গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

কাফের লেখকদের সম্পর্কে

কাফের লেখকদের সম্পর্কে

কাফের লেখক। কারা এই কাফের লেখক? কোথায় তারা থাকে? কোন দেশে? তারা মানুষ তো? তারা যদি মানুষ হয় তাহলে তারা কোন জীবনে থাকে? সে জীবন নিশ্চয়ই একটি সমাজ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। তাকে প্রচুর সামাজিক আইন কানুন মেনে চলতে হয়। তাহলে সে সমাজটা কোন সমাজ? সমাজ তো আর মানুষ বাদ দিয়ে নয়। মানুষ যেহেতু, তাই মানুষ হিশেবে বেঁচে থাকতে গেলে, মানুষ যা করে তাদেরও তাই করতে হয়। তাদের খেতে হয়— তারা খায়। তারা ঘুমায়। পোশাক পরে। রোগ ব্যাধিতে তারা চিকিৎসা করায়। তারা শিক্ষা লাভ করে। নারীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। শারীরিক উৎসব করে। সন্তান জন্ম দেয় এবং লালন পালন করে। স্বপ্ন দ্যাখে। হাসে। দুঃখ পায়। এছাড়াও লেখে। আমরা তাহলে এই লেখা থেকে শুরু করি। লেখা থেকে শুরু কোরে তাদের বাসস্থান, চিকিৎসা, পোশাক, খাদ্য হয়ে আমরা তাদের দেশ পর্যন্ত যাবো।

এরা কী লেখে? এরা লেখে ছবি, গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, গল্প। সর্বাধুনিক প্রচার মাধ্যমগুলোও এরা ব্যবহার করে। যেমন সংবাদপত্র, বেতার, চলচ্চিত্র। কোন বাংলা ভাষায় এরা লেখে? যে বাংলা ভাষায় আমাদের অধিকাংশ মানুষ কথা বলে, বোঝে, সেই ভাষায়? নাকি ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ষড়যন্ত্র’-এর শিকার যে বাংলা ভাষা, সেই ভাষায়? এরা প্রধানত দ্বিতীয় পক্ষের ভাষাতেই লেখে। এদেশে সাত শতাংশ লোক ইশকুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাষা শেখে, যে অভিব্যক্তি শেখে, যে সুন্দর এবং অসুন্দরের, ন্যায় এবং অন্যায়ের ধারনা গ্রহন করে অর্থাৎ যে মূল্যবোধ অর্জন করে, এই লেখা প্রধানত সেই মূল্যবোধের।

সেই মূল্যবোধের প্রধান প্রবনতা হচ্ছে জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারনা না-দেয়া। জীবনকে বিভিন্ন মুখোশে, রঙে ঢেকে রাখা। জীবনের সঠিক উপলব্ধিগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করা। সঠিক স্বপ্নকে বিভ্রান্ত করা। প্রয়োজনে দেশ রক্ষার অস্ত্র ও বাহিনীকে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা। সামান্য কয়েকজনের সম্পদ ও বিলাসের জন্যে ষড়যন্ত্র করা। অধিকাংশ মানুষকে বাধ্য করা ক্ষুধা-অনাহার, রোগ-মৃত্যু, কর্মহীনতা, শিক্ষাহীনতা আর জীবনের অন্ধকারে থাকতে। এরা কিন্তু সকলেই চায় সবার ভালো হোক। অনাহার না-থাক। রোগ ব্যাধি না-থাক। সকলে গায়ে কাপড় দিতে পারুক। সকলেরই একটি নিশ্চিত বাসস্থান থাকুক। সকলের সন্তানেরা শিক্ষা লাভ করুক। তারা চায় সবাই সুখে থাকুক। তারা চায় মানে তারা বলে। এই চাওয়া বা বলা তারা বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভঙ্গিতে, বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করে। কেউ ধর্মের পোশাকে। কেউ প্রগতির মুখোশে। কেউ সেনাদলের রঙে। পৃথিবীর গরিব এবং ছোট দেশগুলোয় আবার শেষ পক্ষেরই হম্বিতম্বিটা বেশি। অন্যেরা তো আর প্রকাশ্যে অস্ত্রপাতি নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারে না। কাজেই অস্ত্রের সাথে কি আর ইয়ার্কি চলে!

লক্ষ্য করুন। যে তিনটি পক্ষের কথা বললাম (পক্ষ আসলে অসংখ্য, প্রধানত এই তিন ভাগে আমি ভাগ করেছি) তাদের শরীরের ত্বকের মসৃনতা এবং লাবন্য কিন্তু প্রত্যেকের সমান। তারা সবাই কিন্তু ভালো খাবারগুলো খেতে পায়। ভালো পোশাকগুলো পরতে পারে। সবারই ভালো বানিজ্য আছে। ব্যক্তি মালিকানায় কারখানা আছে। চলাফেরার জন্যে দুখানা পা ছাড়াও চারখানা চাকাওয়ালা এক বা একাধিক যন্ত্রচালিত শকট আছে। নিরাপদ এবং আরামদায়ক গৃহ আছে। ঘরে সুন্দরী বউ আছে।

লক্ষ্য করবেন, ওই মহিলাদের চুল, অবয়ব বা পোশাক দেখলে মনে হবে তারা প্রচুর পরিশ্রমের সাথে জড়িত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো কাজ করে না। তারা চুল ছোটো কোরে কাটে ধনবাদী সমাজের মেয়েদের মতো কিন্তু তারা যে-পরিমান পরিশ্রম করে বা করতে হয় তার এক শতাংশও এই মহিলারা করে না। তারা গ্রামের নারীদের মতো শরীরের বিভিন্ন অংশ খোলা রাখে কিন্তু তাঁদের মতো পরিশ্রমের এক শতাংশ কাজও করে না। ফলে মেদ এসে মজাদার আস্তানা গড়ে এই মেয়েদের কোমরে আর বাহুতে। এই মেদ কমানোর জন্যে আবার শরীর-রক্ষা কেন্দ্র তৈরি করে কিছু লোক। এগুলোকে তারা বিউটি পারলার নামে ডাকে। তারা নারী স্বাধীনতার আন্দোলন করে। নিজেদের জীবনে যে-কোনো পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের স্বাধীনতা পর্যন্ত ই থাকে তাদের নারী-স্বাধীনতা। অনেকে আবার এই শেষ জামানায় ইহকালের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরকাল নিয়ে মেতে ওঠে। পীর ফকিরের দরগায় মানত-টানত কোরে মনে শান্তি আনে। পবিত্র হয়। আল্লাহতালার হাতে পৃথিবীর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফ্যালে। এদের সন্তানেরা ভালো ইশকুলে লেখাপড়া করে। ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ’ এই মন্ত্র শিরোধার্য কোরে এক দৌড়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে আসে।

এখন সত্যি কথাটা হচ্ছে দেশ এবং সমাজ চালানোর ‘কল ঘর’টি রয়েছে এদের দখলে। আমরা চাইলেও এখন আর সে ‘কল ঘর’ পর্যন্ত পৌঁছতে পারি না। ওরা পয়সা দিয়ে, খেতে দিয়ে অনেক লোককে আটকে ফেলেছে। ওদের হুকুম ছাড়া তারা একটু ঘাড় নাড়াতে পারে না। এই লোকগুলোই এখন সে ‘কল ঘর’ পাহারা দেয়। একদা আমরা বিশ্বাস কোরে কিছু কিছু মানুষকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কাউকে দিয়েছিলাম গোলা ঘরের চাবি, কাউকে অস্ত্র ঘরের চাবি, কাউকে আইন ঘরের চাবি। এখন ওরা ভাবে সব চাবিই তো ওদের হাতে কাজেই আমাদের আর প্রয়োজন কি? ওরা যেমন চলবে আমরাও ঠিক ঠিক তেমনই চলবো।

যে তিনটি পক্ষের কথা বললাম, এই হলো তাদের অবস্থা। এরা কখনোই চায় না জীবনের আসল কথাগুলো, সত্যি ছবিগুলো, প্রকৃত আকাংখাগুলো, স্বপ্নগুলো কোথাও প্রকাশিত হোক। তারা চায় ধর্মের কুয়াশায় জীবন আচ্ছন্ন হোক, তারা চায় প্রগতির শ্লোগানে জীবন ঢাকা প’ড়ে যাক। তারা চায় অস্ত্রের হুংকারে জীবন বিলীন হয়ে যাক। তারা চায় না হাতি তার নিজের শরীর দেখুক। হাতির চোখ দুটিকে তারা সব সময় খুব ছোট কোরে রাখতে চায়। মাহুতের ইচ্ছাই যেন হাতির ইচ্ছা হয়ে থাকে।

আমাদের এক শ্রেনীর লেখক তাদের এই ইচ্ছগুলোকে জ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানেই হোক, কার্যকর করতে সাহায্য করে। এদের মধ্যে আবার প্রধানত দুটো পক্ষ। একটি পক্ষের নাম দিয়েছি আমি নান্দনিক মৌলানা আর অন্যটির নাম আওয়াজ ব্রাহ্মন। নান্দনিক মৌলানারা স্বভাবে বেশ মধুর। তারা ‘এইসব রাজনীতি’ বোঝে না। তারা এমন এক জীবনের স্তব করে যে জীবন স্বপ্নেও যাপন করা চলে না। শ্রমহীনতা, কর্মহীনতাই তাদের সুন্দর। তাদের সুন্দরতম পুরুষ হচ্ছে সে, যে কোনো শ্রমের সাথে সম্পর্কিত নয়, যে শুধু একার স্বপ্ন দ্যাখে। তারা শুধু ফুলের কথা বলে। শুধু পাখির মধুর কন্ঠের কথা বলে। পাখিটির বেঁচে থাকার সংগ্রামকে বলে না। লক্ষ্য করুন তারা যে উপন্যাস লেখে, গান লেখে, চলচ্চিত্র লেখে, নাটক লেখে তার নায়ক নায়িকারা কেউই কাজ করে না। খায় না, মলমূত্র ত্যাগ করে না। শুধু প্রেম করে। শুধু নেচে নেচে গান গায়। মিছিল দেখলে তাদের খারাপ লাগে। তারা চায় আবর্জনা-মুক্ত হোক পৃথিবী। কিন্তু তারা কেউই সেই আবর্জনায় হাত দিতে চায় না।

এবার আওয়াজ ব্রাহ্মনদের কথায় আসা যাক। এরা জীবন মানে বোঝে চিৎকার। বোঝে শ্লোগান। শ্লোগান হচ্ছে সম্মিলিত মানুষের জীবনের ক্ষোভ ও স্বপ্ন থেকে উঠে আসা ধ্বনির একটি ব্যাকরনসম্মত উচ্চারন। শ্লোগান জীবন থেকে ওঠে কিন্তু শ্লোগানের মধ্যে জীবন থাকে না। থাকে জীবনের রেখা। পৃথিবীর সব নির্যাতিত মানুষের শ্লোগান এক কিন্তু সকল নির্যাতিত মানুষের জীবন-পরিবেশ এক নয়। ভৌগোলিক পরিস্থিতির কারনে সব বেঁচে-থাকা, সব সংস্কৃতি, সব জীবন এক নয়। হতে পারে না। সব জীবন যেহেতু এক নয় কাজেই সব জীবন পরিবর্তন হতে পারে না। পৃথিবীর সব বিপ্লব আপাত অভিন্ন হলেও কার্যত এক ভাবে হয়নি। এক ভাবে এক রীতিতে হওয়া অসম্ভব, অবাস্তব। মন্ত্র আর নির্বান এক, সাধন আলাদা। আদর্শ এবং মুক্তি এক কিন্তু অনুশীলন আলাদা। প্রত্যেককেই সমতার মন্ত্রটিকে সেই ভৌগোলিক পরিবেশ, সেই জলবায়ু ও জীবনের উপযোগী কোরে নিতে হয়েছে। আওয়াজ ব্রাহ্মনেরা মুখে এ সত্যটি উচ্চারন করে কিন্তু তাদের লেখা সে কথাটি বলে না। তাদের নায়ক নায়িকারা সব বেহেস্ত থেকে আসা দেবদূত। তারা শুধু এক নোতুন সমাজ গড়তে চায়। তারা শুধু মিছিল করে, শ্রেনী শত্রু হত্যা করে। তারা প্রেম করে না। নারীদের সাথে তাদের পুরুষের শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয় না। তাদের আকাশে শুধু লাল সূর্য ওঠে— জীবন ওঠে না, জীবন জ্বলে না, জীবন জ্ব’লে ওঠে না।

দুই পক্ষই দুইটি ভিন্ন আবরনে ও অস্পষ্টতায় আড়াল কোরে দিয়েছে জীবনকে অধিকাংশ মানুষের জীবন-পরিবেশ এবং স্বপ্ন ও ক্ষোভ, সংগ্রাম এবং বেঁচে থাকাকে লিখতে এরা সম্পূর্নভাবে ব্যর্থ। এরা বিভ্রান্ত। এরা আলোকপ্রাপ্ত নয়। এরা অন্ধকার। এরা কাফের। আমাদের পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ-বিরুদ্ধ, জীবন-সত্য-বিরুদ্ধ কাজে যারা জড়িত তারাই কাফের, তারাই আলোহীন বর্বরতা।

এদেশে যারা রাজনীতিকে বিষয় কোরে শিল্প চর্চা করে তাদের অধিকাংশই এখনো পরিষ্কার কোরে তাদের মাধ্যমটিকে বোঝে না। ঘোড়দৌড়ে অংশ নিলে আমাকে তো ঘোড়ায় চড়তে হবে প্রথম। কিংবা সাঁতারে নামলে তো পানিতে নামতে হবে আগে।

[অসমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *