৭-৯. কফিনের লাশ উধাও

০৭. কফিনের লাশ উধাও

তার মানে তুমি বলতে চাইছো গ্রামের লোকদের ধারণা অমূলক নয়? চিন্তিত গলায় স্বপনকে প্রশ্ন করলেন ডার স্পিগেল পত্রিকার জাঁদরেল সাংবাদিক উলরিখ।

রাতে ডিনার সেরে হোটেল জেরানিয়ামের তিন তলায় স্বপনদের লিভিং রুমে বসেছিলো সবাই। টিটলিঙ থেকে দুপুরের আগেই ফিরেছে স্বপনরা। সেদিন সকালেও নদীর ধারে এক জিপসি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। আগেরগুলোর মতোই, সারা শরীর কাগজের মতো সাদা, গলার বাঁ পাশে দাঁতের কামড়ের দাগ। স্বপনের গাড়ি ঠিক করতে বেশি সময় লাগেনি। ভেবেছিলো জাদুঘরে গিয়ে এর আগে নিহত পিটারের মার সঙ্গে কথা বলবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আরেকটা মৃত্যুর সংবাদ শুনে টিটলিঙে থাকা ঠিক মনে করেনি ওরা। ডেগেনডর্ফ ফিরে এসে বাবাকে সব খুলে বলেছে স্বপন। বাবা শুনে বললেন, এভাবে একটার পর একটা মানুষ খুন হচ্ছে, বাইরের কেউ কিছু জানে না এটা কেমন করে হয়? আমি উলরিখকে ফোন করছি। ও এখনও মিউনিখ আছে। খবরটা পত্রিকায় বেরুনো দরকার।

বাবার টেলিফোন পেয়ে উলরিখ সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছেন। ডেগেনডর্ফ পৌঁছেছেন ডিনারের সামান্য আগে। ডিনার শেষে স্বপনের সব কথা শুনে তিনি মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন। বললেন, বিংশ শতাব্দী শেষ হতে চলেছে, এখনও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে মধ্যযুগের ভ্যাম্পায়াররা বেঁচে আছে?

স্বপন একটু ইতস্তত করে জবাব দিলো–আমি নিজেও বিশ্বাস করতে চাই না। সকালে মিস্তিরি যখন গাড়ি সারাচ্ছিলো শীলা আর রনিকে গাড়ির কাছে রেখে আমি ভাঙা দুর্গের ভেতরে গিয়েছিলাম, মাটির নিচের কামরায় কফিনের ভেতর শোয়ানো কালো পোশাক পরা মাঝ বয়সী একজনের মৃতদেহ নিজ চোখে দেখেছি। ঠোঁটের পাশে রক্তের দাগও ছিলো। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো ঘুমন্ত মানুষ, এক্ষুণি বুঝি জেগে উঠবে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা আর শক্ত।

গ্রামের লোকেরা পুলিসে খবর দিচ্ছে না কেন?

ওরা মনে করে অশরীরী আত্মার বিরুদ্ধে পুলিস কিছু করতে পারবে না।

ভালো কথা, তোমাদের এখানে যে ফিল্ম কোম্পানির লোকরা এসেছিলো ওরা কি আজও ওদিকে শুটিং-এ গেছে?

কোনদিকে গেছে জানি না। তবে কালকের মতোই সকালে বেরিয়েছে। কাল ওদের টিটলিঙ যাওয়ার কথা ছিলো, যায়নি।

জিজ্ঞেস করোনি কোথায় গিয়েছিলো?

না, করিনি। ওরা যদি সত্যি সত্যি ক্রিমিনালদের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাহলে বেশি প্রশ্ন টশ্ন করলে সতর্ক হয়ে যেতে পারে।

চিন্তিত মুখে কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে সায় জানালেন উলরিখ।

তুমি কি টিটলিঙের এসব খুনের ঘটনা নিয়ে তোমাদের পত্রিকায় কিছু লিখবে?

স্বপনের বাবার প্রশ্ন শুনে উলরিখ কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন, দেখো শফিক, পত্রিকায় আমি যদি ভ্যাম্পায়ার আর অতৃপ্ত আত্মাদের কথা লিখি লোকে আমাকে পাগল ভাববে। এসব হত্যার পেছনে যদি সংঘবদ্ধ কোনো দল থাকে, গ্রামের লোকের সহযোগিতা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারবো না। কারণ ছাড়া শুধু রহস্যজনক হত্যাকান্ড বলে দায়সারা রিপোর্টিং করার বয়স অনেক আগে পেরিয়ে এসেছি। আমার সমস্যাটা আশা করি কোথায় বুঝতে পেরেছে।

স্বপন বললো, গ্রামের যারা মারা গেছে তাদের আত্মীয় স্বজনদের যদি বুঝিয়ে বলি তাহলে হয়তো তারা কিছু তথ্য দিতে পারে, এখন যা গোপন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে টিটলিঙ জাদুঘরের টিকেট চেকার বিধবা এঞ্জেলা গিফানের একমাত্র ছেলে মারা গেছে। আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি।

মন্দ বলো নি! সায় জানালেন উলরিখ–কালই চলে। সবাই মিলে টিটলিঙের জাদুঘরটা দেখে আসি! কী বলো শফিক?

মৃদু হেসে বাবা বললেন, তুমি বরং ছেলেদের নিয়ে যাও। ইভা আর আমি দুজনই কাল ব্যস্ত থাকবো।

বাবার কথা শুনে অভিমান হলো শীলার–ছেলেরা মজা করে ঘুরবে আর আমি বুঝি স্কুল ছুটির দিনগুলো ঘরে বসে কাটাবো!

তুমিও যাবে বৈকি! বাবা হাসলেন–ছেলেদের বলতে আমি ছোটদের বুঝিয়েছি।

আমরা এখন আর ছোট নেই।

শীলার কথা শুনে বাবা গলা খুলে হাসলেন। বললেন, স্কুল ছুটির দিনগুলো মনে হচ্ছে ভালোই কাটবে তোমাদের। তোমার মত কী রনি?

রনি খুশি হতো বাভারিয়ার ঐতিহাসিক দুর্গে ডালমানরা কিভাবে শুটিং করছে সেসব দেখতে পেলে। স্বপনের মার কথায় ও কাষ্ঠ হেসে বললো, তাইতো মনে হচ্ছে।

পরদিন সকাল নটায় স্বপন ওদের বড় গাড়িটা নিয়ে টিটলিঙ এলো। আসার পথে উলরিখ ওদের বার বার সাবধান করে দিয়েছেন–কথা যা বলার আমি বলবো। তোমরা এসব খুনোখুনির ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না।

টিটলিঙের জাদুঘরটাও পুরোনো একটা দুর্গে। তবে বেশি পুরোনো নয়। বাভারিয়ার রাজাদের বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আর প্রাসাদে ব্যবহার করার জিনিসপত্র আছে সেখানে। জাদুঘরে গিয়ে দেখে ওরা ছাড়া আর কোনো দর্শনার্থী নেই। ভেতরে এক চক্কর ঘুরে এসে টিকেট চেকার এঞ্জেলাকে উলরিখ বললেন, আজকাল বুঝি লোকজন জাদুঘরের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে?

তা বলতে পারেন। পিটারের মাঝ বয়সী মা এঞ্জেলা গ্রিফান বললেন–কী সব অভিশপ্ত আত্মার উৎপাত শুরু হলো ঈশ্বর জানেন। গত পাঁচ দিনে শুধু আপনারাই এলেন।

পকেট থেকে নেম কার্ড বের করে এঞ্জেলাকে দিলেন উলরিখ–আমি এসেছি টিটলিঙের ওপর একটা আর্টিকেল লেখার জন্য। খুবই আনন্দিত হবো কফি শপে বসে যদি আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি।

ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে এঞ্জেলার খুব মন খারাপ। জাদুঘরে আগের মতো লোকজন এলে, কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ছেলের দুঃখ কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকা যেতো। জাদুঘরে এখন দর্শনার্থী একরকম আসে না বললেই চলে। একা চুপচাপ বসে থাকার মুহূর্তগুলো যন্ত্রণার মস্ত বড় বোঝা হয়ে বুকের ওপর চেপে বসতে চায়। উলরিখের আমন্ত্রণ পেয়ে খুশিই হলেন তিনি আপনার মতো একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে পারা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই বলে এঞ্জেলা তাঁর সহকর্মী টিকেট বিক্রেতা ভাগনারকে দরজার দিকে কিছুক্ষণের জন্য লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ জানিয়ে স্বপনদের সঙ্গে জাদুঘরের পাশে ছোট্ট কফি শপে এসে বসলেন।

সবার জন্য আপেল পাই আর কফির অর্ডার দিয়ে উলরিখ বললেন, আপনার ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আমার সমবেদনা গ্রহণ করুন ফুলাইন গ্রিফান। আপনার কি সত্যি সত্যি মনে হয় পিটারের মৃত্যুর জন্য কোনো ভ্যাম্পায়ার দায়ী?

শুকনো গলায় এঞ্জেলা বললেন, গ্রামের সবাই তো তাই বলছে।

আপনি এসব ভ্যাম্পায়ারের কুসংস্কার বিশ্বাস করেন?

বিশ্বাস না করে উপায় কী? কালও তো একই ভাবে জিপসি মেয়েটা মারা গেলো।

আমাদের ধারণা এ সবের পেছনে খারাপ লোকদের কোনো দল আছে।

আমার ছেলে কারও কোনো ক্ষতি করেনি। ওকে কেন মারতে যাবে?

হয়তো ও খারাপ লোকদের কুকীর্তি সম্পর্কে জেনে ফেলেছিলো। ওকে বাঁচিয়ে রাখলে ওদের বিপদ হতে পারে ভেবে ওরা মারতে পারে।

আপনারা আমাকে এসব কেন বলছেন?

আপনি কি চান না পিটারের হত্যাকারীদের পুলিস গ্রেফতার করুক, ওরা শাস্তি পাক?

চাইলেই কি পুলিস ভ্যাম্পায়ারদের গ্রেফতার করতে পারবে?

আপনি সাহায্য করলে পারবে।

কিভাবে?

রাতে এ গ্রামে থাকার জন্য আমাদের গোপন একটা জায়গা দরকার।

গোপনে থেকে কী করবেন?

টিটলিঙের দুর্গে যাবো। আমার ধারণা রাতে ওখানে গেলে কোনো সূত্র পাবো।

না, তা হয় না। রুক্ষ গলায় বললেন এঞ্জেলা গ্রিফান।

কেন হয় না?

পিটার আর টমাসও এরকম কথাই বলেছিলো। আমি বলেছিলাম এসব অশরীরী অশুভ শক্তির ব্যাপারে কোনো কৌতূহল দেখানো ভালো নয়। ওরা আমার কথা শোনেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এঞ্জেলা বললেন, আপনারা যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে যান। আপনাদের কারও মৃত্যুর দায় আমি নিতে পারবো না।

আপনি ভুল করছেন ফুলাইন এঞ্জেলা গ্রিফান। অশরীরী বা অশুভ শক্তি বলে কিছু নেই। যারা পিটার আর টমাসকে হত্যা করেছে তারা যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই ওদের হত্যা করতে পেরেছিলো। আমরা জানতে চাই পিটারদের কেন হত্যা করা হলো। হত্যাকারীরা যদি শাস্তি না পায় পিটারদের আত্মা শান্তি পাবে না। আপনি মা হয়ে কি চান না আপনার ছেলের হত্যাকারীরা শাস্তি পাক?

উলরিখের কথাগুলো এঞ্জেলার বুকের ভেতর জ্বালা ধরালো। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলে তিনি চুপচাপ বসে থাকলেন। তার সামনে রাখা কফি ঠান্ডা হতে লাগলো। শীলা লক্ষ্য করলো তার চোখ দুটো কান্নায় ভরে গেছে। ওর হাতব্যাগ থেকে এক টুকরো টিস্যু পেপার এঞ্জেলার দিকে এগিয়ে দিলো। ওটাতে চোখ মুছে নাক ঝেড়ে এঞ্জেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে হের উলরিখ। আপনি আমার বাড়িতে থাকতে পারেন।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এঞ্জেলার জন্য আরেক কাপ গরম কফির অর্ডার দিয়ে উলরিখ বললেন, আমাদের গাড়িটা যদি খারাপ হয়ে যায় তাহলে কি ওটা জাদুঘরের চত্বরে থাকতে পারে?

নিশ্চয়ই পারে। তবে আমাদের এখানে ভালো মিস্ত্রি আছে। বললে সারিয়ে দেবে।

গাড়ি সত্যি সত্যি খারাপ হয়নি। আপনি গ্রামের লোকদের বলবেন আমরা দুপুরে আপনার বাড়িতে খেয়ে আমরা পায়ে হেঁটে ডেগেনডর্ফে ফিরে গেছি। রাতে আপনি আমাদের সরাইখানায় থাকতে বলেছিলেন। ভ্যাম্পায়ারের ভয়ে আমরা থাকতে রাজি হইনি। স্বপনরা পরশু রাতে জলজ্যান্ত ভ্যাম্পায়ার দেখেছে।

রাত পর্যন্ত কোথায় থাকবেন?

আপনার বাড়িতেই থাকবো। আপনি বলবেন লাঞ্চ করেই আমরা ফিরে গেছি। আপনার বাড়িতে নিশ্চয় ফোন আছে?

তা আছে।

ডেগেনডর্ফে ফোন করে জানিয়ে দিতে হবে রাতে আমরা ফিরবো না।

চলুন তাহলে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এঞ্জেলা গ্রিফান। আপনাদের বাড়ি। পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার জাদুঘরে ফিরে আসতে হবে।

সন্ধ্যে পর্যন্ত এঞ্জেলার বাড়িতে স্বপনদের কিছুই করার ছিলো না। উলরিখ তার ব্যাগ থেকে সমাজতন্ত্রের পতনের ওপর আমেরিকান এক গবেষকের লেখা বই নিয়ে গেস্ট রুমে সেই যে ঢুকেছেন, দুপুরে শুধু খাবার জন্য একবার বেরুলেন। এ বাড়িতে ঢুকেই স্বপনদের বলে দিয়েছেন কেউ যেন ভুলেও জানালার কাছে না যায়। এঞ্জেলা বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। স্বপনরা সময় কাটালো ভিডিও গেম খেলে । এঞ্জেলাই যাওয়ার সময় ওদের বলে গিয়েছিলেন গেম খেলতে। নাকি পিটারের খুব প্রিয় খেলা ছিলো এগুলো।

জাদুঘর বন্ধ করে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরেছেন এঞ্জেলা। রান্নাঘরে ঢুকে অতিথিদের জন্য রাতের খাবার তৈরি করলেন। অবশ্য শীলাও ওঁকে রান্নাঘরে সাহায্য করলো। সাহায্য বলা ভুল হলো। শীলা রান্না করলো, তিনি শুধু তাকিয়ে দেখলেন। যখন শুনেছেন হোটেল জেরানিয়ামের হাঙ্গেরিয়ান শেফ গুস্তাভের কাছে রান্না শিখেছে শীলা, তখন ওর সামনে রান্না করতে লজ্জাই পাচ্ছিলেন এঞ্জেলা।

খাবার টেবিলে বসে রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন উলরিখ। এঞ্জেলা বার বার বললেন, এতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। সবটুকু প্রশংসা শীলার।

স্বপন মুখ টিপে হেসে বললো, আঙ্কল উলরিখ কারও নিন্দা করতে জানেন না।

খাওয়া শেষ হতে হতে নটা বাজলো। ইচ্ছে করেই দেরি করছিলেন উলরিখ । গ্রামের সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে না পড়লে বেরুনো ঠিক হবে না।

স্বপনরা আগের বারও দেখেছে, নটা বাজার আগেই টিটলিঙের সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। রাস্তায় মিটমিট আলো ছাড়া কারও বাড়িতেই আলো থাকে না। উলরিখ কফি খেতে খেতে বললেন, আমরা সাড়ে নটায় রওনা দেবো।

দেয়ালে ঝোলানো মাদার মেরির ছবির সামনে তিনটা মোমবাতি জ্বালিয়ে উলরিখ, শীলা আর স্বপনের নাম ধরে প্রার্থনা করলেন, যেন ওরা কোনো বিপদে না পড়ে। রনি এখানে আসার আগেই বলেছে রাতের অন্ধকারে ভ্যাম্পায়ারদের ভাঙা দুর্গ দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই ওর। উলরিখ ওকে বলেছেন তুমি তাহলে এঞ্জেলা গ্রিফানের বাড়িতেই থাকো। রাতে আমরা যদি না ফিরি সকালে সোজা ডেগেনডর্ফ গিয়ে স্বপনের বাবাকে বলবে পুলিশ নিয়ে দুর্গে আসার জন্য। রাতে দুর্গে যাওয়ার বদলে এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব হাতে পেয়ে রনি বরং খুশিই হয়েছে। এঞ্জেলা গ্রিফান বলেছেন, আমি নিজেই যাবো রনিকে সঙ্গে নিয়ে।

ঠিক সাড়ে নটায় স্বপনরা বেরুলো এঞ্জেলা গ্রিফানের বাড়ি থেকে। জন মানুষ দূরে থাক সারা গ্রামে একটা কুকুরের ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিলো না। ফিনফিনে কুয়াশা রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোকে আরও ম্লান করে দিয়েছে। উত্তেজনায় স্বপন আর শীলার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিলো। শুধু উলরিখ ছিলেন নির্বিকার। যেতে যেতে ভাবছিলেন বহুদিন পর একটা উত্তেজনাকর রিপোর্ট লিখতে হবে তাকে।

এঞ্জেলার বাড়ি গ্রামের উত্তর প্রান্তে। এদিকে বাড়িগুলো গা লাগানো নয়। বেশ ছাড়া ছাড়া। উত্তর দক্ষিণে টানা রাস্তা, পুব পাশে লোকজনের ঘর বাড়ি, পশ্চিমে ফাঁকা মাঠ। মাঠের শেষে ই নদী। উলরিখ আগেই হিসেব করে রেখেছিলেন, পায়ে হেঁটে গ্রাম পেরুতে মিনিট পঁচিশেক লাগবে। তারপর বন পেরিয়ে দুর্গে পৌঁছতে বড় জোর চল্লিশ মিনিট। গ্রামের পথটুকু দ্রুত পা চালিয়ে পার হলেন।

শুক্লপক্ষের ভরা চাঁদ তখনও মাথার ওপরে ওঠেনি। বনের ভেতর পথ চেনার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও বার বার টর্চ জ্বালাচ্ছিলেন উলরিখ । এদিককার বনগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগনো। একটু বেখেয়াল হলেই সীমান্ত পেরিয়ে চেকোশ্লোভাকিয়ায় চলে যেতে হবে।

রনির কথা ভেবে শীলার খারাপ লাগলো। বেচারা একা এঞ্জেলার বাড়িতে, এলেই পারতো! নিজ চোখে দেখতে পেতো ভ্যাম্পায়ার বলে যে কিছু নেই। উলরিখের যুক্তি শুনে শীলা আর স্বপন দুজনেরই বিশ্বাস–টিটলিঙের এসব হত্যাকান্ড কোনো ভ্যাম্পায়ারের দ্বারা হয়নি, এর জন্য দায়ী খারাপ প্রকৃতির মানুষ। স্বপনের ধারণা ডালমানরা এর সঙ্গে জড়িত। ডালমানকে দেখে রনি প্রথম দিনই বলেছিলো ও নাকি নব্য নাৎসিদের মতো দেখতে। স্বভাবও ওদের মতো, রাগী আর অসহিষ্ণু, নিজে যা ভাবে মনে করে ওটাই ঠিক। তাছাড়া প্রথম দিন ওরা বলা সত্ত্বেও ওদের বাদ দিয়ে অচেনা দুর্গে কেন শুটিং করতে এলো? এতে করে স্বপনদের সন্দেহ আরও বেড়েছে।

জঙ্গল পেরিয়ে ওরা যখন শার্লেমানের দুর্গের ঠিক নিচে ফাঁকা জায়গাটায় এলো তখনই আকাশের মেঘ সরে গিয়ে পেতলের থালার মতো চাঁদটা ওদের চারপাশে জ্যোৎস্নার ঢল নামিয়ে দিলো। ওরা পা চালিয়ে দ্রুত সরে এলো বুড়ো এক গাছের তলায়।

উলরিখ চাপা গলায় বললেন, তোমরা তো আগেও এসেছো। চাঁদের আলো থেকে গা বাঁচিয়ে দুর্গে ঢুকতে হবে আমাদের। যেতে পারবে তো স্বপন?

সেক্ষেত্রে আমাদের পেছন দিক দিয়ে যেতে হবে। স্বপন বললো, বেশ খানিকটা খাড়া চড়াইয়ে উঠতে হবে। আপনার অসুবিধে হবে না তো?

কিসের অসুবিধে! স্বপনের কথায় মৃদু হাসলেন উলরিখ–মোটা মানুষ বলে অকেজো ভেবো না। দশ বছর আগেও নিয়মিত আপ্পস্-এ ক্লাইম্বিং-এ যেতাম।

স্পাইক শু, ক্লাইম্বিং স্টিক আর সব দড়িদড়া নিয়ে পাথুরে আল্পস-এ ওঠা এক কথা আর শ্যাওলা ধরা, কোথাও ঝুরঝরে মাটি আর শুকনো ঘাসপাতায় ঢাকা গর্ত থেকে পা বাঁচিয়ে বাভারিয়ার পাহাড়ে ওঠা ভিন্ন কথা। স্বপনের খুব একটা অসুবিধে না হলেও শীলার খুব কষ্ট হলো খাড়া পাহাড় বেয়ে তিরিশ মিটারের মতো উঁচুতে উঠতে। উলরিখও স্বীকার করলেন কাজটা যত সহজ ভেবেছিলেন মোটেই তত সহজ নয়। মোটা শরীর নিয়ে হাঁচড় পাঁচড় করে সারা গায়ে ধুলোমাটি মেখে অতি কষ্টে দুর্গের পেছনে চাতালে উঠে এসে হাঁপ ছাড়লেন।

সামনে টিটলিঙের অভিশপ্ত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। চাঁদের আলোয় স্বপনের মনে হলো আধুনিক জগত থেকে বহু দূরে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে গেছে ওরা। ডানা ঝটপট করে দুটো কালো বাদুর উড়ে গেলো গ্রামের দিকে। হঠাৎ একটা পঁাচা ডেকে উঠলো। এমন যে সাহসী মেয়ে শীলা, ওর বুকের ভেতরটাও ধক করে উঠলো।

উলরিখ ফিশ ফিশ করে স্বপনকে জিজ্ঞেস করলেন, পেছন দিক দিয়ে ঢোকার কোনো পথ জানা আছে তোমার?

ছোট বেলায় যখন এদিকে বেড়াতে আসতো তখন বন্ধুদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে স্বপনরা ভাঙা দুর্গের অনেক ফাঁকফোকড়ের কথা জেনেছিলো। চাপা গলায় উলরিখকে বললো, সামনের ওই ওক গাছটার পাশে দেয়ালে বড় ফুটো আছে। ওখান দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে কিছুদূর গেলেই একটা বড় ঘরে ঢোকা যাবে।

কোনো কথা না বলে উলরিখ ইশারায় স্বপনকে পথ দেখাতে বললেন। তিনি আর শীলা নিঃশব্দে অনুসরণ করলেন ওকে। দেয়ালের বেশ বড় অংশ ধ্বসে পড়েছে এদিকটায়। সম্ভবত জায়গাটা আগে ঘোড়ার আস্তাবল ছিলো।

স্বপনের কথা মতো বাঁ দিকে খানিকটা যেতেই ছাদহীন একটা ঘর পড়লো পথে। সে ঘর পেরিয়ে ওরা ঢুকলো আস্ত একটা ঘরে । দরজা জানালায় ফোকড় দিয়ে চাঁদের আলো। ঢুকে ভেতরে জমে থাকা অন্ধকার কিছুটা দূর করেছে। স্বপন ফিশ ফিশ করে বললো, ডান দিকের ঘরে নিচে নামার সিঁড়ি আছ। কফিনটা দেখতে চাইলে এখান দিয়ে যেতে হবে।

উলরিখ মাথা নেড়ে সায় জানালেন। শীলা যাতে ভয় না পায় ওর একটা হাত তিনি শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন। কোথাও মানুষজনের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কিছুটা অবাকই হয়েছেন তিনি। ওঁর ধারণা ছিলো দুর্গের ভেতর ঢুকলেই বদমাশদের দলের কারও দেখা পাবেন।

স্বপনকে অনুসরণ করে পাথরের ঠান্ডা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় উলরিখকে বাধ্য হয়ে টর্চ জ্বালাতে হয়েছিলো। এমনই জমাট অন্ধকার যে মনে হচ্ছিলো গায়ে বুঝি ধাক্কা লাগবে।

নিচে নেমে স্বপন ইশারায় কফিনটা দেখালো। লোকজনের ভয় না থাকাতে উলরিখ আর টচ্ নেভাননি। কাছে গিয়ে টর্চের আলো ফেলে চমকে উঠলেন। কফিনের ঢাকনি এক পাশে সরানো। ভেতরে লাল শার্টিনের লাইনিং দেয়া। বোঝাই যায় খুব দামী কফিন। কিন্তু ভেতরে কোনো লাশ নেই। কখনও যে এতে লাশ রাখা হয়েছে তেমন কোনো চিহ্নও নেই। বলতে গেলে কফিনটা একেবারেই নতুন।

তুমি কি সত্যি সত্যি লাশ দেখেছিলে এতে? স্বপনকে প্রশ্ন করলেন উলরিখ–দেখার ভুল হয়নি তো?

আমি নিজের চোখে দেখেছি। শুধু দেখা নয়, হাত দিয়ে ছুঁয়েছি পর্যন্ত। মরে কাঠ হয়ে ছিলো লাশটা।

তাহলে! হতভম্ব হয়ে গেলেন উলরিখ–লাশের কি পাখা গজিয়েছে যে উড়ে চলে যাবে?

শুকনো গলায় স্বপন বললো, যদি ভ্যাম্পায়ার বলে কিছু থাকে তাহলে রাতে তার কফিনে থাকার কথা নয়। অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে গেছে।

তার মানে ভোর হওয়ার আগে আবার তাকে ফিরে আসতে হবে? সন্দেহ ভরা গলায় বললেন উলরিখ।

ঠিক তাই। আমরা কি তার জন্য অপেক্ষা করবো?

কোনো দরকার হবে না!

সিঁড়ির ওপর থেকে ভারি গমগমে গলার শব্দ শুনে ওরা চমকে উঠে সেদিকে তাকালো। ওদের চোখের ওপর ঝলসে উঠলো সার্চ লাইটের তীব্র আলো। কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ রাখতে হলো ওদের। তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখলো কালো আলখাল্লা পরা অস্বাভাবিক লম্বা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির ওপর। ওর চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না। আবার ওর গলা শুনলো–নেকড়ের গুহায় নেংটি ইঁদুরের উৎপাত আমি পছন্দ করি না।

হঠাৎ কোত্থেকে সাদা ধোঁয়া এসে ঘর ভরে গেলো। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে যেতেই ওদের বেদম কাশি পেলো। কাশতে কাশতে তিরিশ সেকেন্ডের ভেতর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো স্বপন, উলরিখ আর শীলা।

.

০৮. ভ্যাম্পায়ারের কবলে

কতক্ষণের জন্য ওরা জ্ঞান হারিয়েছিলো এটা বোঝার কোনো উপায় ছিলো না ওদের। ঘড়িতে সময় দেখতে পেলে বলা যেতো। জ্ঞান যখন ফিরলো এখন ওরা নিজেদের তিনটে চেয়ারে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। হাত দুটো চেয়ারের পেছনে টেনে বাঁধা হয়েছে। পা দুটোও চেয়ারের পায়ের সঙ্গে বাঁধা। নড়াচড়ার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি।

চারপাশে তাকিয়ে ওরা বুঝতে পারলো না জায়গাটা কোথাকার। বড় একটা ঘরের মতো, পাথরের দেয়ালের গায়ে গ্যাস লাইট জ্বলছে। ঘরের মেঝেতে দাবার ছকের মতো সাদা কালো পাথর বসানো। উঁচু সিলিং দেখে মনে হয় কোনো পুরোনো দুর্গ, তবে এটা যে টিটলিঙের দুর্গ নয় এ বিষয়ে স্বপন নিশ্চিত। বেশি পুরোনো হলে লুডভিগের আমলের হবে, ঘরের চেহারা দেখেও মনে হয় আদৌ পরিত্যক্ত জায়গা নয়। অল্প দূরে পুরোনো আমলের লম্বা একটা টেবিল আর গোটা চারেক চেয়ার রয়েছে। দেয়াল ঘেঁষে আরেকটা ছোট টেবিল। যে চেয়ারে ওরা বসেছিলো সেগুলো যদিও পুরোনো দিনের, তবে যথেষ্ট ভারি আর শক্ত। স্যাঁতসেঁতে গন্ধ থেকে শুধু এটুকু বোঝা যায় ঘরটা মাটির নিচে। যে কারণে বাইরে এখন রাত না দিন–টের পাওয়ার কোনো উপায় নেই।

স্বপন আর শীলার জ্ঞান ফিরেছিলো আগে। ওদের বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালেন উলরিখ। ওরা ছাড়া ঘরে আর কেউ ছিলো না। দুদিকে দুটো মাত্র দরজা, জানালার বালাই নেই। দরজা দুটো পুরোনো ওক কাঠের বাইরে থেকে বন্ধ। স্বপন আর শীলাকে দেখে ওঁর মনে হলো না ওরা তেমন ভয় পেয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়েছে, চেহারায় তারই ছাপ। মৃদু হেসে বললেন, তোমরা ঠিক আছে তো বাছারা?

আমাদের কিছু হয়নি। স্বপন হাসার চেষ্টা করলো।–আপনি কেমন আছেন?

ভালোই আছি। পায়ে শুধু ঝিঁঝি ধরেছে। শয়তানরা আমাদের কোথায় এনেছে কিছু বুঝতে পারছো?

টিটলিঙের বাইরে কোথাও হবে। একশ দেড়শ বছরের পুরোনো কোনো দুর্গের মাটির নিচের ঘরে।

এ এলাকায় এরকম পুরোনো দুর্গ কোথায় আছে জানো?

কাছাকাছি ফুর্সটেনেকের দুর্গ আছে। আরেকটু দূর মুনশেন দুর্গও বেশি পুরোনো নয়। কোনোটাই পরিত্যক্ত নয়। রীতিমতো বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট।

তেমন জায়গায় আমাদের রাখাটা ওদের জন্য বিপদজনক হবে।

ওরা কারা? জানতে চাইলো শীলা।

মনে হচ্ছে সীমান্তের চোরাচালানীদের কোনো দল। এরাই টিটলিঙে একটার পর একটা খুন করছে?

তাইতো মনে হচ্ছে।

কী শয়তান! শীলার ভীষণ রাগ হলো।

স্বপন কাষ্ঠ হেসে বললো, শয়তানদের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে হলে আগে আমাদের এখান থেকে বেরুতে হবে।

কি ভাবে?

সেটাই তো ভাবছি।

ওরা কি আমাদের খেতে টেতে দেবে? আমার ক্ষিদে পেয়েছে।

ক্ষিদে আমারও পেয়েছে। মনে হয় জ্ঞান হারাবার পর দশ বারো ঘন্টা কেটে গেছে।

তার মানে সকাল হয়ে গেছে। রনির এতক্ষণে ডেগেনডর্ফের পথে রওনা হওয়ার কথা।

ওরা তো আমাদের টিটলিঙের দুর্গে খুঁজবে।

ভালো মতো খুঁজলে নিশ্চয় সেখানে কোনো সূত্র পাবে।

বাইরে দরজা খোলার শব্দ হলো। ওরা একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো কালো সবুট পরা লম্বা এক লোক। খাঁটি জার্মান চেহারা, বয়স তিরিশ বত্রিশ হবে। একটা চেয়ার টেনে ওদের সামনে বসে বললো, তারপর হের উলরিখ, রাতের অন্ধকারে কী মনে করে আমাদের আস্তানায় ঢু মেরেছিলেন জানতে পারি?

তুমি আমাকে চেনো? লোকটার কথা শুনে অবাক হলেন উলরিখ।

বাঁ দিকের ঠোঁট বাঁকা করে সামান্য হেসে লোকটা বললো, জাদুঘরের টিকেট চেকারের বাড়িতে যে পুঁচকে ছোঁড়াকে রেখে এসেছিলেন পুলিশে খবর দেয়ার জন্য, ডেগেনডর্ফ যাবার পথে ওটা আমাদের হাতে ধরা পড়েছে। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

কীভাবে ধরা পড়লো রনি?

প্রশ্ন আমি করবো, আপনি উত্তর দেবেন।

পরিচয় যখন জানো, কেন এসেছি সেটাও তোমার অজানা থাকার কথা নয়।

এটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়।

তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।

চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে হঠাৎ উলরিখের বাঁ গালে প্রচন্ড জোরে চড় মারলো লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর ঠোঁটের কষ বেয়ে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। সাপের মতো ঠাণ্ডা গলায় হিশহিশিয়ে লোকটা বললো, আমি না শুনতে অভ্যস্ত নই।

দাঁতে দাঁত চেপে উলরিখ বললেন–শুয়োরের বাচ্চা, তোর …।

কথা শেষ না হতেই উলরিখের ডান গালে আরেকটা চড় মারলো লোকটা ঠিক মতো কথার জবাব না দিলে তোমার চোখের সামনে এই মেয়েটার সর্বনাশ করবো।

স্বপন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো–যদি কোনোভাবে ছাড়া পায় সবার আগে এই লোকটার জিবটা সাঁড়াশি দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। শীলার ওপর অত্যাচার করা হবে শুনে উলরিখ ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, আমি এসেছি টিটলিঙের হত্যাকাণ্ডের ওপর আমাদের পত্রিকায় রিপোর্ট লেখার জন্য।

ভালো! লোকটার ঠোঁটের ফাঁকে বিদ্রুপের হাসি–কাল ভোরে ডানিউবের ধারে চারটা রক্তশূন্য লাশ দেখবে টিটলিঙের অধিবাসীরা। আপনার রিপোর্ট দেখার সুযোগ হবে না কারও।

মরার আগে একটা কথা জানার খুব কৌতূহল হচ্ছে আমার। নিরীহ গলায় লোকটাকে বললো শীলা।

কী কথা?

মানুষকে তো কতভাবেই মারা যায়। এভাবে রক্তশূন্য করে মারার কারণটা কি জানতে পারি?

ওটা আমাদের একটা পদ্ধতি। রক্তটা কাজে লাগে। আর একই সঙ্গে মূর্খ গ্রামবাসীকে ধারণা দেয়া যায় কাজটা পার্থিব মানুষের নয়।

আপনারা কারা? কেন এভাবে ভ্যাম্পায়ারদের মতো মানুষের রক্ত শুষে নিচ্ছেন?

আমাদের ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে মানুষের রক্ত দরকার।

ল্যাবরেটরিতে কী নিয়ে গবেষণা করছেন আপনারা?

উন্নত প্রজাতির মানুষ তৈরি সম্পর্কে।

আপনারা কি নব্য নাৎসি?

বলতে পারো। সেদিন আর বেশি দূরে নয়–জার্মানরা পুরো ইউরোপে রাজত্ব করবে।

হের উলরিখ একজন খাঁটি জার্মান। স্বপন বললো, অত্যন্ত প্রতিভাবান জার্মান। আপনাদের নীতি অনুযায়ী তাকে তো হত্যা করতে পারেন না।

কোনো জার্মান যদি আমাদের পথের বাধা হয়, সে যত প্রতিভাবান হোক না কেন তার বাঁচার অধিকার নেই। উলরিখ একজন নোংরা কমিউনিস্ট। সে সব সময় আমাদের বিরুদ্ধে লেখে।

আমাকে হত্যা করা হলে তার পরিনাম কী হবে ভাবতে পারো? বললেন উলরিখ।

কী আর হবে! ডার স্পিগেল-এ এক কলাম আট ইঞ্চির একটা শোক সংবাদ বেরোবে।

শুধু তাই নয়। ইঁদুরের গর্ত থেকে প্রত্যেককে টেনে বের করে তোমাদের সব আস্তানা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে।

আপনি অনেক বেশি আশাবাদী। আপনাদের লাশ টিটলিঙ থেকে অনেক দূরে পাওয়া যাবে। আমরা আমাদের প্রভাব বলয় বড় করতে চাই।

আমাদের মিউনিখ অফিস জানে আমি যে টিটলিঙ দুর্গে যাচ্ছি।

মিথ্যা কথা। ডেগেনডর্ফ আসার আগে পর্যন্ত তুমি জানতে না আসল ঘটনা কী!

অ্যাসাইনমেন্টে এসে আমি কখন কোথায় যাই সব কথা আমাদের অফিসকে জানাতে হয়। এটাই নিয়ম।

ভালো। বিদ্রুপের ভঙ্গিতে শব্দটা উচ্চারণ করলেও লোকটাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। উলরিখ সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলেন–আমরা যে পথে এসেছি, সব জায়গায় চিহ্ন রেখে এসেছি। স্কাউটিঙের ট্রেনিংটা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছি।

চুপ কর শয়তান কমিউনিস্ট। খেঁকিয়ে উঠলো লোকটা, তোর বিষাক্ত রক্ত নিয়ে আমাদের ল্যাবরেটরি অপবিত্র করবো না। তোকে বুনো শুয়োরের মতো জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো।

সুযোগ পেলে মেরো। তার আগে তোমাদের কী দশা হয় সেটাও একবার ভেবো।

লোকটা হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠলো–এগুলো খুবই পুরোনো ফন্দি উলরিখ। এখানে এর কোনোটাই খাটবে না।

আমার আরেকটা প্রশ্ন ছিলো। বিনীত গলায় বললো শীলা।

কী প্রশ্ন? শীলার কথা বলার ধরনে নিজেকে বেশ কেউকেটা একজন ভাবছিলো। লোকটা।

ডালমান কি আপনাদের জন্য কাজ করছে?

কোন ডালমান?

মিউনিখ থেকে এসে যে আমাদের হোটেলে উঠেছে। শার্লেমানের পুরোনো দুর্গের ওপর যে নাকি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাবে বলে সব জায়গায় প্রচার করছে।

বুঝেছি। ওই মাথামোটা ইহুদিটা কেন আমাদের লোক হবে?

ওর ভবিসাব বেশ সন্দেহজনক। দেখে মনে হয় নব্য নাৎসি।

নাৎসি হওয়া খুব সহজ নয়। ইহুদিদের আরেক দফা নিকেশ করার দিন ঘনিয়ে এসেছে। এই বলে লোকটা উলরিখের দিকে তাকালো–সেই সঙ্গে নোংরা কমিউনিস্টদেরও।

স্বপন নিরীহ গলায় জানতে চাইলো, জার্মানিতে এত জায়গা থাকতে আপনারা ঘাঁটি বানাবার জন্য আমাদের বাভারিয়া কেন বেছে নিলেন?

আমাদের ঘাঁটি এখানে একথা তোমাদের কে বললো? আর বাভারিয়া নিশ্চয় তোমাদের বাপের সম্পত্তি নয়।

আমি জানি তোমরা বাভারিয়ায় কেন আস্তানা গেড়েছো? সবজান্তার মতো কথাটা বললেন উলরিখ।

কেন? লোকটার গলা বিদ্রুপে ভরা।

পূর্ব জার্মানি থেকে পালিয়ে যারা আসছে তাদের লোভ দেখিয়ে নাৎসি বানাতে চাও। তাদের জন্য তোমরা কোনো কোনো জায়গায় অভ্যর্থনা কেন্দ্রও খুলেছো।

তাতে তোমার কী?

জার্মানির সাধারণ মানুষ এটা কখনোই মেনে নেবে না। তারা এখনও নাৎসিদের ঘৃণা করে।

তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। যারা আমাদের ঘৃণা করে তারা দুর্বল, কাপুরুষ। তাদের দিয়ে দেশের কোনো মঙ্গল হবে না। জার্মানির দরকার সাহসী মানুষ। শার্লেমানের মতো শক্তিমান সম্রাট। হিটলারের মতো বিচক্ষণ নেতা।

শালেমান তো জার্মান ছিলেন না। সময় কাটাবার জন্য তর্কের ভঙ্গিতে স্বপন বললো, তিনি তো জার্মান স্যাক্সনদের যুদ্ধে হারিয়ে জার্মান দখল করেছিলেন।

শার্লেমানের শরীরে খাঁটি আর্য রক্ত ছিলো। স্যাক্সনরা খাঁটি আর্য ছিলো না।

লোকটার ইতিহাস জ্ঞান স্বপনকে মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারলো না। শীলা বললো, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন আপনার পূর্ব পুরুষ স্যাক্সন ছিলেন না?

অবান্তর প্রশ্ন। আমি খাঁটি জার্মান, একজন নিষ্ঠাবান খৃষ্টান, নাৎসিবাদে বিশ্বাস করি, এটাই আমার বড় পরিচয়। এই বলে লোকটা উঠে দাঁড়ালো–যাক অনেক গালগল্প হলো। মারার আগে মানুষের কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখতে নেই বলে তোমাদের কিছুটা সময় দিলাম। কমিউনিস্ট শয়তানটাকে মারতে আমাদের আনন্দই হবে। তুমি ছেলে–চেহারাটা খাঁটি জার্মান হলেও তোমার রক্তে ভেজাল রয়েছে। তার ওপর তোমাদের কৌতূহল বড় বেশি। এ বয়সে কৌতূহল থাকা ভালো। তবে বেশি কৌতূহল মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে। তোমরা তাহলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।

শীলা বললো, আমাদের আর কতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখবেন আপনি?

শীলার প্রশ্ন শুনে লোকটা নিজেকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাবান ভাবলো। এই ঘাঁটিতে ওর অবস্থান তিন নম্বরে হলেও এরা ওকে এক নম্বর ভাবছে। মেয়েটা জার্মান

হলেও ভদ্রভাবে কথা বলতে জানে। পাজি কমিউনিস্টটার পাল্লায় পড়ে নিজের মরণ ডেকে এনেছে। নইলে মেয়েটার ভদ্র আচরণের জন্য ওকে মারার আগে আরেকবার ভাবা যেতো। সামান্য হেসে লোকটা বললো, আরও বারো ঘন্টা আছে তোমাদের আয়ু।

মৃত্যুর আগে কি আমাদের কিছুই খেতে দেয়া হবে না?

নিশ্চয়ই দেয়া হবে। দশ মিনিটের ভেতর তোমাদের খাবার পরিবেশন করা হবে।

এই বারো ঘন্টা সময় আমরা আমাদের ধর্মমতে প্রার্থনা করে কাটাতে চাই।

করতে পারো। বাধা দিচ্ছে কে?

এভাবে হাত পা বাঁধা থাকলে প্রার্থনা করবো কিভাবে? প্রার্থনার আগে তা মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হতে হবে।

একটু ভেবে লোকটা বললো, ঠিক আছে, হাত পা খুলে দেয়া হবে। যদি ভেবে থাকো এখান থেকে পালাবে তাহলে বলবো তোমরা মূখের স্বর্গে বাস করছে। এখান থেকে একটা পিঁপড়েও পালাতে পারবে না। প্রত্যেকটা দরজায় লেজার গার্ড রয়েছে। বারো সেকেন্ডও লাগবে না পরলোকে যেতে। নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠলো লোকটার ঠোঁটের ফকে। তারপর গট গট করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

পুরু কাঠের দরজাটা বন্ধ হওয়ার পর ঘটাং ঘটাং শব্দ হলো। বোঝাই যায় এমন দরজা ভাঙতে হলে কামান দাগতে হবে। উলরিখ কাষ্ঠ হেসে বললেন, মিষ্টি কথা বলে শীলা অনেকখানি সুবিধা আদায় করে নিয়েছে।

ম্লান হেসে শীলা বললো, শয়তানটার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে খুবই খারাপ লেগেছে আমার।

মন খারাপ কোরো না শীলা। স্বপন বললো, শয়তানরা রনিকেও বন্দী করেছে। যেভাবেই হোক ওকে উদ্ধার করতে হবে।

আমরা এখান থেকে বেরুচ্ছি কীভাবে? জানতে চাইলো শীলা।

খাবার দিতে আসুক, হাত পা খুলুক, তারপর দেখা যাবে।

শয়তানরা কত বড় জাল বিছিয়েছে দেখেছো! উলরিখ চিন্তিত গলায় বললেন, রনি যে ডেগেনডর্ফ যাবে সেটা পর্যন্ত জেনে গেছে!

ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। স্বপন বললো, খবরটা ওরা জানলো কিভাবে? এঞ্জেলা গ্রিফান ছাড়া এ খবর কারও তো জানার কথা নয়!

তোমার কি এঞ্জেলাকে সন্দেহ হচ্ছে? প্রশ্ন করলো শীলা।

প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর নিজের ছেলের হত্যাকারীদের সঙ্গে তিনি হাত মেলাবেন এটা হতেই পারে না।

নাৎসিদের সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণাই নেই। উলরিখ বললেন, এঞ্জেলা যদি সত্যিই ওদের দলে যোগ দিয়ে থাকে, আর পিটার যদি বিরোধিতা করে, ওকে দলের স্বার্থে হত্যা করতে এঞ্জেলার বুক এতটুকু কাঁপবে না।

স্বপন বললো, বাবার কাছে শুনেছি বাংলাদেশে নাকি নাৎসিদের মতো এরকম নৃশংস একটা দল আছে। ওখানে ওটাকে জামাত বলে।

শুধু বাংলাদেশে নয়। উলরিখ বললেন, ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবির ভেঙে যাবার পর পৃথিবীর অনেক দেশেই নাৎসিদের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী আর ধর্মীয় মৌলবাদীদের দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশ্বাস হারানো মানুষ খুবই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির হতে পারে।

আবার দরজা খোলার শব্দ হলো। দুজন স্মার্ট, নিষ্ঠুর চেহারার যুবক ঘরে ঢুকলো। দুজনের কাঁধে স্টেনগান ঝোলানো। ওদের পেছনে সাদা অ্যাপ্রন পরা ভাবলেশহীন পাথরের মূর্তির মতো একজন মহিলা ঢুকলো ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে। ট্রলির ওপর খাবার দেখে স্বপনের পেটে ক্ষিদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।

একজন যুবক বললো, মার্থা, ওদের হাত পায়ের বাধন খুলে দাও।

মার্থা নামের পাথরের মূর্তিটা এ্যাপনের পকেট থেকে ছুরি বের করে প্রথমে শীলার, তারপর স্বপনের এবং সবার শেষে উলরিখের বাঁধন কেটে দিলো। কম বয়সী যুবকটা কর্কশ গলায় বললো, কোনো ঝামেলা না করে চুপচাপ খেয়ে নাও।

শীলা নরম গলায় মহিলাকে বললো, ফুলাইন মার্থা, আমার একটু বাথরুমে যাবার দরকার ছিলো।

মহিলা কোনো কথা না বলে কর্কশভাষী যুবকের দিকে তাকালো। যুবকের চোখের পাতায় সম্মতির ইঙ্গিত পেয়ে মার্থা পকেট থেকে চাবি বের করে উল্টো দিকের দরজার তালা খুলে দিলো। ওটা যে বাথরুম শীলারা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিলো ওটা অন্য ঘরে যাবার দরজা।

যেতে পারি? মার্থার সম্মতি চাইলো শীলা।

মহিলা মাথা নেড়ে ইশারা করলো। তারপর তিন নাৎসি ঘর থেকে বেরিয়ে কাঠের দরজা বন্ধ করে দিলো।

হাত পা ঝাড়তে ঝাড়তে উলরিখ বললেন, এবার কী করা যায় বলতো!

আগে তো খাবারগুলো যথাস্থানে পাঠাই! খেতে খেতে ভাববো।

খাবারের পাত্রগুলো ঢাকা ছিলো। শীলা এসে ঢাকনি তুলতেই সবার মন ভরে গেলো। প্রচুর খাবার পাঠিয়েছে। বড় বাটিতে ঘন রাইস স্যুপ, আলাদা জায়গায় মাংসের স্টেক, সালাদ আর রুটি। স্যুপে দেয়ার জন্য কেভিয়ার সস, গোল মরিচের গুঁড়ো, লবন সবই আছে। এমনকি ন্যাপকিনটাও বাদ দেয়নি। পান করার জন্য তিন ক্যান অরেঞ্জ জুসও দিয়েছে।

দারুণ জিনিস! বলে উলরিখ স্যুপের বাটির দিকে হাত বাড়াতেই স্বপন বাধা দিলো–ওটা ছোঁবেন না।

ঘাবড়ে গিয়ে উলরিখ হাত সরিয়ে নিয়ে সন্দেহভরা গলায় বললেন, তোমার কি মনে হয় ওতে বিষ মেশানো আছে?

না বিষ নয়। স্বপন হেসে বললো, এটা দিয়ে ওদের ঘায়েল করবো। আমার মনে হয় বিফ স্টেক আর সালাদই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

নিজের প্লেটে সালাদ তুলতে তুলতে উলরিখ জানতে চাইলেন, স্যুপ দিয়ে কীভাবে ওদের ঘায়েল করবে?

রহস্যভরা গলায় স্বপন বললো, ওরা কী রকম স্মার্টলি চলাফেরা করে লক্ষ্য করেছেন? নাক উঁচু করে গট গট করে হাঁটে, মাটির দিকে তাকাতে ঘেন্না করে।

দাম্ভিকতা আর কর্তপরায়নতা বোঝাবার জন্য ওরকম করে। তার সঙ্গে রাইস স্যুপের কী সম্পর্ক?

দরজা খোলার শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্যুপ ঢেলে ঘরের মেঝে ভিজিয়ে দেবো। স্যুপের সঙ্গে ক্যাভিয়ার সসও মেশানো থাকবে। এতে পা পড়া মাত্র সব কটা পিছলে পড়ে দড়াম করে আছাড় খাবে। শীলা তৈরি থাকবে গোলমরিচের গুঁড়ো নিয়ে। আছাড় খাওয়া মাত্র ওদের চোখে গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেবে। তারপর আমরা ওদের এসএমজিগুলো হাতিয়ে বেরিয়ে পড়বে।

রুটি দিয়ে স্টেক খেতে খেতে উলরিখ বললেন, তোমার প্ল্যান খুবই ভালো। কিন্তু ওরা যদি একসঙ্গে ঘরে না ঢুকে এক এক করে ঢোকে? একজন আছাড় খেলে অন্যরা নিশ্চয়ই সতর্ক হয়ে যাবে!

আমি আর আপনি দরজার দুপাশে তৈরি থাকবো। সঙ্গীকে আছাড় খেতে দেখলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও বাকিরা হতভম্ব হবে, ওদের সতর্কতা ঢিলে হয়ে যাবে। ওরই ভেতর ওদের ঘায়েল করতে হবে।

কালো স্যুট যে বললো দরজায় দরজায় নাকি লেযার গার্ড আছে! শীলা জানতে চাইলো, লের রে থেকে বাঁচবে কিভাবে?

আঙ্কল উলরিখ যেমন ওকে ভয় দেখাবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলেছেন, ওই লোকটাও লেজারের কথা বলেছে। দরজায় যদি লেজার থাকতো তাহলে এ ঘরে গ্যাসের বাতি জ্বলতো না, ইলেকট্রিক লাইট থাকতো।

ঠিক বলেছো। খেতে খেতে সায় জানালেন উলরিখ–লোকটা সম্ভবত ক্রাইম ছবির ভক্ত। নিশ্চয় এরকম পাহারার কথা কোনো ছবিতে দেখেছে। এবার খাওয়ার দিকে নজর দাও।

পালাবার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ওরা গভীর পরিতৃপ্তির সঙ্গে নাৎসিদের খাবার সদ্ব্যবহার করলো।

.

০৯. জয় পরাজয়ের পালা

সব কিছু যে স্বপনের প্ল্যান মতো ঘটবে এ নিয়ে ওদের তিনজনেরই যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। প্রথমত ওরা যদি ঘরে না ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়ে শুধু মার্থাকে ভেতরে পাঠায় সেক্ষেত্রে মার্থা আছাড় খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁধে ঝোলানো এসএমজি দুটো ওদের হাতে এসে যাবে। ঘটনাটা কী ঘটেছে বুঝতে দেরি হবে না। দ্বিতীয়ত ওদের জুতোর তলায় ক্রেপ থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক, যেহেতু পাহাড়ি পাথুরে পথে চলাফেরা করে–সেক্ষেত্রে কেউই আছাড় খাবে না। ভেতরে ঢুকে দেখবে দরজার দুপাশে স্বপন আর উলরিখ চেয়ারের দুটো খুটো হাতে দাঁড়িয়ে আছে–তখন কী হবে?

স্বপনদের পরম সৌভাগ্য বলতে হবে–ওদের জুতো তলায় ক্রেপ ছিলো না, থকথকে ক্যাভিয়ার মেশানো ঘন রাইস স্যুপও ঘরের পাথরের মেঝেকে অসম্ভব পিচ্ছিল করে রেখেছিলো এবং আগের মতোই দরজা খুলে প্রথমে দুই পাহারাদার গটগট করে ঢুকেছিলো।

দড়াম করে আছাড় খেয়ে একজন স্লিপ করে চলে গেলো শীলার পায়ের কাছে, যার বিস্ফোরিত চোখে গোল মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে মাথায় ভারি চামচ দিয়ে এক ঘা বসাতে ওর মোটেই বেগ পেতে হলো না। আরেকজন আছাড় খেয়ে সাঁ করে টেবিলের দিকে যেতেই খটাস করে টেবিলের ভারি পায়ার সঙ্গে মাথা ঠুকে গেলো। মুহূর্তের ভেতর সেও জ্ঞান হারালো। মার্থা দরজায় দাঁড়ানো ছিলো। এমন অভাবনীয় ঘটনা দেখে যেই চিৎকার দিতে যাবে ঘাড়ের ওপর উলরিখের হাতে ধরা চেয়ারের খুটোর বাড়ি খেয়ে ভেজা কাপড়ের মতো ঝুপ করে পড়ে গেলো মেঝের ওপর।

সাব মেশিনগান দুটো পাহারাদারদের কাঁধের ওপর থেকে খসিয়ে নিয়ে উলরিখ আর স্বপন নিজেদের হাতে নিলো। অস্ত্র হিসেবে ভারি স্টেনলেস স্টিলের চামচ যে যথেষ্ট কার্যকরী এর প্রমাণ শীলা হাতেনাতেই পেয়েছে। হাতের মুঠোয় ওটা শক্ত করে ধরে স্বপন আর উলরিখের পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

দরজার বাইরে লোহার আঙটায় ঝোলানো বড় একটা টিপতালা হা করা অবস্থায় ঝুলছিলো। স্বপন দরজা বন্ধ করে তালা টিপে দিলো।

বাইরের জায়গাটা সরু করিডোরের মতো। একদিকে খাড়া মসৃণ দেয়াল অন্যদিকে সারি সারি কামরা। বেশির ভাগই বাইরে থেকে তালা বন্ধ। দেয়ালে বেশ দূরে দূরে গ্যাস লাইটের আলো থাকলেও তাতে অন্ধকার খুব সামান্যই দূর হয়েছে। ওরা হাঁটছিলো পা টিপে টিপে। তালা ছাড়া এমনি দরজা লাগানো ঘরগুলোতে লোকজন থাকতে পারে।

গোটা দশেক দরজা পেরুনোর পর ওরা দেখলো করিডোরটা ইংরেজি এল অক্ষরের মতো বেঁকে গেছে। ওপাশে মানুষের গলার শব্দ শুনেই ওরা থমকে দাঁড়ালো। কারা যেন ওপাশ থেকে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছে।

বাঁ পাশের তালা ছাড়া দরজার দিকে সরে গেলো ওরা। সামান্য ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো দরজাটা। কোনো কিছু না ভেবে হুট করে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। এর দশ সেকেন্ড পরই ওরা শুনলো তিন জন লোক পাথরের মেঝের ওপর দিয়ে খট খট জুতোর শব্দ তুলে হেঁটে গেলো।

ওদের ভয় ছিলো লোকগুলোর গন্তব্য যদি এ ঘরটা হয় তাহলে ওরা কী করবে? এসএমজিতে অবশ্য ম্যাগজিন ভরা ছিলো। উলরিখ স্বপনকে দেখিয়ে দিয়েছেন ট্রিগার কিভাবে টিপতে হবে–তবু এত তাড়াতাড়ি ওদের পালাবার কথা জানাজানি হোক এটা ওরা কেউ চাইছিলো না। লোকগুলো ওদের দরজা পেরিয়ে চলে যাবার পর স্বপনরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে, তখনই টের পেলো ঘরের ভেতরটা ভয়ঙ্কর রকম ঠান্ডা আর উৎকট এক গন্ধ সেখানে জমাট বেঁধে আছে। অন্য ঘরের মতো এ ঘরের দেয়ালেও গ্যাস লাইট জ্বালানো। সাদা কুয়াশা ছড়ানো ছিলো ঘরে। তার ভেতর দিয়ে আবছা যে দৃশ্য ওরা দেখলো তাতে ওদের বুক কেঁপে উঠলো।

ঘরটা ছিলো নাৎসিদের ল্যাবরেটরি। টেবিলে বুনসেন বার্ণার জ্বলছে। বার্ণারের ওপর বড় বীকারে লাল রঙের পদার্থ ফুটছে। নানা ধরনের ছোট বড় পাত্র ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। টেবিলে। পাশের টেবিলে একটা চিমসানো লাশ শোয়ানো রয়েছে, অনেকটা মিশরের মমির মতো। বুকের কাছটা খোলা, ভেতরে হৃৎপিন্ড, যকৃত, ফুসফুস সব দেখা যাচ্ছে। বোঝা যায় কাজ করতে করতে কেউ এইমাত্র কোথাও গেছে, এক্ষুণি এসে পড়বে। ঘরের ভেতর তাপ হিমাঙ্কের কাছাকাছি, আর কিছুক্ষণ থাকলে স্বপনদের হাত পা জমে বরফ হয়ে যাবে। কারণ ওদের গায়ে খুব হালকা গরম কাপড় ছিলো। বাভারিয়ায় অক্টোবরে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে কেউ গরম কাপড় পরে না।

শীলা নাক কুঁচকে চাপা গলায় বললো, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

উলরিখ ওর হাত ধরলেন চলো, বেরিয়ে পড়ি। এখনই কেউ এসে পড়বে এ ঘরে। এই বলে তিনি শীলাকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

একটু পরেই স্বপন এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলো। শীলাকে বললো, তাড়াতাড়ি হাঁটো, কখন কী ঘটে বলা যায় না।

পর পর তিনটা বাঁক পেরিয়ে ওরা বড় একটা হলঘরে এসে ঢুকলো। জায়গাটাকে মনে হলো মাকড়শার শরীরের মতো। দুপাশ থেকে গোটা ছয়েক টানেল চলে গেছে অজানা গন্তব্যে, ওদেরটা তার ভেতর একটা। মাকড়শার মাথার কাছে ওপরে ওঠার লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। সিঁড়ির দিকে নজর পড়া মাত্র ওরা তিনজন ছুটে গেলো সেদিকে।

সিঁড়ি বেয়ে তেইশ ধাপ ওঠার পর আবার একটা টানেল। এটার দুদিকে নিরেট পাথরের দেয়াল। পাশাপাশি দুজনের বেশি হাঁটা যায় না। এসএমজি হাতে স্বপন আগে আগে হাঁটছিলো। ঠিক হাঁটা নয়, বলতে গেলে একরকম দৌড়াচ্ছিলো। পেছনে শীলার অসুবিধে না হলেও ঝানু পর্বতারোহী উলরিখ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। টানেলের শেষ মাথায় এসে থমকে দাঁড়ালো স্বপন। উলরিখ আর শীলাকেও দাঁড়াতে হলো। সামনে এগুবার কোনো পথ নেই। মনে হয় টানেলটা তৈরি করতে করতে হঠাৎ কাজ থামিয়ে মিস্ত্রিরা চলে গেছে। অস্ফুট গলায় শীলা বললো, এখন কী হবে!

স্বপন চিন্তিত গলায় বললো, আমার মনে হয় যে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছি ওটা আমাদের মতো কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্য বানিয়েছে। আমি তখনই ভাবছিলাম সিঁড়ির নিচে বা ওপরে কোনো পাহারাদার নেই কেন?

তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমাদের আবার নিচের হলঘরে যেতে হবে? শীলার গলায় হতাশার ছোঁয়া।

উলরিখ বললেন, দাঁড়াও। রাজা লুডভিগের একটা দুর্গে এরকম একটা সুড়ঙ্গ দেখেছিলাম। এসো তো, সবাই মিলে সামনের দেয়ালটাকে ধাক্কা দিয়ে দেখি, কিছু হয় কি না!

মনে সন্দেহ নিয়ে স্বপন আর শীলা সামনের পাথরের দেয়ালে ধাক্কা দিলো। উলরিখও জোরে ধাক্কা দিলেন। যেমন দেয়াল তেমনই রইলো।

মাঝখানে নয়, উলরিখ বললেন, কিনারের দিকে ধাক্কা মারতে হবে।

প্রথমে বাঁ দিকের কোণে ধাক্কালো সবাই। কিছুই হলো না। ডান দিকেও জানা কথা কিছু হবে না–এমন একটা মনোভাব নিয়ে ধাক্কা মারতেই মনে হলো দেয়ালটা সামান্য নড়ে উঠেছে। চাপা উত্তেজিত গলায় উলরিখ বললেন, এতক্ষণে পেয়েছি। গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারো।

দেয়াল নড়তে দেখে স্বপন আর শীলার গায়ের জোর ডবল হয়ে গেলো। পাথরের দেয়ালে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারলো ওরা। মেঘ ডাকার মতো গুরু গম্ভীর শব্দ করে পাথরটা ফুট দেড়েকের মতো সরে আবার অনড় হয়ে গেলো। ফাঁক দিয়ে স্বপন আর শীলা অনায়াসে বেরিয়ে এলো। বেগ পেতে হলো উলরিখের বেলায়। মোটা শরীর নিয়ে গা হাতের চামড়া ছিঁড়ে ফুড়ে একাকার হয়ে গেলো তার। তবে শেষ পর্যন্ত ঠিকই বেরিয়ে এলেন তিনি। মনে মনে ঠিক করলেন যদি এই সুড়ঙ্গের গোলক ধাঁধা থেকে প্রাণ নিয়ে বেরুতে পারেন, শরীরের ওজন একশ পাউন্ড কমিয়ে ফেলবেন।

পাথরের দরজার এপাশে এসে স্বপন চারদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আপন মনে বললো, জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

চিনতে ওর বেশি দেরি হলো না। এখানেই কফিনে শোয়ানো লাশ দেখেছিলো স্বপন। অবাক হয়ে বললো, আরে এটা তো টিটলিঙের দুর্গ! সেদিন এ ঘরেই কফিনের ভেতর তাজা লাশ দেখেছিলাম। কাল রাতেও তো কফিনটা এখানে ছিলো!

হাত তুলে আঙুল দিয়ে ইশারা করে ও জায়গাটা দেখালো উলরিখ আর শীলাকে। হঠাৎ করে অচেনা গোলক ধাঁধা থেকে বেরোবার পথ পেয়ে ওদের টান টান সতর্কতায় ঢিল পড়েছিলো। আর তখনই বন্দুকের গুলির শব্দ হলো। পেছন থেকে পর পর দুটো গুলি ওদের হাত থেকে এসএমজি দুটোকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো দেয়ালের দিকে। পেছনে তাকাতেই ওদের চোখে পড়লো কালো স্যুট পরা নাৎসিটাকে। ওর সঙ্গে একজন এলএমজিধারী প্রহরীও রয়েছে। ওদের দিকে পিস্তল তাক করে লোকটা নিষ্ঠুর হেসে বললো, ল্যাবরেটরি থেকে বেরুতেই আমার নজরে পড়ে গিয়েছিলে। হাতে ও দুটো থাকাতে এতক্ষণ কিছু বলিনি। এবার সবাই মাথার ওপর হাত তোলো।

কোনোরকম প্রতিবাদ না করে স্বপনরা হাত তুললো। লোকটা রুক্ষ গলায় বললো, পেছনে না তাকিয়ে সোজা তোমাদের ডান দিকের ঘরে ঢুকে যাও।

স্বপনরা ডান দিকে ঘোরা মাত্র বাইরে বু-ম করে বিকট শব্দ হলো। মনে হলো কেউ বুঝি পাঁচশ পাউন্ডের বোমা ফাটিয়েছে। ওরা থমকে দাঁড়ালো। বাঁ পাশের দেয়াল ঘেঁষা সরু পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে থামলো এক স্টেনধারী। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে আমাদের আত্মসমর্পণ করতে বলছে। আমি করিনি। ওরা বলছে বোমা মেরে নাকি দুর্গ উড়িয়ে দেবে।

এতই সোজা বুঝি দুর্গ ওড়ানো? স্বপনদের দিকে তাকিয়ে কালো স্যুট পরা নাৎসিটার ঠোঁটের ফাঁকে কুৎসিত হাসি ফুটে উঠলো–চার চারটা জিম্মি আমাদের হাতে আছে। এদের এভাবে রেখে আমরা যদি স্বর্গে চলে যাই সেটা খুবই অমানবিক আর স্বার্থপরতা হবে। একটু থেমে ওর সঙ্গের লোকটাকে বললো, এলার্ম বেল বাজিয়ে দাও। এদের বারো নম্বরে আটকে রেখে পাহারা দাও। আমি ওপরে যাচ্ছি।

এলএমজি হাতে লোকটা ইশারায় স্বপনদের এগুতে বললো। উলরিখের মুখে চাপা উল্লাস। শীলা বাংলায় স্বপনকে বললো, রনিকে নিশ্চয় দুর্গের ভেতর কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।

কোনো কথা নয়। পেছন থেকে বাজখাই গলায় বললো এলএমজি।

বারো নম্বর ঘরটা আরও একতলা নিচে। ওরা নামছিলো পাথরের সিঁড়ি বেয়ে। সবার আগে উলরিখ আর শীলা তারপর স্বপন, ওর পেছনে এলএমজি। কালো স্যুট অ্যালার্ম বাজাবার কথা বলেছিলো। স্বপনরা অ্যালার্মের কোনো শব্দ শুনতে পেলো না। স্বপন নির্বিকার গলায় বললো, শীলা তোমরা তাড়াতাড়ি নামো।

পিঠে এলএমজির নলের স্পর্শ পেলো স্বপন–মানা করেছি না সাংকেতিক ভাষায় কথা বলবে না।

অ্যালার্ম না বাজাতে স্বপনদের মতো এলএমজিও কিছুটা চিন্তিত ছিলো। তখনও সিঁড়ির আট নয় ধাপ নামতে বাকি। আগেকার দিনের বানানো, ধাপগুলো এক ফুটেরও বেশি উঁচু, তবে যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিলো স্বপনদের।

শীলা আর উলরিখ সিঁড়ির নিচে নেমে যেতেই টপ করে বসে পড়লো স্বপন। স্কুলে এমন বাদরামো ওরা অনেক করেছে। পেছন পেছন আসা এলএমজি হাতে লোকটা স্বপনের গায়ে টক্কর খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো কালো গ্রানাইট পাথরে সিঁড়িতে। নাক ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে গোটা চারেক দাঁতও ভাঙলো ওর। পেছন থেকে স্বপনের কড়া লাথি খেয়ে গড়িয়ে পড়লো সিঁড়ির শেষ ধাপে। বলা বাহুল্য ততক্ষণে পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়েছে লোকটা।

উলরিখ এলএমজিটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, শিগগির ওপরে চলো, পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। কোথাও আগুন ধরেছে।

শীলা বললো, রনিকে সঙ্গে না নিয়ে আমি ওপরে যাবো না।

রনি এখানে এ কথা কে বললো তোমাকে? উলরিখ বললেন, নাৎসিটা তখন কী বলেছিলো ভুলে গেছো নাকি! ওকে ওরা অন্য জায়গায় রেখেছে।

উলরিখের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে শীলা জানতে চাইলো, এখানে না রেখে অন্য জায়গায় কেন রাখবে?

জেরা করতে সুবিধে হবে বলে। জলদি চলো।

স্বপন মৃদু হেসে বললো, ল্যাবরেটরি থেকে বেরোবার সময় আমিই বার্নারটা কাত করে রেখে এসেছিলাম।

সর্বনাশ! উলরিখ খুশিতে গদগদ হলেন–ল্যাবরেটরিতে যে নানারকম এক্সপ্লোসিভ জিনিসপত্র থাকে!

স্বপন নির্বিকার গলায় বললো, ভ্যাম্পায়ারদের আগুনে পুড়িয়ে মারাই তো নিয়ম।

ভ্যাম্পায়ার কোথায় দেখলে? শীলা অবাক হলো–তুমি কি রনির মতো এসব বিশ্বাস করা আরম্ভ করলে নাকি?

নাৎসি আর ভ্যাম্পায়ার একই জিনিস শীলা। উলরিখ যেতে যেতে বললেন, নাৎসিদের মতো অশুভ শক্তি পৃথিবীতে আর কী আছে?

ওরা যখন দুর্গের ওপরের ঘরে এলো তখন একই সঙ্গে দুটো বিস্ফোরণের শব্দ হলো। একটা মাটির নিচে, আরেকটা দুর্গের বাইরে। দৌড়ে দুর্গের বাইরে এসে দেখলো শেষ বিকেলের আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। নাৎসিরা আত্মসমর্পণ করেছে। একদল পুলিস এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। উলরিখ অবাক হয়ে বললেন, পুলিস খবর পেলো কোত্থেকে?

এমন সময় শীলা! স্বপন! বলে চিৎকার করে পুলিসদের পেছন থেকে রনি ছুটে এলো দুর্গের চত্বরে।

আরে রনি! অবাক হয়ে শীলা বললো, তোমাকে না ওরা বন্দী করেছিলো! ছাড়া পেলে কি ভাবে?

রনি হেসে বললো, আমাকে বন্দী করলে কি হবে, ফুলাইন এঞ্জেলাকে তো বন্দী করতে পারেনি। তিনিই ডেগেনডর্ফ গিয়ে খবর দিয়েছিলেন।

তোমাকে বন্দী করলো কিভাবে?

এর জন্য স্বপনের বিএমডব্লু দায়ী। সকালে আমরা ঠিকই রওনা দিয়েছিলাম। গ্রামের সীমানা পেরিয়ে যেই জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকলাম অমনি গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ। কি করবো ভাবছি তখনই দেখি পেছনে এসে দাঁড়ালো ছুতোর মিস্ত্রি কালোফের গাড়ি। এঞ্জেলা আমাকে ডেগেনডর্ফ পৌঁছে দিতে যাচ্ছেন শুনে বললো ও নাকি ওদিকেই যাচ্ছে। ফুলাইনকে কষ্ট করতে হবে না। আমাকে ও দিব্যি লিফট দিতে পারবে। ওর গাড়িতেই এঞ্জেলাকে জাদুঘরে নামিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে বেরুলো। পেছনের সিটে ছিলো আরেকটা লোক। কিছুক্ষণ পর পেছনের লোকটা আমার নাকে ক্লোরোমে ভেজানো রুমাল চেপে ধরলো। জ্ঞান ফিরলো কালোফের বাড়িতে। আরও লোক ছিলো সেখানে। প্রথমে কিছু বলতে চাইনি। যখন বললো, সাঁড়াশি দিয়ে চোখ উপড়ে নেবে তখন সব বলে দিলাম।

ততক্ষণে একজন অফিসার সহ পুলিসের দল দুর্গের চত্ত্বরে পৌঁছে গেছে। তরুণ অফিসার হেসে উলরিখের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বললো, সবাই এঞ্জেলার বাড়িতে অপেক্ষা করছে। চলুন আমরা সেখানে যাই।

উলরিখ উত্তেজিত গলায় বললেন, দুর্গের নিচে অনেক ঘর। ওদের লোকজনরা সব শেয়ালের মতো সুড়ঙ্গ কেটে সাংঘাতিক এক আস্তানা বানিয়েছে।

সুড়ঙ্গের একটা মুখ ছুতোর মিস্ত্রি কার্লোফের বাড়িতে। আপনি ভাববেন না। ওদের ব্যবস্থা আমি করছি।

শুধু এঞ্জেলা গিফান নয়, তাঁর বাড়িতে স্বপনের বাবা মাও অপেক্ষা করছিলেন উৎকণ্ঠিত হয়ে। স্বপনদের দেখে তাদের মুখে হাসি ফুটলো। এঞ্জেলা ছুটে এসে শীলাকে জড়িয়ে ধরলেন–লক্ষ্মী মেয়ে, শয়তানরা কি তোমাদের মারধোর করেছিলো?

মৃদু হেসে শীলা বললো, না ফ্লাইন। তবে আপনি যদি পুলিসে খবর না দিতেন তাহলে কাল সকালে ডানিউবের তীরে আমাদের লাশ পাওয়া যেতো।

স্বপন ব্যগ্র গলায় এঞ্জেলাকে প্রশ্ন করলো, আপনি তো জানতেন না রনিকে ওরা গ্রেফতার করেছে। পুলিসে খবর দেয়ার কথা আপনার মনে হলো কেন?

একগাল হেসে এঞ্জেলা বললেন, আমারও কি মনে হতো? ভাগ্যিস জাদুঘরে এসে কথাটা ভাগনারকে বলেছিলাম। ও শুনেই আঁতকে উঠলো–নাকি কার্লোফ ইদানীং বদলোকের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। বললো, বিদেশী একটা ছেলের জন্য কার্লোফের এমন গায়ে পড়া দরদ খুবই সন্দেহজনক। ও নাকি বিদেশীদের দু চোখে দেখতে পারে না। শুনেই আমি গাড়ির মেকানিক গুস্তাভকে নিয়ে ছুটলাম তোমাদের গাড়ি সারাতে । আমার ছোট গাড়ি নিয়ে এতদূর যেতে সাহস হচ্ছিলো না। গুস্তাভ বললো, আমার একা যাওয়া ঠিক হবে না। সেও সঙ্গে যাবে। তারপর আমরা ডেগেনডর্ফ এসে পুলিসকে সব বললাম। পুলিসও নাকি সন্দেহ করছিলো বদমাশরা এখানে আখড়া বানিয়েছে। কোনো সূত্র পাচ্ছিলো না বলে এগুতে পারছিলো না। পুলিস স্টেশন থেকে জেরানিয়াম গিয়ে তোমাদের বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলাম দুপুরে। সেই থেকে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্য।

উলরিখ একগাল হেসে বললেন, আমার কী বুদ্ধি! ফুলাইনকে আমি নাৎসিদের দলের বলে সন্দেহ করে বসেছিলাম!

স্বপন বললো, আমরা যেমন ডালমানকে করেছিলাম।

ছোটদের স্ট্রবেরি জুস আর বড়দের হাতে বিয়ারের মগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আজ কারও ফেরা হবে না। তোমরা টিটলিঙের অভিশাপ ঘোচানোর জন্য এত বড় ঝুঁকি নিয়েছো শুনে গ্রামের সবাই তোমাদের জন্য গির্জায় প্রার্থনা করছে।

সন্ধ্যার পর তরুণ পুলিস অফিসার এলো এঞ্জেলার বাড়িতে। বললো, সব মিলিয়ে মোট এগারো জন ধরা পড়েছে। তবে আসল শয়তান বরিসই নাকি পালিয়ে গেছে।

বরিস কোনটা? জানতে চাইলে উলরিখ । সব কিছু ওঁর জানা দরকার। ডার স্পিগেল পত্রিকায় রিপোর্ট লেখার জন্য দারুণ সব মাল মশলা জোগাড় হয়েছে।

লম্বা, কালো স্যুট পরা, আমাদেরই বয়সী। ধরা পড়তো ঠিকই, হঠাৎ স্মোক বম্ব ছুঁড়ে আমাদের কাবু করে পালিয়ে গেলো। ধরতে পারলে ওর কাছ থেকে কথা বের করা যেতো।

এঞ্জেলা বললেন, যে মার খেয়েছে, শয়তানটা নিশ্চয় টিটলিঙের ধারে কাছে আসবে না।

আমার সরাইখানা আবার আগের মতো জমজমাট হয়ে উঠবে। হাসি মুখে ঘরে ঢুকলো বুড়ো স্তেফান–শোনো ছেলেমেয়েরা, তোমাদের বাবা মাকেও বলি আজ গ্রামের সবার জন্য আমার পানশালা খোলা। তোমরা আমার বিশেষ অতিথি। আশা করি শীলার সঙ্গে আমার নাচ সবাই উপভোগ করবে।

ফুর্তিবাজ বুড়ো স্তেফানের কথায় ঘর সুদ্ধো সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। গ্রামের আরও লোক জড়ো হলো এঞ্জেলার বাড়িতে। তাদের ভেতর গুফো বুড়ো জোয়াকিম, গাড়ির মেকানিক গুস্তাভ আর জাদুঘরের ভাগনারও ছিলো। স্বপনের বাবা মা বসেছিলেন ঘরের এক কোণে। তাঁদের ছেলেমেয়েরা রাতারাতি হয়ে উঠেছে দারুণ এক ঘটনার মধ্যমণি। স্বপনের বাবা বললেন, ছেলেমেয়েদের জন্য তোমার নিশ্চয় গর্ব হচ্ছে ইভা।

কেন হবে না! গর্বিত গলায় ইভা বললেন, নাৎসিরা আমার বাবা মাকে হত্যা করেছিলো। আমার ছেলেমেয়েরা নব্য নাৎসিদের একটা ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছে।

আমার কী মনে হচ্ছে জানো?

কী মনে হচ্ছে?

দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য একদিন রাজনীতি করতে নেমেছিলাম। টিকতে না পেরে দেশ থেকে পালিয়েছি। এত বছর একধরনের অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আজ মনে হচ্ছে আমি যা পারিনি আমার ছেলেমেয়েরা তা পারবে।

বাইরে আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ বাভারিয়ার পাহাড় আর বনে জ্যোৎস্নার ঢল নামিয়ে দিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে বহু বছর দেশছাড়া শফিক খানের মনে হলো, এতকাল নিজেকে একা ভেবে ভয় পেয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। এবার তিনি নির্ভয়ে দেশে ফিরে যেতে পারবেন।