পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ১৫

পনেরো

সায়াহ্নে মোহনপুরের স্টেশনে যখন পৌঁছিলাম তখনও গ্রীষ্মের বেলা অনেকখানি বাকি আছে। স্টেশনের প্রাঙ্গণে বাহির হইয়া দেখি কলোনীর গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে, মুস্কিল মিঞা পা-দানে বসিয়া বিড়ি টানিতেছে।

মুস্কিলকে এ কয়দিন দেখি নাই, সে যেন আর একটু বুড়ো হইয়া গিয়াছে, আরও ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। সেলাম করিয়া বলিল,—‘বিজয়বাবু আপনাগোর জৈন্য গাড়ি পাঠাইছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘ওরা ঘাট থেকে ফিরেছে তাহলে?’

মুস্কিল বলিল,—‘হ—ফিরছেন।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘নতুন খবর কিছু আছে নাকি?’

মুস্কিল নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,—‘আর নূতন খবর কী কর্তা। সব তো শেষ হইয়া গিছে।’

‘তা বটে। চল—কিন্তু একবার থানা হয়ে যেতে হবে।’

‘চলেন। —কর্তাবাবুর নাকি ময়না তদন্ত হৈছে?’

‘হ্যাঁ। তুমি খবর পেলে কোত্থেকে?’

‘শুন্ গুন্ কানে আইল। তা ময়না তদন্তে কী জানা গেল? সহজ মৃত্যু নয়?’

ব্যোমকেশ প্রশ্নটা পাশ কাটাইয়া গেল। বলিল,—‘সে কথা ডাক্তার জানেন। মুস্কিল মিঞা, তুমি তো আফিম খেয়ে ঝিমোও, তুমি এত খবর পাও কি করে?’

মুস্কিলের মুখে একটু ক্ষীণ হাসি দেখা দিল, সে বলিল—‘আমি ঝিমাইলে কি হৈব কর্তা, আমার বিবিজানডার চারটা চোখ চারটা কান। তার চোখ কান এড়ায়া কিছু হৈবার যো নাই। আমি সব খবর পাই। একটা কিছু যে ঘটবো তা আগেই বুঝছিলাম।’

‘কি করে বুঝলে?’

মুস্কিল একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ আক্ষেপভরে হস্তসঞ্চালন করিয়া বলিল,—‘মেইয়া মানুষ লইয়া লট্‌খট্। রাতের আঁধারে এ উয়ার ঘরে যায়, ও ইয়ার ঘরে যায়—ই সব নষ্টামিতে কি ভাল হয় কর্তা? হয় না।’

বিস্মিতস্বরে ব্যোমকেশ বলিল,—‘কে কার ঘরে যায়?’

কথাটা বলিয়া ফেলিয়া মুস্কিল একটু বিব্রত হইয়া পড়িয়াছিল,—‘বলিল,—‘কারে বাদ দিমু কর্তা? মেইয়া লোকগুলাই দুষ্ট হয় বেশি, মরদের সর্বনাশের জৈন্যই তো খোদা উয়াদের বানাইছেন।’

‘মানে…তুমি বলতে চাও রাত্রে কলোনীর মেয়েরা লুকিয়ে পুরুষদের ঘরে যায়। কে কার ঘরে যায় বলতে পার?’

‘তা কেমনে কৈব কর্তা? আঁধারে কি কারো মুখ দেখা যায়। তবে ভিতর ভিতর নষ্টামি চলছে। এখন কর্তাবাবু নাই, বড়বিবিও সাদাসিদা মেইয়া, এখন তো হদ্দ বাড়াবাড়ি হৈব।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘মেয়েরা কারা তা না হয় বলতে পারলে না, কিন্তু কার ঘরে যায় সেটা তো বলতে পার।’

মুস্কিল একটু অধীরস্বরে বলিল,—‘কি মুস্কিল, সেটা আন্দাজ কৈরা লন না। মেইয়া লোক জোয়ান মরদের ঘরে যাইব না তো কি বুড়ার ঘরে যাইব?’

মুস্কিল মিঞার জীবন-দর্শনে মার-প্যাচ নাই। মনে মনে হিসাব করিলাম, জোয়ান মরদের মধ্যে আছে বিজয়, রসিক, পানুগোপাল। ডাক্তার ভুজঙ্গধরকেও ধরা যাইতে পারে।

ব্যোমকেশ আর প্রশ্ন করিল না, গাড়িতে উঠিয়া বসিয়া বলিল,—‘চল, এবার যাওয়া যাক। থানা কতদূর?’

‘কাছেই, রাস্তায় পড়ে।’ মুস্কিল চালকের আসনে উঠিয়া গাড়ি হাঁকাইয়া দিল।

থানায় উপস্থিত হইলে প্রমোদ বরাট আমাদের খাতির করিয়া নিজের কুঠরিতে বসাইল এবং সিগারেটের টিন খুলিয়া ধরিল। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া মৃদুহাস্যে বলিল,—‘নিশানাথবাবুকে কেউ খুন করেছে এ প্রত্যয় আপনার হয়েছে?’

বরাট বলিল,—‘আমার হয়েছে, কিন্তু কর্তারা তানানানা করছেন। তাঁরা বলেন, পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টে যখন কিছু পাওয়া যায়নি তখন ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজ কি! আমি কিন্তু ছাড়ছি না, লেগে থাকব। —আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘সন্দেহ এখনও কারুর ওপর পড়েনি। কিন্তু এই ঘটনার একটা পটভূমিকা আছে, সেটা আপনার জানা দরকার। বলি শুনুন।’ বলিয়া সুনয়না ও মোটরের টুকরো সংক্রান্ত সমস্ত কথা বিবৃত করিল।

শুনিয়া বরাট উত্তেজিত হইয়া উঠিল, বলিল,—‘ঘোরালো ব্যাপার দেখছি। —আমাকে কী করতে হবে বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপাতত দুটো কাজ করা দরকার। এক, কলোনীর সকলের হাতের টিপ নিতে হবে—’

‘তাতে কী লাভ?’

‘ওটা থাকা ভাল। কখন কি কাজে লাগবে বলা যায় না।’

বরাট একটু ইতস্তত করিয়া বলিল,—‘কাজটা ঠিক আইনসঙ্গত হবে কিনা বলতে পারি না, তবু আমি করব। দ্বিতীয় কাজ কী?’

‘দ্বিতীয় কাজ, আমরা কলোনীতে যাচ্ছি, আপনিও চলুন। আপনার সামনে আমি কলোনীর প্রত্যেককে প্রশ্ন করব, আপনি শুনবেন এবং দরকার হলে নোট করবেন।’

‘কী ধরনের প্রশ্ন করবেন?’

‘আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হবে, সে-রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কে কোথায় ছিল, কার অ্যালিবাই আছে কার নেই, এই নির্ণয় করা।’

‘বেশ, চলুন তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক, কাজ সেরে ফিরতে হবে।’

টিপ লইবার সরঞ্জামসহ একজন হেড্ কনস্টেবল আমাদের সঙ্গে চলিল।

সন্ধ্যা হয়-হয় এমন সময় কলোনীতে পৌঁছিলাম। গত রাত্রির বর্ষণ এখানেও মাটি ভিজাইয়া দিয়া গিয়াছে। বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভুজঙ্গধরবাবু বিজয়ের সহিত কথা বলিতেছিলেন। বিজয়ের মুখে এখনও শ্মশানবৈরাগ্যের ছায়া লাগিয়া আছে। ভুজঙ্গধরবাবুর মুখ কিন্তু প্রফুল্ল, তাঁহার মুখে অম্লরসাক্ত একপেশে হাসি আবার ফিরিয়া আসিয়াছে।

আমাদের সঙ্গে প্রমোদ বরাট ও কনস্টেবলকে দেখিয়া বিজয়ের চোখে প্রশ্ন জাগিয়া উঠিল। ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—‘আসুন। বিজয়বাবুকে মোহমুদগর শোনাচ্ছি—কা তব কান্তা—নলিনীদলগত-জলমতিতরলং—’

তাঁহার লঘুতা সময়োচিত নয়; মনে হইল বিজয়ের মন প্রফুল্ল করিবার জন্য তিনি আধিক্য দেখাইতেছেন।

বরাট পুলিসী গাম্ভীর্যের সহিত বলিল,—‘আপনাদের সকলের হাতের টিপ দিতে হবে।’

বিজয়ের চোখের প্রশ্ন আরও তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল, ভুজঙ্গধরবাবুও চকিতভাবে চাহিলেন। ব্যোমকেশ ব্যাখ্যাচ্ছলে বলিল,—‘কলোনী থেকে যে-ভাবে একে একে লোক খসে পড়ছে, বাকিগুলি কতদিন টিকে থাকবে বলা যায় না। তাই সতর্কতা।’

বিজয় বুঝিল,—‘বেশ তো—নিন।’ তাহার চোখের দৃষ্টি নীরবে প্রশ্ন করিতে লাগিল,—কেন? নতুন কিছু পাওয়া গেছে কি?

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আশা করি কারুর আপত্তি হবে না। কারণ যিনি আপত্তি করবেন স্বভাবতই তাঁর উপর সন্দেহ হবে। ভুজঙ্গধরবাবু, আপনার আপত্তি নেই তো?’

‘বিন্দুমাত্র না। আসুন—’ বলিয়া তিনি অঙ্গুষ্ঠ বাড়াইয়া দিলেন।

বরাট কনস্টেবলকে ইঙ্গিত করিল, কনস্টেবল অঙ্গুষ্ঠের ছাপ তুলিতে প্রবৃত্ত হইল। ভুজঙ্গধরববাবু বাঁকা হাসিতে হাসিতে বলিলেন,—‘দেখছি আমি ভুল করেছিলাম। আঙুলের ছাপ যখন নেওয়া হচ্ছে তখন লাস পরীক্ষায় কিছু পাওয়া গেছে।’

তাঁহার এই অর্ধ-প্রশ্নের জবাব কেহ দিল না। কাগজের উপর তাঁহার ও বিজয়ের নাম ও ছাপ লিখিত হইলে ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—‘আর কার কার ছাপ নিতে হবে বলুন, আমি কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।’

বরাট বলিল,—‘সকলের ছাপই নিতে হবে। মেয়ে পুরুষ কেউ বাদ যাবে না।’

‘মিসেস সেনেরও?’

‘হ্যাঁ, মিসেস সেনেরও?’

‘বেশ—আও সিপাহী।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আর একটা কথা। টিপ নেবার সময় সকলকে বলে দেবেন যেন আধ ঘন্টা পরে এই বাড়িতে আসেন। দু’চারটে প্রশ্ন করব।’

ভূজঙ্গধরবাবু কনস্টেবলকে লইয়া চলিয়া গেলেন। আমরা বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলাম। বিজয় আলো জ্বালিয়া দিল। ব্যোমকেশ বলিল,—‘এ ঘরটা হোক ওয়েটিং রুম—যাঁরা সাক্ষী দিতে আসবেন তাঁরা এ ঘরে বসবেন। আর পাশের ঘরে আমরা বসব, প্রত্যেককে আলাদা ডেকে প্রশ্ন করা হবে। কি বলেন ইন্সপেক্টর বরাট?’

বরাট বলিল,—‘সেই ঠিক হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘তাহলে বিজয়বাবু, ও ঘরে একটা টেবিল আর গোটাকয়েক চেয়ার আনিয়ে দিন। আর কিছুর দরকার হবে না।’

বিজয় চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করিতে গেল। পনেরো মিনিট পরে ভুজঙ্গধরবাবু কনস্টেবলসহ ফিরিয়া আসিলেন, বলিলেন—‘এই নিন; টিপ সই হয়ে গেছে। ন্যাপ্‌লা একটু গোলমাল করবার তালে ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। —সকলকে বলে দিয়েছি, আধ ঘন্টার মধ্যে আসবে। আমিও আসছি হাত-মুখ ধুয়ে।’ বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।