১.৩১-৩৫ দবির নরম গলায় ডাকল

১.৩১

দবির নরম গলায় ডাকল, নূরজাহান।

চকির ওপর পাশাপাশি শুয়েছে হামিদা আর নূরজাহান। মেঝেতে নিজের বিছানায় বসে ঘুমাবার আগের তামাকটা খেয়ে নিচ্ছে দবির। অদূরে গাছার ওপর জ্বলছে কুপি। জানলা দুয়ার বন্ধ ঘরের ভিতর ওইট্টুকু আলো বেশ চোখে লাগছে। চারদিকে অন্ধকার, শুধু এক জায়গায় সামান্য আলো। ফলে পরিবেশ থমথমা। এই থমথমা ভাব ভেঙে যাচ্ছিল দবির গাছির তামাক টানার শব্দে।

নূরজাহান দুই তিনবার এপাশ ওপাশ করেছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। তবে হামিদার লড়াচড়া নাই, সাড়াশব্দ নাই। আজ সারাদিন বেশ একটা ধকল গেছে তার। যে ধকল শীতের মাঝামাঝি থেকে কোনও কোনওদিন যাওয়ার কথা সেই ধকল শীতের প্রথম দিনেই হামিদার উপর দিয়ে একবার গেল। প্রথম দিনকার রস বিক্রি না করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল দবির। দিনভর সেই রস জ্বাল দিয়ে তোয়াক করেছে হামিদা। তার ওপর সংসারের অন্যান্য কাজকাম তো ছিলই। নূরজাহান বাড়িতে থাকলে সেও হাত লাগাতে মায়ের লগে। একা সবদিক সামলাতে হতো না হামিদাকে। কিন্তু নূরজাহান বাড়িতে ছিল না। সকালবেলা সেই যে মুখের রস ফেলে ছুটে গিয়েছিল ছনুবুড়িকে শেষ দেখা দেখতে, মুর্দারের খাট কাঁধে পুরুষ মানুষরা গোরস্থানের দিকে রওনা দেওয়ার অনেক পর বাড়ি ফিরেছে। তখন পুরাপুরি বিকাল। সারাদিন পেটে কিছু পড়ে নাই তার উপর কানছে (কেঁদেছে), চোখ দুইটা ফুলা ফুলা, লাল, মুখটা শুকাইয়া ছোট হয়ে গেছে। দবির যাচ্ছিল হাঁড়ি পাততে, নূরজাহানকে দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল তার। যেন মা বাবার মতোই কোনও আপনজন ছেড়ে গেছে নূরজাহানকে। মানুষের জন্য এত মায়া মেয়েটার!

নূরজাহান আবার পাশ ফিরল, আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আগেরবার ডেকে মেয়ের কোনও সাড়া পায় নাই দবির। আবার ডাকল, নূরজাহান।

নূরজাহান ধীর গলায় সাড়া দিল। উ।

কী গো মা, ঘুম আহে না?

না বাবা।

ক্যা গো মা?

কইতে পারি না। মনডা জানি কেমুন লাগ্র।

 আমার কাছে আইয়া হুইবা?

হ।

আহো।

 চকি থেকে নামল নূরজাহান। দবিরের কোলের কাছে এসে বসল।

হুঁকা রেখে একহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল দবির। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ছনুবুজি মইরা গেছে দেইক্কা এমুন লাগতাছে তোমার, না মা?

হ বাবা।

বাপ যখন জড়িয়ে ধরে নূরজাহানকে বয়স কমে যায় তার, শিশু হয়ে যায়। এখনও হল। বাপের বুকের লগে মিশে গেল নূরজাহান।

গভীর মমতায় মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে দবির বলল, বেবাক মাইনষেরঐ একদিন না একদিন মরণ লাগবো মা, এইডাঐ দুইন্নাইর নিয়ম।

নূরজাহান কাতর গলায় বলল, এমুন নিয়ম ক্যা দুইন্নাইর?

দুইন্নাইডা যে বানাইছে এইডা তার নীলাখেলা মা। জীবন দিবোও হে, নিবোও হে।

তাইলে মাইনষের মনের মইদ্যে এত মায়া মহব্বত দেওনের কাম আছিলো কী? কাইল বিয়ালেও যেই মানুষটা আছিল আইজ বিয়ানে হেয় নাই। এই কষ্ট অন্য মাইনষে সয় কেমতে!

দবির কথা বলল না, কুপির আলোর দিকে তাকিয়ে রইল।

নূরজাহান বলল, ছনুফুলুর লগে আমার আর কোনওদিন দেহা অইবো না, দেশ গেরামে ঘোরতে ঘোরতে কোনওদিন আর দেহুম না মাডির মিহি বেকা অইয়া রাস্তা দিয়া আইট্টা যাইতাছে ফুবু। এর কথা অরে কইতাছে, কাইজ্জাকীত্তন লাগায় দিতাছে। একদিন দেহি মেন্দাবাড়ির ঝাকা থিকা পটপট কইরা কয়ডা ঢেরস ছিঁড়ল। এইমিহি চায়, ওইমিহি চায় আর ছিঁড়ে। আমি দৌড়াইয়া উটতাছি বাইত্তে, আমারে দেইক্কা এমুন শরম পাইলো! পয়লা মুখখানা গেল কালা অইয়া, তারবাদে হাসলো। কেঐরে কইচ না মা! খিদা লাগছে তো এর লেইগা ছিড়লাম। কাঁচা ঢেরস চাবাইয়া খাওন যায়। খাইতে সাদ, পেডও ভরে। কী করুম ক! পোলারবউ ভাত দেয় না। ঢেরস কোছরে গুইজ্জা হাজামবাড়ি মিহি গেল গা ফুবু। বাবা, আইজ হারাদিন আমার খালি এই কথাডা মনে অইছে। ফুবু আমারে দেইক্কা শরম পাইছিল, কইছিলো কতাডা আমি যেন কেঐরে না কই। আমি কই নাই বাবা, কোনওদিন কেঐরে কই নাই। আইজ পয়লা তোমারে কইলাম। ফুবু মইরা গেছে দেইক্কা কইলাম।

ফোপাইয়া ফোপাইয়া (ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে) কাঁদতে লাগল নূরজাহান। জড়ানো গলায় বলতে লাগল, আল্লায় মাইনষের পেডে এত খিদা দিছে ক্যা বাবা? ক্যা দিছে এত খিদা! জীবন দিছে, মরণ দিছে, খিদাডা দেওনের কাম আছিলো কী!

.

১.৩২

মিয়াদের পুকুরপারের পুরানা হিজল গাছটার তলায় খালি গায়ে বসে আছে মাকুন্দা কাশেম। গায়ের রঙ বাইল্লামাছের মতো বলে হিজলের ছায়ায় ফুটে আছে সে।

ঝাঁকিজাল হাতে আলফু যাচ্ছিল পুকুরের পুব দক্ষিণ কোণে। সেখানে পুকুরপার ভরা কাশের জঙ্গল আর পুকুরের পানিতে ঠাসাঠাসি কচুরি। কচুরি আর কাশের রঙ প্রায় একরকম। শুধু ফুল ফুটেছে দুই রঙের। কাশফুল মানুষের মাথার পাকা চুলের মতো আর কচুরিফুল গ্রাম রমণীর হাতের চুড়ির মতো, নীল বেগুনীতে মিশানো। পানির তলায় ডুবে থাকা কচুরির ছোবা (ছোবড়া) দেখতে মান্নান মাওলানার দাঁড়ির মতো। মান্নান মাওলানার দাঁড়ির ভিতর যেমন লুকিয়ে থাকে নানারকম শয়তানি এই পুকুরের কচুরির ছোবার ভিতর তেমন করে লুকিয়ে থাকে কই রয়না খলিসা ফলি। সুযোগ পেলেই মান্নান মাওলানা যেমন কাঁকুই দিয়ে দাঁড়ি আঁচড়ান প্রায় তেমন করেই কোনও কোনওদিন ঝাঁকিজাল দিয়ে কচুরির চাক বেড় দেয় আলফু। কচুরির ছোবার আড়ালে লুকিয়ে থাকা জিয়ল মাছ ধরে ঘোপায় (মাছ জিয়াবার মাটির হাঁড়ি) রাখে।

দাঁড়ির ভিতর লুকিয়ে থাকা শয়তানিও কি প্রায় এই কায়দাই মনের ভিতর জিইয়ে রাখেন মান্নান মাওলানা!

আজ সকালে ঝাঁকিজাল কাঁধে, হাতে পোড়ামাটির বড় একটা ঘোপা, পুকুরের দিকে যেতে যেতে এই কথাটা মনে হল আলফুর। মান্নান মাওলানা যে এত বদ, ছনুবুড়ির মৃত্যুর দিন আলফু তা টের পেয়েছে। মজনুর মুখে সব শুনে আলফুর মতো লোকও বুঝে গিয়েছিল সব মিথ্যা, সব শয়তানি মান্নান মাওলানার। ভুল ফতোয়া দিয়েছে সে। মানুষের মৃত্যু নিয়েও এমন করতে পারে মানুষ! তাও যার নামের শেষে আছে মাওলানা! মাথায় টুপি, মুখে দাঁড়ি, হাতে তসবি। কথায় কথায় আল্লাহর নাম নিচ্ছে কিন্তু করতাছে সব বদকাজ! মানুষ এমন হয় কী করে!

পাশাপাশি মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের কথাও মনে পড়ল আলফুর। ফেরেশতার মতো পবিত্র মানুষ। আচার আচরণ কথাবার্তা সব মিলিয়ে মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব হচ্ছেন যথার্থ পরহেজগার, সৎ ধার্মিক মানুষ। কী যত্নে কী মমতায় ছনুবুড়ির জানাজা পড়লেন, লাশ কাঁধে নিয়ে গেলেন গোরস্থানে।

এসব ভেবে মনে মনে মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবকে সালাম দিল আলফু আর মান্নান মাওলানাকে দিল খুব খারাপ দুই তিনটা বকা। বিড়বিড় করে বলল, মুখে খালি দাঁড়ি থাকলেঐ অয় না, মাথায় খালি টুপি থাকলেঐ অয় না, দিল সাফ থাকতে অয়, মাইনষের লেইগা মহব্বত থাকতে অয়, কোরান হাদিস ঠিক মতন জানতে অয়, নাইলে মাওলানা অওন যায় না।

ঠিক তখনই হিজলতলায় বসে থাকা মাকুন্দা কাশেমকে দেখতে পেল আলফু। কাশেমের মুখ দেখতে পেল না, পেল পেছন দিকটা। তবু কাশেমকে চিনতে অসুবিধা হল না। এরকম গায়ের রঙ এই গ্রামে আর কারও নাই।

তবে কাশেমকে দেখে অন্যরকমের একটা অনুভূতি হল আলফুর। মাত্র মান্নান মাওলানার কথা ভেবেছে, মান্নান মাওলানাকে বকাবাজি করেছে ঠিক তখনই কি না তার বাড়ির গোমস্তাকে বসে থাকতে দেখল মিয়া বাড়ির হিজলতলায়! অবাক কাণ্ড! এর মধ্যে আল্লাহ্পাকের কোনও ইশারা নাই তো! নাকি মান্নান মাওলানা কোনও অলৌকিক ক্ষমতায় আলফুর মনে মনে দেওয়া গালি শুনতে পেয়েছেন? বাড়ির গোমস্তাকে সেজন্য পাঠিয়েছেন এখানে!

মুখে কথা কম বলা হয় বলে মনে মনে সারাক্ষণই কথা বলে আলফু। এখনও তেমনই বলতে লাগল। আমি হুনছি বদ মাওলানারা কুফরি কালাম জানে। কুফরি কালামের জোরে কি মাকুন্দা কাশেমরে পাডাইছে এহেনে!

ততক্ষণে হিজলতলায় এসে পড়েছে আলফু। তার পায়ের শব্দ পেল না কাশেম। যেমন বসেছিল বসে রইল। পিছন ফিরে তাকাল না।

কিন্তু পিঠে এমুন দাগ ক্যান কাইশ্যার! কী অইছে? পিঠে আর ঘেটিতে ফ্যারা উঠলে যেমুন অয় তেমুন বিনবিনা গোটা।

এই সব দেখে খানিক আগের ভাবনা চিন্তা মন থেকে হাওয়া হয়ে গেল আলফুর। অবাক গলায় কাশেমকে ডাকল সে। ঐ কাইশ্যা।

আলফুর দিকে মুখ ফিরাল কাশেম। কাতর চোখে আলফুর দিকে তাকিয়ে রইল।

তার দিকে মুখ ফিরাবার পর কাশেমের মুখ দেখে চমকে উঠল আলফু। মুখটা বীভৎস হয়ে আছে। নিচের ঠোঁটের মাঝ বরাবর কেটে ঝুলে পড়েছে ঠোঁট। ডানদিকের চোখের কোণ এমন করে ফুলছে, চোখটাই ঢাকা পড়ছে। গাল কপাল ভরা দাগ, থ্যাতলানো, ফুলা ফুলা। মুখ আর মানুষের মুখ মনে হয় না।

দিশাহারা গলায় আলফু বলল, কী অইছেরে তর? মুখহান এমুন ক্যা?

আলফুর কথার জবাব দিতে পারল না কাশেম। পানিতে চোখ ভরে এল। কাঁদতে লাগল সে।

কাঁধের ঝাঁকিজাল মাটিতে রেখে কাশেমের পাশে বসল আলফু। একটা হাত রাখল তার কাঁধে। গভীর সহানুভূতির গলায় বলল, কী অইছে তর, আমারে ক। কে মারছে?

অতিরিক্ত কষ্ট পাওয়া মানুষ যখন কাঁদে, যত নিঃশব্দেই কাঁদতে থাকে তারা, বুক ঠেলে বেরয় তাদের অদ্ভুত কষ্টের এক শব্দ। কাশেমের কান্নার লগেও মিশে যাচ্ছিল তেমন শব্দ। সেই শব্দে বুক তোলপাড় করতে লাগল আলফুর। কাশেমের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ক আমারে, ক, কে মারছে তরে?

কাশেম জড়ান গলায় বলল, হুজুরে।

ক্যা? কী অন্যায় করছস তুই?

 ছনুবুজির জানাজা পড়ছি এইডা আমার অন্যায়।

কচ কী!

হ।

দুই হাঁটুর মাঝ বরাবর মুখ নামিয়ে লুঙ্গির খুঁটে চেপে চেপে চোখ মুছতে লাগল কাশেম। কান্না তবু কমল না। জড়ানো গলায় বলল, খালি মাইরাঐ ছাইড়া দেয় নাই, বাইত থিকাও বাইর কইরা দিছে। কইছে ওই বাইত্তে আমার আর জাগা নাই। ঐ বাইত্তে উটলে আমারে হেয় জব কইরা হালাইবো। জন্মের পর থিকা ওই বাইত্তে থাকি আমি। অন্য কোনওহানে গেলে ঘুম আহে না। লাতথি দিয়া হুজুরে আমারে বাড়ির নামায় হালায় দিছে। তাও রাইত দোফরে, বাড়ির বেবাক মানুষ ঘুমাইয়া যাওনের পর বাড়ির সামনের নাড়ার পালাডায় গিয়া হুইয়া রইছি। এক পলকের লেইগাও ঘুমাইতে পারি নাই। মাশায় আমারে খাইয়া হালাইছে। দেহ শইলডা কী করতাছে! এতেও আমার কোনও দুঃখ নাই। মাশায় আমারে যত ইচ্ছা খাউক, আমি খাই কী! দুইদিন ধইরা না খাইয়া রইছি। আলফু ভাই, সব কষ্ট সইজ্জ করন যায়, খিদার কষ্ট সইজ্জ করন যায় না। এত মাইর মারলো হুজুরে, এত বেদনা শইল্লে, খিদার কষ্টে হেই বেদনা আমি উদিস পাই না। আমার মা বাপ নাই, ভাই বইন নাই, কার কাছে যামু আমি! কে আমারে একওক্ত খাওন দিব?

হাঁটুতে মুখ গুঁজে আবার কাঁদতে লাগল মাকুন্দা কাশেম।

.

১.৩৩

দোতালা ঘরের খাটাল থেকে খুনখুনা গলায় ডাকতে লাগলেন বড়বুজান। কুট্টি রে, ও কুট্টি, এইমিহি ইট্টু আয়। তাড়াতাড়ি আয় বইন।

রান্নাঘরের সামনে বসে মাছ কুটছিল কুট্টি। দুইটা শোলটাকি (ছোট শোল। বাচ্চা অর্থে) কুটে ছাই আর মাছের আঁশ নিয়েছে ভাঙা কুলায়, পোড়ামাটির খাদায় নিয়েছে কোটা মাছ। মাছ ধুতে ঘাটে যাওয়ার আগে মাছের আঁশ আর ছাই ফেলে যাবে চালতাতলায়, খাদা কুলা হাতে মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে তখনই ওই ডাক। তবে ডাকের লগে বইন কথাটা খুব কানে লাগল কুট্টির। এই বাড়ির মানুষ খুব সহজে আদরের ডাক ডাকে না কাউকে। বিপদে পড়লে ডাকে আর নয়তো কাউকে দিয়ে কোনও বাড়তি কাজ আদায় করতে হলে। বড় বুজানের কী এমন কাজ পড়ল! সকালবেলার সব কাজ সারিয়ে, কুট্টি বের হয়েছে সংসারের অন্যকাজে। সেটা তো বেশিক্ষণ হয় নাই।

রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল কুট্টি, সাড়া দেওয়ার কথা মনে ছিল না। বড় বুজান আবার ডাকলেন। কুট্টিরে, ও বইন, হোন না?

এবার সাড়া দিল কুট্টি। কী কন?

এইমিহি ইট্টু আয়।

ক্যা?

কাম আছে।

আমি অহন আইতে পারুম না। মাউচ্ছা হাত (মাছের গন্ধ আঁশ ইত্যাদি লেগে থাকা হাত)।

 মাউচ্ছা হাতে কিছু অইবো না। আয় বইন।

বুজানের কাতর অনুনয়ে যেমন বিরক্ত হচ্ছিল কুট্টি তেমন মায়াও লাগছিল। নিশ্চয় কোনও ঝামেলা হয়েছে নয়তো এসময় এমন করে ডাকতো না।

কুলা মাছের খাদা একপাশে নামিয়ে রেখে রান্ধনঘরের সামনে রাখা ঠিলা কাত করে খলবল করে হাত দুইটা ধুয়ে নিল কুট্টি। শাড়ির আঁচলে হাত মুছে মাছের খাদা নিয়ে দোতালা ঘরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কুলা পরে পরিষ্কার করলেও হবে। এখন বড় বুজানকে দেখে উত্তর দিকের বারান্দা টপকে ঘাটে গিয়ে মাছটা ধুয়ে আনলেই হবে। তাছাড়া মাছ এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না। কাউয়া চিলের ভয় আছে, বিলাইয়ের ভয় আছে। বাচ্চা দেওয়া বিলাইটা সারাক্ষণ কাতর হয়ে আছে ক্ষুধায়। খেয়ে না খেয়ে পাঁচটা বাচ্চা পাহারা দিচ্ছে ঘরে বসে। চারদিন হল জায়গা বদল করেছে। ঘেটি (ঘাড়) কামড়ে ধরে একটা একটা করে বাচ্চা এনে রেখেছে বড় বুজানের পালঙ্কের তলায়। যতবার খেতে বসে ততবারই টিনের চলটা ওঠা বাটিটায় করে মাছের কাটাকোটা, নিজের পাতের মাখা ভাত কিছুটা পালঙ্কের তলায় রেখে আসে কুট্টি। তবু ক্ষুধা বিলাইটার কমে না। সুযোগ পেলেই এইটা ওইটা নিয়া দৌড় দেয়।

খাটালের পালঙ্কের সামনে এসে কুট্টি বলল, কী অইছে বুজান?

পালঙ্কের কাঁথা কাপড়ের ভুরের ভিতর জেগে আছে বড় বুজানের মাথা। শীত পড়তে না পড়তেই শীতে বেদম কাতর হয়েছেন তিনি। হাত পা আর মুখের কুঁচকানো চামড়ায় খড়ি উঠেছে। মাথায় চুল বলে কিছু নাই, সব উঠে গেছে। পাকা বেলের মতো মাথায় লেগে আছে একেবারেই সাদা দুই একটা চুল। মুখ শুকাইয়া এতটুকু হয়ে গেছে। শীতের সকালে পুকুর থেকে ডাঙায় উঠে কাউট্টা যেমন শক্ত খোলসের ভিতর থেকে মাথা বের করে রোদ পোহায়, কাঁথা কাপড়ের ভিতর থেকে বের হয়ে থাকা বড় বুজানের মুখ মাথা এখন তেমন দেখাচ্ছে।

কুট্টির কথা শুনে ফোকলা মুখে হাসবার চেষ্টা করলেন তিনি। বয়স আর শরীরের চাপে এমন হয়েছে চেহারা, হাসি কান্নার ভাব একই রকম। কুট্টি বুঝতেই পারে না কোনটা হাসি কোনটা কান্না।

এখনও পারল না। মনে হল বুজান কাঁদছেন। বলল, কী অইছে? কান্দেন ক্যা?

 বুজান খিক করে হাসির শব্দ করলেন। কান্দি না, হাসি।

ক্যা? হাসনের কী অইছে?

অইছে একটা কাম।

তাড়াতাড়ি কন। ঘাডে যামু। কোডা মাছ লইয়া ঘরে আইছি। বেইল উইট্টা গেছে। ভাত চড়ামু।

আমি বইন একখান খারাপ কাম কইরা হালাইছি।

কী?

কইতে শরম করতাছে।

ইস আমার কাছে আবার শরম! মার কাছে ল্যাংটা পোলার শরম আছেনি!

বুজান কাঁচুমাচু গলায় বললেন, পেশাব কইরা দিছি।

শুনে কুট্টি খ্যাক খ্যাক করে উঠল। ক্যা আমারে ডাক দিতে পারলেন না? আমি মইরা গেছিনি?

কুনসুম করছি, উদিস পাই নাই।

এমতে দিহি পান। এমতে দিহি চিল্লাইয়া গলার রগ ছিড়া হালান। ও কুট্টি ডহি বাইর কর, আমি পেশাব করুম। অহন চিল্লাইতে পারলেন না? খালি আমার কাম বাড়ায়! বেবাক কেথা কাপোড় অহন রইদ্দে দেওন লাগবো। পশশু দিন নাওয়াইয়া দিছি আইজ আবার নাওয়ান লাগবো। নাওয়াইতে যে জানডা বাইর অইয়া যায় আমার হেইডা কেঐ বোজে? পানি গরম করো, পোলাপানের লাহান কুলে কইরা ফিরিতে (পিঁড়িতে) নিয়া বহাও। ইস জানডা শেষ কইরা হালাইলো আমার! মাজরো বুজানে ঢাকা যাওনের পর বুজছিলাম অহন কয়ডা দিন আরামে থাকুম, কাম ইট্টু কমবো, কীয়ের কী, আরও দিহি বাড়তাছে!

মাছের খাদা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখল কুট্টি। আগের মতোই গজ গজ করে বলল, পেশাব করনের সমায় মাইনষে আবার উদিস না পায় কেমতে!

বুজান অপরাধীর গলায় বললেন, এমুন তো কোনওদিন অয় নাই। আইজঐ পয়লা। তিন চাইর বচ্ছর ধইরা বিচনায় পড়ছি কোনওদিন এমুন অয় নাই। শীতের দিনে মাইনষের ইট্টু ঘন ঘন পেশাব অয়। হের লেইগা বিচনায় পেশাব করুম, এমনু। কোনওদিন অয় নাই। এই শীতটা টিকুম তো! নাকি এইবারের শীতে উড়াইয়া নিবো আল্লায়! মরণের আগে বলে এমুন অয় মাইনষের। কী করে না করে উদিস পায় না!

মৃত্যুর কথা শুনে ভিতরে ভিতরে দমে গেল কুট্টি। শীতের শুরুতেই ছনুবুড়ি গেল, আবার যদি বড়বুজানও যায়!

মৃত্যুর কথা ভাবলে বুকের ভিতর কেমন করে কুট্টির। মনে হয় দেশ গ্রামের একেকজন মানুষ একেকটা গাছ, বাড়ির একখান ঘর। সেই ঘর ভেঙে নিলে সেই গাছটা কেটে ফেললে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায়, শূন্য হয়ে যায়। সেই শূন্যতার দিকে তাকালে বুকটা হাহাকার করে। বড়বুজান যদি না থাকে, বড়বুজান যদি মরে যায় তাহলে এই পালঙ্কটা খালি হয়ে যাবে। হঠাৎ করে খাটালে ঢুকলে বুকটা ছ্যাত করে উঠবে কুট্টির। একজন মানুষের শূন্যতা কেমন করে সয় অন্য মানুষ! ছনুবুড়ির শূন্যতা কেমন করে সইছে তাদের বাড়ির লোক!

বড়বুজান বলল, তুই চেতিচ না বইন। আমারে ইট্টু উডা। বিচনাডা বদলাইয়া দে। ভিজা জাগায় হুইয়া থাকতে ভাল্লাগে না।

কুট্টি নরম গলায় বলল, আর ইট্টু থাকেন। ঘাডে গিয়া মাছ ধুইয়াহি আমি, তারবাদে চুলায় পানি গরম দিয়া আইয়া বেবাক কেথা কাপোড় রইদ্দে দিমুনে। আপনেরেও নাওয়াইয়া দিমুনে। ইট্টু সবুর করেন।

বড়বুজান বিগলিত গলায় ললেন, আইচ্ছা বইন, আইচ্ছা।

পায়ের কাছ থেকে কোটা মাছের খাদা ভোলার জন্য উপুড় হল কুট্টি ঠিক তখনই খাদা থেকে মুখ তুলে চঞ্চল ভঙ্গিতে পালঙ্কের তলার অন্ধকারে ছুটে গেল বিলাইটা। মুখে কামড় দিয়ে ধরা দুই টুকরা মাছ। কুট্টিকে বড়বুজানের লগে কথা বলায় ব্যস্ত দেখে, মাছের গন্ধে পালঙ্কের তলা থেকে বেরিয়ে আসছিল সে। একদিকে বড়বুজান কাজ বাড়িয়েছে অন্যদিকে বিলাইতে লইয়া যায় কোটা মাছ, অন্য সময় হলে এইসব নিয়া গলা চড়াত কুট্টি। খানিক আগে যেটুকু চড়িয়েছিল তারচেয়ে শতগুণ চড়াত। কিন্তু এখন তেমন কিছুই করল না। বিলাইটার জন্যও অদ্ভুত এক মায়া হল তার। খাউক, দুই টুকরা মাছই তো! না খাইতে পাইয়া বিলাইডা যুদি মইরা যায়, এই যে ঘরের ভিতরে টুকটাক ঘুইরা বেড়ায়, খাইতে বইলে পাতের সামনে ঘুরঘুর করে, ম্যাও ম্যাও করে আর নাইলে আল্লাদ দেহায় এই হগল কুট্টি পাইবো কই! ঘর খালি খালি মনে অইবো না!

.

১.৩৪

ঘন কচুড়ির তলার পানি এমন ঠাণ্ডা হয়, খরালিকালে ডুব দিয়ে কচুরির তলায় গেলে শরীর জুড়ায় আর শীতকালে গেলে শরীর হিম। প্রথমে কাঁটা দেয় শরীরে তারপর শক্ত হতে থাকে। এজন্য শীতকালে কচুরির তলায় যেতে হলে কেউ কেউ খুব জুত করে সউষ্যার তেল মাখে গায়ে। তেল মাখার সময় হাত দুইটা শরীরের এইদিক ওইদিক ঘুরপাক খায় বলে শরীরে এমনিতেই তৈরি হয় এক ধরনের উষ্ণতা, তার ওপর আছে তেলের উষ্ণতা। দুয়ে মিলে কচুরির তলার পানিকে কাবু করা যায়। তবে কচুরি তোলা আর চাক বেড় দিয়ে মাছ ধরার ব্যাপার থাকলে পানিতে নামার লগে লগে পানির ঠাণ্ডায় ধরতে না ধরতেই কাজের চাপে গরম হয় শরীর, পানির ঠাণ্ডা তো উদিস পাওয়া যায়ই না, একটু পর লাগে গরম। ঘাড় গলা, বুক পিঠ ঘামতে শুরু করে।

এই এখন যেমন হচ্ছে আলফুর।

মাকুন্দা কাশেমকে নিয়ে একটু আগে পুকুরের পুব দক্ষিণ কোণে আসছে সে। পুকুরপারে কাশঝোপের কাছে কাশেমকে বসিয়ে লুঙ্গি কাছা মেরে ঝাঁকিজাল নিয়ে নিজে নেমে গেছে কচুরি ভর্তি পুকুরে। পুকুরের একদিকটায় এখনও হাত পড়েনি। এমনিতেই ঘন কচুরি এখানটায় তার ওপর পারে আছে কাশ, কাশের শিকড় বাকড় তো আছেই, কোনও কোনও নুয়ে পড়া কাশও এসে লেপটে পড়েছে পানিতে, কচুরির ওপর, ফলে জংলা মতন জায়গটাকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে পুকুরের বাছা বাছা মাছগুলি নিশ্চয় এখানে এসে থান গাড়ছে। আলফু আজ সেই মাছ ধরবে। একটানা বেশ কয়েকদিন বাড়িতে থেকে আজ তিনদিন হল বাড়ির কর্তী চলে গেছেন ঢাকায়। যে কয়দিন বাড়ি ছিলেন তিনি আলাম (আস্ত) একটা মাছও পড়েনি আলফুর পাতে। এত মাছ ধরে জিইয়ে রাখে ঘোপায়, হলে হবে কী কোনও কোনও ওক্তে মাছের চেহারাই দেখে নাই। কর্ত্রী বেজায় কৃপণ মানুষ। নিজে খেয়ে শেষ করে গেছেন ঘোপার সব মাছ।

আলফু ভেবেছিল কর্ত্রী চলে যাওয়ার পরদিনই পুকুরে নামবে। বাছা বাছা কিছু মাছ ধরে কুট্টিকে বলবে বেশি করে তেল মশলা দিয়ে রান্না করতে। তারপর দুইটা তিনটা করে আলাম মাছ দিয়া ভাত খাবে একেকবেলা। যে কদিন মাছ খেতে পারে নাই সেই কয়দিনেরটা উসিল করবে। কিন্তু দুইটা দিন কেটে গেছে পুকুরে আলফু নামতে পারেনি। একটা দিন গেল ছনুবুড়ির মৃত্যু নিয়ে আরেক দিন সকাল থেকেই আলস্য লাগল। এই সব কারণে আজ আর কোনও কিছু ভাবে নাই আলফু, কোনওদিকে তাকায় নাই, পুকুরে এসে নামছে।

আলফু যখন পুকুরে নামছে মাকুন্দা কাশেম কাতর গলায় বলল, আমিও তোমার লগে নামুম মিয়াবাই?

আলফু বলল, না। তুই বইয়া থাক। খালি একখান চাক উডামু। ঘণ্টাহানির কাম। একলা পারুম। তারবাদে বাইত যামু। কুট্টি ততক্ষুণে রান্দন বাড়ন সাইরা হালাইবো। তরে আমার লগে বহাইয়া খাওয়ামুনে। দুইডা দিন কষ্ট করছস, আর ইট্টু কষ্ট কর।

হেইডা পারুম। তয় আজাইরা থাকলে খিদা বেশি লাগে মিয়াবাই। আমি তোমার লগে নামি?

আলফু হেসে বলল, লুঙ্গি তো ভিজ্জা যাইবো!

যাউক।

ভিজা লুঙ্গি ফিন্দা দিন কাডাবি?

ক্যা আমার আরেকখান লুঙ্গি আছে না।

কো?

কাশেমের মনে পড়ল লুঙ্গিটা মান্নান মাওলানার বাড়িতে রয়ে গেছে। লুঙ্গি কেন তার নিজের ব্যবহারের কোনও জিনিসই সে ওই বাড়ি থেকে আনতে পারিনি।

মার খাওয়া মুখটা আবার বিষণ্ণ হয়ে গেল কাশেমের। চোখ দুইটা ছলছল করে উঠল। লুঙ্গিহান বাইত্তে রইয়া গেছে মিয়াবাই। আমারে যে বাইত থিকা বাইর কইরা দিছে, আমি যে ঐ বাইত্তে আর যাইতে পারুম না এই কথাডা আমার মনে থাকে না। ভুইল্লা যাই।

চোখের পানি সামলাতে অন্যদিকে তাকাল কাশেম।

আলফু বলল, এই হগল চিন্তা কইরা অহন আর মন খারাপ করি না। তুই পুরুষপোলা না, কী রে বেডা, পুরুষপোলাগো এমুন মুলাম (মোলায়েম) মন অইলে কাম অয়নি? বাইত থিকা বাইর কইরা দিছে দেইক্কা কী অইছে! শইল্লে জোরবল নাই তর? অন্য বাইত্তে গিয়া কাম লবি। আর যেই বাড়ির মাইনষে তরে বিনা দোষে এমুন মাইর মারছে হেই বাইত্তে তো তর এমতেঐ যাওন উচিত না। হেই বাইত্তে ফিরা যাওনের আশা ছাইড়া দে। অন্য বাড়ি দেক। অন্য বাইত্তে কাম ল।

হাত দিয়ে ডলে ডলে চোখ মুছল কাশেম। হুজুরের বাড়ির গোমস্তারে এই গেরামের কোনও বাইত্তে কামে রাখবো না।

আলফু অবাক হল। ক্যা?

হুজুরের ডরে। গেরামের বেবাক মাইনষেঐ হুজুররে ডরায়। হের পোলা আতাহাররে ডরায়। আমারে কামে রাইক্কা হেগো শতরু অইবো কেডা?

তাইলে কনটেকদার সাবের কাছে যা, মাইট্টাল অ। দিন গেলে নগদ টেকা পাবি।

ওহেনেও ভেজাল আছে। আতাহারে অইলো কনটেকদার সাবের দোস্ত।

আলফু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুই তো তাইলে এই গেরামেই থাকতে পারবি না। অন্য গেরামে গিয়া কাম কাইজ কইরা খাইতে অইবো তর।

হেইডা আমি পারুম না মিয়াবাই।

ক্যা?

আমি কোনওদিন এই গেরাম ছাইড়া কোনওহানে যাই নাই, কোনওহানে গিয়া থাকি নাই। একদিন এই গেরামে আমগো বাড়িঘর আছিলো, বাপ দাদারা আছিলো, চাচারা আছিল, অহন আর কেঐ নাই। কে গেছে মইরা, কেঐ গেছে দেশ গেরাম ছাইড়া। রক্তের আততিয় স্বজন কে কোনহানে আছে কইতে পারি না। এই গেরামডারেঐ মনে। অয় আমার আততিয়। আমার বাপ দাদা, ভাই বেরাদর, চাচা ফুবু, বেবাক মনে হয় এই গেরামডারে। এই গেরাম ছাইড়া আমি কোনওহানে যামু না। মইরা গেলেও যামু না।

কাশেমের কথা শুনে অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল আলফু। তারপর পানিতে নামছে। ঝকিজালটা হাতেই ছিল। শক্ত, মোটা সুতার জাল। ঘন করে কাঠি দেওয়া। একটু লম্বা ধরনের লোহার কাঠি। গাবের কষে প্রায়ই ভিজিয়ে রাখা হয় বলে কড়কড়া শুকনা বেগুনির কাছাকাছি রঙের শক্ত জাল। পাঁচ সাত কেজি ওজনের রুই বোয়ালেরও সাধ্য নাই এই জাল ছিঁড়ে বের হয়। ঘন করে কাঠি দেওয়া বলে জালের ওজনও বেশ। পানির তলায় গিয়ে এমন করে ছড়ায় জাল, ওজনদার বলে কাঠিগুলি গেঁথে যায় কাদায়। কাদার ভিতর লুকিয়ে থাকা শাল গজার তরি কাদা ভেঙে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় না। জালে আটকা পড়তেই হয়। তবে আলফুর মতো দশাসই জুয়ান ছাড়া এই জাল বাওয়া কঠিন। ছুঁড়ে জায়গা মতো ফেলা তো দূরের কথা, এক হাতে রশি ধরে অন্যহাতে বারোহাতি জাল কায়দা করতেই জান বের হয়ে যাবে।

এই জালে আজ চাক বের দিবে বলে জালের বারো চৌদ্দ হাত লম্বা রশিন গুটিয়ে গরুর মুখের ঠুলির মতো গোল করেছে আলফু। এমন করে গিটঠু দিয়েছে যাতে রশিটা খুলতে না পারে। চাক বেড় দেওয়ার সময় রশি খুলে যদি পানির তলায় ছড়িয়ে যায়, পানির তলায় লুকিয়ে থাকা কোনও বঁটাখাঁটির লগে যদি প্যাঁচায়া যায় তাহলে লাগবো আরেক ভেজাল। অতিকষ্টে কচুরির তলা দিয়ে টেনে নিয়ে চারদিক থেকে কচুরির দশ বারোহাতি চাক বেড় দিয়ে যখন কচুরি তুলে ফেলতে ফেলতে গুটিয়ে আনা হবে জাল, হয়তো তখনই পানির তলায় জড়িয়ে যাওয়া রশির টানে কচুরির তলা থেকে সরে যাবে জাল। পালাবার তক্কে থাকা মাছগুলি পালিয়ে যাবে। সামান্য ভুলের জন্য পরিশ্রমটাই মাটি। এজন্য আগেভাগেই কাজটা সেরে রাখছে আলফু।

নিঃশব্দে কচুরির জঙ্গল ফাঁক করে আলফু যখন পানির গভীরে আগাচ্ছে তখনই ঘাটলায় মাছ ধুতে এসে তাকে দেখতে পেল কুট্টি। দেখে আনমনা হল। সেই যে একদিন চালতাতলায় আলফুর ঘাড়ের কাছে একটুখানি রোদ পড়ে থাকতে দেখে শরীরের খুব ভিতরে অন্যরকমের একটা অনুভূতি হয়েছিল, এতদূর থেকে আলফুকে দেখে আজও ঠিক তেমন অনুভূতিই হল। সব ভুলে আলফুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। পুকুরপারে যে তারেকজন মানুষ আছে কুট্টি তাকে দেখতেই পেল না।

.

১.৩৫

হাঁটাচলা করতে পারে না এমন পোলাপানকে যেমন করে ঘরে আনেন মা, নাওয়াইয়া ধোয়াইয়া (গোসল টোসল) পাথালি কুলে (পাঁজাকোল) নেন, ঠিক তেমন করে বড়বুজানকে ঘরে নিয়ে এল কুট্টি। পেশাবে দুর্গন্ধ হওয়া কথা কাপড় আগেই রোদে দিয়েছিল। খাটালের পালঙ্কে এখন অন্য তোষক বিছানো। তোষকের উপর অন্য কাঁথা, সাদা গিলাপ লাগান অন্য বালিশ, শীতকালের জন্য তুলে রাখা লেপও বের করা হয়েছে। কটকটা লাল রঙের লেপখান ঢোকান হয়েছে ঠিক সাদা না সাদার কাছাকাছি রঙের ওসারে (ওয়ার)। এসবই ভোলা ছিল ছোটখাট ঘরের সমান টিনের আলমারিতে। দীর্ঘদিন আলমারি বন্দি থাকার ফলে লেপ তোষকে ঘুম ঘুম গন্ধ হয়। বড়বুজানের পালঙ্কে এখন সেই গন্ধ। খুব সহজ প্যাঁচে বড়বুজানকে যখন সাদা কাপড় পরিয়ে পালঙ্কের ওপর বসিয়েছে কুট্টি, মানুষটার মুখে তখন গভীর প্রশান্তির হাসি। খুনখুনা গলায় বললেন, বহুত আরাম লাগতাছে রে বইন।

শুনে কপট রাগের গলায় কুট্টি বলল, আরাম তো লাগবোঐ! আরামের কাম কইরা দিলাম যে! আপনের আরামের লেইগা আমার যে কী খাটনিডা গেল হেইডা তো একবারও চিন্তা করলেন না!

কে কইছে চিন্তা করি নাই? করছি। তয় চিন্তা কইরা কী করুম ক? আমি আতুর লুলা মানুষ, আমার কিছু করনের আছে!

বড়বুজান কাত হয়ে শুয়ে পড়তে চাইলেন। দুইহাতে তাকে ধরল কুট্টি। ইট্টু পরে হোন।

ক্যা?

শইল্লে ইট্টু তেল দিয়া দেই।

শরীরে তেল ডলে দেওয়ার কথা শুনে খুশি হলেন তিনি। ফোকলা মুখ হাসিতে ভরে গেল। এটা যে কান্না না, এটা যে আনন্দের হাসি বুজানের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল কুট্টি। তার মুখেও হাসি ফুটল। ইস তেল দেওনের কথা হুইন্না দিহি আল্লাদে আর বাচে না! হাসে কী!

আমার হাসন তুই বোজছ! তুই দিহি কচ আমি হাসি না কান্দি বুজা যায় না। অহনকার বোজলাম।

খাটালের ছোট্ট আলমারির মাথার উপর রাখা সউষ্যার তেলের শিশি নিয়ে এল কুট্টি। এক হাতের তালুতে একটু তেল ঢেলে দুইহাতে সেই তেল ঘষে প্রথমে বুজানের মাথায়, তারপর হাতে পিঠে বুকে ডলতে লাগল। ডলায় ডলায় শিশুর মতো দোল খেতে লাগলেন বড়বুজান। শীতের দিনে সউষ্যার তেল শইল্লে দিলে শইল গরম থাকে। শীত লাগে কম।

কুট্টি বলল, তয় একখান কামও বাড়ে।

কী কাম?

শইল্লের বেবাক তেল লাইগ্যা যায় বিচনায়। বিচনা নষ্ট হয়।

বুজান একটু চমকালেন। ঘোলা চোখে কুট্টির মুখের দিকে তাকালেন। হ এইডা তো ঠিক কথা কইছস! আইজঐ নতুন লেপ তোষক বাইর করলি আইজই হেইডি নষ্ট অইবো! তাইলে আমারে তেল দেওলের কাম আছিলো কী!

তেল ডলতে ডলতে কুট্টি বলল, এত কষ্ট কইরা এত কাম আপনের লেইগা আইজ করলাম, এডু আর বাকি রাখুম ক্যা! বিচনা নষ্ট অইলে আমার কাম বাড়বো! আপনের কী?

তুই খুব ভালরে বইন, খুব ভাল।

কেডা কইছে আমি ভাল! আমি দিহি খালি আপনের লগে রাগ দেহাই, কাইজ্জা করি! ভাল অইলাম কেমতে!

কো কাইজ্জা করচ!

করি না?

 যা করচ ওইডা কাইজ্জা না।

তয় কী?

ঐডা তর সবাব। যে কোনও কামে পয়লা ইট্টু চিল্লাচিল্লি করচ, তারবাদে হেই কামডাঐ খুব ভাল কইরা করচ। এই হগল মাইনষের ভিতর খুব ভাল অয়।

কুট্টি একটু উদাস হল। ভিতর ভাল অইলে কী অইবো? ভিতর তো মাইনষে দেহে না!

যারা মাইনষের ভিতর দেহে না তারা মানুষ না। তারা আমানুষ।

দুইন্নাইতে আমানুষঐ বেশি। জন্মের পর থিকা মা বাপরে দেকলাম, তাগো পেড়ে জন্মাইলাম, তাগো কুলে বড় অইলাম, তারা কেঐ আমার ভিতরডা দেকলো না। হাত পাও বাইন্দা হতিনের ঘরে ঘর করতে পাডাইলো। হতিন তো হতিনঐ, হেয় আমারে কী বুজবো! যার লগে বিয়া অইলো হেই মানুষটাঐ কিছু বোজলো না! পেডের কষ্ট তো আছে, মনের কষ্টও আছে। যে কোনও একখান কষ্ট মাইনষে সইজ্জ করতে পারে দুইখান করে কেমতে! খাইতেও দিবো না মনও বুজবো না হেই মাইনষের ঘর কেমতে করে মাইনষে!

তেল ডলা শেষ করে বড়বুজানকে শোয়াইয়া দিল কুট্টি। গলা তরি লেপ টেনে দিল। বড়বুজান তখন ঘোলা চোখ দুইখান মায়াবি করে তাকিয়ে আছেন কুট্টির দিকে।

কুট্টি বলল, চাইয়া রইলেন ক্যা?

তরে দেকতাছি।

আমারে আবার দেহনের কী অইলো! এমুন পচামুখ মাইনষে দেহে

আমি তর মুখ দেহি না, আমি তর ভিতরডা দেহি। তর লাহান একখান মাইয়া যুদি আমার থাকতো, এই দুইন্নাইতে আমার তাইলে কোনও দুঃকু থাকতো না।

আর আমার মা বাপে আমারে বাইত্তে যাইতে দেয় না। আমার মুখ দেহে না।

 তর মা বাপে মানুষ না। আমানুষ।

তয় তাগোও আমি দোষ দেই না। দোষ দেই আমার কপালের। বিয়ার বস (বয়স) অওনের পর থিকা জামাই লইয়া, জামাইবাড়ি লইয়া কতপদের চিন্তা করছি। কত খোয়াব দেকছি। চিন্তা করছি এক, খোয়াব দেকছি এক, অইছে আরেক।

কুট্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বড়বুজান বললেন, আমার যুদি একখান পোলা থাকতো, হেই পোলার যদি তর লাহান একখান বউ থাকতো, আহা রে, কত খুশি অইতাম আমি।

দখিনা দুয়ার দিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে কুট্টি বলল, বিয়ার আগে চিন্তা করছি জামাই বাইত্তে গিয়া আমার হরির (শাশুড়ি) বেবাক কাম কইরা দিমু আমি। হৌরের বেবাক কাম কইরা দিমু। গিয়া দেহি হৌরও নাই হরিও নাই। আছে একখান হতিন, তার এলাগেন্দা পোলাপান।

বিয়ার আগে তুই হোনচ নাই হতিনের ঘর?

না।

কচ কী!

হ। আমারে কেঐ কয় নাই। বুজান, আপনের কাম কাইজ যহন কইরা দেই, আপনেরে নাওয়াই থোয়াই, খাওয়াই ঘুম লওয়াই তহন আপনেরে আর দেহি না আমি। দেহি বিয়ার আগে খোয়াবে দেহা আমার হরিরে। দেহি আমার জামাই বাড়িডা। যেন আমি আমার হরির কাম কাইজ করতাছি। যেন আমি আমার জামাই বাইত্তেঐ আছি। আমি তহন আর আউজকার আমি থাকি না। আমি অইয়া যাই কহেক বচ্ছর আগের আমি।

কুট্টির কথা শুনে বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ল বড়বুজানের। গভীর দুঃখের গলায় বললেন, বহুত ছোডকালে বিয়া অইছিলো আমার। ছয় সাতমাস জামাইর ঘর করছিলাম। তারবাদে জামাই মরলো। আগের দিনে ভাল বংশের মাইয়ারা রাড়ি (বিধবা) অইলে হারা জনম রাড়ি থাকতো। তাগো আর বিয়া অইতো না। আমারও আর বিয়া অয় নাই। বাপের অবস্তা ভাল আছিলো দেইক্কা বাপে আমারে আর জামাই বাইত্তে রাখে নাই। বাপের বাইত্তে লইয়া আইছিল। একভাই দুইবইন আছিলাম আমরা। ভাইডা বেবাকতের ছোড়। ঘোড অইলে কী অইবো হেয়ঐ গেল বেবাকতের আগে। অহন আছি খালি রাজা মিয়ার মায় আর আমি। দুই বইনে খুব খাতির আছিলো আমগো, অহনও আছে,এর লেইগা জনম ভর বইনে আমারে টানলো। বইনের সংসারে জীবনডা কাইট্টা গেল আমার। স্বামী সংসার বোজনের আগে বিয়া অইছিলো, বোজনের আগে রাড়ি অইলাম। জীবনের সাদ আল্লাদ কিছুই বোজলাম না। স্বামী সংসার, পোলা মাইয়া, পোলার বউ, মাইয়ার জামাই, নাতি নাতকুর সব মিলাইয়া মাইয়াছেইলাগো যেইডা জীবন হেই জীবন আমি কোনওদিন চোক্কে দেকলাম না। একটা জীবন জীবন না অইয়া কাইট্টা গেল। কুট্টিরে, তর জীবনডাও দেকতাছি আমার লাহান। দিনে দিনে দিন চইলা যাইবো, একদিন দেকবি আমার লাহান বিচনায় পড়ছস, আর উইট্টা খাড়ঐত পারবি না। তহন খালি মনে অইবো জন্মাইছিলাম ক্যা! মাইনষের আসল যেই জীবন হেই জীবনঐ যদি না পাইলাম তয় জন্মাইছিলাম ক্যা!

বড়বুজানের কথা শুনে কখন যে কাঁদতে শুরু করেছে কুট্টি, কখন যে চোখের পানিতে গাল ভাসতে শুরু করেছে, কুট্টি তা টের পায়নি।

পালঙ্কের তলায় বিলাইয়ের বাচ্চাগুলি তখন কুঁইকুই করতাছে। বোধহয় ক্ষুধা লেগেছে তাদের, বোধহয় মায়ের সঙ্গে আল্লাদ করতাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *