১.৪১-৪৫ গভীর রাতে মান্নান মাওলানার বাড়িতে

১.৪১

গভীর রাতে মান্নান মাওলানার বাড়িতে এসে উঠল কাশেম। সন্ধ্যাবেলা মিয়াবাড়ির চালতাতলায় বসে অন্ধকার শীত আর মশার কামড় ভুলে গরুগুলির কথা ভেবে আকুল হয়ে কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল বাড়ি থেকে তাকে বের করে দিয়েছেন মান্নান মাওলানা। বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখলে কঠিন মাইর আছে কপালে। নিজের অজান্তেই চালতাতলা থেকে তারপর উঠেছিল কাশেম। তখনও চোখ ভেসে যাচ্ছে কাশেমের, গাল ভেসে যাচ্ছে। এক ফাঁকে হাঁটু তরি মুখ নামিয়ে লুঙ্গি দিয়ে চোখ মুছেছে। তারপর বাড়ির পিছন দিক দিয়া গিয়া উঠছে মেন্দাবাড়িতে। সেই বাড়ির উপর দিয়া গিয়া নামছে উত্তরের চকে। চক তখন থই থই করতাছে অন্ধকারে। চারদিকের ছড়ান ছিটান গিরস্ত বাড়ির ঘর দুয়ারে জ্বলছে কুপিবাতি। রান্ধনঘর, উঠানের কাজ শেষ করে রাতের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন চলছে কোনও কোনও বাড়িতে। যে বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে পড়ে তারা কুপি, হারিকেনের আলোয় পড়তে বসেছে। কোনও কোনও আয়েশি গিরস্ত ঘরের ছেমায় বসে তামাক খাচ্ছে। গল্পগুজব করতাছে কেউ কেউ। সড়কের দিকে মাটিয়ালদের চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পাওয়া যায়। দিন কয়েক হল তোড়জোড় বেড়ে গেছে কাজের। প্রেসিডেন্ট এরশাদ নাকি বলেছেন, তিন চার মাসের মধ্যে মাওয়ার ঘাট পর্যন্ত রাস্তা হতেই হবে। শুনে কন্ট্রাক্টরদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। একদিকে মাটির কাজ হচ্ছে, আরেক দিকে হচ্ছে ইট বিছানোর কাজ, আরেক দিকে হচ্ছে পিচ, পাথরের কাজ। শ্রীনগর পর্যন্ত পাকা হয়ে গেছে রাস্তা। কোলাপাড়া পর্যন্ত ইট বিছানো শেষ। এসব দেখে আলী আমজাদের গেছে মাথা খারাপ হয়ে। হ্যাঁজাক জ্বালিয়ে সারারাত কাজ করাচ্ছে সে। দিনের পর দিন বাড়িতে যায় না। ছাপড়া ঘরে থাকে। নাওয়া খাওয়া এখানেই। যদিও ম্যানেজার হেকমত আছে তবু নিজেও দেখাশোনাটা সে করতাছে। মাঝে একটু ঢিলা দিয়েছিল কাজে, এখন আর সেই ঢিলামি নাই। জাহিদ খাঁর বাড়ি ছাড়িয়ে বেশ অনেকদূর আগিয়েছে সড়ক কিন্তু ঘর আগায় নাই। যেখানে ছিল সেখানেই আছে। এইসব ঘর। সাধারণত কন্ট্রাক্টরদের কাজের লগে লগে আগায়। বেডা, চাল দরজা জানালা এমন কি খুটাখুটিও আলগা থাকে। আট দশজন মানুষ হলে যখন তখন সরিয়ে নেওয়া যায় পুরা ঘর। দিনে দিনেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে উঠে যায়। ব্যাপারটি এত সহজ হওয়ার পরও আলী আমজাদ যে কেন সরায় নাই ঘরটা! নিজে কষ্ট করতাছে, বেশ খানিকদূর আগিয়ে যাওয়া সড়ক ধরে হেঁটে আর নয়তো মোটর সাইকেলে চড়ে ফিরে ফিরে আসছে এই ঘরে! কেন, কোন গোপন টানে, কে জানে!

অন্ধকারে ডুবা উত্তরের চক থেকে হাজামবাড়ির দিকে একবার তাকিয়েছিল কাশেম। তাকিয়ে গাছপালা, ঘর দুয়ারের ফাঁক ফোকর দিয়ে সড়কের ওদিকটা দেখতে পেয়েছিল। হ্যাঁজাকের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে। মাটি ভর্তি ছোঁড়া মাথায় ভাঙন থেকে সার ধরে সড়কে উঠছে মাটিয়ালরা, মোড়া খালি করে সার ধরে নেমে যাচ্ছে। ঠিক তখনই হু হু করে আসছিল উত্তরের হাওয়া। সেই হাওয়ায় তীব্র শীতে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল কাশেমের উদাম গা। মনে পড়েছিল সবকথা। আলফুকে বলা আসা হল না। কী ভাববে সে! যে মানুষটা চুরি করে নিজের ভাগ থেকে এমন করে ভাত খাওয়াল, দুইদিনের অনাহারী পেট ভরল যার ভাতে, কুট্টির কাছে ধরা পড়েও যে একদমই ঘাবড়াতে দিল না কাশেমকে, বলল কথা শুনতে হলে সে শুনবে, কাশেমের কী, সে কেন পেট ভরে খাচ্ছে না, সে কেন ভয় পায়! সেই মানুষকে না বলে এমন করে কেন পালিয়ে এল কাশেম! যে মানুষ গেল তার জন্য রাতের ভাত জোগাড় করতে, আরামছে ঘুমাবার ব্যবস্থা করতে সেই মানুষকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে কাশেম কি না পলালো!

চকের চষা অচষা জমি থেকে, বড়কলুই ছোটকলুই (মটুরশুঁটি। দুই ধরনের হয়। বড় এবং ছোট। বড়গুলোকে বলে বড়কলুই ছোটগুলোকে ছোটকলুই। শুকিয়ে যাঁতায় ভাঙিয়ে ডাল করা হয়। বিক্রমপুর অঞ্চলে বলে কলুইয়ের ডাইল। কলুই শাক বেশ আগ্রহ করে খায় লোকে। গরু ছাগলের খাদ্য হিসেবেও কাজে লাগে) আর সউষ্যার সদ্য গজান চারায় তখন অন্ধকারে ঝরছিল শিশির। উত্তরের হাওয়ার লগে পাল্লা দিয়া শস্যচারা আর ঘাসের আড়াল সরিয়ে মাটি থেকে উঠছিল আশ্চর্য এক শীতলতা। গ্রাম প্রান্তরের উপর পড়েছে কুয়াশা। আকাশ জুড়ে আছে ঝিকিমিকি তারার মেলা। তারার ক্ষীণ আলোয় অন্ধকারেও আবছা মতন চোখে পড়ে কুয়াশা। এরকম পরিবেশে আলফুর কথা ভেবে পা থেমে গিয়েছিল কাশেমের। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল সে। মনে মনে আলফুর উদ্দেশ্যে বলেছিল, দুনিয়াদারির চক্কর আমি বুজি না ভাই। আমি বলদা (বলদ, বোকা অর্থে) মানুষ। মানুষ থুইয়া গরুর লেইগা বেশি টান। তুমি আমারে মাপ কইরা দিও।

হন হন করে হেঁটে মান্নান মাওলানার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল কাশেম। বাড়ির ঘর দুয়ারে তখন কুপিবাতি জ্বলছে, এইঘর ওইঘর করতাছে লোকজন, এই অবস্থায় কিছুতেই বাড়িতে ওঠার সাহস হয় নাই কাশেমের। সে গিয়ে বসেছিল পথপাশের কাশবনে।

জায়গাটা বেপারীদের পুকুরপারে। পার জুড়ে ঘন কাশ জন্মেছে। পাশ দিয়ে চলে গেছে সরু একটা পথ। কয়দিন হল এমন সাদা হয়েছে কাশফুল, অন্ধকারেও ফকফক করে। জায়গাটায় শীত যেন আরও বেশি। জবুথুবু হয়ে বসেই হি হি করে কাঁপতে লাগল কাশেম। লুঙ্গি খুলে কান পর্যন্ত শরীর ঢুকিয়ে দিল লুঙ্গির ভিতর, দিয়ে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে রইল মান্নান মাওলানার বাড়ির দিকে। কখন ঘরের দুয়ার বন্ধ হবে বাড়ির, কখন নিভবে কুপিবাতি, কখন কাশেম গিয়ে উঠবে বাড়িতে, কখন অন্ধকারে হাত রাখবে গরুগুলির গায়ে। তার স্পর্শে, গায়ের গন্ধে গরুরা টের পাবে তাদের প্রিয়তম জীবটি তাদের টানে ফিরে এসেছে।

সেই যে দুপুরবেলা খেয়েছিল তারপর পেটে আর কিছু পড়ে নাই কাশেমের, তবু ক্ষুধা বলতে কিছু টের পাচ্ছিল না সে। মন জুড়ে শুধু গরুদের কথা, কখন ছুঁয়ে দেখবে গরুদের, শরীর জুড়ে শুধু সেই উত্তেজনা। উত্তেজনায় উত্তেজনায় সময় কেটে গেছে। রাত হয়েছে গভীর। কাশবন থেকে বেরিয়েছে কাশেম। দ্রুত হেঁটে বাড়িতে উঠেছে। নাড়ার পালার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। তিনদিন হল বাড়ি ছাড়া সে, মনে হল তিনদিন না যেন বহু বহুদিন পর বাড়ি ফিরল সে, বহু বহুদিন পর নাড়ার পালাটা দেখতে পেল। বহুদিন পর দেখা হলে আপনজনকে যেমন করে ছোঁয় মানুষ ঠিক তেমন করে, গভীর মায়াবি হাতে নাড়ার পালাটা একটু ছুঁয়ে দিল কাশেম। তারপর আথালের সামনে এসে দাঁড়াল।

রাবের মতন অন্ধকারে ডুবে আছে চারদিক। তারার আলোয়ই যেটুকু যা চোখে পড়ে। আর মানুষের চোখের আছে এক আশ্চর্য ক্ষমতা। দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে থাকলে, অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে আবছা মতন হলেও কিছু না কিছু সেই চোখ দেখতে পায়। কাশেমও পাচ্ছিল। আথালের সামনে দাঁড়িয়ে যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল গরুগুলির কোনওটা দাঁড়িয়ে কোনওটা বসে। কোনওটা জাবর কাটছে, কোনওটা ঝিমাচ্ছে, কোনওটা বা গভীর ঘুমে। লেজ পিটিয়ে মশা তাড়াচ্ছে কোনও কোনওটা। আহা রে, মশায় বুঝি খেয়ে শেষ করতাছে গরুগুলিকে! ওই তো ধূলিটাকে আবছা মতন দেখা যায় অবিরাম লেজ পিটাচ্ছে নিজের পেটে পিঠে। এই গরুটা একটু বেশি আরামপ্রিয়। মশার একটি কামড়ও সহ্য করতে পারে না। সারারাত দাঁড়িয়ে থাকে, সারারাত ছটফট করে।

ধলির দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই লুঙ্গি কাছা মারল কাশেম। যেন এখনই ধুপ জ্বালবে, আথালের চারদিকে ধুপদানী হাতে চক্কর দিবে। ধুপের ধুমায় বেদিশা হয়ে যে দিকে পারে চম্পট দিবে মশারদল।

কিন্তু এই রাত দুপুরে ধুপ কাশেম কোথায় পাবে! সন্ধ্যার পর থেকে বারবার সে কেন ভুলে যাচ্ছে সে এখন আর এই বাড়ির কেউ না। তার জায়গায় নিশ্চয় অন্য গোমস্তা এসেছে বাড়িতে। গরুগুলি এখন সেই গোমস্তার অধীনে। তার সঙ্গে মাঠে যায়, তার সঙ্গে ফিরে আসে। মাঠে যাওয়ার সময়, ফিরার সময় এমন কি বাড়িতে এসেও গুরুগুলি হয়তো কাশেমকে খোঁজে। মুখে ভাষা নাই বলে কথা বলতে পারে না। অবলা চোখে চারদিক তাকিয়ে খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে কাশেমের কথা একদিন ভুলে যাবে তারা। নুতন গোমস্তাকে ভালবাসতে শুরু করবে। দুনিয়ার নিয়মই তো এই, চোখের আড়াল থেকে মনের আড়াল। মানুষই মানুষকে মনে রাখে না আর এ তো গরু!

এসব ভেবে চোখ ভরে পানি এল কাশেমের। ধীর পায়ে হেঁটে আথালে ঢুকল সে। লগে লগে বসে থাকা গরুগুলি উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে থাকাগুলি কান লটরপটর করে এ ওর দিকে তাকাতে লাগল। দুইটা ছাড়া বাছুরের একটা গিয়ে মায়ের পেট ঘেঁষে দাঁড়াল। মা গাইটা লেজ সামান্য উঁচু করে চন চন শব্দে চনাতে লাগল (পেশাব করা)। কাশেম বুঝল অন্ধকারে গরুগুলি তাকে চিনতে পারেনি। গরুচোর ভেবে সচেতন হয়েছে।

দুইহাত দুইটা গরুর পিঠে রাখল কাশেম। গভীর মায়াবি গলায় ফিসফিস করে বলল, আমারে তোমরা চিনতে পার নাই? আমি কাশেম। মাকুন্দা কাশেম।

কাশেমের এই হাকিকি যেন পরিষ্কার বুঝতে পারল গরুগুলি। কী রকম একটা আনন্দের সাড়া পড়ে গেল তাদের মধ্যে। কান লতপত করে, লেজ নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। মায়ের পেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ান বাছুরটা হঠাৎই তিড়িং করে একটা লাফ দিল, তারপর কাশেমের কাছে ছুটে এল। কাশেমের পেট বরাবর মাথা ঘষতে লাগল। যেন বা মায়ের মতোই আপন আরেকজনকে পেয়েছে সে। বাছুরটার আচরণে জীবনে এই প্রথম কাশেমের মনে হল বাছুরটা গরুর না, এ আসলে এক মানব সন্তান। যেন বা কাশেমের ঔরসেই জন্মেছে। বহুকাল দেখেনি পিতাকে। আজ কাছে পেয়ে আল্লাদে আটখানা হয়েছে।

দুইহাতে বাছুরটার গলা জড়িয়ে ধরে আথালের ভিতর বসে পড়ল কাশেম। আথালের মাটি মাখামাখি হয়ে আছে চনায়, গোবরে। চারদিকে বিন বিন করতাছে মশা। মানুষের উদাম শরীর পেয়ে গরুদের ছেড়ে মানুষটার ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। যে যেদিক দিয়ে পারে রক্ত চুষছে। কিন্তু কাশেমের কোনওদিকে খেয়াল নাই। আপন সন্তানের মতো বাছুরটিকে বুকে জড়িয়ে বসেছে সে। চারদিকে দাঁড়ান গরুরা সরে গিয়ে তার বসার জায়গা করে দিয়েছে। কাশেমের পেটে বুকে যেমন আল্লাদে মুখমাথা ঘষছে বাছুরটা ঠিক তেমন করেই বাছুরটার মাথায় মুখ ঘষতে লাগল কাশেম। ফিসফিস করে বলতে লাগল, ওরে আমার সোনারে, ওরে আমার মানিকরে, এত রাইত অইছে ঘুম আহে না তোমার! ক্যান ঘুম আহে না বাজান! ঘুমাও, আমার কুলে হুইয়া তুমি ঘুমাও। আমি তোমার মাথা দোয়াইয়া (হাত বুলিয়ে দেয়া) দিমুনে, পিঠ দোয়াইয়া দিমুনে। একটা মোশায়ও তোমারে কামড় দিতে পারব না। বেবাক মশা আমি খেদাইয়া দিমু নে।

.

১.৪২

সাদা থানের মতো কুয়াশার ভিতর থেকে বের হয়ে আসে একজন মানুষ। কাঁধে একেক পাশে দুইটা করে মাঝারি মাপের ঠিলা বসান ভার। ঠিলাগুলি যে রসে ভরা মানুষটার বেঁকে যাওয়া শরীর দেখে তা বোঝা যায়। গায়ে খয়েরি রঙের হাফহাতা সোয়েটার। বহুকালের পুরানা সোয়েটার। দুইতিন জায়গায় বড় বড় ফুটা। সেই ফুটা দিয়া দেখা যায় সোয়েটারের তলায় আর কিছু পরে নাই সে।

শীতে কাঁপতে কাঁপতে খানিক আগে মান্নান মাওলানার আথাল থেকে বের হয়েছে কাশেম। রাত কেটেছে গরুদের সঙ্গে, সেই বাছুরটাকে কোলে জড়িয়ে। চারদিকে গৰুদের গায়ের উষ্ণতা, কোলের কাছে বাছুরটার উষ্ণতা, রাতেরবেলা শীত একদমই উদিস পায়নি কাশেম। ঘুমিয়েছে কী ঘুমায়নি তাও উদিস পায়নি। রাত কেটে গেছে অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে। ভোররাতে, মোরগে বাগ দেওয়ার লগে লগে নড়েচড়ে উঠেছে কাশেম। রাত শেষ হয়ে এল। এখনই ঘরের দুয়ার খুলবেন মান্নান মাওলানা, উঠানে নামবেন। তারপর আথালের দিকে আসবেন। গরুগুলি ঠিকঠাক আছে কিনা দেখবেন। সেই ফাঁকে কাজের ঝি রহিমা রান্নাঘরে ঢুকে পানি গরম করবে। বালতি ভরে গরম পানি এনে রাখবে বারবাড়ির একপাশে অনেকদিন ধরে ফেলে রাখা চাইর কোনাইচ্চা (চৌকো) পাথরটার সামনে। পিতলের একখান বদনাও রাখবে। পাথরের ওপর বসে বদনা ভরে বালতি থেকে গরম পানি তুলে অজু করবেন মান্নান মাওলানা। শীতকালে গরম পানি ছাড়া অজু করেন না তিনি।

অজু শেষ করে সেই পাথরের ওপর দাঁড়িয়েই পশ্চিমমুখি হবেন। সারাটা শীতকাল গায়ে থাকে তার ফ্লানেল কাপড়ের মোটা পানজাবি। পানজাবির ওপর হাতে বোনা নীল হাফহাতা সোয়েটার। সোয়েটারের ওপর ঘিয়া রঙের আলোয়ান। সেই আলোয়ানে টুপির মতো করে মাথা ঢেকে আজান দিবেন। পায়ে থাকবে মোটা মোজা, কালো রাবারের পাম্পসু। এতসব ভেদ করে শীতের বাবার সাধ্য নাই মাওলানাকে কাবু করে।

এই মানুষটার ভয়েই, মানুষটা দুয়ার খুলবার আগেই আথাল থেকে বের হয়েছিল কাশেম। বের হবার আগে কোলে আদুরে মানব সন্তানের মতো লেপটে থাকা বাছুরটাকে ঠেলে তুলেছে। হাকিহুকি করে বলেছে, ওডো বাজান, ওডো। এলা (এখন) মার কাছে যাও। আমার তো যাওনের সময় অইলো।

ঘুমে চোখ জড়ান শিশুর মতো টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বাছুরটা। কাশেম তাকে ঠেলে দিয়েছে মা গরুটার পেটের কাছে। মার কাছে যাও বাজান।

যেন রাতভর পিতার গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটাকে ভোরবেলা মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিচ্ছে পিতা, ভঙ্গিটা তেমন ছিল কাশেমের। কাশেম তারপর আথালের প্রতিটা গরুর দিকে তাকিয়েছে, প্রতিটা গরুর গায়ে হাত দিয়েছে। আমি তাইলে যাই অহন। বিয়ান অইয়া গেছে। আবার রাইতে আমুনে। দিনে তোমগো লগে আর থাকতে পারুম না আমি। তয় রাইতে আইয়া থাকুম। বেবাকতে ঘুমাইয়া গেলে, চুপ্পে চুপ্পে আমু। তোমগো কাছ থিকা কেঐ সরাইয়া রাকতে পারবো না আমারে।

আথাল থেকে বেরিয়েই বেদম শীত টের পেয়েছিল কাশেম। তার উদাম শরীরের চামড়া যেন ফাটিয়ে দিচ্ছিল শীত। কাশেমের ইচ্ছা করছিল আবার ছুটে যায় আথালে। গরুদের ওমে শীত কাটায়। কিন্তু উপায় নাই। এখনই তার ঘরের দুয়ার খুলবেন মান্নান মাওলানা।

উঠানের মাটি ছিল পুকুরের তলার পানির মতন ঠাণ্ডা। রাতভর ওস (শিশির) শুষে ঠাণ্ডা হয়েছে। কিন্তু এই ঠান্ডা গায়ে লাগল না কাশেমের। লুঙ্গি খুলে কোনও রকমে কান পর্যন্ত ঢাকল সে। দ্রুত হেঁটে বাড়ি থেকে নামল।

বাড়ির লগের রাস্তা সবুজ দূর্বাঘাসে ভরা। ওস পড়ে বৃষ্টিতে ভিজার মতো ভিজেছে ঘাসড়গা। সেই ঘাসে পা ফেলার লগে লগে পায়ের তলার শীতটাও টের পেল কাশেম। হি হি করে কাঁপতে লাগল, দাঁতে দাঁত লেগে খটখট করে শব্দ হতে লাগল তার।

এই শীত থেকে কেমন করে এখন নিজেকে বাঁচাবে কাশেম! লুঙ্গি কাছা মেরে চক পাথালে দৌড় শুরু করবে নাকি। দৌড়ালে শীত বলে কিছু থাকবে না।

নাকি যেভাবে আছে সেভাবে থেকেই যত জোরে সম্ভব হাঁটতে শুরু করবে। জোরে হাঁটলেও শীত কমে।

কাশেম তারপর হাঁটতে শুরু করেছিল।

হাঁটতে হাঁটতে এক সময় মনে হয়েছে গরুগুলি কে নিয়া যায় চকে, একটু দেখা দরকার। নুতন গোমস্তা রেখেছেন নাকি মান্নান মাওলানা! নাকি নিজেরাই নিয়া যাচ্ছেন! নিজেরা নিয়া গেলে কে নিয়া যায়! মাওলানা সাহেব নিজে নাকি আতাহার! কিন্তু আতাহারের যা স্বভাব চরিত্র, শীতের দিনে বেলা অনেকখানি না উঠলে ঘুমই ভাঙে না তার। আর গরু নিয়ে চকে মরে গেলেও সে যাবে না!

তাহলে কি মাওলানা সাহেব নিজেই নিয়া যাচ্ছেন? গোমস্তা রাখলে কাকে রেখেছেন। মেদিনীমণ্ডলের কাউকে নাকি অন্য গ্রামের অচেনা কোনও লোককে

এসব ভেবে মান্নান মাওলানার বাড়ির সামনে থেকে ফকির বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাচ্ছিল কাশেম আর ফিরে আসছিল। এই ফাঁকে শীতটাও এক সময় কজা হয়েছে, সময়টাও কেটেছে। খান বাড়ির মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে এসেছে, মান্নান মাওলানার বাড়িতে জেগে উঠেছে মানুষজন। মান্নান মাওলানা যখন আজান দিচ্ছেন তখন বেপারি বাড়ির সামনে ছিল কাশেম। দ্রুত হেঁটে কাশবনের দিকে যাচ্ছিল তখনই কুয়াশা ভেঙে বের হয়ে এল ভার কাঁধে মানুষটা। পলকেই তাকে চিনতে পারল কাশেম। দবির গাছি।

দবিরও ততক্ষণে চিনে ফেলেছে কাশেমকে বেশ খানিকদূর হাঁটার পর এমনিতেই কোথাও না কোথাও ভার নামাতে হয় তাকে, জিরাতে হয়। কাশেমকে দেখে এই সুযোগটা নিল সে। অতিযত্নে রাস্তার মাঝখানে নামাল কাঁধের ভার। এই শীতেও ঘেমে গেছে সে। উপুড় হয়ে লুঙ্গির খুঁটে মুখ মুছে কাশেমের দিকে তাকিয়ে হাসল, কী রে কাশেম, কই যাচ এত বিয়ানে? 

তারপরই কাশেমের মার খাওয়া বীভৎস মুখটা দেখতে পেল। দেখে আঁতকে উঠল। কী রে, কী অইছে তর?

লুঙ্গির ভিতরে জবুথুব করে রাখা শরীর টানা দিয়ে দাঁড়াল কাশেম। নাভির কাছে লুঙ্গি বেঁধে বলল, হুজুরে মারছে।

ক্যা?

পরে কমুনে।

অহন কইতে অসুবিদা কী!

কাশেমের গায়ে যে কিছু নাই তারপরই তা দেখতে পেল দবির। দেখে এতই অবাক হল, কাশেমকে যে নির্মমভাবে মেরেছেন মান্নান মাওলানা, মুখচোখ ফাটিয়ে ফেলেছেন, ভুলে গেল। গভীর বিস্ময়ে বলল, খালি গায় ক্যা তুই? এমুন শীতে খালি গায় থাকতে পারেনি মাইনষে! মইরা যাবি তো বেডা!

কাশেম অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, কী করুম। কাপড় চোপড় বেবাকঐ হুজুরের বাইত্তে রইয়া গেছে। আনতে পারি নাই। হুজুরে আমারে মাইরা ধইরা খেদাইয়া দিছে।

অবাক হয়ে কাশেমের মুখের দিকে তাকিয়েছে দবির। জিজ্ঞাসা করেনি কিছু তবু ঘটনা তাকে খুলে বলেছে কাশেম। শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে দবির। দুঃখে মাথা নেড়েছে। আহা রে! কী কমু ক, আমরা গরিব গরবা মানুষ। তারা বড় গিরস্ত, পরহেজগার বান্দা, তারা যুদি এমুন করে, আমগো লাহান মানুষ যায় কই! তুই একখান কাম কর, আমার সুইয়াটারড়া নে। আমি তো বোজা কান্দে দৌড়াই, শীত লাগে না, লাগে গরম। এই দেক ঘাইম্মা গেছি।

ছেঁড়া সোয়েটারখান খুলে কাশেমের হাতে দিয়েছে দবির। এইডা গায় দে। দিয়া আমগো বাইত্তে যা। আমি রস বেইচ্চা আহি তারবাদে কথা কমুনে।

সোয়েটার হাতে কাশেম তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দবিরের দিকে। পানিতে চোখ ভরে গেছে তার। সেই চোখের দিকে চোখ পড়ল না দবিরের। বলল, কী অইলো খাড়ই রইলি ক্যা? সুইয়াটার গায়ে দে, যা।

তবু সোয়েটারটা পরল না কাশেম। চোখের পানি সামলে ধরা গলায় বলল, তোমরা আমারে এত মহব্বত করো ক্যান, ক্যান এত মহব্বত করো! তোমগো মহব্বতের টানে, গরুডির মহব্বতের টানে, এই গেরামের গাছগাছলা, ঘরদুয়ার, আসমানের পাখি পুকুরের মাছ, চকের ফসল, রইদ বাতাস, ক্যান বেবাকতে তোমরা আমারে এত মহব্বত করো? তোমগ মহব্বতের টানেঐত্তো গেরাম ছাইড়া যাইতে পারি না আমি। নাইলে কে আছে আমার এই গেরামে, কও! মা বাপ নাই, ভাই বেরাদর নাই, আততিয় স্বজন নাই। ক্যান এই গেরামে পইরা রইছি আমি।

শেষদিকে কান্না আর ধরে রাখতে পারল না কাশেম। অন্যদিকে তাকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগল।

গভীর মমতায় কাশেমের কাঁধে একটা হাত রাখল দবির। এই বলদা, কাঁচ ক্যা? যা আমার বাইত্তে যা। নূরজাহানের মারে কইচ মুড়ি দিবোনে। খা গিয়া। আমি মাওলানা সাবের বাইত্তে যাইতাছি। বেবাক রস বলে আইজ হের লাগবো। দিয়া আইতাছি।

দবিরের দিকে মুখ ফিরাল কাশেম। চোখ মুছতে ভুলে গেল। ভয়ার্ত গলায় বলল, আমার কথা কিছু কইয়ো না হুজুররে। আমার লগে যে তোমার দেহা অইছিলো, আমারে যে তুমি সুয়াটার দিছো, কিচ্ছু কইয়ো না।

দবির কী বুঝল কে জানে, কাশেমের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আইচ্ছা কমু না।

.

১.৪৩

মান্নান মাওলানার বাড়ির উঠানে বসে রস মাপছে দবির। ভার নামিয়ে হাতের কাছে রেখেছে রসের ঠিলা। সামনে বড় সাইজের তিনটা বালতি আর একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি।

দবির এই বাড়িতে এসে ওঠার পর বালতি হাঁড়ি এনে তার সামনে রেখেছে রহিমা। হাঁটু ভেঙে বসে বাপায়ের কাছে রসভর্তি ঠিলা রেখে, বাঁহাতে কায়দা করে ঠিলার কানা ধরে পা এবং হাতের ভরে ঠিলাখান কাত করে ডানহাতের একসেরি মাপের টিনের মগে রস ঢালছে। মগ ভর্তি হওয়ার লগে লগে রস ঢেলে দিচ্ছে বালতিতে। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মান্নান মাওলানা। তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে আছেন দবিরের হাতের দিকে। মাপে কম দিচ্ছে কিনা গাছি, খেয়াল করতাছেন। মুখে বিড়বিড়ান একটা ভাব তার। অর্থাৎ কয়সের হল রস গনছেন তিনি।

ঠিক একই ভঙ্গিতে দবিরও গনছিল। ফলে অন্য কোনওদিকেই খেয়াল ছিল না। তার। চারটা ঠিলা খালি করে হাসিমুখে মান্নান মাওলানার দিকে তাকাল সে। এক মোণ চাইস্বের (চারসের) অইছে হুজুর।

শুনে মান্নান মাওলানা যেন চমকালেন। কচ কী? এক মোণ চাইস্বের?

 হ।

একটু থেমে অবাক গলায় দবির বলল, ক্যা আপনে গনেন নাই?

না।

কন কী! আপনে সামনে খাড়ইয়া রইছেন, আমি তো মনে করছি গনতাছেন!

না গনি নাই।

মুখটা চুন হয়ে গেল দবিরের। হতাশ গলায় বলল, তাইলে?

মান্নান মাওলানা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, তাইলে আর কী!

আবার মাইপ্পা দিমু?

আবার মাপনের তো ঝামেলা অনেক।

আপনে কইলে মাপি। আমার ইট্টু কষ্ট অইবো, অউক।

মান্নান মাওলানা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, কাম নাই আর মাপনের। তয় আমার মনে অইতাছে মাপে গরবর অইছে তর। ছয় পাড়ির (বিক্রমপুর অঞ্চলে পাঁচ সেরকে ‘একপাড়ি’ বলা হয়। তবে কথাটা খুব বেশি প্রচলিত নয়) বেশি রস এহেনে অওনের কথা না।

শুনে দবির আকাশ থেকে পড়ল। কন কী হুজুর! তিনডা বালতি পুরা ভরছে। পাতিলাডাও ভরা ভরা। বালতিডি তো বারোসেরির কম না!

আরে না বেডা, আষ্টসেরি বালতি। পাতিলডাও ওই মাপের।

তাইলে হুজুর আমি আরেকবার মাপি। আপনে গনেন।

না থাউক।

থাকবো ক্যা?

আমি তর কথা বিশ্বাস করলাম।

মনের মইদ্যে সন্দ রাইক্কা আমারে আপনের বিশ্বাস করনের কাম নাই।

না সন্দ আর কী! মাপে কম দিলে আল্লার কাছে ঠেকা থাকবি।

এইডা খাডি কথা কইছেন হুজুর। হ, এক মোণ চাইস্বের থিকা একফোডা রস যুদি আপনেরে কম দিয়া থাকি তয় আল্লার কাছে ঠেকা থাকুম। হাসরের দিন এই রসের বিচার অইবো।

দবির উঠে দাঁড়াল। আমরা হুজুর গরিব গরবা মানুষ, অভাবী মানুষ, তয় নিঐত (নিয়ত) খারাপ না। কেরে ঠকাইয়া দুইডা পয়সা খাইতে চাই না। হারাম খাওনের আগে আল্লায় য্যান এই দুইন্নাই থিকা উডাইয়া নেয়।

রস ভর্তি বালতি একটা একটা করে রান্ধনঘরে নিয়ে রাখছে রহিমা। কোন ফাঁকে পানজাবির পকেট থেকে কাঁকুই বের করেছেন মান্নান মাওলানা। এখন আনমনা ভঙিতে দাঁড়ি আচড়াচ্ছেন।

এক পলক তার দিকে তাকিয়ে দবির হাসিমুখে বলল, এত রস দিয়া কী করবেন হুজুরঃ কুড়ুম আইবোনি?

হ মাইয়ারা আইবো, জামাইরা আইবো। নাতি নাতকুররা আইবো। আতাহারের মায় পোনরো সের চাউল ভিজাইছে। কাইল বিয়ালে কাহাইল ছিয়া দিয়া গুঁড়ি (চাউলের গুড়ো) কুইট্টা রাকছে। আইজ হারাদিন পিডা বানাইবো।

কী পিডা? সেঐ কুলঐ? (সেঐ কথাটির মানে সেমাই। চাউলের গুড়ো আটার মতো দলে পিঁড়ি কিংবা পাটায় রেখে হাতের ঘষায় ঘষায় তৈরি করতে হয়। কড়ে আঙুলের সমান লম্বা এবং সামান্য মোটা। পরে রসে ফেলে জ্বাল দিতে হয়। রসের পরিবর্তে গুড় চিনি দিয়েও তৈরি করা যায়। কুলঐ পিঠা হচ্ছে অর্ধচন্দ্রাকারের, ভেতরে নারকেল দিয়ে। মুখ বন্ধ করে রসে ছাড়তে হয়। কুল পিঠাও গুড় চিনি দিয়ে তৈরি করা যায়)

হ। সেঐ কুলঐ তো আছে, চিতও মনে অয় বানাইবো। চাইর পাঁচখান খাজ বাইর করতাছে দেকলাম। খাঁজের পিডাও বানাইবো। (মাটির তৈরি সাচ। চাউলের গুড়ো পানিতে গুলে যেভাবে চিতইপিঠা তৈরি করা হয় ঠিক সেভাবেই সাচে ফেলতে হয়। এ আসলে এক ধরনের চিতইপিঠা।)

ভাল। পিড়া তো মাইনষে শীতের দিনেঐ খায়।

পুবের ঘরের চালা ডিঙিয়ে সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে উঠানে। কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। যেটুকু আছে সেটুকু উঠে গেছে গাছপালার মাথায়। খানিকপর। উধাও হবে। রোদের ছোঁয়ায় কুয়াশার মতো শীতটাও কাটছে।

মান্নান মাওলানা কয়েক পা হেঁটে রোদে এসে দাঁড়ালেন। দেখে দবির মনে মনে বলল, এত কিছু গায় দিয়াও শীত করে মাইনষের! আর আমি যে খালি গায়!

তারপরই কাশেমের কথা মনে পড়ল। ওইরকম শীতে খালি গায়ে ছিল কাশেম। আশ্চর্য ব্যাপার!

গোয়ালঘরে লুঙ্গি কাছা মেরে কাজ করতাছে একটা লোক। আনমনে সেদিক তাকাল দবির। লোকটাকে চিনতে পারল না। চালাকি করে বলল, কাইশ্যা কো? আথালে দিহি অন্যমানুষ!

হ। কাইশ্যারে খেদাইয়া দিছি। অন্য গোমস্তা রাকছি। চউরা।

নাম কী?

হাফিজদ্দি।

তারপরই হাত কচলাতে কচলাতে আসল কথাটা বলল দবির। দেন হুজুর।

কথাটা যেন বুঝতে পারলেন না মান্নান মাওলানা। বললেন, কী দিমু?

দবির হাসল। রসের দাম দিবেন না?

 হ দিমু না? কত দাম অইছে?

দুই টেকা সের। এক মোণ চাইষের। আষ্টাশি টেকা অইছে।

কচ কী! দুই টেকা সের রস আছেনি? একটেকা দেটটেকার বেশি রসের সের অইতে পারে না!

না। আড়াই তিনটেকা সেরও বেচি। আপনের লগে দামাদামি করি না। দুইটেকা সেরঐ দেওন লাগবো।

পাগল অইছস! কয় সের অইছে না অইছে আমি বুজি না, দুইটেকা না দেটটেকা হেইডাও বুজি না, বেবাক মিল্লা পনচাস টেকা পাবি। চাইর পাঁচদিন বাদে আইয়া টেকা লইয়া যাইচ।

শুনে দাবির হাঁ করে থাকে। কথা বলতে পারে না। তারপর হা হা করে ওঠে। কন কী হুজুর! না না, এইডা অইবো না। আষ্টাশির জাগায় আপনে নাইলে আষ্টটেকা কম দেন। এত কম দিলে মইরা যামু আমি।

পনচাস টেকা কম টেকা না। যা বাইত্তে যা, পরে আইয়া লইয়া যাইচ।

না হুজুর পনচাস টেকা আমি নিমু না। এত ঠকান আমারে আপনে ঠকায়েন না।

একথায় মান্নান মাওলানা রেগে গেলেন। ঘেটি ত্যাড়া করে দবির গাছির দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কী, আমি তরে ঠকাইছি! মান্নান মাওলানা মানুষ ঠকায়! আমার মুখের সামনে খাড়ইয়া এতবড় কথা কইলি! ঐ শুয়োরের বাচ্চা, তর রস তুই লইয়া যা। এই রস আমি রাখুম না। এইরসে আমি মুতি।

দবির কল্পনাও করেনি এইভাবে কথা বলবেন মান্নান মাওলানা। সে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। কাঁচুমাচু গলায় বলল, আমি আপনেরে এইকথা কই নাই হুজুর। আপনে উল্টা বোজছেন।

চুপ কর শালার পো শালা আমি উল্টা বুজছি! উল্টা ভাবদি (সোজা) আমারে বুজাও। তুমি চুতমারানীর পো বহুত খারাপ মানুষ। নিজে যেমুন মাইয়াডাও অমুন বানাইছস। ডাঙ্গর মাইয়া, দিন নাই রাইত নাই যেহেনে ইচ্ছা ওহেনে যায়, যার লগে ইচ্ছা তার লগে রঙ্গরস করে। আমারে কয় রাজাকার। হেইদিনের ছেমড়ি ও রাজাকারের বোজে কী! হ আমি রাজাকার আছিলাম, কী অইছে? আমি অহনও রাজাকার, কী অইছে? আমার একখান পশমও তো কেঐ ছিঁড়তে পারে নাই। কোনওদিন পারবোও না। রাজাকারগো জোরের তরা দেকছস কী! জোর আছে দেইখাই পেসিডেন (প্রেসিডেন্ট) জিয়া রাজাকারগ কিছু করতে পারে নাই, এরশাদ কিছু করতে পারে নাই। উল্টা রাজাকারগো মন্ত্রি মিনিষ্টার বানাইছে।

মান্নান মাওলানার চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম চোখে উঠানে এসেছে আতাহার, বাড়ির বউঝিরা যে যার দুয়ারে দাঁড়িয়েছে, পোলাপান কেউ কেউ এসে জড়ো হয়েছে উঠানে। মান্নান মাওলানা কোনওদিকে তাকালেন না, কোনও কিছু তোয়াক্কা করলেন না। আগের মতোই চিৎকার করে বললেন, পনচাস টেকা দিতে চাইছিলাম অহন এক পয়সাও দিমু না। পারলে তুই আমার কাছ থিকা টেকা আদায় করিচ। যা বাইর অ, বাইর অ আমার বাইত থন।

দবির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, মাথা তুলে কিছু একটা বলতে চাইল, মান্নান মাওলানা তেড়ে এলেন। ঘেটে ধরে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিলেন দবিরকে। অহনতরি খাড়াইয়া রইছস?

ধাক্কা খেয়ে খানিকদূর ছিটকে গেল দবির কিন্তু হুমড়ি খেয়ে পড়ল না, নিজেকে সামলাল। এত অপমান কোনওদিন হয় নাই সে। এতটা দুঃখ কোনওদিন পায় নাই। দুঃখে অপমানে বুক ফেটে গেল দবির গাছির, চোখ ফেটে কান্না এল। অতি কষ্টে কান্নাটা আটকাল সে। মাথা নিচু করে খালি ঠিলা চারটা ভারে বসাল তারপর কোনও দিকে না তাকিয়ে ভারটা কাঁধে নিল।

মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে যখন নেমে যাচ্ছে দবির পিছনে তখনও সমানে চিল্লাচ্ছেন মান্নান মাওলানা। বাপ বেডি দুইডাঐ শয়তান। বাপে কয় আমি মানুষ ঠকাই মাইয়ায় কয় রাজাকার। রাজাকার যহন কইছে রাজাকারের কাম আমি কইরা ছাড়ুম। ল্যাংটা কইরা ঐ ছেমড়ির হোগায় (পাছায়) আমি বেতামু। হোগার চামড়া উড়াইয়া হালামু।

দবির গাছির চোখ দিয়ে তখন টপ টপ করে পানি পড়ছে।

.

১.৪৪

চাপা ক্রোধের গলায় নূরজাহান বলল, আপনে কেমুন পুরুষপোলা! আপনেরে যে এমনে মারলো আপনে কিছু কইতে পারলেন না?

নূরজাহানদের উঠানের রোদে বসে আছে কাশেম। সকালেবলার রোদ বেশ চড়েছে এতক্ষণে। কুয়াশা সরে ঝকঝক তকতক করতাছে চারদিক। গাছগাছালির ডালপালায় ঝোপঝাড় এবং ঘরবাড়ির আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা কুয়াশা শীত উধাও হতে শুরু করেছে। গিরস্তবাড়ির লগের ডোবানালা আর পুকুরের পানিতে জমিয়ে বসেছিল যে কুয়াশা রোদের তাপে হালকা ধুমার মতো উড়তে শুরু করেছে তা। গিরস্তবাড়ির বউঝিরা ঘাটলায় বসে মরার মতো ঠাণ্ডা পানিতেই শুরু করেছে দিনের কাজ।

হামিদাও গেছে ঘাটপারে। যাওয়ার আগে পাতলা একখান কথা গায়ে জড়িয়ে উঠানের কোণে রোদ পোহাতে বসা নূরজাহানকে দিয়ে গেছে পোয়াখানেক মুড়ি ধরে এমন ডালার একডালা মুড়ি আর মাঝারি মুচির (ডেলা) খাজুরা গুড়ের অর্ধেকটা। একমুঠ মুড়ি আর এক কামড় গুড় মাত্র মুখে দিয়েছে নূরজাহান তখনই বাড়িতে এসে উঠল কাশেম। হামিদা তখনও ঘাটপার যায়নি। দুইহাতে কায়দা করে ধরা বাসি থাল বাসন হাঁড়ি কড়াই, মাত্র পা বাড়িয়েছে, উঠানে এসে দাঁড়াল কাশেম। বিগলিত গলায় বলল, গাছি দাদার লগে দেহা অইলো তো, কইলো বাইত যা, তর ভাবীছাবরে কইচ মুড়ি মিডাই দিতে, খাইতে থাক আমি আইতাছি।

হামিদা আর নূরজাহান দুইজনেই তখন সব ভুলে কাশেমকে দেখছে। হামিদা কথা বলবার আগেই নূরজাহান জিজ্ঞাসা করেছে, কী অইছে আপনের চেহারা এমুন ক্যা?

মান্নান মাওলানার হাতে মার খাওয়ার পর থেকে ঘটনাটা অনেককেই বলতে হয়েছে কাশেমের। প্রতিবার বলার সময়ই কেঁদে ফেলেছে সে। নূরজাহানকে বলার সময়ও কাঁদল। সেই কান্না দেখে ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে গেল নূরজাহান, গম্ভীর হয়ে গেল। মুড়ি খাওয়া ভুলে কাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

নূরজাহানের মতো হামিদাও তাকিয়ে রইল তারপর হাতে ধরা থাল বাসন হাঁড়ি কড়াই উঠানে নামিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে গিয়ে ঢুকল। টিনের খাবদা (বেশি খাবার ধরে। বড় অর্থে) একখান থালার গলা তরি ভর্তি মুড়ি আর নূরজাহানকে যতটা দিয়েছে ততটা গুড় এনে কাশেমের হাত দিল। বহেন, বইয়া খান। আমি ঘাটপার থিকা আহি। তারবাদে হুনুমনে সব।

হামিদা চলে যাওয়ার পরই কথাটা বলল নূরজাহান। শুনে বড় করে একটা শ্বাস ফেলল কাশেম। কথা বলল না। অতিকষ্টে হাঁ করে একমুঠ মুড়ি মুখে দিল, এক কামড় গুড় নিল। তারপর আনমনা ভঙ্গিতে চাবাতে লাগল।

মুড়ি চাবাতে যে খুব কষ্ট হচ্ছে কাশেমের, কেটে ঝুলে পড়া ঠোঁটে যে ব্যথা হচ্ছে মুখ দেখে যে কেউ তা বুঝতে পারবে। নূরজাহানও পারছিল। ফলে ভিতরের রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছিল তার। গুড়মুড়ি খাওয়ার কথা ভুলে বলল, শইল্লে জোরবল নাই আপনের মারলো আর মাইর খাইলেন?

নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে কাশেম বলল, কী করুম মা?

আপনেরে মারলো আপনেও তারে মারতেন!

কও কী, তাইলে তো সব্বনাশ অইয়া যাইতো। হুজুরের পোলা আছে না, আতাহার, ডাকাইত। আমি হুজুরের লগে বেদ্দপি করছি হোনলে জব কইরা হালাইতো আমারে। জব কইরা কচুরি বইন্না (বন অর্থে) পুকুরে ডুবাইয়া রাকতো। দুইন্নাইর কেঐ উদিস পাইতো না। আমার তো কেঐ নাই, কে সমবাত লইতো! তাও অনেকদিন আমারে না দেইকা কেঐ যদি জিগাইতো, কাইশ্যা কো, কইতো কই জানি পলাইয়া গেছে গা, সমবাত নাই।

কাশেমের কথা শুনে নিজেরও একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল নূরজাহানের। একমুঠ মুড়ি মুখে দিল সে। দুইটা কাক আর বাড়ির তিন চারটা কুকরা চড়ছিল উঠানে। দুইটি মানুষকে উঠানে বসে মুড়ি খেতে দেখে ঘুরঘুর করছিল তারা। ডালা থেকে একমুঠ মুড়ি নিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিল নূরজাহান। কাক দুইটা লগে লগে উড়ে গেল সেখানে, কুকরাগুলি ছুটে গেল। একবার সেদিকে তাকিয়ে নূরজাহান বলল, না মারতে পারছিলেন মাইর ঠেকাইতেন। খাড়াইয়া খাড়াইয়া মাইর খাইলেন ক্যা?

কাশেম বলল, মাইর ঠেকানোরও উপায় আছিলো না মা। খাড়াইয়া খাড়াইয়া মাইর খাইয়া উপায় আছিলো না। মাইর ঠেকাইলেও বেপি অইতো, দৌড় দিলেও বেদ্দপি অইতো।

কীয়ের বেদ্দপি?

হুজুরে যা করবো হেইডা বাদা দিলেঐ বেদ্দপি।

এইডা কোনও কথা অইলোনি! একজন মানুষরে মাইরা হালাইবো আর বাদা দিলে অইবো বেদ্দপি! অইলে অইবো। অমুন বেদ্দপি করণ খারাপ না।

তয় আমার দুক্কু এইডা না মা। আমার দুক্কু গরুডি।

গরুডি আবার কী করছে?

ঐ বাইত্তে আমি যাইতে পারি না, গরুডিরে দেকতে পারি না, আমার দুক্কু খালি এইডাঐ। মারছেলো নাইলে আরও মারতো তাও যুদি বাইত্তে থাকতে দিতো, গরুডির লগে থাকতে দিতো!

মান্নান মাওলানার বাড়িতে কাল রাতে গরুদের লগে থাকার ঘটনাটা বলল কাশেম। শুনে নূরজাহান স্তব্ধ হয়ে গেল।

গরুদের লেইগা এতো টান! এইটা কেমুন মানুষ!

খুব হাসি পেল নূরজাহানের। কিন্তু হাসল না। চেপে রেখে বলল, আপনে যে রাইত দোফরে ঐ বাইত্তে গিয়া উঠলেন যুদি কেঐ দেইক্কা হালাইতো?

দেকলে বিপদ আছিলো কপালে। আবার মাইর খাওন লাগতো।

এই হগল জাইন্নাও গেলেন?

হ মা গেলাম। গরুডিরে না দেইক্কা অনেকদিন থাকছি আর থাকতে পারতাছিলাম। মাইর খাইলে কিছু অয় না। গরুডিরে না দেকলে মনডা কান্দে। কাইল রাইতে ঘুটঘুইট্টা আন্দারের মইদ্যে যহন গোয়াইল ঘরে গিয়া হানছি (হান্দাইছি, ঢোকা অর্থে), কী কমু মা তোমারে, অমুন আন্দারেও গরুডি আমারে ঠিক চিনলো।

নূরজাহান অবাক হয়ে বলল, কেমনে চিনলো?

কাটা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল কাশেম। শইল্লের গন্দে চিনলো। এহেকজন মাইনষের শইল্লে তো এহেক রকম গন্দ থাকে! চিননের পর গরুডি যে কেমুন করলো আমার লেইগা, কী কমু তোমারে! কোনডায় শইল চাইভা দেয়, কোনডায় শইল্লে মাথা ঘইষ্যা দেয়। ছোড বাছুরডা হারারাইত আমার কুলে হুইয়া ঘুমাইলো। আমার শইল্লে তো কিছু আছিল না, উদলা গাও, গরুডির লগে হারারাইত গোয়াইল ঘরে রইলাম, ইট্টুও শীত করলো না আমার। তয় শীত করতাছে বিয়ানে, গোয়াইল ঘর থিকা বাইর অওনের পর। গাছি দাদায় সুয়াটার না দিলে শীতে মনে অয় আইজ মইরা যাইতাম।

কাশেম আরেক মুঠ মুড়ি দিল মুখে, এক কামড় গুড় নিল।

নূরজাহান বলল, তয় আপনে অহনে কী করবেন? কই থাকবেন, কই খাইবেন?

কাশেম বলল, থাকনের কোনও অসুবিদা নাই। থাকনের জাগা আমার আছে।

কই?

 হোনলে তুমি হাসবা।

না হাসুম না, কন।

হুজুরের বাড়ির গোয়াইল ঘরে।

কেমতে থাকবেন? ঐবাইত্তে আপনেরে যাইতে দিবো?

না হেইডা দিবো না। আমি থাকুম অন্য কায়দায়।

কথাটা বুঝতে পারল না নূরজাহান। মুখে মুড়ি ছিল, চাবাতে ভুলে গেল। কাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

আবার হাসল কাশেম। কায়দা কী হোনবা মা? বেবাকতে ঘুমাইয়া যাওনের পর রাইত দুইফরে গিয়া উডুম হুজুরের বাইত্তে। চুপ্পে চুপ্পে গিয়া ঢুকুম গোয়াইল ঘরে। হারারাইত গৰুডির লগে থাইক্কা বিয়াইন্না রাইত্রে, হুজুরে উইট্টা আয়জান দেওনের আগে আগে বাইর অইয়া আমু। হারাদিন অন্য জাগায় কাম করুম রাইত্রে গিয়া থাকুম গরুডির লগে।

গরুর লগে এমতে থাকতে পারেনি মাইনষে গোয়াইল ঘরে থাকতে পারে? গরুর শইল্লের গন্দ, গোবর চনা এই হগলের গন্দ। গরুতে আইম (শ্বাস ফেলা অর্থে) দেয় ঐ আইমের গন্দ, এই হগলের মইদ্যে থাকবেন কেমতে?

আমি থাকতে পারি। মাইনষের থিকা গরুর লগে থাকতে আমার বেশি আরাম। মানুষ শয়তান বদমাইস অয়, ইতর বদজাইত অয়, গরুরা অয় না। গরুরা মাইনষের থিকা ভাল। হোনো মা, আমি যহন গরুডির লগে থাকি, আমার মনে অয় আমি আছি আমার মা বাপের লগে, আমার ভাই বইনের লগে, বউ পোলাপানের লগে। আমার মা বাপের কথা আমার মনে নাই, ভাই বইন আত্মীয় স্বজন কেঐরে আমি দেহি নাই, বউ পোলাপান এই জীবনে আমার অইবো না, তয় অমুন একখান সংসারের কথা চিন্তা করতে আমার বহুত আমদ লাগে। এমুন সংসার অনেক থাকে না মাইনষের, মা বাপ ভাই বইন বউ পোলাপান লইয়া একখান ছোট্ট ঘরের মইদ্যে থাকে বেকতে, গরুডির লগে গোয়াইল ঘরে থাকলে আমার এমুন মনে অয়। কোনও কোনও গরুরে মনে অয় আমার মা বাপ কোনও কোনওডারে মনে হয় ভাই বইন, বাছুড়ডিরে মনে অয় পোলাপান।

মানুষের এই ধরনের কথা কখনও শোনেনি নূরজাহান। গরুর লগে এমন সম্পর্ক হতে পারে মানুষের, জানা ছিল না। খুবই হাসি পাচ্ছিল তার। হাসির চোটে বুক ফেটে যাচ্ছিল। হাসি চাপবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল।

কাশেম বলল, আর যে গোবর চনার গন্দের কথা কইলা, গরুর শইল্লের গন্দ, আইমের গন্দ, এইডি আমার কাছে গন্দ মনে হয় না। একখান ঘরের মইদ্যে অনেকটি মানুষ থাকলে হেই ঘরের মইদ্যে অনেক পদের গন্দ থাকে না! পোলাপানের ও মুতের গন্দ, মাইনষের উয়াস নিয়াসের (শ্বাস প্রশ্বাসের) গন্দ, গোয়াইল ঘরে থাকলে আমার অমন মনে অয়।

নূরজাহান ঠোঁট টিপে হাসল। মা বাপ মনে অয় গরুডিরে, ভাই বইন, পোলাপান মনে অয়, পোলাপানের মা মনে অয় না কেরে? বউ মনে অয় না?

কথাটা শুনে কী রকম লাজুক হয়ে গেল কাশেম। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, শরমের কথা, কী কমু মা তোমারে! মনে অয়, আমার পোলাপানের মাও মনে অয় একটা গরুরে। বউ মনে অয়।

একথা শুনে হাসি আর ধরে রাখতে পারল না নূরজাহান। খিলখিল করে হেসে উঠল। কোনওদিকে না তাকিয়ে পাগলের মতো দুলে দুলে হাসতে লাগল।

তখনই শূন্যতার কাঁধে মৃতের মতো বাড়িতে এসে উঠল দবির। ঘরের ছেমায় ভারটা নামিয়ে রাখল।

প্রথমে বাবার মুখ খেয়াল করেনি নূরজাহান। হাসির তালে ছিল। হাসতে হাসতে বাবার দিকে মুখ ফিরিয়েছে, কাশেমের মুখে শোনা কথা মজা করে বলতে যাবে, বাবার মুখ দেখে থতমত খেল। হাসি বন্ধ হল নূরজাহানের, মুড়ির ডালা ফেলে দবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। কী অইছে বাবা? মুখহান এমুন দেহা যাইতাছে ক্যান তোমার?

লগে লগে ঠাস করে নূরজাহানের গালে একটা থাবড় (চড়) মারল দবির।

বাপের হাতে এমন একখান থাবড় খেয়ে নূরজাহান যে কী রকম থতমত খেল! খানিকক্ষণ বুঝতেই পারল না বাবা তাকে থাবড় মেরেছে, খুব জোরে, ডান গালে। গাল জ্বলে যাচ্ছে, মাথা টলমল করতাছে। চোখের দৃষ্টি একটুখানি ঝাপসা হয়েছে।

তবু এই দৃষ্টি নিয়েই ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

মা বাবা যে কেউ মারলেই যে ব্যথা পাওয়া যায়, সেই ব্যথায় যে কাঁদতে হয় নূরজাহানের একবারও তা মনে হল না। এতটা অবাক তের চৌদ্দবছর বয়সের জীবনে সে আর কখনও হয়নি। বাবা তাকে থাবড় মেরেছে এরচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা আজকের আগে নূরজাহানের জীবনে কখনও ঘটেনি।

ছেলেবেলা থেকেই পাড়া বেডানোর স্বভাব নূরজাহানের, সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেডানোর স্বভাব। এই স্বভাবের জন্য মায়ের চড়চাপড় কিলগুতা বহুবার খেতে হয়েছে। আর ঠোকনা তো উঠতে বসতেই খেতে হতো। এখনও হয়। মা যখন তার মাথার উকুন মারতে বসে তখন ঠোকনা নূরজানের কপালে বান্ধা। নূরজাহানের স্বভাব হচ্ছে বেশিক্ষণ স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারেন না। শালিক পাখির মতো ছটফট করে লাফিয়ে ওঠে, হঠাৎ দৌড় দিতে চায়। উকুন মারার সময় স্থির হয়ে না বসলে কী করে হবে। এজন্য ওইসব সময় ছটফট করে ওঠা লাফিয়ে ওঠা আর আচমকা দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করলেই গাল থুতনিতে ঠোকনাটা তাকে দিবেই মা।

তবে বাবা কখনও মেরেছে এমন স্মৃতি নাই নূরজাহানের। উল্টা মা যখন মেরেছে বাবা তাকে বুক দিয়ে আগলেছে, নূরজাহানকে মারার দায়ে দবির গাছির হাতের কিল থাবড় তরি খেতে হয়েছে হামিদাকে। জন্মের পর থেকে, বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বাবার মুখে একটা কথাই শুনে এসেছে নূরজাহান, মাইয়ারা অইলো ঘরের লক্ষ্মী, বাড়ির লক্ষ্মী। লক্ষ্মীগো শইল্লে কোনওদিন হাত তুলতে অয় না। তাইলে অলক্ষ্মী লাইগ্যা যায় সংসারে। সেই বাবাই আজ হাত তুলল নূরজাহানের গায়ে! কেন, কী করেছে সে?

এসময় ঘাটপার থেকে উঠে আসছিল হামিদা। দুইহাত ভর্তি পাল বাসন হাঁড়ি কড়াই। সেই অবস্থায়ই দেখতে পেয়েছিল স্বামী তার মেয়েকে জোরে থাবড় মেরেছে। দেখে সেও নূরজাহানের চেয়ে কম অবাক হয়নি। এটা কী করে সম্ভব! দবির গাছি থাবড় মেরেছে নূরজাহানকে এরচেয়ে অবিশ্বাস্য ঘটনা আর কী হতে পারে সংসারে! নূরজাহানের মতো হামিদাও যেন বোবা হয়ে গেল, পাথর হয়ে গেল। থাল বাসন হাঁড়ি কড়াই হাতে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, দাঁড়িয়ে রইল।

তবে মুড়ির ডালা ফেলে লাফিয়ে উঠল মাকুন্দা কাশেম। হা হা করে উঠল। মারলা ক্যা মাইয়াডারে, মারলা ক্যা গাছি দাদা? কী করছে ও?

দবির কোনও কথা বলল না। থমথমা মুখে ঘরের ওটায় (উঁচু ভিতের ঘরে ওঠার জন্য দরজার সামনে সিঁড়ির মতো যে দুতিনটে থাক থাকে) বসল। না আকাশের দিকে তাকাল, না গাছপালা ঘর দুয়ারের দিকে, না কারও মুখের দিকে। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু মাটি দেখতে পেল না।

কোনও কোনও সময় এমন হয় মানুষের, যেদিকে তাকায় সেদিককার কোনও কিছুই দেখতে পায় না। তাকিয়ে থাকে ঠিকই, দেখে না।

দবির গাছির অবস্থা এখন তেমন।

মাকুন্দা কশেম এসবের কিছুই বুঝল না। কাটা ঠোঁট সরু করে চুকচুক করে শব্দ করল। মাইয়াডা কী করতাছে কিছু বোজলাম না গাছি দাদা? ক্যান অরে এত জোরে একখান থাবড় মারলা?

দবির এবারও কথা বলল না। আগের মতোই মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

নূরজাহান তখনও স্তব্ধ হয়ে আছে, তাকিয়ে আছে বাপের মুখের দিকে। চোখে পলক পড়ে না তার।

কিন্তু হামিদার স্তব্ধতা ভেঙেছে তখন। হাতের থাল বাসন হাঁড়ি কড়াই নিয়ে নরম পায়ে রান্নাচালার সামনে এল সে। যেটা যেখানে রাখার নামিয়ে রাখল। তারপর দবিরের সামনে এসে দাঁড়াল। খানিক আগে সম্পূর্ণ নতুন এক ঘটনা ঘটেছে এই সংসারে, যেন সেই ঘটনার কিছুই জানে না হামিদা, যেন সে কিছুই দেখেনি, কিছুই শোনেনি, রস বেচে বাড়ি ফিরে আসার পর স্বামীকে প্রথমে যে কথাটা সে বলে আজও তাই বলল। মুড়ি মিডাই দেই, খাইয়া লও।

মাটির দিক থেকে চোখ তুলল না দবির। অদ্ভুত এক অসহায় গলায় বলল, না।

ক্যা, খাইবা না? খিদা লাগে নাই?

 না।

তারপরই ধীরে শান্ত গলায় ঘটনাটা জানতে চাইল হামিদা। কী অইছে তোমার?

হামিদার লগে কাশেমও গলা মিলাল। হ, কী অইছে গাছি দাদা?

দবির চোখ তুলে কাশেমের দিকে তাকাল। উদাস গলায় বলল, হুইন্না আর কী করবি! মুড়ি খা।

হামিদা বলল, মাইয়াডারে যে মারলা?

উদাস এবং নরম দুঃখি ভাব কেটে গেল দবিরের। নূরজাহানের দিকে এক পলক তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, অর লেইগা এত শরম পাইতে অইবো ক্যা মাইনষের কাছে? এত কথা হোনতে অইবো ক্যা?

কীয়ের শরম? কী কথা হোনছো?

ও বলে মাওলানা সাবরে রাজাকার কইছে। এর লেইগা যা মুখে আহে তাই আমারে হুনাইয়া দিল মাওলানা সাবে। রসের দাম যা অয় তার অরদেকে নামাইয়া আনলো, তাও টেকা দিল না। বেবাক অর লেইগা।

শুনে হামিদা তাকাল নূরজাহানের দিকে। কীরে সত্যঐ তুই মাওলানা সাবরে রাজাকার কইছস?

এই প্রথম চোখে পলক পড়ল নূরজাহানের। শরীর নড়ল না তার শুধু মুখটা নড়ল। নরম ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখ ফিরাল সে। অদূরে পড়ে আছে তার মুড়ির ডালা। এখনও অর্ধেকের বেশি মুড়ি রয়ে গেছে ডালায়, গুড় রয়ে গেছে বেশির ভাগই। সাহসী ডেকি (মাত্র যুবতী হয়েছে, এই অর্থে) কুকরাটা পায়ে পায়ে এগুচ্ছে নূরজাহানের মুড়ির ডালার দিকে। এখনই ঠোকরে ঠোকরে সাবাড় করবে ডালার মুড়ি। নূরজাহান কেন, উঠানে দাঁড়িয়ে বসে থাকা অন্য মানুষগুলির কেউই তা খেয়াল করল না।

হামিদা বলল, কথা কচ না ক্যা?

দবির বলল, কী কইবো! আর মোক দেহো না! মোক দেকলে বুজা যায় মাওলানা সাবরে রাজাকার ও কইছে। মাওলানা সাবে মিছাকথা কয় নাই।

কাশেম বলল, আমার মনে অয় মিছাকথাই কইছে মাওলানা সাবে। মাওলানা অইলে কী অইবো, বহুত মিছাকথা কয় হেয়। মিছাকথা কইয়া উল্টাসিদা তোমারে বুজাইয়া দিছে যাতে রসের দামডা না দিতে অয়। বহুত বদ মানুষ হেয়। নিজের ভালর লেইগা যা মনে অয় হেইডা করতে পারে। বকাবাজ্জি তো আছেঐ মাইর ধইরও দিতে পারে মাইনষেরে।

মান্নান মাওলানার ঘেটি ধাক্কার কথাটা মনে পড়ল দবিরের। এতটা অপমান জীবনে সে কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরেছে। এখন আর কান্না পাচ্ছে না। কী রকম এক ক্রোধে বুক জ্বলে যাচ্ছে। এই ক্রোধই কি নূরজাহানের ওপর ঝাড়ল সে!

কাশেমের কথা শুনে মনে হচ্ছে নূরজাহান তাকে রাজাকার বলেছে কথাটা ঠিক বলেনি মান্নান মাওলানা। মেয়েটার ওপর দোষ চাপিয়ে রসের দাম না দেওয়ার অজুহাত তৈরি করেছে। এতকাল ধরে মান্নান মাওলানার বাড়ির গোমস্তা কাশেম, কাশেমের চেয়ে মান্নান মাওলানাকে আর বেশি কে চিনে! তবু ব্যাপারটা দবিরের জানতে হবে। কথাটা নূরজাহান বলেছে কিনা জানতে হবে। বলে থাকলে নূরজাহান তা স্বীকার করবে। মিথ্যা বলবে না।

হামিদার দিকে তাকিয়ে দবির বলল, জিগাও তোমার মাইয়ারে, মাওলানা সাবরে রাজাকার ও কইছে কিনা। মিছাকথা য্যান আমার লগে না কয়। সত্যকথা কইলে কিছু কমু না। মিছাকথা কইলে আবার মারুম।

নূরজাহানের দিকে এগিয়ে গেল হামিদা। কী রে, কইছস?

নূরজাহান কোনও কথা বলল না। কোনওদিকে তাকাল না। পাথরের মতো মুখ তার। চোখ স্থির। সেই চোখে রাগ অভিমান নাকি কান্না কোনটা যে আছে কেউ বুঝতে পারল না। আস্তে ধীরে বারবাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।

হামিদা দিশাহারা গলায় বলল, কই যাচ, ও নূরজাহান!

নূরজাহান কথা বলল না, ফিরে তাকাল না। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির নামার দিকে চলে গেল।

হামিদা ব্যস্ত চোখে স্বামীর দিকে তাকাল। যাও, ধরো মাইয়াডারে।

দবির গম্ভীর গলায় বলল, কাম নাই ধরনের। যেই মিহি ইচ্ছা যাইক গা।

একথায় হামিদা না, হা হা করে উঠল কাশেম। না না এইডা তুমি ঠিক কইলা না গাছি দাদা। রাগ কইরা যদি কোনও মিহি যায়গা মাইয়াডা? আমি দেকতাছি কই যায়! আমি অরে ফিরাইয়া আনি।

পায়ের কাছে পড়ে রইল কাশেমের মুড়ির ডালা, কাশেম সেদিকে ফিরেও তাকাল না, নূরজাহানের পিছু পিছু ছুটতে লাগল। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা খাস ফেলল দবির। কেন যেন এই দীর্ঘশ্বাসটা একেবারে বুকে এসে লাগল হামিদার। পায়ে পায়ে স্বামীর কাছে এসে দাঁড়াল সে। একটা হাত রাখল স্বামীর কাঁধে। সত্য কইরা কও তো আমারে কী অইছে। কী কইছে মাওলানা সাবে? জিন্দেগিতে কোনওদিন মাইয়ার শইল্লে তুমি হাত উডাও নাই, আইজ উডাইলা! রস বেচা টেকা পাও নাই দেইক্কা নাকি আর কিছু অইছে? কও, আমার কাছে তো দুইন্নাইর কোনও কথা না কও না তুমি! এইডাও কও। মাওলানা সাবে কী তোমারে মারছে?

লগে লগে দুইহাতে হামিদার মাজার কাছটা জড়িয়ে ধরল দবির। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মারে নাই, মাইরের থিকা বেশি করতাছে। গরদানডার মইদ্যে ঠেলা দিয়া বাইত থিকা নামায় হালায় দিছে। নূরজাহানের মা গো, জীবনে এমুন অপমান কোনওদিন অইনাই।

ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল দবির।

নিজের অজান্তেই দবিরের মাথাটা কখন জড়িয়ে ধরেছে হামিদা। ধরে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে অশুরের মতো মাওলানা প্রচণ্ড জোরে ঘেটি ধাক্কা দিয়ে বাড়ির নামায় ফেলে দিচ্ছে তার স্বামীকে। কী যে অসহায় ভঙ্গিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে মানুষটা, কী যে করুণ ভঙ্গিতে পড়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য সইতে পারে কোনও নারী! হামিদাও পারল না। অসহায় এক দুঃখ বেদনায় বুক ফেটে গেল তার, চোখ ফেটে গেল। গভীর মায়া মমতায় স্বামীর মাথা বুকে জড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল সে।

.

১.৪৫

বাড়ি থেকে বের হলেই নূরজাহানের মনে হয় স্বাধীনতা। চারদিকে অবারিত শস্যের চকমাঠ, গাছপালা, গ্রাম গিরস্তর ঘরবাড়ি, পুকুর ডোবা মাথার ওপরকার আকাশ, রোদ ছায়া, শীত পরালি কোনও কিছুই চোখে পড়ে না তার, কোনও কিছুই মনে থাকে না। নিজেকে নূরজাহানের মনে হয় দূর আকাশের পাখি আর নয়তো জোয়াইরা পানির উদ্দাম মাছ। যেদিকে ইচ্ছা উড়ে যাবে সে, জল কেটে ছুটে যাবে যেদিকে দুইচোখ যায়। এজন্য বাড়ি থেকে বের হবার পর নূরজাহান কখনও হাঁটে না। নিজের অজান্তেই মানুষ স্বভাব পাখি হয়ে যায়, মাছ হয়ে যায়। নূরজাহান উড়তে থাকে, ছুটতে থাকে।

বাড়ি থেকে চকে নামবার পর প্রথমে একটু দাঁড়ায় নূরজাহান। মুখ তুলে খোলা আকাশের দিকে চায়। আবহমান হাওয়া থেকে বুক ভরে টানে মুক্ত হাওয়া। তারপর আচমকা ছুট। অবস্থাটা এমন যেন বা নূরজাহান ছিল এক খাঁচাবন্দি পাখি। এইমাত্র খাঁচার দুয়ার খুলে দিয়েছে কোনও দয়ালু মানুষ। বাইরের দুনিয়াতে বের হয়েই কিছুক্ষণের জন্য স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছে সে। তারপর মন চলো, যে দিকে দুইচোখ যায়।

কিন্তু আজ বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য অবস্থা হল নূরজাহানের। একবারও আকাশের দিকে তাকাল না সে, একবারও বুক ভরে টানল না মুক্ত হাওয়া। নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। যেন দুনিয়ার কোনও কিছুই তার জানা নাই, কোনও বিষয়েই নাই কোনও আগ্রহ। যেন সে এক মৃত মানুষ। হাঁটছে কিন্তু প্রাণ নাই। কোনদিকে যাবে, কার কাছে যাবে কিছুই জানে না।

আর মাকুন্দা কাশেমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে উল্টা। চকে নেমে সে কখনও দৌড়ায় না। বাড়ি থেকে তাকে বের হতে হয় গরু নিয়ে। গরুরা হেলেদুলে আয়েশি ভঙ্গিতে চলে। কাশেমও চলে গরুগতিতে। আস্তে ধীরে, উদাস আয়েশি ভঙ্গিতে। হাঁটে তো হাঁটে না, চলে তো চলে না।

দুই মানুষের দুই স্বভাব আজ উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। দবির গাছির বাড়ি থেকে বের হয়েই নূরজাহানের পিছু পিছু ছুটতে লাগল কাশেম শরীরে মান্নান মাওলানার মারের ব্যথা, ছুটতে গেলে মচমচ করে উঠে মাজার হাড় এর্সবের কোনও কিছুই এখন মনে নাই কাশেমের, উদিসও পাচ্ছে না। চিৎকার করে নূরজাহানকে ডাকতে লাগল সে। নূরজাহান, ও নূরজাহান, খাড়ও মা খাড়ও আমার কথা হোনো।

নূরজাহান নির্বিকার। একবারও পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না, একবারও শুনছে না কাশেমের ডাক। হাঁটছে তো হাঁটছে।

ছুটতে ছুটতে এসে নূরজাহানকে ধরল কাশেম। পিছন থেকে নূরজাহানের ডান হাতটা টেনে ধরে বলল, খাড়ও মা। যাইয়ো না।

নূরজাহান উদাস নির্বিকার ভঙ্গিতে কাশেমের দিকে মুখ ফিরাল। এমন চোখে কাশেমের দিকে তাকিয়ে রইল যেন এই মুখ আজকের আগে কখনও দেখেনি। কাশেম নামে কাউকে চিনে না। লোকমুখে কাশেম যে মাকুন্দা কাশেম জীবনেও যেন সে কথা শোনেনি নূরজাহান।

কাশেম এসব খেয়াল করল না। ছুটতে ছুটতে এসে নূরজাহানকে সে ধরতে পেরেছে এটাই যেন তার জীবনের এক বড়কাজ। কাজটা করতে পেরে সে দারুণ খুশি। যেন দবির গাছির ঋণ খানিকটা হলেও শোধ করতে পারছে। এরকম শীত সকালে দবির তাকে নিজের গায়ের সোয়েটার খুলে দিয়েছে। নিজে খালি গা হয়ে সোয়েটার পরিয়ে কাশেমকে পাঠিয়েছে বাড়িতে। গাছির বউ গুড়মুড়ি খেতে দিয়েছে। এরকম মানুষের মেয়ে বাপের হাতে থাবড় খেয়ে রাগ করে বের হয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে, তাকে ফিরিয়ে আনা কাশেমের কর্তব্য। পোলাপান মানুষ রাগ করে কী না কী করে ফেলবে!

হাঁপাতে হাঁপাতে কাশেম বলল, কই যাও মা?

শীতল নির্বিকার গলায় নূরজাহান বলল, কইতে পারি না।

নূরজাহানের কথা বলার ভঙ্গি এমন, ভিতরে ভিতরে কাশেম কী রকম একটু থমকাল। এই কি সেই মেয়েটি, গাছি বাড়ি ফিরবার আগে কাশেমের মুখে তার মার খাওয়ার কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল যে! এই কি সেই মেয়েটি, গরুদের লগে কাশেমের সম্পর্কের কথা শুনে পানির ওপর পানি পড়ার শব্দে হেসেছিল!

ভুরু কুঁচকে চোখে দুই তিনটা পলক ফেলল কাশেম। কাটা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসতে গেল, গিয়েই ঠোঁট কুঁচকাল। শীতের টানে ফসল তুলে নেওয়া চকের মতো শুকনা, কাটা ঠোঁটের কাটা অংশ চড়চড় করে উঠল। বুঝি রক্ত বের হবে। তবু সেদিকে মন দিল না কাশেম। পুরাপুরি হাসতেও পারল না। তবে মুখটা হাসিহাসি করে বলল, কও কী! কই যাও কইতে পারো না মা! থাউক যাওনের কাম নাই। লও বাইত্তে লও।

এবার কাশেমের দিক থেকে মুখ ফিরাল নূরজাহান। না আমি অহন বাইত্তে যামু না।

তয় কই যাইবা?

কইলাম যে কইতে পারি না।

একটু থেমে কাশেম বলল, গোসা করছো মা?

নূরজাহান কাশেমের দিকে তাকাল না। বলল, কার লগে গোসা করুম?

তোমার বাপের লগে।

নূরজাহান কথা বলল না। আগের মতোই আস্তে ধীরে হাঁটতে লাগল। কাশেমও হাঁটতে লাগল তার লগে লগে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, মা বাপ থাকলে কত সমায় তারা কিল থাবড় মারে। হেতে কী অয়! আদর যে করে হে তো মারতেও পারে। মা বাপ আছে দেইক্কা মারে। না থাকলে তো আর মারতো না। এই যে আমার মা বাপ নাই, আমারে কেঐ মারে!

কাশেমের দিকে মুখ ফিরাল নূরজাহান। মান্নান মাওলানা মারছে না আপনেরে?

 কাশেম থতমত খেল। হ মারছে।

তয়?

ঠোঁট ছড়িয়ে আবার হাসার চেষ্টা করল কাশেম। কাটা জায়গা কেটে রক্ত বের হবার ভয়ে হাসল না। বলল, হের মাইর আর বাপ মার মাইর এক না। বাপ মায় মারে যেমুন। আদরও করে অমুন। দুইডা দুই পদের। তুমি বুজবা না মা।

আমার বোজনের কাম নাই। আপনে যান।

 কই যামু।

কই যাইবেন আমি কেমতে কমু?

আমার তো যাওনের জাগা নাই। গাছি দাদায় কইলো তোমগো বাইত্তে যাইতে, গেছি।

তয় আবার যান।

কই?

আমগো বাইত্তে।

হ তোমগো বাইত্তেই যামু। তয় তোমারে না লইয়া যামু না। তোমারে না লইয়া গেলে তোমার বাপরে আমি কী জব দিমু

এতক্ষণ ধরে কাশেমের মুখে বাপ কথাটা শুনছে, আর মানুষটা তার এত প্রিয়, জন্মের পর থেকে একটা দিনও যাকে না দেখে থাকেনি নূরজাহান, আজ এই প্রথমবার সেই মানুষের কথা শুনতে ভাল লাগছে না নূরজাহানের। কোনও রাগ ঘৃণা যে হচ্ছে বাপের ওপর তাও না। কেমন যেন একটা অবস্থা। যেন এই মানুষটা থাকলেও যা না থাকলেও তাই। আছে তো আছে, নাই তো নাই।

সংসারের প্রিয় মানুষরা সবসময় চোখ জুড়ে থাকে মানুষের। দূরে কোথাও চলে গেলে, চোখ বুজে, খুলে সেই মানুষটাকে দেখতে পায় মানুষ। মানুষটার মুখখানা দেখতে পায়। দুনিয়াতে বাপের চেয়ে প্রিয় কোনও মানুষ নাই নূরজাহানের। প্রিয় কোনও মুখ নাই। বাপ যতক্ষণ বাড়িতে না থাকে, বাপের কথা ভাবলেই চোখের সামনে মানুষটাকে দেখতে পায় নূরজাহান। তার হাঁটাচলার ভঙ্গি, কথা বলা আর কাজ করবার ভঙ্গি, হাসিহাসি মুখ দেখতে পায়। আজ জীবনে প্রথম, কাশেমের মুখে বার বার শুনছে বাপের কথা, তাকে নূরজাহান দেখতে পাচ্ছে না। না তার হাঁটাচলা, না তার কাজকর্মের ভঙ্গি, না তার শোয়া খাওয়া, না তার মুখ।

ভিতরে ভিতরে নূরজাহান খুবই অবাক হল। পাশাপাশি হাঁটছে কাশেম, কাশেমের কথা একদম ভুলে গেল। ভাবল চোখ খোলা আছে বলে বাপের মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে না, হয়তো বা চোখ বুজলে দেখতে পাবে।

হাঁটতে হাঁটতে চোখ বুজল নূরজাহান। তারপরও দবির গাছির মুখটা সে দেখতে পেল না। হামিদাকে দেখল, তাদের বাড়িটা দেখল, বাড়ির খুটিনাটি সবকিছু দেখল কিন্তু বাড়ির প্রধান মানুষটাকে দেখতে পেলে না।

এটা কেমন করে হচ্ছে! কেন হচ্ছে।

ভিতরে ভিতরে নূরজাহান কেমন দিশাহারা হয়ে গেল! এমন তো কখনও হয়নি তার। আজ কেন হচ্ছে! জীবনে আজ প্রথম বাবা তার গায়ে হাত তুলেছে বলে!

কাশেম বলল, সড়কের কাছে তো আইয়া পড়লা মা, এলা বাইত্তে লও।

নূরজাহানের যেন হঠাৎ খেয়াল হল বাড়ি থেকে অনেকটা দূর চলে এসেছে। বড় সড়কের কাছাকাছি। বেশ কয়েকদিন সড়কের এদিকে আসা হয় না। আজ যখন এসেই পড়েছে একটু দেখে যাবে কতদূর আগালো সড়ক! মাওয়ার ঘাট ধরতে আর কতদিন লাগবো।

কাশেমের দিকে তাকিয়ে খুবই স্বাভাবিক গলায় নূরজাহান বলল, আপনে যান গা, আমি ইট্টু সড়কের মিহি ঘুইরাহি।

কাশেম বিগলিত গলায় বলল, তাইলে আমিও তোমার লগে যাই মা।

ক্যা?

তোমার মা বাপরে কইছি তোমারে বাইত্তে লইয়া যামু, না লইয়া যাই কেমতে?

অন্য সময় হলে এই ধরনের কথা শুনে হাসত নূরজাহান। এখন হাসল না। মুখ ঘুরিয়ে কাশেমের দিকে আর তাকালও না। সড়কের দিকে হাঁটতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *