৫-৬. রমনা পার্কের উত্তর দিকের গেট

রাত সাড়ে দশটার সময় রমনা পার্কের উত্তর দিকের গেট-এর সামনে মাইক্রোবাস রেখে টেকো কালো অন্ধকারে গাছের আড়ালে আড়ালে থেকে পানির ট্যাঙ্কের তলায় এলো ব্যাগটা নেয়ার জন্য।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেকো অল্পক্ষণের জন্য টর্চ জ্বেলে দেখে নিলো, কালো একটা কাপড়ের ব্যাগ ঠিকই রাখা আছে। এই ব্যাগের ভেতর দশ লাখ টাকা থাকার কথা। কালোকে ও আগেই বলে রেখেছে রিভলভার হাতে আড়াল থেকে ওকে কভার দেয়ার জন্য। পুলিসকে খবর না দিলেও অন্য পার্টিও তো আঁচ করতে পারে! আজকাল এসব কারবারে নিয়ম রীতি বলে কিছু নেই। চুরির ওপর বাটপারি হরদম লেগেই আছে। ন্যাটা মজনুর পেট পাতলা, কথা হজম করতে পারে না। আরেক পার্টির কাছে হয়তো গল্প করতে পারে কাউলার ওস্তাদ পাঁচ হাজার টাকায় এক রাতের জন্য মাইক্রোবাস ভাড়া করেছে। আর কিছু বলতে হবে না। এতেই পেছনে ফেউ লেগে যাবে।

খুব সাবধানে চোখ কান খোলা রেখে টেকো গুন্ডা কালো ব্যাগটার কাছে এলো। আগের রাতে এসে ও রেকি করে গেছে। রমনা পার্কের এদিকটায় আলোর ছিটেফোঁটা নেই। সাধারণ লোক এই অন্ধকারে ঢুকতেই সাহস পাবে না। টেকোর ওস্তাদ বলতো ওর চোখ নাকি পঁাচার মতো, অমাবস্যার অন্ধকারে রাস্তা থেকে আলপিন কুড়িয়ে নিতে পারে। ওর চলাফেরাও বেড়ালের মতো, এক রত্তি শব্দ হয় না।

টর্চ একটা হাতের পাঁচ রাখতে হয়। টেকো আর ওটা জ্বালালো না। ব্যাগের ওপর হাত দিয়েই ও বুঝে ফেলেছে নোটের বান্ডিল। টাকা যখন এনেছে না গুণেই টেকো বলে দিতে পারে পুরো দশ লাখই আছে। ব্যাগটা বগলদাবা করে বনবেড়ালের মতো দ্রুত গতিতে ও পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো।

কালোর চোখে টেকোর মতো ধার নেই। ও শুনেছে পর পর দুবার প্যাচা ডেকেছে। যা বোঝার ও বুঝে নিয়ে আর কোনও দিকে তাকালো না। এক দৌড়ে ও মাইক্রোবাসের কাছে চলে এলো।

টেকো ততক্ষণে ড্রাইভিং সিটে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়েছে। কালো উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে সত্তর মাইল স্পিডে গাড়ি চালালো। রাতের এই সময়ে রাস্তা ঘাট ফাঁকা থাকে। গাড়িওয়ালাদেরও ঘরে ফেরার তাড়া থাকে। লিমিট ভেঙে বেশি জোরে চালালেও পুলিস খুব একটা গা করে না। ওদের নজর থাকে ট্রাকের দিকে। দূর পাল্লারট্রাক রাত বারোটার আগে শহরে ঢুকলেই পুলিস ওদের ধরবে। নিজের নিখুঁত পরিকল্পনার সাফল্যে নিজেই হা হা করে হাসলো টেকো। বললো, তুই তো পাতলা খান লেনের জণ্ড উস্তাদের লগে কাম করছস। এমন ফাইন কাম আগে দ্যাখছস কাউলা?

না উস্তাদ। গদ গদ হয়ে কালো বললো, তুমার বেরেনের লগে জগু উস্তাদ ক্যা, কলুটোলার দিলবর উস্তাদ বি কিছু না।

টেকো ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি গতকালই শহরের সব কটা কার্ড ফোন বুথে ডিআইজি সেলিম তরফদার গোয়েন্দা বসিয়ে দিয়েছিলেন। টেকো প্রত্যেকবারই কার্ড টেলিফোন ব্যবহার করেছে আর যে সব বুথেই গেছে যেগুলোর আশে পাশে উর্দিপরা পুলিস নেই। ও কীভাবে জানবে, ফকির, কলাওয়ালা, ঝাড়ুদারনি–যারা ওর নজর এড়িয়ে গেছে ওরা সবাই ছিলো পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের! দুপুরের ভেতর সেলিম তরফদারের জানা হয়ে গেছে টেকো আর কালোর যাবতীয় গতিবিধি। তিনি এই দুজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে জানার অপেক্ষা করছিলেন দলে আর কেউ আছে কিনা। সেজন্য তাঁর দলবল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন টেকো কালোর কলতাবাজারের ডেরার চারপাশে।

রমনা পার্ক থেকে কলতাবাজার আসতে টেকোর দশ মিনিট সময় লাগলো। রেড সিগন্যালে থামতে না হলে আরও আগে আসতে পারতো। জোরে চালালেও শহরের ভেতর ট্রাফিক আইন ভাঙা চলবে না–এ শিক্ষা ওর আছে। অকারণে কারো মনে সন্দেহ জাগানোর কোনো মানে হয় না।

কলতাবাজারের চালের গুদামের পাশে মাইক্রোবাস থামিয়ে টাকার ব্যাগ বগলে নিয়ে টেকো আর কালো যখন ওদের ডেরায় এসে ঢুকলো তখনও কিছু টের পায়নি। ডিআইজির ফোর্স হিসেবে যারা এসেছে তারা সবাই ছিলো প্লেন ড্রেস-এ, তাও আড়ালে আবডালে। আসার সময় টেকো শুধু লক্ষ্য করেছে কোনো গাড়ি ওদের অনুসরণ করে কিনা। এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হলে ও কলতাবাজার আসতো না।

ঘরে ঢুকে টাকার ব্যাগটা আগে স্টিলের আলমারিতে তুলে রাখলো টেকো গুন্ডা। কালোকে বললো, আইজ বিলাতি বাইর কর! বিলাতি খামু। হা হা হা!

কালো কাচুমাচু করে বললো, উস্তাদ, গুইনা দেখবা না ঠিক মতো ট্যাকা দিছে কি না।

আরে ব্যাক্কল! না দিলে অর পোলা মাইয়া আস্ত থাকবো! জানে মাইরা ফালামু না?

কালো তবু আবদার করলো আমারে একবার দেখবার দ্যাও উস্তাদ। বাপের জমে এক লগে দস লাখ টাকা দেখি নাই ক্যা।

চাবিটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিলে টেকো–যা দ্যাখ গা! তরে লয়া আর পারি না। এই বলে ও নিজেই তাক থেকে বিলেতি মদ আর অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস নামালো।

কালো লোহার আলমারির তালা খুলছে আর টেকো পুরো এক গ্লাস মদ ঢক ঢক গলায় ঢেলেছে, ঠিক তখনই ঘরের ভেতর যেন বোমা ফাটলো–যেভাবে আছো ঠিক সেভাবে থাকো। নড়াচড়া করলে মাথার খুলি উড়ে যাবে।

কোতোয়ালি থানার দারোগা রহিম বক্স পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকলেন। তার সঙ্গে রাইফেল ধারী জনা চারেক পুলিসও ভেতরে ঢুকলো।

টেকোর গ্লাস ধরা হাতেই হাতকড়া পরালেন দারোগা। কালোকেও একই সঙ্গে হাতকরা পরানো হলো। কালো ফিশ ফিশ করে শুধু বললো, উস্তাদ!

টেকো তিক্ত হেসে বললো, খেল খতম। ওর মাথা তখন ঝিম ঝিম করছিলো।

ওদের দুজনকে প্রথমে কোতোয়ালি থানায় আনা হলো। ডিআইজি সেলিম সেখানে বনি বিনির বাবা আর অমল কাকুকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। টেকো আর কালোকে ডিআইজির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দারোগা বললেন, দুটোই দাগী আসামী স্যার।

আগে বেশ কয়েকবার হাজত খেটেছে।

ডিআইজি ঠান্ডা গলায় বললেন, আর হাজত খাটার কষ্ট দেবো না ওদের। বনি বিনিকে কিডন্যাপ করার জন্য ফাঁসির দড়ি তৈরি হচ্ছে।

কালো গুন্ডা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো–হুজুর মা বাপ! আমগো কুন দুস নাই। মগবাজারের হুজুরে তিরিশ হাজার টাকা দিছে।

বনি বিনি এখন কোথায়?

কালো ওর ওস্তাদের দিকে তাকালো। ডিআইজিকে থানায় উপস্থিত দেখেই টেকো বুঝে ফেলেছে কেস খারাপ। ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও চেহারায় একটা শক্তভাব এনে দাঁড়িয়েছিলো ও। কালো ওর দিকে তাকাতেই পেটের ভেতর দারোগার রুলের গুঁতো খেয়ে আঁক করে উঠলো। দারোগা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, হারামজাদা, ভালো চাস তো কথার ঠিক ঠিক জবাব দে!

রুলের একগুঁতো খেয়েই কালো গড় গড় করে সব বলে ফেললো। কীভাবে আবদুল মালেক ওদের ভাড়া করেছিলো, পাহাড়তলীর কোন বাড়িতে বনি বিনিকে রেখে এসেছে, টেকো কীভাবে দশ লাখ টাকা হাতাবার প্ল্যান করেছে–কিছুই বলতে বাকি রাখলো না।

টেকো কালোকে লক আপ-এ ঢুকিয়ে ডিআইজি সেলিম তখনই ফোন করলেন চট্টগ্রামের এসপিকে। এসপি বললেন, স্যার, আমি এক্ষুণি পাহাড়তলীর বাড়ি রেইডের ব্যবস্থা করছি।

বনি বিনির বাবা আশা করছিলেন চট্টগ্রামের এসপি পাহাড়তলীর বাড়ি থেকে ওদের উদ্ধার করবেন। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি সিগারেট ধরালেন। অমল কাকুকে বললেন, বনিদের খবর পেলে আমি আজ রাতেই চিটাগাং যাবো।

অমল কাকা বললেন, তুই একা যাবি কেন? আমিও যাবো তোর সঙ্গে।

আধঘন্টা পরই চট্টগ্রামের এসপি ফোন করলেন। পাহাড়তলীর বাড়ি বাইরে থেকে তালা দেয়া। পাশের বাড়ির লোকজন বললো, এ মাসেই নাকি আঞ্জুমনের বাবা মা ও বাড়িটা ভাড়া করেছিলো। বিকেলে ওরা তালা বন্ধ করে গ্রামের বাড়ি গেছে, দুদিন পর ফিরবে। দুটো ছোট ছেলেমেয়েকে পাশের বাড়ির এক বুয়া দেখেছে সকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিতে। নাকি আঞ্জুমনের খালাতো ভাইবোন।

ডিআইজি বললেন, হাসপাতাল-টাতাল বাজে কথা। চিটাগং আর আশে পাশে ওদের সবগুলো আস্তানা রেইড করুন। সকালে আমাকে ফোন করবেন।

বাবা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ওদের সত্যি সত্যিই তো কোনো অসুখ করতে পারে! হাসপাতালগুলোতে দেখলে হয় না?

ডিআইজি গম্ভীর হয়ে বললেন, কাজটা করিয়েছে আবদুল মালেক। বুঝতে পারছিস না এটা একটা পলিটিক্যাল ব্যাপার! চট্টগ্রাম ওদের ঘাঁটি। কম্বিং অপারেশন চালালেই বেরিয়ে পড়বে বনিদের কোথায় লুকিয়েছে।

আমি কি চট্টগ্রাম যাবো?

নরম গলায় বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বললেন, এখন গিয়ে কী করবি? বাড়ি ফিরে যা। বনি বিনির মার কাছে থাক। খবর পেলেই তোকে জানাবো।

বনি বিনির জন্য বাবার বুকের ভেতর সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো। রাত এখন বারোটা। কে জানে কোথায় কিভাবে ওদের রেখেছে শয়তানরা! অমল কাকু ওঁর বন্ধুকে ধরে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।

ঠিক তখনই জ্ঞান ফিরেছিলো বিনির। ওর মনে হলো লম্বা একটা ঘুম দিয়েছে সে। মাঝখানে অল্পক্ষণের জন্য ঘুম ভেঙেছিলো। অন্ধকার দেখে ভেবেছে ভোর হয়নি, তাই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন বুঝতে পারেনি ও যে বাড়িতে নেই।

জ্ঞান ফেরার পর প্রথমে মনে হলো ওর বিছানাটা সামান্য দুলছে। চোখে মেলে তাকিয়ে দেখলো, বিছানা কোথায়? কাঠের মেঝের ওপর পড়ে আছে ও। হাত দিয়ে চোখ কচলাতে যাবে, তখন টের পেলো ওর হাত দুটো বাঁধা। অবাক হয়ে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো ওর আর বনির মতো আরও কয়েকটা ছেলেমেয়ে, সবার হাত বাঁধা, মেঝের ওপর অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

ধীরে ধীরে ওর সব মনে পড়লো। মেলা থেকে দাড়িওয়ালা শয়তান আর দুটো গুন্ডা কীভাবে ওদের ধরে এনেছে, কীভাবে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর বাড়িতে এসেছে, সেখানে কী দেখেছে–সবই ওর মনে পড়লো। শুধু বুঝতে পারলো না এখানে কীভাবে এলো। পাহাড়তলীর বাড়িতে সকালে এক ডাক্তার এসে বনি আর ওকে দুটো ইনজেকশন দিয়েছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

বিনি চারপাশে তাকিয়ে ব্যাকুল হয়ে বনিকে খুঁজলো। ঘরের ভেতর কম পাওয়ারের আলো ছিলো। প্রথমে সব আবছা আবছা মনে হলো। শোয়া থেকে অতি কষ্টে উঠে বসলো বিনি। বার কয়েক চোখ বন্ধ করলো আর খুললো। এবার কিছুটা পরিষ্কার হলো ঘরের ভেতরটা। চারদিকে কোনও জানালা নেই, শুধু দুটো দরজা। ঘরের ছাদটাও খুব নিচু।

এক কোণে কাঠের দেয়াল ঘেঁষে পড়েছিলো বনি। তখনও ওর জ্ঞান ফেরেনি। বিনি এবার উঠে দাঁড়ালো। স্কুলে সব সময় স্পোর্টস-এ ও দু তিনটা মেডেল পায়। বনির চেয়ে ওর গড়ন বেশ শক্ত। সাবধানে পা ফেলে ও বনির পাশে গিয়ে বসলো। অন্য সবার মতো বনিরও হাত পা বাঁধা। ওর পাশে বসে বিনি আস্তে আস্তে ডাকলো বনি, বনি, ভাইয়া ওঠ।

কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালো বনি। বিনির মতো সেও প্রথম বুঝতে পারলো না। কোথায় আছে। বললো, আমরা এখন কোথায়?

হালকা ইঞ্জিনের শব্দ বিনি আগেই শুনেছে। বললো, আমার মনে হচ্ছে এটা কোনো জাহাজ হবে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আমরা যাচ্ছি না। আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।

বনি উঠে বসলো। ততক্ষণে অন্য ছেলে মেয়েরাও উঠে বসেছে। বনির চেয়ে ছোট একটা মেয়ে কান্না জুড়ে দিলো। বনি বললো, আপু, এরা কারা?

বিনি বললো, আমাদের মতো ওদেরও গুন্ডারা ধরে এনেছে।

বিনির বয়সী একটা মেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার বাড়ি কোথায়?

ঢাকার বনানীতে। বলে পাল্টা প্রশ্ন করলো বিনি–তোমার?

আমাদের বাড়ি চট্টগ্রাম। আমার বাবা ইউনিভার্সিটি প্রফেসর।

আরো যেসব মেয়ে ছিলো ওরা কাছাকাছি সরে এলো। ওদের কারও বাড়ি ঢাকা, কারো রাজশাহী, কারো খুলনা। ওরা বললো কাকে কীভাবে ধরে এনেছে। ওদের বলার সময় বিনি খেয়াল করলো, সব জায়গাতেই কোনো না কোনো দাড়িওয়ালা শয়তান ছিলো।

সালোয়ার কামিজ পরা তানিয়া বললো, আমি শুনেছি, দাড়িওয়ালা শয়তানটা আমাদের বিক্রি করে দিয়েছে।

বিনি জানতে চাইলো, কাদের কাছে বিক্রি করেছে?

আমাদের যে বাড়িতে রেখেছিলো সেখানে আরবদের মতো পোশাক পরা এক লোক এসে আরবি ভাষায় কী যেন বলাবলি করছিলো।

চুলে পনি টেল বাঁধা নার্গিস বললো, দাড়িওয়ালা একটা বদমাশ আমাকে বলেছে তোর বাবা যেমন আমাদের পেছনে লেগেছে, এবার তার ফল ভোগ করবে।

দরজার বাইরে ঘটাং করে শব্দ হলো। একটু পরে প্যান্ট শার্ট পরা মুখে কালো চাপদাড়ি, চোখে কালো চশমা পরা এক লোক ঘরে ঢুকলো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফ্যাশফ্যাশে গলায় বললো, বাহ্, সবার ঘুম ভেঙে গেছে দেখি। শোন সবাই, আমি জানি তোমরা সবাই ভালো ছেলে মেয়ে। তোমরা এখন জাহাজে করে মাশকাত যাবে। সবাই যদি কথা দাও ভালো হয়ে থাকবে, তোমাদের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হবে, ভালো খেতে দেয়া হবে, ভালো ব্যবহার পাবে। আর যদি শয়তানি করো তার উল্টোটা পাবে। এখন বলো কী তোমাদের ইচ্ছা?

বয়সে সবার বড় নার্গিস বললো, আমরা ভালো হয়ে থাকবো।

এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। একটু পরে তোমাদের হাতের বাঁধন খুলে খাবার দেয়া হবে। পালাবার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। এখন আমরা আছি ভারত মহাসাগরে। যদি সাগরে ঝাঁপ দাও তীরে ওঠার জন্য তোমাদের অন্ততপক্ষে সত্তর আশি মাইল সাঁতরাতে হবে। অবশ্য এর অনেক আগেই তোমরা হাঙ্গরের পেটে হজম হয়ে যাবে। হা হা হা। লোকটার হাসি শুনে মনে হলো যেন দারুণ একটা মজার কথা বলেছে ও।

তো এই কথা থাকলে তোমাদের সঙ্গে। এই বলে লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ওদের সবার চেহারা মলিন হয়ে গেলো অনিশ্চিত গন্তব্যের কথা ভেবে। একটা ছোট মেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

.

০৬.

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আবদুল মালেকদের দলের যতগুলো ঘাঁটি ছিলো সবগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বনি বিনির কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না। ঢাকা থেকে আবদুল মালেকও কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পাহাড়তলীর যে বাড়িতে বনি বিনিকে রাখা হয়েছিলো তাদের প্রতিবেশীদের বর্ণনা থেকে আঞ্জুমনের মুটকি মা আর শুটকো বাপকেও অনেক খোঁজা হলো–কোথাও কারো চিহ্ন মাত্র নেই।

সাত দিন পর চট্টগ্রামের এসপি হাল ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় ডিআইজি সেলিম তরফদারকে জানালেন–ওরা চট্টগ্রামে নেই। হতে পারে অন্য কোনো শহরে, কিংবা দেশের বাইরেও পাচার করে দিতে পারে।

বনি বিনির মা বাবা এবার একেবারেই ভেঙে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার সোনা মানিকদের ওরা মেরে ফেলেনি তো?

ডিআইজি বললেন, আপনাদের এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। শক্ত হোন। আমার মনে হয় না ওদের মেরে ফেলবে। মেরে ওদের লাভ কী? বরং বাঁচিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়লে ওদের দিয়ে কোনো ব্যাপারে ওরা দর কষাকষি করতে পারবে। ওদের বাঁচিয়ে রাখলেই লাভ।

বেঁচেই যদি থাকে, পুলিস ওদের খুঁজে পাচ্ছে না কেন?

আমরা গত কদিন শুধু চট্টগ্রামেই খুঁজেছি। এখন অন্য জায়গায়ও খুঁজবো। আপনারা তো জানেন গত দশ দিনে বনি বিনিদের বয়সী নয়টা ছেলে মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে বিভিন্ন শহর থেকে।

বাবা জানতে চাইলেন, তোদের কী ধারণা বনি বিনিকে যারা চুরি করেছে অন্য বাচ্চাদেরও তারাই চুরি করেছে?

শুধু ধারণা নয়, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বিভিন্ন জায়গায় আবদুল মালেকদের দল যাঁদেরই মনে করেছে ওদের জন্য বিপদজনক, তাদের ওপরই হামলা করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আহমেদ জামালের মেয়েকে ওরা কিডন্যাপ করেছে। কারণ এদের মতো কয়েকজন প্রফেসরের জন্য ওরা এখনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি কজা করতে পারেনি।

ওরা এতটা নীচ! মাসুম বাচ্চাদের ওপর প্রতিহিংসা মেটাচ্ছে, এতটা অমানুষ ওরা?

তুই ওদের কাছে মানবিক কোনো কিছুই আশা করতে পারিস না। ভালো করেই জানিস একাত্তরে ওরা কী করেছিলো। তখন যা পারেনি ওরা এখন তাই করার প্ল্যান করেছে।

আমরা এখন কী করবো?

যা করার আমরা করছি। পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি ছাপা হতে থাকুক।

বনি, বিনি, নার্গিস, তানিয়া সহ নয় জন ছেলে মেয়ের নামে গত ছ দিন ধরে অনেকগুলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে। পুলিসের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে যাকে যেখান থেকে চুরি করুক না কেন ওদের শেষ দেখা গেছে চট্টগ্রামে। পুলিস খুঁজে না পেলেও বনি বিনির বাবার এটা বদ্ধমূল ধারণা যে, তাদের ছেলেমেয়েরা চট্টগ্রামেই আছে। হয়তো ওদের হিলট্র্যাক্টের কোনো গুহায় আটকে রেখেছে। কিংবা কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম শহরের কোনো বাড়ির মাটির নিচের ঘরে! ওরা সব পারে।

টেকো আর কালোকে হাজতে পাঠানো হয়েছে। ওদের অনেক পিটিয়েও জানা যায়নি আবদুল মালেকের সঙ্গে আর কেউ ছিলো কি না, কিংবা পাহাড়তলীর বাড়ির লোকদের চেনে কি না। ওরা পুলিসকে যতটুকু বলেছে তার বেশি ওরা জানতো না। আবদুল মালেকদের দল এদিক থেকে খুব হুঁশিয়ার।

দু দিন পর কী মনে করে ডিআইজি সেলিম টেকো আর কালোকে জামিনে ছেড়ে দিতে বললেন। টেকোরা খুবই অবাক হলো প্রথমে। তারপর ভেবে দেখলো মামলা চলবে, ওরা পালিয়েও যাচ্ছে না, জামিন ওদের পাওয়াই উচিৎ। জেল থেকে বেরোবার আগে ডিআইজি সেলিম নিজে ওঁকে বলেছেন আবদুল মালেকের যদি কোনো খবর পায় তাঁকে যেন সঙ্গে সঙ্গে জানায়, তাহলে পুলিস ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেবে। এ ব্যবস্থা টেকোর খুব পছন্দ হয়েছে। কালোকে বলেছে চোখ কান খোলা রাখতে। ঢাকায় থাকলে আবদুল মালেক বেশিদিন ওদের নজর এড়িয়ে থাকতে পারবে না।

ডিআইজি সেলিম সামান্য প্রমাণের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছেন। আবদুল মালেককে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত তিনি প্রমাণ করতে পারছেন না এটা যে ওদের দলের কাজ। নয়টা বাচ্চা কোথায় কীভাবে আছে এটা জানার জন্যেও আবদুল মালেককে দরকার। অনেক ভেবে চিন্তেই তিনি টেকো আর কালোকে ছেড়েছেন।

টেকোরা জেল থেকে বেরিয়ে আগের জীবনে ফিরে গেছে। আধ ডজন গোয়েন্দা ছদ্মবেশে ওদের ওপর নজর রেখেছিলো। ওদের চোখের সামনে টেকোরা ছোট খাট চুরি চামারি করেই যাচ্ছিলো। ডিআইজি তাঁর গোয়েন্দা বাহিনীকে বলে রেখেছেন এগুলো উপেক্ষা করতে ।

যে নজন ছেলেমেয়েকে জাহাজে করে মাশকাত নেয়া হচ্ছিলো এ কদিনে ওদের ভেতর ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। জাহাজের নিচের তলায় মোটা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় ওরা চলাফেরার অনুমতি পেয়েছিলো। কারণ নার্গিসের কথা মতো ওরা সবাই ঠিক করেছিলো এদের কথার অবাধ্য হবে না।

জাহাজে ওঠার পর থেকে বনি বিনিরা এদের কাছে থেকে ভালো ব্যবহারই পাচ্ছিলো। এরা শুধু বিরক্ত হয় তখন, যদি কেউ জানতে চায় মাশকাত নিয়ে ওদের কী করা হবে। এক দিন তানিয়া খুব আদুরে গলায় ওদের তদারককারী লোকটাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, চাচু, বলুন না মাশকাত নিয়ে আমাদের কী করবেন?

খোশ মেজাজেই ছিলো লোকটা। তানিয়ার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে বলেছে, মালিক জানেন তোমাদের কী করা হবে। আমরা গোলাম। আমাদের কাজ হচ্ছে হুকুম তামিল করা। এসব কথা আমাকে কক্ষণো জিজ্ঞেস করবে না। আমরা মালিকের গোলামরা নিমকহারামি করতে পারবো না।

বোম্বে, করাচী হয়ে জাহাজ যেদিন মাশকাত পৌঁছবে সেদিন সকাল থেকে বনি বিনিরা উত্তেজিত ছিলো। ভয়ও কম ছিলো না। ভোর বেলা নাশতা খাওয়ার পর ওদের ঘরে সবাইকে নিয়ে মিটিঙে বসলো বিনি। বললো, আমরা এখনো জানতে পারিনি মাশকাত নিয়ে আমাদের কী করবে। তোমাদের নিজেদের কী মনে হয়? ওরা আমাদের নিয়ে কী করতে পারে?

নার্গিস বললো, আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম, ইউরোপ আমেরিকায় যে সব বড় লোকের ছেলে মেয়ে নেই তারা গরিব দেশের ছেলে মেয়েদের নিয়ে যায় পুষবার জন্য।

তানিয়া বললো, ওরা নেয় এতিমখানার বাচ্চাদের, যাদের বাবা মা নেই তাদের।

যারা আমাদের বিক্রি করবে তারা বলবে আমরা এতিম।

তানিয়া একটু ভেবে বললো, হ্যাঁ এরকম হতে পারে। এরকম যদি হয় বিক্রির সময় আমরা কোনো কথা বলবো না। যারা আমাদের কিনবেন তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখবো কেমন লোক তারা। যদি ভালো লোক হয় তাহলে ওঁদের বলবো বাংলাদেশে আমাদের বাবা মা সবাই আছে। এরা আমাদের চুরি করে এনেছে। শুনলে তাঁদের নিশ্চয়ই দয়া হবে।

বনি বললো, ওরা যদি খারাপ লোক হয়?

তাহলে আমরা প্রথমে ওঁদের কাছে ভালো হয়ে থাকবো। যা বলে তাই করবো। সুযোগ মতো পালিয়ে পুলিসকে গিয়ে বলবো। আমরা সবাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারি।

নার্গিস বললো, শুনেছি আরবরা বেশির ভাগ অশিক্ষিত। ওরা যদি ইংরেজি না বোঝে?

বিনি বললো, আমি আমাদের হুজুরের কাছে কিছু কিছু আরবি বলা শিখেছি।

তানিয়া উত্তেজিত গলায় বললো, সত্যি বলছো বিনি?

বনি বললো, হ্যাঁ, তানিয়া আপু! বিনি আপু হুজুরের সঙ্গে আরবিতে কথা বলে।

বাহ! বলতো বিনি এ কথাটা আরবিতে কী হবে–আমার নাম তানিয়া?

বিনি লজ্জা পাওয়া গলায় বললো, ইস মী তানিয়া।

আমি বাংলাদেশে থাকি আরবিতে কী হবে?

আনা আসকুনু ফিল বাংলাদেশ।

দারুণ! এবার বলো–আমি বিপদে পড়েছি।

এ কথা আরবিতে কী ভাবে বলবো?

আনা ফি মাশকিলাত।

আমাকে সাহায্য করুন?

উন সুর নী।

আমি একজন ইংরেজি জানা লোক খুঁজছি?

বিনি একটু ভেবে বললো, আনা তালাবতু রাজুলান মাহেরুন ফিল আংকেলিজিয়া।

ব্যস, ব্যস! এতেই হবে। তানিয়া ছুটে এসে বিনিকে জড়িয়ে ধরলো–এর বেশি শেখার দরকার নেই। আমরা সবাই এই কথাগুলো মুখস্ত করে ফেলবো। যে কোনো পুলিসকে এই কথাগুলো বলতে পারলেই আমরা ইংরেজি জানা লোকের খোঁজ পেয়ে যাবো।

বিনি বললো, নার্গিস কথা মতো আমরা কি ধরে নিচ্ছি আমাদের এমন বাপ মাদের কাছে বিক্রি করবে যাদের ছেলে মেয়ে নেই?

তানিয়া চিন্তিত গলায় বললো, না, আমরা তা ধরে নিচ্ছি না। অন্য কিছুও ঘটতে পারে। তোমার কী মনে হয়?

আমি একটা হিন্দি ছবিতে দেখেছিলাম কম বয়সী মেয়েদের বাইজিদের কাছে বিক্রি করে দিতে। বাইজিরা ওদের নাচ গান শিখিয়ে পয়সা রোজগারের জন্য আসর বসায়।

তানিয়া বললো, আরব দেশে বাইজি কোথায়? বাইজি তো সব ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানে!

অন্য দেশেও বাইজি থাকতে পারে।

তা না হয় থাকলো। ছেলেদের নিয়ে বাইজিরা কী করবে? হাত পা ভেঙে ফকির বানিয়ে দিতে পারে।

আমাদের দেশে ছাড়া অন্য কোথাও আজকাল ফকির দেখা যায় না। এ কথাটা তানিয়া ওর বাবার কাছে শুনেছে।

খুলনার রুবেল বললো, বাবা একবার টেলিভিশনে সার্কাস শো দেখে বলেছিলেন, সার্কাসের লোকরা নাকি নানা দেশ থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে চুরি করে ওদের দিয়ে খেলা দেখায়।

তানিয়া মাথা নাড়লো–আমার তা মনে হয় না। সার্কাসের লোকরা চুরি করেই ছেলেমেয়ে জোগাড় করতে পারে, আমাদের পয়সা খরচ করে কিনতে যাবে কেন?

বিনি বললো, আমরা এত কিছু ভাবছি কেন? যাদের কাছেই আমাদের বিক্রি করুক, আমাদের কাজ হবে পালিয়ে আসা। একজনও যদি পালাতে পারি—অন্যদের উদ্ধার করতে পারবো।

নার্গিস বললো, আমাদের যদি এক জায়গায় না রাখে? জানবো কী ভাবে কে কোথায় আছে?

তানিয়া বললো, জাহাজ থেকে নামার পর লক্ষ্য রাখবে আমাদের কোনদিকে নেয়া হচ্ছে। রাস্তার সাইন বোর্ড থেকে যদি নাম পড়তে পারো ভালো। নাহলে যেখানে নিয়ে তুলবে তার চারপাশটা ভালোভাবে খেয়াল করবে। সুযোগ পেলেই পুলিসের সঙ্গে কথা বলবে। যে কোনো ভাবে আমাদের পুলিস স্টেশনে পৌঁছতেই হবে।

দুপুরের দিকে জাহাজ মাশকাত বন্দরে ভিড়লো। এটা ছিলো মাল টানা জাহাজ, কোনো যাত্রী ছিলো না এতে। সরাসরি জেটিতে নোঙ্গর করলো না। বিনিরা পুরু কাঁচ ঢাকা ছোট গোল জানালা দিয়ে দূরে বন্দরে ভেড়া ছোট বড় জাহাজ, উঁচু উঁচু ক্রেন আর লোকজন দেখতে পাচ্ছিলো।

ঘন্টা খানেক পর তদারককারী লোকটা এসে ঘরে ঢুকলো। বললো, তোমরা এখন একটা স্পীড বোটে উঠবে। তোমাদের হাত মুখ কিছুই বাঁধবো না। কিন্তু প্রত্যেকের সঙ্গে দুজন করে পাহারাদার থাকবে। ওদের পিস্তলে সাইলেন্সর লাগানো। গুলি করলে এতটুকু শব্দ হবে না। এটুকু বলে লোকটা বড় ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকালো। গলাটা এক ধাপ নামিয়ে বললো, তোমাদের কারো কারো মাথায় পালাবার চিন্তা থাকতে পারে। আমি তোমাদের শুধু এটুকু বলবো, বেঁচে থাকাটা এখনকার জন্য বেশি জরুরী। শেখের লোকদের প্রাণে দয়ামায়া কিছু নেই। বেতাল দেখলেই জানে মেরে ফেলবে। যদি প্রাণে বেঁচে থাকো পরে পালাবার সুযোগ পেতেও পারো। এখন কোনো রকম সুযোগই নেই। এই বন্দরের পুলিসরাও শেখের পোষা চাকর।

লোকটা চলে যাবার একটু পরই আরবদের পোশাক পরা দুজন লোক ঘরে ঢুকলো। ওদের চোখে কালো চশমা, থুতনিতে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, কর্কশ গলায় বাংলায় বললো, সবাই এক এক করে স্পিড বোটে ওঠো। হাঙ্গর আর পিয়ানহার খাবার হতে না চাইলে চুপচাপ বোটে বসে থাকবে।

বিনি এগিয়ে এসে বনির হাত ধারলো। ছোট ভাইটাকে ও কোনো অবস্থায় হারাতে চায় না। কালো চশমার কথায় বনি খুব ঘাবড়ে গেছে। ও নিজেও শক্ত করে বিনির হাত আঁকড়ে ধরলো।

স্পিড বোট নটা ছেলে মেয়েকে নিয়ে বন্দরের উত্তর দিকে একটু ফাঁকা জায়গায় ভিড়লো। ওদের পাহারা দেয়ার জন্য ন জন লোক দাঁড়িয়েছিলো বোটের দুই কিনারে।

মাশকাত বন্দরের মাটিতে পা রাখতেই বিনির বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় মাশকাত! ওর চোখ দুটো কান্নায় ভিজে এলো। যে লোকটা ওর পাশে পাশে হাঁটছিলো বিনির চোখের পানি দেখে ও চাপা গলায় বললো, খবরদার কান্নাকাটি করবে না। হাতে ছুরি আছে। এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবো।

বিনি চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। বন্দরের জেটি পেরোতেই সাদা দাড়িওয়ালা এক বাঙালি এসে কালো চশমাকে নিচু গলায় বললো, ছেলে আলাদা, মেয়ে আলাদা।

কালো চশমা বিনির হাত থেকে বনিকে টেনে নিতেই ও বললো, না, বনি আমার কাছে থাকবে। বনিও বিনির দিকে এক হাত বাড়িয়ে কান্না ভেজা গলায় বললো, আপু, আমাকে ফেলে যাস না। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। বলতে বলতে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো বনি।

সঙ্গে সঙ্গে বিনি আর বনির পাঁজরে দুজন আরব এসে ছুরি ঠেকালো। কালো চশমা বললো, আর একটা কথা বললে এখানেই শেষ করে ফেলবো।

বিনি আর বনি কোনও কথা বললো না। বনি বার বার ঘুরে ঘুরে বিনিকে দেখছিলো। কালো টুপি পরা একটা লোক কালো চশমাকে বললো, এই গাড়ি।

বিনিকে ঠেলে মস্ত বড় মার্সেডিজ-এর পেছনের সিটে তুললো। ওরা দুজন ওর পাশে বসলো। গাড়ির যে ড্রাইভার সেও কালো চশমা পরা। কালো টুপি ওকে বললো, হুজুরের মহলে চলো।

বনিকে হারিয়ে বিনির বাবা মার কথা মনে হলো। ওরা যত বারণ করুক কিছুতেই ও কান্না সামলাতে পারলো না। বনি, ভাইয়া! বলে আর্ত চিৎকার করে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো বিনি।

গাড়ি তখন প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো শহরতলীর দিকে।