1 of 2

নরেন্দ্রনাথ সেন

নরেন্দ্রনাথ সেন

চতুর্থ নরেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ১৮৪৩-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি। চার ভাই যখন জয়পুরের মহারাজার অধীনে চাকরি নিয়ে চলে গেলেন, তখন সম্ভবত বিধাতার ইচ্ছাতেই, চতুর্থজন পিতামহের জনহিতৈষণার বহুবিস্তৃত কর্মক্ষেত্র কলকাতায় থেকে গেলেন, হয়তো পিতামহের আরব্ধ কিন্তু অসম্পূর্ণ কার্য সম্পূর্ণ করবার জন্যই

সে সময়ের বড় ঘরের ছেলেদের শিক্ষার জন্য পাঠান হত হিন্দু কলেজে। নরেন্দ্রনাথকেও ঐ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছিল। বিশেষ মেধাবী ছাত্ররূপে পরিচিত নরেন্দ্রনাথ সহপাঠীহিসেবে পেয়েছিলেন (রাজা) শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো পরবর্তীকালের বিখ্যাত ব্যক্তিদের। কিন্তু স্বাস্থ্যহীনতার জন্য ষোল বছর বয়সেই তর বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। এদিকে ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থব্যয়ে পিতার কোনো কার্পণ্য ছিল না; তাই, নরেন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা সুস্থ হতেই তাঁর জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন সে সময়ের অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ ক্যাপটেন ফ্র্যাঙ্ক পামার; এঁকে কলকাতার মানুষ আজও স্মরণ করেন। অধ্যয়নশীলতাই ছিল নরেন্দ্রনাথের নেশা; পড়তে এত ভালবাসতেন যে, সেটা তাঁর একরকম পাগলামীতে পরিণত হয়েছিল। এতে আবার পিতার কাছে উৎসাহও পেতেন। এইরূপ বুদ্ধিমান অধ্যয়নপ্রিয় ছাত্র পেয়ে ক্যাপটেন পামারও তাঁকে শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। সুপন্ডিত এই শিক্ষকের সাংবাদিক হিসাবে সাফল্যের প্রভাব এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের সম্বন্ধে যে গল্প বলতেন, তার প্রভাবে, ঐ অল্প বয়সেই নরেন্দ্রনাথ সাংবাদিক হবার বাসনা পোষণ করতে থাকেন। কলেজ ছাড়ার পর বেশ কয়েক বছর তিনি ক্যাপটেন পামারের নির্দেশমত অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে থাকেন; এই হিসাবে তখনও তিনি ছাত্র; কিন্তু ঐ বয়স ও অবস্থাতেই তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক পত্রপত্রিকায় ছোট ছোট প্রবন্ধাদি পাঠিয়ে ভবিষ্যতে সীমাহীন আকাশে ওড়বার আগে যেন নিজের ডানার শক্তি পরীক্ষা করতে লাগলেন। এই সময় তিনি সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত অধ্যয়ন করতে থাকেন। অপ্রতিরোধ্য কোন শক্তি তাঁকে যে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে উৎসুক; তিনি যেন তারই জন্য তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার পূর্ণ করে চলেছিলেন। এদিক থেকে হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জীর মতো তিনি স্বয়ং-অধ্যয়ন দ্বারা শিক্ষিত হয়েছিলেন, কেন না হরিশচন্দ্রের মতই তিনি বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বিশেষ পান নি; সাংবাদিকতা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে অন্যান্যের ঊর্ধ্বে ওঠার এ ছাড়া, বোধ হয়, অন্য কোন পথ নেই। সাহিত্যক্ষেত্রে অগ্রগতির তীব্র আকাঙ্ক্ষা জ্ঞানার্জনে যে-কোনপ্রকার আলস্য তাঁকে যেন অস্থির ধৈর্যহারা করে ফেলেছিল। সেই বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্র থেকে যতখানি সম্ভব সময় ছিনিয়ে নিয়ে সাধারণ এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য অধ্যয়নে নিয়োগ করেছেন। ঊনিশ-কুড়ি বছর বয়সে কলকাতার তখনকার বিখ্যাত অ্যাটর্নি মিঃ উইলিয়াম অ্যাসলির অধীনে শিক্ষানবীশী শুরু করেন। মিঃ জেমস জিউম ও অন্যান্য কয়েকজন উচ্চপদস্থ ও মহাজ্ঞানী ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং বাবু কিশোরীচাঁদ মিত্র কর্তৃক সে সময় সম্পাদিত ইন্ডিয়ান ফিল্ড পত্রিকায় তাঁকে ঐ সময়ই (সম্পাদকীয় বিভাগের) নিয়মিত কর্মী করে নেওয়া হয়।

কিন্তু, ইন্ডিয়ান ফিল্ড পত্রিকায় ঐ সময় তিনি যেসব প্রবন্ধাদি লিখেছিলেন সেগুলিকে তাঁর সাংবাদিক হবার স্বপ্নের প্রথম প্রচেষ্টা বলে গণ্য করা যায়। কলকাতার বিখ্যাত আইনজীবী মিঃ মনোমোহন ঘোষ, বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থানুকূল্য ও বাবু কেশবচন্দ্র সেনের সর্বপ্রকার সহায়তা নিয়ে, ইন্ডিয়ান মিরর প্রতিষ্ঠা করলে, নরেন্দ্রনাথ যেন জীবনের অভীষ্টে পৌঁছে যান। সকলেই জানেন, ১৮৬১তে মিঃ মনোমোহন ঘোষের সম্পাদনায় ইন্ডিয়ান মিরর পাক্ষিক পত্রিকারূপে প্রকাশিত হয়েছিল। নরেন্দ্রনাথকে তিনি সাদর অভ্যর্থনায় ডেকে নিয়েছিলেন মূল্যবান সহায়করূপে। নরেন্দ্রনাথ পত্রিকাটিতে মূল্যবান প্রবন্ধাদি লিখতে থাকেন; মিরর প্রতিষ্ঠার কয়েকমাস পরেই মিঃ ঘোষ ইংল্যান্ড চলে গেলে, নরেন্দ্রনাথ পত্রিকাটির সম্পাদক হন; মিরর পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হলে এবং নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টের অ্যাটর্নিরূপে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তিনি পত্রিকার সম্পাদনাভার অনিচ্ছাসত্ত্বেও ত্যাগ করেন যাতে আরদ্ধ পেশায় প্রতিষ্ঠিত হবার ভিত্তি-স্থাপন করতে পারেন।

কেশবচন্দ্রও ইংল্যান্ডে কিছুকাল থেকে দেশে ফিরলেন এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে, ইন্ডিয়ান মিররকে দৈনিক পত্রিকায় পরিবর্তিত করে অধিকতর কার্যকর মাধ্যমে পরিণত করতে হবে। নরেন্দ্রনাথ ও ইন্ডিয়ান মিরর এতদিন যেন একই সত্তায় পরিণত হয়েছিল। দৈনিকে রূপান্তরে তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল। বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদারকে সম্পাদক করে নরেন্দ্রনাথ অ্যাটর্নির কাজে বেশি সময় দিতে থাকলেন। কিন্তু প্রতাপৰাৰু অল্পকালমাত্র এর সম্পাদক ছিলেন।

সংবাদপত্র পরিচালনা সাধারণত খুব সুখকর বা লাভদায়ক হয় না। এর সঙ্গে কত দুশ্চিন্তা ও অসুবিধা বিজড়িত থাকে। যাঁদের জন্য সাংবাদিক পরিশ্রম করেন, তাঁরাও তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকেন না–এই হল সাংবাদিকের কাজের প্রকৃতি। কাকেও ভয় না করে, কারও অনুগ্রহের প্রত্যাশী না হয়ে সত্য ও ন্যায়ের জন্য তাঁকে লিখতে হবে, কিন্তু খেয়াল রেখে প্রতিটি শব্দ ওজন করে লিখতে হবে যাতে একটি কথাতেও অতিশয়োক্তি বা অল্পোক্তি না হয়ে যায়; কোথাও সে রকম হলে সাংবাদিকের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। ইংরেজের স্বার্থে ইংরেজ পরিচালিত ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিককে যদি এই সব অসুবিধা ও বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে নেটিভদের স্বার্থে নেটিভ- পরিচালিত ইংরেজি ভাষায় পত্রিকার সাংবাদিকদের অনেক বেশি অসুবিধা ও বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। দেশীয়দের অন্য যে কোনো কর্মোদ্যোগের মতো দেশীয় ব্যক্তি কর্তৃক পরিচালিত সংবাদত্রকে এদেশীয়গণও সাধারণত হীন ও নিম্নস্তরের বস্তুরূপে গণ্য করেন, তাই কোন নেটিভ কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় পত্রিকা পরিচালনা করতে হলে অপরিমেয় বিপত্তির মধ্য দিয়ে চলতে হয়। এর আগে অপরাপর অর্থবান ও প্রতিভাধর ব্যক্তিরা একখানি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা পরিচালনর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ইন্ডিয়ান মিরর ছাড়া অন্য সবগুলিই ব্যর্থ হয়েছে। ইন্ডিয়ান মিরর-এর ভাগ্যে ঐ ব্যৰ্থতা না জুটে, জনমতের মুখপত্ররূপে বর্তমান উন্নতির শিখরে ওঠবার একমাত্র কারণ, এর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নরেন্দ্রনাথের অদম্য অধ্যবসায় ও সংকল্পের দৃঢ়তা। এটি সাপ্তাহিক থাকার সময় ছাড়া, এর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নরেন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে এর জন্য সম্পদাকীয় দায়িত্ব পালনের স্বার্থে নিজের সমগ্র সময় ও শ্রম দিয়ে এসেছেন। নেটিভগণও যে সফলভাবে ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা পরিচালনে সক্ষম, তাঁর এই আন্তরিক বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাঁকে অনেক বিঘ্ন অতিক্রম এবং বহু স্বার্থত্যাগ করতে হয়েছে। যে নির্ভীক উদ্যম নিয়ে তিনি এই পত্রিকাখানি পরিচালনা করেছেন, তার সঙ্গে তুলনীয় তাঁরই শ্রমশীলতা, কুশলতা ও কর্মদক্ষতা। তাঁর অ্যাটর্নি পেশাটি ছিল অত্যন্ত লাভদায়ক, সেখানেও কর্তব্যসাধনে তাঁর ত্রুটি ছিল না; তৎসত্ত্বেও ঐ পেশা থেকে বহু ঘণ্টা সময় বাঁচিয়ে, স্বাস্থ্য, আরাম ও বিরাম–সব কিছু উপেক্ষা করে তিনি সম্পাদকের কর্ম সম্পাদন করেছেন। তাঁর শ্রমশীলতা ছিল অপরাজেয়। ইন্ডিয়ান মিরর এতই সাফল্য লাভ করে যে, ১৮৭৮-এ এটিকে একপৃষ্ঠার দৈনিকে পরিণত করা হয়–এটিই হয় ভারতীয় পরিচালিত অনন্য সংবাদপত্র। পত্রিকাটি এতদিন যৌথ মালিকাধীন ছিল, ১৮৭৯ থেকে এটির একমাত্র স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক হলেন নরেন্দ্রনাথ সেন। এখন পর্যন্ত পত্রিকাটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কুড়ি বছরের। ইংরেজিতে ভারতীয় সাংবাদিকতায় তাঁর দান যে কত বড় তা সঠিকভাবে বর্ণনা করা অসম্ভব। তিনিই সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণ করেছেন যে ইংরেজ পরিচালিত ইংরেজি পত্রিকার মতো ভারতীয় পরিচালিত ইংরেজি পত্রিকা সমান জনপ্রিয় হতে পারে! তাঁর দান এর থেকেও বেশি। তিনি দেখিয়েছেন যে, যে কর্মশক্তি, অধ্যবসায় ও সংকল্পের দৃঢ়তাকে একমাত্র ইংরেজ জাতিরই বিশেষ গুণ বলে বিবেচনা করা হয়েছে, ঐসব গুণ একজন ভারতীয়ের মধ্যেও সমভাবে থাকতে পারে। নরেন্দ্রনাথ জীবন ও জীবনী থেকে এই শিক্ষাই আমরা লাভ করেছি; তিনি দেখিয়েছেন, কথা নয় কাজই মূল্যবান। ইন্ডিয়ান মিরর আরও প্রমাণ করেছে, যে সাহিত্য-প্রীতি আমরা রামকমল সেনের চরিত্রে লক্ষ্য করেছিলাম, সেই গুণ তাঁর বংশধরের মধ্যেও এখনও সমভাবে বর্তমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *