আসে বৈকি। বিলক্ষণ দু’পয়সা রোজগার করে নিয়ে যায়। এই তো গত বছর একদল এসেছিল—না, গত বছর নয়, তার আগের বছর।’

‘এরা কতদিন হল এসেছে?’

‘কাল শনিবার ছিল, কাল থেকে এরা খেলা দেখাতে শুরু করেছে।’

প্রসঙ্গত শহরের আমোদ-প্রমোদের অভাব সম্বন্ধে বরদাবাবু অভিযোগ করিলেন। মুষ্টিমেয় বাঙালীর মধ্যে চিরন্তন দলাদলি, তাই থিয়েটারের একটা সখের দল থাকা সত্ত্বেও অভিনয় বড় একটা ঘটিয়া ওঠে না; বাহির হইতে এক-আধটা কার্ণিভালের দল যাহা আসে তাহাই ভরসা। শুনিয়া খুব বেশি বিস্মিত হইলাম না। বাঙালীর বাস্তব জীবনে যে জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের অসদ্ভাব, তাহা সে থিয়েটারের রাজা বা সেনাপতি সাজিয়া মিটাইয়া লইতে চায়। তাই যেখানে দুইজন বাঙালী আছে সেইখানেই থিয়েটার ক্লাব থাকিতে বাধ্য এবং যেখানে থিয়েটার ক্লাব আছে সেখানে দলাদলি অবশ্যম্ভাবী। আমোদ-প্রমোদের জন্য চালানি মালের উপর নির্ভর করিতে হইবে ইহার আর বিচিত্র কি?

শুনিতে শুনিতে ক্লাবে আসিয়া পৌঁছিলাম।

ক্লাবের প্রবেশপথটি সঙ্কীর্ণ হইলেও ভিতরে বেশ সুপ্রসর। খানিকটা খোলা জায়গার উপর কয়েকখানি ঘর। আমরা প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, একটি ঘরে ফরাস পাতা, তাহার উপর বসিয়া কয়েকজন সভ্য ব্রিজ খেলিতেছেন; প্রতি হাত খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা সমালোচনায় মুখর হইয়া উঠিতেছেন, আবার খেলা আরম্ভ হইবামাত্র সকলে গম্ভীর ও স্বল্পবাক্ হইয়া পড়িতেছেন। ক্রীড়াচক্রের বাহিরে তাঁহাদের চিত্ত কোন অবস্থাতেই সঞ্চারিত হইতেছে না; আমরা দুইজন আগন্তুক আসিলাম তাহা কেহ লক্ষ্যই করিলেন না। ঘরের এক কোণে দুইটি সভ্য দাবার ছক লইয়া তুরীয় সমাধির অবস্থায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন, সুতরাং বাজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁহাদের কঠোর তপস্যা অপ্সরার ঝাঁক আসিয়াও ভাঙিতে পারিবে না।

পাশের ঘর হইতে কয়েকজন উত্তেজিত সভ্যের গলার আওয়াজ আসিতেছিল, বরদাবাবু আমাদের সেই ঘরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, একটি টেবিল বেষ্টন করিয়া কয়েকজন যুবক বসিয়া আছেন—তন্মধ্যে আমাদের পূর্বপরিচিত শৈলেনবাবুও বর্তমান। তাঁহাকে বাকি সকলে সপ্তরথীর মত ঘিরিয়া ফেলিয়াছেন এবং ভূতযোনি সম্বন্ধে নানাবিধ সুতীক্ষ্ণ ও সন্দেহমূলক বাক্যজালে বিদ্ধ করিয়া প্রায় ধরাশায়ী করিবার উপক্রম করিয়াছেন।

বরদাবাবুকে দেখিয়া শৈলেনবাবুর চোখে পরিত্রাণের আশা ফুটিয়া উঠিল, তিনি হাত বাড়াইয়া বলিলেন, ‘আসুন বরদাবাবু, এঁরা আমাকে একেবারে—; এই যে, ব্যোমকেশবাবু, আপনারাও এসেছেন। আসতে আজ্ঞা হোক।’

নবাগত দুইজনকে দেখিয়া তর্ক বন্ধ হইল। বরদাবাবু আমাদের পরিচয় দিয়া, আমরা উপবিষ্ট হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমরা এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলে কেন? কি হয়েছে?’

শৈলেনবাবু বলিলেন, ‘ওঁরা আমার ভূত দেখার কথা বিশ্বাস করছেন না, বলছেন ওটা আমারই মস্তিষ্কপ্রসূত একটা বায়বীয় মূর্তি।’

পৃথ্বীশবাবু নামক একটি ভদ্রলোক বলিলেন, ‘আমরা বলতে চাই, বরদার আষাঢ়ে গল্প শুনে শুনে ওঁর মনের অবস্থা এমন হয়েছে যে উনি ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখছেন। বস্তুত যেটাকে উনি ভূত মনে করছেন সেটা হয়তো একটা বাদুড় কিম্বা ঐ জাতীয় কিছু।’

শৈলেনবাবু বলিলেন, ‘আমি স্বীকার করছি যে আমি স্পষ্টভাবে কিছু দেখিনি। তবু বাদুড় যে নয় একথা আমি হলফ্‌ নিয়ে বলতে পারি। আর বরদাবাবুর গল্প শুনে আমি চোখের দৃষ্টিশক্তি হরিয়ে ফেলেছি এ অপবাদ যদি দেন—’

বরদাবাবু আমাদের দিকে নির্দেশ করিয়া গম্ভীর স্বরে কহিলেন, ‘এঁরা দু’জন কাল সকালে এখানে এসেছেন। এঁদেরও আমি গল্প শুনিয়ে বশীভূত করে ফেলেছি বলে সন্দেহ হয় কি?’

একজন প্রতিদ্বন্দ্বী বলিলেন, ‘না, তা হয় না। তবে সময় পেলে—’

বরদাবাবু বলিলেন, ‘ওঁরা কাল রাত্রে দেখেছেন।’

সকলে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া গেলেন। তারপর পৃথ্বীশবাবু ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সত্যি দেখেছেন?’

ব্যোমকেশ স্বীকার করিল, ‘হ্যাঁ।’

‘কি দেখেছেন?’

‘একটা মুখ।’

প্রতিদ্বন্দ্বীপক্ষ পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিতে লাগিলেন। তখন ব্যোমকেশ যে অবস্থায় ঐ মুখ দেখিয়াছিল তাহা বর্ণনা করিয়া বলিল। শুনিয়া সকলে নীরব হইয়া রহিলেন। বরদাবাবু ও শৈলেনবাবুর মুখে বিজয়ীর গর্বোল্লাস ফুটিয়া উঠিল।

অমূল্যবাবু এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন, তর্কে যোগ দেন নাই। তাঁহার মুখমণ্ডলে অনিচ্ছাপীড়িত প্রত্যয় এবং অবরুদ্ধ অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব চলিতেছিল। যাহা বিশ্বাস করিতে চাহি না, তাহাই অনন্যোপায় হইয়া বিশ্বাস করিতে হইলে মানুষের মনের অবস্থা যেরূপ হয় তাঁহার মনের অবস্থাও সেইরূপ—কোন প্রকারে এই অনীপ্সিত বিশ্বাসের মূল ছেদন করিতে পারিলে তিনি বাঁচেন। এইবার তিনি কথা কহিলেন, বিরুদ্ধতার শ্লেষ কণ্ঠ হইতে যথাসম্ভব অপসারিত করিয়া বলিলেন, ‘তা যেন হল, অনেকেই যখন দেখেছেন বলছেন—তখন না হয় ঘটনাটা সত্যি বলেই মেনে নেয়া গেল। কিন্তু কেন? বৈকুণ্ঠ জহুরী যদি ভূতই হয়ে থাকে তাহলে কৈলাসবাবুকে বিরক্ত করে তার কি লাভ হচ্ছে? এই কথাটা আমায় কেউ বুঝিয়ে দিতে পার?’

বরদাবাবু বলিলেন, ‘প্রেতযোনির উদ্দেশ্য সব সময় বোঝা যায় না। তবে আমার মনে হয় বৈকুণ্ঠবাবু কিছু বলতে চান।’

অমূল্যবাবু বিরক্তভাবে বলিলেন, ‘বলতে চান তো বলছেন না কেন?’

‘সুযোগ পাচ্ছেন না। তাঁকে দেখেই আমরা এত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছি যে তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে। তাছাড়া, প্রেতাত্মার মূর্তি পরিগ্রহ করবার ক্ষমতা থাকলেও কথা কইবার ক্ষমতা সর্বত্র থাকে না। এক্‌টোপ্লাজ্‌ম্‌ নামক যে-বস্তুটা মূর্তি-গ্রহণের উপাদান—’

‘পাণ্ডিত্য ফলিও না বরদা। Spiritualism-এর বইগুলো যে ঝাড়া মুখস্থ করে রেখেছ তা আমরা জানি। কিন্তু তোমার বৈকুণ্ঠবাবু যদি কথাই না বলতে পারবেন তবে নিরীহ একটি ভদ্রলোককে নাহক জ্বালাতন করছেন কেন?’

‘মুখে কথা বলতে না পারলেও তাঁকে কথা বলাবার উপায় আছে।’

‘কি উপায়?’

‘টেবিল চালা।’

‘ও—সেই তেপায়া টেবিল? সে তো জুচ্চুরি।’

‘কি করে জানলে? কখনো পরীক্ষা করে দেখেছ?’

অমূল্যবাবুকে নীরব হইতে হইল। তখন বরদাবাবু আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘দেখুন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস বৈকুণ্ঠবাবুর কিছু বক্তব্য আছে; হয়তো তিনি হত্যাকারীর নাম বলতে চান। আমাদের উচিত তাঁকে সাহায্য করা। টেবিল চেলে তাঁকে ডাকলে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করতে পারেন। টেবিল চালিয়ে দেখবেন?’

ভূত নামানো কখনও দেখি নাই; ভারি আগ্রহ হইল। বলিলাম, ‘বেশ তো, করুন না। এখনি করবেন?’

বরদাবাবু বলিলেন, ‘দোষ কি? এইখানেই করা যাক—কি বল তোমরা? ভূত যদি নামে, তোমাদের সকলেরই সন্দেহ ভঞ্জন হবে।’

সকলেই সোৎসাহে রাজী হইলেন।

একটি ছোট টিপাই তৎক্ষণাৎ আনানো হইল। বরদাবাবু বলিলেন যে, বেশি লোক থাকিলে চক্র হইবে না, তাই পাঁচজনকে বাছিয়া লওয়া হইল। বরদাবাবু, ব্যোমকেশ, শৈলেনবাবু, অমূল্যবাবু ও আমি রহিলাম। বাকি সকলে পাশের ঘরে গিয়া বসিলেন।

আলো কমাইয়া দিয়া আমরা পাঁচজন টিপাইয়ের চারিদিকে চেয়ার টানিয়া বসিলাম। কি করিতে হইবে বরদাবাবু সংক্ষেপে বুঝাইয়া দিলেন। তখন টিপাইয়ের উপর আলগোছে হাত রাখিয়া পরস্পর আঙুলে আঙুল ঠেকাইয়া মুদিত চক্ষে বৈকুণ্ঠবাবুর ধ্যান শুরু করিয়া দিলাম। ঘরের মধ্যে আবছায়া অন্ধকার ও অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করিতে লাগিল।

পাঁচ মিনিট এইভাবে কাটিল। ভূতের দেখা নাই। মনে আবোল-তাবোল চিন্তা আসিতে লাগিল; জোর করিয়া মনকে বৈকুণ্ঠবাবুর ধ্যানে জুড়িয়া দিতে লাগিলাম। এইরূপ টানাটানিতে বেশ অধীর হইয়া উঠিয়াছি, এমন সময় মনে হইল টিপাইটা যেন একটু নড়িল। হঠাৎ দেহে কাঁটা দিয়া উঠিল। স্থির হইয়া বসিয়া রহিলাম, আঙুলের স্নায়ুগুলা নিরতিশয় সচেতন হইয়া রহিল।

আবার টিপাই একটু নড়িল, যেন ধীরে ধীরে আমার হাতের নীচে ঘুরিয়া যাইতেছে।

বরদাবাবুর গম্ভীর স্বর শুনিলাম—‘বৈকুণ্ঠবাবু এসেছেন কি? যদি এসে থাকেন একবার টোকা দিন।’

কিছুক্ষণ কোন সাড়া নাই। তারপর টিপাইয়ের একটা পায়া ধীরে ধীরে শূন্যে উঠিয়া ঠক্‌ করিয়া মাটিতে পড়িল।

বরদাবাবু গম্ভীর অথচ অনুচ্চ স্বরে কহিলেন, ‘আবির্ভাব হয়েছে!’

স্নায়ুর উত্তেজনা আরো বাড়িয়া গেল; কান ঝাঁ ঝাঁ করিতে লাগিল। চক্ষু মেলিয়া কিন্তু একটা বিস্ময়ের ধাক্কা অনুভব করিলাম। কি দেখিব আশা করিয়াছিলাম জানি না, কিন্তু দেখিলাম যেমন পাঁচজন আধা অন্ধকারে বসিয়াছিলাম তেমনি বসিয়া আছি, কোথাও কোন পরিবর্তন হয় নাই। ইতিমধ্যে যে একটা গুরুতর রকম অবস্থান্তর ঘটিয়াছে—এই ঘরে আমাদেরই আশেপাশে কোথাও অশরীরী আত্মা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে—তাহা বুঝিবার উপায় নাই।

বরদাবাবু নিম্নস্বরে আমাদের বলিলেন, ‘আমিই প্রশ্ন করি—কি বলেন?’

আমরা শিরঃসঞ্চালনে সম্মতি জানাইলাম। তখন তিনি ধীর গম্ভীরকণ্ঠে প্রেতযোনিকে প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিলেন—

‘আপনি কি চান?’

কোনো উত্তর নাই। টিপাই অচল হইয়া রহিল।

‘আপনি বারবার দেখা দিচ্ছেন কেন?’

মনে হইল টিপাই একটু নড়িল। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও স্পষ্ট কিছু বুঝিতে পারা গেল না।

‘আপনার কিছু বক্তব্য আছে?’

এবার টিপাইয়ের পায়া স্পষ্টত উঠিতে লাগিল। কয়েকবার ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ হইল—অর্থ কিছু বোধগম্য হইল না।

বরদাবাবু কহিলেন, ‘যদি হ্যাঁ বলতে চান একবার টোকা দিন, যদি না বলতে চান দু’বার টোকা দিন।’

একবার টোকা পড়িল।

দেখিলাম, পরলোকের সহিত ভাব বিনিময়ের প্রণালী খুব সরল নয়। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনোক্রমে বোঝানো যায়। কিন্তু বিস্তারিতভাবে মনের কথা প্রকাশ করা অশরীরীর পক্ষে বড় কঠিন। কিন্তু তবু মানুষের বুদ্ধি দ্বারা সে বাধাও কিয়ৎপরিমাণে উল্লঙ্ঘিত হইয়াছে—সংখ্যার দ্বারা অক্ষর বুঝাইবার রীতি আছে। বরদাবাবু সেই রীতি অবলম্বন করিলেন; প্রেতযোনিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘আপনি যা বলতে চান, অক্ষর গুণে গুণে টোকা দিন, তাহলে আমরা বুঝতে পারব।’

তখন টেলিগ্রাফে কথা আরম্ভ হইল। টিপাইয়ের পায়া ঠক্ করিয়া কয়েকবার নড়ে, আবার স্তব্ধ হয়; আবার নড়ে—আবার স্তব্ধ হয়। এইভাবে দীর্ঘকাল ধরিয়া যে কথাগুলি অতি কষ্টে বাহির হইয়া আসিল তাহা এই—

বাড়ি—ছেড়ে—যাও—নচেৎ—অমঙ্গল—

টিপাইয়ের শেষ শব্দ থামিয়া যাইবার পর আমরা কিছুক্ষণ ভয়স্তম্ভিতবৎ বসিয়া রহিলাম। তারপর বরদাবাবু গলাটা একবার ঝাড়িয়া লইয়া বলিলেন, ‘আপনার বাড়ি যাতে ছেড়ে দেওয়া হয় আমরা তার চেষ্টা করব। আর কিছু বলতে চান কি?’

টিপাই স্থির।

আমার হঠাৎ একটা কথা মনে হইল, বরদাবাবুকে চুপি চুপি বলিলাম, ‘হত্যাকারী কে জিজ্ঞাসা করুন।’

বরদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন। খানিকক্ষণ কোন উত্তর আসিল না; তারপর পায়া উঠিতে আরম্ভ করিল।

তা—রা—তা—রা—তা—রা—

হঠাৎ টিপাই কয়েকবার সজোরে নড়িয়া উঠিয়া থামিয়া গেল। বরদাবাবু কম্পিতস্বরে প্রশ্ন করিলেন, ‘কি বললেন, বুঝতে পারলুম না। ‘তারা’—কি? কারুর নাম?’

টিপাইয়ে সাড়া নাই।

আবার প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি কি আছেন?’

কোনো উত্তর আসিল না, টিপাই জড় বস্তুতে পরিণত হইয়াছে।

তখন বরদাবাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, ‘চলে গেছেন।’

ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া আলোটা উজ্জ্বল করিয়া দিল; তারপর সকলের হাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া নেহাৎ অরসিকের মত বলিল, ‘মাফ করবেন, এখন কেউ টিপাই থেকে হাত তুলবেন না। আপনাদের হাত আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’

বরদাবাবু ঈষৎ হাসিলেন—‘আমরা কেউ হাতে আঠা লাগিয়ে রেখেছি কিনা দেখতে চান? বেশ—দেখুন।’

ব্যোমকেশের ব্যবহারে আমি বড় লজ্জিত হইয়া পড়িলাম। এমন খোলাখুলিভাবে এতগুলি ভদ্রলোককে প্রবঞ্চক মনে করা নিতান্তই শিষ্টতা-বিগর্হিত। তাহার মনে একটা প্রবল সংশয় জাগিয়াছে সত্য—কিন্তু তাই বলিয়া এমন কঠোরভাবে সত্য পরীক্ষা করিবার তাহার কোন অধিকার নাই। সকলেই হয়তো মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইলেন; কিন্তু ব্যোমকেশ নির্লজ্জভাবে প্রত্যেকের হাত পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়া দিল। এমন কি আমাকেও বাদ দিল না।

কিন্তু কাহারো হাতেই কিছু পাওয়া গেল না। ব্যোমকেশ তখন দুই করতলে গণ্ড রাখিয়া টিপাইয়ের উপর কনুই স্থাপনপূর্বক শূন্যদৃষ্টিতে আলোর দিকে তাকাইয়া রহিল।

বরদাবাবু খোঁচা দিয়া বলিলেন, ‘কিছু পেলেন না?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আশ্চর্য! এ যেন কল্পনা করাও যায় না।’

বরদাবাবু প্রসন্নস্বরে বলিলেন ‘There are more things—’

অমূল্যবাবুর বিরুদ্ধতা একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল, তিনি অসংযতকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, ‘কিন্তু—‘তারা’ ‘তারা’ কথার মানে কেউ বুঝতে পারলে?’

সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিলেন। আমার মাথায় হঠাৎ বিদ্যুতের মত খেলিয়া গেল—তারাশঙ্কর। আমি ঐ নামটাই উচ্চারণ করিতে যাইতেছিলাম, ব্যোমকেশ আমার মুখে থাবা দিয়া বলিল, ‘ও আলোচনা না হওয়াই ভাল।’

বরদাবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা যা জানতে পেরেছি তা আমাদের মনেই থাক।’ সকলে তাঁহার কথায় গম্ভীর উদ্বিগ্নমুখে সায় দিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজকের অভিজ্ঞতা বড় অদ্ভুত—এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু না করেও উপায় নেই। বরদাবাবু, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

বাড়ি ফিরিবার পথে বরদাবাবুর সহিত শৈলেনবাবু এবং অমূল্যবাবু আমাদের সাথী হইলেন। তাঁহাদের বাসা কেল্লার মধ্যে।

আমাদের বাসা নিকটবর্তী হইলে শৈলেনবাবু বলিলেন, ‘একলা বাসায় থাকি, আজ রাত্রে দেখছি ভাল ঘুম হবে না।’

বরদাবাবু বলিলেন, ‘আপনার আর ভয় কি? ভয় কৈলাসবাবুর। —আচ্ছা, ওঁকে বাড়ি ছাড়াবার কি করা যায় বলুন তো?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওঁকে ও-বাড়ি ছাড়াতেই হবে। আপনারা তো চেষ্টা করছেনই, আমিও করব। কৈলাসবাবু অবুঝ লোক, তবু ওঁর ভালর জন্যই আমাদের করতে হবে।—কিন্তু বাড়ি পৌঁছে যাওয়া গেছে, আর আপনারা কষ্ট করবেন না। নমস্কার।’

তিনজনে শুভনিশি জ্ঞাপন করিয়া ফিরিয়া চলিলেন। অমূল্যবাবুর কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম—‘শৈলেনবাবু, আপনি বরং আজকের রাতটা আমার বাসাতেই থাকবেন চলুন। আপনিও একলা থাকেন, আমার বাসাতেও উপস্থিত আমি ছাড়া আর কেউ নেই—’

বুঝিলাম টেবিল চালার ব্যাপার সকলের মনের উপরেই আতঙ্কের ছায়া ফেলিয়াছে।