পরিশিষ্ট

বহ্নি-পতঙ্গ – ২

দুই

পরদিন সন্ধ্যা আন্দাজ সাতটার সময় পাণ্ডেজি আসিয়া আমাদের মোটরে তুলিয়া দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে লইয়া গেলেন।

দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ি শহরের প্রাচীন অংশে। সাবেক কালের বিরাট দ্বিতল বাড়ি, জেলখানার মত উঁচু প্রাচীর দিয়া ঘেরা। আমরা উপস্থিত হইয়া দেখিলাম বাড়ি ও বাগানে জাপানী ফানুসের ঝাড় জ্বলিতেছে, অতি মৃদু শানাই বাজিতেছে, বহু অতিথির সমাগম হইয়াছে। একতলার বড় হলঘরটিতেই সমাগম বেশি, আশেপাশের ঘরগুলিতেও অতিথিরা বসিয়াছেন। কোনও ঘরে ব্রিজের আড্ডা বসিয়াছে, কোনও ঘরে বয়স্থ হাকিম শ্রেণীর অতিথিরা নিজেদের মধ্যে একটু স্বতন্ত্র গণ্ডী রচনা করিয়া গল্পগুজব করিতেছেন। তক্‌মা আঁটা ভৃত্যেরা চা, কফি ও বলবত্তর পানীয় লইয়া ঘোরাঘুরি করিতেছে।

হল-ঘরটি বৃহৎ, বিলাতি প্রথায় স্থানে স্থানে সোফা-সেট দিয়া সজ্জিত। প্রত্যেক সোফা-সেটে একটি দল বসিয়াছে। ঘরের মধ্যস্থলে সদর দরজার সম্মুখে একটি পালঙ্কের মত আসন। তাহার উপর তাকিয়া ঠেস্‌ দিয়া বসিয়া আছেন একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, ইনিই গৃহস্বামী দীপনারায়ণ সিং। গায়ে লম্বা গরম কোট, গলায় পশমের গলাবন্ধ। চেহারা ভাল, পঞ্চাশ বছর বয়সে এমন কিছু স্থবির হইয়া পড়েন নাই, কিন্তু মুখের পাণ্ডুর শীর্ণতা হইতে অনুমান করা যায় দীর্ঘ রোগ-ভোগ করিয়া সম্প্রতি আরোগ্যের পথে পদার্পণ করিয়াছেন। পরম সমাদরে দুই হাতে আমাদের করমর্দন করিলেন।

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আপনার রোগমুক্তির জন্য ‘অভিনন্দন জানাই।’

দীপনারায়ণ শীর্ণ মুখে মিষ্ট হাসিলেন, ‘বহুৎ ধন্যবাদ। বাঁচবার আশা ছিল না পাণ্ডেজি, নেহাৎ ডাক্তার পালিত ছিলেন তাই এ যাত্রা বেঁচে গেছি।’ বলিয়া ঘরের কোণের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।

ঘরের কোণে একটি সোফায় কোট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক একাকী বসিয়া ছিলেন; দোহারা গড়ন, বেশভূষার বিশেষ পারিপাট্য নাই, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। অঙ্গুলি নির্দেশ লক্ষ্য করিয়া তিনি আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। পরিচয় হইল। দীপনারায়ণ সিং বলিলেন, ‘এঁরই গুণে আমার পুনর্জন্ম হয়েছে।’

ডাক্তার পালিত যেন একটু অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলেন। তিনি গম্ভীর প্রকৃতির লোক, একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘ডাক্তারের যা কর্তব্য তার বেশি তো কিছুই করিনি। —তাছাড়া, চিকিৎসা আমি করলেও শহরের বড় বড় ডাক্তার সকলেই দেখেছেন। ত্রিদিববাবু—’

পাণ্ডেজি প্রশ্ন করিলেন, ‘রোগটা কি হয়েছিল?’

ডাক্তার পালিত বিলাতি নিদানশাস্ত্র সম্মত রোগের যে সকল লক্ষণ বলিলেন তাহা হইতে অনুমান করিলাম, নানা জাতীয় দুষ্ট বীজাণু লিভারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়া রক্তাল্পতা ঘটাইয়াছিল এবং হৃদ্‌পিণ্ডকে জখম করিবার তালে ছিল, ইন্‌জেকশন প্রভৃতি আসুরিক চিকিৎসার দ্বারা তাহাদের বশে আনিতে হইয়াছে। এখন অবশ্য রোগীর অবস্থা খুবই ভাল, তবু তাঁহার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইয়াছে।

এই সময় পিছন দিকে নাক ঝাড়ার মত একটা শব্দ শুনিয়া চমকিয়া ফিরিয়া দেখি, একটি যুবক আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং নাকের মধ্যে শব্দ করিয়া বোধকরি উপেক্ষা জ্ঞাপন করিতেছে। যুবকের চেহারা কৃকলাসের মত, অঙ্গে ফ্যাশন-দুরস্ত বিলাতি সাজপোশাক, মুখে ব্যঙ্গ দম্ভ। দীপনারায়ণ পরিচয় করাইয়া দিলেন—ইনি ডাক্তার জগন্নাথ প্রসাদ, একজন নবীন বিহারী ডাক্তার।’ ডাক্তার অবজ্ঞাভরে আমাদের দিকে ঘাড় নাড়িলেন এবং যে কয়টি কথা বলিলেন তাহা হইতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, প্রবীণ ডাক্তারদের প্রতি তাঁহার অশ্রদ্ধার অন্ত নাই, বিশেষত যদি তাঁহারা বাঙালী ডাক্তার হন। দীপনারায়ণ সিং-এর চিকিৎসার ভার কয়েকজন বুড়া বাঙালী ডাক্তারকে না দিয়া, তাঁহার হাতে অর্পণ করিলে তিনি পাঁচ দিনে রোগ আরাম করিয়া দিতেন। তাঁহার কথা শুনিয়া দীপনারায়ণ সিং মুখ বাঁকাইয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। ডাক্তার পালিত বিরক্ত হইয়া আবার পূর্বস্থানে গিয়া বসিলেন। ডাক্তার জগন্নাথ আরও কিছুক্ষণ বক্তৃতা দিয়া, অদূরে পানীয়বাহী একজন ভৃত্যকে দেখিয়া হ্রেষাধ্বনি করিতে করিতে সেইদিকে ধাবিত হইলেন।

দীপনারায়ণ সিং লজ্জা ও ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বলিলেন, ‘এরাই হচ্ছে নতুন যুগের বিহারী। এদের কাছে গুণের আদর নেই, সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে এরা শুধু নিজের সুবিধা করে নিতে চায়। আজ বিহারে বাঙালীর কদর কমে যাচ্ছে, এরাই তার জন্যে দায়ী।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘হয়তো বাঙালীরও দোষ আছে।’

দীপনারায়ণ বলিলেন, ‘হয়তো আছে। কিন্তু পরিহাস এই যে, এরা যখন রোগে পড়ে, যখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়, তখন এরাই ছুটে যায় বাঙালী ডাক্তারের কাছে।’

এই অপ্রীতিকর প্রাদেশিক প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়ায় আমরা একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িতেছিলাম, কিন্তু পাণ্ডেজি তাহা সরল করিয়া দিলেন, দুই চারিটা অন্য কথা বলিয়া আমাদের লইয়া গিয়া যেখানে ডাক্তার পালিত বসিয়া ছিলেন সেইখানে বসাইলেন।

আমরা উপবিষ্ট হইলে ডাক্তার পালিত একটু অল্প হাসিয়া বলিলেন, ‘ঘোড়া জগন্নাথ আর কি কি বললে?’

পাণ্ডেজি হাসিয়া উঠিলেন, ‘ওর নাম বুঝি ঘোড়া জগন্নাথ? খাসা নাম, ভারি লাগ-সৈ হয়েছে। কিন্তু ওদের কথায় আপনি কান দেবেন না ডাক্তার। ওদের কথা কে গ্রাহ্য করে?’

পালিত বলিলেন, ‘কান না দিয়ে উপায় কি? ওরা যে দল বেঁধে প্রচার কার্য করে বেড়াচ্ছে। যারা বুদ্ধিমান তারা হয়তো গ্রাহ্য করে না, কিন্তু সাধারণ লোকে ওদের কথাই শোনে।’

আমাদের আলোচনা হয়তো আর কিছুক্ষণ চলিত কিন্তু হঠাৎ পাশের দিকে একটা অদ্ভুত ধরনের হাসির শব্দে তাহাতে বাধা পড়িল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখি, অদূরে অন্য একটি সোফা-সেটে তিনটি লোক আসিয়া বসিয়াছে; তাহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি উচ্চকণ্ঠে হাস্য করিতেছে তাহার দেহায়তন এতই বিপুল যে সে একাই সমস্ত সোফাটি জুড়িয়া বসিয়াছে। ব্যুঢ়োরস্ক গজস্কন্ধ যুবক, চিবুক হইতে নিতম্ব পর্যন্ত থরে থরে চর্বির তরঙ্গ নামিয়াছে। তাহার কণ্ঠ হইতে যে বিচিত্র হাস্যধ্বনি নির্গত হইতেছে তাহা যে একই কালে একই মানুষের কণ্ঠ হইতে বাহির হইতে পারে তাহা প্রত্যক্ষ না করিলে বিশ্বাস করা কঠিন। একসঙ্গে যদি গোটা দশেক শৃগাল হুক্কাহুয়া করিয়া ডাকিয়া ওঠে এবং সেই সঙ্গে কয়েকটা পেঁচোয় পাওয়া আঁতুড়ে ছেলে কান্না জুড়িয়া দেয় তাহা হইলে বোধহয় এই শব্দ-সংগ্রামের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

অন্য লোক দুটি নীরবে বসিয়া মুচকি হাসিতেছিল। আশ্চর্য এই যে মোটা যুবকটি যে-পরিমাণে মোটা, তাহার সঙ্গী দুটি ঠিক সেই পরিমাণে রোগা। ইহাদের তিনজনের দেহের মেদ মাংস সমানভাবে বাঁটিয়া দিলে বোধকরি তিনটি হৃষ্টপুষ্ট সাধারণ মানুষ পাওয়া যায়।

বলা বাহুল্য হাসির এই অট্টরোলে ঘরসুদ্ধ লোকের সচকিত দৃষ্টি সেইদিকে ফিরিয়াছিল। একটি রেশমী পাগড়ি-পরা কৃশকায় বৃদ্ধ কোথা হইতে আবির্ভূত হইয়া দ্রুত সেইদিকে অগ্রসর হইলেন।

ব্যোমকেশ ডাক্তার পালিতকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল, ‘গজকচ্ছপটি কে?’

ডাক্তার পালিত মুখ টিপিয়া বলিলেন, ‘দীপনারায়ণবাবুর ভাইপো দেবনারায়ণ। একটি আস্ত—’ কথাটা ডাক্তার শেষ করিলেন না, কিন্তু তাঁহার অনুচ্চারিত বিশেষ্যটি স্পষ্টই বোঝা গেল। ইহাকেই উদ্দেশ্য করিয়া কাল পাণ্ডেজি বলিয়াছিলেন—ঘোর অপদার্থ। শুধু অপদার্থই নয়, বুদ্ধিসুদ্ধিও শরীরের অনুরূপ। পাগড়ি-পরা বৃদ্ধটি আসিয়া রোগা যুবক দুটিকে কানে কানে কিছু বলিলেন, মনে হইল তিনি তাহাদের মৃদু র্ভৎসনা করিলেন। রোগা লোক দুটিও যেন অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়াছে এইভাবে ভিজা বিড়ালের মত চক্ষু নত করিয়া রহিল। গজকচ্ছপের হাসি তখনও থামে নাই, তবে মন্দীভূত হইয়া আসিয়াছে। বৃদ্ধ তাহার পিছনে গিয়া দাঁড়াইলেন এবং কানের কাছে নত হইয়া কিছু বলিলেন। হঠাৎ ব্রেককষা গাড়ির মত গজকচ্ছপের হাসি হেঁচকা দিয়া থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ পূর্ববৎ ডাক্তার পালিতকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘রোগা লোক দুটি কে?’

পালিত বলিলেন, ‘ওই যেটির কোঁকড়া চুল কাঁকড়া গোঁফ ও হচ্ছে দেবনারায়ণের বিদূষক, মানে ইয়ার। নাম বেণীপ্রসাদ। অন্যটির নাম লীলাধর বংশী—দীপনারায়ণবাবুর স্টেটের অ্যাসিস্‌ট্যাণ্ট ম্যানেজার এবং দেবনারায়ণের অ্যাসিস্‌ট্যাণ্ট বিদূষক।’

‘আর বৃদ্ধটি?’

‘বৃদ্ধটি লীলাধরের বাবা গঙ্গাধর বংশী, স্টেটের বড় কর্তা, অর্থাৎ ম্যানেজার। গভীর জলের মাছ।’

গভীর জলের মাছটি একবার চক্ষু তুলিয়া আমাদের পানে চাহিলেন এবং মন্দমধুর হাস্যে আমাদের অভিসিঞ্চিত করিয়া অন্যত্র প্রস্থান করিলেন। দেবনারায়ণ নিজ ঝকমকে শার্কস্কিনের গলাবন্ধ কোটের পকেট হইতে একটি সুবৃহৎ পানের ডিবা বাহির করিয়া কয়েকটা পান গালে পুরিয়া গুরু গম্ভীর মুখে চিবাইতে লাগিল। এই লোকটাই কিছুক্ষণ পূর্বে হট্টগোল করিয়া হাসিতেছিল তাহা আর বোঝা যায় না।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘হাসির কারণটা কী কিছু বুঝতে পারলেন?’

পালিত বলিলেন, ‘বোধহয় বিদূষকেরা রসের কথা কিছু বলেছিল তাই এত হাসি।’

একজন ভৃত্য রূপার থালায় সোনালী তবক মোড়া পান ও সিগারেট লইয়া উপস্থিত হইল। আমরা সিগারেট ধরাইলাম। ব্যোমকেশ এদিকে ওদিকে চাহিয়া পাণ্ডেজিকে বলিল, ‘ইন্সপেক্টর রতিকান্তকে দেখছি না।’

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘হয়তো অন্য ঘরে আছে। কিম্বা হয়তো থানায় আটকে গেছে। আসবে নিশ্চয়। আপনারা বসুন, আমি একবার কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দুটো কথা বলে আসি।’

পাণ্ডেজি উঠিয়া গেলেন। আমরা তিনজনে বসিয়া সিগারেট টানিতে টানিতে ঘরের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অতিথিগুলিকে দর্শন করিতে লাগিলাম। অতিথিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি, দু’ একটি স্ত্রীলোক আছেন।

এই সময় ঘরের অন্য প্রান্তের একটি দ্বার দিয়া এক মহিলা প্রবেশ করিলেন। ঘরে বেশ উজ্জ্বল আলো ছিল, এখন মনে হইল কেবলমাত্র এই মহিলাটির আবির্ভাবে ঘরটি উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। তিনি কোন্‌ রঙের শাড়ি পরিয়াছেন, কী কী গহনা পরিয়াছেন কিছুই চোখে পড়িল না, কেবল দেখিলাম, আলোকের একটি সঞ্চরমাণ উৎস ধীরে ধীরে আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। ঘরের মধ্যে যাঁহারা ছিলেন সকলেই সচকিত হইয়া উঠিলেন, কেহ কেহ উঠিয়া দাঁড়াইয়া নমস্কার করিলেন। মহিলাটি হাসিমুখে লীলায়িত ভঙ্গিমায় সকলকে অভ্যর্থনা করিতে করিতে আমাদের দিকেই আসিতে লাগিলেন।

ডাক্তার পালিত অ্যাশ-ট্রের উপর সিগারেট ঘসিয়া নিভাইলেন, মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘মিসেস দীপনারায়ণ—শকুন্তলা।’

রূপসী বটে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের কম হইবে না, কিন্তু সর্বাঙ্গে পরিপূর্ণ যৌবনের মদোদ্ধত লাবণ্য যেন ফাটিয়া পড়িতেছে। আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এইরূপ লাবণ্যবতী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা রমণী হয়তো দুই চারিটি দেখা যায়, কিন্তু এদিকে বেশি দেখা যায় না। শকুন্তলা নামটিও যেন রূপের সঙ্গে ছন্দ রক্ষা করিয়াছে। শকুন্তলা—অপ্সরাকন্যা শকুন্তলা—যাহাকে দেখিয়া দুষ্মন্ত ভূলিয়াছিলেন। দীপনারায়ণ সিং প্রৌঢ় বয়সে কেন অসবর্ণ বিবাহ করিয়াছেন তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না।

শকুন্তলা আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, আমরা সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিলাম। ডাক্তার পালিত পরিচয় করাইয়া দিলেন। শকুন্তলা অতি মিষ্ট স্বরে দুই চারিটি সাদর সম্ভাষণের কথা বলিলেন, তাহাতে তাঁহার গৃহিণীসুলভ সৌজন্য এবং তরুণীসুলভ শালীনতা দুইই প্রকাশ পাইল। তারপর তিনি অন্যদিকে ফিরিলেন।

এই সময় লক্ষ্য করিলাম শকুন্তলা একা নয়, তাঁহার পিছনে আর একটি যুবতী রহিয়াছেন। সূর্যের প্রভায় যেমন শুকতারা ঢাকা পড়িয়া যায়, এতক্ষণ এই যুবতী তেমনি ঢাকা পড়িয়া ছিলেন; এখন দেখিলাম তাঁহার কোলে একটি বছর দেড়েকের ছেলে। বস্তুত এই ছেলেটি হঠাৎ ট্যাঁ, করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়াই যুবতীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। যুবতী শকুন্তলার চেয়ে। বোধহয় দু’ এক বছরের ছোটই হইবেন; সুশ্রী গৌরাঙ্গী, মোটাসোটা ঢিলাঢালা গড়ন, মহার্ঘ বস্ত্র ও গহনার ভারে যেন নড়িতে পারিতেছেন না। তাঁহার বেশবাসের মধ্যে প্রাচুর্য আছে কিন্তু নিপুণতা নাই। তাছাড়া মনে হয় প্রকাশ্যভাবে পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করিতে তিনি অভ্যস্ত নন, পর্দার ঘোর এখনও কাটে নাই।

শিশু কাঁদিয়া উঠিতেই শকুন্তলা পিছু ফিরিয়া চাহিলেন। তাঁহার মুখে একটু অপ্রসন্নতার ছায়া পড়িল, তিনি বলিলেন, ‘চাঁদনী, খোকাকে এখানে এনেছ কেন? যাও, ওকে নার্সের কাছে রেখে এস।’

প্রভুভক্ত কুকুর প্রভুর ধমক খাইয়া যেভাবে তাকায়, যুবতীও সেইভাবে শকুন্তলার মুখের পানে চাহিলেন, তারপর নম্রভাবে ঘাড় হেলাইয়া শিশুকে লইয়া যে পথে আসিয়াছিলেন সেই পথে ফিরিয়া চলিলেন।

দীপনারায়ণ দূর হইতে স্ত্রীকে আহ্বান করিলেন—‘শকুন্তলা!’ কয়েকজন হোমরাচোমরা অতিথি আসিয়াছেন।

শকুন্তলা সেই দিকে গেলেন। পাশের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া দেখিলাম, দেবনারায়ণ কোলা ব্যাঙের মত ড্যাবডেবে চোখ মেলিয়া শকুন্তলার পানে চাহিয়া আছে।

আমরা আবার সিগারেট ধরাইলাম। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘দ্বিতীয় মহিলাটি কে?’

ডাক্তার পালিত অন্যমনস্কভাবে বলিলেন, ‘দেবনারায়ণের স্ত্রী। ছেলেটিও দেবনারায়ণের।’

লক্ষ্য করিলাম ডাক্তার পালিতের কপালে একটু ভ্রূকুটির চিহ্ন। তাঁহার চক্ষুও শকুন্তলাকে অনুসরণ করিতেছে।

তারপর আমরা অনেকক্ষণ বসিয়া ধূমপান করিতে করিতে সময় কাটাইলাম। ডাক্তার পালিত অন্যমনস্ক হইয়া রহিলেন এবং তাঁহার চক্ষু দুটি ঈষৎ উদ্বিগ্নভাবে শকুন্তলাকে অনুসরণ করিতে লাগিল।

সাড়ে আটটার সময় আহারের আহ্বান আসিল।

অন্য একটি হল-ঘরে টেবিল পাতিয়া আহারের ব্যবস্থা। রাজকীয় আয়োজন। কলিকাতার কোন বিলাতি হোটেল হইতে পাচক ও পরিবেশক আসিয়াছে। আহার শেষ করিয়া উঠিতে পৌনে দশটা বাজিল।

বাহিরের হল-ঘরে আসিয়া পান সিগারেট সেবনে যত্নবান হইলাম। ডাক্তার পালিত একটি পরিতৃপ্ত উদগার তুলিয়া বলিলেন, ‘মন্দ হল না। —আচ্ছা, আজ চলি, রাত্তিরে বোধহয় একবার রুগী দেখতে বেরুতে হবে। আবার কাল সকালেই দীপনারায়ণবাবুকে ইন্‌জেকশন দিতে আসব।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখনও ইন্‌জেকশন চলছে নাকি?’

পালিত বলিলেন, ‘হ্যাঁ, এখনও হপ্তায় একটা করে লিভার দিচ্ছি। আর গোটা দুই দিয়ে বন্ধ করে দেব। আচ্ছা—নমস্কার। আপনারা তো এখনও আছেন, দেখা হবে নিশ্চয়—’

তিনি প্রস্থানের জন্য পা বাড়াইয়াছেন এমন সময় দেখিলাম সদর দরজা দিয়া ইন্সপেক্টর রতিকান্ত চৌধুরী প্রবেশ করিতেছে। তাহার পরিধানে পুলিসের বেশ, কেবল মাথায় টুপি নাই। একটু ব্যস্তসমস্ত ভাব। দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া সে একবার ঘরের চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল, তারপর ডাক্তার পালিতকে দেখিতে পাইয়া দ্রুত আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

‘ডাক্তার পালিত, একটা খারাপ খবর আছে। আপনার ডিস্‌পেনসারিতে চুরি হয়েছে।’

‘চুরি!’

রতিকান্ত বলিল, ‘হ্যাঁ। আন্দাজ ন’টার সময় আমি থানা থেকে বেরিয়ে এখানে আসছিলাম, পথে নজর পড়ল ডিস্‌পেনসারির দরজা খোলা রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি দরজার তালা ভাঙা। ভেতরে গিয়ে দেখলাম আপনার টেবিলের দেরাজ খোলা, চোর দেরাজ ভেঙে টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়েছে। আমি একজন কনস্টেবলকে বসিয়ে এসেছি। আপনি যান। দেরাজে কি টাকা ছিল?’

পালিত হতবুদ্ধি হইয়া বলিলেন, ‘টাকা! রাত্রে বেশি টাকা তো থাকে না, বড় জোর দু’চার টাকা ছিল।’

‘তবু আপনি যান। টাকা ছাড়া যদি আর কিছু চুরি গিয়ে থাকে আপনি বুঝতে পারবেন।’

‘আমি এখনি যাচ্ছি।’

‘আর, টাকা ছাড়া যদি অন্য কিছু চুরি গিয়ে থাকে আজ রাত্রেই থানায় এত্তালা পাঠিয়ে দেবেন।’

শকুন্তলা ও পাণ্ডেজি দূরে দাঁড়াইয়া বাক্যালাপ করিতেছিলেন, আমাদের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ্য করিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। পাণ্ডেজি প্রশ্ন করিলেন, ‘কি হয়েছে?’

ডাক্তার পালিত দাঁড়াইলেন না, তাড়াতাড়ি চলিয়া গেলেন। রতিকান্ত চুরির কথা বলিল। তারপর শকুন্তলার দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘আমার বড় দেরি হয়ে গেল—খেতে পাবো তো?’

শকুন্তলা একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘পাবেন। আসুন আমার সঙ্গে।’

গৃহস্বামী পূর্বেই বিশ্রামের জন্য প্রস্থান করিয়াছিলেন, আমরা শকুন্তলার নিকট বিদায় লইয়া গৃহে ফিরিলাম।