৫-৬. নাশতার টেবিলে

সকাল নটায় নাশতার টেবিলে মিষ্টি হেসে নাজমুল টুপুলদের সম্ভাষণ জানালো–সুপ্রভাত বন্ধুরা, রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

লাজুক হেসে টুপুল বললো, দারুণ ঘুম হয়েছে।

জয় বললো, আগের রাতেরটুকু পুষিয়ে নিয়েছি।

তাহলে শুরু করা যাক। আমি এক ঘন্টা ধরে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।

সরি নাজমুল ভাই! বিব্রত গলায় টুপুল বললো, বাড়িতে কখনও এত দেরিতে উঠি না।

বন্ধুকে কখনও সরি বলতে হয় না টুপুল! নাজমুল অভিমান ভরা গলায় বললো, আমার সঙ্গে কি তোমাদের ভদ্রতার সম্পর্ক যে সরি বলবে?

টুপুল তাড়াতাড়ি–সরি আর বলবো না, বলেই সঙ্গে সঙ্গে এতটুকু জিভ কাটলো।

ওর কথা শুনে জয় আর নাজমুল হো হো করে হেসে উঠলো। টুপুল ওদের সঙ্গে হাসতে গিয়ে বিষম খেলো।

টেবিল ভরা নাশতা সাজিয়েছে জোনাবালি। ঘিয়ে ভাজা পরোটা, ফুলকপি আলু, ভাজি, মুরগির দোপেয়াজি, ডবল ডিমের অমলেট, ছানা, কলা, আপেল সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো। টুপুল বললো, জীবনে এমন রাজকীয় ব্রেকফাস্ট করিনি।

নাজমুল কোনো কথা না বলে মৃদু হাসলো। জয় বললো, নাজমুল ভাইকে দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছে আজ।

টুপুলও প্রশংসার চোখে তাকালো। ভোরে উঠে শেভ করেছে নাজমুল। ফরসা মসৃণ গালে হালকা সবুজ আভা, নাম-না-জানা আফটার শেভ লোশনের মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে, গায়ে রাজশাহী সিল্কের নকশাতোলা পাঞ্জারির ওপর সুন্দর কাজ করা চমৎকার কাশ্মিরী শাল। টুপুল বললো, এত সুন্দর শাল আমি জীবনেও দেখি নি।

জয় বললো, নিশ্চয় খুব দামী শাল?

মৃদু হেসে নাজমুল বললো, হ্যাঁ, শালটা একটু দামী। ইন্ডিয়ান টাকায় তিরিশ হাজার পড়েছিলো। তাও চার বছর আগে কেনা। এখন বোধহয় আরও বেড়েছে।

এত দাম! আঁতকে উঠলো টুপুল।

কাশ্মীর থেকে কিনেছিলাম। এটাকে ওরা বলে পশমিনা। কাশ্মীরের একেবারে উত্তর-পূর্বে হিমালয়ের এক কোণে লেহ বলে একটা জায়গা আছে। সেখানেই শুধু পাওয়া যায় দুর্লভ জাতের এই ভেড়া, যাদের নোম দিয়ে পশমিনা তৈরি হয়।

আপনি খুব সৌখিন মানুষ। প্রশংসাভরা গলায় বললো জয়।

বিব্রত হয়ে নাজমুল বললো, শুধু পোশাকের ব্যাপারে সৌখিন বলতে পারো।

খাওয়ার ব্যাপারেও। হেসে যোগ করলো টুপুল।

মোটেই না। নাজমুল প্রতিবাদ জানালো-জোনাবালিকে জিজ্ঞেস করো, একা যখন থাকি তখন দুখানা বাটার টোস্ট আর একটা আপেল নয়তো কলা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারি।

তাহলে এত সব কেন?

মৃদু হেসে নাজমুল বললো, সবই আমার সদ্য পাওয়া মিষ্টি দুই বন্ধুর জন্য।

টুপুল আর জয় লজ্জায় লাল হয়ে দ্রুত নাশতা সারলো। চায়ের পর্ব শেষ করে নাজমুল বললো, তোমরা দুপুরের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ রওনা হচ্ছে। রাতে বর্ডার ক্রস করবে। সঙ্গে অবশ্য লোক থাকবে, কোনো অসুবিধে হবে না।

টুপুল কাল রাত থেকে যে কথাটা বলার জন্য উশখুশ করছিলো সেটা বলে ফেললো–নাজমুল ভাই, যাওয়ার আগে দুটো মানিঅর্ডার করতে চাই ঢাকায়। আপনাকে তো বলেছি ছোড়দির জরি কেনার টাকা আর ক্লাবের চাঁদা নিয়ে এসেছি। ভেবেছিলাম চাকরি পেলে প্রথম মাসের বেতন থেকে পাঠিয়ে দেবো।

নাজমুল ব্যস্ত হয়ে বললে, নিশ্চয় পাঠাবে। তোমরা কোনো চিন্তা কোরো না। ঠিকানা দিয়ে দাও। বিকেলে আমার লোক আসবে। আজই টেলিগ্রাম মানিঅর্ডার করে দেবো। তোমরা বাড়িতে দুটো চিঠিও দিতে পারো–ভালো আছো লিখে। বাড়ির লোকের দুশ্চিন্তা তাহলে কমবে।

গত রাতে সাজ্জাদের কথা উড়িয়ে দিলেও নাজমুল পরে ভেবেছে, খবরের কাগজে যদি টুপুল-জয়ের ছবিওয়ালা হারানো বিজ্ঞপ্তি বের হয় আর সঙ্গে যদি পুরস্কার ঘোষণার কথা থাকে, পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ পাবলিকও কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে। ওদের চিঠি পেলে নিশ্চয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি বেরোবে না।

বাড়িতে চিঠি লেখার আইডিয়া টুপুলদেরও ভালো লাগলো। টুপুল দাদিকে আর জয় মাকে চিঠি দিয়ে জানালো ওরা ভালো আছে। এক সঙ্গে আছে। ওদের জন্য যেন কেউ চিন্তা না করে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই ওরা বাড়ি ফিরবে যাতে অযথা পড়ে পড়ে

কারো মার কিংবা বকুনি খেতে না হয়।

জোনাবালি পোস্ট অফিস থেকে খাম কিনে আনলো। টুপুল আর জয় খামের ওপর ঠিকানা লেখার পর নাজমুল বাঁ দিকের কোনায় ইংরেজিতে এক্সপ্রেস ডেলিভারি লিখে দিলো, বললো, আরএমএস-এ দিলে নাকি কালই পেয়ে যাবে। জোনাবালিকে দিয়েই চিঠি দুটো আরএমএস-এ পোস্ট করার জন্য পাঠানো হলো।

রাজশাহীতে খবরের কাগজ একদিন পরে যায়। আগের দিনের বাসি কাগজে চোখ বুলিয়ে নাজমুল টুপুলদের বললো, তোমরা কি তাস খেলা জানো?

টুপুল আর জয় একে অপরের দিকে তাকালো। ওরা জানে তার বড়রা খেলে, কেউ ওদের শেখায় নি। দুজনই মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। নাজমুল বললো, এসো তোমাদের ব্রিজ খেলা শিখিয়ে দিই।

নাজমুলকে ওরা যত দেখছিলো ততই মুগ্ধ হচ্ছিলো। ওদের সঙ্গে ওর ব্যবহার সত্যিকারের বন্ধুর মতোই, ছোট-বড়র কোনো ব্যবধান নেই। তখন পর্যন্ত শুধু সিগারেটটা অফার করেনি। করলে অবশ্য ওরা খেতো না।

নজমল স্যুটকেস থেকে দারুণ সুন্দর নকশা করা তাসের প্যাকেট বের করলো। কিভাবে ডাকতে হয়, নম্বর কিভাবে গুনতে হয়–ব্রিজ খেলার সবকিছু সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়ে নাজমুল গেম সাজিয়ে বসলো। খেলতে খেলতে টুপুল আর জয় ভাবলো, বাড়ি থেকে পালানোর দুদিনের ভেতর অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে ওদের, যেন ওদের বয়স কয়েক বছর বেড়ে গেছে। ওদের ক্লাসের ছেলেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না আজ রাতে কি দুঃসাহসিক অভিযানে নামতে যাচ্ছে ওরা। বিনা পাসপোর্ট ভিসায় গভীর রাতের অন্ধকারে বিপ্লবীদের গোপন কাগজপত্র নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার কথা ওরা যতবার ভাবছিলো ততবারই রোমাঞ্চিত হচ্ছিলো।

খেলার ফাঁকে টুপুল নাজমুলকে জিজ্ঞেস করলো, যখন আমরা কলকাতা থাকবো সে কদিন কি বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারবো?

নিশ্চয়ই পারবে। মিষ্টি হেসে নাজমুল বললো, প্রতুলকে আমি চিঠিতে লিখে দেবো। তোমাদের যেন কলকাতায় যা যা দেখার আছে সব দেখিয়ে দেয়।

জয় অভিভূত হয়ে বললো, দারুণ হবে!

কিছু যদি কিনতে ইচ্ছে করে কোনো লজ্জা করবে না। প্রতুল আমার বিজনেস পার্টনার। যা বলতে তাই কিনে দেবে।

যা বলবে তাই! বিস্ময়ে টুপুলের চোখ কপালে উঠলো।

যা বলবে তাই। লোকে বলে টাকা দিলে কলকাতায় নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যায়।

বাঘের দুধ কিনে আমরা কি করবো? নিরীহ গলায় জানতে চাইলো জয়।

টুপুল হেসে বললো, খেয়ে দেখলে মন্দ হয় না!

কেন, বাঘের মত ডাকার জন্য? চার পায়ে হাঁটার জন্য?

তাহলে তোমাদের সুন্দর বনের ভেতর দিয়ে বর্ডার ক্রস করতে হবে। দুই বন্ধুর রসিকতায় নাজমুলও হেসে ফেললো।

দুপুরে খাওয়ার পরই ওদের রওনা হতে হলো। থুতনিতে একটুখানি ছাগুলে দাড়ি, মাথায় আধময়লা কিস্তি টুপি, পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবী, তার ওপর বহু পুরোনো কালো একটা কোট গায়ে, কালো পামশু আর লাল নায়লনের মুজো পায়ে শুকনো লিকপিকে এক লোক দুপুরে এসে নাজমুলকে সালাম করে একগাল হেসে বললো, খোকাবাপুরা কি তয়ার হয়েছে?

নাজমুল বললো, তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসে গেছো কাসেদ আলী।

বাসে আগে-ভাগে জাগা লিতে হইবে। সানঝের আগে নদী না পার হইলে অতখানি ঘাঁটা যাবে কি কইরা?

নাজমুল সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে টুপুলদের বললো, তোমরা কি তৈরী হয়েছে?

ওরা খাওয়ার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। শক্ত খামে গালা দিয়ে মুখ আঁটা একটা চিঠি দিয়েছে নাজমুল। সঙ্গে দুটো প্যাকেট ওদের দুজনকে দিয়ে নাজমুল চাপা গলায় বলেছে, এর ভেতর বোমা বানাবার কিছু মশলা আছে। খুব সাবধানে নিতে হবে।

টুপুল উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, ঝাঁকুনি লাগলে ফাটবে না তো?

ঝাঁকুনি লাগলে ক্ষতি নেই। তবে আগুনের ধারে কাছে রেখো না। জবাব দিয়েছে নাজমুল।

ব্যাগের একবারে তলায় ওটা রেখে তার ওপর ওদের জামা কাপড়, টুথপেস্ট, ব্রাশ, চিরুনি, সাবান, তোয়ালে সব গুছিয়ে নিয়েছে। পথে ঠাণ্ডা লাগলে গায়ে দেয়ার জন্য নাজমুল দুজনকে নতুন দুটো কাশ্মিরী শাল দিয়েছে। পশমিনার মত অত দামী না হলেও বোঝা যায় হেলাফেলার জিনিস নয়। নতুন জিন্স-এর শার্ট প্যান্ট, তার ওপর উলের পুলোভারে চমৎকার মানিয়েছে ওদের। রওনা হবার সময় নাজমুল মিষ্টি হেসে ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো, তোমাদের কলকাতা সফর আনন্দের হোক। আশা করছি আগামী মঙ্গল বুধবারে আমাদের দেখা হবে এখানে। এরপর প্লেনে করে সোজা চট্টগ্রাম।

জীবনে প্লেনে চড়ে নি টুপুল আর জয়। দুজনে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরলো নাজমুলকে–আপনি কি ভালো নাজমুল ভাই!

নাজমুল ওদের পিঠ চাপড়ে হেসে বললো, গুড লাক!

কাসেদ আলী ওদের তাড়া দিলো, তাড়াতাড়ি কইর‍্যা চলেন খোকাবাপুরা। বাসের টাইম হইয়া গেছে।

সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে টুপুল গম্ভীর গলায় বললো, দেখুন কাসেদ আলী সাহেব, আমার নাম টুপুল, ওর নাম জয়। আমরা কেউ খোকা নই। আপনি আমাদের খোকা ডাকবেন না।

কাসেদ আলী এতখানি জিভ কেটে বললো, হামি আপনারঘে নফর। হামাকে নাম লিয়া ডাকবেন। সাহেব, আপনি ইগল্যা কহিবেন না। হামি আপনাঘের টুপুল সাহেব আর জয় সাহেব কহবো।

কাসেদ আলীর কথার ধরণ দেখে টুপুল হেসে ফেললো। জয়কে বললো, ভালোই বিপদ দেখছি।

জয় মৃদু হেসে বললো, ভেরি ইন্টারেস্টিং গাই। আই লাইক হিম।

কিছু না বুঝে কাসেদ আলী পানের দাগওয়ালা কালো কালো সব দাঁত বের করে। কান পর্যন্ত লম্বা এক হাসি দিলো।

বাসস্ট্যাণ্ডে এসে দেখলো, একটু আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সপ্রেস বাস ছেড়ে গেছে। পরের লোকাল বাস পঁচিশ মিনিট পর ছাড়বে। টুপুল বললো, অল্পের জন্য বাসটা মিস হলো!

কাসেদ আলী দাঁত বের করা হাসির সঙ্গে বললো, ওইট্যাতে আরামে বসা যাইতক না। পিছে বসলে বাসের ঝাঁকুনির চোটে শরীরের হাড়-মাংস সব আলাধা হইয়ো যাইতক।

যেটা ছাড়বে সেটাতে ওরাই প্রথম যাত্রী। সামনের দুজনের সিটে আরামে বসলো ওরা। কাসেদ আলী বিনয়ের দূরত্ব বজায় রাখার জন্য পাশের সারিতে বসলো। ব্যাগ দুটো ওদের পায়ের কাছে। যখনই মনে হয় ব্যাগের ভেতর বোমা বানাবার বিপদজনক

রাসায়নিক পদার্থ আছে তখনই ওদের হার্টবিট বেড়ে যায়।

তিনটা নাগাদ পুরো বাস বোঝাই হওয়ার পর ড্রাইভার ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো। দেরিতে ছাড়ার জন্য টুপুলরা মনে মনে বিরক্ত হলেও কাসেদ আলী খুশিই হলো। ও জানে টুপুলদের ব্যাগে কোটি টাকার মাল। এদিকের বাসে প্রায়ই বিডিআর চেক করে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ভিসিপি আর যাবতীয় ছোটখাট ইলেকট্রনিকস্ জিনসপত্র এ পথ দিয়ে ভারতে চোরাচালান হয়। যদিও চোরাচালানীদের মাল পাচারের আলাদা রুট আছে–মাঝে মাঝে ওরা লোকাল বাসও ব্যবহার করে ভিড় বেশি হয় বলে। বাসে যাত্রী কম থাকলে বিডিআর-রা সবার ব্যাগ, স্যুটকেস খুলে তন্নতন্ন করে সার্চ করে। যাত্রী বেশি থাকলে তাদের বিরক্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য খুব বেশি সার্চ করে না। তবে কাউকে সন্দেহ হলে কোনো রেহাই নেই। ভালো করে সার্চ করার জন্য অনেক সময় তাদের বাস থেকে নামিয়ে রেখে দেয়া হয়। কিছু না পেলে পরের বাসে তুলে দেয়, আর পেলে সোজা থানায়।

দুটো স্টপেজ পরে বাসে এত বেশি লোক হয়ে গেলো যে পাদানিতে পা রাখার পর্যন্ত জায়গা নেই। কাসেদ আলী আহ্লাদে আটখানা হয়ে পকেট থেকে পানের ডিবে বের করে বাবাজর্দা দিয়ে এক সঙ্গে দুখিলি পান মুখে পুরে পরিতৃপ্তির সঙ্গে চিবোতে লাগলো। ও মনে মনে পথে যে কটা ফাড়া ভেবে রেখেছে এই বাসযাত্রা তার ভেতর একটা।

গভীর আহ্লাদে কাসেদ আলী আপন মনে বেসুরো গলায় নূরজাহানের পুরোনো গান–আ ইন্তেজার হ্যায় তেরা, দিল বেকারার হ্যায় মেরা গাইতে শুরু করেছিলো। অর্ধেক গান না গাইতেই হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে থামতে হলো ওকে। সামনে বিডিআর চেকপোস্ট বসেছে। আচমকা ব্রেক কষাতে কাসেদ আলী নিজেকে সামলাতে না পেরে আঁক করে পাশে বসা মোটাসোটা লোকের ঘাড়ে হুমড়ি খেলো। সেই লোক গিয়ে পড়লো তার স্ত্রীর ঘাড়ে। বোরখা পরা মহিলা চেঁচিয়ে উঠলো, চোখের মাথা খাইছ! নিজেকে সামলে ভদ্রলোক কটমট করে তাকালেন কাসেদ আলীর দিকে।

কাসেদ আলী নার্ভাস গলায় শুধু বললো, বিডিআর।

লোকটা বিরক্ত হয়ে বললো, বিডিআর কি বাঘ-ভালুক, না আমি চোর-বাটপার যে নাম শুনলে ডরামু?

ততক্ষণে বিডিআর-এর জোয়ানরা বাসে উঠে তল্লাসি শুরু করেছে। ভদ্রলোকের শেষের কথা কানে যেতে একজন ওদের দিকে এগিয়ে এলো কোথায় চোর-বাটপার দেখি?

কাসেদ আলীকে দেখিয়ে লোকটা বললো, অরে জিগান বিডিআর-এর কথা শুইন্যা গান গাওন বন্ধ ওইয়া গ্যাছে ক্যা?

কি গান? জানতে চাইলো বিডিআর ।

নূরজাহানের গান-ইন্তিজার হ্যায় তেরা গাইতাছিলো।

আপনি কি করেন ইন্তেজার মিয়া? প্রশ্ন করা হলো কাসেদ আলীকে।

আমার নাম কাসেদ আলী। আমের কারবারি।

আপনার ব্যাগটা বের করেন।

হামার কুনো ব্যাগ-ট্যাগ নাইখো।

বিডিআর-এর আরেকজন লোক টুপুল আর জয়কে বললো, আপনাদের ব্যাগ দুটো খুলুন।

কাসেদ আলীর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। আড়চোখে টুপুল আর জয়কে দেখে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মনে মনে সুরা এখলাস পড়তে লাগলো। কাসেদ আলী এই সুরার ফজিলত জানে। তিনবার সুরা এখলাস পড়া একবার কোরান খতমের সমান।

ব্যাগের তালা খুলে চেইন টানতে গিয়ে টুপুল আর জয় দুজনই ঘেমে গেলো। যদিও লোকটা ওদের খোকা না বলে আপনি বলেছে, শুনতে ভালো লাগতো যদি না ব্যাগ খুলতে বলতো।

চেইন খোলার পর বিডিআর–এর লোকটা ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো ভেতরে কি আছে?

টুপুল ওপরের কাপড়-চোপড় বের করতে করতে বললো, আমাদের জামাকাপড়।

জয় ওর জামাকাপড় দেখাতে গিয়ে ইচ্ছে করেই নতুন কেনা সাবানটা ফেলে দিলো, যেন হাত থেকে ফসকে পড়ে গেছে।

বিডিআর-এর লোকটা জয়ের সাবান কুড়িয়ে হাতে দিয়ে আবার প্রশ্ন করলো, কোথায় যাবেন আপনারা?

টুপুল জবাব দিলো–চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাচার বাড়িতে। আর বেশি কিছু বললো না, যদিও নাজমুল তথাকথিত চাচার নাম-ঠিকানা সব বলে দিয়েছিলো।

ঠিক আছে। বলে পেছনের দিকে এগিয়ে গেলো জোয়ানটা।

ততক্ষণে কাসেদ আলীর সুরা এখলাস তিনবার পড়া শেষ করেছে। ওর মনে হলো সুরা এখলাসের কারণেই এবারের ফাঁড়াটা কেটেছে। হাঁপ ছেড়ে পকেট থেকে পানের ডিবে বের করে আবার দুখিলি একসঙ্গে মুখে গুজলো। বাস ছাড়ার পর আড়চোখে পাশের লোকটাকে দেখে আপন মনে বললো, বাসে গান গাহা কেহু মানা কহে নি। হামার যত খুশি হামি গান করবো।

টুপুল আর জয় কাসেদ আলীর রাগ আর অভিমান উপভোগ করছিলো। জয় জিজ্ঞেস করলো, এবার কি গান হবে ইন্তেজার আলী?

কাসেদ আলী ঢক করে পানের পিকটুকু গিলে পুরোনো হিন্দি ছবির গান ধরলো–ইচিক দানা, বিচিক দানা, দানা উপ্পর দানা–

কাসেদ আলীর পাশে বসা মোটা লোকটা এসব উৎপাত পছন্দ না করলেও অন্যদের আগ্রহ দেখে গোল মুখখানা আরো গোল করে চুপচাপ বসে রইলো। টুপুলদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই দারুণ মজা লাগছিলো। ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে এভাবে রেহাই পেয়ে ওরা কাসেদ আলীর বেসুরো গানের সমঝদার হয়ে ওকে একের পর এক গাইবার জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলো। বাসের অন্য যাত্রীরাও দুটি মিষ্টি চেহারার কিশোরের আনন্দে বাধা দিতে চাইলো না।

দেড়ঘন্টা পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসে যখন ওরা নামলো সূর্য তখন মহানন্দা নদীর ওপারে ডোবার আয়োজন করছে। কাসেদ আলী বললো, ফেরি পার হইয়্যে হামারঘের টেম্পো ধইরতে হবে।

বাসের বেশির ভাগ যাত্রী এপারেই রয়ে গেলো। টুপুলদের সঙ্গে জনাচারেক ফেরিতে উঠলো। ফেরি ছাড়ার পর জয় বললো, ঢাকায় আমাদের বন্ধুরা এখন কাগজিটোলা ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছে। অথচ আমরা কোথায়!

টুপুল বললো, তোর কি বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে?

আমি বুঝি তাই বললাম? আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারের কথা কোনোদিন যদি ওরা শোনে–হিংসেয় পেট ফেটে মরে যাবে।

ফেরিতে মহানন্দা পেরিয়ে ওরা একটা টেম্পো পেয়ে গেলো। যাত্রী ওরা তিনজনই। টেম্পোওয়ালা বললো, পরের ফেরি এলে ও গাড়ি ছাড়বে। কাসেদ আলী বললো, হামারঘের দেরি হইয়ে যাবে। বাকি তিনজনের ভাড়া হামি দেবো। তুমি গাড়ি ছাড়।

বারঘরিয়ার অর্ধেকের বেশি রাস্তা পাকা ছিলো, আরামেই আসছিলো ওরা। হঠাৎ সন্তোষপুরে এসে বাঁ দিকে ইট বিছানো রাস্তায় টার্ন নেয়ার পর ওদের খবর হয়ে গেলো। পুরো রাস্তা উঁচু-নিচু, যেখানে সেখানে ইট খোয়া উঠে গর্ত হয়ে গেছে। টেম্পো চলছিলো এক পা খোঁড়া কুকুরের মত লাফাতে লাফাতে। টুপুল কাসেদ আলীকে বললো, বাকি রাস্তাটুকু হেঁটে গেলে হয় না?

পারবেন দু মাইল হাঁটতে?

কাসেদ আলীর প্রশ্ন শুনে ওরা ঠোঁট উল্টালো–দু মাইল কোনো দূর হলো নাকি।

টেম্পো বিদায় করে ওরা দুপাশে কুয়াশা ঢাকা ন্যাড়া ধান ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে আলপথে শর্টকাট ধরলো। কাসেদ আলী জোর করে ওদের ব্যাগ দুটো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। নাজমুল যদি শোনে টুপুলদের দু মাইল হাঁটিয়েছে, কাসেদ আলীকে আস্ত রাখবে না।

আকাশে যখন রূপোলি থালার মতো ঝকঝকে চাঁদ দেখা গেলো তখন ওরা মস্ত এক আম বাগানের ভেতর বড়সড় মাটির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তিন পাশে ঘর, মাঝখানে উঠোন। উঠোনে ওদের দাঁড়াতে দেখেই ভেতর থেকে সাদা চুলদাড়িওয়ালা এক বুড়ো বেরিয়ে এলো। কাছে এসে চাপা গলায় বললো, কাসেদ আলী, সর্বনাশ হয়েছে। আজ সকাল থেকে পুরো বর্ডার সিল করে দিয়েছে, বিডিআরের এক বড় সাহেব নাকি এসেছে।

.

০৬.

আপনারা সবভাই তাহিলে কহিছেন দুদিন হামারঘের এরম গা ঢাকা দিয়্যা থাকতে হইব্যে?

কাসেদ আলীর প্রশ্ন শুনে চারপাশে যারা বসেছিলো তারা সরদার সাহেবের দিকে তাকালো।

রাত তখন সাড়ে দশটা। তিনঘন্টা আগে নারায়নপুর এসে বুড়ো নইমুদ্দিনের মুখে বিপদের কথা শুনে ওরা আর ওখানে অপেক্ষা করে নি। আমবাগানের ভেতর দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে পনেরো মিনিট হেঁটে সরদার আলী আসগরের বাড়িতে এসে উঠেছে। এ এলাকায় সবচেয়ে নিরাপদ বাড়ি এটা। বহুদিন সংস্কার না করা সাবেকি ধরনের দোতালা বাড়ি। সরদার আলি আসগর শুধু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নয়, নাজমুলদের দলের সঙ্গেও জড়িত। কাসেদ আলীর গলার আওয়াজ শুনে নিজেই বেরিয়ে এসে ওদের ভেতরের এক ঘরে নিয়ে বসিয়েছে। সরদারের বয়স নাজমুলের চেয়ে কম হলেও ঘাড়ে-গর্দানে প্রচুর চর্বি আর গোলগাল একটা ভুড়ি থাকার কারণে মনে হয় চল্লিশের ওপর বয়স। কাসেদ আলীর কাছে নইমুদ্দিনের বিপদের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে বললো, উ যদি সাহস না করে তাহিলে তো মুশকিল! তাও হামি আর সভারি খবর পাঠাছি। আপনারা হাতমুখ ধুইয়্যা খাওয়া-দাওয়া করেন। দেখি কি করা যায়।

দেখা-দেখির কিছু নাই। যে কইর‍্যাই হউক হামারঘেরকে পার হইতে হইবে। শুকনো আদেশের গলায় বললো কাসেদ আলী, হামারঘের পার না কইর‍্যা আক্কাস ভাই যাইবেন না।

সরদারের হাঁকডাকে টুপুলদের বয়সী একটা কাজের ছেলে ছুটে এলো। ওকে মেহমানদের দেখাশোনা করার নির্দেশ দিয়ে নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দশ মিনিটের ভেতর বালতিতে করে মুখ-হাত ধোয়ার পানি, সাবান, গামছা সব নিয়ে ভেতরের বারান্দায় নিয়ে গেলো ওদের। মুখ ধুতে গিয়ে টুপুলরা টের পেলো বালতিতে গরম পানি মেশানো হয়েছে। মুখ-হাত ধোয়া শেষ হলে রুস্তম জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কি চা খাইবেন এখন?

পেলে তো ভালোই হয়। বলে কাসেদ আলীর দিকে তাকালো টুপুল।

কাসেদ আলী ব্যস্ত গলায় বললো, তাড়াতাড়ি চা আন। এরা সব শহরের মানুষ। ঘন্টায় ঘন্টায় চা লাগে।

রুস্তম চলে যাওয়ার পর জয় হেসে বললো, কক্ষনো আমাদের ঘন্টায় ঘন্টায় চা লাগে না কাসেদ আলী।

কাসেদ আলী খুব চিন্তিত ছিলো। জয়ের কথার কোনো জবাব দিলো না। চা খেয়ে জয় আর টুপুল ঘরের অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকা বনেদি এক পালঙ্কে উঠে বসলো।

হারিকেনের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা না গেলেও সরদারদের অবস্থা যে খুব ভালো এটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হলো না ওদের।

আপনারা আরাম করেন। হামি একটু ঘুইর্যা আসছি। এই বলে কাসেদ আলী তখন যে বেরিয়েছে ফিরেছে একটু আগে। ততক্ষণে রুস্তম ঘরের মেঝেতে দস্তরখান বিছিয়ে ওদের তিনজনের জন্য খাবার এনে সাজাতে শুরু করেছে।

কাসেদ আলীর সঙ্গে সরদার আলী আসগর আর দুটো অচেনা লোক এসেছে। কাসেদ আলী টুপুলদের সঙ্গে নিচে বসলো।

টুপুলদের প্লেটে ভাত-তরকারি তুলে দিচ্ছিলো রুস্তম। চেয়ারে বসে তদারক করছিলো সরদার। বিনয় দেখিয়ে ওদের বললো, গরিবের বাড়িতে সামান্য ব্যবস্থা। নিজের বাড়ি মনে কইর‍্যা খান আপনারা।

আয়োজন মোটেই সামান্য ছিলো না। মস্তবড় এক বাটি মুরগীর মাংস, ডিমের ঝোল, সবজি ভাজি আর দুরকমের ডাল। টুপুল বললো, এসব যদি সামান্য হয় তাহলে আর বাকি থাকলো কি।

খেতে গিয়ে জয় আর টুপুল টের পেলো মুরগি আর ডিম দুটো আগুনের মতো ঝাল। একটুখানি মুখে দিতেই ওদের নাক আর চোখের পানি একাকার হয়ে গেলো। তখনই কাসেদ আলী প্রশ্নটা করলো।

ওর প্রশ্ন শুনে সরদার একটু ভেবে বললো, হামি কুনু রকম ঝুঁকি ল্যাওয়ার পক্ষপাতি লই। দুদিন দেরি হইল্যে যুদি ঝামেলা কাটে ক্ষতি কি! জানি কুটুমের এখ্যান একটু অসুবিধা হইবে। তাউ আর কুনু উপায় তো দেখছি না।

ফোঁৎ করে নাকের পানি টেনে টুপুল বললো, আমাদের অসুবিধে হবে না।

কাসেদ আলী আপন মনে চিন্তিত গলায় বললো, কইলকাতার পার্টি না ফের বিগড়া যায়।

কেউ ওর কথার কোনো জবাব দিলো না। একটু পরে কাসেদ আলী আবার বললো, সরদার সব কিছু ভাইব্যা চিন্তা কহো কুটুমের এখানে থাকা কতটুকুন নিরাপদ?

অন্য যে কুনু বাড়ির চাহিতে হামার বাড়ি নিরাপদ। সরদারের গলায় আত্মতৃপ্তি– এখ্যানে থাইকল্যে কাকপক্ষিও টের পাইবে না।

ঠিক আছে। খেয়ে উঠে বড় গামলায় হাত ধুতে ধুতে কাসেদ আলী বললো, কাইল হামি তাহিলে রাজশাহী থেইক্যা ঘুইরা আসি। খবরটা ছোট হুজুরকে কহা দরকার।

খাওয়ার পর এঁটো থালাবাসন সব তুলে নিয়ে রুস্তম বড় পালঙ্কে মশারি এনে লাগালো। কাসেদ আলী টুপুলদের বললো, আপনারা এ ঘরে নিন্দ যাইবেন। চিন্তার কুনু কারণ নাই। আমি অন্য ঘরে নিন্দ যাছি।

বহুদূরে একটা-দুটো শেয়ালের ডাক আর মাঝে মাঝে ঝিঁঝি পোকার শব্দ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও কোনো শব্দ নেই। ঘরের জানালা বন্ধ থাকলেও উপরের ঘুলঘুলি দিয়ে যেভাবে হুহু করে বাতাস ঢুকছিলো তাতেই লেপ-তোশক-বালিশ সব ভিজে ভিজে হয়ে আছে। ওসবের পরোয়া না করে টুপুলরা লেপের তলায় ঢুকলো। হারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে রুস্তম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

নতুন জায়গায় ঘুম আসতে দেরি হওয়ার জন্য সকালে টুপুল আর জয় উঠলো দেরি করে। দেয়ালে ঝোলানো পুরোনো এক ঘড়িতে ঘড় ঘড় করে নটার ঘন্টা বাজলো। ওদের ওঠার শব্দ হতেই রুস্তম এসে ঘরে ঢুকলো। বললো, হাত-মুখ ধুইয়া ল্যান। নাশতা রেডি হইয়া গেছে।

টুপুল হাই তুলতে তুলতে বললো, এ বাড়িতে তুমি কদ্দিন ধরে আছো রুস্তম?

চমকে উঠে রুস্তম টুপুলের দিকে তাকালো। তারপর কোনো কথা না বলে ও হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। টুপুল অবাক হয়ে–স্ট্রেঞ্জ বলে জয়ের দিকে তাকালো। জয় কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট ওল্টালো।

নাশতা ওদের ঘরেই দেয়া হলো। রুস্তমের গম্ভীর চেহারা দেখে টুপুল ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না জয় বললো, নাজমুল ভাই কি বলেছিলেন মনে আছে? কোনো বিষয়ে যেন কৌতূহল না দেখাই।

টুপুল আপন মনে বললো, বাড়ির চাকর কদ্দিন কাজ করে এটা গোপন করার মতো খবর নাকি!

পরোটা, আলুভাজি আর ডিম দিয়ে আয়েশ করে নাশতা সারলো। একটু পরে রুস্তম এসে দুকাপ চাও দিয়ে গেলো। চা শেষ করতেই সরদার এসে ঘরে ঢুকলো। একটু অপরাধী গলায় বললো, কাঙ্গালের বাড়িতে আইসছেন। চাইরদিকে একটু ঘুইর্যা বেড়াতে কহবো তারও উপায় নাই।

টুপুল ব্যস্ত গলায় বললো, বেড়াবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আমরা ঘরের ভেতর খুব আরামে আছি।

ঘরে বইস্যা গান শুনতে পারেন। হামি টুইন ওয়ান পাঠিয়ে দিছি। এই বলে সরদার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

একটু পরে রুস্তম আলী মাঝারি সাইজের একটা টু-ইন-ওয়ান আর সাত আটটা ক্যাসেট দিয়ে গেলো। দুটো মোহাম্মদ রফি আর রুনা লায়লার, বাকি সব পাকিস্তানী সিনেমার গান। দুপুর পর্যন্ত ক্যাসেট বাজিয়ে শুয়ে-বসে কাটালো টুপুল আর জয়। একটার দিকে রুস্তম ওদের নিয়ে গেলো বাড়ির ভেতরের গোসলখানায়। দেখেই বোঝা যায় এটা মেয়েদের জন্য। একটু অস্বস্তি লাগলেও করবার কিছু নেই। বালতিতে গরম পানি ছিলো। ঝটপট গোসল সেরে ওরা নিজেদের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ততক্ষণে রুস্তম মেঝেতে পাটি বিছিয়ে দুপুরের খাবার সাজিয়েছে।

টুপুলরা খেতে বসার পর দরজার কাছে চুড়ির শব্দ শুনলো। ওদিকে তাকাতেই রুস্তম বললো, হামারঘে বেগম সাহেব।

বড় ঘোমটা টানা ছোটখাট বেগম সাহেব ঘরে এসে ঢুকলো। রুস্তমকে ইশারায় যেতে বলে নিজে ছোট মোড়াটায় বসলো। ঘোমটা ছোট করে বললো, শুনলাম ঝাল বেশি হয়েছে বলে কাল তোমরা কিছু খেতে পারো নি। তুমি বলে ফেললাম, কিছু মনে কোরো না। তোমরা আমার ছোট ভাইয়ের বয়সী।

টুপুল ব্যস্ত হয়ে বললো, আমাদের তুমিই বলবেন আপা। আজকের রান্না খুব সুন্দর হয়েছে।

বেগম সাহেব মৃদু হেসে ওদের পাতে দুটুকরো রুই মাছ তুলে দিয়ে বললো, আজ আমি রান্না করেছি। এদিকে মাছ পাওয়া যায় না। সকালে জেলে ডাকিয়ে মাছ ধরিয়েছি। তোমাদের দেখে আমার ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেছে।

কোথায় থাকে আপনার ভাই?

ছিলো, মুর্শিদাবাদে। আমাদের বাড়ি ওখানে জলঙ্গিতে। দুবছর আগে ভাইটা নৌকা ডুবে মারা গেছে। বলতে গিয়ে বেগম সাহেবের গলা ভারি হয়ে এলো।

টুপুল সমবেদনার গলায় বললো, আপনার আর কোনো ভাই নেই?

টুপুল আর জয় কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেতে লাগলো। বেগম সাহেব ওদের পাতে দুহাতা মুড়িঘন্ট তুলে দিয়ে বললো, লজ্জা কোরো না। পেট ভরে খাও। তোমরা বুঝি ঢাকা থাকো?

মুখ ভর্তি ভাত ছিলো। টুপুল মাথা নেড়ে সায় জানালো। বেগম সাহেব আবার প্রশ্ন করলো, এদের সঙ্গে কদ্দিন ধরে আছো?

বেশি দিন নয়। পরীক্ষা ভালো হয় নি বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। নাজমুল ভাই-র সঙ্গে স্টিমারে দেখা। সেই থেকে ওঁর সঙ্গে আছি।

তোমরা যা করছো, সবকিছু বুঝে শুনে করছো তো?

টুপুল কি বলবে ঠিক করতে পারলো না। ওর মনে হলো এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে গেলে গোপনীয়তার শর্ত ভাঙা হবে। বেগম সাহেবের কথার জবাবে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানালো।

বেগম সাহেব আবার বললো, একাজে কি রকম বিপদ জানা আছে?

এবারও টুপুল মাথা নেড়ে সায় জানালো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেগম সাহেব আপন মনে বললো, কে জানে কোন্ মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন তোমরা।

টুপুল নিচু গলায় বললো, আমার মা নেই। জয়ের আছে।

মা না থাকলেও বাবা তো আছেন?

জয় শক্ত গলায় বললো, বাবা আমাকে দুচোখে দেখতে পারেন না।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বেগম সাহেব চাপা গলায় বললো, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।

এমন সময় বাইরের বারান্দায় সরদারের গলা শোনা গেলো, রুস্তমকে ডাকছে। বেগম সাহেব চমকে উঠে টুপুল আর জয়কে অবাক করে দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

খেয়ে উঠে বিছানার লেপের তলায় ঢুকে টুপুল বললো, বেগম সাহেবের কথা শুনে মনে হচ্ছে বিপ্লবীদের গোপন কাজ তিনি পছন্দ করেন না।

জয় বললো, তাতে কি! মেয়েরা কোনো ঝামেলার কাজেই পছন্দ করে না।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে টুপুল বললো, তোর কি মনে হয় আমরা ভুল করতে যাচ্ছি?

না। হাই তুলে জয় বললো, অনেকে বিপ্লব চায় না। সমাজটা বদলাতে চায় না। কিন্তু আমি চাই।

জয়কে হাই তুলতে দেখে টুপুল আর কথা বাড়ালো না। নাজমুলের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হয়েছে সমাজটা বদলানো দরকার। একই সঙ্গে একটু আগে হঠাৎ পরিচিত অচেনা বোনটির কথাও ওর বুকের ভেতর খচখচ করতে লাগলো। ওর কথা শুনে মনে হয়েছে ওরা বুঝি ভীষণ অন্যায় কোনো কাজ করতে যাচ্ছে।

টুপুলরা যখন রাতের খাওয়া শেষ করেছে তখনই কাসেদ আলী ফিরলো রাজশাহী থেকে। সরদার ওদের খাওয়া তদারক করছিলো। কোন রকম ভূমিকা না করে কাসেদ আলী সরদারকে বললো, যে কইর‍্যা পারো আইজ রাইতেই হামারঘে পার করার ব্যবস্থা করো। দেরি কইরল্যে অবস্থা আরো খারাপ হইবে।

কি খারাপ হইবে? প্রশ্ন করলো সরদার।

তোমার এ বাড়িও নিরাপদ নয়। শুকনো গলায় বললো কাসেদ আলী।তোমার বাড়ি থাইক্যা মাল ধরা পড়লে খুবই বিপদ হইবে।

ঠিক আছে আমি তোরাপ আর নইমুদ্দিনকে এখনই খবর পাঠাছি। আসল লোক তো অরাই।

যা করার তাড়াতাড়ি কর। এই বলে কাসেদ আলী টুপুলদের দিকে তাকালো–আইজ রাইতে যাইত্যে কি অসুবিধা হইবে আপনারঘে?

অসুবিধা কিসের? টুপুল শান্ত গলায় বললো, আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসল ঠিকানায় পৌঁছতে।

আধঘন্টা পর সরদারের সঙ্গে জনাচারেক লোক ঘরে ঢুকলো। গতকালের বুড়ো নইমুদ্দিন ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারলো না টুপুলরা। কাসেদ আলী সবাইকে নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে কি শলা-পরামর্শ করলো তার কিছুই জানা গেলো না। আধঘন্টা পর কাসেদ আলী এসে বললো, আপনারঘে ব্যাগ রেডি আছে তো?

টুপুল আর জয় যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে বসেছিলো। কাসেদ আলীর কথা শুনে ওরা ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালো। রুস্তম আড়ালে কোথাও ছিলো। টুপুলদের ব্যাগ তুলতে দেখে ও এগিয়ে এলো–হামাকে দ্যান। আমি আগিয়া দি।

কাসেদ আলী রুস্তমকে চাপা গলায় ধমক দিলো–তুই ভিতরে যা। এটা তোর কাম লয়।

মুখ কালো করে চলে গেলো রুস্তম। জয় আর টুপুলের মনে হলো বেচারাকে এভাবে ধমক না দিলেও চলতো। প্রথম বারের মত কাসেদ আলীর ওপর রাগ হলো ওদের।

সরদার বাড়ির চারপাশে বিশাল আমবাগান। এ মাথা থেকে ও মাথা পাহারা বসানো হয়েছে। টুপুল আর জয়ের চোখে না পড়লেও কাসেদ আলীর চোখে ঠিকই পড়েছে। বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত এসে ওদের বিদায় দিয়েছে সরদার। ওদের সঙ্গে বাড়তি লোক বলতে শুধু নইমুদ্দিন। আমবাগানের ভেতর জ্যোত্সা আর কুয়াশার লুকোচুরি খেলা চলছে। চারপাশের পরিবেশ ছিলো অদ্ভুত মায়াময়। টুপুল আর জয় সরদার বাড়ি থেকে বেরোবার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কায় এমনই উৎকণ্ঠিত ছিলো যে, বাগানের ভেতর জ্যোৎস্নার অপরূপ আল্পনাও ওদের চোখে পড়লো না। নিঃশব্দে দ্রুত হাঁটছিলো ওরা।

মিনিট পনেরো হাঁটার পর দূরে একটা টর্চের আলো দুবার জ্বলে নিভে গেলো। নইমুদ্দিনের হাতের ইশারায় সঙ্গে সঙ্গে সবাই আম গাছের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো পাথরের মূর্তির মত। কিছুক্ষণ পর যেন মাটি খুঁড়ে বের হলো কালো চাদর মোড়া এক লোক। নঈমুদ্দিনের কানে কানে কি যেন বললো। নইমুদ্দিন সেই কথাগুলো আবার কাসেদ আলীর কানে ফিসফিস করে বললো। কালো চাদর মোড়া লোকটা যেভাবে এসেছিলো সেভাবে উধাও হয়ে গেলো। ওরা একক্ষণ হাঁটছিলো পশ্চিম মুখ করে। এবার দিক পরিবর্তন করে ওরা দক্ষিণ দিকে হাঁটলো। এদের সতর্কতা দেখে টুপুল আর জয় দুজনই স্বস্তি বোধ করলো। ওদের বুকের ওপর চেপে থাকা উদ্বেগের ভারি বোঝাটা অনেক হালকা হয়ে গেলো।

কোথাও না থেমে একটানা চারঘন্টা হাঁটার পর ওরা এক ভোলামেলা প্রান্তরের কিনারায় এসে দাঁড়ালো। ততক্ষণে চাঁদ ডুবে গেছে পশ্চিমের ঘন কালো আমবাগানে। আকাশ জুড়ে লক্ষ তারার মেলা। কাসেদ আলী এতক্ষণ ধরে ওর জানা যাবতীয় সুরা আর দোয়াদরুদ কয়েকবার পড়ে শেষ করেছে। এবার হালকা গলায় বললো, আল্লার রহমতে বালা-মুসিবত দূর হয়েছে।

নইমুদ্দিন বললো, আমাকে কি আরো যাইতে হইবে?

না না! অমায়িক গলায় কাসেদ আলী বললো, তোমাকে আর কষ্ট দিবো না। পদ্মার ওপারে হামারঘে লোক আছে।

নইমুদ্দিন চলে যাবার পর টুপুল বললো, পদ্ম কতদূর এখান থেকে?

নরম বালির ওপর হাঁটতে হাঁটতে কাসেদ আলী বললো, হামরা পদ্মার ওপর দিয়া হাঁটছি।

ঠাট্টা করছো কেন?  আমি পদ্মা নদীর কথা বলছি।

ঠাট্টা লয় মিয়া। কাসেদ আলী শান্ত গলায় বললো, ফারাক্কা বাঁধ পদ্মা নদীকে এভাবে গলা টিপ্যা খুন কইর‍্যাছে। এইখান থাইক্যা মাইল দশেক উজানে গেলেই ফারাক্কা।

শুকিয়ে যাওয়া পদ্মার করুণ চেহারা দেখে টুপুলের খারাপ লাগলো। মিনিট দশেক হাঁটার পর এক চিলতে নালার মত পানি বয়ে যেতে দেখলো। জুতো খুলে পার হলো ওরা। হাঁটুও ডুবলো না। চারপাশের জমাটবাধা কুয়াশা। টুপুল বললো, এই কুয়াশায় পথ চিনবে তো কাসেদ আলী?

কাসেদ আলী যেতে যেতে বললো, ই ঘাটা হামার হাতের তাইলার মতন মুখস্থ। আজ রাইতে কুয়াশা আল্লার রহমত হইয়্যা নাইম্যাছে।

আরো পঁচিশ মিনিট হাঁটার পর হঠাৎ করেই গাছপালা ঘেরা গ্রাম ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

টুপুল বললো, ইন্ডিয়া আর কতদূর কাসেদ আলী?

ততক্ষণে ওরা একটা টিনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কাসেদ আলী বললো, হামরা এখন ইন্ডিয়ায়। তারপর গলা তুলে ডাকলো, নিবারণ বাড়িতে আছো?