৭-৮. পেজেক আর ত্রয়কার অভিযান

০৭. পেজেক আর ত্রয়কার অভিযান

অরবিস-এর অফিসে গাড়ি জমা দিয়ে নিজের পাওনা বুঝে নিয়ে পালকের মতো হালকা মনে ভাসতে ভাসতে বাড়ি এসে দরজায় কড়া নাড়লো পেজেক। পুরোনো আর নতুন শহরের সীমানায় পুরোনো ধরনের এক বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলার এক অ্যাপার্টমেন্টে বাবা মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে থাকে পেজেক। বাবা ছিলেন লবন খনির শ্রমিক, বছর তিনেক আগে কোমরে পাথর চাপা পড়ে পঙ্গু হয়ে হুইল চেয়ারের আশ্রয় নিয়েছেন। মা পৌরসভার অফিসে সামান্য বেতনের কেরানী। বছর দুয়েক ধরে জিনিসপত্রের দাম এত বেড়েছে যে বাবার পেনশন, মায়ের বেতন এক করলেও সংসারের খরচ কুলোয় না। তাই বাধ্য হয়ে পেজেক রাতের স্কুলে ভর্তি হয়ে দিনে গাড়ি চালানোর কাজ নিয়েছে।

কড়া নাড়ার ধরন দেখেই মা বুঝলেন পেজেক এসেছে। অফিস থেকে ফিরে মাত্র রান্না চড়িয়েছিলেন তিনি। অ্যাপ্রনে হাত মুছতে মুছতে এসে দরজা খুললেন।

কাগজের প্যাকেট থেকে রিনির দেয়া স্কার্ফটা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললে, তোমার পছন্দ হয়েছে মা?

কদিন আগে পেজেক ওঁকে ছেঁড়া শাল রিপু করতে দেখেছে। নতুন স্কার্ফ দেখে মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মৃদু হেসে বললেন, দারুণ সুন্দর দেখতে। নিশ্চয় অনেক দাম নিয়েছে?

দাম কম নয়। ভেতরে নিজের কামরায় যেতে যেতে পেজেক বললো, তবে জিনিসটা আমি কিনি নি। বাংলাদেশের এক ট্যুরিস্ট উপহার দিয়েছে।

অবাক করলি বাছা। পেজেকের মা সত্যি সত্যি অবাক হলেন–টুরিস্ট তোকে এত দামী স্কার্ফ উপহার দিলো কেন?

জানি না কেন দিয়েছে। বোধ হয় আমাকে ভালে লেগেছে। বলতে গিয়ে লজ্জায় লাল হলো পেজেক।

তোর বাপের বয়সী কোনো ট্যুরিস্ট বুঝি। বাড়িতে তোর মতো ছেলে আর বউ ফেলে এসেছে?

না মা, বয়স্ক কোনো লোক নয়। আমার কাছাকাছি বয়সের একটা মেয়ে। পরির মতো সুন্দর দেখতে।

বলিস কিরে। এতটুকু মেয়ে বাংলাদেশ থেকে আমাদের ক্র্যাকভ এসেছে বেড়াতে?

একা নয় মা, ওরা চার ভাই বোন মনে হলো। দুজন ওয়ারস থাকে, আর দুজন লন্ডন থেকে বেড়াতে এসেছে। বেশ বড়লোকের ছেলেমেয়ে মা। আমার ভাড়া হয়েছিলো এক লাখ পঁচাত্তর হাজার, অথচ দিয়েছে পুরো দুলাখ যুলটি। দুপুরে দামী রেস্তোরাঁয় খাইয়েছে। দারুণ ভালো ওরা।

কাল বিকেলে ওদের কফি খাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন কর না? আমি তাহলে সজির পিঠা বানাই

সত্যি বলছো মা। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি ওদের বলতে। আজ রাতেও ওরা আমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে।

তোর বাবার মোটা মাফলারটা নিয়ে যা। রাতে বাইরে ঘুরিস না।

ঠিক আছে মা। বলে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পেজেক দ্রুত পা চালালো-রিনিরা যেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। যেতে যেতে ঠিক করলো রিনিকে বলবে ওকে চিঠি লেখার জন্য ওর অনেক দিনের সখ ইউরোপটা ঘুরে দেখবে। লন্ডনে একটা বন্ধু থাকলে দারুণ হবে।

জায়গা মতো এসে রিনিদের দেখতে না পেয়ে খুবই অবাক হলো পেজেক। আশে পাশে ঘুরে দেখলো কোথাও ওদের কারো কোনো চিহ্ন নেই। একেবারে কোনো চিহ্ন নেই বললে ভুল হবে। শীলার চুইংগামের রঙিন কাগজের টুকরো দেখলো, ওরা যেখানে বসেছিলো সেই টেবিলের তলায়। সকাল থেকে পেজেক লক্ষ্য করেছে শীলা চুইংগাম খেতে খুবই পছন্দ করে। ওকেও কয়েকবার দিয়েছে যদিও ও ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলো। কি মনে করে ও চুইংগামের মোচড়ানো মোড়কটা তুলে নিয়ে খুলে দেখলো ওর জন্য কোনো কিছু ওতে লেখা আছে কি না।

পেজেক রীতিমতো হতাশ হলো। মনে হলো বেশি ঠাণ্ডা পড়ায় ওরা বোধহয় হোটেলে ফিরে গেছে। সকালে হোটেলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রিনি ওদের হোটেলটা ওকে দেখিয়েছে। কথাটা মনে হতেই আর দেরি করলো না পেজেক। একরকম ছুটে গেলো হোটেলে।

অরবিস হোটেলের ম্যানেজার পেজেককে খুব ভালো করেই চেনে। বললো, ওরা যে সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো ফেরে নি। কেন, তোমার ভাড়া মিটিয়ে দেয় নি?

ভাড়া মিটিয়েছে। ওরা আমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে।

তুমি ভাগ্যবান। লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে পারো। নিশ্চয়ই আসবে। আমি লক্ষ্য করেছি ভারতীয়রা দেরি করে ডিনার খায়।

ম্যানেজারের কথা মতো পেজেক লাউঞ্জে গিয়ে বসলো। টেলিভিশনে তখন দুর্ধর্ষ এক মারপিটের ছবি দেখাচ্ছে। অন্য সময় হলে পেজেক সব কিছু ভুলে ছবি দেখতে কিন্তু ওর মন খুব বিক্ষিপ্ত ছিলো। সারা দিনে ওদের যতটুকু জেনেছে, ডিনারের নেমন্তন্ন করে ভুলে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে রিনি কক্ষনো ভুলতে পারে । তবে কি ওরা ছবি চোরের কোনো সন্ধান পেয়েছে? ওরা তো দুর্গের কাছেই বসেছিলো? হতে পারে ছবি চোরকে দেখে ওরা ওকে অনুসরণ করে কোথাও গেছে। কিংবা পুলিস স্টেশনেও যেতে পারে চোরের খবর দেয়ার জন্য।

একের পর এক নানা ধরনের চিন্তা পেজেকের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। শেষে মনে হলো যেখানেই ওরা যাক, ওকে যখন আসতে বলেছে নিশ্চয় ওখানে আবার ফিরে আসবে। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেজেক উঠে দাঁড়ালো। রিসিপশনে গিয়ে ম্যানেজারকে বললো, আমি ঘুরে আসছি। ওরা এলে বলবেন, আমি আবার আসবো।

রাত তখন প্রায় আটটা। পুরোনো শহরের পথঘাট একরকম ফাঁকা হয়ে গেছে। দুদিন আগে পেজেক টেলিভিশনে দেখেছে ওয়ারস আর গোনস্কে বরফ পড়েছে। ক্র্যাকভে বরফ না পড়লেও হিমেল বাতাসে বরফের কামড় ঠিকই টের পাচ্ছিলো। শীতের আঁচড় থেকে বাঁচার জন্য, সেই সঙ্গে রিনিদের জন্য উৎকণ্ঠার কারণে পেজেক এক দৌড়ে এসে পৌঁছলো আগের সেই জায়গায়।

চত্বরে একটা লোকও নেই। অল্প দূরের কফি শপে কয়েকজন বুড়ো খদ্দের বসে আছে। পাশের বার–এ হৈ হল্লা হচ্ছে। এ ছাড়া আর কোথাও প্রাণের স্পন্দন নেই। দূরে দুৰ্গটা জোছনাভেজা আকাশের গায়ে রাজ্যের রহস্য গায়ে মেখে শুয়ে আছে। পাঁচটার পর দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে যায়। রাতে কেয়ারটেকারও দুর্গের ভেতরে থাকে না।

ক্র্যাকভের বাসিন্দারা জানে এ দুর্গকে ঘিরে অনেক কাহিনী আছে। জিপসিদের গানের কথায় সেকালের রাজাদের অনেক অত্যাচারের বিবরণ থাকে। একবার রাজার সঙ্গে নদীর ওপারের গ্রামের এক ছেলের কি এক গন্ডগোল হয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে রাজার লোকজন গোটা গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। তাদের আত্মারা নাকি এখনো দুর্গের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। পূর্ণিমার মেলায় জিপসিরা সেই সব আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে, ধবধবে সাদা ছাগল বলি দেয়।

চত্বরে দাঁড়িয়ে জিপসিদের মেলার কথা ভাবতে গিয়ে পেজেকের মনে হলো রিনিরা জিপসিদের আস্তানার দিকে যায় নি তো। বিশেষ করে রিনি তো যা কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখে সবই কিনে ফেলতে চায়। হতে পারে কিছু কেনার জন্য ওরা ওখানে গেছে। মেলা শুরু হওয়া পর্যন্ত ওরা যে ক্র্যাকভ থাকছে না, এ কথা ওদের কাছ থেকে সকালেই জেনেছে পেজেক।

প্রতি বছর ক্র্যাকভে এসে এক মাসেরও বেশি থাকে জিপসিরা। ওদের অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে পেজেকের। আস্তানায় গিয়ে ত্রয়কার খোঁজ করলো সে। ওরই বয়সী, জিপসি সর্দারের ছেলে। দারুণ বুদ্ধিমান, দুবছর আগে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। স্থানীয় লোকজন জিপসিদের খুব অপছন্দ করে জায়গা নোংরা করে বলে । জিপসিরাও তাদের দেখতে পারে না। তবে বন্ধুর জন্য ওরা জান দিতে পারে। ত্রয়কা সব সময় বলে, বিপদে সত্যিকারের বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। কখনো যদি কোনে বিপদে পড়িস, আমাকে খবর দিবি। দেখিস তোর জন্য কি করি।

ত্রয়কাকে ওদের তাঁবুতেই পাওয়া গেলো। পেজেককে দেখে ও হৈচৈ করে উঠলো–আজ বিকেলে এসেই তোর খোঁজ করেছিলাম। বললো, তুই নাকি কোন ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট নিয়ে বেরিয়েছিস সারা দিনের জন্য। কেমন আছিস বল ।

ত্রয়কার গলা শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ওর মা। পেজেকের থুতনি নেড়ে আদর করে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললেন, এক বছরে অনেক লম্বা হয়েছে। রাতে না খেয়ে যেও না।

পেজেককে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে গেলেন ত্রয়কার মা। ত্রয়কা বললো, তোর চেহারাটা এত শুকনো লাগছে কেন রে পেজেক। খিদে পেয়েছে?

না ত্রয়কা। মাথা নাড়লো পেজেক । তুই যে ট্যুরিস্টদের কথা বললি ওরা ইন্ডিয়ার বাংলাদেশের।

একই কথা। তোর মন খারাপ কেন সে কথা বল।

ত্রয়কা, আমার মনে হচ্ছে ওরা কোনো বিপদে পড়েছে। এই বলে পেজেক সারা দিনের ঘটনা খুলে বললো ত্রয়কাকে।

সব শুনে ত্রয়কা বললো, তোর তাহলে মনে হচ্ছে ছবি চোরটাকে ধরতে গিয়ে ওরা কোনো বিপদে পড়েছে?

আমার তাই ধারণা।

ওরা চারজন। আর ছবি চোর একা।

চোরটার পেছনে আরও কেউ থাকতে পারে। ওরা বার বার বলছিলো মাফিয়া বলছিলো।

মাফিয়ার কথা বলেছে?

তাই তো বললো। তুই চিনিস নাকি মাফিয়াকে?

ওরে বোকা ছেলে, মাফিয়ার নাম শুনিস নি? এমন ভাবে বলছিস, যেন মাফিয়া কোনো ছিঁচকে চোরের নাম।

মাফিয়া তাহলে কে?

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গুন্ডাদের দল। ওরা ইচ্ছে করলে আমাদের ওয়ালেসাকেও সাত দিনের ভেতর গদি থেকে হটিয়ে দিতে পারে।

ওরা থাকে কোথায়?

আসল ঘাঁটি ইটালীতে। তবে ইউরোপ আমেরিকায় এমন কোনো বড় শহর নেই যেখানে ওদের লোক পাওয়া যাবে না।

তাহলে তো রিনিদের ভয়ানক বিপদ হতে পারে?

যার পেছনে ওরা লেগেছে সে যদি সত্যি সত্যি মাফিয়াদের লোক হয় তাহলে খুবই ভয়ের কথা।

ত্রয়কার কথা শুনে পেযেকের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেলো। ভাঙা গলায় বললো, ত্রয়কা, ওরা খুব ভালো। আমাদের দেশের জিনিস কে নাকে চুরি করছে, এ নিয়ে ওদের চেয়ে বেশি মাথাব্যাথা হওয়ার কথা আমাদের। আমাদের জিনিস রক্ষা করতে গিয়ে ওরা বিপদে পড়েছে, আমি ভাবতেই পারি না।

তুই বলতে চাইছিস আমাদের কিছু করা উচিৎ?

নিশ্চয় ত্রয়কা। ওদের জন্য নয়, আমাদের লজ্জা থেকে বাঁচার জন্যই ওদের খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে ওদের যেন কোনো বিপদ না হয়।

তাহলে চল, আগে হান্না দিদিমার কাছে যাই।

হান্না দিদিমা কে?

ভবিষ্যৎ বলতে পারে। ক্রিস্টাল বল দেখে বলতে পারবে ওরা কোথায় আছে।

এক্ষুণি চল।

ত্রয়কাদের তাঁবু থেকে অল্প দূরেই হান্নাবুড়ির তাঁবু। ওরা যখন ওর তাঁবুতে ঢুকলো তখন বুড়ি শোয়ার আয়োজন করছিলো। ত্রয়কাকে দেখেই বললো, খুদে সর্দারকে খুব পেরেশান মনে হচ্ছে? সঙ্গে এটি কে, বন্ধু নাকি।

জানো যখন সব, জিজ্ঞেস করো কেন?

খিক খিক করে হেসে হান্না বুড়ি বললো, জিজ্ঞেস না করলে যে বোবা হয়ে থাকতে হয়। আর জানতে না চাইলে জানা যায় না–এ কথাটা জেনে রাখিস রে ভালো করে।

শোনো দিদিমা। আমার বন্ধু পেজেকের ভারি বিপদ। ওর বিপদ মানে আমাদেরও বিপদ। এই বলে ত্রয়কা রিনিদের নিখোঁজ হওয়ার কথা সব বললো। মাফিয়ার প্রসঙ্গও বাদ দিলো না।

ত্রয়কার কথা শুনে–হুম, বলে হান্নাবুড়ি কতক্ষণ চোখ বুজে চুপচাপ বসে রইলো। তারপর এক কোণে রাখা মস্ত বড় তোরঙ্গ থেকে কালো মখমলের পেটমোটা থলে বের করলো। তাঁবুর মাঝখানে রাখা ছিলো ছোট্ট উঁচু টেবিল। মখমলের থলে থেকে তার স্ফটিক গোলকটি বের করে টেবিলে রাখলো। টেবিলের তলায় মাটির পাত্রে কয়লার আগুন ছিলো তাঁবুর ভেতরটা গরম রাখার জন্য। লালচে গনগনে কয়লার ওপর ধুপের গুড়োর মতো কি যেন ছিটিয়ে দিলো। সুগন্ধী ধোঁয়ায় তাঁবুর ভেতরটা সাদা হয়ে গেলো। হান্না বুড়ি স্ফটিক গোলক সামনে রেখে কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো । তারপর হাত দুটো স্ফটিক গোলকের ওপর দিয়ে বুলানোর ভঙ্গি করলো।

ক্রয়কার কাছে এ দৃশ্য নতুন নয়। কিন্তু পেজেক আগে কখনো এসব দেখে নি। বুড়ির কান্ড কারখানা দেখে ওর চোখ দুটো আলু হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চোখ বুজে বিড় বিড় করে অদ্ভুত এক ভাষায় মন্ত্র পড়লো হান্নাবুড়ি। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো স্ফটিক গোলকের দিকে। মাথাটা সামান্য দোলালো ওপরে নিচে। নিচু গলায় বললো, তোমাদের অনুমান মিথ্যে নয়। ওদের মাথার ওপর বিপদের তলোয়ার ঝুলছে।

ওটাকে আগে সরাও দিদিমা। তারপর বলল ওরা এখন আছে কোথায়?

এই শহরে আছে। তবে বেশিক্ষণ নেই।

কোথায় আছে বলতে পারবে?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হান্নাবুড়ি বললো, ওরা গেছে উত্তরে। উত্তর থেকে পুবে। আবার উত্তরে। এর বেশি জানি না।

ঘর থেকে ততক্ষণে ধোয়ার সাদা মেঘ সরে গেছে। স্ফটিক গোলকটা হান্নাবুড়ি আবার মখমলের থলেতে ঢুকিয়ে তোরঙ্গে তুলে রাখলো।

পেজেক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখছিলো হান্নাবুড়িকে। যা বলেছে তা কি সত্যি? ত্রয়কা ওর হাত ধরে টানলো–চল বেরিয়ে পড়ি। দিদিমা এখন আর এর চেয়ে বেশি বলবে না।

হান্নাবুড়ির তাঁবু থেকে বেরোতেই ত্রয়কার বয়সী একটা ফাজিল টাইপের মেয়ে, কোথায় যেন যাচ্ছিলো, পেকেককে দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো–একে আবার কোত্থেকে জোটালি ত্রয়কা?

আমার বন্ধু পেজেক। ওর চারজন বাঙালী বন্ধু হারিয়ে গেছে। তাই হান্না দিদিমার কাছে এসেছিলাম।

ত্রয়কার কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো মেয়েটা–এক মিনিট দাঁড়া। চারজনের ভেতর দুটো ছেলে দুটো মেয়ে? একটা ছেলে দারুন হ্যান্ডসাম দেখতে?

মাথা নেড়ে সায় জানালো মেয়েটা। সন্ধ্যেবেলা দেখেছি। বুরঝিনিস্কি বুড়োর কফি শপের কাছে। হন্তদন্ত হয়ে জাদুঘরের দিকে যাচ্ছিলো।

সঙ্গে আর কেউ ছিলো?

না তো। হারিয়ে গেলে পুলিশে খবর দিচ্ছিস না কেন?

তোকে অনেক ধন্যবাদ এলিজা। এই বলে ত্রয়কা পেজেকের হাত ধরে ছুটলো জাদুঘরের দিকে।

ছুটতে ছুটতে পেজেক বললো, হান্না দিদিমা যে বললেন, ওরা উত্তরে গেছে।

আমরা তো যাচ্ছি দক্ষিণে।

এলিজা নিজের চোখে যখন দেখেছে, তখন ওটা আগে যাচাই করে দেখি।

বুরঝিনিস্কির দোকানে আসতে ওদের দশ মিনিট লাগলো। বুড়ো দোকানে শুধু কফি বেচে না, ফুলও বেচে। আশেপাশে যেসব দোকানপাট ছিলো সব বন্ধ। শুধুমাত্র বার আর কফিশপগুলো খোলা। বুরঝিনিস্কির দোকানের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বুড়োর তিনকুলে কেউ নেই, দোকানের ভেতরই থাকে। রাতে কারো ফুলের দরকার হলে দরজায় ধাক্কা দেয়। ওর দোকানে চব্বিশ ঘন্টা ফুল পাওয়া যায়।

পেজেক বললো, বুড়োকে জিজ্ঞেস করে দেখবো ওদের দেখেছে কি না।

দেখতে পারিস। সন্ধ্যের পর থেকে বুড়ো যেভাবে ভদকা টানে মনে তো হয় না কিছু বলতে পারবে।

পেজেক কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিলো শেষের বার বেশ জোরে। ভেতর থেকে কফ জড়ানা ঘড়ঘড়ে গলা শোনা গেলো–আস্তে বাপু আস্তে! এত তাড়া কিসের! বুরঝিনিস্কির ফুল পেলে কি মড়া জ্যান্ত হয়ে উঠবে, নাকি রাজকন্যা মিলবে। কথা বলতে বলতে এসে দরজা খুলে খদ্দের না দেখে হতাশ হলো বুড়ো—কেন ইয়ার্কি মারছিস বাছা! নেশাটা মাত্র জমে এসেছিলো, তুই খেলনাগাড়ির পেজেক না?

হ্যাঁ খুড়ো! আমার ভারি বিপদ। তুমি কি আজ সন্ধ্যায় চারজন বিদেশী ছেলেমেয়েকে এ পথ দিয়ে যেতে দেখেছো?

ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবলো বুড়ো বুরঝিনিস্কি। তারপর মাথা নেড়ে বললো, সন্ধ্যের কথা বলছিস? হা সন্ধ্যেই হবে। রাত হলে তো ঠাহর পেতাম না। দুটো ছেলে আর দুটো মেয়েকে দেখেছিলাম ওপাশের গলিতে ঢুকতে। বিপদ কেন রে পেজেক? তোর ভাড়া মেরে দিয়েছে, না অচল নোট দিয়েছে?

ওসব কিছু না খুড়ো, ওরা খুব ভালো। তুমি শুতে যাও। এই বলে বুরঝিনিস্কির সামনে থেকে তাড়াতাড়ি সরে এলো পেজেক আর ত্রয়কা। সবাই জানে বুড়ো যাকে একবার সামনে পাবে কম করে হলেও একটি ঘন্টা বকবক করবে।

সরে আসতে আসতে ওরা শুনলে বুড়ো বলছে–আজকাল কে ভালো আর কে মন্দ স্বয়ং ঈশ্বরও বলতে পারবেন না। আর তুই হলি সেদিনের পুঁচকে ছোঁড়া। বললেই হলো–

পেজেক আর ত্রয়কা ততক্ষণে উল পটেঝনা রাস্তার শেষ গলির মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে ওরা হতাশ হলো। গলিটা ছোট, একমাথা বন্ধ, তবু দুপাশে কম করে হলেও ষোল সতেরোটা বাড়ি। রিনিরা কোন বাড়িতে ঢুকেছে কে জানে। বুড়োর কথা শুনে মনে হচ্ছে ওরা নিজের ইচ্ছায় এসেছে। কেউ কি ওদের কোনো কিছুর লোভ দেখিয়ে এনেছে? নাকি সেই চোরটা এ সব বাড়ির কোনোটাতে থাকে? পাকা গোয়েন্দার মতো ভাবনাগুলো মাথার ভেতর সাজাতে লাগলো পেজেক। টেলিভিশনে গোয়েন্দা ছবি আর গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে পেজেক এই বয়সেই ঝানু হয়ে গেছে।

এক পা দুপা করে হাঁটতে হাঁটতে দুটো বাড়ি পেরিয়ে এলো। তৃতীয় বাড়ির সামনের রাস্তায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলো পেজেক। চাঁদের আলোয় রূপোলি রাংতা চিকচিক করছে। কাছে গিয়ে তুলে দেখলো, ঠিক যা ভেবেছিলো তাই। শীলার চুইংগামের মোড়ক। তার মানে ওর একটা অনুমান সঠিক হলো–ওরা এখানে নিজের ইচ্ছায় এসেছে।

কথাটা ত্রয়কাকে বলতে সেও সায় জানালো। প্রশ্ন করলো, এখন কি করবি? ভেতরে যাবি?

না। আমি দুটো দিক ভাবছি। যদি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসে থাকে তাহলে কাজ সেরে ওরা হোটেলে ফিরে যাবে। রাত এখন মাত্র সাড়ে নটা কাল সকালে খবর নেবো ওরা হোটেলে ফিরেছে কিনা। না ফিরলে পুলিস নিয়ে আসবো। এর যে কোনো একটা বাড়িতে ওদের পাওয়া যাবে।

পুলিসের কাছে এখন যেতে অসুবিধে কোথায়?

ওরা যদি বেড়াতে আসে এখানে? কেলেঙ্কারীর ব্যাপার হবে না? উল্টো পুলিসকে মিথ্যে খবর দেয়ার জন্য আমাদের কয়েদ করবে।

আপাতত তাহলে কিছু করার নেই? জানতে চাইলো ত্রয়কা।

একটা খোঁজ তো পেলাম। আপাতত এতেই চলবে। বাকিটা কাল সকালে। তুই আটটার মধ্যে চলে আসবি আমার বাসায়। জানিস তো মা তোকে কত পছন্দ করেন।

আমার চেয়ে বেশি করে নিককে। ওটাকেও আনবো।

ত্রয়কার পোষা বাঁদরের নাম নিক। শুধু পেজেকের মা কেন, ওদের বাড়ির সবাই পছন্দ করে ওটাকে। ভাবসাব দেখে মনে হয় অতিশয় বুদ্ধিমান এক বুড়ো মানুষ।

শেষ পর্যন্ত ওদের একটা হদিস পাওয়া গেলো। এতক্ষণে মুখে হাসি ফুটলো পেজেকের। ভারি দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আমার।

ত্রয়কা মুখ টিপে হেসে বললো, এই দুশ্চিন্তার কথাটা তোর সেই পরির মতো মেয়েটাকে বলিস।

পেজেক লাজুক হাসলো। পরির মতো মেয়েটা তখন যে কি এক ভয়ঙ্কর অবস্থায় আছে ওর কল্পনাতেও এলো না।

.

০৮. গন্তব্য–লেকার্তের রাজপ্রাসাদ

মাটির নিচের একটা ঘরে হাত পা বেঁধে রেখে দেয়ার পর রিনিদের হুশ ফিরে এলো যখন শীলা তীক্ষ্ণ গলায় বললো, আমি তোমাদের বার বার বলেছিলাম এসব বদমাশদের পেছনে লাগতে যেও না। এখন বোঝা অ্যাডভেঞ্চার করার মজা।

সবাই চুপচাপ শীলার কথা শুনলো। একটু পরে শীলা আবার বললো, বড়দের বাদ দিয়ে নিজেরা একা একা ঘুরে বেড়ানোর এমন একটা সুযোগ পেলাম, সব মাটি হয়ে গেলো। শোয়েব ভাইকে না আনলেই ভালো হতো।

রিনি আস্তে আস্তে বললো, শোয়েবকে কেন দোষ দিচ্ছো শীলা? ও না এলে। আমাদের এখানে বেড়াতে আসাই হতো না।

এখন ভালো করে বেড়াও। শোনোনি কি বললো ওরা? লেকার্ত না ফেকার্ত কোথায় নিয়ে যাবে। তারপর দেখো ঠিক ঠিক হাত পা নুলো করে জিব কেটে যোবা বানিয়ে রাস্তায় বসিয়ে দেবে ভিক্ষে করার জন্য।

ডিকেন্সের উপন্যাস পড়ে তোমার এরকম ধারণা হয়েছে। শান্ত গলায় বললো রিনি। এসব একশ বছর আগে হতো, এখন হয় না।

জনি অসহিষ্ণু গলায় বললো, তুই কিরে আপু! আমরা কি এখন ডিকেন্সের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করবো, না এখান থেকে বেরোবার পথ খুঁজবো!

বিপদে পড়লে রিনি সব সময় চেষ্টা করে মাথা ঠান্ডা রাখতে। গত বছর একদিন স্কুলের একটা ফাংশনের জন্য ফিরতে রাত হয়েছিলো। উডগ্রীন স্টেশনে ও ছাড়া আর কেউ নামে নি। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিলো বিচিত্র চেহারার এক পাঙ্ক। লম্বায় সাত ফুটের কাছে, দৈত্যের মতো শরীর। রিনিকে একা দেখে হাই হানি, বলে এগিয়ে এলো। পাঙ্কটা দু পা এগোতেই রিনি ছুটে গিয়ে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটার ফিতে শক্ত করে ধরে ওর মুখে আঘাত করলো। ঘটনাটা ঘটতে তিন সেকেন্ড ও লাগে নি। রিনির জিনসের ব্যাগে ছিলো হার্ড মেটালের টিফিন বক্স, শক্ত রেক্সিন আর চামড়ায় বাঁধানো লাইব্রেরি থেকে আনা গোটা চারেক বই, জ্যামিতি বাক্স–এই সব। এমনিতেই সের তিনেকের মতো ওজন আর ছুটে গিয়ে জোরে মারাতে পাঙ্কটার মনে হলো মুখের ওপর বুঝি পাঁচশ পাউন্ডের বোমা ফেটেছে। গড! বলে চিৎকার করে দুহাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়লো। জ্ঞান হারাবার আগে শুনলো, পুঁচকে মেয়েটা ওকে শান্ত গলায় বলছে, আশা করি এর পর থেকে একা কোনো মেয়ে দেখলে দ্র ব্যবহার করবে।

বিপদের সময় রিনিকে শান্ত থাকতে দেখে শোয়েবের খুব ভালো লাগলো। তারপরও ওর মনে হলো, বেড়াতে এসে এ ধরনের ঝামেলায় নাক না গলালেই ভালো ছিলো। রিনির উৎসাহ দেখে ও সবাইকে নিয়ে মাফিয়াটার পেছনে লাগতে গিয়েছিলো। ও অবাক হচ্ছিলো এত তাড়াতাড়ি শয়তানগুলো মারাওস্কিকে কোথায় গুম করে ফেললো! ওদের চারজনকে বেঁধে ফেলার পর সাদাচুলো ওর সঙ্গীকে বলেছিলো, আপাতত সেলার–এ নিয়ে ফেলে রাখো। আমাদের মাল যখন লেকার্ত যাবে তখন একটা ভ্যানে তুলে দিও। ওখানে গিয়ে এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবো।

সাদাচুলো কথা বলছিলো জার্মান ভাষায়। কথা বলার ভঙ্গী দেখেই বোঝা যায় ও খাঁটি জার্মান। পোলদের জার্মান উচ্চারণ শুনলে আলাদা ভাবে চেনা যায়।

লেকার্ত জায়গাটা শোয়েবের অচেনা নয়। যেশভ–এ ওর এক বন্ধু থাকে। এক সামারে ওর কাছে বেড়াতে গিয়ে লেকাৰ্ত–এর রাজপ্রাসাদ আর জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলো। যেশভ থেকে মাত্র বাইশ কিলোমিটার দুরে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে। ওদের লেকার্তে নিয়ে কি করা হবে এ নিয়ে ভাবছিলো শোয়েব। সেই সঙ্গে ভাবছিলো পালাতে হলে এখান থেকেই সুবিধে বেশি। একঘন্টা শোয়েব ভাবছিলো একটা কিছু করতে হবে। শীলার অভিযোগ শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা মিথ্যে নয়। শোয়েবের ভালো লাগলো রিনিকে ওর পক্ষ নিয়ে বলতে দেখে।

যে জায়গায় ওদের রাখা হয়েছে সেটা এক সময় ভাড়ার ঘর ছিলো। ছাদের সঙ্গে লাগানো ছোট স্কাইলাইটের জানালা ছাড়া একটা মাত্র দরজা সিঁড়ির মাথায়। ঘরটা মাটির বেশ নিচে। ঘরের দেয়ালের তাকে মদের বোতল সাজানো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক অদরকারি জিনিস। পেপারওয়েট, টেনিস র‍্যাকেট, মলাট ছেঁড়া কতগুলো বই, ভাঙা টেবিল ল্যাম্প কিছুই বাদ নেই।

শোয়েবকে চুপচাপ দেখে জনি আবার ঝাঝালো গলায় বললো, তুমি মুখে তালা দিয়ে বসে আছো কেন শোয়েব ভাই? কিছু বলছে না যে?

কি বলবো? কাষ্ঠ হেসে শোয়েব বললো, শীলা সত্যি কথাই বলেছে। আমারই জন্য তোমাদের এত ঝামেলা।

ঝামেলা নয় শোয়েব ভাই। বিপদ বলল। উই আর ইন গ্রেট ডেঞ্জার। রহস্য কাহিনী পড়ে আর থ্রিলার ছবি দেখে সামান্য বিপদকেও অনেক বাড়িয়ে দেখে জনি। যদিও ওদের বিপদ সামান্য ছিলো না।

ঠিক বলেছো জনি ভাইয়া। শীলা ওকে সমর্থন করে বললো, আমার মনে হয় ওদের কথা মতো আমরা যদি নুলো ফকির হতে রাজী না হই, তাহলে আজ রাতটাই হবে আমাদের শেষ রাত।

রিনি শান্ত গলায় বললো, ওরা এখনও আমাদের নুলো ফকির বানাবার কোনো প্রস্তাব দেয় নি। তুমি একটু বেশী কল্পনা প্রবণ শীলা।

দেয় নি ঠিকই, তার মানে এই না যে কখনও দেবে না। তোমার কি ধারণা লেকার্ত নিয়ে গিয়ে আমাদের অনারে ওরা পার্টি থ্রো করবে?

না, তাও করবে না। রিনি আগের মতো শান্ত গলায় বললো, ওরা আমাদের কথা বিশ্বাস করছে না। ভাবছে ওদের কোনো গোপন খবর আমরা জেনে ফেলেছি। যে জন্যে আমার মনে হয় ওদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দূরে কোথাও নিয়ে আমাদের আটকে রাখবে, তারপর কাজ হয়ে গেলে ছেড়ে দেবে।

কি করে তোমার ধারণা হলো ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে? বাঁকা গলায় প্রশ্ন করলো শীলা।

কারণ মাফিয়ারা অকারণে কাউকে খুন করে না। ওরা এমন সব খুন করে যার কথা ওরা স্বীকার করে। আমাদের খুন করে সে দায় ওরা নিতে পারবে না।

শোয়েব বললো, তোমার কথায় যুক্তি আছে রিনি। কিন্তু লেকার্ত জায়গাটা সুবিধের নয়। ওখান থেকে শুরু হয়েছে দুর্গম কার্পেথিয়ান রেঞ্জ। তিন দেশের সীমান্তের কাছে ওখানকার গভীর বন হচ্ছে ক্রিমিনালদের স্বর্গ। আমাদের মেরে ফেললে কেউ টেরও পাবে না।

আমরা কি মেরে না ফেলা পর্যন্ত এভাবে গল্পগুজব করে কাটাবো? জানতে চাইলো জনি।

আমরা পালাবো এখান থেকে। কোর্টে রায় দেয়ার মতো ঘোষণা করলো শোয়েব।

কিভাবে? শোয়েবের কথায় সবাই উত্তেজিত হলো। কারণ ওদের দুহাত পিছমোড়া করে বাঁধা। পা দুটো একসঙ্গে বাঁধা। এ বাঁধন ছিঁড়ে বেরোনো কল্পনার বাইরে। সিঁড়ির দরজাও বাইরে থেকে তালা দেয়া।

আমি কয়েকটা পথ ভেবে রেখেছি। একটা না হলে আরেকটা চেষ্টা করবো। প্রথমে আমাদের বাঁধনগুলো খুলতে হবে। তারপর তোমরা তিনজন যেভাবে বসে আছো সেভাবেই থাকবে। আমি সিলিংএর ওপরে উঠে যাবো। বোধহয় লক্ষ্য করো নি, যে দরজা দিয়ে আমাদের ঢোকানো হয়েছে তার ঠিক ওপরে সিলিং শেষ হয়েছে। সিলিং এর ওপর কাঠের যে পিপেগুলো রয়েছে আমার ধারণা ওর একটাও খালি নয়। দরজা দিয়ে যে ঢুকবে একটা করে ভারি পিপে ওর মাথায় পড়বে। যেই ঢুকুক তার সঙ্গে নিশ্চয় পিস্তল থাকবে। আমাদের কাজ হবে পিস্তলটা নিয়েই স্কাই লাইটের জানালায় গুলি করা। তাতে জানালার কাঁচও ভাঙবে, গুলির শব্দে বাইরে লোকজনের সঙ্গে পুলিসও এসে হাজির হবে। ক্র্যাকভ হচ্ছে মিউজিয়াম সিটি। এখানে গুলি দূরে থাক সামান্য পটকার আওয়াজও কেউ করতে পারে না। পিস্তল না পাওয়া গেলে জানালার কাঁচ ভাঙার অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার প্ল্যানের একটাই খারাপ দিক হচ্ছে গুলির শব্দে ক্রিমিনালরাও অ্যালার্ট হয়ে যাবে। পুলিস আসার আগেই ওরা পালাবে। ওদের আর ধরতে পারবো না।

শোয়েবের কথা শুনে সবাই চমৎকৃত হলো। যে শীলা এতক্ষণ ওর ওপর চোটপাট করছিলো মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো শোয়েবের বুদ্ধির কাছে ওরা কেউ কিছু নয়। বললো, ক্রিমিনালদের ধরতে না পারার দুঃখ নিয়ে সারা জীবন ভাববো। এখন হাত পাগুলো খুলবো কি করে তাই বলো।

নিজেরটা নিজে খুলতে না পারলেও অন্যেরটা তো পারবো। কেউ প্রথমে গড়িয়ে গড়িয়ে আমার হাতের কাছে এসো। নিজেদের পা আর হাতের গিটগুলো হাতে ধরিয়ে দাও। একটু সময় লাগলেও মনে হচ্ছে খুলতে পারবো। তাড়াহুড়ো করে বাঁধতে গিয়ে ওরা আমার হাত বেঁধেছে দুই তালুর সঙ্গে লাগিয়ে।

রিনি ছিলো শোয়েবের কাছে। সবচেয়ে দূরে ছিলো জনি। ও বললো, আপু, তুই আগে যা। আমার মনে হচ্ছে এখান থেকে গড়াতে গেলে হাতের গোড়া আলগা হয়ে যাবে।

রিনি পিছমোড়া করে বাঁধা হাতে মাটিতে ভর দিয়ে নিজেকে অতি কষ্টে শোয়েবের কাছে আনলো। দুজন দুদিকে মুখ করে বসে, কেউ কারো হাত দেখতে পাচ্ছিলো না। শোয়েবকে দুবার বলতে হলো, আরো কাছে এসো রিনি, নাগাল পাচ্ছি না।

শেষবার হাতে ভর দিয়ে কাছে আসতে গিয়ে রিনি ধাক্কা খেলো শোয়েবের পিঠের সঙ্গে। প্রথমে ওর কড়ে আঙ্গুলের সঙ্গে শোয়েবের হাতের ছোঁয়া লাগলো। কব্জির বাঁধন শোয়েবের আঙ্গুলের কাছে নিতে গিয়ে হাতের গোড়ায় প্রচণ্ড ব্যথা পেলো। রিনির চোখে কান্না এসে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে চুপ করে রইলো সে।

শোয়েব রিনির বাঁধনের গিটটা ভালোভাবে অনুভব করলো। তারপর আস্তে আস্তে সমস্ত মনোযোগ নিজের আঙুলের ডগায় এনে দশ মিনিটের কঠিন পরিশ্রমের পর গিটটা খুললো।

গিট খোলার সঙ্গে সঙ্গে রিনি খুশির চোটে আরেকটু হলেই শোয়েবকে জড়িয়ে ধরতো। দেরি না করে ও আগে ঘুরে বসে শোয়েবের বাঁধন খুললো তারপর ওরা দুজন নিজেদের পায়ের বাঁধন খুলে শীলা আর জনির বাঁধন খুলে দিলো। শীলা আনন্দে উত্তেজিত হয়ে জনির দু গালে চুমু খেলো। জনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, এসব পরে হলেও চলবে। ওরা যে কোনো সময়ে চলে আসতে পারে।

আসতে পারে নয়, এসে গেছে।

ঘরের ভেতর যেন হাজার পাউন্ডের বোমা ফাটলো। খসখসে গলাটা ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো দৈত্যের মতো দুটো নোক ওদের দিকে পিস্তল উচিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। খসখসে গলা আবার বললো, আরেকটু আগেই আসতে পারতাম। একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিলো, তাই দেরি হলো। বাছারা বোধহয় জানেন না এ বাড়ির সবগুলো ঘরে ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরা বসানো আছে। ফন্দি ফিকির কিছু গোপন করার উপায় নেই।

ওদের পেছনে যে আরেকটা ঘর ছিলো আর সেখান থেকে যে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে, ওরা বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পারে নি। চট করে শোয়েবের কথা মনে হলো জনির। ও ছিলো রিনির আড়ালে। চোখের পলকে ও বাঁ পাশে ঝুঁকে একটা ভাঙা পেপার ওয়েট তুলে প্রচন্ড জোরে ছুঁড়ে মারলো স্কাইলাইটের জানালায়। ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দ হতেই জনি চিৎকার করে বাংলায় বললো, সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালাও। এই বলে নিজে ছুটে গেলো সিঁড়ির দিকে। তখনই গুলির শব্দ হলো।

গুলির শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা কর্কশ গলা চিৎকার করে বললো, খবরদার কেউ গুলি ছুড়বে না। ক্ষুদে শয়তানগুলোকে জ্যান্ত ধরতে হবে।

রিনি চিৎকার করে বললো, বাঁচাও, কে কোথায় আছো।

সঙ্গে সঙ্গে শোয়েব, শীলা আর জনিও চিৎকার করে উঠলো–বাঁচাও বলে। শোয়েব আর শীলা চিৎকার করছিলো পোলিশ ভাষায়, রিনি জনি ইংরেজিতে। চিৎকার আর গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আরও চারজন বিশাল দেহী দৈত্য ঘরে ঢুকলো। এরপর রিনিদের ধরতে ওদের বেশি বেগ পেতে হলো না। ধরার সঙ্গে সঙ্গে মুখ চেপে কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধলো। হাতগুলো বাঁধলো আগের চেয়ে শক্ত করে। পা বাঁধলো না। খসখসে গলা বললো, লেকার্তো নিয়ে কুচি কুচি করে কেটে নেকড়েদের খাওয়াবো। দেখবো তখন কে বাঁচাতে আসে।

ওদের মুখ আর হাত এত শক্ত করে বাঁধা হয়েছিলো যে ব্যথায় কান্না এসে গেলো। কিছু বলার উপায় নেই। করারও জো নেই, ওদের গলায় ধাক্কা দিয়ে সেলার থেকে বের করে নিয়ে গেলো দৈত্যের মতো লোকগুলো। বাইরের দরজার সঙ্গে লাগানো ছিলো বড় ভ্যানের দরজা। ধাক্কা মেরে ওদের ছুঁড়ে দিলো ভেতরে নিরেট অন্ধকারে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো বাইশ টনী বিশাল ভ্যানের ইঞ্জিন।

পরদিন সকালে বাদর কাঁধে ত্রয়কাকে নিয়ে পেজেক যখন অরবিস হোটেলে রিনিদের পেলো না, তখন রীতিমতো ঘাবড়ে গেলো। ম্যানেজার বললো, আমি পুলিশে খবর দিয়েছি। ওয়ারসতে ওদের ঠিকানায় খবর পাঠানো হয়েছে। বুঝতে পারছি না, কোথায় উধাও হয়ে গেরো জলজ্যান্ত চারটা হাসিখুশি ছেলে মেয়ে!

আমার ধারণা ওদের কেউ কিডন্যাপ করেছে। চিন্তিত গলায় বললো পেজেক। আমাদের ক্র্যাকভে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি।

ত্রয়কাকে নিয়ে পেজেক প্রথমে এলো পুলিস স্টেশনে। তদন্তকারী অফিসারকে বললো শেষবার রিনিদের কোথায় দেখা গেছে। সেই সঙ্গে ছবি চুরির ব্যাপারে ওদের সন্দেহের কথাও বললো। অফিসার সব কথা শুনে হেসে ফেললো ভয়ঙ্কর রোমহর্ষক সব হলিউডি ছবি দেখে বিদেশী ছেলেমেয়েগুলো একেবারে বখে গেছে। সব কিছুতে রহস্য আর রোমাঞ্চ খুঁজতে চায়। মাফিয়াদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই আমাদের ওয়াভেল দুর্গে আসবে ছবি চুরি করতে। আমাকে যা বলেছিস, বাইরে আর এসব আজগুবি গপ্পো কাউকে বলতে যাস নি ছোঁড়া!

ওদের শেষবার যে বাড়িতে দেখা গেছে সেখানে একবার যেতে কি আপনাদের অসুবিধে আছে?

পেজেকের শান্ত অথচ শক্ত কথায় অফিসার একটু অস্বস্তি বোধ করলো। ধমকের সুরে বললে, ঠিক আছে যাচ্ছি। না পেলে পুলিসকে হয়রানি করার মজা টের পাওয়াবো।

সঙ্গে গোটা চারেক কনস্টবল আর পেজেকদের নিয়ে অফিসার এলো উল পটেঝনার শেষ গলিতে। যে বাড়ির সামনে পেজেক শীলার চুইংগামের মোড়ক পড়ে থাকতে দেখেছিলো সে বাড়ির দরজায় মস্ত এক তালা ঝোলানো। আশে পাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করা হলো কাল সন্ধ্যায় কেউ চারটা বিদেশী ছেলেমেয়েকে এ পাড়ায় কিংবা এ বাড়িতে দেখেছে কিনা। কেউ কোনো হদিস দিতে পারলো না। পাশের বাড়ির এক চিমসে বুড়ো বললো, গত ছমাস ধরে এ বাড়িতে তালা ঝুলতে দেখছি। বিদেশী ছেলেমেয়ে কোত্থেকে আসবে!

পেজেককে কড়া ধমক লাগিয়ে অফিসার তার দলবল নিয়ে চলে গেলো। বন্ধুর বিমর্ষ চেহারা দেখে ত্রয়কা সহানুভূতির গলায় বললো, এখন কি করবি পেজেক?

আমার খুব খারাপ লাগছে ত্রয়কা। পেজেক বিষণ্ণ গলায় বললো, মনে হচ্ছে ওরা কঠিন কোনো বিপদে পড়েছে। আমার উচিৎ ওদের সাহায্য করা, অথচ কি যে করবো ভেবে পাচ্ছি না!

পুলিস তো ওদের ঠিকানায় খবর পাঠিয়েছে। কেউ মুক্তিপণের জন্যেও ওদের আকটাতে পারে। আমার মনে হয় শত্রুপক্ষের কাছ থেকে চিঠি আসা পর্যন্ত আমাদের চুপচাপ থাকা উচিৎ।

হাঁটতে হাঁটতে বুরঝিনিস্কির কফি শপের সামনে আসতেই ওরা বুড়োর নজরে পড়ে গেলো। পেজেকের চেহারা দেখে বুড়ো জিজ্ঞেস করলো, মড়ার মতো মুখ বানিয়ে। ঘুরছিস কেন রে ছোঁড়া? বাড়িতে কিছু হয়েছে?

পেজেক ম্লান মুখে বললো, কাল রাতে তোমাকে বলেছিলাম না–চারজন বিদেশী ছেলেমেয়ে হারিয়ে গেছে।

হ্যাঁ, বলেছিলি বটে। ওরা কি তোর বন্ধু ছিলো?

খুব ভালো বন্ধু ছিল।

আহা রে! বলে বুরঝিনিস্কি কি যেন ভাবলো। তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়লো ওর। উত্তেজিত গলায় বললো, কাল রাতে গলির ভেতর কিছু ঘটেছে মনে হয়।

কি ঘটেছে? চমকে উঠে জানতে চাইলো পেজেক।

মাঝ রাতে আমাকে প্রকৃতি ডেকেছিলো। উঠে চোখে মুখে একটু পানি ছিটিয়ে প্রকৃতির কাজ শেষ করে আবার শুতে যাবো, এমন সময় কে যেন দরজা ধাক্কালো। গিয়ে দরজা খুলোম। দেখি ট্রাক ড্রাইভার টাডেউজ আর যাচেক। বললে, খুড়ো, শীতে হাড় মাস সব জমে বরফ হয়ে গেলো। একটু কফি যদি বানাতে পারো ডবল দাম দেবো। আমি ওদের ভেতরে এনে বসালাম। কফির সঙ্গে দুটো বিস্কুটও দিলাম। বললাম, এই শীতের ভেতর মাঝরাতে কোথায় যাচ্ছো? ওরা বললো লেকার্তের প্রাসাদে নাকি কি জরুরী সাপ্লাই যাবে। ওরা কফি খাওয়া শেষ করে নি–হঠাৎ শুনি জানালার কাঁচ ভাঙার শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলির শব্দ। কারা যেন অনেক দূর থেকে বলছে বাঁচাও। তক্ষুণি একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে যাচেকদের নিয়ে গেলো। গোলমালের ভেতর হারামজাদা দুটো আমার কফির দাম না দিয়েই লরি নিয়ে ভেগে গেছে। এই বলে বুড়ো একটু থেমে পেজেককে বললো, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে। হয়তো তোর বন্ধুরাই কোনো বিপদে পড়েছে। গলির ভেতরের বাড়িগুলো ভালো করে খুঁজে দ্যাখ।

পেজেক বললো, এখানে কেউ নেই। তুমি কি ঠিক শুনেছো যাচেকরা তোমাকে লেকার্তের রাজপ্রাসাদের কথা বলেছে?

ঠিক কেন শুনবো না? ঝাঁঝালো গলায় বুরঝিনিস্কি বুড়ো বললো, কানে তো এখনও পচন ধরে নি। আর মাঝরাতে নেশার ঘোরও থাকে না। আমার যা শোনার পষ্টই শুনেছি। তোর বিশ্বাস হলো না তো বয়েই গেলো। ভোর না হতেই জ্বালাতে এসেছে। ভালোয় ভালোয় এখনই কেটে পড়। সকালে আমার অনেক কাজ থাকে।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বুরঝিনিস্কি খুড়ো। এই বলে ত্রয়কাকে নিয়ে পেজেক ছুটলো অরবিস হোটেলে। যেতে যেতে হয়কাকে ও বললো, পুলিস ওদের খোঁজার ব্যাপারে কোনোই সাহায্য করবে না। মনে হচ্ছে এখানকার পুলিস অফিসারও শয়তানদের পক্ষের লোক।

হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ওয়ারসতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ফোন করলো পেজেক। রাষ্ট্রদূতকে অফিসেই পাওয়া গেলো। পেজেক সংক্ষেপে ওর পরিচয় দিয়ে গত কালকের ঘটনা আর বুরঝিনিস্কির সর্বশেষ ভাষ্য জানালো ওঁকে। রাষ্ট্রদূত উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ক্র্যাকভের পুলিস কমিশনার আমাকে শুধু বলেছে শীলাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এক্ষুণি ক্র্যাকভ রওনা হচ্ছিলাম। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমাদের লেকার্তে যাওয়াই উচিৎ হবে।

পেজেক বললো, ক্র্যাকভের পুলিসের কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না। আপনি লেকার্ত আসুন। আমি আর আমার এক বন্ধু এখনই লেকার্তের পথে রওনা হচ্ছি। রাজপ্রাসাদের ওপর নজর রাখা দরকার।

টেলিফোনে কথা না বাড়িয়ে ত্রয়কাকে নিয়ে পেজেক ছুটলো রেল স্টেশনের দিকে। দশটার ট্রেন ধরতে পারলে তাড়াতাড়ি যেশভ পৌঁছতে পারবে। নইলে যেতে হবে বাসে। দেড়ঘন্টা বেশি সময় লাগবে ওতে । স্টেশনের পথে ছুটতে ছুটতে ওর মনে হচ্ছিলো প্রতিটি মুহূর্ত এখন সোনার চেয়ে দামী ।

.

০৯. রাজপ্রাসাদে আরেক ষড়যন্ত্র

রিনিদের যখন লেকার্তের রাজপ্রাসাদে এনে লরি থেকে নামানো হলো তখন ওদের দেখাচ্ছিলো ঝড়ো কাকের মতো। সবার চুল উসকো খুসকো, চোখের নিচে কালি পড়েছে যেন অনেক রাত ঘুমোয় নি । শোয়েবের কপাল কেটে গিয়েছিলো লরিতে ছুঁড়ে ফেলার সময়, সেখানে রক্ত জমে কালচে হয়ে আছে। শীলার ঠোঁট কেটেছে, জনির মাথার পেছনে সুপুরি আর রিনির কনুই ছিলে গেছে।

লরির দরজা খুলে খসখসে গলার দৈত্যটা বললো, এক রাতেই কাবু হয়ে গেলে যে বীরযোদ্ধারা। এখনও অনেক কিছু বাকি আছে। নেমে এসো সবাই। লেকার্তের রাজপ্রাসাদে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি। এই বলে খ্যাস খ্যাস করে হায়নার মতো হাসলো সে।

হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা অবস্থায় নামতে গিয়ে ওদের মাথা ঘুরছিলো, পা টলছিলো, তবু কেউ কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করলো না। অতিকষ্টে লাফিয়ে নামলো।

খসখসে গলা এগিয়ে এসে মুখের বাঁধন খুলে দিলো। বললো, গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচালেও আধ মাইলের ভেতর কেউ তোমাদের গলা শুনবে না। অনুগ্রহ করে আমাকে অনুসরণ করো। তোমাদের জন্য রাজকীয় প্রাতরাশ অপেক্ষা করছে।

লরি থামানো হয়েছিলো রাজপ্রাসাদের সামনে নয়, পেছন দিকে। ওয়ারসর রাজপ্রাসাদের চেয়ে লেকার্তের রাজপ্রাসাদ অনেক বড় মনে হলো। চারদিকে ওক, এম, বার্চ আর লাইম গাছের সাজানো বন। মাঝে মাঝে ফাঁকা ঘাস জমিতে পাথরের বাগান, মর্মর মূর্তি, ফোয়ারা আর পানির নহর। শ্বেত পাথরে বাঁধানো বারান্দার ওপর দিয়ে হেঁটে ওরা প্রাসাদের একটা কামরায় ঢুকলো। বড় দরজার কাছে দুজন বন্ধুকধারী প্রহরী। খসখসে গলার সঙ্গে ওর সঙ্গীও রিনিদের পেছন পেছন কামরায় ঢুকলো। কামরার মাঝখানে লম্বা পাথরের টেবিলের চারপাশে গোটা দশেক রাজকীয় চেয়ার। টেবিলে খাবার সাজানো। রুটি, মাখন, ডিম আর অরেঞ্জ জুস।

খসখসে গলা আপ্যায়নের ভঙ্গীতে বললো, দেরি না করে বসে পড়লেই হয়। আমাদের আরো গেস্ট আছে।

ওরা কেউ বুঝতে পারলো না হঠাৎ এই আপ্যায়নের ঘটা কেন। খিদের কথা কারো মনে ছিলো না। খাবার দেখে মনে হলো বহুদিন ধরে বুঝি ওরা উপোষ রয়েছে। তবু শীলা শক্ত গলায় বললো, হাত বাঁধা অবস্থায় কিভাবে খাবো আমরা?

শোয়েব বললো, মুখ হাত না ধুয়ে কিছু খেতে পারবো না।

ভুল হয়ে গেছে। বলে আবার খ্যাস খ্যাস করে হাসলো দৈত্যটা। ওদের হাতের বাঁধন খুলে দিতে দিতে বললো,  পাশে বাথরুম আছে। একজন একজন করে যাও। আমি খুব দুঃখিত, এই বেলা তোমাদের গরম পানি দিতে পারছি না। দুপুরে তাও পাবে।

পানি ঠাণ্ডা হলেও বাথরুমে তোয়ালে, সাবান, টুথপেস্ট সবই ছিলো। এক এক করে ওরা চারজন বাথরুম থেকে যথাসম্ভব পরিপাটি হয়ে বেরোলো। চেয়ারে যেই বসতে যাবে সামনে দরজায় চোখ পড়তে রিনি চমকে উঠলো। মাফিয়াদের সেই শুটকো চরটা এসে একটা চেয়ার টেনে বসলো। লোকটা চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে শীলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ধারালো গলায় বললো, এই নোংরা মাফিয়াটার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে আমি ঘৃণা বোধ করি।

শীলার কথা শুনে শুকোর চোখ দুটো আলুর মতো গোল হয়ে গেলো পাশে দাঁড়ানো খস খসে গলা খ্যাস খ্যাস করে হেসে উঠলো। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকলো রবার্ট মারাওস্কি। বললো, ও কেন মাফিয়ার এজেন্ট হতে যাবে? মাফিয়ারা ওকে বাড়ির চাকরও রাখবে না।

বিষ্ময়ে কয়েক মুহূর্ত বাকহারা হয়ে গেলো ওরা চারজন। রিনি তীক্ষ্ম গলায় বললো, আপনি এখানে, এদের সঙ্গে?

অমায়িক হেসে বুড়ো মারাওস্কি বললো, এরা সব আমারই লোক।

কে আপনি? কেন মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিলেন আমাদের। এই লোকটাই বা কে?  রাগে রি রি করে কাঁপছিলো রিনি ।

অতো উত্তেজিত হওয়ার কি আছে। ঠাণ্ডা মাথায় বসে নাশতা খাও। সব বলবো। এই বলে মারাওস্কি খসখসে গলার দিকে তাকালো–এদের খাওয়াদাওয়ার যেন কোনো অসুবিধা না হয়। আমি কনফারেন্স রুমে আছি।

মারাওস্কি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রিনি শোয়েবকে বাংলায় বললো, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

শোয়েব বললো, আগে নাশতা খাই, তারপর আলোচনা করা যাবে।

রিনি লক্ষ্য করলো, মারাওস্কির কথায় যাকে মাফিয়ার এজেন্ট বলে এ কদিন জেনে এসেছিলো সে মাথা নিচু করে চুপচাপ রুটিতে মাখন লাগাচ্ছে। রিনি ওকে ইংরেজিতে বললো, আমি দুঃখিত। না জেনে আপনাকে মাফিয়ার এজেন্ট বলেছি।

আপনার পরিচয় কি জানতে পারি?

শুকনো হেসে শুটকো লোকটা বললো, আমি এজেন্ট বটে, তবে মাফিয়ার নই, ইন্টারপোলের।

ইন্টারপোল মানে আন্তর্জাতিক পুলিস বিভাগ, অপরাধী ধরার জন্য যারা পৃথিবীর যে কোনো দেশে যেতে পারে?

ঠিক ধরেছো। রুটিতে কামড় দিয়ে ইন্টারপোলের এজেন্ট বললো, আমার নাম জঁ শিরাক। প্যারিস থেকে ফলো করছি বদমাশটাকে। ক্র্যাকভে এসে ধরা পড়ে গেলাম।

মারাওস্কি আসলে কে?

ও একজন ধুরন্ধর চোর, দুর্লভ পেইন্টিং চুরি করার একজন বিশেষজ্ঞ। আদি বাড়ি জার্মানীতে। নাম ভাঁড়িয়ে পোল্যান্ডে আস্তানা গেড়েছে। বছর পাঁচেক আগে ও আমাস্টার্ডাম থেকে ভ্যানগগের একটা ছবি চুরি করেছে। পোল্যান্ড থেকে রাফায়েল আর দ্য ভিঞ্চির ছবি চুরির মতলব করেছে ও।

রিনি খেতে খেতে বললো, ক্র্যাকভে ওর আখড়ায় গিয়েই সেটা আমি বুঝেছিলাম । তার আগে আমরা আপনাকেই চোর ভেবে বসেছিলাম। ওয়াভেল দুর্গে কাল সকালে আপনি কি করছিলেন?

দেখছিলাম, ওখান থেকে ও অলরেডি একটা ছবি সরিয়েছে। নিখুঁত কপি করতে পারে ও। নতুন ছবি পুরোনো করার টেকনিকও জানে। যে জন্যে ছবি কখন খোয়া যায় কিছু টের পাওয়া যায় না জাদুঘর আর প্রাসাদের পাহারাদারদের ঘুষ দিয়ে সে বশ করে। ওদের সাহায্যে আসল ছবি সরিয়ে নকল ছবি ঝুলিয়ে দেয় দেয়ালে।

শোয়েব বললো, আমিও ঠিক তাই অনুমান করেছিলাম।

ওরা কথা বলছিলো ইংরেজিতে। খসখসে গলা কিংবা ওর সঙ্গী কেউ ইংরেজি বোঝে না। রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করছিলো ওরা। পুঁচকেগুলোকে ধমক দেয়ার জন্য ওর গলাটা নিশপিশ করলেও মারাওস্কির নির্দেশের কারণে কিছু বলতে পারছিলো না। সুযোগটা ওরা ভালোভাবেই নিলো। বললো, মারাওস্কির ক্র্যাকভের ডেরাতে সাদাচুলের এক জার্মানকে দেখেছিলাম। মনে হলো এদের নেতা সে। আপনি ওর কথা কিছু জানেন?

ঠিক ধরেছো তোমরা। শিরাক বললো, ও হচ্ছে কার্ল রেইনহাইম। নিও নাজী আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা। পোল্যান্ডের দায়িত্বে আছে ও।

নিও নাজী মানে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো জনি।

তোমরা নিশ্চয় জানো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীতে হিটলারের পার্টিকে বলা হতো নাজী পার্টি। তার বাহিনী ছিলো নাজী বাহিনী, যারা লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মেরেছে। বাচ্চার মায়েদের মেরেছে। ফ্রান্সের লিয়তে নাজী বাহিনী আমার বাবা আর বড় ভাইকে হত্যা করেছে। তোমরা এসব কল্পনাও করতে পারবে না। কথা বলতে গিয়ে ভারি হয়ে এলো শিরাকের গলা।

রিনি সমবেদনার গলায় বললো, আপনি বোধহয় জানেন না একাত্তরে বাংলাদেশে আমরা যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছিলাম, পাকিস্তানী সৈন্যরা নাজী বাহিনীর মতোই আমাদের দেশে গণহত্যা করেছে। ওরা আমাদের তিরিশ লক্ষ নিবীহ মানুষকে হত্যা করেছে।

আমি জানি। স্বাভাবিক গলায় শিরাক বললো, হিটলারের নাজী পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইদানিং জার্মানীতে আর ইউরোপের কয়েকটি দেশে বর্ণবিদ্বেষী কিছু লোক নব্য নাজী পার্টি গঠন করছে। পোল্যাণ্ডেও এদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। ওরা মনে করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ঠিক কাজ করেছিলো।

রিনি বললো, আমাদের দেশে একাত্তরের ঘাতকদের একটা দল আছে। ওটার নাম জামাতে ইসলামী। ওরাও বলে একাত্তরে তারা লক্ষ লক্ষ নিরীহ বাঙালীকে হত্যা করে ভুল করে নি। আমাদর দেশটাকে ওরা আবার পাকিস্তান বানাতে চায়।

রিনির কথা শুনে শোয়েব রীতিমতো অবাক হলো। শীলার মতো হালকা স্বভাবের মেয়েও নয়, তাই বলে এতটা সচেতন এটা শোয়েব ভাবতেও পারে নি।

শীলা বললো, এসব রাজনীতির বিষয় নিয়ে পরেও আমরা আলোচনা করতে পারবো। মিস্টার শিরাক কি দয়া করে বলবেন এরা আমাদের কেন এভাবে আটকে রেখেছে? কি চায় আমাদের কাছে? কবে আমরা মুক্তি পাবো?

শুকনো হেসে শিরাক বললো, আমার ব্যাপারে ওদের সিদ্ধান্ত জানি। ওরা আমাকে হত্যা করবে। কারণ আমি ইহুদি, তার ওপর ইন্টারপোলের এজেন্ট, মারাওস্কির শয়তানী জেনে গেছি। তোমাদের ব্যাপারে শুনেছি সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করবে । ওদের দুজন দুরুত্বপূর্ণ কর্মীকে ওয়ালেসার সরকার মাস তিনেক আগে বন্দী করেছে। নাজী পার্টি এখানেও নিষিদ্ধ। নাজীরা এখানেও লক্ষ লক্ষ পোলদের হত্যা করেছিলো।

রিনি বললো, এখান থেকে পালাবার কি কোনো পথ নেই?

গত এক বছর ধরে সংস্কারের কাজ চলছে বলে রাজপ্রসাদ দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কার্ল রেইনহাইম প্রাসাদের পুরোনো গার্ডদের টাকা দিয়ে বশ করেছে। দুজন ওর কথা শোনে নি বলে ওদের খুন করেছে। এখন এই প্রাসাদের পুরোটাই ওদের দখলে। মাটির তলা দিয়ে টানেল চলে গেছে কার্পেথিয়ানের গভীর বনে। খুবই সুরক্ষিত জায়গা এটা। দিনে রাতে চব্বিশ ঘন্টার পাহারা বসানো আছে। পালাবার কোনোপথ নেই।

শীলা বললো, আপনি কি জানেন মিস্টার শিরাক, বাবাকে ওরা কখন খবর পাঠাবে?

ওই নোংরা ইহুদিটা কি করে জানবে? হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলো মারাওস্কি। একটা চেয়ার টেনে বসে বললো, দুচার দিন যাক, তোমাদের জন্য যথেষ্ট উতলা হওয়ার পর্যাপ্ত সময় দিতে চাই তোমার বাবাকে। যাতে আমাদের শর্ত মানার জন্য তিনি এবং তাঁর সম্প্রদায় চাপ দিতে পারে সরকারের ওপর।

মিস্টার শিরাককে কেন আটকে রাখা হয়েছে জানতে পারি?

রিনির প্রশ্ন শুনে খিক খিক করে হাসলো মারাওস্কি–কার্ল রেইনহাইমের ইচ্ছে ইহুদি ইঁদুরটাকে খাঁচায় পুরে প্রাসাদের হ্রদে ডুবিয়ে মারি । আমার ইচ্ছে ওকে বাঁচিয়ে রাখা। ভবিষ্যতে আমি যদি কোনো বিপদে পড়ি সেক্ষেত্রে ইহুদিটা ভালো জামানত হতে পারে। জানোই তো কত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় আমাকে। পার্টির জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

তুমি কি বলবে লণ্ডন থেকে কেন আমাদের পিছু নিয়েছো? আমরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করি নি।

ক্ষতি কোথায়, তোমরা তো আমার উপকারই করলে। তোমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আমার হয়ে পাঁচ কেজি হেরোইন বয়ে আনলে ওয়ারস। ইউরোপের বাজারে যার দাম আট লাখ পাউন্ড। তোমাদের এ উপকার আমি ভুলবো না।

ইয়ার্কি মেরো না জনি শক্ত গলায় বললো, এত উপকার করার ফল বুঝি এভাবে আমাদের আটকে রাখা? তোমার লোকজন আমাদের ওপর যে অত্যাচার করেছে কিছুই আমরা ভুলি নি।

ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। এর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। দুঃখের লেশমাত্র ছিলো না মারাওস্কির গলায়-তবে কথা হলো কি, তোমরা যদি আমাদের ঘাঁটিতে না ঢুকতে, তাহলে তোমাদের এ হাল হতো না।

তুমি অতি বড় অকৃতজ্ঞ, শয়তান। ধারালো গলায় রিনি বললো, ওটা তোমার ঘটি না কি কিছুই জানি না আমরা। শিরাক তোমাকে ফলো করছে দেখে ভাবলাম তুমি বিপদে পড়তে যাচ্ছে। তাই তোমাকে সাবধান করার জন্য তোমার পিছু পিছু আমরা ও বাড়িতে ঢুকেছিলাম।

আমি জানি কার্ল তোমাদের কথা বিশ্বাস করে নি বলে সামান্য কষ্ট দিয়েছে। আমি তখন ওখানে ছিলাম না। পরে এসে যখন শুনলাম তখন কার্লকে বকে দিয়েছি। ভবিষ্যতে এরকম হবে না। তোমরা এখানে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াও। লুকোচুরি খেলো, হ্রদে গিয়ে সাঁতার কাটো–যা খুশি করো, শুধু বাইরে যাওয়ার কথা ভেবো না। কে জানে কখন কি দুর্ঘটনা ঘটে। এই বলে মারাওস্কি খসখসে গলার দৈত্যটাকে নির্দেশ দিলো–ইহুদিটাকে ওর কামরায় নিয়ে আটকে রাখো। আর এই ছেলেমেয়েরা ভালো হয়ে থাকবে।

মারাওস্কি বেরিয়ে যাওয়ার পর শিরাক নিচু গলায় বললো, দুদিন সময় আছে। ভেবে চিন্তে পালাবার একটা প্ল্যান করবো। তোমরা ভয় পেও না। আমি–

খসখসে গলা এগিয়ে এসে শিরাকের কনুই ধরলো–কোনো কথা নয়।

নিজের ঘরে চলো। এই বলে ওকে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে গেলো।

পেজেক আর ত্রয়কা যখন লেকার্ত এসে পৌঁছালো, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ত্রয়কার পরনে জিপসিদের পোশাক কাঁধে পোষা বাদর, পেজেক রাস্তা থেকে একটা খড়ের টুপি কিনে চাষীদের বখা ছেলের মতো হাঁটছিলো রাস্তা দিয়ে। দুজনকেই মনে হচ্ছিলো গ্রামের ছেলে। লেকার্ত খুবই ছোট জনপদ। রাজপ্রাসাদ দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকলে অনেকে আসে বাইরে থেকে। তবে গত এক বছর ধরে এই এলাকায় প্রাণের কোনো স্পন্দন আছে বলে মনে হয় না। রাতে রাজপ্রাসাদে নাকি অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। সেই ভয়ে লোকজন প্রাসাদের ধারে কাছে আসে না । রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকের কাছে সাইনবোর্ড লেখা সংস্কারের কাজ চলছে। দর্শনার্থী বা বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। ওটা না দেখার ভান করে গ্রাম্য ছেলের কৌতূহল নিয়ে গেজেক আর ত্রয়কা ফটকের দিকে এগোতেই যেন মাটি খুঁড়ে দু জন সশস্ত্র প্রহরী সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন কর্কশ গলায় বললো, নোটিস চোখে পড়ে নি? ভাগগা এখান থেকে।

সঙ্গে সঙ্গে ভয় পাওয়ার ভান করে দুপা পিছিয়ে এলো পেজেক আর ত্রয়কা। পেজেক ভয়ে ভয়ে বললো, আমরা প্রাসাদে ঢুকবো না। গাছের কিছু মরা ডাল কুড়িয়ে নেবো, যেগুলো মাটিতে পড়ে আছে।

না, হবে না। কঠোর গলায় বললো প্রহরী, এক্ষুণি পালাও, নইলে গুলি করবো।

পেজেক আর ত্রয়কা পা চালিয়ে পালিয়ে এলো। রাজপ্রাসাদের চারপাশ দিয়ে গভীর খালের মতো কাটা রয়েছে। এক সময় পানির স্রোত বইতো সেখানে, এখন শুকনো ঘাসের জঙ্গল আর আগাছায় বোঝাই হয়ে আছে। কিছুদূর গিয়ে পেজেক আর ক্রয়কা সেই খালের ভেতরে নেমে গেলো। পুরো খালটা পা চালিয়ে ঘুরে আসতে একঘন্টার বেশি সময় লাগলো । রাজপ্রাসাদের পশ্চিম দিক থেকে একটা সুড়ঙ্গের মতো এসে খালে মিশেছে, সম্ভবত পানি সরার জন্য। পেজেক বললো, মনে হয় এখান দিয়ে ঢোকা যাবে।

ত্রয়কা বললো, এখনই ঢোকা ঠিক হবে না। একটু অন্ধকার নামুক।

পেজেক বললো, এখন তাহলে আমরা সদর রাস্তায় গিয়ে শীলার বাবার জন্য অপেক্ষা করতে পারি। নইলে তিনি সরাসরি প্রাসাদে এসে বিপদে পড়বেন।

পেজেক হিসেব করে দেখেছিলো গাড়ি নিয়ে সকাল দশটায় যদি শীলার বাবা ওয়ারস থেকে রওনা হন, লেকার্ত পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সন্ধ্যার আগেই ওরা শহরে ঢোকার বড় রাস্তার মাথায় গিয়ে দাঁড়ালো।

বেশিক্ষণ ওদের অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট কুড়ি পরেই দেখলো রাষ্ট্রদূতের কালো মার্সেডিজ আসছে দ্রুত গতিতে। ওপরে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে পতপত করে। পেছনে একটা পুলিশের গাড়ি, আরেকটা মিলিশিয়ার ভ্যান।

হাত তুলে পেজেক পতাকাওয়ালা গাড়ি থামালো। কাছে গিয়ে বললো, স্যার আমার নাম পেজেক। মনে হচ্ছে শীলারা প্যালেসের ভেতরে আছে। চারপাশে কড় পাহাড়া দিচ্ছে। দিনের আলোয় যাওয়া ঠিক হবে না।

রাষ্ট্রদূতের পাশে ছিলেন পুলিশের চীফ কমিশনার বিগনিউ জাকোবস্কি আর মিলিশিয়ার একজন সিনিয়র অফিসার। গাড়ির সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বিশালদেহী আঁদ্রে আর শীলাদের গ্রে হাউন্ড স্পটি। পেযেকের কথা শুনে পুলিসের চী বললেন, পেজেক ঠিকই বলেছে এক্সেলেন্সি। আমরা সন্ধ্যার পর প্যালেস ঘেরাও করে ওদের আত্মসমর্পণ করতে বলবো। আপনি দয়া করে মিউজিয়ামের গেস্ট হাউসে বিশ্রা নিন।

আমি এখানেই ভালো থাকবো। শান্ত গায় রাষ্ট্রদূত বললেন, ওরা যদি আত্মসমর্পণ না করে আমার ছেলে মেয়েদের সামনে রেখে গুলি চালায় তখন কি হবে?

পেজেক বললো, পুলিশের ঘেরাও করার আগে আমি আর ত্রয়কা সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রাসাদে ঢুকবো। শীলারা যাতে নিরাপদ থাকে সে দায়িত্ব আমার।

পেজেকের বুদ্ধি আর সাহস দেখে মুগ্ধ হলেন রাষ্ট্রদূত। বললেন, সেক্ষেত্রে তোমর আমার কুকুরের সাহায্য নিতে পারে। শীলারা কোথায় আছে ও সঙ্গে থাকলে বেশি খুঁজতে হবে না।

স্পটিকে দেখার পর থেকে ক্রয়কার পোষা বাঁদর নিক ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। স্পা একবার ওই অদ্ভুদ প্রাণীটার দিকে তাকিয়েছিলো তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে। তারপর পেজে আর ত্রয়কাকে শুঁকে দেখে ভাব জমালো।

অল্প কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যার কুয়াশায় ভর করে অন্ধকার নামলো লেকার্তের ছোয় জনপদে। চারপাশের গাছপালার ভেতর জমে থাকা অন্ধকার কালো আলকাতরার মতে গড়িয়ে পড়লো সবখানে। আকাশে চাঁদ ছিলো। অন্ধকার তাই বেশি জমাট বাঁধতে পারলো না।

পরিকল্পনা অনুযায়ী পেজেক আর ত্রয়কা রাজপ্রাসাদের পশ্চিমের সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। সদর দরজায় পাহারা দেখে পেজেক যতটা ঘাবড়ে গিয়েছিলে চারপাশের পাহারা ততটা কড়া ছিলো না।

রাজপ্রাসাদের সামনের দরজায় জনা তিনেক পাহারাদার ছিলো। পেছনের দরজা পাহারাদার দুজন আর খসখসে গলা ওর সঙ্গীকে নিয়ে তাস খেলছিলো। ওরা জানে সদরজা দিয়ে বা বাইরের ফটক দিয়ে কেউ ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না। চারপাশের দশ ফুট উঁচু পাচিলও টপকাতে পারবে না। শুধু ইহুদি শিরাককে বিশ্বাস নেই বলে ওর ঘরের দরজার বাইরে থেকে তালা আটকানো ছিলো। শীলারা ছিলো নিচে তলায়। ওপর তলার কনফারেন্স রুমে তখন মারাওস্কি আর কার্ল রেইনহাইম জার্মানীর দুজন ধনকুবেরের প্রতিনিধির সঙ্গে বসে দর কষাকষি করছিলো রাফায়েলের আঁকা আসল ম্যাডোনা নিয়ে। ছবির ব্যাপারটা মিটে গেলে বন্দী বিনিময়ের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে ওদের। তখন পাহারাও অনেক বাড়াতে হবে। সরকার পক্ষের সব রকম হামলার জন্য তৈরি থাকতে হবে। কালই ওয়ারস থেকে নতুন ফোর্স আসবে।

পেজেক আর ক্রয়কা নিঃশব্দে স্পটিকে অনুসরণ করছিলো প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে শীলাদের খুঁজে বের করতে স্পটির বেশি সময় লাগলো না। শীলাকে দেখে স্পটি ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর কোলের ওপর। খুশিতে চিৎকার করে উঠতে যাচিছলো শীলা। পেজেক ইশারায় ওদের চুপ থাকতে বললো। তারপর টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললো, গোটা এলাকা পুলিস ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু গ্রীন সিগন্যাল না পেলে আমরা বাইরে যাবো না।

একা ঘরের দরজাগুলো ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো। জানালার কাছে দিয়ে পেজেক পুলিস চীফের দেয়া লম্বা টর্চটার আলো ফেললো আকাশে। তিনবার ওটা জ্বালালো আর নিভালো। তারপর জানালা বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো । চরম মুহূর্তের জন্য।

আলোর সংকেত দেয়ার দুমিনিট পরেই রিনিরা শুনলো বাইরে মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে-রাজপ্রাসাদের চারদিক ঘিরে ফেলা হয়েছে। ভেতরে যাবা আছো অস্ত্র ফেলে বেরিয়ে এসো। নইলে প্রত্যেকে মারা পড়বে।

ঘোষণার এক মিনিট পরই রিনিদের দরজায় প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিলো কেউ। পুরু মেহগিনি কাঠের দরজার এতটুকু আঁচড় লাগলো না তাতে। বাইরে থেকে মারাওস্কি চিৎকার করে বললো, দরজা খুলে বেরিয়ে এসো, নইলে গুলি করবো।

ঠিক তখনই বাইরে পরপর দুটো গুলির শব্দ হলো। মারাওস্কি ছুটে গেলো প্রাসাদের মূল দরজার দিকে। মিলিশিয়ারা বিশাল লরি থেকে মেশিনগান চালাতে চালাতে প্রচণ্ড গতিতে বাইরের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকলো। পেছনের সুড়ঙ্গ দিয়ে আরো দশজন মিলিশিয়া ঢুকলো নিঃশব্দে সামনের দরজার দিকে। লরি আসতে দেখে প্রাসাদের ভেতরের প্রহরীরা সবাই সেদিকে গেছে। পেছন থেকে মিলিশিয়ারা এসে ওদের দিকে বন্দুক ঠেকানোর আগে পর্যন্ত টেরও পেলো না কি ঘটে গেলো। বাইরের ফটকের দুই প্রহরীকে আঁদ্রে একাই কাবু করেছে।

কার্ল রেইনহাইম মারাওস্কির মতো বোকামি করে নি। ছবি টবি ফেলে দুই জার্মান খদ্দেরকে নিয়ে ততক্ষণে সে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়েছে সীমান্তের দিকে।

গুণ্ডাদের সবার হাতে হাতকড়া পরানোর পর হাসিমুখে চীফ কমিশনার নিজেই অল কিয়ার হুইসেল বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে ছুটে এলো শীলা, জনি, শোয়েব আর রিনি। শীলা জড়িয়ে ধরলো ওর বাবাকে। হাতকড়া পরা মারাওস্কি দাঁড়িয়েছিলো মাথা নিচু করে । জনি গিয়ে ওর টাকের ওপর জোরে চাটি মেরে বললো, মিস্টার রবার্ট মারাওস্কি, বলেছিলেন নেকড়ে দিয়ে খাওয়াবেন। আপনার নেকড়েগুলোকে অভুক্ত রাখতে হলো বলে আমি খুবই দুঃখিত।

শোয়েব অল্পক্ষণের জন্য বেরিয়ে গিয়ে জাঁ শিরাককে উদ্ধার করে আনলো। পরিচয় করিয়ে দিলো সবার সঙ্গে। পুলিসের চীফ অবাক হয়ে বললেন, আপনার কিছু হলে আমার যে চাকরি চলে যেতো!

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পেজেককে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, যায় নি এ ছেলেটার জন্য।

স্পটি এগিয়ে এসে পেজেকের গাল চেটে দিলো।

এতক্ষণ পর নিরাপদ ভেবে ত্রয়কার কাঁধের ওপর থেকে স্পটির পিঠে লাফ দিলো নিক।

একার সঙ্গে শীলাদের পরিচয় করিয়ে দিলো পেজেক। ত্রয়কা বললো, ক্র্যাকভে আমাদের মেলা না দেখে তোমরা কেউ যেতে পারবে না।

একগাল হেসে চীফ কমিশনার জাকোবস্কি বললেন, ক্র্যাকভের এই মেলা দারুণ দেখতে এক্সেলেন্সি। যদি সময় থাকে এ সুযোগ হারাবেন না।

জনিও বললো, রাজী হয়ে যাও মনু মামা।

রাষ্ট্রদূত হেসে বললেন, শীলার মাকে তাহলে আনার ব্যবস্থা করতে হয়।

জাকোস্কি বললেন, আমি এক্ষুণি ফোন করছি ওয়ারস আর ক্র্যাকভে। আজকের রাতটা আপনারা রাজপ্রাসাদের আতিথ্য গ্রহণ করুন। পেইন্টিং উদ্ধারের জন্য মনে হয় ছেলেমেয়েরা প্রেসিডেন্টের পদক পেতে যাচ্ছে।

কি মজা জনি ভাইয়া বলে খুশিতে শীলা জড়িয়ে ধরলো জনিকে।

পেজেকের চোখ দুটো আনন্দে চকচক করছিলো, দেশের এত দামী সম্পদ বক্ষার গজে সাহায্য করতে পেরেছে বলে।

রিনি আর শোয়েব সবার পেছনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছিলো। দুজনের মুখে মৃদু হাসি ছিলো আর চোখে ছিলো অনেক না বলা কথা।