পাঁচ
যেদিক দিয়া আসিয়াছিলাম সেই দিক দিয়াই ফিরিয়া চলিলাম। মোড় পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই দেখা গেল সম্মুখের রাস্তা দিয়া একটি যুবতী এক ঝাঁক পাতিহাঁস তাড়াইয়া লইয়া যাইতেছে।
যুবতী আমাদের দেখিতে পায় নাই। তাহার মাথার কাপড় খোলা, পরনে মোটা তাঁতের লুঙ্গি-ডুরে শাড়ি, দেহে ভরা যৌবন। অন্যমনস্কভাবে যাইতে যাইতে আমাদের দিকে চোখ ফিরাইয়া যুবতী লজ্জায় যেন শিহরিয়া উঠিল। ক্ষিপ্রহস্তে মাথার উপর ঘোমটা টানিয়া দিয়া সে তাড়াতাড়ি হাঁসগুলিকে পিছনে ফেলিয়া চলিয়া গেল। কলোনীর পিছন দিকে প্রকাণ্ড ইঁদারার পাশে কয়েকটা ঘর রহিয়াছে, সেইখানে অদৃশ্য হইয়া গেল।
নিশানাথ বলিলেন,—‘মুস্কিলের বৌ। কলোনীর হাঁস-মুরগীর ইন-চার্জ।’
মনে আবার একটা বিস্ময়ের ধাক্কা লাগিল। এখানে কি প্রভু-ভৃত্য সকলেরই দ্বিতীয় পক্ষ? ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘ওদিকে কোথায় গেল?’
নিশানাথ বলিলেন,—‘ওদিকটা আস্তাবল। মুস্কিলও ওখানেই থাকে।’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হয়।’
‘ওদের মধ্যে কে ভদ্র, কে অভদ্র বলা শক্ত। জাতের কড়াকড়ি নেই কিনা।’
‘কিন্তু পর্দার কড়াকড়ি আছে।’
‘আছে, তবে খুব বেশি নয়। আমাদের দেখে নজর বিবি এখন আর লজ্জা করে না। আপনারা নতুন লোক, তাই বোধহয় লজ্জা পেয়েছে।’
নজর বিবি! নামটা যেন সুনয়নার কাছ ঘেঁষিয়া যায়! চকিতে মাথায় আসিল, যে স্ত্রীলোক খুন করিয়া আত্মগোপন করিতে চায়, মুসলমান অন্তঃপুরের চেয়ে আত্মগোপনের প্রকৃষ্টতর স্থান সে কোথায় পাইবে? আমি রমেনবাবুর দিকে সরিয়া গিয়া চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘কেমন দেখলেন?’
রমেনবাবু দ্বিধাভরে মাথা চুলকাইয়া বলিলেন,—‘উহুঁ, নেত্যকালী নয়;—কিন্তু কিছু বলা যায় না—’
বুঝিলাম, রমেনবাবু নেত্যকালীর মেক্-আপ করিবার অসামান্য ক্ষমতার কথা ভাবিতেছেন। কিন্তু মুস্কিল মিঞার বৌ দিবারাত্র মেক্-আপ করিয়া থাকে ইহাই বা কি করিয়া সম্ভব?
ইতিমধ্যে আমরা আর একটি বাড়ির সম্মুখীন হইতেছিলাম। ভোজনালয় যে রাস্তার উপর তাহার পিছনে সমান্তরাল একটি রাস্তা গিয়াছে, এই রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে একটি কুঠি। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘এখানে কে থাকে?’
নিশানাথ বলিলেন,—‘এখানে থাকেন প্রফেসার নেপাল গুপ্ত আর তাঁর মেয়ে মুকুল।’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘নেপাল গুপ্ত—নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে। বছর তিন-চার আগে এঁর নাম কাগজে দেখেছি মনে হচ্ছে।’
নিশানাথ বলিলেন,—‘অসম্ভব নয়। নেপালবাবু এক কলেজে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি রাত্রে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন। একদিন ল্যাবরেটরিতে বিরাট বিস্ফোরণ হল, নেপালবাবু গুরুতর আহত হলেন। কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করলেন নেপালবাবু লুকিয়ে লুকিয়ে বোমা তৈরি করছিলেন। চাকরি তো গেলই, পুলিসের নজরবন্দী হয়ে রইলেন। যুদ্ধের পর পুলিসের শুভদৃষ্টি থেকে মুক্তি পেলেন বটে কিন্তু চাকরি আর জুটল না। বিস্ফোরণের ফলে তাঁর চেহারা এবং চরিত্র দুই-ই দাগী হয়ে গিয়েছে।’
‘সত্যিই কি উনি বোমা তৈরি করছিলেন? উনি নিজে কি বলেন?’
নিশানাথ মুখ টিপিয়া হাসিলেন,—‘উনি বলেন গাছের সার তৈরি করছিলেন।’
আমরা হাসিয়া উঠিলাম। নিশানাথ বলিয়া চলিলেন,—‘এখানে এসেও সার তৈরি করা ছাড়েননি। বাড়িতে ল্যাবরেটরি করেছেন, অর্থাৎ গ্যাস-সিলিন্ডার, বুনসেন বার্নার, টেস্ট-টিউব, রেটর্ট ইত্যাদি যোগাড় করেছেন। একবার খানিকটা সার তৈরি করে আমাকে দিলেন, বললেন, পেঁপে গাছের গোড়ায় দিলে ইয়া ইয়া পেঁপে ফলবে। আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু উনি শুনলেন না—’
‘শেষ পর্যন্ত কি হল?’
‘পেঁপে গাছগুলি সব মরে গেল।’
নেপালবাবুর কুঠিতে প্রবেশ করিলাম। বাহিরের ঘরে তক্তপোশের উপর একটি অর্ধ-উলঙ্গ বৃদ্ধ থাবা গাড়িয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার সম্মুখে দাবার ছক। ছকের উপর কয়েকটি ঘুঁটি সাজানো রহিয়াছে, বৃদ্ধ একাগ্র দৃষ্টিতে সেইদিকে চাহিয়া আছেন। সেই যে ইংরেজি খবরের কাগজে দাবা খেলার ধাঁধা বাহির হয়, সাদা ঘুটি প্রথমে চাল দিবে এবং তিন চালে মাত করিবে, বোধহয় সেই জাতীয় ধাঁধার সমাধান করিতেছেন। আমরা দ্বারের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম; কিন্তু তিনি জানিতে পারিলেন না।
নিশানাথবাবু আমাদের দিকে চাহিয়া একটু হাসিলেন। বুঝিলাম ইনিই বোমারু অধ্যাপক নেপাল গুপ্ত।
নেপালবাবু বয়সে নিশানাথের সমসাময়িক, কিন্তু গুণ্ডার মত চেহারা। গায়ের রঙ তামাটে কালো, মুখের একটা পাশ পুড়িয়া ঝামার মত কর্কশ ও সচ্ছিদ্র হইয়া গিয়াছে, বোধকরি বোমা বিস্ফোরণের চিহ্ন। তাঁহার মুখখানা স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো এতটা ভয়াবহ ছিল না, কিন্তু এখন দেখিলে বুক গুরগুর করিয়া ওঠে।
নিশানাথ ডাকিলেন,—‘কি হচ্ছে প্রফেসর?’
নেপালবাবু দাবার ছক হইতে চোখ তুলিলেন, তখন তাঁহার চোখ দেখিয়া আরও ভয় পাইয়া গেলাম। চোখ দুটো আকারে হাঁসের ডিমের মত এবং মণির চারিপাশে রক্ত যেন জমাট হইয়া আছে। দৃষ্টি বাঘের মত উগ্র।
তিনি হেঁড়ে গলায় বলিলেন,—‘নিশানাথ! এস। সঙ্গে কারা?’
দেখিলাম নেপালবাবু আশ্রয়দাতার সঙ্গে সমকক্ষের মত কথা বলেন, এমন কি কণ্ঠস্বরে একটু মুরুব্বিয়ানাও প্রকাশ পায়।
আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। নেপালবাবু শিষ্টতার নিদর্শন স্বরূপ হাঁটু দুটির উপর কেবল একটু কাপড় টানিয়া দিলেন। নিশানাথ বলিলেন,—‘এঁরা কলকাতা থেকে বাগান দেখতে এসেছেন।’
নেপালবাবুর গলায় অবজ্ঞাসূচক একটি শব্দ হইল, তিনি বলিলেন,—‘বাগানে দেখবার কি আছে তোমার? আমার সার যদি লাগাতে তাহলে বটে দেখবার মত হত।’
নিশানাথ বলিলেন,—‘তোমার সার লাগালে আমার বাগান মরুভূমি হয়ে যেত।’
নেপালবাবু গরম স্বরে বলিলেন,—‘দেখ নিশানাথ, তুমি যা বোঝ না তা নিয়ে তর্ক কোরো না। সয়েল কেমিষ্ট্রির কী জানো তুমি? পেঁপেগাছগুলো মরে গেল তার কারণ সারের মাত্রা বেশি হয়েছিল—তোমার মালীগুলো সব উল্লুক।’ বলিয়া একটা আধপোড়া বর্মা চুরুট তক্তপোশ হইতে তুলিয়া লইয়া বজ্র-দন্তে কামড়াইয়া ধরিলেন।
নিশানাথ বলিলেন,—‘সে যাক, এখন নতুন গবেষণা কি হচ্ছে?’
নেপালবাবু চুরুট ধরাইতে ধরাইতে বলিলেন,—‘তামাক নিয়ে experiment আরম্ভ করেছি।’
‘এবার কি মানুষ মারবে?’
নেপালবাবু চোখ পাকাইয়া তাকাইলেন,—‘মানুষ মারব! নিশানাথ, তোমার বুদ্ধিটা একেবারে সেকেলে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধার দিয়ে যায় না। বিজ্ঞানের কৌশলে বিষও অমৃত হয়, বুঝেছ?’
ঠোঁটের কোণে গোপন হাসি লইয়া নিশানাথ বলিলেন,—‘তামাক থেকে যখন অমৃত বেরুবে তখন তোমাকে কিন্তু প্রথম চেখে দেখতে হবে। —এখন যাই, বেলা বাড়ছে, এঁদের বাকী বাগানটা দেখিয়ে বাড়ি ফিরব। হ্যাঁ, ভাল কথা, মুকুলের নাকি ভারি মাথা ধরেছে?’
নেপালবাবু উত্তর দিবার পূর্বে ঘনঘন চুরুট টানিয়া ঘরের বাতাস কটু করিয়া তুলিলেন, শেষে বলিলেন,—‘মুকুলের মাথা! কি জানি, ধরেছে বোধহয়।’ অবহেলাভরে এই তুচ্ছ প্রসঙ্গ শেষ করিয়া বলিলেন,—‘অবৈজ্ঞানিক লে-ম্যান হলেও তোমাদের জানা উচিত যে, নতুন ওষুধ প্রথমে ইতর প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে দেখতে হয়, যেমন ইঁদুর, গিনিপিগ। তাদের ওপর যখন ফল ভাল হয় তখন মানুষের ওপর পরীক্ষা করতে হয়।’
‘কিন্তু মানুষের ওপর ফল যদি মারাত্মক হয়?’
‘এমন মানুষের ওপর পরীক্ষা করতে হয় যারা মরলেও ক্ষতি নেই। অনেক অপদার্থ লোক আছে যারা ম’লেই পৃথিবীর মঙ্গল।’
‘তা আছে।’ অর্থপূর্ণভাবে এই কথা বলিয়া নিশানাথ দ্বারের দিকে চলিলেন। কিন্তু ব্যোমকেশের বোধহয় এত শীঘ্র যাইবার ইচ্ছা ছিল না, সে নেপালবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল,—‘আপনি বুঝি ভাল দাবা খেলেন?’
এতক্ষণে নেপালবাবু ব্যোমকেশকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলেন, ব্যাঘ্রচক্ষে চাহিয়া বলিলেন,—‘আপনি জানেন দাবা খেলতে?’
ব্যোমকেশ সবিনয়ে বলিল,—‘সামান্য জানি।’
নেপালবাবু ছকের উপর ঘুঁটি সাজাইতে সাজাইতে বলিলেন,—‘আসুন, তাহলে এক দান খেলা যাক।’
নিশানাথ বলিলেন,—‘আরে না না, এখন দাবায় বসলে দু’ঘন্টাতেও খেলা শেষ হবে না।’
নেপালবাবু বলিলেন,—‘দশ মিনিটেও শেষ হয়ে যেতে পারে। —আসুন।’
ব্যোমকেশ আমাদের দিকে একবার চোখের ইশারা করিয়া খেলায় বসিয়া গেল। মুহূর্তমধ্যে দু’জনের আর বাহ্যজ্ঞান রহিল না। নিশানাথ খাটো গলায় বলিলেন,—‘নেপাল খেলার লোক পায় না, আজ একজনকে পাকড়েছে, সহজে ছাড়বে না,—চলুন, আমরাই ঘুরে আসি।’
বাহির হইলাম। আমরা যে-উদ্দেশ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি তাহাতে ব্যোমকেশের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক নয়, রমেনবাবুর উপস্থিতিই আসল।
বাড়ির বাহিরে আসিয়া পিছন দিকে জানালা খোলার শব্দে আমরা তিনজনেই পিছু ফিরিয়া চাহিলাম। বাড়ির পাশের দিকে একটা জানালা খুলিয়া গিয়াছে এবং একটি উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে রুক্ষ উৎকণ্ঠাভরা চক্ষে আমাদের দিকে চাহিয়া আছে। আমরা ফিরিতেই সে দ্রুত জানালা বন্ধ করিয়া দিল।
এক নজর দেখিয়া মনে হইল মেয়েটি দেখিতে ভাল; রঙ ফরসা, কোঁকড়া চুল, মুখের গড়ন একটু কঠিন গোছের। রমেনবাবু স্থাণুর মত দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে বন্ধ জানালার দিকে তাকাইয়া ছিলেন, বলিলেন,—‘ও কে?’
নিশানাথ বলিলেন,—‘মুকুল—নেপালবাবুর মেয়ে।’
রমেনবাবু গভীর নিশ্বাস টানিয়া আবার সশব্দে ত্যাগ করিলেন,—‘ওকে আগে দেখেছি—সিনেমার স্টুডিওতে দেখেছি—’
নিশানাথ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া শেষে মৃদুস্বরে বলিলেন,—‘কিন্তু ও সুনয়না নয়?’
রমেনবাবু ধীরে ধীরে মাথা নাড়িলেন,—‘না—বোধ হয়—সুনয়না নয়।’