৯-১০. বন্দী রাজেনের মুক্তি

০৯. বন্দী রাজেনের মুক্তি

ঠিক পৌনে দুটোর সময় সিমি, রিমি আর জয় ছাতিম তলায় এসে পৌঁছলো, যেখান থেকে ফরহাদরা ধরা পড়েছিলো। জঙ্গল থেকে বেরোবার আগেই নিকিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে জয়। তার আগে ছোট একটা কাগজে লিখেছে–আব্দু, ফরহাদ ভাই আর সুমন ভাইকে শান্তিবাহিনীর ডাকাতরা ধরে নিয়ে গিয়ে প্রজেক্টের দক্ষিণে একটায় জায়গায় আটকে রেখেছে। আমরা জায়গাটা পাহারা দিচ্ছি। এদের এখানে লোক সংখ্যা পঞ্চাশ ষাটজন মতো হবে। অনেক বন্দুকও আছে। তুমি সবাইকে নিয়ে জলদি আসো। নিকি তোমাদের পথ দেখাবে। এখানে আসতে প্রায় দু ঘণ্টা লাগবে।

ব্যাগ থেকে স্কচ টেপ বের করে ভাঁজ করা চিরকুটটা নিকির গলার বেল্ট-এর সঙ্গে ভালোভাবে আটকে দিয়েছে রিমি। নিকির পিঠ চাপড়ে দিয়ে জয় বলেছে, ছুটে যা তীরের মতো। আব্বদের সঙ্গে করে নিয়ে আয়।

বিপদ বুঝতে পেরে নিকি তীরের বেগে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাড়ির দিকে ছুটেছে। রিমি হিসেব করেছে, নিকি যদি ঠিক মতো পৌঁছতে পারে সন্ধ্যে নাগাদ আতিক কাকুরা এসে পড়বেন। এর ভেতর ফরহাদ ভাইদের খবর জানতে হবে।

ছাতিম তলায় এসে দেখলো মাঠে লোকজন কেউ নেই। দূরে ব্যারাকের ছাউনিগুলোর উত্তরে বড় যে কাঠের ঘরটা তার চারপাশে পাহারা দিচ্ছে স্টেনগান হাতে চারজন কালো পোশাকপরা ষণ্ডামতো লোক। ওরা বুঝলো নেতারা সব ওই ঘরে আছে। ছাতিম গাছের সামনের কাঠের ঘরটাকে পরিত্যাক্ত মনে হলো। ঘরের সামনে কয়েকটা বড় গাছ আর একটা পাহাড়ী কলার ঝোঁপ রয়েছে।

রিমি ফিশ ফিশ করে বললো, আগে এ ঘরে দেখি কী আছে!

গাছের আড়াল থেকে আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে খুব সাবধানে ওরা ঘরটার কাছে এলো। কাঠের দেয়ালে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো, ঘরে কোনো শব্দ শোনা যায় কিনা। ওদের মাথার ওপর ছিলো ছোট কাঠের জানালা। বাইরে লোহার শিক বসানো, জানালার পাল্লা ভেতরের দিক থেকে লাগানো। চারপাশে আরেকবার তাকিয়ে দেখলো রিমি, কোথাও কেউ নেই। ফিশ ফিশ করে সিমি আর জযকে বললো, তোরা ঘরের দুই কোনা থেকে গার্ডদের ওপর নজর রাখ। কেউ এদিকে এলে আমাকে বলবি।

সিমি আর জয় কোনো শব্দ না করে দুদিকে সরে গেলো। হঠাৎ রিমির মনে হলো ঘরের ভেতর কে যেন কঁকিয়ে উঠেছে। খুব আবৃছা শুনলো যন্ত্রণাভরা গলায় আহ্ শব্দটা। চমকে উঠলো রিমি। ফরহাদ আর সুমনকে পরে এখানে এনে রাখেনি তো? আস্তে করে ও জানালার পাল্লায় ধাক্কা দিলো। কাঁ-এ্যা-চ শব্দ করে একটা পাল্লা খুলে গেলো। ধীরে ধীরে মাথা তুলে ঘরের ভেতর তাকালো। অবাক হয়ে দেখলো খাঁটিয়ার ওপর পিছমোড়া দিয়ে হাত বাঁধা একটা লোক শুয়ে আছে জানালার দিকে মুখ করে। কালো শুকনো মতো দেখতে, দুচোখে ভয়ের ছাপ। রিমিকে দেখে লোকটাও কম অবাক হলো না। ঘরের ভেতর ভালো করে তাকিয়ে দেখলো রিমি, এ লোকটা ছাড়া আর কেউ নেই। চাপা গলায় ডাকলো, ভয় পাবেন না, জানালার কাছে আসুন।

উঠে বসতে কষ্ট হলো লোকটার। তবু সে রিমির ডাকে সাড়া দিলো। কাছে আসতেই রিমি ফিশ ফিশ করে বললো, আপনি কি রাজেন সরকার?

রিমির কথা শুনে লোকটা এমনই অবাক হলো যে ওর চোয়াল ঝুলে গেলো। কোনো রকমে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললো, তুমি কে? আমার নাম কোথায় শুনেছো?

আমার নাম রিমি। রবার প্রজেক্টের আতিকুর রহমান আমার কাকা। ওখানে বেড়াতে এসে শুনি আপনি নিখোঁজ। ফরহাদ ভাইকে নিয়ে আমরা আপনাকে খুঁজতে এসেছি।

ফরহাদ ভাই কোথায়? চাপা উত্তেজিত গলায় চানতে চাইলে রাজেন।

তিনি আর সুমন ভাই এদের হাতে ধরা পড়েছেন। ওপাশের লম্বা ঘরটাতে ওঁদের বেঁধে রেখেছে।

তোমার সঙ্গে আর কে আছে?

জয় আর আমার বড় বোন সিমি। আপনি ধরা পড়লেন কিভাবে?

রাতে অফিসে কাজ করছিলাম। আমাদের গার্ড মতি ওদের পথ দেখিয়ে এনেছে। বাধা দেয়ার আগেই ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে নিয়ে এসেছে।

এরা কি শান্তিবাহিনীর লোক?

না। মাথা নাড়লো রাজেন–মনে হয় এরা জামাতে ইসলামী। বলছিলো বাংলাদেশকে নাকি আবার পাকিস্তান বানাবে। দেশে কোনো হিন্দু আর কমিউনিস্ট রাখবে না। তারা নাকি ইন্ডিয়ার দালাল!

আপনার ঘরে কোনো পাহারা নেই কেন?

ম্লান হেসে রাজেন বললো, ওরা জানে এ ভয়ানক জঙ্গলে কেউ আমকে উদ্ধার করতে আসবে না। আমার হাত বেঁধে রেখেছে। দরজা বাইরে থেকে আটকানো। সকালে একবার বাইরে যেতে দেয়, তাও বন্দুক হাতে পাহারা থাকে। তারপর দুপুরে আর রাতে খাবার দেয়ার জন্য দুজন লোক আসে।

তার মানে রাত পর্যন্ত এ ঘরে কেউ আসবে না?

এ কদিন তো আসেনি। আসার দরকারই বা কী? আমাকে যেভাবে বেঁধে রেখেছে পালাবার কোনো উপায় নেই।

রাত কটায় ওরা খাবার নিয়ে আসে?

আটটা থেকে নটার মধ্যে।

তাহলে আটটার ভেতর ফরহাদ ভাই আর সুমন ভাইকেও উদ্ধার করতে হবে। সকালে এত লোক দেখলাম, ওরা সব এখন কোথায়?

দুপুরে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নেয়। তারপর বিকেলে সবাই আবার বেরোয়। রীতিমতো মিলিটারি ট্রেনিং নেয়।

আপনি ঘুরে দাঁড়ান। আপনার হাতের বাঁধন খুলে দিই।

রিমির কথা মতো রাজেন ঘুরে দাঁড়ালো। দড়ি বাঁধা হাত দুটো যতোটা সম্ভব উঁচু করে ধরলো। ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে রিমি ওর হাতের বাঁধন কেটে দিলো। রাজেনের চোখ দুটো খুশিতে চকচক কলে উঠলো। বললো, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এভাবে মুক্তি পাবো।

দাঁড়ান, আমি আগে দরজাটা খুলি। এই বলে রিমি জয়ের বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে গিয়ে দরজার শেকল খুলে দিলো। রাজেন ঘর থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে কোনো শব্দ না করে শেকলটা আবার তুলে দিলো। তারপর ওকে নিয়ে ঘরের পেছনে এলো রিমি। সিমি আর জয়কে ডাকতে হলো না। জয় ছুটে এসে রাজেনকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি ভালো আছো তো রাজেন দা!

রাজেনের দুচোখ তখন খুশির কান্না। ফিশ ফিশ করে বললো, মনে হচ্ছে তোমরা স্বর্গের দেবদূত!

সিমির সঙ্গে রাজেনের পরিচয় করিয়ে দিয়ে রিমি বললো, এবার ফরহাদ ভাই আর সুমন ভাইকে উদ্ধার করতে হবে।

রাজেন বললো, খালি হাতে বড় ঘরগুলোর দিকে যাওয়া যাবে না। ওখানে পাহারা আছে।

আপনার ঘরে পাহারা নেই, ওখানে কেন থাকবে?

একটা ঘরে ওদের গোডাউন। আরেকটা ঘরে কারখানা। নিজেদের বন্দুক নাকি ওরা নিজেরা বানায়। মাঝখানের ঘরটা ওদের ল্যাবরেটরি।

ফরহাদ ভাইদের মাঝের ঘরে ঢোকাতে দেখেছি।

সিমি বলো, আতিক কাকুরা সন্ধ্যায় আসবেন লোকজন নিয়ে। তখন না হয় ফরহাদ ভাইদের উদ্ধার করা যাবে। আপাতত আমরা জঙ্গলে বসে এদের ওপর নজর রাখি।

রিমি বললো, তার আগে আমি শিওর হতে চাই–ফরহাদ ভাইরা আসলেই ওখানে আছেন কিনা।

খালি হাতে যাবি তুই?

খুঁজে দেখা যাক, লাঠি জাতীয় কিছু পাওয়া যায় কিনা।

রাজেন বললো, এঘরটাতে কয়েকটা বাঁশের লাঠি পড়ে আছে। তোমরা দাঁড়াও। আমি আসছি।

একটু পরে রাজেন চারটা বাঁশের লাঠি এনে সবার হাতে একটা করে ধরিয়ে দিলো। তারপর বললো, সবাই একসঙ্গে গেলে ওদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আমি আর রিমি যাবো। জয় আর সিমি এখানে থাকো।

জয় বললো, আমিও যাবো তোমাদের সঙ্গে।

না জয়। তোমার এখানে থাকার দরকার আছে। এখান থেকে অফিস ঘরের পাহারাদারদের ওপর নজর রাখা সহজ। এদিকে অনেক আড়ালে আছে। তোমাকে যে ঘুঘুর ডাক শিখিয়েছি–মনে আছে?

হাত দুটো গোল করে মুখের কাছে নিয়ে জয় অবিকল ঘুঘুর মতো ডাকলো। রাজেন বললো, ঠিক হয়েছে। যদি দেখ পাহারাদারদের কেউ বড় ঘরের দিকে যাচ্ছে, ঘুঘুর ডাক দেবে।

লাঠি হাতে রাজেন আর রিমি এগিয়ে গেলো বড় ঘরগুলোর দিকে। দুপুরের সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ওরা গাছের ছায়ায় ছায়ায় গুটি গুটি এগুতে লাগলো। মাঝে মাঝে একটা দুটো পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। প্রথম টিনের ঘরটা ওরা নিরাপদে পেরিয়ে গেলো। ওরা ছিলো ঘরের পেছন দিকে। সামনে গার্ড আছে কিনা বুঝতে পারছিলো না। হঠাৎ ঘুঘুর ডাক শুনে ওরা সঙ্গে সঙ্গে গাছের আড়ালে গিয়ে বসে পড়লো। ভয়ে রাজেনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। রিমি ইশারায় শুয়ে পড়তে বললো।

আবার ঘুঘু ডাকলো। এবার খুব কাছে। রিমি তাকিয়ে দেখলো সেগুন গাছটার ডালে এক জোড়া ঘুঘু বসে আছে। রাজেনকে ইশারায় দেখাতেই ওর মুখে হাসি ফুটলো। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও ঢুকলো বুকের ভেতর। এরপর কোনটা আসল আর কোনটা নকল ঘুঘুর ডাক বোঝার উপায় থাকলো না। সাবধান হওয়ার জন্য এবার হাতের কনুইতে ভর দিয়ে বুকে হেঁটে গুই সাপের মতো ওরা এগিয়ে চললো মাঝের ঘরের দিকে।

ঘরটার পেছন দিকে ওরা লক্ষ্য করলো মেঝের নিচে ঘরের ভিটার গায়ে মাটির সঙ্গে লাগানো তিনটা ভেন্টিলেটারের মতো। প্রথম ভেন্টিলেটারে চোখ লাগিয়ে রিমি দেখলো ভেতরে অনেকগুলো কাঠের বাক্স। কয়েকটা বাক্সের গায়ে ইংরেজিতে EXPLOSIVE লেখা। তার মানে বিস্ফোরক জাতীয় কিছু! আরেকটু এগিয়ে মাঝখানের ভেন্টিলেটারে উঁকি মেরে অবাক হয়ে গেলো রিমি। ভেতরে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো একটা ল্যাবরেটরি। দুজন লোক উল্টো দিকে মুখ করে টেবিলে ঝুঁকে কি যেন দেখছে। একজন বয়স্ক, টাকমাথা। তিনি যে প্রফেসর জাকারিয়া চিনতে রিমির অসুবিধে হলো না। অবাক হয়ে ভাবলো, জাকারিয়া তাহলে এদের লোক! শেষ পর্যন্ত ওর ধারণাই ঠিক হলো। প্রফেসরের সঙ্গী মাথা ঘুরিয়ে এদিকে তাকাতে যাবে-চট করে সরে গেলো রিমি। নিঃশব্দে ক্রলিং করে শেষের ভেন্টিলেটারের দিকে এগিয়ে গেলো। রাজেন ওকে অনুসরণ করলো নিঃশব্দে।

ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে মাথাটা সামান্য উঁচু করে নিচে তাকাতেই রিমির চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেলো। পিছমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় ঘরের মেঝের ওপর অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে সুমন আর ফরহাদ। সুমনের মাথাটা ফরহাদের কাঁধের ওপর রাখা, সম্ভবত ঘুমোচ্ছে। রিমি চাপা গলায় ডাকাতলা, ফরহাদ ভাই।

ফরহাদ চমকে উঠে ভেন্টিলেটারের দিকে তাকালো। রিমিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ চলে গেলো পশ্চিমের দেয়ালের ফুটোর দিকে। ফুটো দিয়ে ওপাশ থেকে কেউ যখন ওদের দেখে তখন সেখানে থাকে অন্ধকার। নইলে ফুটো দিয়ে ওপাশের ঘরের আলো দেখা যায়। পশ্চিমের দেয়ালে অন্ধকারের বদলে আলো দেখলো ফরহাদ। সুমনকেও ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে ওঠালো। ভেন্টিলেটারে রিমির পাশাপাশি ওরা রাজেনের উত্তেজিত চেহারা দেখতে পেলো।

ফরহাদ দাঁড়িয়ে ফিশ ফিশ করে বললো, জয় আর সিমি ঠিক আছে তো?

আছে। তোমাদের ছুরি আর লাঠি দিচ্ছি। তৈরি থাকো। রাতে যারা খাবার নিয়ে আসবে ওদের মাথায় বাড়ি মেরে বেরিয়ে পড়বে। আমরা জঙ্গলে আছি। আতিক কাকুদের খবর পাঠিয়েছি, সন্ধ্যে নাগাদ এসে যাবেন।

ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে ওটার ভাঁজ খুলে আলতোভাবে লাঠির এক মাথায় গাঁথলো রিমি। তারপর দুটো লাঠি দড়ি দিয়ে বেঁধে নিঃশব্দে মেঝের ওপর নামিয়ে দিলো। বললো, দড়িও কাজে লাগতে পারে।

ফরহাদ বললো, তোমরা জঙ্গলে ফিরে যাও। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে কারও চোখে পড়ে যাবে।

রিমি বললো, প্রফেসর জাকারিয়া তোমাদের ডান পাশের ঘরে আছে মনে হচ্ছে। ওদের দলে যোগ দিয়েছে।

ঠিক আছে রিমি, অনেক ধন্যবাদ। এখন তোমরা যাও।

পাশের ঘরে খট করে শব্দ হলো মুহূর্তের ভেতর ফরহাদ আর সুমন মেঝের ওপর পড়ে থাকা লাঠির ওপর শুয়ে পড়লো। রিমিরা ঝট করে মাথা সরিয়ে নিলো। তারপর যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবে ফিরে গেলো ছাতিম তলায়।

.

১০.শত্রুর মুখোমুখি

সেদিন দুপুরের আগেই রাঙ্গামাটির এসপি হায়দার আলী এসে হাজির হলেন হিরণছড়ির রবার প্রজেক্টে । সিমি রিমির আতিক কাকু তখন বাড়ির পাশের হিরণ হ্রদের তীরে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিলেন । গতবছর তেলাপিয়া মাছের পোনা ছেড়েছিলেন। সেগুলো এখন এক থেকে দেড় বিঘৎ বড় হয়েছে। ভেবেছিলেন ছেলে মেয়েরাও মাছ ধরতে মজা পাবে। না, সবকটা গেছে জঙ্গলে ঘুরতে।

হায়দার আলীকে হঠাৎ তাঁদের প্রজেক্টে দেখে অবাক হলেন আতিক কাকু। একজন গার্ডকে ডেকে মাছগুলো রান্নাঘরে পৌঁছে দিতে বলে তিনি এগিয়ে এসে

এসপিকে স্বাগত জানালেন–কী সৌভাগ্য আমার, আপনি নিজে থেকে এসেছেন। চলুন, ঘরে গিয়ে বসি।

আতিক কাকুর নতুন বাড়ি দেখে হায়দার আলী মুগ্ধ হয়ে গেছেন–এই বিরান জঙ্গলে চমৎকার বাড়ি বানিয়েছেন! কে থাকবে এখানে?

বারান্দায় পাতা বেতের চেয়ারে এসপিকে বসতে দিয়ে কাকু বললেন, আমি ঠিক করেছি বছরে তিন মাস সবাই মিলে এখানে এসে থাকবো। এমনিতে ফরহাদ তো সব সময় থাকছে। প্রজেক্টের কাজ বাড়লে এটা আর আগের মতো বিরান থাকবে না।

বারান্দায় হায়দার আলীর গলা শুনে চাচী বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে। অতিথিকে সালাম দিয়ে বললেন, ভেবেছিলাম ভাবীকে সুদ্ধো দু একদিনের ভেতর আপনাদের দাওয়াত করবো। একাই চলে এসেছেন?

হায়দার আলী মৃদু হাসলেন–এমন চমৎকার বাড়ি বানিয়েছেন নিশ্চয়ই আসবো আপনাদের ভাবীকে নিয়ে। আজ এসেছি একটু কাজে।

আতিক কাকু চাচীকে অনুরোধ করলেন–নাহার, আমাদের একটু কফি খাওয়াও না!

এক্ষুণি আনছি। বলে চাচী উঠে যেতেই আতিক কাকু এসপিকে জিজ্ঞেস করলেন–আমাদের রাজেনের কোনো খবর পেলেন?

চারিদিকে লোক লাগিয়েছি। আশা করছি শিগগিরই খবর পাবো। এই বলে হায়দার আলী একটু থেমে কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা আতিক সাহেব, আপনাদের প্রজেক্টের চারদিকেই তো গভর্মেন্টের খাস জমি, তাইনা?

দক্ষিণ দিকে শুনেছি আমাদের আগে এক ইঞ্জিনিয়ার তিরিশ একর লিজ নিয়েছে। আজ পর্যন্ত তার চেহারা দেখিনি, এমনি পড়ে আছে।

আপনাদের প্রজেক্টের আশেপাশে গত কয়েক দিনের ভেতর বাইরের কোনো লোকজন কি দেখা গেছে?

আমি তো এখানে এলাম মাত্র গতকাল। ফরহাদ হয়তো বলতে পারবে।

ওকে একটু ডাকুন।

সিমি রিমিদের নিয়ে ও গেছে প্রজেক্ট ঘুরে দেখতে। এসে পড়বে।

গার্ডদের কেউ বলতে পারবে না?

তা হয়তো পারবে। এই বলে তিনি প্রজেক্টের একজন কর্মচারীকে দেখে ডাকলেন, আবেদালি শোন, বাগান থেকে গার্ড বিমলেন্দুকে পাঠিয়ে দাও।

কিছুক্ষণ পর একমাথা ধবধবে চুলওয়ালা মঙ্গোলিয়ান চেহারার বুড়ো গার্ড বিমলেন্দু এসে সালাম দিয়ে দাঁড়ালো। বয়স ষাটের কাছে হলেও শরীর এখনও বেতের মতো টান টান।

আতিক কাকু ওকে জিজ্ঞেস করলেন, দুদিন মাসের ভেতর আমাদের এলাকায় বা আশে পাশে অচেনা কোনো লোক তোমার চোখে পড়েছে?

আধা চাকমা আধা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে বিমলেন্দু খীসা জানালো, মাস খানেক আগে রাজেন বাবুর কাছে দাঁড়িওয়ালা, লম্বা কোর্তা পরা একজন হুজুর এসেছিলো। নাকি কোন স্কুলের হেডমাস্টার তারপর এ লোককে আরও দুবার রাজেন বাবুর কাছে আসতে দেখেছে।

স্ট্রেঞ্জ! ছোট্ট মন্তব্য করলেন হায়দার আলী।

আতিক কাকু বিমলেন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন, ফরহাদ জানে এ দাড়িওয়ালার কথা?

বিমলেন্দু বললো-এ বিষয়ে ফরহাদকে সে কিছু বলে নি। রাজেন বাবু হয়তো বলতে পারেন, সেটা জানা নেই।

হায়দার আলী জানতে চাইলেন, দাড়িওয়ালা লোকটার সঙ্গে কখনও রাজেনের ঝগড়া হয়েছিলো?

মাথা নাড়লো বিমলেন্দু–ঝগড়া হতে সে কখনো দেখেনি। বরং রাজেন বাবু তাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে চা খাইয়েছেন। হেসে কথা বলেছেন।

ঠিক আছে তুমি যাও। বিমলেন্দুকে বিদায় করে হায়দার আলী বললেন, দাড়িওয়ালার কথা ফরহাদ জানে বলে মনে হয় না। জানলে পরশুই তো বলতে পারতো।

চাচী দুকাপ কফি এনে বেতের টেবিলে রেখে বললেন, শুধু কফি দিলাম। ছেলেমেয়েরা ফিরলেই খেতে দেবো।

হায়দার আলী একটু হেসে বললেন, খেতে বললে বিপদে পড়বেন। আমার সঙ্গে আরও চারজন কনস্টেবল আছে।

আতিক কাকু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ওরা?

বোটে বসে আছে। দুজনকে রেখে যাবো এখানে।

চাচী বললেন, ওদের জন্য কোনো অসুবিধে হবে না। আপনি আসার আগেই উনি চল্লিশটা বড় তেলাপিয়া ধরেছেন!

বলেন কী, চল্লিশটা? অবাক হলেন হায়দার আলী।

আতিক কাকু লাজুক হেসে বললেন, মাছ একে বারে গিজ গিজ করছে, বড়শিও লাগে না, হাত দিয়েই ধরা যায়?

এক সময় আমারও মাছ ধরার খুব সখ ছিলো।

এভাবে শুরু হলো মাছের গল্প। বড়শি দিয়ে যারা মাছ ধরে তাদের গল্প একবার শুরু হলে শেষ হতে চায় না। একটা ঘণ্টা যে কখন কেটে গেলো কেউ টের পেলেন না। মাঝখানে চাচী না এলে বোধহয় এ আলোচনা এক ঘণ্টা চলতো।

দুটোর দিকে উদ্বিগ্ন মুখে চাচী এসে বললেন, ছেলে মেয়েরা যে এখনো এলো না।

আতিক কাকু একটু হেসে বললেন, নতুন জায়গায় বেড়াতে বেরিয়েছে। নাওয়া খাওয়া সব ভুলে গেছে। কাউকে বল ডেকে আনতে।

দুটো বাজে, ওদের খেতে খেতে তিনটা বাজবে। তোমরা বরং খেয়ে নাও। আমি টেবিলে ভাত দিতে বলছি।

সেই ভালো! আতিক কাকু হায়দার আলীকে বললেন, খেয়ে উঠে না হয় গল্প করা যাবে। আপনাকে তো সাগরের হাঙ্গর ধরার গল্পটা বলিনি। সেভেন্টি এইটে কক্সবাজরে ……..।

এ পর্যন্ত শুনে চাচী ভেতরে চলে গেলেন। জেলেদের সঙ্গে সমুদ্রে গিয়ে আতিক কাকুর ক্ষুদে ক্ষুদে হাঙ্গরের বাচ্চা ধরার গল্প তিনি অনেক শুনেছেন।

খাবার টেবিলে রান্না অনেক পদই ছিলো। হায়দার আলী শুধু তেলাপিয়া ভাজি আর সরষে বাটা দিয়ে তেলাপিয়ার ঝোল দিয়ে ভাত খেলেন। বললেন, মুরগি তো সব সময় খাই। এত সুন্দর তেলাপিয়া কোথায় পাবো!

চাচী মৃদু হেসে বললেন, সামনের সপ্তায় ভাবী আর বাচ্চাদের নিয়ে সারা দিনের জন্য বেড়াতে আসুন। ক্ষেতের ফুলকপি আর ব্রকলি খাওয়াবো।

আতিক কাকু আর হায়দার আলী খেয়ে উঠে বারান্দায় বসেছেন। চাচী ওঁদের চা দিয়ে গেছেন। ঠিক তখনই হাঁপাতে হাঁপাতে নিকি এসে ঘেউ ঘেউ করে আতিক কাকুকে ডাকলো।

কী হয়েছে নিকি! জানতে চাইলেন তিনি, ওরা সব কোথায়?

নিকি কাছে এসে আতিক কাকুর পায়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তখনই ওর বলস-এর সঙ্গে টেপ দিয়ে লাগানো রিমির চিরকুটটা তার চোখে পড়লো। এটা আবার কী? বলে চিরকুট খুলে লেখাটা পড়লেন তিনি। উত্তেজনা আর ভয়ে তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। হায়দার আলী ব্যগ্র গলায় জানতে চাইলেন, ওটা কী আতিক সাহেব?

কোনো কথা না বলে তিনি চিরকুটটা বাড়িয়ে দিলেন রাঙ্গামাটির পুলিস সুপারের দিকে। দ্রুত ওটার ওপর চোখ বুলিয়ে হায়দার আলী বলেন, সর্বনাশ! আপনি এক্ষুণি আপনার গার্ডদের রেডি হতে বলুন। আমি আমার কনস্টেবলদের নিয়ে আসছি।

পুলিশের কনস্টেবলদের চাচী আগেই খাইয়ে দিয়েছেন। ওরা প্রজেক্টের অফিসের সামনে বসেছিলো। আতিক কাকু গার্ড আর অন্য সব স্টাফ ডেকে পাঠালেন। চাচী চিরকুট পড়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। হায়দার আলী বললেন, ভাবী, চিন্তা করবেন না। সুমন আর ফরহাদের কিছু করার সাহস ওদের হবে না।

প্রজেক্টের দশজন গার্ডের ভেতর নয় জন এলো। গার্ড মতিকে নাকি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাগানে কাজের লোক ছিলো পঁচিশ জন, অন্যান্য কর্মচারী ছয় জন। কর্মচারীদের বাড়িতে রেখে গার্ড আর মালিদের নিয়ে আতিক কাকু আর হায়দার আলী চললেন ফরহাদদের উদ্ধার করতে। গার্ডদের সবার হাতে বন্দুক। হায়দার আলীর কনস্টেবলদের সঙ্গেও বন্দুক রয়েছে। বাগানের চাকমা মালিরা লাঠি আর বল্লম নিয়েছে সঙ্গে। চল্লিশ জনের এ বাহিনীকে পথ দেখিয়ে সবার আগে আগে হাঁটছিলো নিকি। হায়দার আলী রওনা হওয়ার সময় সবাইকে বার বার বলে দিয়েছেন কোনোরকম শব্দ না করে হাঁটার জন্য।

রিমি লাঠি ছুরি রেখে যাওয়ার পরও ফরহাদরা হাতের বাঁধন খোলার কোনো চেষ্টা করেনি। সুমন বলেছিলো, আমি ওপাশের দেয়ালের দিকে দেখছি, কেউ এদিকে তাকায় কিনা, তুমি হাতের দড়ি কাটা শুরু করো। ফরহাদ বলেছে, এখন নয় । অন্ধকার হোক তারপর। এর ভেতর ওদের কেউ যদি এ ঘরে ঢুকে আমাদের হাত খোলা দেখে তাহলে সিমি রিমিরাও বিপদে পড়ে যাবে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত ফরহাদদের ঘরে অবশ্য কেউ এলো না। দড়ি আর ছুরিটা অতি কষ্টে খালি প্যাকিঙ বাক্সের তলায় লুকিয়ে রেখেছে। লাঠি দুটো সরিয়ে রেখেছে ঘরের এক কোণে, যাতে চট করে কারও চোখে না পড়ে। তারপর সন্ধ্যে পর্যন্ত মেঝের ওপর শুয়ে ঘুমিয়েছে। পাশের ঘর থেকে যে পাহারা দিচ্ছিল–ওদের ঘুমোতে দেখে সেও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

সন্ধ্যায় ফরহাদ আর সুমনের ঘুম ভাঙলো মাইকের শব্দে। হ্যান্ড মাইকের ঘড় ঘড় শব্দ সত্ত্বেও ওরা পরিষ্কার শুনতে পেলো হায়দার আলীর ভারি গলা-আমি রাঙ্গামাটির এসপি বলছি। আর্মি আর পুলিস পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছে। তোমরা সবাই হাত তুলে বেরিয়ে এসো।

কথাটা দুবার বলার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ধুপধাপ শব্দ হতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে ফরহাদ ছুরি বের করে প্রথমে সুমনের বাঁধন কাটলো ধারালো ছুরি কাটতে খুব বেশি সময় লাগলো না শুধু দুবার খোঁচা খেলো সুমন। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো, মুখে কিছু বললো না। নিজের বাঁধন খোলার পর ফরহাদের বাঁধন কাটলো সুমন। ঠিক তখনই ওদের দরজার কাছে মিহি গলার চিৎকার শোনা গেলো এ ঘরের শয়তান দুটোকে বের করে সামনে ঠেলে দে। গুলি যদি করে এগুলো আগে জাহান্নামে যাক। ওদের আগে গুলি করতে দিবি, তাহলে মালুম হবে গুলি কোত্থেকে আসছে। ফরহাদরা শুনেই বুঝলো এটা ছাগুলে দাড়ির গলা।

ধুপ ধাপ্ শব্দ করে ছাগুলে দাড়ি অন্যদিকে চলে গেলো। তারপরই ঘট ঘটাঙ শব্দ করে লোহার পাল্লাটা খুললো। এক হাতে বন্দুক, অন্য হাতে টর্চ নিয়ে কালো পোশাক পরা একটা লোক ভেতরে ঢুকলো। দরজার দুপাশে লাঠি হাতে ফরহাদ আর সুমন দাঁড়িয়ে ছিলো। কথা ছিলো প্রথমটাকে মারবে ফরহাদ আর দ্বিতীয়টাকে সুমন। ঘাড়ের ওপর লাঠির বেকায়দা বাড়ি খেয়ে লোকটা এতটুকু শব্দ না করে জ্ঞান হারিয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়লো। বাইরে প্যাসেজে ডায়নামো দিয়ে জ্বালানো বাল্বের সামান্য আলো থাকলেও ঘরের ভেতর ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। পড়ে থাকা লোকটাকে টেনে একপাশে সরিয়ে ফরহাদ দ্রুত হাতে ওর পোশাক খুলে নিজে পরে নিলো। তারপর দড়ি দিয়ে ওকে বাঁধলো। বন্দুকটা ফরহাদ নিজে নিয়ে টর্চটা সুমনকে দিলো। দ্বিতীয় কেউ আর এ ঘরে ঢোকেনি।

ঘর থেকে প্রথমে বেরোলো ফরহাদ, ওর পেছনে সুমন। হ্যান্ড মাইকে তখনও হায়দার আলীর গলা শোনা যাচ্ছে–আমি আর পাঁচ মিনিট সময় দেবো……

সেদিকে কান না দিয়ে ফরহাদরা প্রথমে এলো ল্যাবরেটরিতে। প্রফেসর জাকারিয়ার চেহারার বিবরণ রিমি ভালো মতোই দিয়েছিলো। গণ্ডগোলের ভেতর প্রফেসর হতভম্ব হয়ে একটা টুলে বসেছিলেন। ফরহাদ চাপা গলায় বলল চলুন, স্যার, জলদি আসুন । আমরা আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি।

প্রফেসর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন—না, তুমি এই শয়তানদের দলের লোক। শয়তানরা সব সময় কালো পোশাক পরে থাকে। তুমি আমাকে মেরে ফেলার জন্য নিতে চাও। আমি যাবো না।

সুমন ব্যস্ত হয়ে বললো, স্যার, আমি চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বাইরে শুনুন মাইকিং হচ্ছে। পুলিস আর আর্মি এসে গেছে। না গেলে এদের হাতে মারা পড়বেন।

প্রফেসর তবু ভয়ে ভয়ে বললেন, চলো।

ফরহাদ তাকে জিজ্ঞেস করলো, স্যার এখানে কোনো এক্সপ্লোসিভ জাতীয় কেমিক্যাল আছে?

আলমারির ওই বোতলে নাইট্রো গ্লিসারিন আছে। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন প্রফেসর।

ল্যাবরেটরির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ফরহাদ আলমারির ওপর থেকে একখানা খবরের কাগজ লম্বা করে পাকালো। বার্নার থেকে খানিকটা স্পিট ছিটিয়ে দিলো কাগজটার গায়ে। আপন মনে বললো, চমৎকার ফিউজের কাজ করবে।

ফিউজ দিয়ে কী হবে? জানতে চাইলো সুমন।

এক থেকে দেড় মিনিটের ভেতর এখানে একটা বিস্ফোরণ হবে। তার আগেই আমাদের ছাতিম তলায় পালাতে হবে। বলতে বলতে নাইট্রো গ্লিসারিনের বোতলের কর্ক খুলে সরু করে পাকানো কাগজের এক মাথা ওতে গুঁজে দিয়ে ওটাকে টেবিলের আড়ালে নিয়ে রাখলো। সুমনকে বললো, তোমরা এগোও, আমি আসছি।

সুমন প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলো, ওপরে ওঠার সিঁড়ি আছে এদিকে? আমাদের ঘরের সিঁড়ির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।

পাশের ঘরেরটা খোলা আছে। এসো আমার সঙ্গে।

কাগজের আরেক মাথায় লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো ফরহাদ। পাকানো কাগজ আস্তে আস্তে জ্বলতে লাগলো। সুমন আর প্রফেসরের সঙ্গে ফরহাদও ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এলো বন্দুক হাতে। পাশের ঘরে ঢোকার আগেই উল্টো দিক থেকে ছুটে আসা এক বন্দুকধারীর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার উপক্রম হলো সুমনের। লোকটা অবাক হয়ে আরে এ কী ….. বলে বন্দুক তুলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই ওর মাথায় লাঠির বাড়ি মারলো সুমন। আই বাপ বলে দু চোখে হাজারটা তারা দেখতে দেখতে দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়লো লোকটা।

লোকটার পেটে লাথি মেরে এক পাশে সরিয়ে দিলো ফরহাদ। তারপর পাশের ঘরে ঢুকে ওটার দরজা বন্ধ করে দিলো । দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই একসঙ্গে আট দশটা বন্দুকের শব্দ হলো। জঙ্গলের ভেতর থেকে আসছিলো গুলির শব্দ। কয়েক সেকেন্ড পর এদিক থেকেও কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ হলো। বাইরের দরজার সামনে যে পাহারাদার ছিলো দুদিক থেকে গুলির শব্দে ও হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো। সেই অবস্থায় পেছন থেকে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে ওর মাথায় বাড়ি মারলো ফরহাদ। তারপর প্রফেসরের হাত ধরে ছাতিম তলার দিকে সটান দৌড়ালো।

ওরা তিন জন ছাতিম গাছের আড়ালে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ হলো। চোখের সামনে ল্যাবরেটরির ঘরে আগুন জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে ।

ফরহাদরা জানতো না ল্যাবরেটরির পাশের ঘরটা যে শয়তানদের বিস্ফোরক রাখার গুদাম ছিলো। ল্যাবরেটরির আগুন কয়েক সেকেন্ডের ভেতর কাঠের দেয়াল থেকে ছড়িয়ে পড়লো পাশের ঘরে; যেখানে বাক্স ভর্তি গ্রেনেড, ডিনামাইট আর অন্য সব বিস্ফোরক ছিলো। এরপর শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য, যা শুধু টিভি আর সিনেমার পর্দায় দেখা যায়। একের পর এক ভয়ঙ্কর সব শব্দ হতে লাগলো। ঘরের মেঝে উড়ে গেলো, টিনের ছাদ উড়ে গেলো, আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁতে চাইলো।

ফরহাদরা অবশ্য এ দৃশ্য দেখার জন্য ছাতিমতলায় দাঁড়িয়ে ছিলো না। প্রথম বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ওরা জঙ্গলের দিকে দৌড়ালো। সিমি রিমিরা জঙ্গলে বসে ছাতিম তলার দিকে লক্ষ্য রেখেছিলো। দূর থেকে ফরহাদদের আসতে দেখে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য দুবার নিকি ঘেউ ঘেউ শব্দ করলো। তারপর ছুটে গেলো ওদের স্বাগত জানাবার জন্য।

তিন দিন পর হিরণছড়ির ছবির মতো বাড়িটা এক উৎসবের সাজে ঝলমল করে উঠলো। আতিক কাকুর যতো না উৎসাহ তার চেয়ে বেশি উৎসাহ এসপি হায়দার আলীর। টেলিফোন করে ঢাকা থেকে সিমি রিমির বাবা মাকে আনিয়েছেন। প্রফেসরকে উদ্ধারের পরদিন নিজের জিপে করে চট্টগ্রামে তাঁর বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন এক শর্তে দুদিন পর হিরণছড়ির পার্টিতে তিনি সপরিবারে যোগ দেবেন। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ছাড়া অবশ্য আর কেউ নেই। এক ছেলে আছে আমেরিকাতে, বিয়ে থা করে সেখানে থেকে গেছে।

বিকেলে প্রফেসর আসার সঙ্গে সঙ্গেই রিমি ওঁকে চেপে ধরলো স্যার, আপনি কী মনে করে শয়তানদের সঙ্গে হাত মেলালেন–এটা বলতেই হবে।

বাইরে চকচকে সবুজ ঘাসের লনে বেতের চেয়ারে বসে প্রফেসর রিমির কথা শুনে একগাল হাসলেন। বললেন, শোন মা জেবুন্নিসা, আমাকে ওরা ধরে এনেছিলো মেরে ফেলার জন্যেই। ট্রেনে আমার হাত দিয়ে ওদের ব্যাগটা পার করে নিয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে আবার বদলে নিতো। মাঝখানে সোনাগুলো হাতছাড়া হওয়ায় ওরা আমার ওপর ভীষণ রেগে গিয়েছিলো। যেই শুনেছে আমি বাংলাদেশে আপেল আর আঙুরের চাষের ওপর গবেষণা করছি ওরা বললো, আমাকে কাজে লাগাবে। ওরা চায় বাংলাদেশটা তাড়াতাড়ি মরুভূমি হয়ে গেলে নাকি ওদের ইসলামী হুকমতের সুবিধা হয়। ফারাক্কার কথা বললো, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আল্লার হুকুম হয়েছে বলেই না ইন্ডিয়া বাঁধ দিয়েছে। আরবের মতো বাংলাদেশও যখন পানির অভাবে মরুভূমি হয়ে যাবে তখন নাকি এদেশের মানুষের ঈমান শক্ত হবে। হিন্দুয়ানি খাসলত ভুলে ইসলামী তাহজিব বেশি করে মানবে। সবাই তখন রুটি খাবে, খেজুর খাবে। আরব থেকে খেজুরের বীজ আর উট আমদানি করা হবে।

প্রফেসরের কথা শুনে সিমির বাবা, আতিক কাকু সবাই হেসে খুন হলেন। সিমির মা বললেন, স্যার, সবই বুঝলাম। আমার মেয়েকে আপনি জেবুন্নিসা ডাকছেন কেন? ওর ডাক নাম রিমি, ভালো নাম ফারহানা।

রিমি হাসতে হাসতে বললেন, স্যারের খুব ভুলো মন। ট্রেনে আপুকে একবার আনোয়ারা, একবার সুলতানা–কত কী ডাকলেন।

প্রফেসরের গিন্নি বললেন, অন্যদের কথা বাদ দিন। পঁয়ত্রিশ বছর ঘর করছি, আমাকেই তো চিনতে পারেন না। গত সপ্তায় বিকেলে এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম। উনি দরজা খুলে আমাকে দেখে বললেন, তুমি কার কাছে এসেছো বাছা, আমার বেগম সাহেব তো বাড়িতে নেই।

আরেক দফা হাসির ঝড় উঠলো। সিমি, জয়, ফরহাদ, সুমন আর রাজেন বারান্দায় বসে কথা বলছিলো। মা হাসতে হাসতে রিমিকে বললেন, তুমি সিমিদের কাছে যাও। আমরা বড়রা এখানে অন্যরকম গল্প করবো।

রিমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে সিমিদের আসরে যোগ দিলো। ওর ইচ্ছা ছিলো এসপির সঙ্গে অপারেশনের বিষয়টা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করায় সিমিদের দলের সবাই অবশ্য রিমিকে স্বাগত জানালো। ফরহাদ বললো, এসো রিমি, তুমি যে আমাদের পাত্তাই দিচ্ছে না। সেদিন বুদ্ধি করে ল্যাবরেটরিটা না ওড়ালে আজ এতক্ষণে সবাই বসে বেহেশতের হাওয়া খেতাম।

রিমি বললো, সেটাও পেরেছিলে আমার জন্য। রাজেনদা সাক্ষী আছে।

ফরহাদ হাসতে হাসতে বললো, আমার ওপর রাজেন বাবুর এত রাগ এটা আগে জানা ছিলো না।

রাজেন লাজুক হেসে বললো, কারো ডায়রি পড়া কি ভালো ফরহাদ ভাই! কত সব গোপন কথা থাকে!

কারও ডায়রি পড়া নিশ্চয় ভালো নয়। তবে কথা হলো কী রাজেনবাবু, আপনার ওই নোট বইটা না পড়লে আপনাকে উদ্ধার করা যেতো না।

জয় বললো, আমরা এত বড় একটা ঘটনা ঘটালাম, অথচ খবরের কাগজে কিছুই বেরোয়নি!

ফরহাদ গম্ভীর হয়ে বললো, হায়দার সাহেব প্রেস রিলিজ দিতে চেয়েছিলেন, ওপর থেকে মানা করেছে!

সিমি অবাক হয়ে জানতে চাইলো, মানা করার কী আছে?

গভর্মেন্ট চায় না জামাতীরা যে এরকম একটা সিভিল ওয়ারের প্রিপারেশন নিচ্ছে। লোকে সেটা জানুক।

রিমি দেখলো আলোচনা রাজনীতির দিকে গড়াতে যাচ্ছে। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য ও বললো, রাজেনদার বিয়ের ব্যাপারে আতিক কাকু কী বলেছেন শুনেছো?

কী বলেছেন? ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলো সুমন।

পাত্রী তিনি ঠিক করে ফেলেছেন। এ মাসের শেষে শুভ দিন দেখে শুভ কাজ সেরে ফেলবেন।

ফরহাদ মুখ টিপে হেসে বললো, কি রাজেন বাবু, ইনক্রিমেন্টের জন্য চিঠি দেবেন না?

রাজেন হাসলো, জানি, চিঠি না দিলেও আপনি সেটা করবেন। বলে একটু থামলো রাজেন। কথাটা কী ভাবে বলবে ও ঠিক বুঝতে পারছিলো না, অথচ গত তিন দিন ধরে সারাক্ষণ চাইছিলো বলতে। শেষ পর্যন্ত রাজেন বলেই ফেললো, আমার মতো নগণ্য একটা মানুষকে সবাই এত ভালোবাসবে আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।

সিমি বললো, যে মানুষ নিজের দেশকে এতখানি ভালোবাসে সে নগণ্য মানুষ নয় রাজেনদা।

রাজেনের দুচোখ তখন কান্নায় ভরে গেছে।