পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ২২

বাইশ

পুলিস ভ্যানে ফিরিয়া যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল,—‘দময়ন্তী দেবীর কথা সত্যি বলেই মনে হয় নিশানাথবাবুর সন্দেহ হয়েছিল কেউ দময়ন্তীকে blackmail করছে; তাই যেদিন তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে যান সেদিন নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন। কথাটা তাঁর মনের মধ্যে ছিল তাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।’

বরাট বলিল,—‘এখন কথা হচ্ছে, কে blackmail করছে? নিশ্চয় এমন লোক যে দময়ন্তীর গুপ্তকথা জানে।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আমাদের জ্ঞানত তিনজন এই গুপ্তকথা জানে—বিজয়, ব্রজদাস বাবাজী আর নেপালবাবু। নেপালবাবু জানলে মুকুল জানবে। সব মিলিয়ে চারজন; আরও কেউ কেউ থাকতে পারে, যাদের আমরা নাম জানি না। আর কিছু না হোক হত্যার একটা স্পষ্ট পরিষ্কার মোটিভ পাওয়া গেল।’

জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘স্পষ্ট পরিষ্কার মোটিভটা কি?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘ধরা যাক নেপালবাবু blackmail করছিলেন। আট মাস ধরে তিনি বেশ কিছু দোহন করেছেন, আরও অনেক দিন পেন্সন ভোগ করবার ইচ্ছে আছে, এমন সময় দেখলেন নিশানাথবাবুর সন্দেহ হয়েছে, তিনি আমাকে ডেকে এনেছেন। নেপালবাবুর ভয় হল এমন লাভের ব্যবসাটা বুঝি ফেঁসে যায়। শুধু তাই নয়, তিনি যদি ধরা পড়েন তাহলে ইতিপূর্বে তাঁর কন্যার সাহায্যে যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন তাও প্রকাশ হয়ে পড়বে, তাঁর কন্যাটিও যে চিত্রাভিনেত্রী সুনয়না ওরফে নৃত্যকালী তাও আর গোপন থাকবে না। রমেন মল্লিককে আমাদের সঙ্গে দেখে তাঁর এ রকম সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। তিনি তখন কী করবেন? নিশানাথকে মারতে গেলে সব সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়, নির্ভয়ে blackmail চালানো যায়। কিন্তু নিশানাথের মৃত্যুটা স্বাভাবিক হওয়া চাই। সুতরাং নিশানাথ যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে মারা গেলেন। কিন্তু তবু খুঁত রয়ে গেল। পুলিসের যাতায়াত শুরু হল। তার ওপর পানুগোপালটা কিছু দেখে ফেলেছিল। অতএব তাকেও সরানো দরকার হল। মোটামুটি এই মোটিভ।’

বরাট বলিল,—‘তাহলে কর্তব্য কি?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘একটা প্ল্যান আমার মাথায় ঘুরছে, কিন্তু সে বিষয়ে পরে ব্যবস্থা হবে। আজ রাত্রেই একটা কাজ করা দরকার, আবার আমাদের কলোনীতে ফিরে যেতে হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে কলোনীর লোকগুলির ওপর নজর রাখতে হবে।’

‘কী উদ্দেশ্য?’

‘আজ মেঘৈর্মেদুরমম্বরং—অভিসারের উপযুক্ত রাত্রি। দেখতে হবে কেউ কারুর ঘরে যায় কিনা। আপনি রাজী?’

‘নিশ্চয় রাজী। কিন্তু আগে চলুন আমার বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবেন।’

বরাটের বাসায় আহার শেষ করিয়া আমরা যখন বাহির হইলাম রাত্রি তখন সওয়া ন’টা। একটু আগে যাওয়া ভাল, পালা শেষ হইবার পর প্রেক্ষাগৃহে রাত জাগিয়া বসিয়া থাকার মানে হয় না। বরাট আমাদের জন্য দুইটা বর্ষাতি যোগাড় করিয়া লইল।

কলোনী হইতে আধ মাইল দূরে গাড়ি থামানো হইল। ড্রাইভারকে এইখানে গাড়ি রাখিতে বলিয়া আমরা পদব্রজে অগ্রসর হইলাম। আকাশ তেমনি থমথমে হইয়া আছে, প্রত্যাশিত বৃষ্টি নামে নাই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাইতেছে বটে, কিন্তু তাহা অবগুণ্ঠিতা বধূর মুচকি হাসির মত লজ্জিত; তাহার পিছনে গুরু গুরু ডাকও নাই।

কলোনীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম একটিও কুঠিতে আলো জ্বলিতেছে না, কেবল ভোজনগৃহে আলো। সকলেই আহার করিতে গিয়াছে। ব্যোমকেশ চুপি চুপি আমাদের নির্দেশ দিল,—‘অজিত, তুমি বিজয়ের কুঠির আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে বোসো, বিজয় ছাড়া আর কেউ আসে কিনা লক্ষ্য করবে।—ইন্সপেক্টর বরাট, আপনি দময়ন্তীর খিড়কি দরজার ওপর নজর রাখবেন।’

‘আর আপনি?’

‘আমি নেপালবাবুর সদর আর অন্দর দু’দিকেই চোখ রাখব। একটা করবীর ঝাড় দেখে রেখেছি, সেখান থেকে দু’দিকেই দৃষ্টি রাখা চলবে।’

বরাট ও ব্যোমকেশের বর্ষাতি-পরা মূর্তি অন্ধকারে মিলাইয়া গেল। আমি বিজয়ের কুঠির এক কোণে একটা ঝোপের মধ্যে আড্ডা গাড়িলাম।

পনরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে ভোজনকারীরা একে একে ফিরিতে আরম্ভ করিল। প্রথমে ডাক্তার ভুজঙ্গধরের ঘরে আলো জ্বলিয়া উঠিল। তারপর বিজয়ের পায়ের শব্দ শুনিলাম; সে নিজের কুঠিতে প্রবেশ করিয়া আলো জ্বালিল। বনলক্ষ্মীর ঘর অন্ধকার, সে বোধহয় এখনও রান্নাঘরে আছে।

বসিয়া বসিয়া দময়ন্তী ও নিশানাথের চিন্তাই মনে আসিল; যে-কঙ্কালটুকু পাইয়াছিলাম তাহাতে কল্পনার রক্ত-মাংস সংযোগ করিয়া মানুষের মত করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলাম।—দময়ন্তী বোধহয় লাল সিং-এর মত দুর্দান্ত নিষ্ঠুর স্বামীকে ভালবাসিত না, কিন্তু স্বামী খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হইলে অশিক্ষিত রমণীর স্বাভাবিক কর্তব্যবোধে বিচারকের করুণা-ভিক্ষা করিতে গিয়াছিল; তারপর বিজয় ও নিশানাথের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল, দাম্পত্য জীবনের যে-কোমলতা পায় নাই তাহার আশায় লুব্ধ হইয়াছিল। নিশানাথও ক্রমশ নিজের বিবেকবুদ্ধির বিরুদ্ধে এই সুন্দরী অনাথার মায়াজালে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহার অন্তরে ঘাত-প্রতিঘাত আরম্ভ হইয়াছিল, বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত হইয়া তিনি নীতি লঙ্ঘন করিতে পারেন নাই। চাকরি ছাড়িয়া দিয়া এই একান্ত অপরিচিত স্থানে আসিয়া দময়ন্তীর সহিত বাস করিতেছিলেন।…দোষ কাহার, কে কাহাকে অধিক প্রলুব্ধ করিয়াছিল, এ প্রশ্নের অবতারণা এখন নিরর্থক; কিন্তু এ জগতে কর্মফলের হাত এড়ানো যায় না, বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না। নিশানাথ কঠিন মূল্য দিয়াছেন, দময়ন্তীও লজ্জা ভয় ও শোকের মাশুল দিয়া জীবনের ঋণ পরিশোধ করিতেছেন। যে ছিদ্রান্বেষী শত্রু তাহাদের দুর্বলতার ছিদ্রপথে প্রবেশ করিয়া কৃমিকীটের ন্যায় আত্মপুষ্টি করিতে চায় সে নিমিত্ত মাত্র। আবার তাহাকেও একদিন মাশুল দিতে হইবে—

বিজয়ের ঘরে আলো নিভিয়া গেল; পাশের কুঠিতে বনলক্ষ্মীর আলো জ্বলিল। কিছুক্ষণ পরে বনলক্ষ্মীর ওপাশের কুঠিতে ভুজঙ্গধরবাবুর সেতার বাজিয়া উঠিল! কী সুর ঠিক জানি না, কিন্তু দ্রুত তাহার ছন্দ তাল, অসন্দিগ্ধ তাহার ভঙ্গী; যেন বহিঃপ্রকৃতির রসালতায় নূতন উদ্দীপনা প্রয়োগ করিবার প্রয়াস পাইতেছে, বিরহী প্রিয়তমাকে আহ্বান করিতেছে—

কাজর রুচিহর রয়নী বিশালা,

তছুপর অভিসার করু নববালা—

দশ মিনিট পরে সেতার থামিল, ভুজঙ্গধরবাবু আলো নিভাইলেন। কয়েক মিনিট পরে বনলক্ষ্মীর আলোও নিভিয়া গেল। সব কুঠিগুলি অন্ধকার।

আপন আপন নিভৃত কক্ষে ইহারা কি করিতেছে—কী ভাবিতেছে? এই কলোনীর তিমিরাবৃত বুকে কোন্‌ মানুষটির মনের মধ্যে কোন্‌ চিন্তার ক্রিয়া চলিতেছে? বনলক্ষ্মী এখন তাহার সঙ্কীর্ণ বিছানায় শুইয়া কি ভাবিতেছে? কাহার কথা ভাবিতেছে?—যদি অন্তর্যামী হইতাম…

অলস ও অসংলগ্ন চিন্তায় বোধ করি ঘন্টাখানেক কাটিয়া গেল। হঠাৎ সচকিত হইয়া উঠিলাম। পায়ের শব্দ। দ্রুত অথচ সতর্ক। আমি যে ঝোপে লুকাইয়া ছিলাম তাহার পাশ দিয়া বিজয়ের কুঠির দিকে যাইতেছে। অন্ধকারে কিছুই দেখিতে পাইলাম না।

যেখানে লুকাইয়া আছি সেখান হইতে বিজয়ের সদর দরজা দশ-বারো হাত দূরে। শুনিতে পাইলাম খুট্‌খুট্‌ শব্দে দরজায় টোকা পড়িল; তারপর দ্বার খোলার শব্দ পাইলাম। তারপর নিস্তব্ধ।

এই সময় আকাশের অবগুণ্ঠিতা বধূ একবার মুচকি হাসিল। আর আধ মিনিট আগে হাসিলে বিজয়ের নৈশ অতিথিকে দেখিতে পাইতাম।

পাঁচ মিনিট—দশ মিনিট। কুঠির আরও কাছে গেলে হয়তো কিছু শুনিতে পাইতাম, কিন্তু সাহস হইল না। অন্ধকারে হোঁচট কিম্বা আছাড় খাইলে নিজেই ধরা পড়িয়া যাইব।

দ্বার খোলার মৃদু শব্দ! আবার আমার পাশ দিয়া অদৃশ্যচারী চলিয়া যাইতেছে। আকাশ-বধূ হাসিল না। কাহাকেও দেখা গেল না, কেবল একটা চাপা কান্নার নিগৃহীত আওয়াজ কানে আসিল। কে? —কান্নার শব্দ হইতে চিনিতে পারিলাম না, কিন্তু যেই হোক সে স্ত্রীলোক!

তারপর আরও এক ঘন্টা হাত পা শক্ত করিয়া বসিয়া রহিলাম কিন্তু আর কাহারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আর কতক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইবে ভাবিতেছি, কানের কাছে ব্যোমকেশের ফিস্‌ফিস্ গলা শুনিলাম—‘চলে এস। যা দেখবার দেখা হয়েছে।’

ফটকের বাহিরে আসিয়া দেখিলাম ছায়ামূর্তির মত বরাট দাঁড়াইয়া আছে। তিনজনে ফিরিয়া চলিলাম।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘কে কি দেখলে বল।—অজিত, তুমি?’

আমি যাহা শুনিয়াছিলাম বলিলাম।

ব্যোমকেশ নিজের রিপোর্ট দিল,—‘আমি একজনকে নেপালবাবুর খিড়কি দিয়ে বেরুতে শুনেছি। নেপালবাবু নয়, কারণ পায়ের শব্দ হাল্কা। পনরো-কুড়ি মিনিট পরে তাকে আবার ফিরে আসতে শুনেছি।—ইন্সপেক্টর বরাট, আপনি?’

বরাট বলিল,—‘আমি দময়ন্তীর বাড়ি থেকে কাউকে বেরুতে শুনিনি। কিন্তু অন্য কিছু দেখেছি!’

‘কী?’

‘বনলক্ষ্মীকে তার ঘর থেকে বেরুতে দেখেছি। আমি ছিলাম দময়ন্তীর বাড়ির পিছনের কোণে; বনলক্ষ্মীর ঘরের আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপর আলো নিভে গেল, আমি সেই দিকেই তাকিয়ে রইলাম। একবার একটু বিদ্যুৎ চমকালো। দেখলাম বনলক্ষ্মী নিজের কুঠি থেকে বেরুচ্ছে।’

‘কোন্ দিকে গেল?’

‘তা জানি না। আর বিদ্যুৎ চমকায়নি।’

কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,—‘মুস্কিল মিঞার বৌ মিথ্যা বলেনি। এখন কথা হচ্ছে, বিজয়ের ঘরে যে গিয়েছিল সে কে? মুকুল, না বনলক্ষ্মী? যদি বনলক্ষ্মী বিজয়ের ঘরে গিয়ে থাকে তবে মুকুল কোথায় গিয়েছিল?’