পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ২৬

ছাব্বিশ

পরদিন সকালবেলা হ্যারিসন রোডের বাসায় বসিয়া ব্যোমকেশ গভীর মনঃসংযোগে হিসাব কষিতেছিল। হিসাব শেষ হইলে সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিল,—‘জমা ষাট টাকা, খরচ ঊনষাট টাকা সাড়ে ছয় আনা। নিশানাথবাবু খরচ বাবদ যে ষাট টাকা দিয়েছিলেন, তা থেকে সাড়ে নয় আনা বেঁচেছে।—যথেষ্ট, কি বল?’

আমি নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,—‘সত্যান্বেষণের ব্যবসা যে রকম লাভের ব্যবসা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত আমাকেও গোলাপ কলোনীতে ঢুকে পড়তে হবে দেখছি।’

বলিলাম,—‘ছাগল চরানোর প্রস্তাবটা ভুলো না।’

সে বলিল,—‘খুব মনে করিয়ে দিয়েছ। ছাগলের ব্যবসায় পয়সা আছে। একটা ছাগলের ফার্ম খোলা যাক্‌, নাম দেওয়া যাবে—ছাগল কলোনী। কেমন হবে?’

‘চমৎকার। কিন্তু আমি ওর মধ্যে নেই।’

‘নেই কেন? বিদ্যাসাগর মশাই থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যে-কাজ করতে পারেন, সে-কাজ তুমি পারবে না! তোমার এত গুমর কিসের?’

বিপজ্জনক প্রসঙ্গ এড়াইয়া গিয়া বলিলাম,—‘ব্যোমকেশ, কাল সমস্ত রাত কেবল স্বপ্ন দেখেছি।’

সে চকিত হইয়া বলিল,—‘কি স্বপ্ন দেখলে?’

‘দেখলাম বনলক্ষ্মী দাঁত বার করে হাসছে। যতবার দেখলাম, ঐ এক স্বপ্ন।’

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,—‘অজিত, মনে আছে আর একবার বনলক্ষ্মীকে স্বপ্ন দেখেছিলে। আমি সত্যবতীকে স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু আসলে একই কথা। মনস্তত্ত্বের নিগূঢ় কথা। বনলক্ষ্মীর দাঁত যে বাঁধানো তা আমাদের চর্মচক্ষে ধরা পড়েনি বটে, কিন্তু আমাদের অবচেতন মন জানতে পেরেছিল—তাই বারবার স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের জানাবার চেষ্টা করেছিল। এখন আমরা জানি বনলক্ষ্মীর ওপর পাটির দু’পাশের দুটি দাঁত বাঁধানো, তাতে তার মুখের গড়ন হাসি সব বদলে গেছে। সেদিন ভুজঙ্গধর ‘দন্তরুচি কৌমুদী’ বলেছিলেন তার ইঙ্গিত তখন হৃদয়ঙ্গম হয়নি।’

‘দন্তরুচির মধ্যে ইঙ্গিত ছিল নাকি?’

‘তা এখনও বোঝোনি? সেদিন সকলের সাক্ষী নেওয়া হচ্ছিল। বাইরের ঘরে বনলক্ষ্মী জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। যেই তার সাক্ষী দেবার ডাক পড়ল ঠিক সেই সময় ভুজঙ্গধরবাবু ঘরে ঢুকলেন। বনলক্ষ্মীকে এক নজর দেখেই বুঝলেন সে তাড়াতাড়িতে দাঁত পরে আসতে ভুলে গেছে। যারা বাঁধানো দাঁত পরে, তাদের এরকম ভুল মাঝে মাঝে হয়। ভুজঙ্গধরবাবু দেখলেন,—সর্বনাশ। বনলক্ষ্মী যদি বিরল-দন্ত অবস্থায় আমার সামনে আসে, তখনি আমার সন্দেহ হবে! তিনি ইশারা দিলেন—দন্তরুচি কৌমুদী। বনলক্ষ্মী সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝতে পারল এবং তৎক্ষণাৎ নিজের কপালে চুড়ি-সুদ্ধ হাত ঠুকে দিলে। কাচের চুড়ি ভেঙে কপাল কেটে গেল, বনলক্ষ্মী অজ্ঞান হয়ে পড়ল। বনলক্ষ্মীকে তুলে নিয়ে ভুজঙ্গধর তার কুঠিতে চললেন। বিজয় যখন তার সঙ্গ নিলে তখন তিনি তাকে বললেন—ডাক্তারখানা থেকে টিঞ্চার আয়োডিন ইত্যাদি নিয়ে আসতে। যতক্ষণে বিজয় টিঞ্চার আয়োডিন নিয়ে বনলক্ষ্মীর ঘরে গিয়ে পৌঁছল, ততক্ষণ বনলক্ষ্মী দাঁত পরে নিয়েছে।—’

দ্বারে টোকা পড়িল।

ইন্সপেক্টর বরাট এবং বিজয়। বিজয়ের ভাবভঙ্গী ভিজা বিড়ালের মত। বরাট চেয়ারে বসিয়া দুই পা সম্মুখে ছড়াইয়া দিয়া বলিল,—‘ব্যোমকেশবাবু, চা খাওয়ান। কাল সমস্ত রাত ঘুমুতে পারিনি। তার ওপর সকাল হতে না হতে বিজয়বাবু এসে উপস্থিত, উনিও ঘুমোননি।’

পুঁটিরামকে চায়ের হুকুম দেওয়া হইল। বরাট বলিল,—‘ব্যাপারটা সবই জানি, তবু মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে ফাঁক রয়েছে। আপনি বলুন—আমরা শুনব।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘বিজয়বাবু, আপনিও শুনবেন? গল্পটা আপনার পক্ষে খুব গৌরবজনক নয়।’

বিজয় ম্রিয়মাণ স্বরে বলিল,—‘শুনব।’

‘বেশ, তাহলে বলছি।’ অতিথিদের সিগারেটের টিন বাড়াইয়া দিয়া ব্যোমকেশ আরম্ভ করিল,—‘যা বলব তাকে আপনারা গল্প বলেই মনে করবেন, কারণ তার মধ্যে খানিকটা অনুমান, খানিকটা কল্পনা আছে। গল্পের নায়ক নায়িকা অবশ্য ভুজঙ্গধর ডাক্তার আর নৃত্যকালী।

‘ভুজঙ্গধর আর নৃত্যকালী স্বামী-স্ত্রী। বাঘ আর বাঘিনী যেমন পরস্পরকে ভালবাসে, কিন্তু বনের অন্য জন্তুদের ভালবাসে না, ওরাও ছিল তেমনি সমাজবিরোধী, জন্মদুষ্ট অপরাধী। পরস্পরের মধ্যে ওরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ আদর্শের সন্ধান পেয়েছিল। ওদের ভালবাসা ছিল যেমন গাঢ় তেমনি তীব্র। বাঘ আর বাঘিনীর ভালবাসা।

‘লন্ডনের একটি রেজিস্ট্রি অফিসে ওদের বিয়ে হয়। ডাক্তার তখন প্ল্যাস্টিক সার্জারি শিখতে বিলেত গিয়েছিল, নৃত্যকালী বোধহয় গিয়েছিল কোনও নৃত্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে। দু’জনের দেখা হল, রতনে রতন চিনে নিলে। ওদের প্রেমের মূল ভিত্তি বোধহয় ওদের অভিনয় এবং সঙ্গীতের প্রতিভা। দু’জনেই অসামান্য আর্টিস্ট; সেতারে এমন হাত পাকিয়েছিল যে বাজনা শুনে ধরা যেত না কে বাজাচ্ছে, বড় বড় সমজদারেরা ধরতে পারত না।

‘দু’জনে মিলে ওরা কত নীতিগর্হিত কাজ করেছিল তার হিসেব আমার জানা নেই—স্টিলের আলমারিতে যে ডায়েরিগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো ভাল করে পড়লে হয়তো সন্ধান পাওয়া যাবে—কিন্তু ডাক্তারের বৈধ এবং অবৈধ ডাক্তারি থেকে বেশ আয় হচ্ছিল; অন্তত উনিশ নম্বর বাড়িটা কেনবার মত টাকা তারা সংগ্রহ করেছিল।

‘কিন্তু ও-ধাতুর লোক অল্পে সন্তুষ্ট থাকে না, অপরাধ করার দিকে ওদের একটা অহেতুক প্রবণতা আছে। বছর চারেক আগে ডাক্তার ধরা পড়ল, তার নাম কাটা গেল। ডাক্তার কলকাতার পরিচিত পরিবেশ থেকে ডুব মেরে গোলাপ কলোনীতে গিয়ে বাসা বাঁধল। নিজের সত্যিকার পরিচয় গোপন করল না। কলোনীতে একজন ডাক্তার থাকলে ভাল হয়, তা হোক নাম-কাটা। নিশানাথবাবু তাকে রেখে দিলেন।

‘নৃত্যকালী কলকাতায় রয়ে গেল। কোথায় থাকত জানি না, সম্ভবত ১৯ নম্বরে। বাড়ির ভাড়া আদায় করত, তাতেই চালাত। ডাক্তার মাসে একবার দু’বার যেত; হয়তো অবৈধ অপারেশন করত।

‘নৃত্যকালী সতীসাধ্বী একনিষ্ঠ স্ত্রীলোক ছিল। কিন্তু নিজের রূপ-যৌবন ছলাকলার ফাঁদ পেতে শিকার ধরা সম্বন্ধে তার মনে কোনও সঙ্কোচ ছিল না। ডাক্তারেরও অগাধ বিশ্বাস ছিল স্ত্রীর ওপর, সে জানত নৃত্যকালী চিরদিনের জন্য তারই, কখনও আর কারুর হতে পারে না।

‘বছর আড়াই আগে ওরা মতলব করল নৃত্যকালী সিনেমায় যোগ দেবে। সিনেমায় টাকা আছে, টাকাওয়ালা লোকও আছে। নৃত্যকালী সিনেমায় ঢুকল। তার অভিনয় দেখে সকলে মুগ্ধ। নৃত্যকালী যদি সিধে পথে চলত, তাহলে সিনেমা থেকে অনেক পয়সা রোজগার করতে পারত। কিন্তু অবৈধ উপায়ে টাকা মারবার একটা সুযোগ যখন হাতের কাছে এসে গেল তখন নৃত্যকালী লোভ সামলাতে পারল না।

‘মুরারি দত্ত অতি সাধারণ লম্পট, কিন্তু সে জহরতের দোকানের মালিক। ডাক্তার আর নৃত্যকালী মতলব ঠিক করল। ডাক্তার নিকোটিন তৈরি করল। তারপর নির্দিষ্ট রাত্রে মুরারি দত্তর মৃত্যু হল; তার দোকান থেকে হীরের নেকলেস অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘প্রথমটা পুলিস জানতে পারেনি সে-রাত্রে মুরারির ঘরে কে এসেছিল। তারপর রমেনবাবু ফাঁস করে দিলেন। নৃত্যকালীর নামে ওয়ারেন্ট বেরুল।

‘নৃত্যকালীর আসল চেহারার ফটোগ্রাফ ছিল না বটে, কিন্তু সিনেমা স্টুডিওর সকলেই তাকে দেখেছিল। কোথায় কার চোখে পড়ে যাবে ঠিক নেই, নৃত্যকালীর বাইরে বেরুনো বন্ধ হল। কিন্তু এভাবে তো সারা জীবন চলে না। ডাক্তার নৃত্যকালীর মুখের ওপর প্ল্যাস্টিক অপারেশন করল। কিন্তু শুধু সার্জারি যথেষ্ট নয়, দাঁত দেখে অনেক সময় মানুষ চেনা যায়। নৃত্যকালীর দুটো দাঁত তুলিয়ে ফেলে নকল দাঁত পরিয়ে দেওয়া হল। তার মুখের চেহারা একেবারে বদলে গেল। তখন কার সাধ্য তাকে চেনে।

‘তারপর ওরা ঠিক করল নৃত্যকালীরও কলোনীতে থাকা দরকার। স্বামী-স্ত্রীর এক জায়গায় থাকা হবে, তাছাড়া টোপ গেলবার মত মাছও এখানে আছে।

‘চায়ের দোকানে বিজয়বাবুর সঙ্গে নৃত্যকালীর দেখা হল; তার করুণ কাহিনী শুনে বিজয়বাবু গলে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে নৃত্যকালী কলোনীতে গিয়ে বসল। ডাক্তারের সঙ্গে নৃত্যকালীর পরিচয় আছে কেউ জানল না, পরে যখন পরিচয় হল তখন পরিচয় ঝগড়ায় দাঁড়াল। সকলে জানল ডাক্তারের সঙ্গে নৃত্যকালীর আদায়-কাঁচকলায়।

‘নিশানাথ এবং দময়ন্তীর জীবনে গুপ্তকথা ছিল। প্রথমে সে কথা জানতেন বিজয়বাবু আর ব্রজদাস বাবাজী। কিন্তু নেপালবাবু তাঁর মেয়ে মুকুলকে নিয়ে কলোনীতে আসবার পর বিজয়বাবু মুকুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আবেগের মুখে তিনি একদিন পারিবারিক রহস্য মুকুলের কাছে প্রকাশ করে ফেলেলেন। —বিজয়বাবু, যদি ভুল করে থাকি, আমাকে সংশোধন করে দেবেন।’

বিজয় নতমুখে নির্বাক রহিল।

ব্যোমকেশ আবার বলিতে লাগিল—

‘মুকুল ভাল মেয়ে। বাপ যতদিন চাকরি করতেন সে সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটিয়েছে, তারপর হঠাৎ ভাগ্য-বিপর্যয় হল; কচি বয়সে তাকে অন্ন-চিন্তা করতে হল। সে সিনেমায় কাজ যোগাড় করবার চেষ্টা করল, কিন্তু হল না। তার গলার আওয়াজ বোধহয় ‘মাইকে’ ভাল আসে না। তিক্ত মন নিয়ে শেষ পর্যন্ত সে কলোনীতে এল এবং বারোয়ারী রাঁধুনীর কাজ করতে লাগল।

‘তারপর জীবনে এল ক্ষণ-বসন্ত, বিজয়বাবুর ভালবাসা পেয়ে তার জীবনের রঙ বদলে গেল। বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে, হঠাৎ আবার ভাগ্য-বিপর্যয় হল। বনলক্ষ্মীকে দেখে বিজয়বাবু মুকুলের ভালবাসা ভুলে গেলেন। বনলক্ষ্মী মুকুলের মত রূপসী নয়, কিন্তু তার একটা দুনিৰ্বার চৌম্বক শক্তি ছিল। বিজয়বাবু সেই চুম্বকের আকর্ষণে পড়ে গেলেন। মুকুলের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিলেন।

‘প্রাণের জ্বালায় মুকুল নিশানাথবাবুর গুপ্তকথা বাপকে বলল। নেপালবাবুর উচ্চাশা ছিল তিনি কলোনীর কর্ণধার হবেন, তিনি তড়্‌পাতে লাগলেন। কিন্তু হাজার হলেও অন্তরে তিনি ভদ্রলোক, blackmail-এর চিন্তা তাঁর মনেও এল না।

‘এদিকে বিজয়বাবু বনলক্ষ্মীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তার অতীত জীবনের কলঙ্ক-কাহিনী জেনেও তাকে বিয়ে করবার জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। নিশানাথ কিন্তু বেঁকে দাঁড়ালেন, কুলত্যাগিনীর সঙ্গে তিনি ভাইপোর বিয়ে দেবেন না। বংশে একটা কেলেঙ্কারিই যথেষ্ট।

‘কাকার হুকুম ডিঙিয়ে বিয়ে করবার সাহস বিজয়বাবুর ছিল না, কাকা যদি তাড়িয়ে দেন তাহলে না খেয়ে মরতে হবে। দুই প্রেমিক প্রেমিকা মিলে পরামর্শ হল; দোকান থেকে কিছু কিছু টাকা সরিয়ে বিজয়বাবু বনলক্ষ্মীর কাছে জমা করবেন, তারপর যথেষ্ট টাকা জমলে দু’জনে কলোনী ছেড়ে চলে যাবেন। ওদিকে রসিক দে’র সঙ্গে বনলক্ষ্মী ঠিক অনুরূপ ব্যবস্থা করেছিল। রসিক কপর্দকহীন যুবক, সেও বনলক্ষ্মীকে দেখে মজেছিল; বনলক্ষ্মীর কলঙ্ক ছিল বলেই বোধহয় তার দিকে হাত বাড়াতে সাহস করেছিল। বনলক্ষ্মীও তাকে নিরাশ করেনি, ভরসা দিয়েছিল কিছু টাকা জমাতে পারলেই দু’জনে পালিয়ে গিয়ে কোথাও বাসা বাঁধবে। এইভাবে রসিক এবং বিজয়বাবুর টাকা ১৯ নম্বর মির্জা লেনের লোহার আলমারিতে জমা হচ্ছিল।

‘তারপর একদিন বিজয়বাবু বনলক্ষ্মীর কাছেও পারিবারিক গুপ্তকথাটি বলে ফেললেন। ভাবপ্রবণ প্রকৃতির ঐ এক বিপদ, যখন আবেগ উপস্থিত হয় তখন অতিবড় গুপ্তকথাও চেপে রাখতে পারেন না।

‘গুপ্তকথা জানতে পেরে বনলক্ষ্মী সেই রাত্রেই ডাক্তারকে গিয়ে বলল; আনন্দে ডাক্তারের বুক নেচে উঠল। অতি যত্নে দু’জনে ফাঁদ পাতল। নিশানাথকে হুমকি দিতে গেলে বিপরীত ফল ফলতে পারে, কিন্তু দময়ন্তী স্ত্রীলোক, কলঙ্কের ভয় তাঁরই বেশি। সুতরাং তিনি blackmail-এর উপযুক্ত পাত্রী।

‘দময়ন্তী দেবীর শোষণ শুরু হল; আট মাস ধরে চলতে লাগল। কিন্তু শেষের দিকে নিশানাথবাবুর সন্দেহ হল, তিনি আমার কাছে এলেন।

‘সুনয়না কলোনীতে আছে এ সন্দেহ নিশানাথের কেমন করে হয়েছিল তা আমি জানি না, অনুমান করাও কঠিন। মানুষের জীবনে অতর্কিতে অভাবিত ঘটনা ঘটে, তেমনি কোনও ঘটনার ফলে হয়তো নিশানাথের সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে গবেষণা নিষ্ফল।

‘নিশানাথের নিমন্ত্রণ পেয়ে আমরা রমেন মল্লিককে সঙ্গে নিয়ে কলোনীতে গেলাম। রমেনবাবুকে ডাক্তার চিনত না কিন্তু সুনয়না চিনত; স্টুডিওতে অনেকবার দেখেছে, মুরারি দত্তর বন্ধু। তাই রমেনবাবুকে দেখে সুনয়না ভয় পেয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না, সুনয়নার খোঁজেই আমরা কলোনীতে এসেছি।

‘দাস-দম্পতি বড় দ্বিধায় পড়ল। এ অবস্থায় কী করা যেতে পারে? বনলক্ষী যদি কলোনী ছেড়ে পালায় তাহলে খুঁচিয়ে সন্দেহ জাগানো হবে, পুলিস বনলক্ষ্মীকে খুঁজতে আরম্ভ করবে। বনলক্ষ্মী যদি ধরা পড়ে, তার মুখে অপারেশনের সূক্ষ্ম চিহ্ন বিশেষজ্ঞের চোখে ধরা পড়ে যাবে, বনলক্ষ্মীই যে সুনয়না তা আর গোপন থাকবে না। তবে উপায়?

‘নিশানাথবাবু যত নষ্টের গোড়া, তিনিই ব্যোমকেশ বক্সীকে ডেকে এনেছেন। তাঁর যদি হঠাৎ মৃত্যু হয় তাহলে সুনয়নার তল্লাস বন্ধ হয়ে যাবে, নিষ্কণ্টকে দময়ন্তী দেবীর রুধির শোষণ করা চলবে।

‘কিন্তু নিশানাথবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রতিপন্ন হওয়া চাই। তাঁর ব্লাড্‌-প্রেসার আছে, ব্লাড্‌-প্রেসারের রুগী বেশির ভাগই হঠাৎ মরে—হার্টফেল হয় কিম্বা মাথার শিরা ছিঁড়ে যায়। সুতরাং কাজটা সাবধানে করতে পারলে কারুর সন্দেহ হবার কথা নয়।

‘ভুজঙ্গধর ডাক্তার খুব সহজেই নিশানাথকে মারতে পারত। সে প্রায়ই নিশানাথের রক্ত-মোক্ষণ করে দিত। এখন রক্ত-মোক্ষণ ছুতোয় যদি একটু হাওয়া তাঁর ধমনীতে ঢুকিয়ে দিতে পারত, তাহলে তিন মিনিটের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হত। অ্যাড্রেনালিন ইন্‌জেকশন দিলেও একই ফল হত; তাঁর পায়ে দড়ি বেঁধে কড়িকাঠে ঝোলাবার দরকার হত না। কিন্তু তাতে একটা বিপদ ছিল। ইন্‌জেকশন দিলে চামড়ার ওপর দাগ থাক না থাক, শিরার ওপর দাগ থেকে যায়, পোস্ট-মর্টেম পরীক্ষায় ধরা পড়ে। নিশানাথের গায়ে ইন্‌জেকশনের চিহ্ন পাওয়া গেলে প্রথমেই সন্দেহ হত ডাক্তার ভুজঙ্গধরের ওপর। সুতরাং ভুজঙ্গধর সে রাস্তা দিয়ে গেল না; অত্যন্ত স্থূল প্রথায় নিশানাথবাবুকে মারলে।

‘ব্যবস্থা খুব ভাল করেছিল। বেনামী চিঠি পেয়ে বিজয়বাবু কলকাতায় এলেন। ওদিকে লাল সিং-এর চিঠি পেয়ে রাত্রি দশটার সময় দময়ন্তী পিছনের দরজা দিয়ে কাচ-ঘরে চলে গেলেন। রাস্তা সাফ, ডাক্তার সেতার বাজাচ্ছিল, বনলক্ষ্মীর হাতে সেতার দিয়ে নিশানাথের ঘরে ঢুকল। সম্ভবত নিশানাথ তখন জেগে ছিলেন। ডাক্তার আলো জ্বেলেই জানালা বন্ধ করে দিলে। তারপর—

‘দুটো ভুল ডাক্তার করেছিল। কাজ শেষ করে জানালাটা খুলে দিতে ভুলে গিয়েছিল, আর তাড়াতাড়িতে মোজা জোড়া খুলে নিয়ে যায়নি। এ দুটো ভুল যদি সে না করত তাহলে নিশানাথবাবুর মৃত্যু অস্বাভাবিক বলে কারুর সন্দেহ হত না।

‘পানুগোপাল কিছু দেখেছিল। কী দেখেছিল তা চিরদিনের জন্যে অজ্ঞাত থেকে যাবে। আমার বিশ্বাস সে বাইরে থেকে ডাক্তারকে জানালা বন্ধ করতে দেখেছিল। নিশানাথের মৃত্যুটা যতক্ষণ স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হয়েছিল ততক্ষণ সে কিছু বলেনি, কিন্তু যখন বুঝতে পারল মৃত্যু স্বাভাবিক নয় তখন সে উত্তেজিত হয়ে যা দেখেছিল তা বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার কপাল খারাপ, সে কিছু বলতে পারল না। ডাক্তার বুঝলে পানু কিছু দেখেছে। সে আর দেরি করল না, পানুর অবর্তমানে তার কানের ওষুধে নিকোটিন মিশিয়ে রেখে এল।

‘তারপর যা যা ঘটেছে সবই আপনাদের জানা, নতুন করে বলবার কিছু নেই।—কাল ডাক্তার আর বনলক্ষ্মীর আত্মহত্যা আপনাদের হয়তো আকস্মিক মনে হয়েছিল। আসলে ওরা তৈরি হয়ে এসেছিল।’

বরাট বলিল,—‘কিন্তু সায়েনাইডের অ্যাম্পুল কখন মুখে দিলে জানতে পারিনি।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘দুটো সায়েনাইডের অ্যাম্পুল ডাক্তারের মুখে ছিল, মুখে করেই এসেছিল। আমি লক্ষ্য করেছিলাম তার কথা মাঝে মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তখন প্রকৃত তাৎপর্য বুঝিনি। তারপর ডাক্তার যখন দেখল আর নিস্তার নেই, তখন সে উঠে বনলক্ষ্মীকে চুমো খেল। এ শুধু প্রণয়ীদের বিদায় চুম্বন নয়, মৃত্যু চুম্বন। চুমু খাবার সময় ডাক্তার একটা অ্যাম্পুল স্ত্রীর মুখে দিয়েছিল।’—

দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করিয়া ব্যোমকেশই আবার কথা কহিল,—‘যাক, এবার আপনারা দু’একটা খবর দিন। রসিকের কি ব্যবস্থা হল?’

বরাট বলিল,—‘রসিকের ওপর থেকে বিজয়বাবু অভিযোগ তুলে নিয়েছেন। তাকে ছেড়ে দিয়েছি।’

‘ভাল। বিজয়বাবু, পরশু রাত্রে আন্দাজ এগারোটার সময় যে-মেয়েটি আপনার ঘরে গিয়েছিল সে কে? মুকুল?’

বিজয় চমকিয়া মুখ তুলিল, লজ্জালাঞ্ছিত মুখে বলিল,—‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে বনলক্ষ্মী গিয়েছিল স্বামীর কাছে। ডাক্তার সেতার বাজিয়ে তাকে ডেকেছিল। মুকুল আপনার কাছে গিয়েছিল কেন? আপনি ওদের কলোনী থেকে চলে যাবার হুকুম দিয়েছিলেন, তাই সে আপনার কৃপা ভিক্ষা করতে গিয়েছিল?’

বিজয় অধোবদনে রহিল।

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল,—‘বিজয়বাবু, আশা করি আপনি মুকুলকে বিয়ে করবেন। সে আপনাকে ভালবাসে। এত ভালবাসা উপেক্ষার বস্তু নয়।’

বিজয় মৌন রহিল, কিন্তু তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, মৌনং সম্মতিলক্ষণম্‌। মুকুলের সঙ্গে হয়তো ইতিমধ্যেই পুনর্মিলন হইয়া গিয়াছে।

বিদায়কালে বিজয় আমতা-আমতা করিয়া বলিল,—‘ব্যোমকেশবাবু, আপনি আমাদের যে উপকার করেছেন তা শোধ দেবার নয়। কিন্তু কাকিমা বলেছেন আপনাকে আমাদের কাছ থেকে একটা উপহার নিতে হবে।’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিয়া বলিল,—‘কি উপহার?’

বিজয় বলিল,—‘কাকার পাঁচ হাজার টাকার জীবনবীমা ছিল, দু’চার দিনের মধ্যেই কাকিমা সে টাকা পাবেন। ওটা আপনাকে নিতে হবে।’

ব্যোমকেশ আমার পানে কটাক্ষপাত করিয়া হাসিল। বলিল,—‘বেশ, নেব। আপনার কাকিমাকে আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ ধন্যবাদ জানাবেন।’

প্রশ্ন করিলাম,—‘ছাগল কলোনীর প্রস্তাব কি তাহলে মুলতুবি রইল?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘তা বলা যায় না। এই মূলধন দিয়েই ছাগল কলোনীর পত্তন হতে পারে। বিজয়বাবু প্রস্তুত থাকবেন, গোলাপ কলোনীর পাশে হয়তো শীগ্‌গির ছাগল কলোনীর আবির্ভাব হবে।’