বেনুর সুখ দুঃখ
বংশাই নদীর ওপরে ধু ধু করে রূপোলি বালির চর। এপারে কুমোর পাড়া। এক চিলতে এই নদী নাকি আগে অনেক বড় ছিলো।। দূর দূর থেকে বজরা আসতো, পশরা সাজিয়ে নিয়ে যেতো। বেনুর দিদিমা রাতে মাটির পিদিম জ্বালিয়ে নদীর কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে–আহারে নদী। কি নদী আছিল, কি হইয়া গেলো! হায় কপাল! রাতের বারো বছরের বেনু স্বপ্নের ভেতর পাল উড়িয়ে বিশাল বংশাই নদীতে ঘুরে বেড়ায়।
কুয়াশাভেজা ধলপহরে বেনু এসে নদীর তীরে কাশফুলের ঝোঁপের নিচে বসে। তির তির করে বয়ে চলে রূপোলি নদীর ছোট ছোট ঢেউ। শীতের শেষে নদী এতো ছোট হয়ে যায় যে ছোট নৌকোও চলতে পারে না। বেনু তখন হেঁটেই নদী পার হয়। বেনুর বাবা আর পাড়ার সবাই মাটি আনার জন্যে নদীর ওপারে যায়। বেনু কখনো বাবার কাঁধে চড়ে, কখনো বুজলে বাবার হাত ধরে নদী পার হয়।
কুয়াশার ভেতর রূপোলি চরে সূর্য ওঠা বেনুর কাছে কোনোদিনই এক রকম মনে হয় না। তাই বেনু রোজ এসে কুয়াশার চাঁদরের নিচে আস্ত মুশুরির ডালের মতো লাল সূর্যটাকে অনেকক্ষণ দেখে। নদীর তীরে একটা দুটো বক মাছ ধরার জন্যে উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকে। মাঝে মাঝে বকের আড়চোখে তাকানো দেখে বেনু হাসে। দাঁত মাজার নিমের ছোট্ট দাঁতন। দিয়ে বালির বুকে বকের একটা ছবি এঁকে ফেলে। ছবি আর মনের মতো হয় না। বেনু বার বার শুধু ছবি আঁকে। একটা বকের ছবি অনেকগুলো হয়ে যায়।
কখনো বেনু নদীতে ছোট ছোট মৌরলা মাছের খেলা দেখে। কাকের চোখের মতো টল টল করে নদী। মৌরলা মাছের দল ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। বেনু যেই নদীতে হাত ছোঁয়ায় তখনই মাছগুলো ছুটে পালিয়ে যায়। বেনু হেসে ফেলে। মুখ দিয়ে ফোয়ারা ছুটিয়ে রঙধনু দেখে। কুয়াশার চাঁদরের নিচে সূর্য তখন অনেক ওপরে উঠে এসেছে।
মা দূর থেকে বার বার ডাকে, বেনু, বেনু। বেনু শুধু হাসে। এক সময় ব্যস্ত হয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
বাবা চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, মেলার আর বেশি দেরি নাইরে বেনু। অখনো তোর পুতুলগুলা হইলো না?
বেনু হেসে বলে, হইয়া যাইবো বাবা। ভয় পাও ক্যান?
বাবা দিনরাত কাজ করে। মেলায় অনেক জিনিস নিতে হবে। সারা বছরে এ রকম বিক্রির সুযোগ দু তিন বারের বেশি আসে না। নিপুণ হাতে বাবা ফুলদানি বানায়। ছোট ছোট কলসি আর মাটির টব বানায়। মা ফুলদানি আর কলসিতে এলা মাটি, পুঁতের গুঁড়ো, নীলের গুঁড়ো আর সিঁদুর দিয়ে ফুল, লতা-পাতা-এসব আঁকে। দিদিমা তেঁতুল বিচি গুঁড়ো করে চমৎকার পালিশ তৈরি করে। লক্ষ্মী যখন এগুলো রোদে শুকোতে দেয় তখন ঝক ঝক করে যেন হাসতে থাকে।
বেনু শুধু পুতুল বানায়। সবাই বলে দেখ, একরত্তি ছেলে কি চমৎকার পুতুল বানিয়েছে। বাবার মুখটা তখন হাসিতে ভরে যায়। বাবা চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে আবার বলে, বেনু দেরি করিস না। কাম শুরু কইরা দে।
আঙিনার এক কোণে ঘষাচন্দনের মতো নরম মাটি স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। বেনু। পুতুল বানাতে বসে। অনেক রকম ছাঁচ আছে পুতুলের। ছাঁচের পুতুল তো সবাই বানায়। বেনু ছাঁচ থেকে পুতুল বের করে পুতুলের গায়ে আরো কিছু কাজ করে। পছন্দ মতো অলংকার পরায়। শাড়ির আঁচলে নকশা কাটে। দেখতে দেখতে ওর পুতুলগুলো অন্যরকম হয়ে যায়।
বেনু দুটো পুতুলকে বর-কনে বানায়। লক্ষ্মী পাশে বসে সব দেখে। তার চোখ দুটো গোল হয়ে যায়। বলে, দাদা, এ পুতুল দুইটা আমারে দিবি?
বেনু মাথা নাড়ে–না! এগুলো আমি বেশি দামে বেচুম।
লক্ষ্মী মুখ কালো করে গাল ফুলিয়ে উঠে যায়। বেনু হাসে। মনে মনে বলে–এগুলা বেইচা তোরে বেলুন কিনা দিমু। আর আমার জইন্য নতুন বই।
বেতন দিতে পারেনি বলে স্কুলে বেনুর নাম কেটে দিয়েছে। বাবা বলে, ঘরে বসে পড়। ঘরে বসে পড়তে গেলে বই তো দরকার। বেনুর সেই বইও নেই। বেনু পুতুল বানাতে বানাতে নতুন বইয়ের স্বপ্ন দেখে।
পৌষের মেলাটা অনেক বড় হয়। দূর থেকে লোকজন মেলা দেখতে আসে। সার্কাসের তাঁবু পড়ে। মৃত্যুকূপের খেলা দেখানোর লোকজন আসে। শহর থেকে আসে সিনেমা দেখানোর কোম্পানি। তাছাড়া, সঙ, নাচ, জারী গান, পুতুলনাচ, যাত্রা এসব তো আছেই। উৎসবের হাট সাতদিন ধরে চলতে থাকে।
এবার মেলায় জায়গার খাজনা বড়ো বেশি চেয়েছে। বেনুরা তাই ঘর তুলতে পারেনি। খোলা আকাশের নিচে ঘাসের ওপর ওরা মাটির পসরা সাজিয়ে বসেছে। পাশে প্লস্টিক আর সিরামিকঅলাদের মস্তো বড়ো দোকান। কাঁচের আলমারির ভেতর রঙ চঙে পুতুল, খেলনা আর চিনেমাটির জিনিসপত্র সারাক্ষণ হাসতে থাকে। রাতেও সেই দোকানে দিনের আলো থাকে। সন্ধ্যেবেলা নিজেদের দোকানে হারিকেন জ্বালিয়ে বেনু প্লাস্টিক আর সিরামিকের উজ্জ্বল আলোর নিচে রাখা সেইসব জিনিসপত্র দেখে ।
বেনুর চোখে পলক পড়ে না। বুকের ভেতর সির সির করে। নিজের পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে কান্না পায়। সবাই ওদের জিনিস কিনছে। সুন্দর পোষাক পরা সেই মানুষগুলো বেনুদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। হারিকেনের আলোয় নিজের
পুতুলগুলোকে বড় বেশি ম্লান মনে হয় বেনুর। বর কনে পুতুল দুটোর মুখটা কি রকম গম্ভীর দেখাচ্ছে। অথচ বানাবার সময় এরকম মনে হয়নি।
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যা, মেলা দেইখা আয় বেনু। কাইল তো সময় পাবি না।
বেনু ঘুরে ঘুরে মেলা দেখে। রং-উঠে যাওয়া ময়লা কাপড় পরে একটা লিকলিকে জোকার সার্কাসের তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে তোক হাসানোর কি চেষ্টাটাই না করছে! লোকটার জন্যে বেনুর দুঃখ হয়। বেনু সকালে দেখেছে, চার আনা পয়সা চুরি করে তেলেভাজা খাবার জন্যে সার্কাসের ম্যানেজার ওকে বেত দিয়ে পিটিয়েছে। নাকটা এমনই ফুলেছে যে ওকে বাড়তি নাক লাগাতে হয়নি। ফুলোটাকে শুধু রং করে দিয়েছে, যাতে মনে হয় ওটা আসলে বুঝি নকল।
বেনু নাগরদোলার সামনে এসে দাঁড়ায়। সুন্দর জামা-কাপড় পরা ছেলেমেয়েরা নাগরদোলায় ঘুরছে, শব্দ করে হাসছে, চিৎকার করছে। নাগরদোলার লোকটা বেনুকে বলে, কি খোকা উঠবে?
বেনু মৃদু হেসে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। বেনুর পাশে একটা বেলুনঅয়ালা দাঁড়িয়েছিলো। সে বলে, তুমি আমার বেলুনগুলা ধরবা? আমি একটু উঠুম।
ছেলেটা বেনুদের চেয়ে বয়সে বড়ো হবে। বেনু ওর বেলুনগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে এতগুলো বেলুন যদি লক্ষ্মী পেতো! একবার মনে হয় নাগরদোলা জোরে ঘোরার এই ফাঁকে ও যদি বেলুনগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হয়, আহা বেচারা, বেলুন বিক্রি করেইতো ও বেঁচে আছে। বেলুনগুলো হারিয়ে ফেললে ওকে সেই লিকলিকে জোকারটার মতোই হয়তো মার খেতে হবে। বেনু শক্ত করে বেলুনের সুতোগুলো চেপে ধরে। এক সময় ওর মনে হয়, নাগরদোলায় কেউ বসে নেই। শুধু ও আর লক্ষ্মী দুজন ঘুরছে। লক্ষ্মীর হাতে বর-কনে পুতুল দুটো। চারপাশে অনেক রঙ বেরঙের বেলুন উড়ছে।
ছেলেটা এসে বেনুকে বলে, দাও ভাই, বেলুনগুলা দাও।
বেনু চমকে উঠে ওর দিকে তাকায়। তারপর বেলুনগুলো বাড়িয়ে দেয়। ছেলেটা বেলুনগুলো হাতে নিয়ে কি যেন ভাবে। তারপর বলে, তুমি একটা বেলুন নিবা?
বেনু মৃদু হেসে মাথা নাড়ে। ছেলেটা একটু অবাক হয়ে চলে যায়। বেনু মনে মনে বলে– বোকা, আমারে বেলুন দিয়া তুমি যদি পিটুনি খাও!
পরদিন সন্ধ্যেবেলা গরুর গাড়িতে জিনিসপত্র বোঝাই করে বেনুরা আবার ওদের গ্রামের পথে পা বাড়ায়। বেনুর পুতুলের ঝুড়িটা ওর হাতে। একটা পুতুলও বিক্রি হয়নি। বেনুর সামনে ওর বাবা আর নিতাই দাদু হাঁটছে। বাবা এক সময় নিতাই দাদুকে বলে, এ রকম হইলে তো আর বাচন লাগব না খুড়া।
নিতাই দাদু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে, কবে যে ভিটেমাটি থেইকা উচ্ছেদ হই কে জানে। বন্ধকের মেয়াদ তো কবেই ফুরাইয়া গেছে।
বাবা বলে, আমারও তো একই দশা।
নিতাই দাদু বলে, খালি তোর ক্যান, আমাগো সকলের অবস্থাই এক রকম। উপাসের জ্বালায় বিন্তির বাপ মা সেদিন গলায় দড়ি দিলো।
বাবা কী যেন ভাবে। একটু পরে বলে, তোমারে তো সিরামিক কারখানা থেইকা ডাকছিলো। যাইবা?
নিতাই দাদু একটু তেতো হেসে বলে, নারে বাপ, যে কদিন আছি, নিজেগো কামটারে বাঁচাইয়া রাখার চেষ্টা রকুম।
সব কথা বেনুর কানে যায় না। বেনু জানে ওর বাবাও কোনদিন প্লাস্টিক বা সিরামিকের কারখানায় কাজ করতে যাবে না। দিদিমা বলে মোগল বাদশারা আমাগোর কদর করতো। আমাগোর কাম কি এতই ঠুনকা!
বেনুদের ঘরের মাটির দেয়াল প্রায় ধ্বসে পড়েছে। বৃষ্টি হলে ঘর ভেসে যায়। কুমোরপাড়ায় একটা ঘরও আস্ত দাঁড়িয়ে নেই। তবু কেউ বাইরে কাজ করতে যাবে না। এতো দুঃখ বেনুর ভালো লাগে না।
বংশাই নদীর চরে সূর্য ডুবছে। বাতাসে চরের বালিতে ছোট ছোট রূপালি ঘূর্ণি তৈরি হয়। বেনু দূর থেকে লক্ষ্মীকে দেখে।
লক্ষ্মী বেনুকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বেনু ওকে পুতুল দেয়নি বলে ওর দুঃখও কম নয়। বেনু মুখ টিপে হেসে বলে, লক্ষ্মী, তোর লাইগা কি আনছি দ্যাখ।
লক্ষ্মী অভিমান ভুলে বেনুর দিকে তাকায়। বেনুর হাতে পুতুলের ঝুড়ি দেখে অবাক হয়। বলে, এগুলা তুমি বিক্রি কর নাই দাদা?
বেনু ঝুড়ির ভেতর থেকে বর-কনে পুতুল দুটো বের করে। লক্ষ্মীর মুখে হাসি ফোটে। বেনু বলে, এগুলা তোর!
লক্ষ্মী ছুটে এসে পুতুল দুটো নিয়ে বুকে চেপে ধরে। ওর চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে।
বেনু হাসে। হাসতে হাসতে অবাক হয়ে দেখে বর-কনে পুতুল দুটোর মুখ মোটেই গম্ভীর নয় নয়, দিব্যি হাসি-খুশি মুখ, ঠিক লক্ষ্মীর মতো।
দূরে মন্দিরে পূজার ঘন্টা বাজে। লক্ষ্মী হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে বলে, দেখ দাদা, দেখ!’
বেনু চেয়ে দেখে এক ঝাক বক চমৎকার সারি বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। এই বকগুলোর ছবিই সকালে সে এঁকেছিলো। বেনুর মনে হয় বকগুলো যেন ওর বুকের ভেতর থেকে উড়ে গেছে।