পরিশিষ্ট

দুর্গরহস্য – ১.৪

হরিপ্রিয়া বাঁচিল না‌, বাড়িতে লইয়া যাইতে যাইতে পথেই তাহার মৃত্যু হইল।

জঙ্গলে ইতিপূর্বে কেহ বিষধর সাপ দেখে নাই। এবারও সাপ চোখে দেখা গেল না বটে‌, কিন্তু সাপের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ রহিল না; এবং ইহা যে বেদেদের কাজ‌, তাহারাই প্ৰতিহিংসা চরিতার্থকরিবার উদ্দেশ্যে জঙ্গলে সাপ কিম্বা সাপের ডিম ছাড়িয়া দিয়া গিয়াছে‌, তাহাও একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ হইয়া পড়িল। কিন্তু বেদের দল তখন বহুদূরে চলিয়া গিয়াছে‌, তাহাদের সন্ধান পাওয়া গেল না।

হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর পর কিছুদিন রামকিশোরের বাড়ির উপর অভিশাপের মত একটা থমথমে ছায়া চাপিয়া রহিল। রামকিশোর তাঁহার সকল সন্তানদের মধ্যে হরিপ্রিয়াকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালবাসিতেন; তিনি দারুণ আঘাত পাইলেন। মণিলাল অতিশয় সম্বতচরিত্র যুবক‌, কিন্তু সেও এই আকস্মিক বিপর্যয়ে কেমন যেন উদভ্ৰান্ত দিশহারা হইয়া গেল। অপ্রত্যাশিত ভূমিকম্পে তাহার নবগঠিত জীবনের ভিত্তি একেবারে ধবসিয়া গিয়াছিল।

আর একজন এই অনৰ্থপাতে গুরুতরভাবে অভিভূত হইয়াছিল‌, সে তুলসী। তুলসী যে তাহার দিদিকে খুব বেশি ভালবাসিত তা নয়‌, বরং দুই বোনের মধ্যে খিটিমিটি লাগিয়াই থাকিত। হরিপ্রিয়া সুযোগ পাইলেই তুলসীকে শাসন করিত‌, ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিত। তবু্‌, হরিপ্রিয়ার মৃত্যু চোখের সামনে দেখিয়া তুলসী কেমন যেন বুদ্ধিভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। সেদিন বনের মধ্যে বেড়াইতে বেড়াইতে সে অদূরে গাছতলায় হলুদবৰ্ণ শাড়ি দেখিয়া সেই দিকে গিয়াছিল; তারপর দিদিকে ঐভাবে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া ভীতভাবে ডাকাডাকি করিয়াছিল। হরিপ্রিয়া কেবল একবার চোখ মেলিয়া চাহিয়াছিল‌, কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল।

সেই হইতে তুলসীর ধন্দ লাগিয়া গিয়াছিল। ভূতগ্ৰস্তের মত শঙ্কিত চক্ষু মেলিয়া সে বাড়িময় ঘুরিয়া বেড়াইত; কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া থাকিত। তাহার অপরিণত স্নায়ুমণ্ডলীর উপর যে কঠিন আঘাত লাগিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই।

বংশীধর এবং মুরলীধরও ধাক্কা পাইয়াছিল। কিন্তু এতটা নয়। বংশীধর গুম হইয়া গিয়াছিল; মনে মনে সে হয়তো হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দোষী করিতেছিল; বেদেদের উপর অতটা জুলুম না করিলে বোধ হয় এ ব্যাপার ঘটিত না। মুরলীধরের বাহ্য চালচলনে কোনও পরিবর্তন দেখা যায় নাই বটে। কিন্তু সেও কচ্ছপের মত নিজেকে নিজের মধ্যে গুটািইয়া লইয়াছিল। দুই ভ্ৰাতার মধ্যে কেবল একটি বিষয়ে ঐক্য হইয়াছিল‌, দুইজনেই মণিলালকে বিষচক্ষে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছিল। যেন হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর জন্য মণিলালই দায়ী।

হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর একমাস পরে মণিলাল রামকিশোরের কাছে গিয়া বিদায় চাহিল। এ সংসারের সহিত তাহার সম্পর্ক ঘুচিয়া গিয়াছে‌, এই কথার উল্লেখ করিয়া সে সজল চক্ষে বলিল‌, ‘আপনার স্নেহ কখনও ভুলব না। কিন্তু এ পরিবারে আর তো আমার স্থান নেই।’

রামকিশোরের চক্ষুও সজল হইল। তিনি বলিলেন‌, ‘কোন স্থান নেই? যে গেছে সে তো গেছেই‌, আবার তোমাকেও হারাবো? তা হবে না। তুমি থাকো। যদি ভগবান করেন আবার হয়তো সম্পর্ক হবে।’

বংশীধর ও মুরলীধর উপস্থিত ছিল। বংশীধর মুখ কালো করিয়া উঠিয়া গেল; মুরলীধরের ঠোঁটে অসন্তোষ বাঁকা হইয়া উঠিল। ইঙ্গিতটা কাহারও বুঝিতে বাকি রহিল না।

মণিলাল রহিয়া গেল। পূর্বাপেক্ষাও নিম্পূহ এবং নির্লিপ্তভাবে ভূতপূর্ব শ্বশুরুগৃহে বাস করিতে লাগিল।

অতঃপর বছর দুই নিরুপদ্রবে। কাটিয়া গিয়াছে। রামকিশোরের সংসার আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে। কেবল তুলসী পূর্বের মত ঠিক প্রকৃতিস্থ হইল না। তাহার মনে এমন গুরুতর ধাক্কা লাগিয়াছিল‌, যাহার ফলে তাহার দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি নিরুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। দশ বছর বয়সে তাহার দেহ-মন যেরূপ অপরিণত ছিল‌, তের বছরে পা দিয়াও তেমনি অপরিণত আছে। মোট কথা‌, যৌবনোদগমের স্বাভাবিক বয়সে উপনীত হইয়াও সে বালিকাই রহিয়া গিয়াছে।

উপরন্তু তাহার মনে আর একটি পরিবর্তন ঘটিয়াছে। যে-মাস্টারের প্রতি পূর্বে তাহার অবহেলার অন্ত ছিল না‌, অহেতুকভাবে সে সেই মাস্টারের অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে মাস্টার রমাপতি যতটা আনন্দিত হইয়াছে‌, তাহার অধিক সঙ্কোচ ও অশান্তি অনুভব করিতেছে। কারণ অবহেলায় যাহারা অভ্যস্ত্‌্‌, একটু সমাদর পাইলে তাহারা বিব্রত হইয়া ওঠে।

যাহোক‌, রামকিশোরের সংসার-যন্ত্র আবার সচল হইয়াছে এমন সময় বাড়িতে একজন অতিথি আসিলেন। ইনি রামকিশোরের যৌবনকালের বন্ধু। আসলে রামকিশোরের দাদা রামবিনোদের সহিত ইঁহার গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। রামবিনোদের অকালমৃত্যুর পর রামকিশোরের সহিত তাঁহার সখ্য-বন্ধন শিথিল হইয়াছিল বটে‌, কিন্তু প্রীতির সূত্র একেবারে ছিন্ন হয় নাই। ইনি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন‌, সম্প্রতি অবসর লইয়াছেন। নাম ঈশানচন্দ্র মজুমদার। কয়েক বছর আগে বংশীধর যখন কলেজে দুস্কৃতি করার ফলে বিতাড়িত হইতেছিল‌, তখন ইনিই তাহাকে রক্ষা করিয়াছিলেন।

অধ্যাপক ঈশানচন্দ্রের চেহারা তপঃকৃশ সন্ন্যাসীর ন্যায় শুষ্কশীর্ণ প্রকৃতি ঈষৎ তিক্তর সাক্ত। অবসর গ্রহণ করিবার পর তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়াছিল‌, অর্থেরও বোধকরি অনটন ঘটিয়াছিল। তিনি পূর্ব ঘনিষ্ঠতা স্মরণ করিয়া রামকিশোরকে পত্র লিখিলেন; তোমাদের অনেকদিন দেখি নাই‌, কবে আছি কবে নাই‌, ওখানকার জলহাওয়া নাকি ভাল‌, ইত্যাদি। রামকিশোর উত্তরে অধ্যাপক মহাশয়কে সাদর আমন্ত্রণ জানাইয়া পত্র লিখিলেন‌, এখানকার স্বাস্থ্য খুবই ভাল‌, তুমি এস‌, দু’এক মাস থাকিলেই শরীর সারিয়া যাইবে।

যথাসময়ে ঈশানচন্দ্ৰ আসিলেন এবং বাড়িতে অধিষ্ঠিত হইলেন। বংশীধর কিছু জানিত না‌, সে খাস-আবাদী ধান কাটাইতে গিয়াছিল; বাড়ি ফিরিয়া ঈশানচন্দ্রের সঙ্গে তাহার মুখোমুখি দেখা হইয়া গেল। বংশীধর ভূত দেখার মত চমকিয়া উঠিল; তাহার মুখ সাদা হইয়া গিয়া আবার ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিল। সে ঈশানচন্দ্রের কাছে আসিয়া চাপা গলায় বলিল‌, ‘আপনি এখানে?’

ঈশানচন্দ্ৰ কিছুক্ষণ একদৃষ্টি প্রাক্তন শিষ্যের পানে চাহিয়া থাকিয়া শুষ্কম্বরে বলিলেন‌, ‘এসেছি। তোমার আপত্তি আছে নাকি?’

বংশীধর তাঁহার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল‌, ‘শুনে যান। একটা কথা আছে।’

আড়ালে গিয়া গুরুশিষ্যের মধ্যে কি কথা হইল‌, তাহা কেহ জানিল না। কিন্তু বাক্যবিনিময় যে আনন্দদায়ক হয় নাই। তাহা প্ৰমাণ হইল যখন ঈশানচন্দ্র রামকিশোরকে গিয়া বলিলেন যে‌, তিনি আজই চলিয়া যাইতে চান। রামকিশোর তাঁহার অনেক সাধ্যসাধনা করিলেন; শেষ পর্যন্ত রফা হইল অধ্যাপক মহাশয় দুর্গে গিয়া থাকিবেন। দুর্গের দু’একটি ঘর বাসোপযোগী আছে; অধ্যাপক মহাশয়ের নির্জনবাসে আপত্তি নাই। তাঁহার খাদ্য দুর্গে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইবে।

সেদিন সন্ধ্যায় ঈশানচন্দ্ৰকে দুর্গে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রামকিশোর ফিরিয়া আসিলেন এবং বংশীধরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। পিতাপুত্রে সওয়াল জবাব চলিল। হঠাৎ রামকিশোর খড়ের আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিলেন এবং উগ্ৰকণ্ঠে পুত্ৰকে ভর্ৎসনা করিলেন। বংশীধর কিন্তু চেঁচামেচি করিল না‌, আরক্ত চক্ষে নিষ্ফল ক্ৰোধ ভরিয়া তিরস্কার শুনিল।

যাহোক‌, ঈশানচন্দ্ৰ দুর্গে বাস করিতে লাগিলেন। রাত্রে তিনি একাকী থাকেন। কিন্তু দিনের বেলা বংশীধর ও মুরলীধর ছাড়া বাড়ির আর সকলেই দুর্গে যাতায়াত করে। মুরলীধর অধ্যাপক মহাশয়ের উপর মমস্তিক চটিয়াছিল‌, কারণ তিনি দুর্গ অধিকার করিয়া তাহার গোপন কেলিকুঞ্জটি কাড়িয়া লইয়াছিলেন।

অতঃপর একপক্ষ নিৰ্ব্বঞাটে কাটিয়া গেল। একদিন সন্ধ্যার সময় রামকিশোর ঈশানচন্দ্রের সহিত দেখা করিতে যাইতেছিলেম, দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া দুর্গের সিঁড়ি ধরিবেন, দেখিতে পাইলেন কুয়ার কাছে তরুগুচ্ছের ভিতর হইতে ধূঁয়া বাহির হইতেছে। কৌতুহলী হইয়া তিনি সেইদিকে গেলেন। দেখিলেন‌, বৃক্ষতলে এক সাধু ধুনি জ্বালিয়া বসিয়া আছেন।

সাধুর অঙ্গ বিভূতিভূষিত‌, মাথায় জটা‌, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফ। রামকিশোর এবং সাধুবাবা অনেকক্ষণ স্থির নেত্রে পরস্পর নিরীক্ষণ করিলেন। তারপর সাধুবাবার কণ্ঠ হইতে খল খল হাস্য নিৰ্গত হইল।

রামকিশোরের দুর্গে যাওয়া হইল না। তিনি ফিরিয়া আসিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহার তাড়ন্স দিয়া জ্বর আসিল। জ্বরের ঘোরে তিনি উচ্চকণ্ঠে প্ৰলাপ বকিতে লাগিলেন।

ডাক্তার আসিল। প্ৰলাপ বন্ধ হইল‌, জ্বরও ছাড়িল। রামকিশোর ক্রমে সুস্থ হইলেন। কিন্তু দুখ গেল তাঁহার হৃদয়ত্ব গুরুতরভাবে জখম ইয়াছে। পূর্বে তাঁহার হৃদযন্ত্র বেশ মজবুত ছিল।

আরও একপক্ষ কাটিল। ঈশানচন্দ্র পূর্ববৎ দুর্গে রহিলেন। সাধুবাবাকে বৃক্ষমূল হইতে কেহ। তাড়াইবার চেষ্টা করিল না। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখিলে ডরায়‌, বেদেদের লইয়া যে ব্যাপার ঘটিয়া গিয়াছে তাহার পুনরিভনয় বাঞ্ছনীয় নয়।