1 of 2

কুমারটুলি বেণীমাধব মিত্রের পরিবারবর্গ

কুমারটুলি বেণীমাধব মিত্রের পরিবারবর্গ

এই মিত্র পরিবারটির আদি বাস ছিল নদীয়া জেলার চাকদহ স্টেশনের নিকটবর্তী গোরেপাড়া গ্রামে। শতাধিক বছর পূর্বে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এঁরা কলকাতা চলে আসেন। বেণীমাধবের প্রপিতামহ নিধিরাম মিত্র কুমারটুলির বসু পরিবারে বিবাহ করার সুবাদে কুমারটুলিতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। তাঁর পুত্র দূর্গাচরণের দুই বিবাহ; প্রথমা স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় অল্প বয়সে মারা যান; দ্বিতীয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন দূর্গাচরণের চার পুত্র : দর্পনারায়ণ, রাজমোহন, ভৈরবচন্দ্র ও বৃন্দাবনচন্দ্র। এঁদের মধ্যে দর্পনারায়ণই অধিক পরিচিত। অল্প বয়সেই রাজনারায়ণের মৃত্যু হয়। মাত্র বারো বা তেরো বছর বয়সেই দর্পনারায়ণ মেসার্স ফেয়ারলি, ফার্গুসন অ্যান্ড কোম্পানিতে কেরাণীর চাকরি পান; (উল্লেখযোগ্য যে তখন এই কোম্পানিই ছিল সঙ্গতি ও খ্যাতির দিক থেকে একমাত্র মেসার্স জন পামার কোম্পানির পরবর্তী স্থানের অধিকারী)। দর্পনারায়ণ ছিলেন যেমন বুদ্ধিমান তেমনি চটপটে ও অন্যান্য বহু সদগুণের অধিকারী। শীঘ্রই তাঁকে ‘ক্যালকুলেটার ও অ্যাডজাস্টার’ পদে উন্নিত করা হয়। দর ও সুদের হার সম্পর্কিত প্রশ্ন শোনামাত্র তিনি উত্তর বলে দিতে পারতেন, তার জন্য তাঁর চিন্তা করারও প্রয়োজন হত না। চোখের নিমিষে তিনি বড় বড় যোগ কষে দিতেন। তাঁর এই নির্ভুল ও দ্রুত হিসাব করার ক্ষমতার জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত অনুগ্রহ লাভ করেন; সাহেবরা তাঁকে ‘ড্যাপ’ নামে ডাকতেন, হিসাব মেলাবার ব্যাপারে কোথাও কোন গোলযোগ হলেই ড্যাপের ডাক পড়ত, আর মুস্কিলেরও আসান হত। অফিসে যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি থাকায় তিনি তাঁর ভাইদের নিজের সহকারি করে ঐ অফিসে ঢুকিয়ে নেন। অর্থবান তিনি হতে পারেন নি; তবে সে সময় জিনিসপত্রের দাম কম থাকায়, তাঁর অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। ব্যক্তিগত স্বার্থ অপেক্ষা (হিন্দু) ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাববশত তিনি স্বীয় বাসগৃহকে ছয় বা তারও অধিকসংখ্যক ব্রাহ্মণের বাসস্থানে পরিণত করেছিলেন, তাঁদের ব্যয়ের একটা বড় অংশও তিনি দিতেন। তাঁদের স্বগ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম কামালপুর থেকে তর্কালঙ্কার ও ন্যায়রত্নগণ, বিশেষত বিখ্যাত পন্ডিত বলরামের বংশধরগণ, পূজা, বিবাহ, শ্রাদ্ধ উপলক্ষে তাঁদের প্রাপ্য দক্ষিণা ও পার্বণী আদায়ের জন্য কলকাতা এলে দর্পনারায়ণের বাড়িতেই তাঁরা আরামে থাকতে পারতেন। দর্পনারায়ণের ভাইয়েরা বিশেষত ছোট ভাই বৃন্দাবন, এ-বিষয়ে দাদার আদর্শ অনুসরণ করতেন।

দর্পনারায়ণ ও ভৈরবচন্দ্র নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। ফলে, বৃন্দাবনচন্দ্র হন এ বংশের প্রতিনিধি। তাঁর চার পুত্র মধুসূদন, নবীনচন্দ্র, বেণীমাধব ও নবকিশোরের মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ জন অল্প বয়সেই মারা যান। বাবু মধুসূদন তাঁর জ্যেঠামশায়ের অফিস মেসার্স ফেয়ার্লি, ফার্গুসন অ্যান্ড কোম্পানির অফিসে প্রথম চাকরিতে ঢোকেন; ঐ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেলে, পর পর কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর সামরিক বিভাগের ফিল্ড হাসপাতালে গোমস্তার চাকরি লাভ করেন। তখন দ্বিতীয় শিখযুদ্ধ চলছে। চিলিয়ানওয়ালা, গুজরাট প্রভৃতি বহু স্থানের রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁকে উপস্থিত থাকতে হয়েছে; এমন পরিস্থিতিতে বহু চাকুরেই দু হাতে টাকাপয়সা জমিয়ে ধনী হয়ে যায়; কিন্তু মধুসূদন হয় খুব সৎ ছিলেন, নয় ছিলেন অত্যন্ত ভীরু, যার জন্য তিনি তুলনামূলকভাবে অর্থহীন থেকে যান। যুদ্ধের পর তাঁকে ফিরোজপুরে সামরিক ডিপোতে বদলী করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁকে কাস্টমস হাউসে নিয়োগ করা হয়; সেখান থেকে অবসর নিয়ে এখন অবসর ভাতা পাচ্ছেন। পুরাণ, তন্ত্র ও সাহিত্যসমূহ তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন– এই সব হিন্দু শাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান গভীর ও ব্যাপক। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের তিনটি পুত্র আছে, এরা সকলেই অল্পবয়স্ক।

বাবু বেণীমাধবের জন্ম ১৮২২-এ। তাঁর বাল্যকাল আদৌ উল্লেখযোগ্য বা উজ্জ্বল ছিল না; ইংরেজির প্রাথমিক শিক্ষা তিনি লাভ করেন ডাঃ ডাফের স্কুলে। ১৮৪২-এ তিনি কাস্টম হাউসে একটি চাকরি পান; মিঃ জে জে হার্ভে তখন ঐ বিভাগের কালেক্টর। বেণীমাধবের পদের মাইনে বা মর্যাদা কোনটাই বেশি ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি নিজের কাজ খুব ভালভাবে করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। পদ উচ্চ না হোক, উচ্চতর আধিকারিকগণ তাঁর সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষযে ডেপুটি কালেক্টরগণ তো বটেই, কালেক্টরগণও তাঁর পরামর্শ চাইতে লজ্জাবোধ করতেন না। এই সব কারণে তাঁর ছোটখাট পদোন্নতি হয়। তাঁর দক্ষতা ও চাকুরিক্ষেত্রে তিনি কত প্রয়োজনীয় সেটা উপলব্ধি করে উচ্চতর আধিকারিকগণ স্বেচ্ছায় অযাচিতভাবে তাঁকে প্রশংসাপত্র দিতে থাকেন। অন্যান্যদের মধ্যে সর্বজনশ্রদ্ধেয় দক্ষতাসম্পন্ন কালেক্টর মিঃ ডব্‌ল্যু ব্রাকেন বিশিষ্ট পদ্ধতিতে বেণীমাধবের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও স্নেহ প্রকাশ করেন। ১৮৪৫ সালে অবসর গ্রহণকালে মিঃ ব্র্যাকেন অন্যান্য অফিসার বিশেষত তাঁর স্থলাভিষিক্তের কাছে বেণীমাধবকে ‘সবজান্তা’ অর্থাৎ কাস্টম বিষয়ক সব বিষয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী, বলে পরিচয় করিয়ে দেন। মিঃ ব্র্যাকেন ব্যবসায়ী ও অধীনস্থ কর্মচারীদের কাছে সমান প্রিয় ছিলেন। তাঁর অবসর গ্রহণকালে ব্যবসায়ীগণ তাঁকে একটি রৌপ্য আধার উপহার দেন, আর অধীনস্থ কর্মচারীবর্গ তাঁর একখানি তৈলচিত্র আঁকাবার জন্য ২,০০০ টাকা চাঁদা তোলেন– যাতে তাঁর সহৃদয় ব্যবহারের স্মৃতি জাগরূক থাকে। মিঃ ব্র্যাকেন জানান ‘বেণীর’ সাহায্য না পেলে তিনি অতখানি দক্ষতা সহকারে কাজ করতে বা জনপ্রিয় হতে পারতেন না, কাজেই, প্ৰতিকৃতিতে ‘বেণী’ও চিত্রিত হলে তিনি সব চেয়ে বেশি খুশি হবেন। প্রতিকৃতিখানি আঁকেন জার্মান শিল্পী ক্রমহোলস; প্রতিকৃতিতে আছে, উপবিষ্ট মিঃ ব্র্যাকেনের পাশে দপ্তরের পোশাকে সজ্জিত বেণীমাধব অফিসের কোন বিষয় ব্যাখ্যা করছেন। এই প্রতিকৃতিখানি এখনও কালেক্টরের ঘরে টাঙানো আছে। যে-কোন ব্যবসায়ী সে খ্রিস্টীয়ান, পার্শী, ইহুদি, পশ্চিমা, বোম্বাইওয়ালা বা বাঙালি যা-ই হন, কাস্টম হাউসে যাঁরই কোন কাজ থাকত, তিনিই বেণীমাধবকে ভালবাসতেন। উনচল্লিশ বছর তিনি চাকরি করছেন, এর মধ্যে তাঁর সততা বা কর্তব্যনিষ্ঠায় কোন কলঙ্কের ছাপ লাগে নি। গত পাঁচ বছর কাল তিনি ডেপুটি সুপারভাইজারের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

বেণীমাধবের বিবাহ হয় বাগবাজারের বনেদী সোম পরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তি কৃষ্ণচন্দ্র সোমের জ্যেষ্ঠা কন্যার সঙ্গে। বর্তমানে তাঁর এক পুত্র ও চার কন্যা। পুত্রের নাম বরদাচরণ মিত্র, তিনি বি-এ পাস। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যার বিবাহ হয়েছে স্মলকজ কোর্টের প্রাক্তন জজ হরচন্দ্র ঘোষের পুত্র প্রতাপচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে; তিনি কলকাতার রেজিস্ট্রার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *