৫-৬. হিরণছড়ির স্বপ্নের বাড়ি

০৫. হিরণছড়ির স্বপ্নের বাড়ি

আতিক কাকু আগেই বলেছিলেন জায়গাটা দুর্গম। সকালে স্পিড বোটে উঠে খানিকটা উজানে যেতেই ছোট পাহাড়ী নদীর দু পাশের জঙ্গল ওদের গিলে খেতে চাইলো। যত উজানে যাচ্ছিলো জঙ্গল ততই ঘন হচ্ছিলো চারপাশে। কুয়াশায় জঙ্গলটাকে মনে হচ্ছিলো ঘষা কাঁচ দিয়ে ঢাকা। নদীটাও ক্রমশ সরু হচ্ছিলো। ফরহাদ বন্দুক হাতে স্পিডবোর্টের পেছনে বসেছে। মাঝে মাঝে নাকি শান্তি বাহিনীর লোকেরা হামলা করে।

স্পিড বোটটা বেশ বড়। দশ বারোজন লোক অনায়াসে যেতে পারে। বোটের চালক আর নিকি ছাড়া যাত্রী ওরা সাত জন। মাঝখানে ফাইবার গ্লাসের চারটা বেঞ্চ রয়েছে। আতিক কাকু আর চাচী বসেছেন সামনের বেঞ্চে। মাঝখানের দুই বেঞ্চে রিমি, জয়, সিমি আর সুমন। নিকি একাই বেঞ্চ জুড়ে শুয়ে আছে। পানি ওর পছন্দ নয়। এ ছাড়া রয়েছে ওদের ব্যাগ স্যুটকেস।

স্পিড বোটে উঠেই চাচী ফরহাদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাজার টাজার সব করা হয়েছে তো?

ফরহাদ বলেছে, পরশু আমি নিজে শহরে এসে ফর্দ মিলিয়ে সব কিনেছি। শহর মানে রাঙ্গামাটি।

শহর থেকে মাইল দশেক আসার পর স্পিড বোট নদী ছেড়ে ডান দিকের একটা খালে ঢুকে গেলো। দুপাশের ঘন সবুজ জঙ্গল ওদের আরও চেপে ধরলো। উত্তেজনায় রিমির বুকের ভেতর ঢিব ঢিব করছিলো। প্রতি মুহূর্তে ও আশা করছিলো এই বুঝি জঙ্গলের ভেতর থেকে মঙ্গোলিয়ান চেহারার শান্তি বাহিনীর ডাকাতরা তীর ধনুক নিয়ে হামলা করবে। ফরহাদ একা কটাকে সামলাবে? ও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো বুকে তীর লেগে ফরহাদ স্পিডবোট থেকে পানিতে পড়ে গেছে। ওদের ড্রাইভারের বুকেও তীর লেগেছে। দুপাশের জঙ্গল থেকে ডাকাতরা পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে স্পিড বোট ধরার জন্য। বোটের কাছাকাছি আসতেই বৈঠা তুলে নিয়ে রিমি সমানে ওদের মেরে চলেছে। সবাই ভয়ে চিৎকার করছে। রিমি চেঁচিয়ে বলছে, হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে শয়তানগুলোকে মারো। নিকি, কামড়ে গলা ফুটো করে দে।

ঘড়িতে তখন নটা বাজলেও দুপাশের পাহাড় আর জঙ্গল থেকে গড়িয়ে আসা কুয়াশা খালের ওপর সাদা ধোয়াটে চাদর বিছিয়ে রেখেছে। জয়ের মনে হচ্ছিলো এই বুঝি কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে স্পিড বোট উল্টে পড়বে। পাশে তাকিয়ে দেখলো রিমি বিড় বিড় করে কী যেন বলছে। পেছনে নিচু গলায় সিমি আর সুমন কথা বলছিলো। স্পিড বোটের ইঞ্জিনের শব্দে ওদের কথা শোনা যাচ্ছিলো না। রিমিকে আস্তে ধাক্কা দিয়ে জয় জিজ্ঞেস করলো, মনে মনে কার সঙ্গে কথা বলছিস?

চমকে উঠে রিমি বললো, নাম ভাবছিলাম–ধর হঠাৎ যদি শান্তি বাহিনী আমাদের অ্যাটাক করে?

জয় হেসে বললো, কাপ্তাই লেক আর বরকলের নদীতে ছোট খাট লঞ্চ নয়তো নৌকায় মাঝে মাঝে ওরা হামলা করে। তবে আমাদের এই খালে কখনও ঢোকেনি। এসপি কী বললেন শুনলি না? এদিকে শান্তিবাহিনীর উৎপাত নেই।

রিমি আপন মনে বললো, তবে কি রাজেন সরকারকে জ্বীনে তুলে নিয়ে গেছে?

জয় শুনতে না পেয়ে পললো, কী বলছিস?

তুই জ্বীন ভূত বিশ্বাস করিস?

নিজে কখনও দেখিনি। আমাদের প্রজেক্টের চাকমা মালী মঙচু বলে জঙ্গলে নাকি দানো আছে।

কী করে দানো?

জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে কেউ যদি দানোকে বিরক্ত করে তাহলে দানো ওদের ঘাড় মটকে দেয়।

দানোকে বিরক্ত করবে কী ভাবে?

জঙ্গলের গাছ কাটলেও দানো বিরক্ত হয়।

তুই এসব বিশ্বাস করিস?

কখনও মনে হয় মঙচু বানিয়ে বলছে। কখনও মনে হয় হতেও পারে।

রাঙ্গামাটি থেকে সকাল আটটায় ওদের স্পিড বোট ছেড়েছিলো। হিরণছড়ি এসে পৌঁছলো সোয়া দশটায়। প্রজেক্টের এলাকার আশে পাশে গাছপালা তেমন ঘন ছিলো না। ততক্ষণে কুয়াশা মিলিয়ে গেছে। সকালের রোদে কুয়াশা ভেজা গাছপালা ঝোঁপঝাড় সব কিছু চকচক করছে। চারপাশে নাম না জানা পাখিরা ডাকছে।

লম্বা কাঠের পাটাতনের গায়ে স্পিডবোট এসে থামতেই প্রজেক্টের জনা তিনেক গার্ড এগিয়ে এলো। ফরহাদ ওদের বললো ব্যাগ স্যুটকেসগুলো সব তুলে নিতে। আতিক কাকু গার্ডদের প্রশ্ন করলেন, রাজেন বাবুর কোন খবর পাওয়া গেলো?

বয়স্ক গার্ড শুকনো গলায় শুধু বললো, জ্বী না স্যার।

এতক্ষণ পর শুকনো মাটি পেয়ে নিকি মহা আনন্দে ঘেউ-উ বলে ডাক ছেড়ে লাফ দিয়ে পাটাতনে নামলো। বিশাল শরীরে ওকে লাফ দিতে দেখে কম বয়সী যে দুজন মাল নিতে এসেছিলো তাদের একজন আরেকজনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তারপর দুজন কাদার ভেতর গড়াগড়ি খেলো। ওদের অকারণে ভয় পেতে দেখে নিকি রেগে গেলো। গম্ভীর গলায় ঘেউ, ঘেউ ঘেউ-উ, বললো। ভাবখানা এই-তোমরা চোর না ডাকাত, আমাকে ভয় পাচ্ছো কেন?

নিকির মনের খবর জানতে না পেরে বয়স্ক গার্ডও দুপা পিছিয়ে গেলো। বোটের ভেতর রিমি ততক্ষণে হেসে জয়ের গায়ে গড়িয়ে পড়েছে। জয় কোনো রকমে হাসি চেপে ডাকলো, নিকি, একদম চুপ। বসো ওখানে।

জয়ের ধমক খেয়ে নিকি পা দুটো সামনে মেলে দিয়ে মাটিতে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে বসলো। আড়চোখে পিট পিট করে জয়কে একবার দেখলো। বলতে চাইলো, ওরা অযথা ভয় পেয়েছে, আমি ভয় দেখাই নি।

আতিক কাকু আর চাচী আগে নামলেন। পেছন পেছন অন্য সবাই নামলো এক এক করে। পাটাতনের কিনারে দাঁড়িয়ে বয়স্ক গার্ডটা হাত বাড়িয়ে সবাইকে নামতে সাহায্য করছিলো।

আতিক কাকু একটু হেসে সিমি রিমিকে জিজ্ঞেস করলেন, কি মামণিরা, কেমন লাগছে?

সিমি বললো, দারুণ সুন্দর জায়গা।

রিমি উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, ইচ্ছে করছে চিরদিন এখানে থেকে যাই।

চাচী হেসে বললেন, এখানে টেলিভিশন নেই, ভিসিআর নেই, ইলেকট্রিসিটি নেই, দুদিন পরেই বোরিং লাগবে।

সিমি বললো, টিভি ভিসিআর দেখতে দেখতে এখন বিরক্ত লাগে চাচী।

আতিক কাকু মৃদু হাসলেন, তোমাদের ভালো লাগলেই আমি খুশি।

স্পিড বোট থেকে লাফ দিয়ে নেমেই জয় আর রিমি ছুটলো নতুন বাড়ির দিকে। নিকিও ওদের সঙ্গে ছুটলো। সিমির পাশে হাঁটতে হাঁটতে সুমন নিচু গলায় বললো, তোমারও ওদের মতো ছুটতে ইচ্ছে করছে?

কী পাগলের মতো কথা বলছো?

সিমি আর জয়কে কিন্তু বেশ লাগছে।

তোমার ইচ্ছে হলে ওদের মতো দৌড়াতে পারো।

পারি, যদি তুমি রাজী হও।

আমি রিমির মতো খুকি নই।

মাঝে মাঝে তুমি শীর্ষেন্দুর বুড়ি পিসিমাদের মতো কথা বলো।

আর তুমি নিজে কী?

আমি? একটু ভেবে সুমন বললো, কখনও মনে হয় আমি অপরাজিতর অপু।

তুমি একটা আস্ত ছোট লোক সুমন ভাই।

কেন?

তুমি বিভূতিভূষণের অপু, আর আমি শীর্ষেন্দুর পিসিমা!

তাহলে তুমি সিন্ডারেলা।

ধ্যেৎ! বলে লাজুক হাসলো সিমি।

সিমির বয়স পনেরো, সুমনের উনিশ। এই বয়সে সব ভাবুক ছেলেই নিজেকে অপু ভাবে আর মেয়েরা ভাবে স্নো হোয়াইট নয় সিণ্ডারেলা। সুমনের সঙ্গে কাল সন্ধ্যায় কথা বলে ওর মনের অনেক খবর জেনেছে সিমি। রাতে বিছানায় শুয়ে ভেবেছে সুমনের মতো একটা বন্ধু থাকলে বেশ হয়।

জয়দের নতুন বাড়ি দেখে সিমি রিমির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। পেছনে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ঝাউবন। তার সামনে কাঠের দোতালা বাড়ি। রাঙ্গামাটির অন্য সব বাড়ির মতো কাঠের খুটির ওপর বড় পাটাতন। তার চার পাশে কাঠের রেলিং। বাইরের দেয়ালের রং হালকা বাদামি আর ছাদে দেয়া হয়েছে ঘন জলপাই সবুজ রঙ। একতলার মতো দোতালার চারদিকেও ঘেরা বারান্দা। কাঠের রেলিংগুলো সাদা রঙ করা। দরজা জানালার রঙও সাদা। সিমি বললো, বিদেশী ক্যালেন্ডারের ছবিতেই শুধু এত সুন্দর বাড়ি দেখা যায়।

জয় আর সুমন বাড়িটা বানাবার সময় কয়েকবারই দেখেছে। ওদেরও মনে হলো রঙ করার পর সারা বাড়ির চেহারা শুধু নয়, চারপাশের পরিবেশটাও বদলে গেছে। বাড়ি থেকে অল্প দূরে ডানদিকে মাঝারি আকারের হ্রদ। নীল আকাশ আর গাঢ় সবুজ পাহাড়ের ছায়া পড়েছে হ্রদের টলটলে পানিতে। চাচী বারান্দায় উঠে ডাকলেন–তোমরা সবাই দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো।

সিমি, রিমি, জয় আর সুমন এসে সামনের বারান্দায় পাতা বেতের চেয়ারে বসলো। ফরহাদ ওদের সঙ্গে আসেনি। প্রজেক্টের অফিস আর স্টাফদের থাকার জায়গা এখান থেকে দেখা গেলেও বেশ দূরে। হ্রদের ডানপাশে পাহাড় পরিস্কার করে রাবার গাছ। লাগানো হয়েছে। এক মানুষ উঁচু হয়েছে গাছগুলো। রোদের আলোয় ঘনসবুজ পাতাগুলো চকচক করছে। সিমি জয়কে বললো, তোদের রাবার প্রোডাকশন শুরু হতে অনেক সময় লাগবে মনে হচ্ছে।

জয় বললো, স্টাফ কোয়ার্টারের ওদিকের পাহাড়ের গাছগুলো এর ডবল হয়েছে। ফরহাদ ভাইতো বলেছে দু বছরের ভেতরই ওগুলো থেকে রাবার নেয়া যাবে।

রিমি জয়কে প্রশ্ন করলো, ফরহাদ ভাই কি অন্য স্টাফদের সঙ্গে থাকে?

এ বাড়ি হওয়ার আগে স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতো। এখন এখানে থাকবে।

তুই কোথায় থাকবি?

পাঁচলাইশের বাড়ির মতো ছোটরা সব দোতালায়, বড়রা নিচের তলায়।

ফরহাদ ভাই ছোটদের দলে না বড়দের দলে।

বাবা মার কাছে ছেলে মেয়েরা সব সময় ছোটটি থাকে।

সিমি একটু হেসে বললো, যতদিন না বিয়ে হচ্ছে।

রিমি বললো, তোর তো ওই এক চিন্তা আপু। কত তাড়াতাড়ি পাশ করে বেরোবি, কত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবি।

সুমনের সামনে রিমির এ ধরনের কথা বলা সিমি মোটেই পছন্দ করলো না। বললো, রিমি, বড়দের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় এটা তোমাকে নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না?

সিমির কথার ধরন দেখেই রিমি বুঝলো ও বেশ রেগেছে। সরি আপু বলে জয়ের দিকে তাকালো–চল, ওপরে যাই, আমাদের ঘরগুলো দেখে আসি।

জয় বললো, তুমিও চলো না সিমি আপু।

সিমি বললো, তোমরা যাও। আমি একটু পরে আসছি।

কাঠের সিঁড়িতে রিমি আর জয়ের ধুপ ধাপ পায়ের শব্দ মিলিয়ে না যেতেই ফরহাদ এলো। একটা চেয়ার টেনে সিমির সামনে বসে হাসিমুখে জানতে চাইলো, নতুন বাড়ি কেমন হয়েছে দেখতে?

সিমি মুগ্ধ গলায় বললো, এরকম জঙ্গলের ভেতর এত সুন্দর বাড়ি থাকতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

ফরহাদ বললো, পুরো বাড়ির নকশা আমি করেছি। তদারকিও আমার।

সুমন মুখ টিপে হেসে বললো, নকশাটা তুমি একটা সুইস ক্যালেন্ডার থেকে নিয়েছে ফরহাদ ভাই।

ফরহাদ একটু অপ্রস্তুত হলো–সে তো বাইরের চেহারাটা। ভেতরে কোথায় কোন ঘর হবে, সিঁড়ি কীভাবে উঠবে সবতো আমাকেই মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হয়েছে। এ ধরনের কাটের পাটাতনের ওপর বাড়ির ব্যালেন্স একটা বড় ফ্যাক্টর। নিচে দেখেছিস খুঁটিগুলো কীভাবে সাজানো হয়েছে। ক্যালেন্ডারে এসব ছিলো?

এ আর এমন কঠিন কী? রাঙ্গামাটি, বান্দরবন সব জায়গায় এরকম মাচার ওপর। বাড়ি বানানো হয়।

ওসব বাড়ির ভেতর বাথরুম থাকে না। এত বড় বড় দরজা জানালাও থাকে না। লিখিস তো ন্যাকা ন্যাকা প্রেমের কবিতা, তাও যদি কাগজওয়ালারা ছাপাতো! তুই কী বুঝবি আর্কিটেকচারাল ব্যালেন্স কাকে বলে?

সিমি অবাক হয়ে বললো, সুমন ভাই, তুমি কবিতা লেখো? কই বলোনি তো?

সুমন বিব্রত হলো, না মানে … বলার মতো কিছু না।

ফরহাদ মুখ টিপে হেসে বললো, কলেজ ম্যাগাজিনে একটা যে ছাপা হয়েছিলো ওটার কথা বলতে পারি।

স্কুল আর কলেজ ম্যাগাজিনে সবাই লেখে, ফরহাদ ভাই, তুমি কি এবার থামবে?

ঠিক আছে থামছি। রিমি আর জয় কোথায়? ওদের ডেকে আন। রিমি নাকি রাজেনের কেস তদন্তের ভার নিয়েছে।

সুমন কথা না বলার অজুহাত পেয়ে বেঁচে গেলো। সিমির সামনে ফরহাদ ওকে যে ভাবে ঠাট্টা করেছে এটা ওর মোটেই ভালো লাগেনি।

সুমন চলে যাওয়ার পর ফরহাদ বললো, তারপর সিমি, কী মনে হচ্ছে?

সিমি একটু চমকে উঠলো–কোন ব্যাপারে?

ফরহাদের গলার স্বর বেশ ভারি, দেখতেও অনেক ম্যানলি। ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সিমির বুকের ভেতরটা তিরতির করে কেঁপে উঠলো।

ফরহাদ বললো, শহরের সব হইহল্লা থেকে অনেক দূরে এরকম একটা জায়গায় থাকতে পারবে?

সিমি আস্তে আস্তে বললো, বেড়াবার জন্য চমৎকার জায়গা। আমার তো ইচ্ছে করছে পুরো ছুটিটাই এখানে কাটিয়ে দিই।

ছুটি কাটানো নয়, আমার মতো যদি সব সময়ের জন্য থাকতে বলা হয়?

মনে হয় না পারবো।

হা হা করে গলা খুলে হাসলো ফরহাদ–আমি কিন্তু দুবছর ধরে পড়ে আছি এখানে।

মাঝে মাঝে তো শহরে যান।

মাসে দু মাসে একবার।

আপনার সময় কাটে কিভাবে?

মজুর ঠেঙিয়ে। দেড়শ একর জমির প্ল্যানটেশন তো সোজা কথা নয়। আমি আসার আগে তিন বছরে মাত্র পঁচিশ একর জমিতে গাছ লাগানো হয়েছিলো। আমি এসে লাগিয়েছি নব্দুই একর।

আপনার কোনো অবসর নেই?

সন্ধ্যের পর কিছুক্ষণ অফিস ওয়ার্ক করি। রাতে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত তিন চার ঘণ্টা অবসর পাই।

তখন কী করেন?

গান শুনি ক্যাসেটে। কখনও হালকা কোনো বই পড়ি।

ফরহাদের একা থাকার কথা ভেবে সিমির খারাপ লাগলো। একবার ইচ্ছা হলো ওকে বলে, ফরহাদ ভাই, আপনাকে আমি চিঠি লিখবো। বলতে গিয়েও পারলো না। সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ করে তখন রিমিরা নামছিলো।

রিমি, জয় আর সুমন এসে বসতেই চাচী এলেন বড় ট্রেতে করে চা আর চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে। একটা কাঁচের বাটিতে আপেলও এনেছেন গোটা দশেক। বললেন, দুপুরে খেতে একটু দেরি হবে। ইচ্ছে করলে তোমরা মাছ ধরতে পারো। কিংবা ফরহাদের সঙ্গে জায়গাটা ঘুরে দেখতেও পারো।

রান্না ঘর বাড়ির পেছনে। যাওয়ার রাস্তাটা লাল ইট দিয়ে বাঁধানো, ওপরে কাঠের দোচালা ছাউনি। চাচী রান্নাঘরে যাওযার পর রিমি মুড়ি মাখা খেতে খেতে বললো, আমি আগে জায়গাটা ঘুরে দেখতে চাই। আপনার অসুবিধে হবে না তো ফরহাদ ভাই?

মৃদু হেসে ফরহাদ বললো, কোনো অসুবিধে হবে না। তোমার তদন্তের কাজটা কী এখনই শুরু করবে?

রিমি গম্ভীর গলায় বললো, এখনই করা দরকার। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যত দেরি হবে সূত্র তত হারিয়ে যাবে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফরহাদ হাসি চেপে বললো, তোমার তদন্তটা কী ধরনের হবে–আমরা যারা তোমার সহকারী আছি জানলে সুবিধে হতো।

রিমি কিছুক্ষণ ভেবে বললো, আমি শুরু করতে চাই রাজেন সরকারের ঘর থেকে। তারপর যেখানে তাকে শেষ দেখা গেছে সেখানে যেতে চাই। সিকিউরিটি গার্ডদের সঙ্গেও কথা বলতে চাই।

একদিনে কি এত কিছু করা যাবে?

কাজটা শুরু করতে অসুবিধে কোথায়? একদিন না হলে দুদিন বা তিনদিন লাগবে। কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়।

সুমন হেসে সিমিকে বললো, তোমাকে আমি ঠাট্টা করে শীর্ষেন্দুর পিসিমা বলেছিলাম। এ যে দেখি ফেলুদার দিদিমা।

আহ সুমন ভাই! রিমি ধমক দিয়ে বললো, দেখতে পাচ্ছো একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি? এরকম করলে তো কোনো কাজই হবে না।

ফরহাদও সুমনকে ধমক দিলো–ফের যদি কথার মাঝখানে এরকম ফোড়ন কাটিস, –তোকে দল থেকে বের করে দেবো।

দুদিক থেকে ধমক খেয়ে সুমন চুপসে গেলো। পাশেই বসেছিলো নিকি। সুমনের করুণ চেহারা দেখে নিকি ওর গাল চেটে দিলো। তারপর বাইরে একটা কাঠবেড়ালি দেখে ওটার পেছনে ছুটলো।

রিমি বললো, আপনি বলতে পারবেন ফরহাদ ভাই, রাজেন সরকার ডায়েরি লিখতো কিনা?

একটু ভাবুক টাইপের ছিলো। ডায়েরি লেখাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আমরা প্রথমে ওর ঘরে গিয়ে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র দেখবো। ভালো করে খুঁজতে হবে–ডায়েরি বা অন্য কোনো জায়গায় চিঠি বা চিরকুট জাতীয় কিছু রেখে গেছে কিনা।

সিমি বললো, রাজেন সরকার তো খুন হয়নি রিমি, হয়তো কেউ কিডন্যাপ করেছে, নয়তো বিশেষে কোনো কারণে কোথাও আটকা পড়ে আছে। কারও ব্যক্তিগত জিনিস ঘাটাঘাটি করা আমি মোটেই পছন্দ করি না।

ফরহাদ রিমির দিকে তাকিয়ে বললো, তদন্তের বৃহত্তর স্বার্থে এটা মেনে নাও ভাই সিমি। দরকার হলে রিমি আমাকেও জেরা করতে পারে।

সুমন একটু হেসে বললো, তাহলে কি আমরা উঠবো?

ফরহাদ মুখটা কচুমাচু করে বললো, ডিটেকটিভ রিমি, আমি কিন্তু সব সময় তোমার সঙ্গে থাকতে পারবো না। প্রজেক্টে এখন অনেক কাজ।

অসুবিধে হবে না। রিমি গম্ভীর হয়ে বললো, দরকার হলে আমি ডাকবো। এবার তাহলে আমরা আমাদের তদন্তের কাজ শুরু করতে পারি।

.

০৬. রাজেনের নোটবই ও রহস্যময় ক

আজ সকালে রাঙ্গামাটি গিয়াছিলাম ডিজেল কিনিতে। বোটের ড্রাইভার নুরু মিয়া চুরি করে। সেই জন্য ম্যানেজার ফরহাদ সাহেব বলিলেন আমাকে যাইতে। এইভাবে মাসে দুই তিন বার রাঙ্গামাটি যাইবার সুযোগ হইয়া যায়। এইসব সুযোগ আমি কখনও হাতছাড়া করি না। দিনের পর দিন পাহাড়ে জঙ্গলে পড়িয়া থাকিতে থাকিতে মনে হয় আমি বুঝি মানুষ নই, গাছপালা কিংবা জীবজন্তু হইয়া গিয়াছি। গত পরশু রাত্রিতে অনেকক্ষণ ঘুম আসিতেছিল না দেখিয়া বাহিরে ঘুরিতে গেলাম। প্রজেক্টের এলাকার শেষ প্রান্তে আসিয়া একটি টিলার উপর বসিলাম। সেদিন পূর্ণিমা ছিল। অল্প কুয়াশা ছিল। জ্যোৎস্নার আলোকধারা কুয়াশার হালকা চাদর ভেদ করিয়া নামিয়া আসিয়া পাহাড় জঙ্গল সব কিছু ভাসাইয়া দিয়াছে। দূরে শিয়াল ডাকিল। আমিও শিয়ালের মত ডাকিলাম। শিয়ালেরা আমার ডাকে সাড়া দিল। মনে হইতেছে আর কিছুদিন পর গাছের ভাষাও আমি বুঝিতে পারিব।

নোট বইয়ের পাতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে এইভাবে নিজের মনের কথা লিখেছে রাজেন। ওর ঘরে এসে সিমি, রিমি জয় আর সুমনকে বেশি খুঁজতে হয়নি। তক্তপোষের ওপর বিছানো পাতলা তোষকটা ওল্টাতেই মাথার কাছে পেয়ে গেছে সবুজ রেক্সিনে বাঁধানো ছোট এই নোট বইটা। কোনো তারিখ নেই। কোথাও পর পর কয়েক পাতা লেখা, মাঝখানে বেশির ভাগই ফাঁকা। তারিখ দেয়নি বলে কবেকার লেখা বোঝারও উপায় নেই। সাধু ভাষায় লেখা, মাঝে মাঝে কাব্য করার চেষ্টা করেছে। বাংলায় অনার্সের ছাত্র সুমন মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো-দ্রলোক সাধারণ বিএ পাশ হলেও ভাষার ওপর যথেষ্ট দখল আছে। সুমনই পড়ছিলো নোট বইটা। পড়া থামাতেই রিমি বললো, থামলে কেন পড়ে যাও।

ফাঁকা কয়েক পাতা উল্টে সুমন আবার পড়লো

এমনই এক জায়গায় আমাদের মালিক আতিকুর রহমান সাহেব রাবারের বাগান বানাইতেছেন যে আট দশ মাইলের ভিতর কোন লোকালয় নাই। বাজার হাট করিতে হইলে রাঙ্গামাটি না গিয়া গত্যন্তর নাই। ডাইল কিনিতে গিয়া সকালে ক-এর সহিত দেখা হইল। ভারি অমায়িক ও বন্ধুবৎসল ভদ্রলোক। যদিও মৌলবিদের মতো লম্বা আলখাল্লা পরেন, মাথায় টুপি দেন এবং দাঁড়ি রাখেন তবু কোন রকম গোঁড়ামি তাঁহার মধ্যে নাই। আমি হিন্দু বলিয়া অবজ্ঞা করেন না। এর আগে একদিন পেট্রল পাম্পে আলাপ হইয়াছিল। আমার নাম-ধাম, কি করি–এইসব জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। আজ আমাকে দেখা মাত্র–আরে রাজেন বাবু যে, কেমন আছেন, ইত্যাদি কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার গলার স্বর মেয়েদের মত পাতলা। কথা বলিতে বলিতে চায়ের দোকানে লইয়া গিয়া চা ও মিষ্টি খাওয়াইলেন। তিনকূলে আমার কেহ নাই বলিয়া বিস্তর দুঃখ করিলেন। নিজের কতা বলিলেন, বরকলে থাকেন, প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। তিনি নাকি রাজনীতিও করেন। দেশে সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠা করিতে চান। রাজনীতি করেন বলিয়া সরকার তাঁহাকে সুনজরে দেখেন না। বিশেষভাবে বলিলেন, আমার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে এ কথা গোপন রাখিবেন। গোয়েন্দারা জানিতে পারিলে অযথা আপনাকে হয়রানি করিতে পারে। আমি কথা দিলাম তাঁহার কথা কাহাকেও বলিব না। অতপর তিনি আমাকে চাকমাদের দোকান হইতে সুন্দর একটা উলের চাদর কিনিয়া দিলেন। আমি মানা করিয়াছিলাম, তিনি শুনেন নাই। বলিলেন, ইহা তাঁহার স্নেহের উপহার। আমার ঊনত্রিশ বৎসরের জীবনে কোনদিন কাহারও নিকট হইতে আমি কোন উপহার পাই নাই। তাঁহার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় মন ভরিয়া গিয়াছে। আরও বলিলেন, মাঝে মাঝে তিনি আমাকে দেখিতে আসিবেন। তাঁহাকে যেন বড় ভাই মনে করি। বলিলাম, তিনি আসিলে আমি খুশি হইব। পৃথিবীতে এখনও ক এর মত মানুষ আছে।

রাজেনের লেখা শুনতে শুনতে সিমি, রিমি, জয় রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লো। এক নাগাড়ে তিন পাতা পড়ে থামা মাত্র সুমনের ওপর ওরা ঝাঁপিয়ে পড়লো–আহ, থামলে কেন? কোনো থামাথামি নেই, পড়ে যাও।

ফরহাদ ওদের সঙ্গে আসেনি। একজন গার্ডের হাতে রতনের ঘরের চাবি দিয়ে বলেছে, তোমরা কাজ শুরু কর, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই যাচ্ছি।

নিকি বাইরে বসে পাহারা দিচ্ছিলো। বুদ্ধিটা রিমির। জয়কে বলেছে, এ সময় অন্য কেউ এখানে আসুক আমি চাই না। নিকিকে বল পাহারা দিতে।

জয় বলা মাত্র নিকি সামনের পা দুটো মেলে দিয়ে দরজার সামনে বসে পড়েছে। সিমি রিমিদের তাড়া খেয়ে সুমন আবার পড়তে যাবে তখনই বাইরে নিকির গলার শব্দ শোনা গেলো। রিমি চমকে উঠলো –নিশ্চয় কেউ আসছে!

জয় হেসে বললো, অচেনা কেউ নয়। মনে হয় ফরহাদ ভাই নয়তো আব্দু।

ঘরের একটাই দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে লাগানো ছিলো। সুমন উঠে দরজা খুলে দিলো। সবাই তাকিয়ে দেখলো ফরহাদ এসেছে।

ফরহাদ হাসি মুখে রিমিকে প্রশ্ন করলো, কী খবর, পেলে কিছু? রিমি উত্তেজিত গলায় বললো, রাজেন সরকারের নোট বই পেয়েছি। বোঝা যাচ্ছে না কবেকার লেখা তবু মনে হচ্ছে অনেক কথা জানতে পারবো।

দেখি তো কী লিখেছে? বলে নোট বইটা নিয়ে সুমনের পড়া পাতাগুলোয় চোখ বুলালো। তারপর বললো, মনে হচ্ছে এ বছরের। আমার নোট বইতে লেখা আছে কবে ওকে পেট্রল কিনতে আর কবে বাজার করতে পাঠিয়েছি।

রিমি বললো, ঠিক আছে, পরে আমি আপনার কাছ থেকে জেনে তারিখগুলো বসিয়ে নেবো। এখন ওটা সুমন ভাইকে পড়তে দিন।

সুমন পাতা উল্টে পড়লো—

আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই ক আমাকে দেখিতে আসিবেন। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ফরহাদ সাহেব চট্টগ্রাম গিয়াছেন সেই সকালে। তাহাকে বলিয়াছিলাম আমাকেও সঙ্গে লইয়া চলুন। আগ্রাবাদে একজনের কাছে কিছু টাকা পাই, সেইটা উদ্ধার করা দরকার। তিনি বলিলেন, দুইজন একসঙ্গে বাহিরে যাওয়া ঠিক হইবে না। আপনি আগামী শুক্রবার যাইবেন। তিনি শুধু উপরওয়ালাই নন, মালিকের পোষ্যপুত্রও বটে। তাঁহার কথা না মানিয়া উপায় নাই। বিমর্ষ চিত্তে পুষ্করিনীর তেলাপিয়া মাছদিগকে মুড়ি খাওয়াইতে বসিয়াছি, এমন সময় বুড়ো গার্ড বিমলেন্দু খিসা আসিয়া খবর দিল আমার সহিত একজন হুজুর দেখা করিতে চান, বরকলের প্রাইমারি স্কুল হইতে আসিয়াছেন। বলিলাম, তাঁহাকে আমার ঘরে আনিয়া বসাও। বাটির সব মুড়ি পুস্করিনীর পানিতে ঢালিয়া দিয়া ঘরে আসিয়া বসিয়াছি। একটু পরে ক আসিলেন। কুশল বিনিময়ের পর নানান বিষয় আলোচনা করিয়া হঠাৎ হাসিতে হাসিতে বলিলেন, চিরকাল কি একা এই জঙ্গলে পড়িয়া থাকিবেন? নাকি ঘর সংসার, সমাজের কথা কিছু ভাবিবেন? বলিলাম, ভাবিলেও উপায় তো দেখি না। তিন হাজার টাকা বেতন পাই। ঘর ভাড়া যদিও দিতে হয় না, মেসে তিন বেলা খাইতেই দেড় হাজার টাকা চলিয়া যায়। ইহা ছাড়া তেল, সাবান ইত্যাদি কিনিতে হয়, দাঁতের মাজন লাগে, দাড়ি কাটার সাবান ব্লেড লাগে, অসুখ বিসুখ হইলে খরচ হয়–বলিতে গেলে মাসের শেষে তেমন কিছুই হাতে থাকে না। দু একশ টাকা বাঁচিলে পোস্টঅফিসে জমা করি। ওইখানে সুদ বেশি পাওয়া যায়। যাই হোক বউ খাওয়াইবার সামর্থ নাই। তাহাছাড়া বিবাহের পর সংসারও তো বাড়িবে। তাই এই সব চিন্তা বাদ দিয়াছি। ক আমার দুঃখের কথা শুনিয়া বিচলিত হইলেন। বলিলেন, আপনার জন্য আমি ভাল ব্যবস্থা করিতেছি। শুনিয়া বড়ই ভাল লাগিল । জানিনা কী করিতে পারিবেন তবু এইভাবে কেহ তো বলেন না।

এপর্যন্ত পড়ে সুমন থামলো। ফরহাদ বললো, দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে তো! আমার ওপর ওর এত রাগ-জানতামই না! বয়সে বড় হলেও সারাক্ষণ যেভাবে ফরহাদ ভাই, ফরহাদ ভাই করতো

রিমি বাধা দিয়ে বললো, আগে ওর লেখা সবটুকু শুনি, পরে অন্য কথা আলোচনা করা যাবে।

জয়ও ওর সঙ্গে গলা মেলালো–হ্যাঁ সুমন ভাই, কুইক! দুপুরের আগে ওটা শেষ করা চাই।

সুমন মৃদু হেসে পড়লো–

ক আজ যে প্রস্তাব দিলেন তা লোভনীয় হইলেও সাহস হইতেছে না। সরাসরি বলিলেন তাহাদের দলের হইয়া কাজ করিতে হইবে। বরকল হইতে সীমান্তের ঐ পারে মিজোরামে তাহাদের দলের শুভানুধ্যায়ীরা আছে। তাহাদের গোপন চিঠিপত্র আদানপ্রদান করিতে হইবে। আমি হিন্দু বলিয়া ভারতে আমাকে কেহ সন্দেহ করিবে না। ত্রিপুরা, মিজোরামে অনেক বাঙ্গালি হিন্দু আছে। বেতন আপাতত ভারতীয় টাকায় ছয় হাজার। প্রতি বছর এক হাজার টাকা করিয়া বাড়িবে। বলিলেন, তাহাদের শুভানুধ্যায়ীরা আমার বিবাহ, সংসার বসানো ইত্যাদিরও দায়িত্ব লইবেন। অতি উত্তম প্রস্তাব! কিন্তু সমস্যা হইতেছে বিনা পাসপোর্ট ভিসায় বর্ডার পার হইতে হইবে, মাসে তিন/চার বার। যদিও এদিকে সীমান্ত রক্ষীদের দেখা পাওয়া ভার, তবু কখনো ধরা পড়িব না এমন কথা হলফ করিয়া কে বলিতে পারে? ধরা পড়িলে বাকি জীবন জেলে পাঁচিতে হইবে। আমার ভয়ের কথা শুনিয়া তিনি উপহাস করিয়া বলিলেন, এখন যেমত আছেন উহা জেল অপেক্ষা বেশি ভালো কি? ভাবিয়া দেখিবার জন্য দুই দিন সময় লইলাম।

এ পৃষ্ঠা পড়ে সুমন বললো, এত ছোট লেখা, আমার মাথা ধরে গেছে। এবার সিমি পড়। আর বেশি নেই।

রিমি তাড়া দিলো–আপু, জলদি কর।

সিমি পড়তে লাগলো–

দুই দিন অনেক ভাবিয়া স্থির করিলাম কর প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হইবে না। তিনি যতই মিষ্টি কথা বলুন আর সব সময় নানান জিনিস উপহার দেন না কেন তাঁহার উপর শ্রদ্ধা রাখিতে পারিতেছি না। তিনি বলেন তাঁহারা নাকি সৎ লোকের শাসন চান। একজন সৎ লোক হইয়া তিনি কী করিয়া আমাকে বেআইনি কাজ করিতে প্ররোচিত করেন? ইহা তো দেশদ্রোহিতার নামান্তর! অনেক ভাবিয়াই সিদ্ধান্ত নিয়াছিলাম তাঁহাকে মানা করিয়া দিব। আজ রাত্রিতে তিনি আমার অমতের কথা জানিয়া যারপর নাই বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, কিসের দেশ দেশ করিতেছেন? এই দেশ আপনাকে কী দিয়াছে? দুর্নীতি আর বেহায়াপনায় সারা দেশ ভরিয়া গিয়েছে। আরো অনেক কথা বলিলেন। তাঁহার কথার ধরন ভাল লাগিল না। তারপর আরেকটি অদ্ভুত প্রস্তাব দিলেন। তিনি আমসাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিবেন যদি আমি প্রজেক্টের এক বৎসরের বাজেট আর কিছু দরকারী কাগজের একটি করিয়া কপি তাঁহাকে দিই। ইহাও কম অপরাধের কাজ নয়। যাহাদের নুন খাই তাহাদের গোপন দলিল বাহির করিয়া অন্যের হাতে তুলিয়া দিব এইটা তিনি কী করিয়া ভাবিলেন? আমাকে এইসব কথা বলার সাহস তিনি কোথায় পাইলেন? কারণ কি এই যে আমি গরিব, আমি হিন্দু, তিন কূলে আমার কেহ নাই? লোকটার উপর খুব রাগ হইলো। তাঁহাকে পরিষ্কার বলিয়া দিলাম, তিনি যেন আমার কাছে আর না আসেন। তিনি যাইবার সময় আমাকে শাসাইলেন–দেখিয়া লইব বলিয়া । আমার কেমন যেন ভয় ভয় করিতেছে। সারা জীবন কাহারও সাতে পাঁচে থাকি নাই। এ মৌলবিটি যেভাবে আমাকে শাসাইয়াছে এইখানে বেশিদিন থাকা বোধহয় আর সম্ভব হইবে না। মালিককে বলিতে হইবে আমাকে যেন চট্টগ্রামের অফিসে কোন কাজ দেন।

আজ ফরহাদ সাহেব রাঙ্গামাটি যাইতে বলিলেন, আমি অসুস্থতার অজুহাত দিয়া যাই নাই। আমার ভয় হইতেছে রাঙ্গামাটি গেলেই ক-এর দলের ছেলেরা আমাকে মারিবে। একবার ভাবিলাম পুরা ঘটনা ফরহাদ সাহেবকে বলি, পরক্ষণেই মনে হইল তিনি বিরক্ত হইবেন, আগে বলি নাই কেন এই কথা বলিয়া তিরস্কারও করিতে পারেন। হা ঈশ্বর, আমি এখন কী করিব?

রাজেন সরকারের নোট বইতে এ পর্যন্তই লেখা ছিলো। পরের পাতাগুলো সাদা। নোট বইয়ের শেষের দিকে ওর নিজের কিছু হিসেব লেখা আছে। আগ্রাবাদে কাকে কত টাকা ধার দিয়েছে, তার ঠিকানা-সবই ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে লেখা আছে, পড়তে গেলে মাথা ধরে যায়।

রাজেনের নোট পড়া শেষ হওয়ার পর জয় রিমিকে জিজ্ঞেস করলো, সব তো শুনলি, এবার কী করবি?

গার্ডদের যারা ক কে দেখেছে তাদের সঙ্গে কথা বলে ওর চেহারার বিবরণ নিতে হবে। আমার ধারণা বরকলে নয়, আশে পাশে কোথাও ওদের আস্তানা আছে।

ফরহাদ একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো, তোমার এরকম মনে হওয়ার কারণ। কী? যদুর জানি আশেপাশে কয়েক মাইলের ভেতর কেউ থাকে না।

কারণ একটাই। প্রতিবারই ক এখানে এসেছে তখন, যখন আপনি এখানে থাকেন না। তার মানে আপনি কখন বাইরে যান তার ওপর ওরা নজর রাখে। বরকল থেকে আপনার ওপর নজর রাখার উপায় নেই, কারণ ওটা উল্টো দিকে। আমার ধারণা খুঁজলে কাছাকাছি কোথাও ওদের আস্তানার খবর আমরা জানতে পারবো।

কথাগুলো খুব ভারিক্কি চালে বললো রিমি। অন্যরা ওর কথা এমনভাবে শুনছিলো যেন রিমি সত্যিই দলের নেতা, সব কিছু ব্যাখ্যা করার দায়িত্বও ওর।

জয় প্রশ্ন করলো, তোর কি ধারণা রাজেনদাকে ওরা কিডন্যাপ করেছে?

কিডন্যাপ করতে পারে। কিংবা কিডন্যাপিং-এর ভয়ে তিনি নিজেই কোথাও গা। ঢাকা দিয়েছেন।

গা ঢাকা দেয়ার দরকার কী? ফরহাদ ভাইকে বলতে পারতেন, থানায়ও যেতে পারতেন!

রাজেন সরকারের নোট পড়ে মনে হচ্ছে ক খুব শক্তিশালী চোরাচালানীর দলের সঙ্গে যুক্ত। মিজোরামে নিজেদের লোক থাকা সোজা কথা নয়!

ফরহাদ চিন্তিত গলায় বললো, আমি ভাবছি প্রজেক্টের কাগজপত্রের ব্যাপারে ওরা এত উৎসাহী কেন?

রিমি বললো, হতে পারে ওরা চায় না আপনারা এখানে থাকুন। হয়তো ওদের ঘাঁটি এখানে সরিয়ে আনতে চায়।

ফরহাদ মাথা নেড়ে সায় জানালো–কথাটা ভেবে দেখার মতো! চোরাচালানীদের ঘাটির জন্য এ জায়গাটা খুব চমৎকার। আমার মনে হয় কালই আমাদের রাঙ্গামাটি গিয়ে এসপি হায়দার আলীর সঙ্গে কথা বলা দরকার। সিমি যাবে নাকি!

সিমি বললো, এত কিছু যখন জানা গেছে এসপিকে তো বলতেই হবে। নইলে তিনি অন্ধকারে থেকে যাবেন।

রিমি মাথা নাড়লো–না আপু, আমি চাই না পুলিস আমাদের কাজে বাগড়া দিক। ওরা এমন হইচই বাঁধিয়ে কদের আস্তানা খুঁজতে বেরোবে সারা জঙ্গলে খবর হয়ে যাবে। আস্তানা খুঁজে পেলেও লোকজন খুঁজে পাবে না। তাছাড়া আমার ধারণা বরকলের। ওসির সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে। নইলে খোঁজ খবর না নিয়ে তিনি বলেন কী ভাবে এটা শান্তিবাহিনীর কাজ?

জয় বললো, তুই কি চাস পুলিসকে না জানিয়ে আমরা নিজেরা রাজেন সরকারকে খুঁজবো?

মাথা নেড়ে সায় জানালো রিমি–ঠিক তাই। আমরা বেড়াতে এসেছি। আশে পাশে যদি ওদের লোক থাকেও আমাদের জঙ্গলে ঘুরতে দেখলে সন্দেহ করবে না। পুলিস যা পারবে না সেটা আমরা পারবো।

ফরহাদ গম্ভীর হয়ে বললো, কাজটা খুব রিস্কি হয়ে যাচ্ছে রিমি। আব্বু তোমাদের প্রজেক্টের এলাকার বাইরে যেতে দেবেন না।

রিমি এতক্ষণ এটাই ভয় করছিলো। ফরহাদের কাছে গিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি গলায় বললো, কাকুকে এসব জানাবার কী দরকার ফরহাদ ভাই? তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলে ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত কাউকে ভয় পাই না। প্লীজ ফরহাদ ভাই, তুমি হবে আমাদের লিডার। রাজেন সরকারকে আমরা ঠিকই খুঁজে বের করবো। এই বলে রিমি ফরহাদের গালে চুমো দিলো।

ফরহাদ হেসে বললো, ঠিক আছে, আব্দুকে বলবো না। তবে লিডার তুমিই থাকবে। আমি হবো ডেপুটি লিডার।

রিমি খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো–থ্রি চিয়ার্স ফর ফরহাদ ভাই।

সবাই হাসতে হাসতে বললো, হিপ হিপ হুররে।

ঘরের ভেতর হল্লা শুনে নিকি দরজার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে বললো, ঘোউ-উ উ-উ।